খেয়া পারের তরণী

ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বারো জন মুক্তিযোদ্ধা নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে। এবারের অভিযান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাকাইল ব্রিজের ধারের মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমণ করতে হবে। সম্ভব হলে আজকেই সাকাইল ব্রিজটা উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা। সোর্স জানিয়েছে ক্যাম্পে শ’ খানেক পাক হানাদার অবস্থান করছে। সাথে প্রচুর ভারী অস্ত্র -শস্ত্র। আচমকা আক্রমণ করে সর্বোচ্চ ক্ষতি করতে হবে। এই দলটা আক্রমণ করবে পূর্ব দিক থেকে। আরেকটা মুক্তিযোদ্ধাদের দল দক্ষিণ দিক থেকে থেকে যেয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার জন্যে রকেট লঞ্চার ও গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ করবে। সেখানে আছে সাত জন মুক্তিযোদ্ধা। বড় দলটার কমান্ডার জালাল। ছোট দলটার নেতৃত্বে দিচ্ছে চন্দন। দু জনই ভয়ঙ্কর ধরণের যোদ্ধা। যুদ্ধে হানাদারদের যেমন তারা হতাহত করেছে, তেমনি নিজেরা অনেকবার আহত হয়েছে। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। কিছুটা সুস্থ হয়েই ফিরে এসেছে নতুন কোন একশনে। তারা প্রতিজ্ঞ যুদ্ধে তাদের জিততেই হবে। বাংলাদেশকে পাক হানাদার মুক্ত না করে বিশ্রাম তারা নিবে না।

অভিযানটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ-ই না, খুবই বিপদজনকও বটে। সংখ্যায় প্রায় দশ গুণ বেশী সৈন্যদের সাথে লড়তে হবে। তার থেকে বড় সমস্যা হলো মিলিটারিদের পরের ক্যাম্প বেশ কাছে। এই ক্যাম্প থেকে সাহায্য যেয়ে ওয়ারলেসে ম্যাসেজ দিলে অন্য ক্যাম্প থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে সৈন্যরা চলে আসবে। পাঁচজনের আরেকটা তৃতীয় মুক্তিযোদ্ধার দল এই সাহায্য করতে আসা মিলিটারির গাড়ির উপর আচমকা আক্রমণ করে গুলি চালাতে থাকবে। কতজন মিলিটারি আর কয়টা ট্রাক সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে, সেটা বলা কারোর পক্ষেই সম্ভব না। পাঁচ জন মুক্তিযোদ্ধা কতক্ষণ ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, সেটাও বলা মুশকিল।

এই অভিযানটা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কিন্তু কাছাকাছি দুটো মিলিটারি ক্যাম্প হওয়াতে ঠিক মাথায় আসছিল না, কিভাবে আক্রমণটা করা যায়। বড় সংখ্যার মুক্তিযোদ্ধা পাঠালে মিলিটারি আগেই জেনে ফেলবে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর ঠিক হলো, অল্প সংখ্যক যোদ্ধা যাবে। তারমধ্যে ছোট দল দুটো একদিন আগে যেয়ে আশে পাশে লুকিয়ে থাকবে। গোপনে রেকি মানে পর্যবেক্ষণ করবে। চন্দনের দল অবশ্য জালালের দলের জন্যে একটা কাজ করে রাখবে। ব্রিজ থেকে তিন মাইল দূরে নদীর অন্য পাড়ে নির্দিষ্ট স্থানে একটা নৌকা লুকিয়ে রাখবে। সেই নৌকা দিয়ে যোদ্ধার দল অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে অন্য পাড়ে যাবে। এদের কাছে রকেট লঞ্চার, গোলা বারুদ, গ্রেনেড সহ আরও কিছু অস্ত্র থাকবে।

দেশের জন্যে এই তরুণ বাঙালিগুলোর ভীষণ ভালোবাসা। সীমান্ত অতিক্রম করেই দেশের মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। সাথে আরম্ভ হলো ওদের কান্না। কেন কাঁদছে ওরাই হয়ত সব চেয়ে ভাল জানে! এই মাটিকে উপর কত না অত্যাচার চলছে। সন্তান হয়ে মায়ের উপর অত্যাচার কেই বা সহ্য করতে পারে? ভাইয়েরা খুন হচ্ছে, মা-বোন ধর্ষিতা হচ্ছেন। এর থেকে বেশী কষ্টের আর কি হতে পারে? কমান্ডার জালাল ছোট একটা বক্তৃতা দিলেন, “ভাইরা আমার, কান্নাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করো । আজকে আমাদের অভিযানকে সফল করতেই হবে। এই মাটিকে আমরা মুক্ত করবই। আমরা জানি না আমরা কয়জন অক্ষত ফিরে আসতে পারব। তবে আল্লাহ সাক্ষী, আমরা আমাদের মা’কে মুক্ত করতে যাচ্ছি।”

