ঢাকা কিসসা
কোন শহরের নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি ধৈর্য্য? সর্বাধিক ধৈর্য্যের উপর অলিম্পিকে একটা প্রতিযোগিতা থাকলে; স্বর্ণ পদক নির্ঘাত ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের জুটতো। সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে এসে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। উত্তরা থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দূরত্ব বেশি হলে সাড়ে পাঁচ মাইল (৯ কিলোমিটার)। গাড়িতে চড়ে যেতে লেগে গেল পাক্কা শোয়া দু ঘণ্টা। শক্তি, সামর্থ্য ও উপায় থাকলে দৌড়ে আরও অল্প সময়ে সেখানে পৌঁছান সম্ভব। বর্তমানে ঢাকা শহরে এমন কোনো রাস্তা সম্ভবত নাই যেখানে কিছু দূর পর পর পাগলা ফকিরের চুলের জটের থেকে জটিল জ্যাম হয় না। সেগুলো পার হয়ে আসতে সময় তো লাগারই কথা। কিন্তু এই ধরণের অবিশ্বাস্য পরিমাণ জীবনায়ুর অপচয়?
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এ নিয়ে নগরবাসীর তেমন অভিযোগ নাই। জ্যামে পড়লেই ঢাকাবাসীর ধৈর্য্য প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যায়। স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করতে দিনের অর্ধেক পার হয়ে গেলেও, হাসি মুখে তারা গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে। তাদেরকে ধৈর্যের কাছে এই চ্যালেঞ্জ নগণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইবার আপনারাই বলুন এ রকম প্রফুল্ল নাগরিকরা ধৈর্য্য প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক পাবে না তো কে পাবে?
বহু বছর ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের আনা নেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস সার্ভিস চালু আছে। আশির দশকে বাস বনানী বাজার পর্যন্ত আসতো। এর পর জনবসতি তেমন ছিল না। সময়ের সাথে সাথে মানুষের আবাস বাড়তে লাগল। বাসের রুট সম্প্রসারিত হতে থাকল। স্টাফ রোড, খিলখেত, বিমান বন্দর, উত্তরার আজমপুর পর্যন্ত আসল। নব্বুই সালে যখন দেশ ছাড়ি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস টুঙ্গি পর্যন্ত যাচ্ছিল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাকা শহর যে বেড়েই চলেছে সেটা বুঝানোর জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস সার্ভিসের ফিরিস্তি দিলাম। আশির দশকে উত্তরা ছিল নিরিবিলি ফাঁকা জনপদ। ঢাকার বাসিন্দারা মনে করতো উত্তরা মেলা দূর। আর উত্তরা এখন এতোই জনবহুল এবং ব্যবসা, বাণিজ্য ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধায় সমৃদ্ধ ; যে উত্তরাবাসী বেশির ভাগ প্রয়োজনই এলাকার মধ্যেই সেরে ফেলতে পারে। সেটা স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাজার থেকে আরম্ভ করে কারো কারোর জন্যে চাকরি-বাকরি পর্যন্ত । আবার এলাকার মধ্যেই মানুষ ও যানবাহনে ভিড় এতোই বেড়েছে যে এলাকাতেই চলাচল করাটা বেশ কঠিন। রাজধানী ঢাকা শহরের প্রতিটি এলাকা মোটামুটি একই অগ্রিগতি। নগরের প্রতিটা অংশে এই বিশাল কলেবর সৃষ্টি করার কৃতিত্ব অবশ্যই এখানকার নাগরিকদেরই প্রাপ্য।
