বিন্দু-বিসর্গ
সকাল এগারোটা মতো বাজে। অফিসে কাজ করছি। কম্পিউটার মনিটরের পাশে মোবাইল ফোনটা রাখা। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের রিং বাজা আরম্ভ করলো। বলতে গেলে অভ্যাস বশতই কল রিসিভ অপশনে আঙুলের আলতো ছোঁয়া লেগে গেল। সাথে সাথেই আই ফোনের পুরো স্ক্রিন জুড়ে সুন্দরী এক ললনার মুখ ভেসে উঠলো। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এটা অডিও কল। কিন্তু ছবি দেখা মাত্রই বুঝলাম এটা অডিও না ভিডিও কল। মাথাটা অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, হঠাৎ মেয়ের ছবি দেখে চিনতে কষ্ট হলো, এটা আবার কে। তবে মুহূর্তেই আবিষ্কার করলাম মেয়েটাকে আমি চিনি।
বাইশ-পঁচিশ বছরের মেয়েটা কিছু দিন আগে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। কমন একজন বন্ধু থাকার জন্যে একসেপ্ট করে নেই। ইদানীং মনে হয় সবাই প্রচুর এই ধরণের বন্ধু হওয়ার রিকোয়েস্ট পেয়ে থাকেন। আমি সাধারণত একসেপ্ট করার আগে ছোট একটা গবেষণা করে নেই। কোন কমন বন্ধু আছে কি-না, এবং তার ইচ্ছা-আগ্রহের সাথে আমার কতটুকু মিল। মেয়েটার পেজে যেয়ে দেখলাম বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ের খবর শেয়ার করেছে। তবে নিজের সম্পর্কে তেমন কিছু লেখা নাই। ছোট তুলতুলে সাদা কুকুর হাতে একটা ছবি দেখে মনে হলো, মেয়েটা হয়তো পশু প্রেমিক। শুনেছি কিছু মানুষ বদ চিন্তা নিয়ে ফেক একাউন্ট খুলে। মেয়েদের ছবি ব্যবহার করে নিরীহদের ফাঁদে ফেলে। দেখলাম একাউন্টটা বেশ কয়েক বছরের পুরনো। তার মানে ফেক হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর বেশী চিন্তা ভাবনা না করে মেয়েটাকে ফেসবুক ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেললাম। তা ছাড়া তরুণ মেয়েদের মনে কষ্ট দেয়া আমার একেবারেই স্বভাব বিরুদ্ধ।
সেও তো মাস খানেক আগের কথা। কিছুটা বিরক্ত হলাম। এখনকার দিনে ফোন ও ভিডিও কল করা বেশী সহজ হয়ে গেছে। কোন বাড়তি খরচ পর্যন্ত নাই। শুধু ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই হলো। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যে কারো নামের উপর চাপ দিলেই কল হয়ে যায়। ফোনের ছবিতে চাপ দিলে শুধু অডিও কল; ভিডিও ক্যামেরার ছবিতে চাপ দিলে একেবারে ছবি সহ কথাবার্তা। যাই হোক এই সব কলা কৌশল এখন সবারই জানা। মেয়েটার কোনো দরকার থাকলে ম্যাসেজ পাঠালেই পারতো। আমি সুযোগ মতো উত্তর দিতাম। সেটা না করে অফিস টাইমে ভিডিও কল করেছে। ভিডিও কলের একটা অসুবিধা আছে। ফোনের স্পিকার চালু হয়ে যায়। আশে পাশের সবাই শুনতে পায় কি কথা হচ্ছে। আমি কথা আরম্ভ করলে অফিসে সহকর্মীদের আগ্রহ বেড়ে যাবে। তারা এসে নানান প্রশ্ন করতে পারে। অফিসে স্পিকার ফোন দিয়ে আলাপ করার রেওয়াজ নাই। অন্যদের কাজের মনোযোগ নষ্ট হতে পারে। মাথার মধ্যে আর কিছু কাজ করলো না। ঠাস করে লাইনটা কেটে দিলাম।
বাহ, শান্তি পেলাম। সহকর্মীদের অকারণ আগ্রহ আমার কাছে উটকো ঝামেলা মনে হয়। আশা করি বিষয়টা ওই পর্যায়ে গড়াবে না। নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর আবার ম্যাসেঞ্জারে রিং বাজতে লাগলো। কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই কলটা একসেপ্ট করলাম। বাম হাতে ফোনটা ডেস্ক থেকে উঠিয়ে নিয়ে ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে সোয়াইপ করলাম। এইবার শুধু আমি ওকে দেখলাম না, সেও আমাকে দেখলো। মহা-উৎসাহে মেয়েটা বলে উঠলো, “ভাইয়া কেমন আছেন?” আমি উত্তর না দিয়ে আবারও লাইন কেটে দিলাম। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উত্তর দিতে ইচ্ছা করলো, “আমি কেমন আছি জেনে তোমার কি লাভ? কল করার কি আর সময় পাও না।”
এর মধ্যে মেয়েটার নাম দেখে নিলাম, অধরা আহমেদ (প্রকৃত নাম না)। টেক্সট ম্যাসেজ করে বললাম এখন ব্যস্ত আছি। তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করবো। নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলাম। বিশ মিনিট পরে জরুরী মিটিং। তার জন্যে কিছু কাগজ পত্র রেডি করতে হচ্ছে। যাই হোক ঠিক সময়মত মিটিঙে পৌঁছে গেলাম। প্রথমদিকে মন দিয়ে সবার কথা শুনলাম। আমার আইডিয়াগুলো উপস্থিত সবাইকে জানালাম। কিন্তু পনেরো মিনিটের মাথায় মনটা একেবারে অন্য দিকে চলে গেল।