দলটার প্রত্যেকের কাছে নিজের প্রাণ থেকে অনেক বেশী জরুরী মাতৃভূমিকে মুক্ত করা। কারোর কোনো ক্লান্তি নাই। চোয়াল ইস্পাতের মত শক্ত, মনে বিন্দুমাত্র ভয় নাই। দামাল ছেলেগুলো মানুষরূপী পাক হানাদার পশুগুলোকে বিলীন করতে নির্মম হতে প্রস্তুত। তারা ধীরে পায়ে এগিয়ে চললো। প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটার পরে হাজির হলো নদীর ধারে। সেখানে তাদের জন্যে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নৌকা থাকার কথা। না সেখানে নৌকা নাই। এমনকি আশে পাশে কোন নৌকা দেখা গেল না। ডাঙ্গায় একটা নৌকা অবশ্য পড়ে আছে। মনে হচ্ছে নৌকাটাকে টেনে উপরে উঠানো হয়েছে। মাটিতে টেনে তুলার ছাপ স্পষ্ট। কেউ ইচ্ছা করে নৌকাটার মাঝখানে একটা বিশাল বড় ছিদ্র বানিয়েছে। নৌকাটা যাতে আর ব্যবহার না করা যায়।

সাঁতরে এই পাড় থেকে ওই পাড়ে যাওয়াটা কঠিন কিছু না। দলের সবাই সাঁতারু। কিন্তু সমস্যা আরেক জায়গায়। সাথের গোলা বারুদ, অস্ত্রে পানি লাগানো যাবে না। সবাই এ দিক ওদিক তাকাচ্ছিল, বিকল্প কোন উপায় পাওয়া যায় কি-না। নদীতে আর কোনো নৌকা দেখা যাচ্ছে না। ফিসফিস করে কথা বলে নিজেরা বুদ্ধি বের করার চেষ্টা করলো। মাথার উপরে অস্ত্র নিয়ে পানিতে নামা যায়। কিন্তু সমস্যা সেখানে দুটো। এক পানি লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। দুই, মাঝ নদী বেশ গভীর। সাঁতারের জন্য হাত ব্যবহার করতে হবে। তখন তো আর অস্ত্র মাথার উপরে তুলে রাখা যাবে না।

হঠাৎ একটা মেয়েলি গলার আওয়াজ কানে এলো। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসী; ভূতের ভয় ওদের নাই। প্রায়ই রাত-বিরাতে অভিযানে বের হতে হয়। সাপ, বিচ্ছু, জোক--এখন আর কোন ব্যাপারই না। আর ভূতের ভয় তো একেবারে তুচ্ছ। তারপরেও সাবধানে থাকতে হয়। কান সব সময়ে খাঁড়া-ই থাকে। শত্রুর তো অভাব নাই। রাজাকাররা এদিক ওদিক লুকিয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করে বসে। ক্যাম্প থেকে শুনে এসেছে ইদানীং মিলিটারিও এই অঞ্চলে টহল দিতে বের হয়। যাই হোক মেয়েলি কণ্ঠে সবাই সতর্ক হয়ে উঠলো। সাথে সাথেই অজানা আক্রমণের আশংকায় অস্ত্র প্রস্তুত করে ফেললো।

পরের মুহূর্তেই ১৪-১৫ বছরের একটা বালিকার ওদের সামনে উদয় হলো। স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় জানতে চাইলো, “তোমরা কি মুক্তি?” কি অদ্ভুত, এত রাতে একাকী এক মেয়ে এতগুলো অস্ত্রধারী মানুষের সাথে কি নির্ভয়ে কথা বলছে। কমান্ডার জালাল বুঝার চেষ্টা করছিলেন, এখন কি করার উচিত। যদিও মুক্তিযোদ্ধারা এই মুহূর্তে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত।

মেয়েটা একটু থেমে নিয়ে বলে চললো, “তোমাদের নৌকা রাজাকাররা ছিদ্র করে দিয়েছে।” মেয়েটা এবার সবার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমরা বন্দুক নামিয়ে ফেলো। আমার সাথে আসো। আমার নৌকা ওই-ওখানে লুকানো আছে । বলেই সে হাটা আরম্ভ করল। মুক্তিযোদ্ধারা সতর্কতার সাথে মেয়েটাকে অনুসরণ করলো।

একটু দূরেই নদীর বাঁকে নৌকা বাঁধা। সাইজে খুব বেশী বড় না হলেও সবাই এঁটে গেল। নদী পার হতে মিনিট বিশেক লাগল। এর মধ্যে তেমন একটা কোন কথা হলো না। মেয়েটা দলের নেতা কে, এর মধ্যে বুঝা ফেলেছে। ওই পাড়ে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে মেয়েটা কমান্ডারের উদ্দেশ্য একটা শীতল গলায় কিন্তু পরিষ্কার স্বরে বলল, “আমার নাম সখিনা। আমার বোন জরিনা। তাকে সাত দিন আগে পাক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমাকেও নিতে চেয়েছিল। যেই রাজাকার ওদের নিয়ে এসেছিল, সে ওদেরকে বলল আমাকে পরের বার নিতে।” এইবার মেয়েটা ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো, “পারলে আমার আপুরে আইনা দিয়েন। না হয় জানোয়ার-গুলোরে গুলি করে শেষ কইরা দিয়েন।”

ঠিক হল মেয়েটা এই নৌকা নিয়ে ভোর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন শেষে ফিরতি পথে সখিনা তাদেরকে আবার নদী পার করে দিবে। নেমে যাওয়ার সময়ে যোদ্ধারা মেয়েটার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। মৌখিক ধন্যবাদ দিয়ে তো এক বাঙালি গ্রাম্য বালিকার এই বিশাল বড় অবদানকে ছোট করা যায় না। শেষের কথাগুলো সখিনাই বলল, “আমিও আপনাদের সাথে যুদ্ধ যাবো। আপু না ফেরা পর্যন্ত আমি শুধু পাক জানোয়ারদের গুলি করতেই থাকবো।” কারোর বুঝতে বাকী রইলো না, কথাগুলো কি প্রচণ্ড ক্রোধ ও ক্ষোভ থেকে বের হচ্ছে!

মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। কথা ছিল কমান্ডার জালালের দল আচমকা পাক ক্যাম্পে আক্রমণ করবে। মিলিটারিরা এই দলের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই, অন্য দলটা ব্রিজটা উড়িয়ে দেয়ার কাজে লেগে পড়বে। এর মধ্যে অন্য ক্যাম্প থেকে মিলিটারিদের সাহায্যকারীদের উপর হামলা চালাবে রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকা তৃতীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দল।

শেষের কাজটা প্রথমে আরম্ভ হয়ে গেল। কিছু পাক সেনা অন্য ক্যাম্প এমনিতেই স্থানান্তরিত হয়ে সাকাইন ক্যাম্পে আসছিল। এই পাকিস্তানী ক্যাম্প থেকে বাড়তি সৈন্যের কোনো আবেদন করা হয় নি। সাব কমান্ডার চন্দন পাক মিলিটারিদের ট্রাক দেখেই আক্রমণ করে বসলো। ট্রাকের মিলিটারিরা হাসি ঠাট্টা করতে করতে আসছিল। সারা বাংলায় অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাবে, আনন্দ ঠাট্টায় মশগুল থাকবে; সেটা কেমন করে হয়? ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে পড়তে লাগল ট্রাকে। কি হচ্ছে বুঝার আগেই, বেশ কয়েকটা পাক্কুর জীবন শেষ হয়ে গেল। কয়েকজন প্রতিরোধের চেষ্টা করে পাল্টা গুলি চালানো আরম্ভ করলো। এইবার বাঙালিরা ট্রাক লক্ষ্য করে কয়েকটা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল। ট্রাকটা ভীষণ শব্দ করে বিস্ফোরিত হয়ে সাথে সাথে আগুন লেগে গেল। ট্রাকের ভিতরের গোটা বিশেক পাক মিলিটারির জীবন ওখানেই শেষ হয়ে গেল।

এত অল্পতেই কাজটা শেষ হবে সেটা চন্দনের হিসেবে ছিল না। যোদ্ধাদের এক জায়গায় করে প্রথমে ওদের বাহবা দিলো। তারপরে বলল, “বেশী আনন্দিত হওয়ার কোন উপায় নাই। যে কোন মুহূর্তে বিপদ চলে আসতে পারে। সে জন্যে সাবধান, খুব সাবধান! প্ল্যান অনুযায়ী এতক্ষণে ক্যাম্পে আক্রমণ আরম্ভ হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ মিলিটারি ট্রাক, আক্রমণ হওয়ার ঘণ্টা খানেক পরে আসার কথা।” চিন্তিত মুখে অন্যদের জানালো, “বুঝতে পারছি না গোলাগুলির শব্দ কেন শোনা যাচ্ছে না।” দলটা ঠিক করল তারা সাবধানে ক্যাম্পের দিকে এগুতে থাকবে। যদি বাকী দল দুটোর কোন সাহায্যের দরকার হয়।

দলটা এইবার অন্য ধরণের সমস্যায় পড়লো । আক্রান্ত ট্রাক থেকে সম্ভবত তারা যে ক্যাম্প থেকে এসেছিল এবং যে ক্যাম্পে যাচ্ছিল, দু জাগাতেই ওয়ারলেসে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল। দু দিক থেকে আসা পাক মিলিটারি সাব কমান্ডার চন্দন ও তার ছোট দলকে দু দিক ঘিরে ফেললো। চন্দন সাথীদের বুঝিয়ে দিলো চারিদিকে এখন শুধু বিপদ। শুনলো এক হানাদার চিৎকার করে বলছে, “হ্যান্ডস আপ”। চন্দন শব্দ যে দিক থেকে এসেছে সেদিকে গুলি চালাতে চালাতে একটা গাছের পিছনে আশ্রয় নিলো। দলের অন্যরাও কভারের জন্য এদিক ওদিক ছুটতে লাগল। সাথে অন্ধকারে অনেকটা আন্দাজে শব্দ লক্ষ্য ধরে নিয়ে গুলি চালাতে লাগল। কিন্তু বেচারা স্বল্প সংখ্যক বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা করতে পারল না। পাক হানাদাররা আরও অনেক বেশী শক্তি নিয়ে স্টেন গান থেকে বিরতি-হীনভাবে গুলি চালাতে থাকল।

কমান্ডার জালাল ও তার দল পজিশন নেয়ার আগেই প্রথমে গুলির শব্দ শুনতে পেল। পরে দেখল আগুন। ক্যাম্পের যখন কাছাকাছি তখন দেখল দুটো মিলিটারি ট্রাক সজোরে বের হয়ে গেল। কমান্ডার জালালের একশন শুরু করার সংকেত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে গেল। বাকীটুকু পরিকল্পনা মোতাবেক এগুতে থাকলো। গুলি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে গ্রেনেড ছুড়তে থাকল। সাথের রকেট লঞ্চারও ব্যবহার করা হলো। ক্যাম্পের মিলিটারিরা কিছুক্ষণের মধ্যেই সমান তালে পাল্টা গুলি চালানো আরম্ভ করলো। মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য এদেরকে যতক্ষণ ব্যস্ত রাখা যায়।

