শূন্যে গড়ি বসত
অনেকটা ধুম করে বিয়ে হয়ে গেল শিউলির। ও ছুড়ি তোর বিয়ে লেগেছের মত অবস্থা। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্কলারশিপ নিয়ে নিয়ে এমেরিকা যাবে। ছেলে পক্ষ এক দেখাতেই মেয়ে পছন্দ করে ফেলল। বাবা মা অমত করল না। বুধবার সন্ধ্যায় আংটি পড়িয়ে গেল। শুক্রবারে সন্ধ্যায় এসে শিউলিকে বিয়ে পড়িয়ে উঠিয়ে নিয়ে গেল।
জীবনের গতি অনেক সময় ঝড়ের থেকেও দ্রুত হয়। শিউলির যেমন কল্পনা ছিল তার কিছুই হল না। গায়ে হলুদ হল না, কোন গান বাজনা হল না। কোন কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করা হল না । বিয়ের গেট, আলোক-সজ্জা কিছুই না। বন্ধু বান্ধব কাউকে পর্যন্ত ঢাকা গেল না।
শিউলি মহিলা কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। শাড়ি পরে এক সপ্তাহ পর শিউলি যখন কলেজে গেল, সবাই অনুমান করার চেষ্টা করল কি বিষয়। বেশীর ভাগই ভাবল হয়ত এনগেজমেণ্ট হয়েছে। তার পরেও মুখ ফুটে কেউ জানতে চাইল না। টিচাররা পর্যন্ত দু একবার আড় চোখে ঘুরে তাকিয়েছেন। ডাগর চোখের শিউলির কপাল ভড়া টিপ; চোখ তো কাড়বেই। থার্ড পিরিয়ড তপতী ম্যাডামের; বাংলা ক্লাস। তিনি সরাসরি জানতে চাইলেন, ছেলে কি করে। বয়স্কা ম্যাডামের বিয়ের ব্যাপারে তুমুল কৌতূহল। হয়ত নিজে বিয়ে করেন নি, তাই।
এর আগে এ রকম ঘটনা যে হয় নি, তা কিন্তু না। গত তিন মাসে রত্না, শেলির এনগেজমেণ্ট হয়েছে। বিয়ে হয়েছে এনির। বিয়েতে ক্লাসের সবার দাওয়াত ছিল। শিউলি নিজে ওর বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। ক্লাসের আরও বেশ কয়েক জন এক সাথে যেয়ে গায়ে হলুদ, বিয়েতে খুব আনন্দ করে এসেছিল। তপতী ম্যাডামও গিয়েছিলেন। তিনি এনিকে বিয়ের দিন কানে কানে কত না বিদ্যা শিখিয়ে দিলেন। হয়ত শিক্ষকরা; ঢেঁকির স্বর্গে যেয়ে ধান ভানে, সে রকমই কি না। ক্লাস হোক, কিংবা অন্য জায়গা হোক, তাদের বিদ্যা দান অব্যাহত রাখতেই হয়। ম্যাডামের শেষ কথাটা অবশ্য সবাই স্পষ্ট শুনতে পেল। তিনি বললেন, দেখ যা যা বললাম, সব মনে রেখ। আমি কিন্তু জানতে চাইব, তুমি কি কি করতে পারলে।
মেয়েরা তপতী ম্যাডামের কথায় খুব লজ্জা পেল। কিন্তু উপস্থিত মেয়েদের মেলা সাজ-গোঁজ, আর মেক আপ করা। অন্য সময় হলে তাদের মুখ যে লাল হয়েছে, তা বুঝা যেত। কিন্তু মুখের মেক আপের কারণে সেটা বুঝা গেল না। শুধু স্নেহা শিউলিকে ফিস ফিস করে বলল, ম্যাডাম নিজে তো বিয়েই করে নি। তার এ বিষয়ে এত জ্ঞান আসল কি করে। শিউলিও কম যায় না। সেও ফিস ফিস করে উত্তর দিল, পুথি বিদ্যা, বড় বিদ্যা। দু জনেই শিউলির রসিকতায় এক সাথে বেশ জোড়ে হেসে উঠল। তপতী ম্যাডাম ওদের দিকে কটমট করে তাকালেন, যেন ক্লাসের বাচ্চারা খুব বেশি হৈ চৈ করে বিরক্ত করছে।
শিউলির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তপতী ম্যাডাম ক্লাস শুদ্ধ সবার সামনে কি না আবার বলে বসেন। খুব আস্তে আস্তে বলল, জী মানে পড়ায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে; টিচার। তপতী ম্যাডামের পরের প্রশ্ন যেন ঠোঠের মাথায় রেডিই ছিল। তাই না কি? বিয়ে কবে, দাওয়াত দিতে ভুল না কিন্তু। আমি আবার বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠান খুব পছন্দ করি।
শিউলির মনে হল, ধরণী তুমি দ্বিধা হও, আমি সেখানে মুখ লুকাই। বেচারা আর মুখ তুলে তাকাতে পারল না। নীচের দিকে তাকিয়ে অনেকটা ছোট গলায় বলল, হঠাৎ করে বিয়েটা হয়ে গেল। ছেলে পক্ষ থেকে তাড়া দিল। ছেলে কয়েক দিন পরে বিদেশ যাবে। তাই আর কি।
ম্যাডাম ঠিকই শিউলির সব কথা শুনে ফেললেন। কি, কি বললে। একবারে বিয়ে হয়ে গেছে। আবার ছেলে বিদেশ যাবে। তাড়া দিয়ে বিয়ে করল। সব খবর নিয়েছ তো তোমরা। বিয়ের প্রস্তাবটা কে আনল?
