নিউ ইয়র্কে বাঙালির তল্পি তল্পা

নিউ ইয়র্ক। সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক রাজধানী। জাতি সংঘের সদর দপ্তর এখানে। পৃথিবীর এমন কোন দেশের মানুষ সম্ভবত নাই, যে এই শহরে থাকে না কিংবা আসে না। বাংলদেশের বাঙালিরাও এখানে আছে। শুধু আছে বললে, কম হবে। বেশ দাপট নিয়েই আছে। শহরের কিছু জায়গায় বাংলায় লেখা সাইন বোর্ড পর্যন্ত দেখা যায়। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা কাজের ফাঁকে বাঙালিরা হাঁটছে, খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। এখানে বাঙালিরা প্রাণবন্ততার দিক থেকে ঢাকার থেকে এগিয়ে আছে বলা যায়। রাত দুটো সময়ে দেখা যেতে পারে মেয়েরা কাজ থেকে ফেরার সময়ে রেস্টুরেন্টে খেয়ে রাস্তার দাঁড়িয়ে হয়ত কারোর সাথে কোন বিষয়ে গল্প করছে।

কয়েক দিন আগে ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক থেকে। সংক্ষিপ্ত সফর হলেও, বেশ অনেক কিছুই দেখা হল; বিশেষ করে বাঙালিদের কার্যক্রম। আগেও গিয়েছি নিউ ইয়র্কে। কিন্তু এবার যেয়ে বাঙালিদের দাপট একেবারে নিজের চোখে পরখ করলাম। রেস্টুরেন্টের কাউণ্টারের শো কেসে থরে থরে সাজানো বাঙালিদের প্রিয় সব খাবারঃ চিকেন বিরানি, কাচ্চি বিরানি, খিচুরি, মুরগির রোস্ট, ভাজি, ভর্তা সব। যার যেটা পছন্দ, সেটা দেখিয়ে দিলেই রেডি করে টেবিলে পৌঁছে দিচ্ছে। যারা বড় ধরণের ভোজন রসিক, তাদের জন্যে রয়েছে, মিষ্টি, চম চম, দই আর ৭৭ ধরণের নানা মিষ্টান্ন।

শহরটার আগের নাম “নিউ নেদারল্যান্ড”। ১৬৬৪ সালে ইংরেজরা, ইংল্যান্ডের ইয়র্ক শহরের নাম অনুযায়ী নাম দেয়, নিউ ইয়র্ক। হাডসন নদীর তীরে অবস্থিত শহরটা জন বহুল। প্রতি বর্গ মাইলে ২৬,০০০ মানুষ বাস। ধনী লোকের ছড়াছড়ি। প্রতি ২১ জনের মধ্যে একজন মিলিনওর। নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রীটে ফেডারেল রিসার্ভ ব্যাংকের ভল্টে পুরো পৃথিবীর ২৫% স্বর্ণের বার মজুত রয়েছে। ম্যানহাটান বাণিজ্যিক এলাকায় কাজের সময়ে জন সংখ্যা, প্রায় ৪ মিলিওনে পৌঁছে যায়। তার মধ্যে আবার অর্ধেকের বেশী মানুষ আশে পাশের জায়গার থেকে আসে। যাই হোক এগুলো তো হল, সব ইতিবাচক দিক। ২০১৪ সালের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, শতকরা হিসেবে এমেরিকার সব চেয়ে বেশী দুঃখী মানুষের বাস এখানে। এখন আমরা চট ক্রে দেখে আসি; বাংলদেশ থেকে আসা মানুষরা নিউ ইয়র্কে এসে মিলিনিওর হয়েছে, না-কি সোনার হরিণ খুঁজতে যেয়ে; সুখকে হারিয়ে ফেলছে।

এখন হয়ত এমেরিকার কোন শহর নাই; যেখানে বাঙালিরা বাস করে না। তবে, সব চেয়ে বেশী বাঙালির আবাস নিউ ইয়র্কে। সংখ্যায় কত হতে পারে? মার্কিন সরকারের ২০১০ সালের সেন্সাস অনুযায়ী, বাঙালিরা সংখ্যায় ছিল ৫০,৬৭৭। কিছু মানুষের বৈধ কাগজ পত্র না থাকায়, তারা এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় নি। বর্তমান হিসেবে, এই সংখ্যা অনায়াসে ২ লক্ষ্য ছাড়িয়ে যাবে। শুধুমাত্র কুইন্স এলাকায় ৬০ ভাগ বাঙালির নিবাস। তা ছাড়া ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস, ম্যানহাটানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি থাকে।

