topless woman

মনোহারিণী

“তোমার হাতের সিগারেট যদি আমি একটা টান দেই, তা হলে কি হয়?”

“কি আবার হয়, সিগারেট টানা হয় ।”

“আরে হাদা তুমি তো কিছু বুঝো না, আমার ঠোট তোমার ঠোটের ছোয়া পায়, যাকে বলে চুমু।”

“কি গাজাখুরী কথা, সিগারেট থেকে আবার চুমু হয় কি করে?”

“প্রথমে তোমার ঠোটে, তার পরে আমার ঠোটে, তার মানে দুটো ঠোটের ছোয়া-ছুয়ী । প্যাসিভ চুমু বলা যেতে পারে । সিগারেট একটা মিডিয়া আর কি।”

এই ভাবেই কথা চলতো মিঠু আর সুমির । পরিচয় বেশী দিনের না। মাস চারেক হবে । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনে পরিচয় । দু জনে লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষায় ছিল ভর্তির টাকা জমা দেয়ার জন্যে। বেশ লম্বা লাইন। সামনে সুমি , পিছনে মিঠু । অসাবধানবসত সুমির কলমটা হাত থেকে পড়ে গেল । মিঠু কলমটা কুড়িয়ে সুমির কাছে ফেরত দিল । প্রথমে চোখাচুখি। পরে মিষ্টি করে ধন্যবাদ দেয়া।

লাইনে দাড়িয়েই বেশ কিছু কথা বার্তা হয়ে গেল। দু জন দুই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হচ্ছে । নাম জানা জানি থেকে আরম্ভ করে কোথায় থাকে, কি রাশী, প্রিয় রং. প্রিয় বন্ধুদের নাম, প্রিয় ফুল, সহ আরো অনেক তথ্য তারা বিনিময় করলো । আবিষ্কার হলো দু জনের প্রিয় রং নীল আর প্রিয় ফুল রজনীগন্ধা। বের হলো দু জনই সিংহ রাশীর । সুমি বললো, এই রাশীর মানুষরদের সমস্যা আছে। সবাই নেতা হতে চায় । চায় সব আগ্রহ তাদের ঘিরেই থাকুক । কিন্তু দুই সিংহ রাশি এক সাথে বেশী দূর এগুতে পারে না বলে বিজ্ঞ লোকেরা মতামত দিয়ে থাকেন । সুই সিংহ রাশির এক সাথে কোন ভবিষ্যৎ নাই। হা হা।

তার পরেও, এক সাথে তারা দুপরে একটা রেস্টুরেন্টে যেয়ে বিরানি খেলো । বিকাল পর্যন্ত একসাথে থাকলো । মাঝে ভর্তি, রেজিসট্রেশান, বই কেনার কাজগুলোও হলো। পরিচত অনেকের সাথে দেখা হলো । হাই, হ্যালো ছাড়া তেমন কোনো কথা অন্যদের সাথে দু জনের কেউ করলো না । একে অপরকেই সব এটেনশান দিল । একটা ছেলে আর একটা মেয়ের পরিচয়ের মোহ এই ভাবেই সূচনা হলো

সুমির পাড়ার এক ছেলে রাজা । খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে । এক বছর মাত্র বাকী পড়া লেখা শেষ করতে । বছর খানেক আগে পরিচয় হয়েছিল এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। রাজা সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব করে ফেলল, আপনি কিছু যদি মনে না করেন, তা হলে আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই। সুমি বিরক্তি চেপে জানাল, বাবার সাথে কথা বলতে । কি অদ্ভূত । তিন দিন পরে প্রচুর মিষ্টি নিয়ের রাজার বাবা, মা সুমির বাসায় এসে হাজির । তারা পাকা কথা নিয়ে উঠলো। রাজার চাকরী হওয়ার সাথে সাথেই বিয়ে হবে । সুমি ভাবলো তার জীবন নির্ধারণ হয়ে গেল তার কোনো মতামত ছাড়াই । শুধু মা অনেকটা খবর পড়ার মত করে জানালো, ছেলের বংশ অনেক ভাল , বাবা বিরাট চাকরি করে। ঢাকা শহরে তিনটা বাড়ি আছে। সুমি বুঝলো না, বংশ পরিচয়, বাবার কর্ম আর অর্থ সম্পদ কি করে ছেলের যোগ্যতা হতে পারে। এর পর সে যত টুকু না নিজের হবু বর নিয়ে ভেবেছে , তার থেকে বেশী পুলকিত হয়েছিল তার বান্ধবীদের দল। রাজার বিভিন্ন কথা সুমিকে বলতে তাদের যেন শিহরনের কোনো সীমা থাকতো না ।