যাই হোক, ম্যাডাম ক্লাসে মন দিলেন। কিন্তু শিউলির বিয়ের খবর কলেজের সবার কাছে পৌছতে সময় লাগল না। ।
২
শিউলির বরের নাম, নোমান আহমেদ। হ্যাংলা, পাতলা মাঝারি গড়ন। লম্বাটে মুখ। চোখে ইয়া বড় একটা পুরু চশমা। দেখলে মনে হয়, একান্ত নির্ভেজাল একটা মানুষ। শিউলির জানতে ইচ্ছা করেছিল, চোখ বুড়ো মানুষদের মত এত খারাপ হল কি করে। নিশ্চয়ই বই পড়তে পড়তে চোখ নষ্ট করে ফেলেছে। যা তা ব্যপার না, কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। চশমা না থাকলে, লোকটাকে কিন্তু দেখতে বেশ লাগত। রাজকুমার বলা যেতে পারে। শিউলির মনে হল, অন্য যে সব বান্ধবীদের বিয়ে হয়েছে, তাদের সবার বর থেকে তার নিজের বর দেখতে অনেক বেশী সুন্দর। মুচকি করে যখন হাসে, তখন কি ভালই না লাগে। একেবারে বুকের ঠিক মাঝখানের জায়গায় রক্ত ছলাৎ করে উঠে।
তাড়াহুড়া করে বিয়ে হলেও, বাসর ঘর কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজান হয়েছিল। বরের ছোট বোন রুপা, এখনতো ননদ, শিউলি ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল। ওর নাম শিউলি বলে কি-না। হয়ত বরের ইচ্ছাও থাকতে পারে। ভেবেছিল সারা রাত ধরে বরের সাথে গল্প হবে। তার অনেক কথা শুনবে। কিন্তু প্ল্যান মোতাবেক এগোল না। লোকটা এসে গম্ভীরভাবে,এটা সেটা, বেশ অনেক কথাই বলল। কিন্তু শিউলি না পারল কিছু জিজ্ঞাসা করতে, না পারল নিজের কিছু বলতে। যাকে নিয়ে বাকিটা জীবন কাটাবে, তার সাথে সহজ হতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? মাঝে মাঝে মনে হল, ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে যেই ছেলেটা তাকে টিউশানি করত, তার চেহারার সাথে বেশ মিল। ছেলেটাকে শিউলি সার বলে ডাকত। জামাইকে তো আর সার বলে ডাকা যায় না।
সারের প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে তুলল না। অজানা, অচেনা মানুষ। কিছু যদি মনে করে বসে। শেষে একটা ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। ওর কথা আপাতত না বলাই ভাল। নতুন বউয়ের উপস্থিতিতে লোকটার মধ্যে কোন দ্বিধা-দ্বন্ধ দেখতে পেল না। ছাত্রী পড়ানোর মত করে কথা বলতে লাগল। কত না কথা! ছোট বেলার কথা, বাবা হারানোর কথা, শেষে ক্লাসের ছাত্রীদের কথা।
বর সাহেব বলতে লাগল, মেয়েরা বলতে পার আমাকে খুব পছন্দ করে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ওদেরকে আমি ছাত্রী থেকে বেশি কিছু ভাবি না। ভদ্রলোক চশমা খুলতে খুলতে শিউলির দিকে এগিয়ে আসল। ঘোমটা সরিয়ে শিউলির ঠোটে ঠোট রাখল। তার পরে আরম্ভ হল, শান্ত এক মানুষের অশান্ত সব কার্যকলাপ। শিউলির প্রথমে অস্বস্তি লাগছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাল লাগা আরম্ভ করল। আহ কি সুখ, কি আনন্দ। মনে হচ্ছে সুখের সাগরে ডুবে যাচ্ছে। লোকটা ওকে প্রথম দিনই পাগল করে দিল। এই সুখ ছাড়া সে এত দিন কি করে ছিল, আর কি করেই বা থাকবে। লোকটা কয়দিন পরে বিদেশ চলে যাবে। তখন তার কি হবে?
এতটুকু সময়ের মধ্যে লোকটার জন্যে বুকের ভিতরের অশান্ত দীঘিটা ভরে গেল অনাবিল প্রশান্তিতে । জামাইয়ের সব কিছুই ভাল লাগছে। চশমা ছাড়া ভাল লাগছে, চশমা পরা চেহারা চিন্তা করেও ভাল লাগছে। বিয়ের আকদ যখন হচ্ছিল, তখনও পুরু চশমা পরা লোকটাকে দেখে খুব অস্থির লাগছিল। এখন একেবারে সব উল্টে গেল। একে নিশ্চয়ই ভালবাসা বলে?