অন্য দলটা সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলো। ব্রিজটাকে উড়ানোর ব্যবস্থা করতে লাগল। তাদের সাথে একজন বিস্ফোরক এক্সপার্ট ছিল। তিনি প্রাক্তন আর্মির মানুষ। তাকে ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার কাজে অংশ নেয়ার জন্যই এই অপারেশনের নেয়া হয়েছিল। শেষের দিকে অবশ্য মিলিটারিরা বুঝে ফেললো, মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের মূল কারণটা কি। তারা বিভক্ত হয়ে গেল এবং দু দিকে গুলি চালাতে লাগল। ব্যাটারা তো পেশাজীবী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিলিটারি। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উল্টো আক্রমণ করার নিয়ম কানুন ভালই তাদের জানা। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর বিরামহীনভাবে গুলি আসা আরও বেড়ে গেল।

প্রচণ্ড শব্দে ব্রিজটা গুড়িয়ে নদীর উপর পড়তে থাকলো। এই মুহূর্তটার জন্যই অকুতোভয় বাঙালি ছেলেগুলো জীবনের বাজি ধরে এসেছিল। কিন্তু খুশী হওয়ার কোন উপায় নাই। এখন মূল কাজটা হলো পিছু হটা। গুলির রেঞ্জের বাইরে যাওয়া মাত্রই নদী পার হয়ে ছুটে বর্ডারের ওই পাড়ে চলে যাওয়া। দিনের আলো ফুটলেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে নিশ্চয়ই প্রচুর মিলিটারি চলে আসবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্যে পুরো জায়গাটা চষে ফেলবে। কমান্ডার জালাল নির্দেশ দিয়ে দিলো, পিছু হটার।

কমান্ডার জালালের বাম দিকের ঘাড়ে গুলি লাগল। প্রচুর রক্তক্ষরণ ও ব্যথা নিয়ে এই যোদ্ধা তার কাজ নির-বিচ্ছিন্নভাবে করে গেল। মুহূর্তের জন্যও বিরতি নেয়ার উপায় নাই। ১২ জনের দলের অবস্থা বেশ করুণ। রহিমের ও সিদ্দিকের গুলি লেগেছিল মাথায়, রতনের ঠিক বুকের মাঝখানে। তিনজনই এর মধ্যে শহীদ হয়েছে। দেশ মাতৃকা ওদের টকটকে লাল রক্তে রঞ্জিত। দলের মধ্যে আরও তিনজন আহত। অন্য যারা অক্ষত ছিল, তারা আহতদের সাহায্য করতে লাগল ঘটনাস্থল থেকে সরে যাবার জন্যে। অন্যদিকে যে পাঁচজন ব্রিজ উড়িয়ে দিল, তাদের প্রত্যেকেই ইহ জগতের সব দায়িত্ব শেষ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে গেল। মাতৃভূমিকে হায়েনার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই প্রাণ দিলো।

দলের বাকী নয় জন ভোর হওয়ার কিছু আগেই নদীর পাড়ে এসে হাজির হলো। কিন্তু কি অদ্ভুত। নৌকা আছে, কিন্তু সখিনা নাই। ওরা এই দিক ওই দিক তাকালো। ভাবলো, মেয়েটা হয়ত ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। না সেটা সম্ভব না। কারণ তার বাড়ি নদীর ওই পাড়ে। নৌকা ছাড়া সে নদী পারি দিবে কি করে? তাকে খুঁজতে যাওয়া সম্ভব না। এই দিকে আলো ফোঁটা আরম্ভ করেছে। নৌকার থেকে কিছু দূরে কয়েকটা ভাঙ্গা চুড়ি দেখা গেল। তার পাশে এক জোড়া স্যান্ডেল। কমান্ডার জালালের পর্যবেক্ষণ ও স্মৃতিশক্তি ভাল। এইগুলো যে সখিনার সেটা বুঝতে বেশী সময় লাগল না। বুঝলো, সখিনাকে জোড় জবরদস্তি করে এখান থেকে কেউ নিয়ে গেছে। কমান্ডার এক দলা থু থু মুখ থেকে ছুঁড়ে বলল, “হারামজাদা রাজাকাররা নিশ্চয়ই তুলে নিয়ে গেছে।”

ওদের অপেক্ষা করার উপায় নাই। নৌকায় উঠে নিজেরাই বৈঠা নিয়ে বাইতে আরম্ভ করলো।

সাব কমান্ডার চন্দনের দলটা সরে যেতে পারলো না। দলে ছিল মাত্র পাঁচ জন। তাদের ঘিরে ফেলল তিন ট্রাক পাক হানাদার। তার পরেও যোদ্ধারা ছেড়ে দেবার পাত্র না। ওদের কাছে রকেট লঞ্চার ছিল একটা, সাব মেশিনগান দুটো, বাকী দুটো থ্রি নট থ্রি আর কিছু গ্রেনেড। এই দিয়ে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুললো। তবে বেশীক্ষণ প্রতিরোধ টিকলো না। জহির গ্রেনেড ছোড়ার পরের মুহূর্তেই মিলিটারিদের বন্দুক থেকে এক ঝাঁক গুলি এসে বুক ঝাঁঝরা করে দিলো। বেচারা শেষ কোথা ছিল ‘জয় বা...’। পুরো কথাটা শেষ করতে পারলো না। আরেকজন বাঙালি দামাল ছেলে দেশ মাতৃকার বুকে লুটিয়ে পড়লো।