মিঠু মাত্র ইন্টারমমিডিয়েট পাস করেছে । জীবনের লক্ষ্যে পৌছতে তার অনেক স্বপ্ন, অনেক পরিকল্পনা । এ পর্যন্ত বেশ কিছু মেয়ে তাকে প্রস্তাব করেছে, সম্পর্ক করতে চেয়েছে । কিন্তু নিজেকে এ জন্যে প্রস্তুত মনে হয় নি । যখন শুনলো সুমী কারো বাগদত্তা, তখন নিশ্চিন্তে মেলামেশা আরম্ভ করলো । তাদের প্রিয় রং, ফুল এক হলেও, রাশী চক্র তাদেরকে অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে।

দু জনের সম্পর্ক একটু অন্য ভাবে চলতে থাকলো । ওদের বেশীর ভাগ সময় কাটতো দুষ্টুমির ছলে প্রেম প্রেম খেলা আর প্রেমের ডায়ালগ বলে। এক জন যখন কোনো প্রেমময় কথা বলত, তখন আরও বিগলিত হয়ে অন্য জন জবাব দিত। অন্য কেও শুনলে নিশ্চয়ই ভেবে বসতো তাদের মধ্যে নির্ঘাত কঠিন ধরণের প্রেম চলছে।

এক বার মিঠু সুমির হাতে একটা আইসক্রিম দিয়ে বললো, তোমার জন্যে এভারেস্টের চূড়া থেকে আনলাম। উত্তরে সুমী বললো , প্রিয়তম এই আইসক্রিমের জন্যেই আমি জন্ম জন্মান্ত থেকে অপেক্ষায় আছি । পরের দিন সুমি খুব সেজে গুজে আসলো। পরনে নীল শাড়ী । বললো তোমার বউ হতে চাই; এভারেস্টের চূড়া থেকে আনা আইসক্রিমের প্রতিদানে। মিঠু সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই প্রিয়তমা। তার পরে কিনে দিল এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা। নকল আর খেলা প্রেমে, বাস্তব যেন, ওদের অজান্তেই, ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলো।

প্রেম প্রেম খেলায় অল্প সময়ের মধ্যেই তারা পারদর্শী হয়ে উঠলো । হাসি আনন্দে সময় কেটে যেত বেশ দ্রুত । মিঠুর প্রিয় ডায়লগ ছিল, আরে বাংলা মুভিতে দেখনা, ভিলেন নায়িকার সাথে বেশী সময় কাটায়। কিন্তু শেষে নায়কেরই জয় হয়। ভিলেনের শত প্রেমের ডায়ালগ নায়িকাকে কাছে রাখতে পারে না। আমার প্রিয়তমা সুমিও তেমন রাজা সাহেবের বউ হয়ে চলে যাবে । আসো আমরা দশ মিনিট জড়া-জড়ি করে কান্নাকাটি করি; কেঁদে যদি হয় সুখ । তার পরে, শোক প্রস্তাব পাশ করে এক মিনিট নীরবতাও পালন করা যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালেয়ে ক্লাস পুরোদমে আরম্ভ হয়ে গেল । বেশ ব্যস্ততা দু জনেরই । তার পরেও দিনের কিছুটা সময় তারা এক সাথে কাটাতো । নতুন কথা আর আগের কথা নিয়ে আলোচনা, হাসাহাসি চলতো । অনেক কথার ভিতরে চলে আসতো, প্রিয় রং আর ফুল তাদের মিলে গেলেও, তাদের রাশি এক হওয়ায় বিপদের কথা। সুমী প্রায়ই সন্দিহান প্রকাশ করত, সম্পর্ক মানে এই বন্ধুত্ব হয়তো বেশী দিন টিকবে না । মিঠু এটা নিয়ে সব সময় রসিকতা করত । বলত কয়েক দিনের মধ্যে তুমি পরের পরের ঘরণী, ইঞ্জিনিয়ার রাজার রানী হবে, দশ জন কাজের লোক থাকবে, দুই জন ড্রাইভার, আর তিন জন ফুলের বাগানের মালি থাকবে । তোমার আসলে মিঠু নামের জনৈক সিংহ রাশির জাতককে ভুলে যাওয়াই ভালো । তা ছাড়া এক বনে যেমন দুই সিংহ থাকতে পারে না , তেমন এক জায়গায় দুই সিংহ রাশীর জাতক না থাকাই দেশ আর জাতির জন্যে মঙ্গল জনক । শেষে ওদের প্রেম প্রেম খেলার ধরণটা এমন হয়ে দাড়ালো, সুমি করত অনবরত প্রস্তাব আর মিঠু করে যেত সমান তালে প্রত্যাখান।