হাসি লাগল। এত অল্প সময়ের মধ্যে মেয়েদের মধ্যে ভালবাসা চলে আসে কি করে। লোকটাকে আবার কেমন নিষ্পাপ মনে হচ্ছে। সে কোন ভাবেই খারাপ কাজ করতে পারে না। তার পরেও, এই মানুষটা যদি কখনো কোন ভুল করে করে, তার অগ্রিম ক্ষমা সে এখনই দিয়ে রাখল। আজকের এই সুখের যে ঋণ, তার তো শোধ হতে পারে না। শিউলি তার সবচেয়ে দামী উপহারটা স্বামীকে দিল।
পুরোটা সময় শিউলি দু চার বার হ্যা না বলা ছাড়া, তেমন কোন কথা বলল না। তার কথা শুনতেই ভাল লাগছে। ও নিজে কথা বললে, লোকটা কথা বলা বন্ধ করে দেবে হয়ত। না থাক ওদের বাসর রাতে না হয়, জামাই সব বলুক, সব কিছু করুক। আর সে নিজে সমস্থ অন্তর আর শরীর দিয়ে উপভোগ করে যাবে।
কি অদ্ভুত লোকটা বিছানা থেকে উঠে একটা বই নিয়ে, চশমা পড়ে বিছানায় ফিরে আসল। শিউলির দিকে তাকিয়ে জানাল, আমার ঘুমের আগে বই না পড়লে চলে না।
৩
আরও কয়েক দিন পরের কথা। কলেজ শেষ হতে এখনো দু পিরিওড বাকী। দপ্তরী এসে খবর দিল, শিউলিকে নিতে বাসা থেকে মানুষ এসেছে। সে যেন সব কিছু গুছিয়ে অফিসে যায়। শিউলির মাথায় আসল না, তাকে নিতে কে আসতে পারে। বাবা এসেছে তাকে নিতে? কোন বিপদ? ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হওয়ার উপক্রম।
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিসে যেয়ে অবাক হয়ে গেল। নোমানকে নিয়ে প্রিন্সিপাল আর তপতী ম্যাডাম বেশ জোড়ে জোড়ে কি নিয়ে যেন আলাপ করছেন। সবার সামনে এক কাপ করে চা। নোমান যত না কথা বলছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কথা বলছেন তপতী ম্যাডাম।
শিউলি ঢুকতেই তপতী ম্যাডাম হৈ হৈ করে বললেন, তোমার জামাই যে নোমান আহমেদ, সেটা বল নি কেন?এর উত্তরে কি বলা উচিত শিউলি ভেবে পেল না। তার জামাইয়ের নাম, মানুষের কাছে বলতে হবে না কি? অন্য যাদের বিয়ে হয়েছে, তারা ওই কাজ করে নি।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নোমানকে বললেন, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। আপনি লেখা চালিয়ে যান। দেখবেন আপনার লেখা সারা দেশে কত না জনপ্রিয় হয়। শুনলাম আপনি বিদেশে যাচ্ছেন। যেখানেই যান না কেন, লেখা কিন্তু বন্ধ করা চলবে না। এইটা কিন্তু আমার দাবী।
শিউলি অবাক হয়ে গেল, তাকে তো কেও বলে নি, নোমান এক জন লেখক। শুধু লেখক বললে ভুল হবে, হয়ত নাম করা কেও। দুই জন ম্যাডামের চোখ মুখ বলে দিচ্ছে, তারা নোমানকে কাছে পেয়ে মহা খুশী হয়েছে।
নোমান শিউলিকে নিয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে বলল, ইউনিভার্সিটির কলিগরা বলল, তোমাকে দেখতে চায়। তাই ভাবলাম তোমাকে কলেজ থেকে তুলে নিয়ে যাই।
এর মধ্যে শিউলি জামাইকে ‘তুমি' করে বলা রপ্ত করেছে। অভিমানী গলায় বলল, তুমি যে লেখক, সে কথা আমাকে বল নি কেন?