চন্দনের বাম দিকে জহির। হাত ছয়েক দূরে ছিল। চন্দন দেখলো জহির লুটিয়ে পড়ছে। ইচ্ছা থাকলেও ওর সাহায্যে ছুটে যেতে পারলো না। তার বিনিময়ে আরও পাঁচ জন পাক জানোয়ারকে গুলি করে খতম করলো। দলের রসিক সদস্য সেলিমের মাথায় গুলি এসে লাগলো। পাক বাহিনীকে সে বলতো হাতি আর মুক্তিযোদ্ধাদের পিঁপড়া। সে সবাইকে রসিয়ে হাসাতো, “এইতো মাত্র আর কয়টা দিন। পিপড়ার কামড়ে হাতি এই ধপাস করে পড়লো আর কি। তখন কিন্তু বাংলাদেশে ভূমিকম্প হয়ে যাবে।” তার বলার ধরণ দেখে ও কথা শুনে দলের সব চেয়ে গম্ভীর সদস্যও হেসে কুটি কুটি হতো। সেই চির রসিক সেলিম মা গো’ চিৎকার করে পড়ে গেল। তিন মিনিটের মাথায় আরেকটা আর্ত চিৎকার। কামাল বাংলার বাতাস থেকে খুব জোড়ে প্রাণ ভরে প্রথমে শ্বাস নিলো। আহ বাংলার বাতাসে শ্বাস নিতেও কত না আনন্দ। পরের মুহূর্তেই সেই বাংলার বাতাসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। দেখো বাংলা মা গো, তোমার আরেক সন্তান তার ঋণ শোধ করার চেষ্টা করে গেল!

চন্দন ও খোকাকে ওরা জীবিত ধরলো। অবশ্য জীবিত না বলে অর্ধ মৃত বলাটাই ঠিক হবে। চন্দনের ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে পুরোটাই থেঁতলে গেছে। ঘাড়ের ডান দিকে গুলি লেগে আরেক দিয়ে বের হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ইচ্ছা ছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুলি চালানোর। কিন্তু না শরীরে কুলোই নি। চন্দন জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। খোকার অবস্থা আরও খারাপ। মনে হচ্ছে তার শরীরে এমন কোনো জায়গা নাই যেখানে গুলি লাগে নি। হাত, পা, পেট, বুক থেকে রক্ত বের হচ্ছে। খোকার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিল না। বুঝল তার হাতে একেবারেই সময় নাই। নিজেই অবাক হল সে এখনো কি করে বেঁচে আছে।

পাক বাহিনী ঠিকই বুঝে ছিল কে কে এখনও বেঁচে আছে। অচেতন চন্দন এবং অর্ধ-মৃত খোকনকে ক্যাম্পে নিয়ে এক অন্ধকার ঘরে নিয়ে ছুড়ে ফেললো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে খোকনও জ্ঞান হারালো। তারপরে দু জন মুক্তিযোদ্ধা যে কতক্ষণ অচেতন হয়ে ছিল, সেটা দু জনের কারোরই বলতে পারার কথা না। চন্দনের মনে হলো অনেক দূর থেকে এক জন মনে হয় পানি চাচ্ছে, ‘পা...নি, পা...নি’। মাথার মধ্যে খেললো না, সে কোথায় আর পানিই বা কে চাচ্ছে। চোখ খুলার চেষ্টা করলো। চোখের পাতা এতো ভারী কেনো? অনেক কষ্টে চোখ খুললো। এক এক করে মনে পড়লো সাকাইন ব্রিজ অপারেশনের কথা, সঙ্গীদের নিহত হওয়ার কথা।

চন্দন নিজেকে বলল, সে এখনও বেঁচে আছে। যে পানি চাচ্ছে, সে তা হলে তার দলেরই সদস্য। মাথাটা খুব ঝিম ঝিম করছিল। সেটা কে হতে পারে বের করতে আরও কয়েক মিনিট লাগল। ফিস ফিস করে প্রশ্ন করল, “কে খোকন না-কি?” এর মধ্যে খোকন পানি চাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এখন একটা গোঙ্গানির শব্দ খোকনের শরীর থেকে এমনিতেই বের হয়ে আসছে। চন্দনেরও ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। মনে হচ্ছে পানি না পেলে এই মুহূর্তেই সে মারা যাবে। শরীরের সব শক্তি এক জায়গা জড় করে চিৎকার করার চেষ্টা করল। একটা ফ্যাসফ্যাসে শব্দ গলা থেকে উঠে এলো, “ পা...আ আ আ ...নি”।

