শেষ ইচ্ছা
রোজার মাস। ঠিক করলাম ফেসবুক থেকে দূরে থাকবো। মানে কিছুটা সময় বাঁচিয়ে অন্য কিছু করবো। তবে এমন না যে অভিমান করে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। আসলে একবার ফেসবুকে ঢুকলে বেশ কিছুটা সময় চলেই যায়! তাতে রোজার মাসে অন্যান্য কাজের জন্যে সময়ের টান পড়ে। কিন্তু এমন না যে ফেসবুকে আমার সময়টা পুরোটাই অনর্থক হয়ে যায়। তবে অকারণ ও ভিত্তিহীন পোস্ট, কমেন্ট, লাইক, শেয়ারে বিরক্তি উদ্রেক করে। এটাও সত্য যে পরিচিতদের সর্বশেষ খবরাখবর ফেসবুকের কল্যাণেই এখন আমাদের সবার নখদর্পণে। সাথে সাথে আমরা জানতে পারছি ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন বিষয়ের তর্ক-বিতর্ক।
বাঙালি যে পরোপকারী আরেকবার হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বর্তমান যুগে স্মার্ট ফোনের কল্যাণে ফেসবুকে কেউ ট্যাগ কিংবা ম্যাসেঞ্জার করলে সাথে সাথেই নোটিফিকেশন চলে আসে। কোন সময় কি জরুরী বিষয় ঘটে সে জন্য নোটিফিকেশনে চোখ এমনিতেই যায়। সেখান থেকেই বিপত্তির সূত্রপাত। কারো বাগানে হয়তো দুটো পেয়ারা ধরেছে, সে সেই ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে আমাকে ট্যাগ করে দিলো। এ ধরণের ঘটনাগুলোতে আমার মতো বে-রসিক মানুষের পক্ষে বিশাল কোনো মাহাত্ম্য বের করাটা বিরাট কঠিন কাজ। তার পরেও এই সব ফেসবুক বন্ধুদের সৎ ইচ্ছার জন্য সাধুবাদ দিতেই হয়।
লেখাটা নিয়ে এগুনোর আগে ছোট একটা গল্প বলি। এক মা লক্ষ্য করলেন তার টিন এজার ছেলে বাসায় কম্পিউটারে ফেসবুকে প্রচুর সময় কাটাচ্ছে। এমন অবস্থা হয়ে গেল যে কিশোরটা ঘর থেকে বেরই হয় না। বাসায় কারোর সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। মা শত চেষ্টা করেও ছেলেকে কম্পিউটার থেকে উঠাতে পারলেন না। তিনি বকা-ঝকা করলেই ছেলে বলে, “আমার ফেসবুকে সাড়ে চার হাজার বন্ধু আর ছয় হাজার ফলোয়ার। মেনটেন না করলে ওরা সব চলে যাবে।” ওল্ড ফ্যাশন মা ছেলের কথা ধরতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এর মধ্যে ছেলের ডেঙ্গু জ্বর হলো। সে জন্যে বেচারাকে হাসপাতালে সাত দিন থাকতে হলো। মা ভেবেছিলেন ছেলের যখন এতো বন্ধু-বান্ধব, ফলোয়ার; হাসপাতালে সন্তানকে দেখতে প্রচুর মানুষ ভিড় করবে। কিন্তু কাউকে আসতে না দেখে তিনি পুত্রের কাছে জানতে চাইলেন বিষয়টা কি। ছেলে গর্ব করে উত্তর দিলো, “আমার ‘ইন হসপিটাল’ স্ট্যাটাসে দু শোটা লাইক, তিন শত স্যাড ইমোজি পড়েছে।” আবারও পুরনো প্রজন্মের মা বুঝতে পারলেন না, বাস্তব মানুষের ডিজিটাল সহানুভূতি কতটুকু উপকারে আসতে পারে।
ফিরে আসি ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জার বিষয়ে। কিছু শিক্ষিত বন্ধু নিয়মিতভাবে অন্যদের থেকে ধার করা ধর্মীয় তথ্য পাঠিয়ে আমার বন্ধু-বান্ধবদের একই ম্যাসেজ ফরোয়ার্ড করার জন্যে অনুরোধ করে চলেছেন। সাথে আবার সাবধান বাণী জুড়ে দিচ্ছেন; ফরোয়ার্ড করলে প্রচুর পুণ্য। না করলে না-কি বিপদ ডেকে আনা হবে। এইসব অতি-উৎসাহী শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ধর্মের কোন বিধানেই এ ধরণের বয়ান নাই। বরং আপনি নিজের সময় দিয়ে