নোমান হো হো করে হেসে বলল, কিসের আবার লেখক। একটু আধটু লিখি। কিছু বাড়তি আয় হয়। লোক জনে খাতির করে।
শিউলি এবারে সোহাগী গলায় নামল, একটু আধটু লিখলে তো আর প্রিন্সিপাল আর তপতী ম্যাডামের জানার কথা না।
নোমান জানাল, কালকে পত্রিকায় আমার একটা ইন্টার্ভিউ বের হয়েছে। আমার একটা নাটক এ সপ্তাহে টিভিতে দেখাবে তাই। তা ছাড়া গত বই মেলায় আমার লেখা কয়েকটা বই খুব বিক্রি হয়েছে। ওই টাকা দিয়েই তো তোমার বিয়ের শাড়ী, অলংকার কিনলাম। ইউনিভার্সিটির বেতনের টাকায় অত দামী শাড়ী কি আর কেনা হত? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল, মালা শাড়ী নিয়ে গেলে, তোমাকে বিয়ে করে ঘরে আনতে পারতাম না।
শিউলির প্রথমে রাগ হলেও, গর্বে বুকটা ভরে উঠল। তার স্বামী এক জন বিখ্যাত লেখক। সে এত দিন না জানলে কি হবে, এখন সে জানে। গল্পের বই পড়ার অভ্যাস এত দিন ছিল না; এখন তাকে অভ্যাসটা গড়ে তুলতে হবে। তার স্বামী একজন সু-পরিচিত লেখক। কি মজা, সেও জামাইয়ের সাথে সাথে বিখ্যাত মানুষ হয়ে যাবে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুরো কলেজ রটে গিয়েছে, শিউলির স্বামী হল নোমান আহমেদ। কেও যদি বলে কোন নোমান আহমেদ, অন্যরা তখন বুঝিয়ে দিচ্ছে, চিনলে না, ওই যে কালকে যার পত্রিকায় ইন্টার্ভিউ বের হয়েছে। এই সপ্তাহের টিভি নাটকও তার লেখা।
৪
বিয়ের তিন দিনের মাথায় দু জনে হানিমুনে গিয়েছিল কক্সবাজার। সেখানে যেয়ে ছিল তিন দিন। এই জন্যে সব মিলিয়ে সাত দিন কলেজে যাওয়া হয় নি। প্রথমে খুব লজ্জা লাগছিল, শুধুমাত্র দু জনে কক্সবাজারে যাবে। সাথে কেউ গেলে ভাল হত। জামাইয়ের সাথে আগে কোন পরিচয় ছিল না। এখন তার সাথে যেতে হবে। প্রথম রাতটা ভালই কেটেছিল। শরীর, মন দু-ই ভরে গিয়েছিল।
এনি বলেছিল, তার জামাই প্রথম রাতে তার সাথে, সারা রাত জেগে গল্প করেছিল। ভালবাসা-ভালাবাসি হয়েছিলও অনেক। কিন্তু দ্বিতীয় রাত থেকে এক বিরাট সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়েছিল। তার জামাই এত জোড়ে জোড়ে নাক ডাকছিল, মনে হচ্ছিল ঘরের ছাদ এই বুঝি ভেঙ্গে পড়বে। বেচারি সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল। অবশ্য তিন রাতের মাথায় অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন জামাইয়ের নাক ডাকা শুনতে ভালই লাগে। ওই শব্দ না শুনলে ঘুম আসতে চায় না।
শিউলির ভয় ছিল। সব পুরুষ মানুষ কি নাক ডাকে। একই বিছানার মানুষ যদি নাক ডাকতে থাকে, তা হলে তার ঘুম আসার প্রশ্নই উঠে না। ছোট বেলা থেকেই পাতলা ঘুমের ব্যাপারে তার দুর্নাম ছিল। সামান্য টুং শব্দ হলেই, তার ঘুম ভেঙ্গে যেত। না ঘুমিয়ে থাকলে তার আবার চোখের নীচে কালি পড়ে। স্বামীর নাক ডাকার কারণে চোখের নীচে কালি পড়লে, সে মানুষদের কি বলবে। তা ছাড়া এত ভাল এক জন জামাইকে কিভাবে বলবে, তোমার নাক ডাকার কারণে আমার রাতে ঘুম হয় না , আর সে জন্যে চোখর নীচে কালি পড়ছে।
শিউলি যা যা ভেবেছিল, তার কিছুই হল না। জামাই ছোট একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই পড়ে কিংবা কাগজ কলম নিয়ে লিখতে থাকে। এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার যখন সকালে চোখ খুলে, দেখতে পায় তার আগেই ও উঠে পড়েছে। বেশির ভাগ সময়ে আবার সে একই দৃশ্য। হয়ত পড়ছে না হয় লিখছে। একটা লোক এত কম ঘুমিয়ে বাঁচে কি করে!
ঘরের মধ্যেই এক মাস কেটে গেল। নোমানের এমেরিকা যাবার দিনক্ষণ এগিয়ে আসতে লাগল। শিউলির শুধু লোকটার কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে। এই কয়েক দিন পরে চলে যাবে। আবার কবে দেখা যায়, কে জানে। এখন মনে হচ্ছে, লোকটাকে ছাড়া, লোকটাকে না দেখে সে কেমন করে থাকবে। শুধু কান্না আসে। কলেজে যেতে কোন রকম আগ্রহ পর্যন্ত হয় না। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত, কলেজে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করত। নোমানই ওকে ধরে বেঁধে কলেজে পাঠান আরম্ভ করল।
এমেরিকা যাবার তখন দিন তিনেক বাকী, শিউলি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। কলেজে যাবার জন্যে রেডি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এমন কান্না আসল আসল যে, ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। জামাই ছুটে আসল, কি কি হয়েছে?