আজ সুমি সিগারেট আর ঠোট নিয়ে যা কিছু বলল, মিঠুর কাছে তা আগের মতো কোন দুষ্টুমি ছাড়া কিছু মনে হলো না ।

সুমির মা কঠিন শাসনে তার মেয়েকে মানুষ করেছে । তিন ভাই বনের মধ্যে সব চেয়ে ছোট সুমি । বড় দুই জন ভাই। দুজনের অনেকটা প্রধান কাজটা ছিল সুমিকে চোখে চোখে রাখা, একে বারে দেশ রক্ষী বাহিনীর মত । এক বার বড় ভাই রঞ্জনের এক বন্ধু গোপনে একটা চিঠি দিল সুমিকে । রঞ্জন থাকবে না এমন একটা সময় সিরাজ বেছে নিল । কলিং বেল টিপতেই সুমি দরজা খুলে দিলো । অবাক হলো সিরাজকে দেখে । সে তো ভাল করেই জানে, রঞ্জন অফিসের কাজে বরিশাল গেছে । আসতে সপ্তাহ খানেক বাকি। সিরাজ বলল এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম । ভাবলাম তোমাদের সাথে একটু দেখা করে যাই। তা ছাড়া হুমায়ুন আহমেদের একটা নতুন বই বের হয়েছে, তা নিয়ে এলাম তোমার জন্যে । আমি জানি, তুমি হুমায়ুন আহমেদের একজন বিশাল ভক্ত। রঞ্জন হুমায়ুন আহমেদের বই বের হওয়া মাত্র তোমাকে কিনে দেয় । রঞ্জন তো শহরে নাই । তাই আমিই তোমাকে এইবার বইটা কিনে দিলাম।

সিরাজের হয়ত জানা ছিল না সুমির মা ছিল হুমায়ুন আহমেদের আরেক জন বড় ভক্ত। সুমির আগে, সেই পড়তে নিল বইটা। আর যায় কই; আবিষ্কার হলো সুমিকে লেখা সিরাজের প্রেম পত্র। সারা বাড়িতে আরম্ভ হয়ে গেল তুল কালাম কান্ড। রঞ্জনকে ফোন করে জানানো হলো । মেজ ভাই অঞ্জন বলল, বড় ভাইয়ের বন্ধু না হলে সেই এক হাত দেখিয়ে দিত । রঞ্জন ঢাকায় ফিরে কি ব্যবস্তা নিল, তা অবশ্য জানা গেল না। সিরাজের ছায়াও এর পরে তাদের বাসার ত্রি সীমানায় দেখা যায় নি। সুমিকে লেখা জীবনের প্রথম প্রেম পত্র, বেচারির না পড়াই থেকে গেল।

এর বছর খানিক আগে আরেক ঘটনা ঘটেছিল। স্কুলে যাবার পথে, এক ছেলে সুমিকে বিরক্ত করতো। অনেক ধরনের নোংরা কমেন্ট করতো । সুমি বলল মাকে আর তার থেকে সংবাদ পৌঁছল রঞ্জন, অঞ্জন ভ্রাত্রদ্বয়ের কাছে। পরের দিনই ডাইরেক্ট একশান । দুই ভাই যেয়ে ছেলেটার নাক ফাটিয়ে এলো।