আশাতীত কাজ হলো। দরজা খুলে এক মিলিটারি ঢুকলো। তার হাতে এক মগ পানি। প্রথমে খোকনের দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু তার নিজের থেকে পানি খাওয়ার উপায় নাই। খোকন পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। শরীর পানি শূন্য হলেও, চোখ থেকে কিভাবে যেন দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বাড়ি তার খুলনা। ঘরের তিন দিকে তিন পুকুর। দুটো টিউবওয়েল। সব সময় যেনো পানির সাথে বসবাস। খোকন পানির দিকে ভেজা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো। মিলিটারির দয়া হলো কি-না বলা মুশকিল। সে মগ নিয়ে খোকনের মুখের কাছে ধরলো। খোকন তার তেষ্টা মেটানোর চেষ্টা করলো। একইভাবে চন্দনের ভাগ্যেও সামান্য একটু পানি জুটলো।

দু জনের কথা বলার মত শক্তি আর হলো না। চুপচাপ পড়ে রইলো অন্ধকার মেঝেতে। এর পরে এক ঘণ্টা না পাঁচ ঘণ্টা পার হয়েছে সেটা বলতে পারবে না। আবার দরজা খুলে কিছু মানুষ ঢুকলো। আগের সেই মিলিটারি সৈনিক বলল, “ক্যাপ্টেন সাহাব আয়া, তুম লোক সে কুছ পুছনা হায়।”

ইয়া বড় মোছ ওয়ালা লম্বা-চওড়া ক্যাপ্টেন সাহেব ঢুকেই হুকুম দিলো ওদেরকে ছাঁদ থেকে ঝুলিয়ে দিতে। এই দুই বাঙালির শরীর কি আর শরীর আছে? কিছু মাংসের দলা অবশিষ্ট আছে বললে হয়তো ভুল হবে না। শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হতে হতে মনে হয় রক্ত শেষ হয়ে গেছে। কারণ দু জনের কারোরই আর রক্ত বের হচ্ছে না। ক্যাপ্টেনের বর্ডারের ওই পাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প কতো ভিতরে, কয় জন ট্রেনিং নিচ্ছে, ভারতীয় আর্মি ট্রেনিং দিচ্ছে কি-না জাতীয় হাজারও সব প্রশ্ন। কিন্তু দু জনের একজনের কাছ থেকেও থেকে কোন উত্তর না পেয়ে ক্যাপ্টেন মহা ক্ষেপে গেল। ঝুলন্ত মানুষ দুটোর অক্ষত জায়গাগুলোতে জ্বলন্ত সিগারেটের দিয়ে ছ্যাকা দিল। তার পরেও কারোর মুখ থেকে কিছু উত্তর পেলো না। শেষে দুজনের মুখ পানির মধ্যে চুবিয়ে রাখল। কয়েকবার মুখ তুলে হুঙ্কার দিলো, “আভি ভি বোলো”। কিন্তু না পণ্ডশ্রম। পাকিস্তানী হানাদার কোন উত্তর না পেয়ে পানির মধ্যে মুখ চুবিয়ে আরও দু জন বঙ্গ সন্তানকে বাংলার বুকে হত্যা করলো।

এই বছরটায় বৃষ্টি কি বেশী হলো? আকাশ কি অন্য বছর থেকে বেশী মেঘে ছেয়ে থাকলো? সেটা হওয়াটাই হয়ত স্বাভাবিক। মাটিতে এত অনাচার, সেটা দেখে আকাশ কেমন করে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারে? দেশ জুড়ে বাঙালিদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চললো। কিছু বাঙালি বিশ্বাসঘাতক পাক বাহিনীর পা চাটা সুবিধাবাদী চামচা হলো। বিশ্বাসঘাতকদের নাম দিলো রাজাকার, আল বদর ও শান্তি বাহিনী। কুলাঙ্গারগুলো হানাদারদের সব অনাচারে সহায়তা করা আরম্ভ করলো। বাড়ির কুকুর, বিড়ালরা যেমন উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে তুমুল খুশী থাকে, তেমনি এই বিশ্বাসঘাতকরা সামান্য কিছু সুবিধার আশায় নিজের ভাই, নিজের বোনের চূড়ান্ত ক্ষতি করতে দ্বিতীয়বার পর্যন্ত ভাবলো না। হায়রে মীর জাফরের দল!!

অন্য দিকে নির্ভীক বাঙালিরা লড়ে চলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে চরম আতঙ্কিত করে তুললো। যদিও মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা স্টাইলে আচমকা এসে আক্রমণ করে সরে পড়তো। তারপরেও বাঙালিরাও কম হতাহত হতো না। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বল মাত্র অল্প কিছু দিনের ট্রেনিং ও সামান্য অস্ত্র শস্ত্র। পাক বাহিনীর ছিল পূর্ণ সামরিক ট্রেনিং এবং হালকা, ভারী সব ধরণের সামরিক হাতিয়ার। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র না থাকলেও, তারা ছিল আরেকটা একেবারে ভিন্ন এক অস্ত্রে বলীয়ান। সেটা হল মনোবল। মাতৃভূমিকে হায়েনা মুক্ত করতেই হবে। বাংলাদেশ শুধু বাঙালি ছাড়া আর কারোর হতে পারে না।