অধরা আমাকে কেনো ফোন করলো। তাও আবার ভিডিও কল। আমি জানি মেয়েটা বাঙালি হলেও বাংলাদেশে থাকে না। বর্তমান আবাস এমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায়। বাংলাদেশের সাথে টেক্সাসের সময়ের পার্থক্য পাক্কা বারো ঘণ্টা। এক জায়গায় সকাল দশটা হলে অন্য জায়গায় রাতের দশটা। সে জন্যে দেশের থেকে অসাবধান-বশত কালে ভদ্রে বিদ-ঘুটে সময়ে ফোন আসে। ওই সব ফোনের শব্দে বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠে। কি না আবার দুঃসংবাদ আসে। আত্মীয়স্বজনরা ভালো করেই জানে, কোন সময়ে এমেরিকায় মানুষজন কাজে কর্মে ব্যস্ত থাকে। খুব জরুরী না হলে অফিস আওয়ারে ব্যক্তিগত কারণে কল দেয়াটা আমি পছন্দ করি না।
মিটিং শেষ হলো। আপন মনে হেঁটে কখন যে ডেস্কে চলে এসেছি বুঝতেই পারি নি। দিনের বাকী কাজগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু অবচেতন মন অধরার মুখটা ঝেড়ে ফেলতে পারলো না। মেয়েটার কেমন যেন যাদুকরী চেহারা। কথা বলার সময়ে গালে টোল পড়ছিল। মেয়েটার ফোনের লাইন কেটে না দিয়ে কিছু কথা বললেই পারতাম। কলিগদের প্রশ্নের উত্তর পরে সামাল দিলেই হতো। এখন সে কি না কি ভাবছে। খারাপ লাগা আরম্ভ করলো। আমার মাথায় ঢুকছিল না, আমার কাছে কি দরকার থাকতে পারে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম কারণটা আমাকে জানতে হবে। চেহারা দেখে মনে হয়েছে মেয়েটা কিছু বলতে চায়। কিন্তু আমাকে বলার-ই না কি থাকতে পারে? হেলায় হেলায় তো কম বেলা পার করলাম না। বয়সও কতো বেড়ে গেছে! একজন অপ্সরী নিজে উদ্যোগী হয়ে আমাকে ফোন করছে ভাবতেই একটা ফুরফুরা ভাব চলে এলো। পরের মুহূর্তে নিজেকে শাসন করলাম; না এই লাইনে চিন্তা করাটা ঠিক হবে না। হয়তো অন্য কিছু বলতে চেয়েছিল।
বহুদিন ধরে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে যুক্ত আছি। কিছু গুণমুগ্ধ ফ্যান যে হয়নি সেটা হলফ করে বলাটা কঠিন। প্রবাসের এক রেডিও স্টেশনে বেশ কিছু সময় ধরে অনুষ্ঠান করতাম। সেখানে এমনভাবে কথা বলতাম যাতে শ্রোতারা কিছুটা আনন্দিত হয় এবং সুন্দর জীবন গড়ার উৎসাহটা পায়। একবার এক মহিলা ফোন করে অন এয়ারে বললেন, যে তার আমাকে ভালো লাগে। পরে শুনলাম মহিলার চোখের দৃষ্টি নাই মানে তিনি অন্ধ। বেচারি তার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে হয়তো কথাগুলো বলেছিলেন। আমি খুবই বিমোহিত হয়েছিলাম। তা ছাড়া প্রেমের গল্প প্রকাশিত হলে বিশেষ বয়সের পাঠকদের সাড়া একটু বেশীই মিলে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের অনুরোধ রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে প্রত্যেকের আগ্রহকে আমি সম্মান করি। মানুষ শুধু ভালোবাসতেই পারে না, সেটা বহুগুণ বাড়িয়ে ফেরত দিতে পারে। এইজন্যই হয়তো সে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মহাত্মা গান্ধী কিংবা মাদার টেরেসা ভালোবাসার বাঁধনে কেমনভাবেই না সবাইকে বেঁধে দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে আমি নিতান্তই সাধারণ মাপের একজন ক্ষুদ্র মানুষ। তার পরেও আমি যতটুকু ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে পারি, বিনিময়ে তার শত গুণ বেশী ভালোবাসা ফিরে পাই। মানুষের এতো ভালোবাসা আমাকে অনাবিল বিনম্রতার মুগ্ধতা ও কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে রাখে। এই জন্যে পৃথিবীতে হাজার-কোটি বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে।
ম্যাসেঞ্জার কিংবা ইন্টারনেট ফোনগুলোতে কথা বলে খুব একটা আরাম পাই না। কথার শব্দ চিন্তার গতির সাথে তাল মিলিয়ে ঠিক মতো চলে না। মাঝে মাঝে কথার গতি কেমন ধীর হতে যায়। আমি অধরার সাথে কথা বলার সময় এই সমস্যায় ভুগতে চাই নি। ম্যাসেজ দিয়ে ওর মোবাইল নম্বরটা নিলাম। অফিস থেকে বাসায় ফিরে নির্ধারিত সময়ে ফোন করলাম। তবে ভিডিও না সরাসরি মোবাইলে রিং দিলাম। এখন ওকে ভিডিওতে দেখার দরকার নাই। শুধু শুনতে চাই এই তরুণ অপরূপার আমার কাছে কি-ই বা প্রয়োজন থাকতে পারে। মেয়েটা ওই দিক থেকে বেশ উৎসাহের সাথে বলে উঠলো, “ভাইয়া আপনার কলের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আপনি কল করেছেন সে জন্য খুবই খুশি হয়েছি।” এ সব ক্ষেত্রে অপর পক্ষের উচ্ছ্বাস যাতে আমার মধ্যে যাতে না চলে আসে সে ব্যাপারে সাবধান থাকি। আমি বেশ ঠাণ্ডা গলায় বললাম, “তোমার জন্যে আমি কি করতে পারি।” মেয়েটা ওই দিক থেকে হো হো করে হেসে উঠলো, “মনে হচ্ছে আমি গ্রামীণ ফোনের কাস্টমার কেয়ারে কল করেছি। গুড মর্নিং ম্যাম। আমি আপনাকে কিভাবে সেবা দান করতে পারি? আপনি কি এই দেশের কোনো কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিসে চাকরি করেন?”