এই দুটো ঘটনা কিংবদন্তির মত ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো পাড়ায় দু ভাই মেরে নাক ফাটিয়ে দিবে, এই ভয়ে কোন ছেলে ভুল করে সুমির দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতো না। রিমি, ঝুমু, শেলী সবার সঙ্গী জুটলো। কিন্তু বেচারি সুমি একাই থেকে গেল । মাঝে মাঝে সুমির বান্ধবীদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা শুনে ঈর্ষা হতো । মনে হতো, মা আর ভাইদের কড়া দৃষ্টি না থাকলে, সেও অন্য বান্ধবীদের মত কিছুটা না হয় আনন্দ করে বেড়াতে পারত । জীবনটা এত বোরিং মনে হত না। জন অরণ্যে অনেক কিছুই ছুঁয়ে দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে হত না।

মিঠুর ছবি সুমির মনের মধ্যে অনেকটা স্থায়ী আসন করে নিল পরিচয়ের দু সপ্তাহের মাথায়। সারাক্ষণ চোখের সামনে যেন মিঠুর ছবি ভাসতে থাকে । সুমি প্রথমে চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলের চেষ্টা করলো । না তাতে, উল্টোটাই হল। আরো বেশী করে মিঠুকে মনে হতে থাকলো । তার কথা বলার ভঙ্গী, গলার শব্দ, হাটা, চলা, তাকানো, সব কিছু নিয়ে রসিকতা, আর আরো অনেক কিছু। আরও কিছু দিনের মধ্যে রাতের ঘুম পর্যন্ত হারাম হয়ে গেল । চোখ বন্ধ করলেই মিঠুকে স্পষ্ট দেখতে পায়। চোখ খোলা রেখেও বেশী উপকার পাওয়া গেল না । সাথে সাথে ক্ষুধা আহার বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সারক্ষণ একটা বমি বমি ভাব। চোখের নীচে কালি পড়ল। নিজেই বুঝলো সে প্রেমে পড়েছে। তাও আবার জীবনে প্রথম বার। মিঠুকে ছাড়া মনে হয় সে বাঁচতেই পারবে না। না হলে পাগল হয়ে যাবে। প্রথম প্রেমে এরকম ঝামেলা কি সবারই হয়?

পরের মুহুর্তেই ভাবনা আসতো, তার তো বিয়ে হয়ে যাবে রাজা নামের এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। তার তো উচিত রাজাকে নিয়ে ভাবা। না তাকে নিয়ে একেবারেই কোন ভাবনা আসে না। অল্প কিছুক্ষণের পরিচয়, বিয়ের প্রস্তাব। তার সম্মতি আছে কি না তা জানতেও কেউ কেয়ার করে নি। রাজার অতীত, বর্তমান কিছুই জানা হয় নি। বাবা মা বিয়ের পাকা কথা দেয়ার পরে, একবার মাত্র রাজা দেখা করতে এসেছিল। তেমন কোনো অন্তরঙ্গ কথা বার্তা হয় নি । হবু বর সম্পর্কে কিছুই জানা হয় নি।

সুমি ঠিক করলো তার প্রেমের কথা মিঠুকে জানাবে। তাকে রাজী করাতে হবে। দুজনে প্রেম প্রেম খেলা বন্ধ করে আসল প্রেম করবে। তারা প্রমান করে দেখাবে দুই সিংহ রাশির জাতকদের মধ্যে চিরস্থায়ী সম্পর্ক হতে পারে । দু জনের প্রিয় ফুল আর রং তো একই; তাতেই হবে। এই ভালোলাগার উপরেই তৈরি হবে পৃথিবীর সব চেয়ে শক্ত, বড় আর চমৎকার তাজ মহল ।

যত বারই সুমি তার ভালো লাগার কথা বলতে গেছে, মিঠু রসিকতা করে উড়িয়ে দিয়েছে । অনেক দুষ্টুমির মাঝে বলেছে, আমার মাত্র একটাই নাক । আমি চাই না সেই নাকটার ব্রিজ তোমার ভাইরা ধ্বংস করে দিক । শেষে ইহকাল আর পরকাল দুই যাবে । সুমি কোনো ভাবেই মিঠুকে বুঝাতে পারল না, তার ভালো লাগায় রাজা নেই । সে মিঠুকে ভালোবাসতে চায়। ভীষণ, প্রচন্ড ভালবাসা। যে ভালবাসার উপরে কোনো ভালোবাসা হয় নি । মিঠু যদি একবার রাজী হত, সে বাবা মাকে বলে রাজার সাথের তার বিয়ের প্রস্তাব বাতিল করে দিত। ভাইদের বলতো, খবরদার যাতে তারা কোন ভাবেই মিঠুকে বিরক্ত না করে। সে বড় হয়েছে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে। অন্যরা সেখানে নাক না গলানোই ভালো। তার জীবন তার ইচ্ছে মত হতে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