শিউলি কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আমাকে ছেড়ে যেও না। আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চল।
কিন্তু নোমান আহমেদ এমেরিকার উদ্দেশ্যে একাই রওয়ানা দিল।
অবশ্য যাওয়ার সময়ে জানতে পারল, তার শরীরের একটা অংশ; তার সন্তান, শিউলির গর্বে ঠাই নিয়েছে।
নোমানের প্লেন ছিল রাতে দশটায়। সকাল থেকেই শিউলি বমি করা আরম্ভ করল। খাওয়া মুখে দিলেই বমি। কিছুক্ষণ পর পর বমি। সাথে কান্না। বেচারা একেবারে কাহিল হয়ে গেল। নোমানের একবার মনে হল, বিদেশ না গেলে কি হয়। এ রকম একটা স্বামী ভক্ত মেয়েকে সে কি ভাবে একা রেখে যায়।
রুপা ঠেস দিয়ে শিউলিকে বলে গেল, তোমাদের দেখি তর সইল না। ভাইয়া বিদেশ থেকে ফিরে আসার পরে, বাচ্চা নিলে কি হত না।
৫
নোমান যেয়ে পড়ল ঠাণ্ডার জায়গা সাউথ ক্যারোলিনায়। আসে পাশে কোন বাঙালি নাই। বাংলাদেশে ফোন করতে খরচ মিনিটে আড়াই ডলার। স্কলারশিপে টিউশান, হোস্টেল, খাওয়া দাওয়া ফ্রি হলেও; হাত খরচ তেমন একটা দেয় না। এখানে এসেই, দেশ থেকে আনা টাকা দিয়ে গরমের কাপড় চোপড় কিনতেই শেষ হয়ে গেল। ক্লাস, লাইব্রেরী, সব জায়গায় যেতে হয় বরফ ভেঙ্গে, পায়ে হেটে। একেবারে কাহিল অবস্থা। তার পরে পড়ালেখার প্রচণ্ড চাপ।
কথা হচ্ছে সেই সত্তরের দশকের শেষ দিকের। ফোন করলে তেমন বেশি কথা হয় না। শিউলি বাবার বাসায় ফিরে গেছে। সেখানে নিজেদের ফোন নাই। উপর তলার বাড়িওয়ালার বাসায় আছে। সেখানে ফোন করে শিউলিকে ডাকতে ডাকতে কম করে হলে দশ মিনিটের ব্যপার। এ কেমন, সে কেমন করতে করতে চলে যায় আরও কিছু সময়। আসল কথা জানতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। জানতে ইচ্ছা করে শিউলির পেটে তার যে বাচ্চা আছে; সে এত ছোট জায়গায় কি করে থাকে, তার পরে আবার ঘুট ঘুটে অন্ধকার। রসিকতা করে যদি বলা যেত, ছেলে কি বাবাকে খোঁজাখুঁজি করে কিনা।
না সে রকম কিছু আর ফোনে বলা হয়ে উঠে না। নোমান ঠিক করল, ফোন না করে, চিঠি লিখবে। নিজের বউয়ের সাথে যোগাযোগ ছাড়া কি আর চলা যায়। চিঠি সাহিত্য আরম্ভ হল। মনের যত কথা, আবেগ দিয়ে লিখে চলল শিউলি আর অনাগত সন্তানকে উদ্দেশ্য করে। সেখানে যেমন থাকত শিউলির সাথে ফেলে আসা দিন গুলোর কথা, সাথে থাকত শিউলির সৌন্দর্য আর শরীরের বিশেষ অঙ্গ নিয়ে রসনা আর কল্পনা। শিউলি এক বার উত্তরে লিখল, তুমি এত সুন্দর করে লিখতে পার। পৃথিবীর যে কোন মেয়ে তোমার প্রেমে পড়ে যাবে। আমার কিন্তু ভয় হয়। আর যদি কেও প্রেমেও পড়ে, সে কিন্তু তোমাকে ভালবেসে প্রেমে পড়বে না, তোমার লেখা পড়ে প্রেমে পড়বে। এতে তোমার কোন দোষ থাকবে না। একটু রস দেয়ার জন্যে শিউলি জুড়ে দিল, তোমার ভবিষ্যৎ প্রেমের অনুমতি আমি এখনই দিয়ে রাখলাম। শুধু মেয়েটাকে বল, ‘তুমি আমায় নহ গো, ভালবাস মোর লেখা’।
উত্তরে নোমান লিখল, তোমার ইয়া বড় একটা চশমা পড়া, চোখ খারাপ স্বামীর প্রেমে কোন মেয়ে পড়তে পারে না। তার পরে ছেলে সারাদিন হয় পড়ালেখা করে অথবা শিউলি নামে মেয়েটার কথা ভেবে চলে।
দিন যত যায় নোমানের ব্যস্ততা তত বাড়তে লাগল। দেশে ফোন করা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। দেশে চিঠি পাঠানও কমে গেল। অনেকটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থা। পিএইচডি তাকে সময় মত শেষ করতেই হবে। লাইব্রেরী, থিসিস লেখা, সুপারভাইজারের সাথে মিটিং করতে করতে দিন যে কেমন করে শেষ হয়ে যায়, তা বুঝতেই পারে না। ।
হেলায় হেলায় কাটতে লাগল বেলা। নোমান আহমেদের ছেলে রোমান আহমেদের বয়স দু বছর হয়ে গেল। বাব-বেটার এখনো সামনাসামনি সাক্ষাৎ হয় নি। শিউলি প্রায় প্রতি চিঠিতেই বাবার জন্যে ছেলের ছবি পাঠায়। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরা হয় না। কোলে নিয়ে বাচ্চাটাকে প্রকৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় না। কিন্তু তার কয়েকটা গল্পে বাবা ছেলে কত না আনন্দে করে সময় কাটায়। আর বাস্তবে সে এখন নিজের ছেলের সামনে যেয়ে দাঁড়ায় নি। এত বড় পাষাণ এক জন লেখক হয় কি করে! রবীন্দ্রনাথের নিজের পরিবারের জন্যে বেশি কষ্ট পেত, না কি তার কল্পিত চরিত্র তাকে বেশি কাঁদাত। ছোট রোমান কি তাকে মাফ করবে? কিংবা তার বাচ্চার মা, শিউলির ফুলের নামের মেয়েটা!
