মনটা খুবই খারাপ।

গত শুক্রবার (২৭ শে জুলাই, ২০১৮) ডালাসের বাঙালিদের মুরুব্বী আতিয়ার রহমান কাকা বাবুকে তার চির স্থায়ী ঠিকানায় রেখে আসলাম। তিনি এক মাস লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তাকে পৃথিবীর সর্বাধুনিক চিকিৎসা ও প্রযুক্তি ধরে রাখতে পারলো না। ৯১ বছরের একটা জীবনের অবসান হলো। বলা যেতে পারে তিনি দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি মানুষকে সেবা করা ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সময়টা কতটাই না অপ্রতুল ছিল!

বেশ কিছু বছর আগের কথা। আতিয়ার কাকা বাবু আমাকে ফোন করে বললেন, যে তার একটা ক্যাসেট প্লেয়ার দরকার। তার কাছে কিছু ফিতা ওয়ালা ক্যাসেট আছে, সেগুলো তিনি বাজিয়ে শুনতে চান। আমি এই অনুরোধটার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। একবিংশ শতাব্দীতে ক্যাসেট প্লেয়ার জিনিসটার ব্যবহার উঠে গেছে। এখন তো সব কিছুই হয়ে গেছে অন লাইন। তার পরেও উনাকে বললাম, “দেখি কাকা বাবু একটা যোগাড় করা যায় কি-না।”

ডালাসে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কাকা বাবুকে দেখা যেতো একেবারে প্রথমের সারিতে বসে পরিবেশনা উপভোগ করতে। কিছু অনুষ্ঠানে তার সহ ধর্মিণী ও আমাদের সবার প্রিয় কাকিমা, রেজিয়া রহমান কিন্নরী গান গাইতেন। এক সময়ে যে তার দারুণ গানের গলা ছিল, সেটা স্পষ্টই বুঝা যায়। দেশের একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী তার ভাইয়ের মেয়ে। যাই হোক ফিরে আসি কাকা বাবু প্রসঙ্গে। তিনি অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে এক এক করে পরিচিত সবার সাথে কুশল বিনিময় করতেন ও পাশাপাশি অন্যান্য সব খবর নিতেন। স্বল্পভাষী কাকা বাবুর ব্যবহার ও তার ব্যক্তিত্ব বিদেশ বিভুঁয়ে আমাদেরকে একজন মুরুব্বীর ছায়াতলে যাবার একটা অনন্য সুযোগ করে দিতো।

সেই ব্রিটিশ আমলে মুসলমান বাঙ্গালীদের যখন পড়ালেখার দিক দিয়ে এগুনোতে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা, তখন একজন পিতৃহীন হওয়া সত্ত্বেও কাকা বাবু প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি প্রচুর ঘাত-প্রতিঘাতের পর ১৯৪৯ সালে পশ্চিম বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে পুর-কৌশলে (Electrical Engineering) বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে এসে লক্ষ্য করলেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের সাথে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখলেন একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি। কিছু কুচক্রী মহল ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তার জীবনের এই পর্যায়গুলোতে তিনি যেমন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে লড়েছেন, তেমনি অন্যরা বঞ্চিত হয়ে যাতে পিছিয়ে না পড়ে তার জন্যেও উদ্যোগী হয়েছেন। অগণিত মানুষকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে তিনি চল্লিশ বছরের কর্ম-জীবনে বিভিন্ন উচ্চপদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে অবসর নেবার পর একটা নামজাদা বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাথে কনসালটেন্ট হিসেবেও নিয়োগ পান। দেশ ও বিদেশের বেশ কিছু সম্মানিত প্রকৌশল ও ব্যবস্থপনা (Engineering and Management) সংগঠনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।

“সন্দীপন” শব্দটার অর্থ প্রজ্বলন ও উৎসাহিত করা। আমাদের সাদা মনের এই কাকা বাবু এতিম বাচ্চা ও দুস্থ মহিলাদের জীবন সম্পর্কে আশাবাদী করতে এবং সমাজের যোগ্য নাগরিকে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে “সন্দীপন”"নামের একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। সন্দীপন বিনামূল্যে তার কার্যক্রম ও সেবা দিয়ে চলেছে। আতিয়ার রহমান ঢাকার ‘যশোর সমিতি’ র একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। যারা মফস্বল থেকে রাজধানী ঢাকায় এসে সঠিক যোগাযোগের অভাবে প্রয়োজনীয় সুযোগ ও দিক নির্দেশনা পায় না, তাদের জন্যে এই সংগঠন আজও নির-বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছে।

“বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলেই আমার পরিচয়।” তিনি এক পুত্র অভি ও এক কন্যা মিতাকে রেখে গেছেন। পুত্র অভী রহমান ডালাস শহরের বাসিন্দা। তাকে আমি কাছের থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সে দীর্ঘ সময় ধরে একনিষ্ঠ-ভাবে অসুস্থ বাবার সেবা করেছে। এখানে বলে রাখি, কাকা বাবু গত দু বছর ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন এবং তার নিবিড় সেবার দরকার হতো। তার পরে সে শেষের এক মাস একেবারে পুরোটা সময় লাইফ সাপোর্টে থাকা বাবার পাশে উপস্থিত ছিল। অভিকে, তার সু-দীর্ঘ, ক্লান্তিহীন ও অভিযোগহীন পিতৃ সেবা একজন পুত্র হিসেবে অনেক উচ্চ আসনে বসিয়েছে। ঠিক বাবার মতো নিরহংকারী, দায়িত্বশীল পুত্র অভি রহমান পৃথিবীর প্রতিটা সন্তানের জন্যে এক অনন্য উদাহরণ।

আমি আতিয়ার রহমান কাকা বাবুর জন্যে সময়মতো একটা ক্যাসেট প্লেয়ার যোগাড় করতে পারি নি। আমি ঠিক জানি না, অন্য কেউ কাজটা করে দিয়েছিল কি-না; কিংবা তার কাছে সংরক্ষিত সেই টেপগুলো তিনি শুনতে পেরেছিলেন কি-না। অবশ্য এখন তিনি এই সব ইহ-জাগতিক প্রয়োজন থেকে অনেক উর্ধ্বে।

আমার বিশ্বাস ‘সাদা মনের মানুষ’ গুলো আছেন বলেই হয়তো পৃথিবী এখনো বাস যোগ্য আছে। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার সু-দৃষ্টি তাদের উপরে থাকে বলেই তারা সাহায্যের হাত অন্যদের জন্যে মেলে ধরতে পারেন। আমি নিশ্চিত আতিয়ার রহমান কাকা বাবু সে রকমই একজন অসাধারণ মনের মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা শুধু একজন মুরুব্বীই হারালাম না; একজন খাঁটি সাদা মনের মানুষ হারালাম। দোয়া করি, তার বিদেহী আত্মা যেনো পরম শান্তিতে থাকেন।

(তথ্য সুত্রঃ অভী রহমান)

জুলাই ২৯, ২০১৮

কাজী হাসান
quazih@yahoo.com