মিঠুর স্মার্ট, বুদ্ধিমান। সুমির মনের কথা বুঝতে বেশী সময় লাগলো না; সুমি তাদের সম্পর্ককে অন্য দিনে টার্ন নেয়াতে চাচ্ছে । কিন্তু সে তো সুমিকে সেই ভাবে কখনো চিন্তাই করে নি । তার সাথে প্রেম প্রেম খেলার দুষ্টুমি সে খুবই উপভোগ করে। মনের কিংবা শরীরের আকর্ষণ কোন রকম আকর্ষণ তার মধ্যে আসে নি। ভেবেছে অল্প কয়েক দিন পরে সুমির বিয়ে হয়ে যাবে। তার আগে কিছুটা ভালো সময় এক সাথে কাটাতে পারলে মন্দ কি! এর বেশী কিছু ভাবনা তার মাথার মধ্যে খেলে নি ।

এর মধ্যে আরেক ঘটনা হলো। সুমি বলল, আমার বই আর খাতাটা একটু রাখো। আমি দশ মিনিটের আসছি মেয়েদের হোস্টেলের অফিক থেকে। সেখানে একটা ফর্ম জমা দিতে হবে। মিঠু অকারনেই খাতাটা খুলল কিছুটা সময় কাটানোর জন্যে । যা দেখল তাতে চক্ষু চরক গাছ হওয়ার উপক্রম । তার অনেকগুলে ছবি স্কেচ করা। খাতার প্রতিটা পাতায় শত শত বার লেখা, মিঠুকে আমার ভালো লাগে, মিঠুকে আমি ভালোবাসতে চাই, মিঠুকে আমি সারাক্ষণ ফিল করি, ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না, ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। মিঠু বুঝলো, অনেক বড় ধরনের আকর্ষণ না থাকলে সুমি এই কঠিন কাজ করতে পারতো না। এর জন্যেঅনেক সময় দিতে হয়েছে । হয়ত অনেক গুলো রাত জেগে কাজটা করেছে। মিঠু বুঝতে পারলো না সে সুমীকে কি বলবে । অবশ্য এমন ভান করলো খাতাটা সে খুলেই নি।

সুমি এসেই বলল, রিকশায় উটো আমি তোমাকে আজকে দুপরে চায়নিস খাওয়াবো। মিঠু রিকশায় যেয়ে উঠলো। দু জন দু জনের শরীরের ছোয়া স্পষ্টই পেল। বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা হলো না। মিনিট পাঁচেক পরে সুমি খুব সাহসের একটা কাজ করলো। মিঠুকে একটা আহ্লাদী সুর করে বলল, তোমার শরীরের ছোঁয়ায় আমি মোমের মত গলে গলে পরছি। এর উত্তর মিঠু কি দিতে পারে তা তার মাথায় এলো না। সে তখন চিন্তা করছে, খাতায় তার ছবি আর তাকে নিয়ে শত শত লেখার কথা। একেবারে অপ্রত্যাশিত না হলেও, এত বড় বড় দুটো ধাক্কা নেয়ার নেয়ার প্রস্তুতি তার ছিল না।

অনেক চেষ্টা করেও, মিঠু বলতে পারল না সে সুমিকে বন্ধুর বেশী কিছু চিন্তা করে না । যে আবেগ, প্রস্তুতি, আর ভালো লাগা থাকার দরকার একটা মেয়ের সাথে প্রেম করার জন্যে, তার কোনটাই তার এখন নাই। এই ভাবনা যে সে বদলাতে পারবে তার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হল না।