এইবার আমার হাসার পালা। অধরা আমাকে নিয়ে রসিকতা করছে। বুঝেছে আমি আমার অবস্থান থেকে সরতে চাইছি না। আমি অবশ্য ওর সেন্স অফ হিউমারে কিছুটা বিস্মিত হলাম। সাধারণত বাঙালিরা বিশেষ করে মহিলারা পরিচয়ের প্রথম দিকে আড়ষ্ট থাকে। কিন্তু সে একেবারেই সাবলীল। যাদের রস বোধ ভালো তাদের সাথে আড্ডা আমি খুব উপভোগ করি। যাই হোক আমিও উৎসাহ নিয়ে কথা বলতে লাগলাম। মেয়েটার চেহারার কথা আগেই বলেছি। বয়সের তুলানয় গলার স্বরটা বেশ আদুরে। তবে একটা আঞ্চলিকতার টান স্পষ্ট। ওকে জিজ্ঞাসা না করলেও বুঝতে পারলাম টানটা ময়মনসিংহ অঞ্চলের। হয়তো মেয়েটা মফস্বলে বেড়ে উঠেছে। কিংবা গ্রামেও হতে পারে। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াতে বাঙালিদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মেলা দরজা খুলে গেছে। চাইলে বিদেশে যেয়ে চাকরি-ব্যবসা পর্যন্ত করা যায়। বর্তমানে বিশ্বে এমন কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে বাঙালি পৌঁছায় নি। কিন্তু তার পরেও মাথায় খেলতে লাগলো কোনো মফস্বল কিংবা গ্রামের মিষ্টি চেহারার অপ্সরীটা হলিউড খ্যাত লস এঞ্জেলেস এলো কি পারে?
মেয়েটা দেখলাম আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। সে আমার মতো অধমের সংস্কৃতি চর্চা এবং সাহিত্য সাধনা সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল। আমি যে ফেসবুক লাইভে অনুষ্ঠান করি, সে তার একনিষ্ঠ দর্শক-শ্রোতা। চট করে জানিয়ে দিলো অনুষ্ঠানের কি ভালো লাগে, আর কি করলে আরও ভালো হতে পারে। আমি ভেবে চললাম এতো দেখছি একজন বড় ধরণের নিরেট ভক্ত। তবে অফিস টাইমে ফোন না করলেও পারতো। আমার আশংকা ছিল, কি না কি আবার বলে বসে। তার পরেও একজন গুণমুগ্ধের কাছ থেকে প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে? সাথে স্বস্তিও পেলাম। মেয়েটা তা হলে বিশেষ কোনো দরকার ছাড়াই আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার জানা ছিল না আমার অবাক হওয়ার পালা আরও অনেক বাকী আছে।
ময়মনসিংহের জেলা শহরের কাছাকাছি এক জনপদ বেলতলা। সেখানকার এক নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে পারভিন আক্তার অধরা। বাবা আব্দুল জব্বার ডাক বিভাগে কাজ করতেন। পায়ে হেঁটে মাইল দুয়েক পাড়ি দিয়ে চলে যেতেন পোস্ট অফিসে। সেখানে তার কেরানী পদে দায়িত্ব। প্রয়োজনে স্ট্যাম্প বিক্রি, চিঠিতে সিল দেয়া থেকে আরম্ভ করে চিঠি বিলিরও কাজ করতে হতো। মাসের শেষে যে বেতন আসতো তা দিয়ে সংসার চালাতে খুব বেগ পেতে হতো। তা স্বত্বেও আব্দুল জব্বারের স্বপ্নের কমতি ছিল না। তিনি ছেলে-মেয়েকে পড়ালেখা করিয়ে অনেক বড় করবেন। সন্তানেরা মেলা টাকা আয় করবে। তাদের সুন্দর ও স্বচ্ছন্দের জীবন হবে। পরিবারে অধরা বড় আর ছোট ছেলে টুটুল। পড়া-লেখায় দু জনই ক্লাসের শীর্ষে।
বাংলাদেশের আর দশটা কিশোরী মেয়েদের জন্যে যেমন হয়, পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষীরা অ-ক্লান্তভাবে অধরার বিয়ে দেবার চেষ্টা করে আসছিল। অধরার সোজা উত্তর ছিল, সে আগে ডাক্তার হবে। তার পরে বিয়ের চিন্তা। বাবার সায় ছিল বলেই বিয়ে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু অধরার বুঝতে অসুবিধা হতো না লোভাতুর পুরুষদের দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করে চলতো এবং হয়তো এদের কেউ কেউ কল্পনায় গ্রাসও করতে। ঘর থেকে বের হলেই এর থেকে নিস্তার ছিল না। কিশোরী বাঙালি মেয়েকে এ সবে ভ্রুক্ষেপ করলে এগুনো সম্ভব না। দেখতে দেখতে সে ক্লাস টেন শেষ করে মাধ্যমিক মানে এসএসসি পরীক্ষা দিলো। পুরো এলাকার মধ্যে পারভিন আক্তার অধরা সেরা রেজাল্ট করলো।