ঢাকা মহানগরীতে জীবনের একটা বড় সময় পার করেছি। এখানকার প্রত্যেকটা অর্জনে বুকের ছাতিটা ফুলে বায়ান্ন ইঞ্চি হয়। আবার প্রতিটা সমস্যা ও হুমকি অন্তরের অন্তঃস্থলে পীড়া দেয়। এইবার কয়েক বছর ব্যবধান দিয়ে দেশ থেকে ঘুরে আসলাম। বিদেশে থাকার কারণে প্রবাসীদের পাখির দৃষ্টি (birds view) সৃষ্টি হয়। সে জন্যে স্বদেশ সফরে গেলে দুটো ব্যাপার হয়। প্রথমে না চাইলেও ঢাকা শহরের যাই চোখে পড়ে; তার সাথে অবচেতন মন বিদেশে দেখা একই ধরণের জিনিষগুলোর সাথে তুলনা করে ফেলে । দ্বিতীয় বিষয়টা হলো সময়ের সাথে নগরের যে কাঠামোগত পরিবর্তনটা হয়েছে প্রবাসীদের চোখে সেটা বেশি করে ধরা দেয়। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনাবিল আনন্দ পাই। এই অনন্দ প্ৰিয় পাঠক বন্ধুদের সাথে আজকের এই লেখার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নিতে চাই।
এয়ারপোর্টের ঝক্কি ঝামেলা শেষ করে উত্তরায় বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। আমাদেরকে দেখার জন্যে আব্বা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। পোশাক পাল্টে গোসল করে জীবাণুমুক্ত না হয়ে তার কাছে যাওয়াটা ঠিক হতো না। সেজন্য বেচারাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখতে হলো। হাসি খুশি, প্রাণোচ্ছল, কর্মঠ মানুষটার জীবনটা এখন ভীষণভাবে সীমাবদ্ধ। বয়সের ভারে ন্যুব্জ বলা যায়। পা দুটো দুর্বল হয়ে গেছে। হাঁটতে গেলে প্রচণ্ড কষ্ট হয়; ভারসাম্য রাখতে পারেন না। শ্রবণ শক্তিও খুবই কম। তিনি কান্না দিয়ে আমাদের আগমনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। কষ্টে বুকটা ফেটে যেত চাইলো। বয়স জিনিসটা কি ভীষণ নির্মম! কিভাবেই না প্রাণ শক্তিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে।
এইবার কর্মতৎপর সদা হাস্যোজ্জল একজনের কথা বলি। আমার বড় ভাইয়ের বড় মেয়ে তিন্নু। আমাদের সবার চোখের মণি। একেবারে সংক্ষিপ্ত নোটিসে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করে বসল। সেটা আবার যে দিন আমরা ঢাকায় যেয়ে পৌঁছলাম; সেই সন্ধ্যাতেই। একদিন পর সে দেশের বাইরে যাচ্ছে তাই এই তাড়াহুড়া। দেশে যাবো তিন্নু আর ওর বাচ্চাদের সাথে দেখা হবে না, সেটাতো হতে পারে না। ওর বাসাতেই এইবারের সফরের প্রথম চাঁদের হাট মানে পারিবারিক রি ইউনিয়ন (reunion) হলো। তিন্নু যখন খাবার দাবার রান্না-বান্না করছিল, তখন তার এক বান্ধবী কল করে। কথা প্রসঙ্গে তিন্নু কি নিয়ে ব্যস্ত সেটা জানায় এবং বলে তার চাচা এখনও ঢাকায় পৌঁছায়নি কিন্তু বিমানে আছে। বান্ধবী অবাক হয়ে বলে, "তোমার চাচাও দেখি তোমার মতো হাইপার। এতো লম্বা রাস্তা পারি দিয়ে বিকালে এসে, সন্ধ্যায় দাওয়াতে আসার প্ল্যান করে রেখেছে।"