কমান্ডার জালালের সার্জারি করে ঘাড় থেকে গুলি বের করতে হলো। ডাক্তার বলল কমপক্ষে দু মাস বিশ্রামে থাকতে হবে। না হলে ওখানকার নার্ভ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। জালাল কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লো। এখন কতো কাজ। সে কমান্ডার। যোদ্ধারা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। কারণে অকারণে বলে ফেলে তারা কমান্ডার জালালের সাথে অপারেশনে যেতে যায়। তাদের কাছে কমান্ডার জালাল একবারে দেবতুল্য। হয়তো তার মতো অন্যান্য কমান্ডাররা প্ল্যান ও সাহস দিতে পারে না। জালালও বিষয়টা ভাল করেই জানে। কিন্তু সব চেয়ে বেশী জরুরী হলো দেশকে সব কম সময়ের মধ্যে স্বাধীন করতে হবে। বাঙালিদের অসহনীয় ভোগান্তি বন্ধ করতে না পারলেই না।

তিন দিনের মাথায় কমান্ডার জালাল হাসপাতাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে ফিরে এলো। সে নিজে বুঝল এই শরীর নিয়ে অপারেশনের যাওয়া কোনো ভাবেই ঠিক হবে না। তার কারণে নিজের ও সাথীদের বিপদ হতে পারে। কমান্ডার জালাল নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়ার কাজে নেমে পড়লো। উদ্বুদ্ধ করা, শারীরিক ব্যায়াম থেকে আরম্ভ করে বন্ধুক চালানোর কাজ ধৈর্য ধরে শেখাতে লাগলো। কিন্তু জালালের মানসলোকে কাজ করছিল আরও একটা জলজ্যান্ত বিষয়। দেশে একটা মেয়ে আছে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রতি দিন প্রতিটা কাজের মাঝে মিষ্টি কিশোরী মেয়েটার মুখটা ভেসে আসে। মেয়েটার মুখ যত বেশী ভাবনায় আসে, মেয়েটা তত বেশি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মেয়েটাকে আগলে রাখতে ইচ্ছা করে। হয়ত কাছে পেতেও ইচ্ছা হয়।

ভারতের মাটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে প্রায় প্রতিদিনই বিনা পারিশ্রমিকে জীবন বাজি দিয়ে যুদ্ধ করতে বাঙালি তরুণেরা এসে হাজির হচ্ছে। এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছল যে এতগুলো মানুষের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করাটাই এক বিশাল বড় কাজ হয়ে দাঁড়ালো। বেশ কিছু মহিলাও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না বান্না করে দিতো। এইসব বীর মহিলাদের সাথে সুযোগ পেলেই জালাল যেয়ে আলাপ করতো। প্রত্যেকের একেকটা করুণ গল্প আছে। কারো চোখে সামনে স্বামীকে মেরে ফেলেছে, কিশোরী মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে কিংবা বাড়িতে আগুন দিয়েছে। জালাল তাদের আশ্বস্ত করতো, “এইতো আর মাত্র আর কয়টা দিন। দেশ স্বাধীন হলো বলে।”

নভেম্বর মাস নাগাদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেশ বেড়ে গেল। আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলা বারুদ মুক্তিদের হাতে চলে এলো। ফলে জায়গায় জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের রণ কৌশলের পরিবর্তন হতে থাকলো। তারা পাক মিলিটারির সাথে সামনা সামনি যুদ্ধ আরম্ভ করলো। আট মাসে পাক মিলিটারি এমনিতেই বিধস্থ হয়ে পড়েছিল। মিলিটারিদের এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ভারী অস্ত্রের গোলাগুলির মুখে পড়ে নাজেহাল হতে থাকলো। মুক্তিরা জেতা আরম্ভ করলো। বাংলার মাটিকে হায়েনা মুক্ত করার প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেল। পরাজিত পাকিস্তানীরা হয় প্রাণ হারাচ্ছিল, না হয় আরও ভিতরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল।

এর মধ্যে কমান্ডার জালাল একশনে ফিরে এলো। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত ছিল। ছোট কিছু অভিযান চালিয়ে প্রমাণ করে দিলো, সে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত। তাকে দায়িত্ব দেয়া হলো দক্ষিণ পূর্ব বর্ডার থেকে বাংলাদেশের ১০০ মাইল জায়গা সম্পূর্ণ শত্রু মুক্ত করার। কিছুদিনের মধ্যে ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে। ভারত বাহিনী এই পথ দিয়ে ঢুকে ঢাকার দিয়ে এগুবে। এই এক শত মাইলের মধ্যে মোট সাতটা পাক মিলিটারি ক্যাম্প আছে। কাগজে কলমে বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত পরিকল্পনা করে বুঝিয়ে দিলো।

মুক্তিযোদ্ধারা বুক ফুলে এখন ইয়া বড়। তারা স্বাধীনতাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। স্বাধীনতাকে ছুঁয়ে দেখা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। মনোবল তুঙ্গে। মুক্তিবাহিনী ও ভারত সেনাবাহিনী যৌথভাবে ঢাকা মুক্ত করে বাংলাদেশের পতাকা উড়াবেই। কমান্ডার জালাল ও তার দল এক এক করে পাকিস্তানী ক্যাম্প ধ্বংস করতে লাগল। হানাদাররা পরাজিত হয়ে পিছু হটছে। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহত হওয়ার সংখ্যা আগের থেকে কমে গেল। বরং অল্প সময়ের মধ্যে বেশী পাকিস্তানী হানাদার ঘায়েল হতে থাকলো।