সেদিন সকাল আটটার দিকে সূর্যমুখী বালিকা বিদ্যালয়ের দপ্তরী অধরাদের বাসায় এসে হাজির। বাবা আব্দুল জব্বার তখনও বের হন নি। দপ্তরী জানালো তার কন্যাকে হেড মাষ্টার সাহেব এখনই স্কুলে যেতে বলেছেন। সে পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। তিন জন সাংবাদিক না-কি আসবে ছবি তুলতে ও কথা বলতে। তার মধ্যে ঢাকার এক বড় পত্রিকার সাংবাদিকও আছে। বাড়িতে সাথে সাথে খুশির রোল পড়ে গেল। অধরা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে দপ্তরী সাথে বের হয়ে পড়লো। অন্যদিকে বাবা ছুটলেন পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের খবর দিতে। হাতে বেশী টাকা নাই। তার পরেও আলমারিতে যা ছিল সব সাথে নিয়ে বের হলেন। প্রাণ প্রিয় কন্যা পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও এলাকার মান উঁচু করে করেছে; এখন সবাইকে মিষ্টি মুখ না করালে আবার কথা উঠবে।
অধরা এই পর্যন্ত তার কাহিনী মহা উৎসাহে বলে চললো। প্রতিটা ব্যাপারে বেশ বুঝিয়ে বর্ণনা দিয়ে চলছিল। কিন্তু এই জায়গায় এসে চুপ করলো। ভাবলাম এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলায় হয়তো একটু দম নিচ্ছে। আমি ভেবে চলেছি, মেয়েটা মাধ্যমিকে কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। হয়তো এরই ধারাবাহিকতায় ক্যালিফোর্নিয়ার কোনো নামজাদা ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি করছে। অধরা ওই দিক থেকে বলল, “আচ্ছা ভাইয়া আপনি বলেন তো এর পরে কি হলো?” আমি যেটা ভাবছিলাম সেটা জানালাম। ও শুনে কেমন অদ্ভুত ধরণের শব্দ করে হাসলো। আমার কানে সেটা একটা বিদ্রূপের মতো মনে হলো। কথোপকথনের কেমন একটা ছন্দ পতন হলো। সে আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপরে শুনলাম মৃদু কান্নার শব্দ। ধীরে ধীরে শব্দটা বাড়তে বাড়তে অঝর ধারার কান্নায় পরিণত হলো। অধরা আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করলো, কিন্তু তাতে কান্নার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। আমি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমরা একই দেশে থাকলেও আমি ওর থেকে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরে। একজন বাঙালি তরুণী মেয়ে কেঁদে চলেছে। আমি জানি না কারণটা কি। তাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিবো তাও আমার মাথায় এলো না। বেচারির বিদেশ বিভুয়ে এতো কষ্ট। মেয়েটার মাথায় যদি হাত বুলিয়ে দিতে পারতাম! হয়তো তাতে কিছুটা স্বস্তি পেতো! বলতে ইচ্ছা হলো, “দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ভাবলাম জানাই ওর আর কিছু বলার দরকার নাই। মনে হচ্ছে মেয়েটার জীবনে বড় কোনো দুর্ঘটনা আছে; সেটা না হয় না-ই বা শুনলাম। ওর কান্না কিভাবে থামানো যায় সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম। পরের মুহূর্তে মনে হলো মেয়েটার ভিতরের জমাট দুঃখ; কান্নার স্রোতে যদি কিছুটা যদি বের হয়ে আসে, তবে আসুক না। আমার এই মুহূর্তের খারাপ লাগার বিনিময়ে ওর ভিতরের গুমোট চাপ যদি কমে, তবে না হয় তাই হউক। কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। আমি চুপচাপ ফোনটা কানে ধরে রাখলাম। আমার ভাবনার স্রোত বইতে থাকলো; ওর কিসের এতো কষ্ট যে প্রায় অপরিচিত একজন মানুষের কাছে এভাবে কাঁদছে।
সূর্যমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নাম সৈয়দ কামরান। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। দু জন নাতিও আছে। স্কুল সংলগ্ন একটা টিনের ঘরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। স্ত্রী কয়েকদিন আগে ঢাকায় ভাইয়ের বাড়িতে বেরাতে গেছেন। দপ্তরী অধরাকে ওই বাড়িটার সামনে দিয়ে বলল, “ভিতরে স্যার তোমার অপেক্ষায় আছেন। আমি চললাম। আমাকে এখন কবিরাজ নিয়ে বাসায় যেতে হবে। ছোট মেয়েটার খুব জ্বর।” দপ্তরী আর দেরী করলো না, সে উল্টো রাস্তায় রওয়ানা দিলো। কিশোরী মেয়েটার একদিকে জিপিএ গোল্ডেন ৫ পেয়ে এলাকার সেরা রেজাল্ট করার উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে একা একা হেড স্যারের বাসায় আসার সংশয়। স্কুলের কিছু শিক্ষক বাসায় প্রাইভেট পড়ালেও, তখন তাদের বাসায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা থাকে। অথবা মেয়েরা ব্যাচ করে পড়ে। কিন্তু হেড স্যার প্রাইভেট পড়ান না। তার উপর তিনি ভীষণ কড়া মেজাজের মানুষ। নিয়মের বাইরে কিছু করলে ছাত্রীদের কঠিন শাস্তি দিতে পিছপা হন না। এইজন্য কামরান স্যারের সামনে গেলে স্কুলের যে কোন মেয়েরই মুখ শুকিয়ে যায়।
দরজায় কড়া নাড়া মাত্রই কামরান স্যার হাসি মুখে দরজা খুলে দিলেন। আজকে তার একেবারে অন্য রূপ। গায়ে লাল পাঞ্জাবী। মুখটা ক্লিন শেভ। শরীর থেকে সুগন্ধি ভেসে আসছে। গাল ভর্তি হাসি। অধরার স্যারকে কেমন অপরিচিত মনে হলো। স্কুলে তিনি সব সময়ই শার্ট-প্যান্ট পরে যান। অধরা ভাবলো, আজকে সাংবাদিক আসবে, ছবি তুলবে; সেই জন্য হয়তো হয়তো তিনি বাড়তি কিছু সাজ-গোঁজ করেছেন। স্যার বসার ঘরে অধরাকে বসিয়ে ভালো রেজাল্টের জন্য অভিনন্দন জানালেন। ছোট ভাই টুটুল, বাবা ও মায়ের খোঁজ-খবর নিলেন। ভিতর থেকে ট্রে ভর্তি খাবার আনলেন। অধরার মনে হলে স্যার হয়তো এগুলো তার জন্যে রেডি করেই রেখেছিলেন। সে সকালে বাসা থেকে নাস্তা না করেই বের হয়েছিল। তখন সাংবাদিকরা প্রশ্ন করবে, ছবি তুলবে ভাবতেই উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। ফলে খিদাটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে এখন পেটে বেশ টান পড়েছে।
কামরান স্যার অধরাকে খেতে বলে নিজে ভিতরে গেলেন। মিনিট দশেক পর তিনি ভিতর থেকে ডাকলেন। সে যেয়ে দেখলো, পাশের কামরায় একটা বিছানায় স্যার পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। হাতের মিষ্টির প্যাকেট। তিনি ছাত্রীকে পাশে বসালেন, “নিজের হাতে মিষ্টি খাওয়াব বলে বেড রুমে ডাকলাম। বসার ঘরে জানালা দিয়ে কে না আবার কখন দেখে ফেলে। আবার কি-না রটায়।” ষোল বছরের কিশোরী অধরা কথাগুলোর মর্মার্থ ঠিক বুঝলো না। সে শিক্ষকের কাছে এসেছে; এখানে মানুষের রটানোর কি থাকতে পারে। সে কোনো দ্বিধা ছাড়াই স্যারের দিকে মিষ্টির জন্যে মুখ বাড়িয়ে দিলো। গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাওয়া মেয়েটার মনে হলো, হেড স্যার তাকে মিষ্টি মুখ করিয়ে দিচ্ছেন; এ তো অনেক বড় সম্মানের ব্যাপার। বান্ধবীরা জানলে খুবই হিংসা করবে।
ঘণ্টা দুয়েক পরে স্কুলের দপ্তরী হন্ত-দন্ত হয়ে বাবা আব্দুল জব্বারে কাছে খবর দিলো, অধরা হেড মাস্টারের বাড়িতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। বাবা ছুটে গেলেন সৈয়দ কামরানের বাড়িতে। শোবার ঘরে বিছানায় মেয়েটার অসার শরীর। একজন বাবা কল্পনায় যে দৃশ্য ভাবতে পারেন না, তিনি তাই দেখলেন। মেয়ের কাপড়ে ও বিছানার চাদরে রক্ত লেগে আছে। পরনের কাপড় জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। পারভিন আক্তার অধরা নামের মেয়েটা আর অধরা রইলো না। বাবার বয়সী শিক্ষক তার শরীরটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছে। খবরটা চারিদিকে রটে যেতে সময় লাগলো না। অধরাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। এলাকার মুরুব্বিরা দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিলেন, স্কুলের হেড মাষ্টার সৈয়দ কামরানের সাথে পারভিন আক্তার অধরার বিয়ে দেয়া হবে। পুলিশে মামলা করে এলাকায় একটা অকারণ ঝামেলা করার কোনো দরকার নাই।