এই বারে আসি সমস্যার কথায়। অর্থনৈতিক দিক থেকে; নিউ ইয়র্কে এশিয়া মহাদেশের বংশোদ্ভূতদের মধ্যে বাঙালিরা একেবারে পেছনের সারির। প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন (৩২%) বাঙালি, দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে। মাথা পিছু আয় বছরে ১৩,৫০৪ ডলার, যেখানে শহরব্যাপী মাথা পিছু আয়ের পরিমাণ গড়ে বছরে ৩০,৭১৭ ডলার। পরিবারের সাইজ অন্যদের থেকে বড়। সাধারনত, এক রুমে একাধিক বাসিন্দা থাকে। প্রধান চ্যালেঞ্জ হল প্রায় ৫৩% ভাগ লোকের ইংরেজি জ্ঞান একেবারে সীমাবদ্ধ। তাদের জীবিকা নির্বাহ প্রায় প্রতিটা কাজে ইংরেজি জানা বাঙালির মুখাপেক্ষী হতে হয়। ফলে অসচেতনতা এবং না - জানার কারণে বিভিন্ন ধরণের দুর্ভোগে শিকার তারা নিয়মিত হচ্ছে।

২০১৫ সালের ১৩ ই আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমসে ২১ বছর বয়সী বাঙালি এক নারীকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পুলিশ রশিদা চৌধুরীকে, নিজের শিশুকে চার তলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করার অপরাধে গ্রেফতার করে। রশিদার ধারণা, তার শিশুকে কোন দুষ্টু শক্তি বা জীন আসর করেছিল। এই বছরের প্রথম দিকে আরেক দুর্ঘটনায় এক জন বয়স্কা মহিলা আগুনে পুড়ে মারা যান। বাড়ির অন্যরা দৃশ্যটা দেখলেও ৯১১ নম্বরে কল করেন নি। পুরো এমেরিকা জুড়েই ৯১১ নম্বরে ফোন করলে, জরুরী সাহায্যদাতারা মুহূর্তের মধ্যে এসে হাজির হয়।

নিউ ইয়র্কে তিনশোর উপরে বাঙালিদের সংগঠন আছে। প্রতিটা জেলা-উপজেলা-রাজনৈতিক ভিত্তিক দল তো আছেই, তার সাথে যোগ হয়েছে নেতৃত্বের কোন্দল থেকে তৈরি হওয়া পাল্টা পাল্টী দল। দেশের মতই কথা কাটা-কাটি, মাথা ফাটাফাটির কোন কমতি নাই। অনেক সময়ে পুলিশ এসে এদের শান্ত করে। বাঙালিদের উঁচু মাথা তখন হয়তো ধুলায় গড়াগড়ি খায়। দেশের মত বিদেশেও বাঙালিদের একতা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার।

তার পরেও, নিউ ইয়র্কের প্রতিটা বাঙালির মাতৃভূমি প্রতি ভালোবাসা নিয়ে কোন প্রশ্ন নাই। তবে ভালোবাসার ধরণটার মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। খেয়ে না খেয়ে প্রচণ্ড শ্রম করে আয়ের টাকার একটা বড় অংশ, তারা দেশে পাঠাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিরাট পৃষ্ঠপোষক। ব্যাপক খরচ করে দেশের থেকে শিল্পীদের আনছে, বিরাট উৎসাহ নিয়ে শিল্পীদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে।

নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে বাঙালিদের সম্ভবত এমন কোন জিনিষ নাই, যেটা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ থেকে চাল, ডাল, মুরি, চানাচুর সবই আসছে। আরও আছে বাংলাদেশীদের স্বর্ণের দোকান। এই বার যেয়ে দেখে আসলাম, বাংলা বইয়ের দোকান। মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা গলা নিচু করে বললেন, বাংলাদেশের বাঙালিরা তেমন বই কিনে না। তবে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা, বলতে গেলে, ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। বাংলদেশীরা যদি জানতো, বই তাদের মানুষ হিসেবে কত না মহৎ করতে পারে!