আসলেও হাইপার না হলে অল্প সময়ে ঢাকা শহরে বেশি কিছু করা সম্ভব না। শ্যালক কন্যা মাইশার বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। বাঙালিদের বিয়ে তো একদিনের ব্যাপার না। দু পক্ষের গায়ে হলুদ, মূল বিয়ের অনুষ্ঠান, বৌ ভাত মিলিয়ে মোটামুটি পুরো সপ্তাহ লেগে গেল। দেশ ছাড়ার পর এই প্রথম ঢাকায় কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকার সুযোগ হলো। দেখলাম প্রচুর রীতি, নীতি, নিয়ম কানুন চালু হয়েছে। বাঙালি এমনিতেই উৎসব ও আনন্দ প্ৰিয় জাতি। তার সাথে নতুন মাত্র যোগ হয়েছে। জাক জমক আয়োজনে মন জুড়িয়ে গেল। বাড়তি পাওনা হিসেবে পূর্ব পরিচিত কিছু মানুষের সাথে বহুদিন পর দেখা হলো। আবার নতুন অনেকের সাথেও পরিচিত হলাম। আমার নিকটের মানুষেরা জানেন বিদেশে থাকার জন্যে আমি বিয়ের অনুষ্ঠানে রান্না করা মুরগির রোস্ট কতো মিস করি! দুঃখটা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারলাম। 👏👏👏
সরকারি একটা অফিসে যেতে হয়েছিল। দেওয়ালে বড় করে লেখা, "এখানে কোনো দুর্নীতি হয় না।" মনটা ভরে উঠল; ধরেই নিলাম আমার কাজটা সহজেই হয়ে যাবে। কিন্তু না হতাশ হতে হলো। দু দিন পরে আসতে হবে। কারণ যার হাতে কাজ উনি অফিসে নাই; ট্রেনিং করতে গেছেন। ভাবলাম বড় সাহেবের সাথে কথা বললে যদি উপকার হয়। উনার অফিসের দরজায় বড় একটা তালা ঝুলতে দেখলাম। পরে আরেকদিন গেলাম। ভদ্রলোক আজকেও অফিসে নাই। অন্য কারো পক্ষে আমার অনুরোধ রাখা সম্ভব না। কাজ হবে না, কিন্তু অফিস চলবে ও জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে কর্মচারীরা বেতন পাবে; এইটা দুর্নীতি ছাড়া কিভাবে অন্য কিছু হয়? তৃতীয় দিন স্থানীয় একজনকে পাঠালাম। সে কাজটা ঠিকই করিয়ে নিয়ে আনল। বুঝলাম সরকারি দপ্তরে কর্ম উদ্ধারের সঠিক কৌশল আমার নাই।
লেখালেখি করার একটা বদ অভ্যাস আমার বহু দিনের। প্রায় বছরই বই মেলায় বই বের হয়। গত বছর আমার প্রকাশক বি ভি রঞ্জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। "শৈলী" সাহিত্য পত্রিকার তরুণ সম্পাদক নুরুল মোমেন ভীষণ একজন সাহিত্যানুরাগী মানুষ। আমাদের দীর্ঘ দিনের পরিচয় ও আন্তরিকতা। ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করি। সে ও তার স্ত্রী দুজনে মিলে ভবিষ্যতে প্রকাশনা শিল্পে আসার পরিকল্পনা করছে। নুরুল মোমেন মহা-উৎসাহ নিয়ে বলল, "আপনার লেখা বই দিয়ে আমাদের প্রকাশনার পথ চলা শুরু করতে চাই।" প্রচণ্ড খাটুনি করে সে বইটা আমার ঢাকায় অবস্থান কালে বের করল। শেষের দিকে তার স্ত্রী খুব অসুস্থ ছিল। কিন্তু তার পরেও সে একেবারে লেগে ছিল যে ঠিক সময় মতো যাতে বইটা প্রকাশিত হয়। এ রকম কিছু 'পাগল' আছে বলেই হয়তো সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলে। নুরুল মোমেন ও তার স্ত্রী মাসুমা মোমেনকে এতো বিশাল একটা কাজ করে দেওয়ার জন্যে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
লেখার প্রথমেই বলেছিলাম ঢাকার রাস্তায় চলা ফেরার বিড়ম্বনার কথা। দেশে গেলে চেনা জানা সবার সাথে দেখা করতে ইচ্ছা করে, তেমনি তারাও একই কারণে আমন্ত্রণ করে। কিন্তু ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম এর অন্তরায়। বিষয়টা মাথায় আগের থেকেই ছিল। ঢাকা সেনানিবাসে লেকের ধারে দারুণ সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট/ব্যাঙ্কুয়েট হল আছে, নাম ত্রিবেণী। সেখানে কয়েকজন কাছের মানুষকে কিছুটা সময় একসাথে কাটানোর জন্যে আমন্ত্রণ করেছিলাম। পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও উপস্থিত হয়েছিল ফেলা আসা সোনালি দিনের কাছের বন্ধুরা। এই আয়োজনকে রাঙিয়ে দিয়েছিল আমার 2022 একুশে বই মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত নতুন বই "স্বপ্নগুলো কুড়াই" 'র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান।📕📖📗