একটু আগেই যে মেয়েটা অঝর ধারায় কাঁদছিল, সে এইবার ফোনের ওইদিক থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আমার মাথায় এলো না আমার এখন কি বলা উচিৎ। আবার আগের ভাবনাটা আমার মাথায় ফিরে এলো। বাংলাদেশের মফস্বলে এ রকম ন্যক্কার জনক ঘটনা যে মেয়েটার সাথে ঘটলো, সে এখন কি করে লস এঞ্জেলেসে। মাথার মধ্যে হিসেব ঠিক মিললো না। মেয়েটা হাসি কিছু কমিয়ে বলতে লাগল, “দেখলেন তো কেমন বোকা বানিয়ে দিলাম। আপনি তো এমন গল্প নিশ্চয়ই আশা করেন নি।” আমি কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বললাম, “ইয়ে মানে...।” মেয়েটা ফোনের অন্যদিক থেকে আবার নতুন করে হাসতে লাগল, “মাননীয় হেড মাস্টারকে যখন এলাকার সবাই চেপে ধরেছিল, তখন সেও না-কি কয়েকবার বলেছিল ‘ইয়ে মানে, সে এর বিন্দু-বিসর্গ কিছুই জানে না’। পরে অবশ্য নিজের কৃতকর্ম স্বীকার করে যোগ করেছিল যে তার একজন স্ত্রী আছে। তার অনুমতি ছাড়া সে কিভাবে দ্বিতীয় বিবাহ করবে। ব্যাটা অবশ্য প্রথমে আমার ঘাড়ে দোষ চাপাতে চেয়েছিল। আমি অসতী, শিক্ষক মহোদয়কে ফুসলিয়েছি।”
তার পরের ঘটনাগুলো না হয় সংক্ষেপেই বলি। না, অধরা প্রধান শিক্ষককে বিয়ে করে নি। শুভাকাঙ্ক্ষীরা বুঝাতে চেষ্টা করেছিল এ রকম ঘটনা পর তাকে অন্য কেউ বিয়ে করবে না। অধরা এদের সবার কথা অগ্রাহ্য করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। বাবা প্রথমে গর-রাজী হলেও পরে মেয়েকে সাধ্যমত সহযোগিতা করেছিলেন। অধরা বৃত্তির টাকায় ও টিউশনি থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে কলেজ শেষ করলো। মেডিকেল কলেজে পর্যন্ত ভর্তি হলো। বিপত্তি আরম্ভ হলো সেখানেই। কলেজের আরও কিছু ছাত্র ছিল ময়মনসিংহ এলাকার। অধরাকে দেখা মাত্রই তারা ঘটনাটা স্মরণ করতে পারলো। তারপর একমুখ থেকে আরেকমুখ করে একজন বাঙালি মেয়ের জীবনের গোপন অধ্যায় পুরো ক্যাম্পাস ছড়িয়ে পড়লো। গল্পটাকে মুখরোচক করার জন্যে দুষ্টুরা কথাগুলোর সাথে অতিরঞ্জিত আকারে চোখ-কান-নাক জুড়ে দিলো।
এর পরের সময়গুলো অধরার জন্যে খুবই লজ্জা ও কষ্টের। ক্যাম্পাসের সবাই তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতো। অতি উৎসাহীরা কঠিন সব মন্তব্য করতো। ক্লাসে শুরুর ঠিক আগে ঝাঁকড়া চুলের এক ছেলে মন্তব্য করে উঠলো, “বেশ্যারা এখন দেখি মেডিকেল কলেজে পর্যন্ত আসা আরম্ভ করেছে।” কথাটা উপস্থিত সবাই শুনতে পেলো। বেচারি আর সহ্য করতে পারছিল না। ছেলেটার যেয়ে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলো, “হারামজাদা না জেনে মেয়েদের অপমান করে খুব সুখ পাস?” অধরা ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। তারপর সে যেই কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিল, সেখানকার অনার্স ক্লাসে ভর্তি হলো; অধরার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের ইতি ঘটলো। সেটা মহিলা কলেজ হওয়াতে আপত্তিকর মন্তব্য কিছু কম শুনতে হতো। কলেজের বাইরে মাঝে মধ্যে ছেলেরা অশ্লীল মন্তব্য করলেও অধরা সেদিকে কোনো দৃষ্টি দিতো না।
অনার্সে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে পরিচয় হলো সিদ্দিকুর রহমানের সাথে। ক্লাসের এক বান্ধবী রীতার কাসিন। এমেরিকায় থাকে। মেম বউ ছিল। এখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। রীতা বলেছে ভালো মেয়ে পেলে সে বিয়ে করে এমেরিকায় নিয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা আছে একটা, পাত্র হিসেবে সিদ্দিকের বয়স কিছুটা বেশী। অধরা ভীষণ একটা সাহসের কাজ করলো। রীতাকে বলল তার কাজিনকে সে বিয়ে করতে রাজী। পরের দিনই সিদ্দিকুর রহমান দেখা করতে এলো। ভদ্রলোকের বয়স কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশ তো হবেই। মাথায় ইয়া বড় টাক শোভা বর্ধন করছে। শরীর থেকে ভূরি বের হয়ে বেশ কিছুটা সামনে এসে ঝুলে পড়েছে। পরিচয়ের দ্বিতীয় দিনেই অধরা সবিস্তারে তার অতীতের দুর্ভোগ ও বর্তমানের অপমানজনক পরিস্থিতির কথা বলল। অধরার ভয় ছিল এই সব কথা শুনে লোকটা আবার পিছুটান না দেয়। সিদ্দিকুর রহমান একগাল হেসে নিয়ে বলল, সে অতীতের কোনো দুর্ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষের জীবনে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা থাকে। সে নিজেও তার ব্যতিক্রম না।
