ঐখানে যেও নাকো তুমি

হবু বর, তার এক বন্ধুকে নিয়ে কন্যা দেখতে এসেছে।

বরের নাম তৌফিক। তিন সপ্তাহের জন্যে দেশে এসেছে। বিয়ে করে, নেপালে হানিমুন করে; পারলে মেয়ের ভিসার ব্যবস্থা করে যাবে। পরে টিকেট পাঠালে মেয়ে যাবে এমেরিকায়। সব মিলিয়ে মেলা কাজ। এর মধ্যে আবার পাঁচ দিন পার হয়ে গেছে। তা ছাড়া বউ নিয়ে গ্রামের বাড়ি যেয়ে নানীর সাথে দেখা করে আসতে হবে। তৌফিকের জন্মের সময় নানী বলেছিল, নাত বউ না দেখা আমি মরব না। এখন নাতির বিয়ের সময় চলে এসেছে, কিন্তু তিনি মহা অসুস্থ। মাস খানেক আগে তার স্ট্রোক করেছিল। স্মৃতিশক্তি এলোমেলো হয়ে গেছে; চোখের দৃষ্টিও বেশ খারাপ। কারোর দিকে আর চোখে চোখ রেখে তাকায় না। যতক্ষণ জেগে থাকে, উদাস দৃষ্টিতে, জানালা দিয়ে বাইরে পুকুর পাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তৌফিকের মা জরুরী চিঠি পাঠালো। বাবা আমি তোর নানীর নাত বউ দেখার ইচ্ছাটা পূরণ করতে চাই। তার ইচ্ছা, এখন আমার ইচ্ছাও হয়ে গেছে। আমি মেয়ে ঠিক করে রেখেছি। অনেক ভাল ফ্যামিলি। খুব সুন্দর দেখতে। লম্বা; গায়ের রঙটা শ্যামলা হলেও দেখতে ভারী মিষ্টি। লন্ডনে ছিল অনেক দিন। কিছু দিন আগে দেশে ফিরেছে। অনর্গল ইংলিশ বলতে পারে। এমেরিকায় তোর কাছে গেলে কোন সমস্যাই হবে না। আমাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে গেছে। তা ছাড়া তোর বিয়ের বয়স তো হয়েছে-ই।

কিন্তু চিন্তায় আসতে পারে না, এমন ধরণের একটা সমস্যা হল। মেয়ে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, সে ছেলের সাথে দেখা করতে চায় না। বিয়ের দিন দেখা তো হবেই। তার পরে যত খুশী দেখতে পারবে। এখন বিরক্ত না করাই ভাল। এই কয়টা দিন সে স্বাধীন ভাবেই, নিজের মত থাকতে চায়। কথাগুলো শুনে তৌফিকের আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। মেয়ের কথা শুনতে শুনতে, তাকে সে এর মধ্যে ভালোবাসতে আরম্ভ করেছে। কি যেন গানটা, আমি তারে চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি। গল্প শুনে একটু একটু ভালবাসতে.........। বন্ধু তারেক ওই মেয়েকে দেখেছে। সে বলেছিল, একবারে ফাটাফাটি সুন্দরী। তোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এই কথাটা শুনার পর থেকে, যেই মেয়েকে সে এখনো দেখেনি, তার জন্যে ভালবাসা বাড়তে লাগল, একেবারে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে।

আর সেই মেয়ে কি-না বলে হবু বরের সাথে দেখা করবে না। তৌফিকের মনে হল, ডাল’মে কুছ কালা হ্যায়। নিশ্চয়ই সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। এই বিয়েতে হয়ত তার মত নেই। ঘটক পারভিন খালা কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিল। আরে দূর দূর। ওর মত স্মার্ট মেয়ে পাচ্ছিস; তোর সাত পুরুষের ভাগ্য। বিয়ের পর সারাক্ষণ তোকে বড় বড় চোখ করে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, তাই তোর চোখ দুটোকে কিছুটা রেস্ট দিয়ে নিচ্ছে। আর বিয়ের আগে প্রেম ফ্রেম নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বিয়ের রাতেই সবাই সেটা ভুলে যাবে।

চার বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি শেষ করতে ছয় বছর লেগে গেল। এক সময়ের মেলা স্বপ্নের এক জায়গা ছিল এমেরিকা। তৌফিক সেখানে পৌঁছানোর পরের দিনই বুঝল, বাস্তবের সাথে স্বপ্নের অনেক পার্থক্য। বিশেষ করে তার মত বাঙালি মধ্যবিত্ত ছেলের জন্যে। বাবার দেওয়া টাকা প্রথম সেমিস্টারের বেতন আর প্লেন টিকেট কিনেই প্রায় শেষ। পঞ্চাশ টাকা দিলে এক ডলার। বাংলাদেশে সেই টাকা দিয়ে কত কিছু কেনা যায়। আর এখানে একটা বার্গারও এক ডলারে হয় না।

শুধু বার্গার খেলেই তো চলে না। আরও কত কিছু দরকার। দ্বিতীয় দিনেই বাকী টাকা শেষ হয়ে গেল। এই ইউনিভার্সিটিতে সে সময় আর কোন বাঙালি ছাত্র ছিল না। সব চেয়ে কম খরচ দেখে তৌফিক এখানে এপ্লায় করেছিল। ক্যানসাস স্টেটের এক পাড়া গাঁয়ে। আগে কখন মনে হয় নি, এমেরিকায় এ রকম জায়গা থাকতে পারে। ক্যাম্পাস এরিয়া বাদ দিলে, একেবারে বাংলাদেশের আশির দশকের দিনাজপুর কিংবা যশোর।

ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল এডভাইসার অফিসে পরিচয় হল ভারতীয় মেয়ে গীতার সাথে। ওখানেই পার্ট টাইম জব করে। এসেছে তিন বছর হল। সবার সাথে তার চেনা জানা। দশ মিনিটের মধ্যে তৌফিকের দিদি হয়ে গেল। হিন্দি মুভি দেখে শেখা ভাষা বেশ কাজে লাগলো। তার থেকেই খবর পেল, এখানে দু জন ভারতীয় শিক্ষক আর ছয় জন ছাত্র আছে। একেবারে অজ জায়গা বলে, বেশ কিছ ভারতীয় ছেলে মেয়ে কিছু দিন থেকে এদিক ওদিক চলে গেছে। তবে, বাংলাদেশ থেকে তৌফিকই প্রথম।

বেশ অনেক্ষন ধরে তৌফিক আর তার বন্ধু পিয়াস বসে আছে। প্রতিটা মিনিটকে অনেক অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। টেনশানে হৃদ কম্পন বেড়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। গলার থেকে আওয়াজ বের হবে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। ভবিষ্যৎ বউ নিশ্চয়ই নার্ভাস ধরণের একটা ছেলেকে বর হিসাবে দেখে পুলকিত হবে না।

প্রায় আধা ঘণ্টা পরে রিমি আসল। তৌফিক ভাবছিল, হয়তো সাজ-গোজ করতে সময় লাগছে। না সাজ-গোজ সে কিছুই করে নি। পরনে টি শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। পিয়াসকে সে আগের থেকে চিনতো। রুমে ঢুকে বলল, আমার একটা ফোন কল এসেছিল। কথাটা সারতে সারতে একটু সময় লেগে গেল।

তৌফিকের মাথায় আসলো না; একটা মেয়ের কাছে হবু বরকে বসিয়ে রেখে বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলাটা, কি করে, বেশী জরুরী হতে পারে। বুঝতে পারলো না, তার এখন কি বলা উচিৎ। পিয়াস দু একটা কথা বলে বলল, তোমরা কথা বল, আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি।

গীতা তিন দিনের মধ্যে তৌফিকের জন্যে কাজের ব্যবস্থা করে দিল। একটা রেস্টুরেন্টের থালা বাসন ধোয়ার কাজ। এক সময়কার জোকস, তার জীবনে সত্যি হয়ে ধরা দিল। সে এমেরিকায় এসে DC মানে ডিশ ক্লিনারের হয়ে গেল। বাহ কি মজা। বাবা-মাকে চিঠি দিবে, তোমাদের স্বনামধন্য ছেলে এখন DC। না সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তারা মন খারাপ করবে। ছেলে কি-না তাদের থালা বাসন ধোয়। মানুষজনকে তারা কি বলবে!

তার পরে চলল, পড়ালেখা আর কাজ, কাজ আর পড়ালেখার জীবন। আয় কর, আর সেই টাকা দিয়ে ইউনিভার্সিটির খরচ সামাল দাও। অন্য কোন দিকের তাকানোর সময় নেই। যেই ভাবে সম্ভব পড়ালেখা শেষ করতে হবেই। নানী রসিকতা করে বলেছিল, দেখিস আবার মেম বিয়ে করে ফেলিস না। নাহ সেই সম্ভাবনা নাই। কোন দিকে তাকাবার অবকাশ পর্যন্ত পেল না।

তৌফিক ক্যানসাসের অজ পাড়া গাঁয়ে ছিল তিন সেমিস্টার। ছোটবেলার বন্ধু শফি এর মধ্যে টেক্সাসের ডালাসে এসেছে। বলল, তুই চলে আয় এখানে। বড় শহর, চাকরী বাকরির অভাব নাই। বাঙালিও আছে অনেক। এই দিক সেই দিক থেকে দাওয়াত পাওয়া যায়। পোলাও, বিরানি খেতে বেশ লাগে। আমার সাথে থাকবি। খরচ পাতিও কম হবে। এই কথা শুনে, তৌফিক আর দেরি করল না। পরীক্ষা যে দিন শেষ হল, সেই দিন সন্ধায় গ্রে হাউন্ড বাসে যেয়ে উঠলো। বাসে তুলে দিতে আসল, পরোপকারী দিদি গীতা। গম্ভীর মুখে বলল, তোমার জন্যে টেক্সাস ভাল হবে। নিজের মানুষের সাথে থাকতে পারবে, নিজের ভাষায় কথা বলতে পারবে। এত খুব আনন্দের কথা। তার পরেও, কখনো কিছু লাগলে আমার সাথে যোগাযোগ কর। তৌফিক ঠিক বুঝল না, গীতা দিদি এত গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বলল কেন। তবে কি, সে যা বলছে, তা তার মনের কথা না! এক বার মা বলেছিল, মেয়েরা অনেক কিছু আগের থেকে বুঝতে পারে।

তৌফিক চলে আসল ডালাস।

রিমি চুপচাপ বসে তার আঙ্গুলের আংটি নিয়ে খেলতে লাগল। তৌফিক অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, একটা মেয়ে এত সুন্দর হয় কি করে। কি মায়াবী চেহারা। ক্যানসাসের শীতকালে মাঝে মাঝে, পর পর সাত দিন বরফ পড়ে। তার পরে চারি দিকে অদ্ভুত সুন্দর, ঝকঝকে সাদা রঙের একটা আবরণ তৈরি হয়। মনটাকে অনাবিল শান্ত করে দেয়। কি আশ্চর্য, এই মেয়েটার মধ্যে মনে হচ্ছে তার থেকে বেশী কিছু আছে। তৌফিকের ভীষণ ভাল লাগতে লাগল। এই মেয়ের জন্যে সব কিছু করা যায়। এই মেয়ের দিকে সাড়া জীবন তাকিয়ে থাকা যায়। এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে পৃথিবীর সব হতাশা ভুলে থাকা যায়।