আমাদের সাথে স্বপ্ন কুড়াতে উপস্থিত ছিল এক সময়কার আবেগী বন্ধু রিজওয়ান আলম রিজু ও তার স্ত্রী ভীনা। এখনকার ডাক সাইটে সরকারী আমলা প্ৰিয় বান্ধবী নীলিমা আক্তার বাণী সপরিবারে এসেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রিয়জন আজাদ, নিশুকা, নীরু, লিটন, লাবু, জাহাঙ্গীর, মাসুদ, জিয়া (বাবলু), টিনা ওই দিনের কঠিন জ্যামকে উপেক্ষা করে আড্ডা ও হাসিতে প্রাণবন্ত করে রেখেছিল পুরোটা সময়। আমার নটরডেম কলেজের শ্রেণী সখা ও দীর্ঘ দিনের বন্ধু রওনক যোগ দিয়েছিল। সে নিশ্চিত করেছিলাম পাখি (ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ও টিনার বেটার হাফ 💞💞) যাতে ঠিকঠাক আসে। বান্ধবী মিশন, পলি, রনি, কেয়া, কামিল, রুচি না আসলে অনুষ্ঠানই অপূর্ণ থাকতো। রুচি অবশ্য মনে করে দিলো যে তার বাসায় গিয়ে আমার কিছু লেখালেখি করার কথা ছিল। সময় ও সুযোগ পেলে ইচ্ছাটা পূরণ করার ইচ্ছা আছে। যারা জানে না তাদেরকে বলি রুচির স্বামী স্থপতি স্বপন ভাই স্থাপত্য ও প্রকৃতির সম্মিলন ঘটিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা আবাস বানিয়েছেন। বিজলি ও বিলকিস আপার সাথে বহুদিন পর দেখা হলো। আর দু জনের কথা উল্লেখ করতে চাই। বন্ধু সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সাংবাদিক মানুষ, দারুণ ব্যস্ত থাকে। তার পরেও ওই সন্ধ্যায় কিছুটা সময় আমাদের মাঝে কাটিয়ে গেছে। আরেকজন হলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও আমাদের বন্ধু এমরান কবীর চৌধুরী। সে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে শারমিনকে (আমাদের আরেক বান্ধবী ও এমরানের বেটার হাফ ❤❤) নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়েছিল। সবার চলে যাওয়ার পর একটা অনুভূতি এলো যে দীর্ঘ সময় পার করার পরও বন্ধুত্ব অটুট থাকাটা ইহজীবনে বিশাল একটা প্রাপ্তি। এ জন্য বন্ধুদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। 🙏🙏🙏
ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় আবৃত্তি শিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি ২০২১ সালে তার অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছেন। আমার বেটার হাফ মারুনা রাহী ♥️♥️ তার আবৃত্তির দল 'কথা' তে সংযুক্ত ছিল। সেও গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে গত তিরিশ বছরের উপরে আবৃত্তি শিল্পে নিবেদিত প্রাণ। গুরু ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সহযোগীরা মিলে তাদের একজন প্রবাসী আবৃত্তিকার মারুনা রাহীকে সম্বর্ধনা জানাল। আমার অবাক হওয়ার পালা বাকি ছিল। ভাস্বর দা বললেন তারা আরও একজন স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছেন। আমি ভাবছিলাম সেটা কে হতে পারে। সেই ব্যক্তিটা আর কেউ নেই; এই অধম 'আমি'। দাদা বলে চললেন আমার সাহিত্য চর্চার কথা, আমার প্রকাশিত বইয়ের কথা। দাদার তনয়া 'তাথৈ' আমাকে এক তোড়া ফুল দিয়ে আবেগ তাড়িত করল। 🙏🙏🙏