অন্যদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্যে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে পারেন। মুহূর্তেই যেখানে ম্যাসেঞ্জার ম্যাসেজ পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে পৌঁছে দেয়, সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তা এই মাধ্যমে না পাঠানোই শ্রেয়। জনগণের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলার থাকে ফেসবুকে পোস্ট করে দিতে পারেন; যার ইচ্ছা সে দেখবে, পড়বে। ভালো লাগলে লাইক-শেয়ার কমেন্ট করবে। গণ ট্যাগ করে কিংবা ম্যাসেঞ্জারে সরাসরি না পাঠালে কিছু মানুষ নিশ্চয়ই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচবে।
এইবার রোজার মাসে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ আকারে সয়লাব হয়েছিল এমন একটা গল্পের কথা বলি। এক ভদ্রলোক হুজুরকে জিজ্ঞাসা করছেন, ফেসবুকে স্ত্রীকে ভালোবাসি কথাটা বলা যাবে কি-না। উত্তরে হুজুর বলছেন, রোজার মাসে মিথ্যা না বলাই ভালো। তা হলে প্রশ্ন আসতে পারে মানুষ কি ফেসবুকে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে? শুনেছি অন্যকে খুশি করার জন্যে কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী লাইক, কমেন্ট দিয়ে থাকেন। এই ধরণের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ব্যক্তি জীবনে যেমন আপনার কথা-বার্তা, ব্যবহার দেখে আপনাকে মূল্যায়ন করা হয়; অনেকটা সে-রকমভাবেই ডিজিটাল দুনিয়ায় পোস্ট, কমেন্ট, লাইক দিয়ে আপনাকে বিচার করা হয়। ইদানীং যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেবার আগে প্রার্থীর ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যমে কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করা হয়।
এইবার আরেকটা গল্প বলি। এক মহিলা ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তাররা রায় দিয়ে দিলেন, যে আগামী অল্প কিছু সময়ের মধ্যে রুগীর মৃত্যু হবে। স্বামী খুব বিচলিত হয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীকে কানে কানে বললেন, “তোমার শেষ ইচ্ছাটা কি বলো? আমি সেটা অবশ্যই পূরণ করবো।” স্বামীকে অবাক করে দিয়ে মৃত্যুপথ যাত্রী অর্ধাঙ্গিনী অনেক কষ্ট করে ফিসফিস করে জানালেন, “কালকে আমি ফেসবুকে “মৃত্যু অত্যাসন্ন” দিয়ে পোস্ট দিয়েছিলাম। আমি এখন দেখতে যাই আমার মৃত্যু নিয়ে কে কে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দিয়েছে। এইটাই আমার শেষ ইচ্ছা।”
ফেসবুক পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমার তো মনে হয় এখানে ব্যক্তিগত খবরাখবর, হাসি মাখা ছবি দেয়ার পাশাপাশি চিন্তার উদ্রেক হয় ও জীবন সুন্দর করে এমন ধরণের পোস্ট দেয়া এবং সেগুলোতে লাইক-শেয়ার, কমেন্ট দিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করা উচিৎ। শেষে বলি, আর যারা আমার মতো কিছুটা সময়ের জন্যে ফেসবুক থেকে ডুব দিতে চায়, তাদেরকেও সেই সুযোগ দেয়াটাও বাঞ্ছনীয়।
বন্ধুরা আমি তো আমার মতামত দিলাম, আপনারা কি বলেন?
জুন ৬, ২০১৮
কাজী হাসান
প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com