তৌফিক অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে, কাঁপা গলায় বলল, আপনাকে I mean তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। রিমি কোন উত্তর দিল না। চোখ তুলে পর্যন্ত তাকালো না। মনে হচ্ছে অন্য কোনকিছু নিয়ে সে চিন্তায় মগ্ন। তৌফিক ভীষণভাবে দমে গেল। কয়েক দিন পরে যে মেয়ে তার ঘরের বউ হবে, জীবন সঙ্গিনী হবে; সে কি না তার উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করছে। একটু আগেই পিয়াসের সাথে একেবারে স্বাভাবিকভাবে কথা বলল। তা হলে কি, মেয়ের এই বিয়েতে মত নেই। তবে কি তার ধারণাই ঠিক; সে কি অন্য কোন ছেলেকে ভালোবাসে।

মাথার মধ্যে আকাশ পাতাল অনেক চিন্তা ঘুরপাক করতে লাগল। এত সুন্দর একটা মেয়ে কারো চোখে পড়ে নি; প্রেমের প্রস্তাব পায় নি; সেটা কি করে সম্ভব। মেয়ের বাবা মা কি তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। যতই সুন্দরী হউক না কেন, ঝামেলার মেয়ে বিয়ে না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। জীবনে সুখ পাওয়া যাবে না। তৌফিক অনন্তকালের এক মিনিট চুপ করে থেকে বলল, আপনার কি এই বিয়েতে মত নাই?

তৌফিক চোখ তুলে তাকাল রিমির দিকে। রিমি এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই শান্ত-সুন্দর চেহারা আর নাই। এর মধ্যে মুখ, নাক ফুলে গেছে। চোখের থেকে আগুন বের হচ্ছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বলেছি না, বিয়ের রাতে দেখা হবে। এত জোরাজোরি করে, দেখা করতে এসেছেন কেন? ভয় নাই, আপনার মধু কেও খাবে না।

রিমি কথাগুলো শেষ করে, তৌফিককে একা রেখে চলে গেল। তৌফিক বুঝতে পারলো না, তার এখন কি করা উচিত।

If they break in, you will break out, right T !! বলে হো হো করে হাসতে লাগলো ৬ ফুট লম্বা, ৩০০ পাউন্ড ওজনের বিশালকায় কৃষ্ণাঙ্গ রায়েন স্মিথ। কথাগুলো বলছে, ৫ ফুট ৬ ইঞ্ছি লম্বা হালকা পাতলা তৌফিক খানকে। তৌফিক শব্দটা ঠিক করে উচ্চারন করা মার্কিনীদের জন্যে কঠিন, তাই তৌফিকের কাজের নাম হয়ে গেছে T । রায়েনের পাশে বাঙালি ছেলে তৌফিককে দেখতে নেহায়েত শিশু মনে হয়। ডাউন টাউনের একটা অফিস বিল্ডিঙে ওরা দু জনে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে।

ব্রায়েন কাজ করে রাত ১১ টা পর্যন্ত। T কাজ করে রাত ১১ থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত। কাজটা তেমন কঠিন না। বারোটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। বিল্ডিঙের ভিতরে বাইরে বসানো ক্যামেরার ছবিগুলোর সেখানে দেখা যায়। কখন কোন সমস্যা দেখলে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াটাই দায়িত্ব। বড় সমস্যা, মানে চোর ডাকাত এসে হাজির হলে সাথে সাথে 911 কল করে পুলিশ ডাকাতে হয়।

ব্রায়েনের একেবারে বদ্ধমূল ধারনা, কখন দরজা ভেঙে চোর ডাকাত আসলে, T ওরফে তৌফিক আরেক দিক দিয়ে ছুটে পালাবে। তাই সে T কে রসিকতা করে বলত, you will break out, right!!

তৌফিকের পড়া লেখার করার সময়ে চাকরিটা বেশ কাজে দিল। বলতে গেলে বসে থাকা ছাড়া তেমন কোন কাজ নেই। ক্লাসের হোম ওয়ার্ক নির্বিঘ্নে করে ফেলতো। কাজ শেষে বাসায় যেয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে, ক্লাসে ছোটা। আয়ের টাকা দিয়ে পড়ালেখার খরচ চলে যেত। মাসের শেষে ব্যাঙ্কে অল্প কিছু টাকাও জমত। দিনের বাকীটুকু সময় কাটতো স্বপ্ন দেখে আর পরিকল্পনা করতে করতে। পরীক্ষা শেষ হবে, চাকরি হবে, দেশে যেয়ে বিয়ে করে বউ আনবে-----এ ধরণের আরও কত কি।

রিমির বাবা কুদ্দুস আলি সরকারী কর্মচারী। আগে ঢাকার বাইরে পোস্টিং ছিল। এখন ঢাকায়। একটা সরকারী সংস্থার কর্ণধার। ড্রাইভার, মালি, দারোয়ান আর কাজের মানুষেরা সারাক্ষণ ছুটাছুটি করে। রিমির ভাই রনি; বয়সে চার বছরের ছোট। মা আদর্শ গৃহ বধূ। সারাক্ষণ বাসায় থাকে। কথা বার্তা বলে কম। প্রায় দিনই দেখা যায়, বিকালে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। আবার রাতে অনেক সময়ে নীরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বাবার ঘুম থেকে দেরী করে উঠার অভ্যাস। বাসায় সাধারনত মাঝ রাতের পরে ফিরে। ছেলে মেয়ের তেমন একটা কথা বার্তা বলে না। যখন ফিরে তখন বাচ্চারা ঘুমিয়ে, আর দিনের বেলা বাচ্চারা স্কুলে চলে যাওয়ার বেশ পরে ঘুম থেকে উঠে। ছুটির দিনগুলো অবশ্য বাচ্চারা, তাদের বাবাকে দেখতে পায়। কিন্তু কুদ্দুস আলির বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর ব্যাপারে আগ্রহ নাই বললেই চলে।