বাংলাদেশের ভৌগোলিক গন্ডি পার করে একজন কবির খ্যাতি বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু স্বরচিত সাহিত্য না; দীর্ঘ কাল ধরে সে নানা ভাষার কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে দেশীয় সাহিত্যানুরাগীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। তার নাম আমিনুর রহমান। সে ২০২২ সালের অনুবাদ সাহিত্যের জন্য বাংলা একাডেমি পদক পেতে যাচ্ছে। এই গুণী ব্যক্তিটা যেমন বিনয়ী ও তেমনি অতিথি বৎসল। আমাদের সাথে অন্তরঙ্গতা সেই মেলা বছরের। তার সাথে হাজারও বিষয় নিয়ে আড্ডা হলো। তার আপ্যায়নও ছিল দারুণ আন্তর্জাতিক মানের। সে এক বিশাল উঁচু বিল্ডিঙের ছাদে নিয়ে গেল। সেখানে বাগানের মাঝে সাজানো একটা রেস্টুরেন্ট। পাশে সুইমিং পুল। পুরো ঢাকা শহরকে উপর থেকে দেখার এক অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতা হলো।🖊️🖊️🖊️
শ্যালকের ছোট কন্যা মাহিবা; আমার বিশেষ ভক্ত। আমি যা না, আমাকে সে তাই ভাবে। সে মনে করে আমি একজন বড় মাপের লেখক। কথাটা সে আবার তার বান্ধবীদের কাছে প্রচার করেছে। তাদের কয়েকজন আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিল। মাঝে একদিন ওদের জন্য কয়েক ঘন্টা সময় বের করলাম। স্বল্প নোটিসের কারণে শুধু দু জন আসতে পারল। আমার খুবই ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের টিন এজারদের চিন্তা ভাবনার সাথে পরিচিত হওয়া। আমার চার জন্যে মিলে কয়েক ঘন্টা ধরে আড্ডা দিলাম। এরা পড়ালেখায় তুখোড়, ছবি আঁকে, গল্প-কবিতা লিখে। দেশ বিদেশের সব উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল। চিন্তা ভাবনায় পশ্চিমা যে কোনো দেশেরই একই বয়সীদের সমকক্ষ। ওরা বিদেশে পড়া লেখা করতে গেলেও, ফিরে এসে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে চায়। ওরাই মোবাইল ফোনের এপ দিয়ে অর্ডার করে পিজা আনালো। ওদেরকে বিদায় দেওয়ার সময়ে মনে হলো যে দেশের সন্তান এতো চৈকোষ সেই দেশ তো বহু দূর এগিয়ে যাবেই!
এই পর্যন্ত বেশ কিছু কাছের মানুষের কথা বললাম। কিন্তু আরও কয়েকটা নাম যোগ না করলে আজকের লেখাটা পূর্ণতা পাবে না। ছোট ভাই টিন্টু নিয়ে গেল কাবাব নানা খাওয়াতে। এই খাবারের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। উত্তরার বাসায় বিট্টু ভাই ও নাসিমা ভাবীর যত্ন- আত্মির ছিল কল্পনাতীত। আমি দেশে গেলে শ্যালক কনকের খাঁটুনি বেড়ে যায়। আমাকে এইদিক সেদিক নিয়ে যাওয় আসা– সব ব্যাপারেই আমার সাথে থাকে। শ্যালক বৌ লাভলি, আমার বিশেষ প্ৰিয়। পারলে সে আমার জন্যে আকাশের চাঁদটাও এনে দেয়। সুন্দরী শ্যালিকা রীতি ক্যানাডা থাকে। সেও এই সময়ে ঢাকায় ছিল। বেচারী সারাক্ষণই আমার অম্ল-মধুর বাক্যবানে জর্জরিত হয়েছে। শালী-দুলাভাইয়ের খুনসুটির স্বাদ যে পায়নি; তার জীবনের বেশ কিছুটাই বৃথা!
