মেয়েটার নাম আকাশী

“বাবা, বাবা, আমি আকাশী। এভারেস্টে, ১৮ হাজার ফুট উপরে। শুনতে পাচ্ছ বাবা, হ্যালো, হ্যালো। বাবা দোয়া কর যেন শেষ পর্যন্ত যেতে পারি।”

কথা একেবারেই পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না।

“একটু ধর, মায়ের সাথে কথা বলে নে।”

মা ছিল বাথরুমে। তাকে ডাকতে ডাকতে লাইন কেটে গেল। বাবা-মা আসলে অপেক্ষা করছিল এই কলটার জন্যে। তারা জানে ১৮ হাজার ফুট উপরে যেই বেস ক্যাম্প আছে, সেখান থেকে ভাগ্য ভালো থাকলে ফোন কল করা যায়। সিগনাল পাওয়া , না পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আকাশী ঠিকই নেটওয়ার্ক পেলো। কিন্তু কথা তেমন একটা হলো না।

কথা বলতে না পেরে মা রহিমা খুব বিরক্ত হল। স্বামী ইদ্রিসকে বকা দিয়ে বলল, “আমাকে ডাকতে না যেয়ে মেয়েটার সব খবর শুনে নিলেই তো পারতে।” বাবা বলল, “তুমি নিজের কানে ওর গলার আওয়াজ শুনবে, সেই জন্যেই তোমাকে ডাকতে গেলাম। তাছাড়া আমি তো জানি আমার মেয়ে এবার এভারেস্ট জয় করবেই।”

আকাশী আজ ত্রিশ দিন ধরে নেপালে। বাংলাদেশের প্রথম মেয়ে এভারেস্ট জয় করতে গেছে। পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচু শৃঙ্গে আকাশটাকে ছুঁয়ে, বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা লাগিয়ে আসার স্বপ্ন। এর আগে অবশ্য আরও দু জন বাংলাদেশের বাঙালি এই দুঃসাহসিক কাজ করেছে---মুসা আর মুহিত। কিন্তু, এই প্রথম এক বাঙালি মেয়ে এই কাজ করতে চলেছে। আকাশীকে আরও উঠতে হবে দশ হাজার ফুট। সব মিলিয়ে ২৯,০২৮ ফুট।

বছর পাঁচেক আগের কথা। আকাশীর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের বয়স মাত্র তখন মাস ছয়েক হয়েছে। ক্লাসমেট মঞ্জু আর রনি কথা বলছিল। আগামী মাসের তিন তারিখে ওরা বান্দরবন যাচ্ছে। পাহাড়ে উঠবে। মোট দশ দিন থাকবে। বান্দরবন থেকে রাঙ্গামাটি। সেখানেও তিনটা পাহাড়ে উঠবে। সাথে থাকবে মাউন্টেন ক্লাবের মোট দশ জন সদস্য। এক জন মেয়েও আছে, নীনা।

আকাশীর ব্যাপারটা খুব রোমাঞ্চকর মনে হল। সাথে সাথেই ঠিক করে ফেলল, তাকেও এদের সাথে যেতে হবে। ভুলে থাকা যাবে প্রতিদিনের একই রকম জীবন। মঞ্জু, রনি শুনতেই রাজী হয়ে গেল। তবে আকাশীকে মাউন্টেন ক্লাবের সদস্য হতে হবে। আর জিমে যেয়ে প্রতি দিন তিন ঘণ্টা করে প্র্যাকটিস করতে হবে। পকেট থেকে সাত হাজার টাকা খরচ করতে হবে।

আকাশী চিন্তা করতে লাগল, টাকার ব্যবস্থা করতে সমস্যা হবে না। তার ব্যাঙ্কে দশ হাজার টাকা আছে। কিন্তু, সমস্যাটা হবে মাকে নিয়ে। পারমিশন নিতে গেলে হয়তো তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসবে। মেয়ে দশ দিন বাসায় থাকবে না। তাও যাবে এক দল ছেলেদের সাথে।

যা ভেবেছিল তাই হল। মা শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। মনে হল এর থেকে অদ্ভুত বিষয় সে কখনো শুনে নি। প্রথমে কিছুক্ষণ হাসল। ভাবল মেয়ে তার সাথে রসিকতা করছে। পরে স্পষ্ট জানিয়ে দিল এইটা একেবারে অসম্ভব। আকাশীকে কোন ভাবেই বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হবে না। দশ দিন কি, এক রাতের জন্যেও না।