রিমি এক ছুটির দিন সন্ধায় দেখলো, বাবা তার বিশ্বস্থ ড্রাইভারকে ডেকে ফিস ফিস করে কিছু বলল। তার পরে ড্রাইভার একাই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। তার আগে কুদ্দুস আলি বাড়ির সব কাজের লোক, মালি, দারোয়ানকে এক দিনের ছুটি দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। শুধু ছুটি পেল না, ড্রাইভার সাত্তার। তার পরে কুদ্দুস আলি, তার স্ত্রীকে কঠিন গলায় বলল, যাও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কোণার রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকো। খবরদার, ওখান থেকে বের হবে না। ।

ড্রাইভার ঘণ্টাখানেক পরে ১২-১৩ বছরের একটা মেয়ে নিয়ে আসলো। মায়ের সাথে সাথে, রিমিও পর্দা সরিয়ে এটা দেখলো। মেয়েটার কেমন যেন অদ্ভুত সাজ। একটা নীল রঙের শাড়ি, ঠোঁটে কড়া লিপষ্টিক। মা জানালার ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ থেকে অশ্রু পড়তেই থাকলো। শুধু একবার বিড় বিড় করে বলল, বাচ্চারা এত ছোট না হলে, আজকেই গলায় দড়ি দিতাম।

বাবা মেয়েটাকে তার শোবার ঘরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।

রিমির বয়স তখন কত?

যে মেয়েটাকে নিয়ে আসা হয়েছে, ঠিক তার-ই বয়সের।

তৌফিক পরীক্ষায় পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হল। কিন্তু এমেরিকায় তখন অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ। মন্দা চলছে। বিদেশীদের চাকরি পাওয়া কঠিন। বেচারার সোনার হরিণ চাকরি ধরা দিল না। দেশের অবস্থা প্রতিদিনই তার আগের দিন থেকে বেশী খারাপ হতে লাগল। সংবাদে শুধু হাজার হাজার মানুষ লে অফের খবর। ভাগ্যিস রাতের সিকিউরিটি গার্ডের কাজটা ছিল।

সাধের আরামের কাজে একটা সমস্যা বাধলো। মাঝ রাত তখন। বিল্ডিঙের মেন দরজা সন্ধ্যার দিকের বন্ধ করে লক করে দেয়া হয়। পেছনেও একটা দরজা আছে। শুধুমাত্র কর্মচারীরা সেটা ব্যবহার করে। মেন দরজার চাবি, যে সিকিউরিটি গার্ড ডিউটিতে আছে, তার কাছে একটা। আরেকটা চাবি থাকে বিল্ডিঙের মালিকের ছেলে টমের কাছে। তৌফিক দেখলো হন্তদন্ত হয়ে মেন দরজা খুলে দরজা দিয়ে টম ঢুকছে। চিৎকার করে বলল, পুলিশ ডাকো, পুলিশ ডাকো। ওরা আমাকে ফেরে ফেলবে।

তৌফিকের কিছু বুঝার আগে, দু জন বিশাল আকারের কৃষ্ণাঙ্গ পিছনে পিছনে ঢুকলো। এর মধ্যে টম সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠা আরম্ভ করেছে। ওরা যেয়ে পেছন থেকে ধরল টমকে। তার পরে আরম্ভ হল; কিল, ঘুষি, লাথি। ভ্যাবাচ্যাকা তৌফিক কি করবে বুঝতে পারলো না। ফোনে 911 কল করে শুধু ফিস ফিস করে বলল, হেল্প, হেল্প। তার পরে মাথায় এলো, পালাতে না পারলে, জীবন এখানেই শেষ। পেছনের দরজা দিয়ে বের হতে ইচ্ছা হল না। ওখানে যদি আবার কেও থাকে। বসার ভারী চেয়ারটা ছুঁড়ে মারল কাচের দেওয়ালে। ঝন ঝন শব্দে কাঁচ ভেঙে পড়তে লাগল। মেটালের চেয়ারটাও মেঝেতে পড়ে যেয়ে বিকট শব্দ করল। এত শব্দ আর তার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি মিলিয়ে বড় ধরণের আওয়াজ তৈরি হল।

মারধরে ব্যস্ত মানুষ দু জনের কানেও এই শব্দ গেল। ভাবল হয়তো মানুষজন আর পুলিশ চলে এসেছে। তারা সিঁড়ি দিয়ে নেমে ভোঁ দৌড়। কোন দিকে তাকিয়ে আর সময় নষ্ট করল না। তৌফিক তিন তলার সিঁড়িতে রক্তাক্ত অবস্থায় টমকে পেল।

টম রাতের বেলায় বিল্ডিঙের বাইরের লাইটগুলো ঠিক করে কাজ করছে কি-না, সেটা দেখতে এসেছিল। সেখানে সে আক্রান্ত হয়। অনেকে বলে, বিষয়টা ছিল hate crime. কালোরা সুযোগ পেয়ে একজন সাদাকে রাতের গভীরে খুন করতে চেয়েছিল।

তৌফিক কাঁচ break করল, কিন্তু break out করল না।

টম তৌফিককে অনেক ধন্যবাদ দিল, তার জীবন বাঁচানোর জন্যে। বলল বেতন বাড়িয়ে ডবল করে দিবে। কিন্তু তৌফিক কাজ থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে আসল। এ রকম বিপদজনক জায়গায় কাজ করতে আর সাহসে কুলাল না। রায়েন স্মিথকে আর বলা হল না, I did not break out.