অনেকের হয়ত আগ্রহ হতে পারে, নিউ ইয়র্কে বাঙালিরা কি ধরণের কাজকর্ম করে? নিম্ন গড় আয় দেখে নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন, নিউ ইয়র্কে অদক্ষ বাঙালিদের বসবাসই বেশী। এখানে বাঙালিরা সব ধরণের পেশাতেই আছে। ডাক্তার, ডেন্টিস্ট, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী পেশায়; মহিলা পুরুষ সব সম তালে কাজ করে যাচ্ছে। বাঙালি মালিকানার দোকান, রেস্টুরেন্টে বাঙালি কর্মচারী বেশী দেখা যায়। তবে গণনা করতে গেলে, সব চেয়ে বেশী সংখ্যক বাঙালি ক্যাব ড্রাইভারের কাজ করে। এদেরকে ছোট করে বলা হয় ক্যাবি। দেশের প্রাক্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, সেনা বাহিনীর কর্মকর্তা থেকে আরম্ভ করে উচ্চ শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত সব ধরণের ব্যাক গ্রাউণ্ডের মানুষ ক্যাবি হিসেবে কাজ করে, ভাগ্যের চাকা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে।

বাঙালিদের প্রিয় কাজের একটা লিস্ট বানানো হলে, সব চেয়ে উপরের দিকে নিশ্চয়ই থাকবেঃ খাওয়া ও খাওয়ানো, এবং আড্ডা দেয়া। এই দুই জিনিষের কোনটারই একেবারে কমতি নাই নিউ ইয়র্কে। প্রতিটা রেস্টুরেন্টে চায়ের টেবিলে কথার ঝড় বয়ে যাচ্ছে; বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান সেখানেই করে ফেলা হচ্ছে।

অবশ্য এই আলোচনার পরিধি ধীরে ধীরে বিস্তৃত করার খুবই দরকার। পৃথিবীর সব চেয়ে উন্নত দেশে বসে, দরজা জানাল বন্ধ করে রাখলে তো চলবে না। মূল ধারার সাথে বেশী বেশী করে মিশতে হবে, সম্পৃক্ত হতে হবে; এক সাথে কাজ কর্ম করতে হবে। তা হলেই না, বাঙালিরা বিদেশে আসার প্রকৃত ফল হবে, পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হবে।

আবার ফিরে আসি নিউ ইয়র্ক শহরের গল্পে। এখানকার আইন মোতাবেক, মহিলারা শরীরের উপরের অংশ অনাবৃত করে চলা ফেরা করতে পারে। কিন্তু কোন মহিলা সেইটা ব্যবসায়িক কারণে করলে, সেটা বে আইনি হবে। কথাটার বলার কারণ হচ্ছে, এখানে সবাই স্বাধীন। নিজের মর্জি মত এখানে চলতে কোন বাঁধা নাই, যতক্ষণ না সেটা অন্যের কোন সমস্যার কারণ হচ্ছে। নিউ ইয়র্কে স্বল্প বসনা মেয়েদের পাশাপাশি হিজাব (বোরখা) পরা মেয়েও পথে ঘাটে চোখে পড়ে।

শেষে, একটা গল্প বলি। কেয়ামতের পরে দেখা গেল, এক পাদ্রিকে দেয়া হয়েছে সর্ব নিম্ন সাত নম্বর বেহেশত , আর নিউ ইয়র্কের এক ক্যাবিকে দেয়া হল বিলাস বহুল তিন নম্বর বেহেশত। পাদ্রি প্রচণ্ড আপত্তি জানাল, সে সারা জীবন ধর্মের জন্যে কাটিয়েছে, তাকে কেন সব চেয়ে নীচের দিককার সাত নম্বর বেহেশত দেয়া হল, আর ক্যাবি পেল তিন নম্বর। বেহেশতের প্রহরীরা বলল, তুমি যখন গির্জায় ধর্মের আলোচনা করতে, তখন মানুষ হাই তুলতো, তাদের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতো, কেউবা ঘুমিয়ে পর্যন্ত পড়তো। আর ওই ক্যাবির ট্যাক্সিতে উঠলে, সবাই সাথে সাথে ঈশ্বরের নাম নিতে থাকতো। এখন তুমিই বলে, ও তোমার থেকে ভাল স্বর্গ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে কি না।

বলা হয়, নিউ ইয়র্কের ক্যাবিরা ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারায় না। প্রচণ্ড দক্ষ তারা, তাদের কাজে। যাত্রীরা সেটা না বুঝে আঁতকে উঠে, কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে থাকে। আমরা জানি, নিউ ইয়র্কে বাঙালিরা ঠিকই বের করে ফেলবেন, তাদের প্রচণ্ড ক্ষমতা ও সম্ভাবনার কথা। তারা ইতিমধ্যে শহরটার একটা বড় অংশ বাঙালি অধ্যুষিত করেছেন। আমরা নিশ্চিত; ভবিষ্যতে বাঙালির সম্মান, তারা আরও অনেক উপরের আসনে নিয়ে যাবেন।

সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৫

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com