আকাশীর মনে পড়ল তার শেষ অস্ত্র বাবার কথা।

বাবা ইদ্রিস আলি পেশায় ডাক্তার। গত তিন বছর ধরে ইরানে। পাঁচ বছরের চুক্তি। দুই বছর পরে ফিরে আসবে দেশে। বাবার বিদেশ যাবার তিন দিনের মাথায় তার সেখান থেকে মন উঠে গেল। দেশে বউ রহিমা আর সতের বছরের আকাশীকে রেখে এসেছে। মনটাকে কোন ভাবেই তাদের কাছ থেকে নিয়ে আসা গেল না। মাছকে নিয়ে ডাঙ্গায় ফেলার অবস্থা হলো। বুকের ভিতরটা সারাক্ষণ ছটফট করতে লাগল।

কিন্তু চাইলেই তো আর ফিরে আসা যায় না। বিদেশ আসার জন্যে তিন লক্ষ্য টাকা খরচ হয়েছে। তার পরে, রহিমার আজন্মের আবদার ঢাকা শহরে নিজের একটা বাড়ি। কতদিন আর ভাড়া বাসায় থাকা যায়! মানুষদের ধারের টাকা শোধ দিতে হবে, বাড়ি কিনতে হবে। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে; আর কত কি! দেশে ফেরা হল না। মানুষ নামের টাকা বানানোর যন্ত্রকে পূর্ণোদ্দমে অর্থ উপার্জন করে যেতে হলো।

কিছু মানুষজন মনে হয়ত এরকম সুযোগের জন্যেই হয়তো অপেক্ষা করছিল। পাড়ার সব ধরনের মাস্তান ছেলেরা পাল্লা দিয়ে বিরক্ত করতে আরম্ভ করল আকাশীকে। এক জন গেলে আরেক জন। একেবারে বিরামহীন যন্ত্রণা। আকাশীর ঘর থেকে বের হওয়া একটা কঠিন কাজ হয়ে গেল। মা রহিমা সাথে থাকলেও খুব একটা উপকার হতো না। এমনকি মা একা বের হলেও, বখাটেরা চীৎকার করে জানতে যেতো, “আকাশী কই, আকাশী?”

বাবা বিদেশ যাবার পরে মায়ের মন এমনিই খারাপ থাকত। তার পরে পাড়ার সব বখাটেদের উৎপাতে একেবারে নাজেহাল হয়ে উঠলো। সারাদিন ধরে ফোন বাজতে আরম্ভ করল। ফোন ধরলে, আকাশীকে চায়। তার পরে শুরু হয় অশ্লীল কথা বার্তা। বাড়ির সামনে কেও না কেও সব সময় দাঁড়িয়ে থাকে।

মায়ের অস্থির মনের সব রাগ যেয়ে পড়লো মেয়ের উপর। মা ঠিক করে কথা বলে না মেয়ের সাথে। মেয়ের সব ব্যাপারেই ধৈর্য হারা হয়ে পড়ে। আকাশীর অপমানের জগত, বাইরে থেকে ঘরের ভিতর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। আকাশীর মাথায় এলো না, তার কি অপরাধ।

একদিন ‘গাল কাটা কুদ্দুস’ নামের মাস্তান ছেলেটা বাসায় এসে কলিং বেল টিপতে থাকল। মা দরজা খুলে সাথে সাথে বন্ধ করে দিল। প্রায় আধা ঘণ্টা বিরক্ত করে, তার পরে গেল। মা আকাশীকে তুমুল বকা ঝকা করল। তার পরে আটকিয়ে রাখল তার রুমে। পরের দিন বান্ধবী রুমকির বাসায় পর্যন্ত যেতে দিল না। রুমকি এক মাস আগে, তার জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে রেখেছিল। ঝুনু, মিলা, রুপা সবার আসার কথা। অনেক কিছু প্ল্যান করা ছিল।

এর কয়েক দিন পরে আকাশী মামার সাথে বেরিয়েছিল। সেই ‘গাল কাটা কুদ্দুস’ চায়ের দোকানে বসে ছিল। আকাশীকে দেখে ছুটে আসলো। বেশ জোরেই বলতে থাকল, “ও মাই ডার্লিং, তোমার বাসায় গেলাম। তুমি দরজা খুললে না। আমাকে এখন আত্মহত্যা করতে হবে।” মাস্তানের বন্ধুরা সব দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল।

আকাশী অকল্পনীয় একটা কাজ করল। মামার পাস থেকেই ডাকল মাস্তান কুদ্দুসকে, “এই, এই দিকে আস।” তার পরে ডান গালে কষে এক থাপ্পড় মারল। পরিষ্কার জানিয়ে দিলো, “আরেকবার যদি অসভ্যতা করেছো, পায়ের স্যান্ডেল খুলে মুখে মারব।”