রিমির বাবার ঘর থেকে মেয়েটার চিৎকার সবাই শুনতে পেল। তার পরে কান্নার শব্দ। কিছুক্ষণ পরে কুদ্দুস আলি দরজা খুলল। ড্রাইভারের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, ভাল মাল একেবারে ভার্জিন। অনেক দিনের একটা সাধ পূরণ হল। কচি বিড়াল মারার অন্য রকম সুখ। তবে একেবারে রক্তারক্তি করে দিয়েছে। এর বাবাকে এক শ টাকা বাড়তি দিয়ে দিও। যদি আবার ডাক্তারের কাছে নিতে হয়।

মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে, ড্রাইভারের সাথে বাড়ি থেকে বের হল। শরীরে শাড়িটা প্যাচান। ঠোঁটের লিপস্টিক, সাজসজ্জা কিছু আর অবশিষ্ট নাই। সে কারোর দিকেই তাকাল না। কিন্তু, মা, রিমি বাড়ির মেন দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাবা একটা বিজয়ের হাসি দিয়ে বলল, যাও যাও সবাই। ঘুমাও যেয়ে। এখানে সময় নষ্ট করার দরকার নাই।

এক ঘণ্টা পরে এক অদ্ভুত ঘটনা হল। রিমি ভীষণ একটা আর্ত চিৎকার দিয়ে বিছানা থেকে উঠলো। হাতের সামনে যা পেল তাই ছুড়তে লাগল। আর মুখে অশ্রাব্য গালি গালাজ। বাবা বিরক্ত হয়ে রিমির ঘরে আসল। রিমি তাকে আক্রমন করল। চিৎকার করে বেশ একটা পুরুষালী গলায় বলতে লাগল, আমি মৌলানা জব্বার আলি। মসজিদের ইমাম। গ্রামের মোড়ল। চার গ্রামের মানুষ আমার মুরিদ। তুই কি-না, আমার ছেলে হয়ে দুনিয়ার সব খারাপ কাজগুলো করছিস। এত দিন ঘরের বাইরে মদ খেয়ে মেয়ে ছেলে নিয়ে ফুর্তি করেছিস, আর এখন কি-না বাড়ির মধ্যে বাচ্চা মেয়ে নিয়ে এসে বেশ্যা বানাচ্ছিস, তুই কি মানুষ, না কি পশু। বউ আর ছেলে মেয়ের সামনে কি করে এই কাজ করলি। চড়, থাপ্পড় আর খামচি দিয়ে বাবার রক্ত বের করে ফেলল। বাবা ড্রাইভারকে নিয়ে রিমির হাত পা বাঁধল। মুখে টেপ দিয়ে দিল। যাতে শব্দ করতে না পারে।

ড্রাইভার বলতে লাগল, রিমি আপুকে জ্বীন ধরেছে। ইয়া আল্লাহ-মাবুদ রক্ষা কর।

যেই বাবা, নির্মম অসামাজিক কাজ করতে সমাজ কিংবা পরিবারের কথা ভেবে, বিন্দু মাত্র দ্বিধা করে না, সেই বাবা; মা আর ড্রাইভারকে শাসিয়ে বলল, খবরদার জ্বীন ধরার খবর যাতে বাইরের কেও জানতে না পারে। একেবারে কাক-পক্ষী পর্যন্ত না।

১০

রিমি আর তৌফিকের বিয়ে হয়ে গেল। তৌফিকের আপত্তি ধোপে টিকলো না। সবার এক কথা, মেয়ের বিয়ের আগের জীবন নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই। মেয়ে দেখতে শুনতে ভাল। এর থেকে বেশী কি আর দরকার। তৌফিকের প্রতিবাদ চলতে লাগল। কাজটা কি সে ঠিক করছে। লোকে যে যাই বলুক, এটা তার নিজের জীবনের ব্যাপার। কিন্তু, কিছু সময়ে ছেলেরাও দুর্বল হয়ে যায়। মুখ থাকলেও চিৎকার করতে পারে না।

তৌফিককে অবাক করে দিয়ে, লন্ডন ফেরত লাল শাড়ী পরা রিমি, বিয়ের রাতে, সেই ঐতিহ্যবাহী ধারায় স্বামীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। অবাকের পালা আরও বাড়িয়ে দিয়ে, শরীরে শরীর লাগিয়ে বলল, দোয়া কর, আমরা যাতে সুখী হই। তৌফিকের, রবীন্দ্রনাথের গল্পের চরিত্রের মত চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, আমি সম্পত্তি না, সম্পদ পেয়েছি।

১১

কুদ্দুস আলি আর মেয়েকে দেশে রাখল না। লন্ডনে পাঠিয়ে দিল। অনিয়মিতভাবে রিমিকে জ্বীন আসর করছিল। তবে সব সময় সে যে কুদ্দুস আলির বাবা হল, তা কিন্তু না। এক বার সে কুদ্দুস আলির স্ত্রী মানে নিজের মা হয়ে গেল। স্ত্রী হয়ে স্বামীর অধিকার নিয়ে যুদ্ধ করল। তাও ভীষণ চিৎকার করে, তুমি বাড়ির বউ রেখে বেশ্যাদের কাছে যাও, তোমার কি লজ্জা বলে কিছু নেই।

এই ঘটনার পরে জব্বার আলি বউকে যেয়ে প্রচণ্ড মার ধর করল। দাঁত কিড় মিড় করতে বলল, আমার সাথে শয়তানি। মেয়েকে দিয়ে অভিনয় করাস। আমার সাথে পোষালে থাকবি; না হলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি। মা কিছু বলল না। মার খাওয়া শেষ হলে, জানালার পাশে যেয়ে অনেকক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলো।