সিদ্দিকুর রহমানের বিশ্বাসই হচ্ছিল না অধরা তাকে বিয়ে করতে রাজী হবে। বিয়ের কাগজে সই করার আগ পর্যন্ত সে বিষয়টা একেবারে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে জানায় নি। পাছে অধরা যদি মত পরিবর্তন করে তা হলে মানুষের ঠাট্টা বিদ্রূপ শুনতে হবে। অধরার পক্ষ থেকে একটাই শর্ত ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে এদেশ থেকে নিয়ে যেতে হবে। সে বাংলাদেশে আর এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। যাই হোক, দু জনের বিয়ে হয়েছিল এবং সিদ্দিক শর্ত পালন করেছিল। বিয়ের নয় মাসের মাথায় অধরার স্বপ্নের দেশ এমেরিকা যাওয়ার ভিসা হয়ে গেল। খবরটা শুনে সিদ্দিক নিজে দেশে চলে এলো স্ত্রীকে নিয়ে যেতে। সবই চলছিল প্ল্যান মোতাবেক। স্বামী বয়স তার প্রায় দ্বিগুণ হলেও অধরা সেটা মেনে নিয়েছিল। বরং তার এই নরক যন্ত্রণা ও অপমান থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ভেবে লোকটির প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা জন্ম নিয়েছিল। হয়তো দিনে দিনে তার থেকে কিছু ভালোবাসা তৈরি হচ্ছিল।
বিপত্তি আরম্ভ হলো লস এঞ্জেলেস এয়ারপোর্ট থেকে। দুজনকে ইমিগ্রেশানের ভিন্ন ভিন্ন লাইনে যেতে হলো। সিদ্দিককে যেয়ে দাঁড়ালো মার্কিন নাগরিকদের সাথে। পারভিন আক্তার অধরা ইমিগ্রেশান শেষ করে এ দিক, ও দিক তাকালো সিদ্দিকের খোঁজে। নাহ তাকে চোখে পড়লো না। সে যে লাইনে দাঁড়িয়েছিল, তার সামনে থেকে কয়েকবার ঘুরে আসলো। প্রথমে ভাবলো ওয়াশ রুমে গেছে। প্রায় মিনিট পনেরো অপেক্ষা করলো। নাহ লোকটা ফিরলো না। আশে পাশে কোনো বাঙালি পেলে জানতে চাওয়া যেতো যে বিষয়টা কি হতে পারে। সিদ্দিক কি তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। পত্রিকায় এ ধরণের ঘটনা সে মেলা পড়েছে। কিন্তু সেগুলো সে তো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর খবর। বিদেশী কারোর থেকে যে জানতে চাইবে সেই সাহসে কুলালো না। ইংরেজিতে অধরা বরাবরই ভালো নম্বর পেয়ে এসেছে। কিন্তু বিদেশী ভাষায় বিদেশী লোকের সাথে কথা বলা! না সেটা সম্ভব হলো না।
অধরা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? সংশয়ের সব বাঁধ ভেঙ্গে পাহারারত এক ইমিগ্রেশন পুলিশকে অনেক কষ্ট করে বুঝালো যে তার স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছে না। এর মধ্যে সে ভয় পাওয়া আরম্ভ করেছে। ফর্সা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শরীরটাও কাঁপা আরম্ভ করলো। সাথে না আছে কোনো ফোন নম্বর, না আছে কোনো ঠিকানা। মন চাইছে ফিরতি ফ্লাইট নিয়ে দেশে ফিরে যেতে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেই অফিসার ফিরে এসে বলল, যে সিদ্দিকের নামে ওয়ারেন্ট ছিল। তাকে এরেস্ট করে নিয়ে গেছে। অধরা এই সংবাদের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে এখন কি করবে? শেষে অন্য মানুষদের দেখাদেখি সেও ছোট ছোট পা ফেলে লাগেজ যোগাড় করে বের হয়ে এলো।
মাথার মধ্যে তুমুল ঝড় বয়ে চললেও অধরা এতটুকু বুঝলো এখন যা করার তাকে একাই করতে হবে। সিদ্দিক বলেছিল তার পরিচিত এক ট্যাক্সি ড্রাইভার জামান তাদেরকে এয়ারপোর্টে নিতে আসবে। দরজার মুখে কয়েকজন বাঙালি চেহারার কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। একজনের কাছে যেয়ে জানতে চাইলো, সে জামান ভাইকে চিনে কি-না। পাশের থেকে আরেক জন এগিয়ে জানালো সেই জামান।