এর পরের ঘটনা প্রবাহ, এক সিংহ রাশির জাতকের এক সিংহ রাশীর জাতিকাকে এড়িয়ে চলার। সুমি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কথা বলতে পারল না মিঠুর সাথে। চরিত্রের সাথে মিলে না, এমন কিছু কাজ মিঠু করলো। পর পর তিন বার সময় দিয়ে মিঠু আসলো না সুমির সাথে দেখা করতে । তার পরে আরেকবার, সুমিকে নিয়ে বসালো এমন একটা আড্ডায় যেখানে সবাই ছিল মিঠুর ছেলে বন্ধু। সুমির সাথে তেমন কোনো ওদের পরিচয় ছিল না। সুমি অস্বস্তিতে ভুগতে থাকলো। কিছুক্ষণ পরে উঠে চলে গেল। বলল একটা কাজের কথা মনে পড়ে গেছে ।

সুমিও নিজেকে গুটিয়ে নিল মিঠুর থেকে। পথে ঘাটে দেখা হলে কেমন আছো, ভালো আছি জাতীয় কিছু আনুষ্ঠানিক কথা বার্তার বাইরে তেমন কোনো কথা বলে না। বছর খানিক পরে, শুধু একবার আড়ালে ডেকে মিঠুকে বলল, রাজার সাথে তার বিয়ে হবে না। রাজা আরেক জন মেয়েকে বিয়ে করেছে। জবাবে মিঠু কিছু বলতে পারল না । চিন্তা করতে থাকলো, সুমি কি এখনো তাকে পেতে চায়। তাকে পাওয়ার জন্যে কি মিথ্যা করে বলছে, রাজার সাথে অন্য কোন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে ।

আরো বছর তিনেক পার হয়ে গেল। অনার্স পরীক্ষার প্রথম দিন। হলে ঢুকার আগে শেষ বারের মত বই, নোটে সবাই চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। মিঠু পরিচিত একটা কন্ঠ শুনলো। শুনো পরীক্ষার পরে একটু অপেক্ষা করো। তোমাকে জরুরী একটা খবর দেয়া আছে। আবার পালিয়ে যেও না। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো সুমি । অদ্ভূত, সুমি নীল শাড়ী পরে পরীক্ষা দিতে এসেছে।

পরীক্ষা দিতে দিতেই অনেক চিন্তা মিঠুর মাথায় চলতে থাকলো। এত দিন পরে, সুমি তাকে কি বলতে চায়, কি এমন জরুরী কথা হতে পারে! আবার শাড়ী পরে আসার কি কারণ হতে পারে। মেয়েটার কি তবে বিয়ে হয়ে গেল নাকি। মনে তো তাই হচ্ছে। আর যদি বলে, এখনো সে অপেক্ষায় তা হলে কি উত্তর হবে। যদি বলে, চল আমরা পালিয়ে যাই।

মিঠু পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দেখে দরজার পাশে সুমি দাড়িয়ে। বলল চলো ওই কোণায় । ভয় নাই এক সিংহ আরেক সিংহকে খেয়ে ফেলতে পারে না। কয়েকটা শুধু কথা বলবো। যেতে যেতে ব্যাগ থেকে কিছু রজনীগন্ধা ফুল বের করে মিঠুকে দিল। নীল শাড়ী পরা সুমি বলল, মনে আছে তুমি আমাকে একবার রজনীগন্ধা কিনে দিয়ে ছিলে? তা এখন ফিরিয়ে দিছি। আমারটা তোমার দেয়া ফুলের মতো ফ্রেস না। সকালে কেনা তো, তার পরে এতক্ষণ ব্যাগে ছিল।

যাই হোক তোমাকে বেশীক্ষণ ধরে রাখবো না। তোমাকে একটা খবর দেই। সপ্তাহ দুয়েক আগে আমার বিয়ে হয়েছে। বছর খানেক ধরে আমাদের পরিচয় ওরও প্রিয় রং নীল আর প্রিয় ফুল রজনীগন্ধা। ও আমাকে বলেছে আমি যখনই নীল শাড়ী পরবো, আমি তখনি রজনীগন্ধা গিফট পাবো। কিন্তু আজ রজনীগন্ধা পেতে না, দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সব চেয়ে বেশী ইচ্ছে করছিল; তোমার রজনীগন্ধার ঋণটা শোধ করতে।

আরেকটা কথা, সে ও সিংহ রাশী আর ওর নামও মিঠু।

উৎসর্গ: যারা প্রথম প্রেম সারা জীবন ধারণ করেন, তাদের সবাইকে