তার কিছু দিন পরে, এক সন্ধ্যার দিকে ড্রাইভার এসে জানাল, স্যার আমাদের গাড়ি চুরি হয়ে গেছে। বারান্দার সামনে থেকে গাড়ি গায়েব। চারি দিকে হৈ চৈ। বেশ কিছুক্ষণ পরে, রিমি গাড়ি চালিয়ে গেট দিয়ে ঢুকল। সবার চোখ টেনিস বলের মত বড় হয়ে গেল। রিমি যে গাড়ি চালাতে জানে, তাই কেও এসে জানত না। রিমি এসে বাবাকে, ড্রাইভারের মত সুর করে বলল, অনেক খুঁজলাম স্যার। আজকে কোন কচি মেয়ে পেলাম না।

১২

তৌফিক দেশের থেকে ফিরে আসার দু সপ্তাহের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনের একটা চাকরি পেল। ফোন করে রিমির সাথে অনেক্ষন কথা বলল। এ কথা, সে কথা বলার পরে, তৌফিক বলল, প্রায় রাতেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে। রিমি বলল, যাও দেরী করছ কেন, ডাক্তার দেখাও।

তৌফিক এক জন বাঙালি ডাক্তারের খোঁজ পেল। তার কাছে যেয়ে বলল, দেশের থেকে ফেরার পর থেকে এই সমস্যা। ডাক্তার সামসুজ্জামান চৌধুরী বলল, আপনার রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। তবে এই ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। কিছুটা উপকার পাবেন।

কয়েক দিন ভালই ছিল। জ্বর তেমন আসতো না। চার দিন পরে, সকাল বেলাতেই তুমুল জ্বর আসল। মাকে ফোন করে বলল, মা খুব কষ্ট। বিছানা থেকে পর্যন্ত উঠতে পর্যন্ত পারছি না। মা বলল, রিমিকে তা হলে পাঠিয়ে দেই। ওর তো ভিসা হয়েই আছে।

১৩

তৌফিক দুর্বল শরীরে রিমিকে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় নিয়ে এলো। তেমন বেশী কথা হল না। রিমিক বেশ গম্ভীর হয়ে ছিল। তৌফিক ভাবল হয়তো এত লম্বা জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। বিয়ের রাতের কথা ভেবে, এই শরীরেও রোমাঞ্চিত হল। হিসেব করল, আজকে তেত্রিশ দিন হয়ে গেছে রিমিকে ছোঁয়া হয় নি। আবার, এইটাও মনে হল রিমি রেগে নেই তো। মা বলেছে, রিমি এত তাড়াতাড়ি আসতে চাচ্ছিল না। কিন্তু, ওর বাবা রিমিকে বলেছে জামাইয়ের শরীর খারাপ। অকারণে দেশের থাকার কোন মানে হয় না।

বাসায় ফিরে তৌফিকের আবার জ্বর। একেবারে আকাশ পাতাল। রিমি মাথায় পানি ঢাললো। আবল তাবোল বকতে তৌফিক জ্ঞান হারাল। রিমি বুঝতে পারলো না, বিদেশ বিভুঁয়ে এখন তার কি করা উচিত। বিছানার পাশে ডাঃ চৌধুরীর একটা বিসনেস কার্ড পেল।

১৪

তৌফিকের যখন জ্ঞান ফিরল, সে তখন হাসপাতালের বিছানায়। চিন্তা করার চেষ্টা করল, সে এখানে এলো কি করে। এক এক করে সব মনে পড়ে গেল। কিন্তু রিমি কোথায়। ও তো মাত্র এই দেশে এসেছে। ও কিভাবে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। তার তো হাসপাতাল কোথায়, তাই জানার কথা না। নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, সে এখানে কিভাবে আসল। নার্স জানাল, তোমাকে ডাঃ চৌধুরী নিয়ে এসেছে।

নার্স রিমির কথা কিছু বলতে পারলো না। মেয়েটা একা একা কি করছে বাসায়। নার্স বলল, সে গত দু দিন ধরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তার রক্তে কোন জীবাণু প্রবেশ করেছে। রক্তের রেড সেল কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। তবে এখন অবস্থার ভালোর দিকে। খুব সম্ভবত অন্য কোন দেশের জীবাণু তার শরীরে ঢুকেছে। ডাক্তারদের মূল সমস্যা বের করতে বেগ পেতে হয়েছে।

তৌফিকের মাথায় একটা বিষয় ঘুরপাক খেতে লাগল, রিমি কোথায়? রিমি কোথায়? নিজের উপরে খুব জিদ হতে লাগল। নতুন বউকে বাড়িতে এনে সে কি-না অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকল। বিধাতাকে বলতে ইচ্ছে হল, তার পৌরুষ এত অল্পতে ধরাশায়ী না হলে, কি হত না!

১৫

ডাক্তার চৌধুরী তৌফিককে হাসপাতালে দিয়ে রিমিকে বলল, আপনি একা একা কি করে থাকবেন। তা ছাড়া মাত্র দেশ থেকে এসেছেন। তৌফিক ভাল না হওয়া পর্যন্ত আপনি না হয় আমার বাসাতেই থাকুন। রিমি রাজি হয়ে গেল। কিন্তু ডাক্তারের বাসায় এসে দেখল, তার স্ত্রী দেশে গেছে। ফিরবে মাস খানেক পরে। বাসায় আছে শুধু তার দশ বছরের ছেলে, রতন ।

ডাক্তারের বাসা বিশাল। দামি ফার্নিচার দিয়ে সাজান। সে তুলনায় তৌফিকের কিছু নাই। কয়েক দিন আগে চাকরিটা পেয়েছিল, সম্ভবত সেটা আর নাই। এমেরিকায়, কর্মচারী সুস্থ হয়ে ফিরে যেয়ে কাজ করে দেবে, সে অপেক্ষায় মালিকের বসে থাকার কথা না। আয় রোজগারবিহীন মানুষ নিজে খাবে কি, আর বউকেই বা কি খাওয়াবে।