সিদ্দিকের নামে একাধিক মামলা ছিল। অন্য মানুষের নামে জালিয়াতি করে সে ক্রেডিট কার্ড বানিয়ে টাকা উঠিয়েছিল। সেটা প্রায় মাস ছয়েক আগে ঘটনা। তা ছাড়া সে একটা “নাইট ক্লাব ও বার” খুলেছিল। সেখানে মদ বিক্রির পাশাপাশি চলতো নগ্ন নৃত্য। যাদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকার বৈধ কাগজ পত্র নাই, তাদেরকে কম পয়সা দিয়ে এই কাজ করিয়ে নিতো। কিছু দিন আগে দালালরা একটা কিশোরী মেয়েকে নিয়ে এলো কাজ করানোর জন্যে। তার মেয়েটার উপর বদ নজর পড়লো। জামান অধরাকে জানিয়েছিল, তার স্বামী এই কাজ মাঝে-মধ্যেই করতো। বিশেষত তার চোখ ছিল অল্প বয়সের মেয়েদের উপর। সিদ্দিকও হেড মাস্টার স্যারের মতো মেয়েটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে রক্তাক্ত করেছিল। মেয়েটার পরিবার থেকে বেশ কিছুদিন পর পুলিশকে ঘটনাটা জানানো হয়। এর মধ্যে সিদ্দিক অধরাকে আনতে দেশে চলে গেছে। তদন্তে সিদ্দিকের কু-কীর্তি বের হয়ে আসে।
মেয়েটা একটানে এতগুলো কথা বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। একটু দম নিলো। আবার কথা আরম্ভ করলো, “আমি এই দেশে এসেছি বছর দেড়েক হলো। এর মধ্যে স্বামীর বিশ বছরের জেল হয়ে গেছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার জামান আমাকে তার বাসায় সপ্তাহ খানেক রেখেছিল। অবশ্য বিনিময়ে দিনে দু বার করে আমাকে তার খোরাক মেটাতে হতো।” অধরা আবার বিরতি নিলো। ফোনের ওই দিককার শব্দে বুঝলাম সে ভিতর থেকে বের হয়ে আসা কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল এই প্রচেষ্টার সাথে মিশে আছে প্রচণ্ড ক্রোধ এবং নিজেকে রক্ষা করতে না পারার অসহায়ত্ব। কিছু সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু কি বললে পুরুষ নামের এইসব কুলাঙ্গার পশুদের দানবীয় অমানুষিক অত্যাচারের কষ্ট লাঘব হবে, তেমন কিছুই খুঁজে পেলাম না। অধরা আবার বলা আরম্ভ করলো, “ভাইয়া আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখেন আজকে আমার এই দশা।”
আমার এখন আর জানতে ইচ্ছা করছে না, আমাকে ফোন করে এত সব বলার কি কারণ থাকতে পারে। কিশোরী মেয়েটার পাহাড় সমান কষ্ট ও দুর্ভোগ আমাকেই ভীষণ বিচলিত করে তুলেছে। আমি বুঝতে পারছি অধরা শুধু কষ্টগুলোকে ভিতর থেকে বের করে কিছুটা হালকা হতে চেয়েছে। হয়তো সে ভেবেছে, কেঁদে চোখের পানি ঝরালে মনটা যদি কিছুটা শান্ত হয়।
বিদেশ বিভুয়ে বাঙালি মেয়েটা ও দিকে কেঁদেই চলেছে। ভাবছি চোখের জল যদি ওর সব কষ্ট ধুয়ে দিতো! ও যদি নতুন করে বাঁচতে পারতো; স্বপ্ন পূরণ করে ডাক্তার হতে পারতো।
আমার ভিতর থেকে নিজের থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বের হয়ে এলো। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই অনাচার চলে আসছে। মানব সভ্যতা এতো এগুলো কিন্তু কিছু নপুংশক পুরুষত্বহীন পুরুষের পঙ্কিল মনের কোনো উন্নতি হলো না। যেই নারীর থেকেই তার জন্ম, যে নারীকে ঘিরে পরিবারের বিবর্তন; সেই নারীকে গায়ের জোরে এতো ভীষণ অত্যাচার ও অপমান কেনো? মনে হলো, কোনো দৈব বলে এই পঙ্কিল মনগুলোকে যদি পরিষ্কার করে দেওয়া যেতো!
ইদানীং #মিটু(#Metoo) আন্দোলনের জোয়ার বাংলাদেশেও এসে পৌঁছেছে। কথিত নামী-দামী মানুষদের নামে অভিযোগ আসছে। যাদের নামে অভিযোগ আসছে, তাদের সবার মুখেই সূর্যমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ কামরানের মতো একই কথা। তারা অভিযোগের ‘বিন্দু-বিসর্গ’ কিছুই জানে না। এগুলো সব ডাহা মিথ্যা। এখন সময় এসেছে এসব ভণ্ডদের মুখোশ খুলে দেবার।
সামান্য কয়েকজনের ভণ্ডের দল পুরো মানব সভ্যতাকে অশুদ্ধ ও নোংরা করে ফেলেছে। শুধুমাত্র সমাজের শীর্ষ স্থানীয় না সব-স্তরে লুকিয়ে থাকা ভণ্ডদের আসল চেহারা সবাইকে দেখাতে ও জানাতে হবে। শুধু উন্মোচন না, নারীকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এবং তাদের জীবন ও স্বপ্ন ধ্বংস করার অপরাধে তাদেরও সম-পরিমাণ ধিক্কার ও শাস্তি হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
কাজী হাসান
লেখকঃ quazih@yahoo.com