পত্রিকায় সংবাদ এসেছে এসেছে ঢাকা শহরের বাতাস দূষণের দিক থেকে পৃথিবীতে নিকৃষ্ট। রাস্তায় গাড়ি, বাস, ও জনগণের বিশৃঙ্খলা, জায়গায় জায়গায় ময়লার স্তূপ, সরকারি অফিসগুলোতে কথার সাথে কর্মের অমিল এবং দুর্নীতি, ক্ষমতা ও অর্থের অপপ্রয়োগ, প্রায় প্রতিটা-ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা তথা বাংলাদেশ নিয়ে কি আশাবাদী হওয়া যায়? আমাদের সবারই হয়তো জানা আছে মাত্র কিছুদিনের আগেও বাঙালি অন্ন ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করতেই ব্যতিব্যস্ত থাকতো। কিন্তু এর বহুলাংশে সমাধান হয়েছে। অন্ন, বস্ত্রের ব্যবস্থা করার পর এখন বাড়তি অর্থনৈতিক সামর্থ তৈরি হচ্ছে। এর পরেই দাবী আসবে অন্যান্য সব কিছু নিয়মের মধ্যে আনার। বাঙালি ধৈর্য্য তথা সবুর করার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রথমেই বলেছি। 'সবুরে মেওয়া ফলে' কথাটা আমরা জানি। ধৈর্য্যের সাথে জোরালো দাবী ও চাপ এই পরিবর্তন নিশ্চিত করবে। প্রসঙ্গত একটা হাদিসের কথা বলি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলেছিলেন, দু পয়সা আয় হলে; প্রথম পয়সা দিয়ে খাদ্য এবং পরের পয়সা দিয়ে ফুল কিনতে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “ফুলের ফসল” কবিতা আমাদের কাছে পরিচিত:
জোটে যদি মোটে একটা পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!
দেখতে দেখতে বিদায়ের ক্ষণ ঘনিয়ে আসলো। সফরের প্রথম দিন আরম্ভ করেছিলাম, আমার আম্মার কবরে কিছুটা সময় পার করে। কর্মচঞ্চল মানুষটা ভীষণ অভিমানী ছিলেন। বিদেশ থেকে ফোন করতে দেরি করলে তার হাজারও উদ্বেগ হতো; তার থেকে আরও বেশি তৈরি হতো অভিযোগ। এখন আর তাকে আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। কারণ আমাদের যোগাযোগ এখন প্রতিটা মুহূর্তেই চলে। তবে সেটা চলে ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন এক ডাইমেনশনের (dimension) মাধ্যমে। তার স্থায়ী ঠিকানায় পাশে দাঁড়িয়ে বিদায় নিলাম। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা আলা যাতে তাকে বেহেশত নসিব করেন।
ঢাকাকে ছেড়ে আসতে প্রতিবারই ভীষণ কষ্ট হয়। মনোজগতে খেলতে থাকে আবার কবে ফিরব কিংবা আদৌ আরও একবার এই মাটিতে পা রাখা হবে কি-না। এই কষ্টের যন্ত্রণা শুধুমাত্র যারা তাদের শিকর ছেড়ে চলে এসেছে; তারাই একমাত্র জানে। ঢাকা তথা দেশটাকে বুঁকের গহিনে ধারণ করি। এখানে বারে বারে ফিরে আসতে চাই বেঁচে থাকার সঞ্জীবন অস্বাদান করতে।
“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।”
---জীবানন্দ দাস
ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২২