প্রথম চারটা ক্যাম্প পাকিস্তান হানাদার বাহিনী মুক্ত হলো। পঞ্চম ক্যাম্প বেশ বড়। মহকুমা কলেজ দখল করে মিলিটারি ক্যাম্প বানিয়েছে। টানা দু দিন গোলাগুলি চললো। পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিলো। বাকীদের জেদ চেপে গেল। জয় না নিয়ে এই জায়গা তারা ছাড়বে না। বেশ অনেক পাকিস্তানী মরলো। শেষে উপায় না পেয়ে, জান বাঁচানোর জন্যে শ দেড়েক মিলিটারি আত্মসমর্পণ করলো। কিছু মুক্তিযোদ্ধার পাক হানাদারদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ এত বেশী ছিল যে তারা সবগুলো মিলিটারিকে মেরে ফেলতে চাইছিল। এই প্রথম তারা এতগুলো মিলিটারি ধরতে পেরেছে। কিন্তু কমান্ডার জালাল কঠিন হুকুম দিল, “পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেছে। ওদের কোনো ক্ষতি করা যাবে না।”

মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানীদের প্রাক্তন ক্যাম্প তল্লাশি চালাতে লাগল। বলা তো যায় না, কোথাও কোন হানাদার যদি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে! কলেজ বিল্ডিং দু তলা। নিচের তলায় চার পাঁচটা রুম জুড়ে ছিল অফিস। কলেজ অডিটোরিয়াম ছিল ওদের টর্চার এরিয়া। সেখানে জায়গায় জায়গায় রক্তের ছাপ। ছাদের থেকে দড়ি ঝুলানো। চাবুক, লাঠি, ছুড়ি, বোতল ভর্তি প্রস্রাব থেকে আরম্ভ করে আরও নানা ধরণের বাঙালিদের উপর অত্যাচারের সামগ্রী পাওয়া গেল। আরেকটা বড় কামরায় পাওয়া গেল ওদের অস্ত্রাগার। নিচের তলায় বাকী রুমগুলো ছিল হানাদারদের ঘুমানোর স্থান।

হঠাৎ করে শোনা গেল উপর তলা থেকে কেউ চিৎকার করে ডাকছে, “কমান্ডার উপরে আসেন”। জালাল দৌড়ে উপরে গেল। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ানো একজন মুক্তিযোদ্ধা জালালকে ডান দিকের কোণায় “সায়েন্স ল্যাবরেটরি’ তে যেতে বলল। পৃথিবীর সব চেয়ে বড় বিস্ময় সেখানে জালালের জন্য অপেক্ষা করছিল। ভিতরে ঢুকতেই দেখল, গোটা বিশেক বাঙালি মেয়েকে সেখানে আটকে রাখা হয়েছে। খাওয়া হয়ত দিতো না। অভুক্ত শরীর শুকিয়ে হাড্ডি বের হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা মেয়ে একেবারেই নগ্ন। শরীরে কোন কাপড় নাই। জালাল বুঝলো, মেয়েগুলোর উপর নির্যাতন চালানো হতো। পরনের কাপড় গলায় পেঁচিয়ে যাতে লজ্জায় কেউ আত্মহত্যা করতে না পারে, সে জন্যে সবাইকে নগ্ন করে রেখেছে। তার পরেও সবার হাত পেছনে বাঁধা।

কমান্ডার জালাল ও তার সাথে যে কয়জন যোদ্ধা তার সাথে সেখানে ঢুকেছিল; সবাই রাগে, ক্ষোভে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। এই যোদ্ধারাই এতদিন বুকে পাথর বেঁধে যুদ্ধ করেছে। কত সাথী হারিয়েছে, নিজেরা গুলি খেয়েছে। কখনও কাঁদে নি। কিন্তু এইবার নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের শার্ট, গেঞ্জি খুলে মেয়েগুলো দিতে লাগল। মেয়েগুলো মাথা নিচু করে রইলো। কারো মুখ থেকে একটাও শব্দও বের হলো না। কিন্তু চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে, তাদের উপরে কি মারত্মক অত্যাচার-ই না চালানো হয়েছে।

হঠাৎ কমান্ডার জালালের চিন্তায় ছেদ পড়লো। চেনা একটা গলার আওয়াজ ওর চোখের ভাষা মুখের ভাষায় পরিণত করে বলল, “মুক্তি, তোমরা এত দেরী করে কেন আইল্যা।” মুখের চোয়াল ভিতরে ঢুকে গেছে, সারা শরীরে হাড্ডি দেখা যাচ্ছে। জালাল মুহূর্তেই চিনে নিলো, এই মেয়েটাই সেই মেয়েটা যে তাদের সে ই গভীর রাতে নৌকা বেয়ে নদী পার করে দিয়েছিল। মেয়েটার নাম সখিনা। সে মুক্তিযোদ্ধা হতে চেয়েছিল। হানাদারদের গুলি করে মারতে চেয়েছিল। বোন জরিনাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল। এই মেয়েটাকেই সে খুঁজে বের করতে চেয়েছে গত কয়েকটা মাসের প্রতিটা ক্ষণে।

কাজী হাসান
লেখক: quazih@yahoo.com