একটা মেয়ে এত কিছু পারে কি করে? এক হাতে একাই সব সামিল দিচ্ছে; নিজের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি। সাথে ছোট বাচ্চাটার সব কাজ নিজের হাতে করছে। কোন ব্যাপারেই কোন অভিযোগ নাই। বরং তার সব অপরাধের জন্যে অগ্রিম ক্ষমা দিয়ে রেখেছে। ভাবতেই লেখকের মন কেমন উদাস হয়ে যায়। হয়ত চোখের কোণায় পানিও চলে আসে। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে সামরিক কায়দায় একটা স্যালুট দিতে ভীষণ ইচ্ছে করে।
নোমান চাইলে এক বার যে দেশ থেকে ঘুরে আসতে পারত না, তা কিন্তু না। দাঁতে দাঁত চেপে পিএইচডি শেষ করতে পারলেই হল। একেবারে ভোঁ দৌড়, বাংলাদেশ। বউ, বাচ্চা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে এক দারুণ জীবন হবে। প্রায়ই প্রকাশকের যোগাযোগ করে পাণ্ডুলিপির জন্যে, বই ছাপাতে চায়। কিন্তু এখন সময় কই।
৬
নোমানের এমেরিকায় অবস্থান প্রায় শেষের দিকে। মাস তিনেকের মধ্যে এখানকার সব ঝামেলা চুকে যাবে। ইতিমধ্যে নামের আগে ‘ডক্টর’ শব্দটা যোগ হয়েছে। ইউনিভার্সিটি সে এখন ক্লাস নিচ্ছে। এই সেমিস্টার শেষ হলেই, কাজ শেষ। ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ তেমন একটা ছিল না। কিন্তু সুপারভাইজারের কথা ফেলতে পারল না। তা ছাড়া, এখানকার রেওয়াজ বলা যেতে পারে, যে ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট পেয়েছে, সেখানে কিছুদিন ছাত্র পড়ান।
রোববার সকাল। কোন কাজ নাই। ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে, সেই কখন। গত কয়েক মাস পড়ালেখার পেছনে এত সময় কাটিয়েছে যে, সে ঠিক করেছে বেশ কিছুদিন যথাসম্ভব বই খাতা থেকে দূরে থাকবে। শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখছিল। বিরক্ত লাগা আরম্ভ করল। রোববারে এই সময়ে টিভিতে খেলা, খবর আর চার্চের অনুষ্ঠান ছাড়া কিছু দেখায় না।
উঠা দরকার। উঠলেই আবার দুনিয়ার কাজ। নাস্তা বানিয়ে খাও, শেভ কর, গোসল কর। ঘর বাড়ি লণ্ড ভণ্ড হয়ে আছে, সে গুলো গুছানোর দরকার। কার্পেট ভ্যাকুম করতে হবে। কোন কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছে না। টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, দুপুরের বারোটা। এই বার উঠতেই হবে। অলসতা বন্ধ করতে হবে।
ইস এখানে যদি শিউলি থাকত। পরের মুহূর্তেই নিজেকে সান্ত্বনা দিল, একবার দেশে ফিরতে পারলেই হল, এমেরিকার নাম পর্যন্ত মুখে নিবে না। এখানে শুধু কাজ আর কাজ। বাঙালির কি এত কাজ করা পোষায়? তারা কবিতা লিখবে, বই পড়বে, সারাদিন ধরে বৃষ্টি দেখবে, মনের সুখে গাইবে বেহাগ। তাদের এত কাজ করতে হলে, বাঙালি কি আর বাঙালি থাকবে?