প্রথম ইঙ্গিতের কথা রিমিই বলল। আপনার মাথার টাক তো কেমন একটা সেক্সি ধরণের। বলে, ডাক্তারের মাথায় এসে হাত বুলাতে লাগল। ডাক্তার তার অর্ধেকেরও কম বয়সের একটা মেয়ের মেয়ের সাথে ওই রাতেই মিলিত হল। এক জন পুরুষের পক্ষে হয়তো একটা মেয়েকে নির্জনে পেয়ে না বলাটা ভীষণ কঠিন কাজ। খুবই অদ্ভুত, বিয়ের তিন মাস পার হওয়ার আগেই, রিমি পর পুরুষের বিছানায়। তার স্বামী কি না হাসপাতালে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

১৬

ডাক্তার তৌফিককেও তার বাসায় নিয়ে আসল। এর মধ্যে সে তৌফিক আর রিমিকে দু জনকে তুমি করে বলা আরম্ভ করেছে। তৌফিকই এই অনুরোধ করেছিল। ডাক্তারের সাহায্য আর আতিথেয়তায় তৌফিক একেবারে মুগ্ধ। ভাগ্যিস রিমি বুদ্ধি করে ডাক্তার চৌধুরীকে ফোন করেছিল। না হলে তার কি অবস্থা হত! আর রিমিই বা কোথায় যেয়ে দাঁড়াত!

তৌফিককে ঘুমের ওষুধ দেয়া হচ্ছিল। সে জন্য সে বেশীর ভাগ সময়ই ঘুমায়। কখন যে রাত হচ্ছে, কখনই বা দিন তা মাথার মধ্যে খেলছিল না। ঘুম ভাঙলে রিমি রিমি করে ডাকে। রিমি এসে বলে, তোমার ঘুম ভাঙল? তারপরে মুখে কিছু দেওয়া। এর কিছুক্ষণ মধ্যে ডাক্তার এসে হাজির হয়। এসেই একটা ইঞ্জেকশান। আবার ঘুম। অনেক ঘুম। আবার ঘুম।

১৭

তৌফিকের যখন ঘুম ভাঙল, তার মনে হল রাত। ঘড়িতে সময় দেখল তিনটা এগারো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল; অন্ধকার। নিশ্চিত হল এখন রাত। কিন্তু রিমি নাই ওর পাশে। ভাবল বাথরুমে। ওখানেও অন্ধকার। কিছুটা শক্তি জোগাড় করে বিছানা থেকে উঠলো। আশে পাশের কামরাগুলো অন্ধকার।

মনে হল, কোণার একটা কামরায় লাইট জ্বলছে। সেখান থেকে কথা বার্তা বলার শব্দ আসছে। পা টিপে টিপে দরজার সামনে যেয়ে দাঁড়াল। ভিতর থেকে ডাক্তার আর রিমির গলার আওয়াজ আসছে। আস্তে করে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভিতর থেকে বন্ধ ছিল না। চোখে যা দেখল, তা না দেখলেই ভাল ছিল। রিমি, ডাক্তার দু জনের গায়ে কোন কাপড় নাই। রিমির বুকের মধ্যে ডাক্তারের মুখ.........।

ওই রাতেই ট্যাক্সি ডেকে তৌফিক বাসায় ফিরল। বের হওয়ার সময়ে, মুখের সবগুলো থুথু একসাথে করে ডাক্তারের মুখে ছুড়ল। বলল, তুই নরকের কীট। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এমন সর্বনাশ করলি। তোর মুখ দেখে মনে হয় নি তুই এত বড় শয়তান।

১৮

সকাল হতে না হতেই রিমি এসে হাজির। এমন ব্যবহার করতে লাগল, যে কিছুই হয় নি। একেবারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, আমাকে না নিয়ে চলে এলে যে। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি তুমি নেই। পরে ডাক্তার ভাই আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। তৌফিক বলল, কেন তোমার কি কালকের রাতের কথা মনে নাই। রিমি বলল, কেন কালকে কি হয়েছে?

তৌফিক চিন্তা করল, ডাক্তার হয়তো তার মত রিমিকে কোন ইঞ্জেকশান দিয়ে তার কু ইচ্ছাগুলো মিটিয়েছে। রিমিকে খুব নিষ্পাপ মনে হল। নোংরা কথাগুলো বলে ওর মনটা বিষিয়ে তুলতে ইচ্ছা করল না।

তৌফিক রিমিকে তার বুকের মধ্যে টেনে নিল।

১৯

রিমির আর ডাক্তারের সম্পর্ক চলতে লাগল তৌফিকের অগোচরে। তৌফিক এক দিন বাসায় এসে দেখে রিমি নাই। অস্থির হয়ে পায়চারী করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে জানালা দিয়ে দেখে, ডাক্তারের গাড়ি থেকে রিমি নামছে। তার পরে ডাক্তার বের হয়ে রিমিকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে রস নিতে লাগল। মনে হল অনেক দিনের জমানো তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে।

রিমি ঘরে ডুকে তৌফিককে দেখে অবাক হল না; বলল, কি ব্যাপার আজকে আগে আগে চলে এসলে যে! বউয়ের উপরে খবরদারি করার জন্যে না কি? তৌফিক উল্টো প্রশ্ন করল, ডাক্তারের সাথে তোমার কি সম্পর্ক। রিমি নির্দ্বিধায় উত্তর দিল, কেন জান না, আমি ওকে ভালবাসি।