মা ঘটনা শুনে ভয়ে অস্থির। সবাই বলতে লাগল, ‘গাল কাটা কুদ্দুস’ তার দল বল নিয়ে এসে আকাশীকে তুলে নিয়ে যাবে। তার সম্পর্কে এ ধরনের অনেক গল্প চালু আছে। এক বার রীনা নামের একটা মেয়েকে বিয়ে বাড়ি থেকে সবার সামনে তুলে নিয়ে এসেছিল। তার পরে তিন দিন আটকে রেখেছিল। মা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে ফোন করলো, “তুমি এখনি ফিরে আস। আমার টাকার দরকার নাই।”

কিন্তু না। একেবারে অবাক কাণ্ড। কোন সমস্যা হল না। এর পর থেকে আকাশীর জীবন অনেকটা শান্তির হয়ে গেল। একা যাওয়া আসা করে। কেও বিরক্ত করে না। তার পরেও, মায়ের মন শান্ত হলো না। তার ধারনা, ‘গাল কাটা কুদ্দুস’ সুযোগের অপেক্ষায় আছে। যে কোন দিন আকাশীর মহা সর্বনাশ নেমে আসতে পারে। মা, মামার সাথে শলা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো আকাশীর বিয়ে দেয়াটা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আকাশী বাবাকে ইরানে ফোন করে বলল, “বাবা, আমি পাহাড়ে উঠতে যাব। তুমি, মাকে বল, আমাকে যেতে দিতে”। বাবা আকাশীর কথা মন দিয়ে শুনে বলল, “মা, তোমাকে পাহাড়ে সব চেয়ে উপরের শৃঙ্গে উঠতে হবে।”

দশ দিন সফরের আকাশী মোট চারটা পাহাড়ের চুড়ায় উঠলো। ঢাকায় ফিরে এসে বাবাকে ফোন করলো খবরটা দিতে। বাবাকে ওই দিক থেকে মহা আনন্দিত মনে হলো, “আমি জানতাম, আমার মেয়ে এই কাজটা পারবে।”

আকাশী মাউন্টেন ক্লাবের নিয়মিত সদস্য হয়ে গেল। মাস তিনেক পরে কিওক্রাডাং পাহাড়ে উঠতে যেয়ে পা ভেঙ্গে ঢাকায় ফিরল। মা বাবাকে জানাল, “তোমার মেয়েকে তুমি এস দেখ।” সবাইকে অবাক করে দিয়ে, বাবা এক মাসের ছুটি নিয়ে চলে আসলো মেয়ের কাছে থাকার জন্যে।

বাবা ছুটি বেশির ভাগ সময় আকাশীর সাথে কাঁটাল।

মা আর মামা বেশ অল্প সময়ের মধ্যে আকাশীর বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। মামার অফিসের মালিক বহর খানের ছেলের সাথে। ধনীর আলাল লন্ডন গিয়েছিল পড়ালেখা করতে। কিন্তু পরে জানা গিয়েছিল, সে দেশে নকল করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছিল। তার পক্ষে কি আর বিদেশে পড়ালেখা করা সম্ভব!

বিলাত ফেরত ছেলের সাথে আকাশীর বিয়ে দিয়ে মা-মামা মহা খুশী। কিন্তু তারা আসল খবর রাখত না। ছেলে বিদেশ যাবার আগে থেকেই ড্রাগ এডিক্ট ছিল। পয়সাওয়ালা বাবার ধারনা ছিল ছেলেকে বিদেশ পাঠালে ছেলে হয়তো লাইনে চলে আসবে। কিন্তু হল তার বিপরীত। ছেলে এক কাড়ি টাকা ধ্বংস করে বাড়ি ফিরে এলো।

দেশে ফিরে আবার সেই একই নেশার লাইনে আরও বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বড় লোক বাবা মানুষের কাছে জানাজানি হয়ে যাবে, এই ভয়ে ছেলের নেশার সব খরচ নীরবে যোগাতে থাকলো। পীর বাবার পানি পড়া আর ডাক্তারের চিকিৎসা ---কোনটাই কোন উপকার এনে দিতে পারল না। ছেলের নেশা বাড়তে লাগলো দিনে দিনে।

ছেলেকে কোন ভাবে সামাল দিতে না পেরে বহর খান সাহেব অস্থির হয়ে পড়লো। এতো বড় ব্যবসা আর এতো মানুষ চালাতে কোন সমস্যা হয় না; আর নিজের ছেলে নেশা খোর হয়ে গেছে, কিছু করতে পারছে না। তার ছেলে নেশার জগত হারিয়ে যাচ্ছে। এইটা কি করে কোনো ভাবে মেনে নেয়া যায়?