লেখক এবার নিজের কথায় নিজেই হাসল। অলস মস্তিষ্ক কি সব চিন্তা করে যাছে। বর্তমান বিশ্বে যে যত কাজ করবে; সে তত আগাবে। আচ্ছা আগানো ব্যাপারটা কি? বাঙালিরা কি আগে পেছানো ছিল? হয়ত, হয়ত না। আবার মাথার মধ্যে চিন্তার গাছ পালা গজান আরম্ভ করল।
দরজার কলিং বেল বিকট শব্দ করে বেজে উঠল। এখন বিছান না ছেড়ে উপায় নাই। মহা বিরক্তি নিয়ে নোমান দরজা খুলতে গেল। এই সময়ে কারো আসার কথা না। কোন সেলসম্যান হয়ত এসেছে, কিছু বিক্রি করতে। এরা মানুষের দরজায় জিনিস-পত্র বিক্রি করে।
দরজা অল্প একটু খুলে বলতে হবে, যাও, যাও—এখন না, পরে আস। আজকে রোববার, সেলসম্যান আসার কথা না। মহা বিরক্তি নিয়ে নোমান সামান্য একটু দরজা খুলে উকি দিল। মনে হচ্ছে শাড়ী পড়া এক মহিলা আর সাথে ছোট একটা বাচ্চা ছেলে।
আজ কত দিন হয়ে গেছে, নোমান শাড়ী পরা মহিলা দেখে নি। হয়ত কোন ভারতীয় মহিলা ভুল করে চলে এসেছে। কিন্তু এই তল্লাটে, তার জানা মতে কোন ভারতীয় থাকে না। নোমানের পড়নে শুধু পাজামা, খালি গা। অপরিচিত মহিলা, তার সামনে খালি গা কি, স্যুট পড়াই বা কি। নোমান আরেকটু দরজা খুলে বলল, May I help you? আমি কি তোমাকে কোন ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি।
সাথে সাথেই মহিলা হো হো করে হেসে উঠল, ছি ছি, কি অন্ধ লোকরে; নিজের বউকে চিনতে পারে না।
হাসি যেন থামতেই চায় না, বউ না চেনার অপরাধে কঠিন দণ্ড হতে পারত। কিন্তু জনাব আপনি তো আগের থেকেই “প্রেসিডেন্টের ক্ষমা” পেয়ে বসে আছেন। আপনার সব অপারাধের মাফ আছে। সাত খুনও মাফ।
শিউলি অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এই দুঃসাহসিক কাজটা করেছিল। ভিসা পেতে কোন ঝামেলা হল না। স্বামীর সাথে দেখা করে ফিরে আসবে শুনে এমব্যাসির লোকজন এক বারেই ভিসা দিয়ে দিল। জমান টাকা দিয়ে এমেরিকা যাওয়ার টিকেট করে ফেলল। উদ্দেশ্য একটাই, নোমানকে বড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ দেয়া। লোকটার মনে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট। এত দিন হয়ে গেল কোন দেখা সাক্ষাত নাই। বাব বেটার পর্যন্ত মোলাকাত হয় নি।। এই সুযোগে দেখা হবে, এমেরিকা দেশ টার মধ্যে কি আছে। কেন লোকজন এমেরিকা বলতে পাগল। তা ছাড়া কয়েকদিন পরে নোমান এমিনিতেই দেশে ফিরবে, তখন স্বপরিবারে ফিরলেই হবে।
৭
দেশে ফিরে লেখকের ব্যস্ততা কমলো না, বরং দিনে দিনে বাড়তে লাগল। চারিদিকে মেলা নাম ডাক। প্রায় প্রতি মাসে লেখকের বই বের হচ্ছে। প্রকাশনী সংস্থাগুলো পারলে এডভান্স টাকা দিয়ে যায়। লেখক টাকা নিলে, আজ হোক কাল হোক পাণ্ডুলিপি পাওয়া যাবে। নোমান আহমেদের বই মানেই হিট। বিক্রির জন্যে বই মেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। বিক্রি মানে ব্যবসা; ব্যবসা মানেই মুখে হাসি।
নাট্য প্রযোজক, পরিচালকেরাও তার পেছনে লাইন দেয়া আরম্ভ করল। নোমান আহমেদ এখানে বাড়তি আয়ের সুযোগ খুঁজে পেল। নিজের গল্পগুলোকে নাট্যরূপ দিতে বেশি সময় লাগে না। টিভি নাটক আরেকটা বড় ধরনের কাজ করল। তার খ্যাতি চূড়ান্ত ধরণের বাড়িয়ে দিল। খ্যাতি যত বাড়ে, বই বিক্রি তত বাড়ে। সাথে সাথে স্বপ্নের জাল বাড়তে বাড়তে পুরো দেশটাকেই ছেঁকে ফেলল।
রোমানের পরে, পরিবারে ঝুমা, রুমা আসল। বাবা মহা ব্যস্ত। ইউনিভার্সিটি চাকরি ছেড়ে সে ফুল টাইম শিল্প সাধনায় মন দিল। মানুষকে না দিয়ে, নিজেই নাটক বানানো আরম্ভ করল। চারিদিকে জয় জয়াকার পড়ে গেল। নোমান নিজের প্রতিভা চলচ্চিত্র নির্মাণেও আবিষ্কার করল। শিল্পের সম্ভবত চূড়ান্ত মাধ্যম চলচ্চিত্র। সব ধরনের সাহিত্য, শিল্প যেখানে মিলে একাকার হয়েছে, তারই নাম চলচ্চিত্র। নোমান আহমেদ চলচ্চিত্র বানিয়ে আরও অনেক এগিয়ে গেল। খ্যাতির শীর্ষ বলতে যা বুঝায়, সেখানে যেয়ে সিংহাসন গাড়ল।
সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যেতে থাকল। শিউলি অনেকটা এক হাতেই তিন ছেলে মেয়েকে মানুষ করল। বাবার কত শত কাজ। ছেলে মেয়েদের পড়া লেখা দেখা, স্কুলে ভর্তি করান সবই মায়ের কাজ। বাজার করা, রান্না করা বাড়ির মহিলারা এমনিতেই করে। নোমানের যেমন ঘর-সংসার নিয়ে ভাবার এক দম কোন অবকাশ নাই, অন্যদিকে শিউলির জীবন আর কাজের কেন্দ্র বিন্দু হল সংসার।
বাচ্চাগুলো দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। বড় মেয়ে ঝুমা কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটি যাওয়া আরম্ভ করেছে। তারই এক বান্ধবী শারমিন ছোট বেলা থেকে নাচ, গান,, অভিনয়ে বেশ পারদর্শী। সে একেবারে ঝুমার সাথে জোকের মত লেগে থাকল; বাবার সাথের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে। উনি যদি একবার নাটকে সুযোগ করে দেন, তা হলে একেবারে মাৎ করে দিতে পারত। বহির্জগত নিয়ে ব্যস্ত বাবাকে সচরাচর ঝুমা কিছু বলে না। তার পরেও, শারমিনের পীড়াপীড়িতে বাবাকে বলল, যদি সম্ভব হয়, আমার বান্ধবীকে তোমার কোন নাটকে নিও।
নোমান আহমেদ ঠিকই মেয়ের আবদার রেখেছিল। এক এক করে বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করে শারমিন দেশ ব্যাপী তারকা খ্যাতি পেয়ে গেল। নোমান আহমেদ পরবর্তী ছায়াছবি প্রজেক্টের জন্য শারমিনকে কোন অনুরোধ ছাড়াই নিয়ে নিল। লোক মুখে যা শোনা যাচ্ছিল, তা সত্যি হয়ে গেল। শারমিন ছবির মুল চরিত্র পেল।
শিউলির কানে মানুষের ফিস ফাস ঠিকই গেল। যে মানুষের বাসার কারোর জন্যে কোন সময় নাই, বাইরের এক মায়াবিনীর ইন্দ্রিয় আকর্ষণের সাড়া নিয়মিত দিচ্ছে। মৃদুভাষী শিউলির বিষয়টা নিয়ে নোমানকে প্রশ্ন করতে রুচিতে বাধল। ভাবতেই ঘৃণায় গা শির শির করে উঠল। শিক্ষিত, সচেতন এক জন মানুষ, কি করে নিজের মেয়ের বয়সী কারোর প্রলোভনে হারিয়ে যেতে পারে। শারীরিক যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারে। স্বামীকে এত টুকু বিশ্বাস করা যাবে না!
নোমান আহমেদ নিজে সাইন করে ডিভোর্সের কাগজ পাঠাল। সাথে ছোট এক চিরকুটে লেখা, পারলে মাফ করে দিও।
ডিভোর্সের কাগজ পেয়ে, অনেকদিন পর, শিউলি জোড়ে জোড়ে হাসল, আরে বোকা তোমাকে আমি এডভান্স মাফ দিয়ে রেখেছি। তবে তোমার ছেলে মেয়েরা মাফ করবে কি-না; সেটা আমি বলতে পারি না।
বিধাতা হয়ত নারীদের ভুলে থাকার, ক্ষমা করে দেয়ার, বুকের কষ্ট সহ্য করার অসাধারণ এক ক্ষমতা দিয়েছেন। সেই জন্যে সন্তানের মৃত্যু হলে অন্য সন্তানদের আঁকড়িয়ে ধরে মা’ রা বাকী জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। স্বামী ছেড়ে চলে গেলেও, সন্তানকে বলে, তোদের বাবা কিন্তু তোদেরকে ভীষণ ভালবাসত।
শিউলিও তার কোন ব্যতিক্রম হয় নি। সন্তানদের একবার বলে নি, ওদের বাবা অন্যায় করেছে।
এত কিছুর পরেও আকাশের তারা গুলো ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। শিউলির ভালবাসা যদি কোন তারা হয়ে থাকে, তা হলে তার ভালবাসা এখনো আগের মতই জ্বল জ্বল করছে। পুরনো স্মৃতিগুলো এক এক করে মেঘের মত চোখের সামনে দিয়ে ভেসে ভেসে যায়।
মাঝে মাঝেই, শিউলির, রাতের নিস্তব্দতায় ভেঙ্গে, ভীষণ জোড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে।
নভেম্বর ২২, ২০১৪