২০

মোটামুটি একই সময়ে দুটো ঘর ভেঙ্গে খান খান হল। ডাক্তারের বউ দেশের থেকে ফিরে এসে সন্তান রতনের কাছ থেকে অনেক কথা শুনলো। সাথে সাথে মেলা প্রমাণ উদ্ধার হয়ে গেল। ডাক্তার অনেকভাবে অস্বীকার করল, ছোট বাচ্চা কি দেখে, কি বুঝেছে। কিন্ত বউ ডিভোর্স ফাইল করল। আমার বাপের টাকাতে বিদেশ এসে ডাক্তার হয়ে, পীড়িত কর অন্য মানুষের বউয়ের সাথে। এ রকম মীর জাফরের সাথে আমি ঘর করি না।

রিমিও তৌফিককে ছেড়ে বের হয়ে এলো। না ডাক্তারের কাছে যেয়ে উঠলো না। এর মধ্যে নতুন এক কৃষ্ণাঙ্গ ভক্ত হয়েছে। তার এপার্টমেন্টে যেয়ে উঠলো। নাইজেরিয়া থেকে এসেছে। বউ বাচ্চা দেশে। কিছু দিনের মধ্যেই রিমি কৃষ্ণাঙ্গের বউয়ের কাছে তাদের একান্ত অন্তরঙ্গ সব ছবি পাঠালো।

২১

গত বাইশ বছরে রিমি কয়টা ঘর ভেঙ্গেছে, তা চট করে বলা, সম্ভবত তার জন্যেও কঠিন। এই শহর, সেই শহর করতে করতে এখন সে লস এঞ্জেলেসে থাকে। ডালাস থেকে অনেক দূরে। ঘটনাক্রমে পরিচয় হল সাইক্রিয়াটিক ডঃ রবার্টের সাথে। ডঃ এক্সপেরিমেন্ট করছিল, মালটিপাল পারসোনালিটি (Multiple Personality) নিয়ে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, তার পরীক্ষার জন্যে কিছু মানুষ দরকার। সে নিজে ইন্টারভিউ করে মানুষ বাছাই করে নিবে। বিনিময়ে ভাল টাকা দেওয়া হবে।

রিমির সে সময়ে টাকার খুব দরকার। সে উৎসাহ জানিয়ে ফোন করলো। এই কথা সেই কথা বলতে, ডঃ বুঝল রিমি জীবনের জটিলতা, তার পরীক্ষার সাথে মিলে যাচ্ছে। বলল, তুমি খুব ইন্টারেস্টিং। তোমাকে আমি সিলেক্ট করলাম, আমার সাথে কাজ করার জন্যে।

ডঃ রবার্ট রিমিকে বিভিন্ন ধরণের টেস্ট করে; শেষে হিপনোটাইসড করলো। রিমির অবচেতন মন বলে চলল, সেই ছোট বেলায় বাবা যে তার বয়সের একজন বালিকাকে বাড়িতে এনে রক্তাক্ত করেছিল, রিমি তার প্রতিশোধ নিয়ে চলেছে একের পর এক। যখন কোন বিবাহিত পুরুষ সে দেখে; তখন তার মন অস্থির হয়ে উঠে কি করে তার লোকটার সংসার ভাঙ্গা যায়।

ডঃ রবার্ট পরে বলল, তুমি ছোট বেলায় যে আতঙ্কের (trauma) মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলে, তোমার অবচেতন মন সেটা ভুলতে পারে না। বারে বারে তাই তুমি পুরুষদের উপর আঘাত করে তাদের জীবন তছনছ করে দাও। তোমার মন তখন মনে করে, তুমি তোমার বাবার উপরে প্রতিশোধ নিচ্ছ। মালটিপাল পারসোনালিটির কারণে হয়ত এ রকম হতে পারে। মালটিপাল পারসোনালিটির মানুষের মধ্যে দুই কিংবা আরও মানুষের ব্যক্তিত্ব চলে আসতে পারে। ছোট বেলার trauma তাদের মনে গেঁথে থাকে। বেশীর ভাগ সময়ে তাদের লক্ষ্য থাকে, অতীতে ফেলে আসা কোন দানবের প্রতিকৃতিকে আঘাত করা। তবে এর চিকিৎসা আছে। তোমার সাথে যদি আমার আগে দেখা হত, তবে হয়ত অনেকগুলো মানুষের সংসার রক্ষা পেত।

২২

তৌফিক আজও ভাবে, সেই এক সময়কার সহ কর্মী ব্রায়েনের কথা,...... you will break out, right !! না তাকে break out করতে হয় নি। রিমি নিজের থেকেই চলে গিয়েছিল। পরে তৌফিক আবার বিয়ে করেছে। বাচ্চা কাচ্চা হয়েছে, ঘর সংসার করছে। সবই হয়েছে, কিন্তু সুখ আসে নি। মুহূর্তের জন্যে ভুলতে পারে নি রিমিকে। সেও বুঝতে চায়, রিমির এমন আচরণের কি কারণ। সে আসলে, আর পাঁচ জনের মত একটু খানি সুখ চেয়েছিল। কিন্তু সেটা হল না। বরং, পুরোটা জীবন ধরে দাউ দাউ আগুনের মধ্যে বুকটা পুড়ে ছাড়খাড় হচ্ছে। জানতে ইচ্ছে করে মেয়েটা এমন করে কি পেল। মনে আসে গীতা দিদির কথা। তার হয়তো ইচ্ছা ছিল না, তৌফিক টেক্সাস যাক। স্পষ্ট চোখে ভাসে বাসে উঠানোর সময় মুখটা কেমন গম্ভীর করে ছিল। একবার না মা বলেছিল, মেয়েরা অনেক কিছু আগের থেকে বুঝতে পারে।

মার্চ ০৯, ২০১২

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com