বহর খান সিদ্ধান্ত নিলো ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে। বৌয়ের প্রেমে পড়ে যদি ঐ লাইন থেকে ফিরে আসে। শেষ চেষ্টাটা করতেই হবে। শহরের মেয়ে পাওয়া না গেলে, গ্রাম থেকে মেয়ে এনে বিয়ে দেয়া হবে।

আকাশী নতুন এক বাবাকে আবিষ্কার করলো। খাওয়ানো, গোসল করানো ---বাবা সব নিজের হাতে করলো; খুব যত্ন করে। আকাশীর নিজেকে ছোট একটা শিশু মনে হতে থাকলো। বাবা তিন দিন পরে আকাশীকে হাসপাতাল বাসায় নিয়ে আসলো।

এর সপ্তাহ খানেক পরে, আকাশী বাবাকে নিয়ে বেড়াতে আসলো মাউন্টেন ক্লাবে। বাবা সবার সাথে পরিচিত হলো। শুনল বাঙালীরা অনেক এগিয়ে গেছে। মুসা, মুহিত পরের বছর যাবে এভারেস্ট জয় করতে। বাবার আনন্দ আর ধরে না। খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে লাগলো, “বাবারা, আমার মনে হচ্ছে তোমরা পারবে। আমাকেই শুধু বল, আমি তোমাদের জন্যে কি করতে পারি?”

আকাশী ভেবে পেল না, বাবা শেষবার কবে এতো খুশী হয়েছিল। বাবা মাউন্টেন ক্লাবের ১২ জন সদস্যকে নিয়ে চাইনিস খেলো। যাবার সময় সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরল, “আমার আকাশীকে তোমাদের সাথে রেখো।”

বাড়ীতে ফেরার সময় আকাশীকে বলল, “মা, তুইও যদি এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারতি!”

আকাশীর বিয়ে হয়েছিল খুবই সাধারণ। আগের দিন মা বলেছিল, “ কাল শুক্রবার তোমার বিয়ে। অনেক বড় লোকের ছেলে।”

আকাশীর কথাটা বুঝতে অসুবিধা হলো। মা কি বলে এই গুলি। একটু থেমে বলল, “বাবার জন্যে অপেক্ষা করলে হতো না।” মা উত্তরে জানালো, “ তোমার বাবা বলেছে বিয়ে দিতে। পরে দেশে আসলে অনুষ্ঠান করবে। গাল কাটা কুদ্দুস কোন ঝামেলা করার আগে, তোমার শ্বশুর বাড়ীতে চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।”

বাবার উপর প্রচণ্ড অভিমান হলো। মাস্তানদের অত্যাচারে তার ‘বেঁচে থাকার স্বপ্নটা’ মারা গেল। কেউ এসে তার পাশে দাঁড়ালো না। মামার সাথে এক দল মানুষ আসলো সন্ধ্যার দিকে। একজন কাজী সাথে ছিল। বিয়ে পড়াতে মিনিট দশেক লাগলো। আকাশীর ভাবল, তার এ পর্যন্ত জীবনের সব চেয়ে বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে আর কেউ তার মতামত পর্যন্ত নেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করলো না।

বাবা ইদ্রিস ইরানে ফিরে যাবার সময় আকাশীকে বলল, “মা এখন থেকে আমি তোর সাথে আছি সারাক্ষণ। দেশে ছিলাম না---আর তোর এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেল। আর দেড় বছর। তার পরে আমি চলে আসবো। আমরা এর প্রতিশোধ নেব রে মা।”

বাবা ইরানে যেয়ে মেয়েকে প্রতিদিন ফোন করে। কথা চলতে থাকে সব ব্যাপারে একেবারে এক জন বন্ধুর মতো। তবে কথার অনেকটুকু জুড়েই থাকে পাহাড়ে উঠা নিয়ে। কার প্রস্তুতি কেমন, কোন বাংলাদেশী প্রথম জয় করবে এভারেস্ট ইত্যাদি।

ইদ্রিস আলী নিজেও খবর নেয়া আরম্ভ করলো হিমালয় আর এভারেস্ট নিয়ে। ১৯৫৩ সালে হিলারি ও তেনজিং প্রথম হিমালয় জয় করে। কিন্তু তার আগে অনেক মানুষ চেষ্টা করেও উঠতে পারে নি চূড়া পর্যন্ত। বেশ কিছু মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে। তার পরেও থেমে থাকে নি মানুষ। প্রতি বছরই মানুষ উঠার চেষ্টা করে। বেশীর ভাগ মানুষকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়। প্রতিটা পদে পদে ওখানে বিপদ। যত উপরে উঠা হয়, বাতাসের চাপ তত কমতে থাকে, শরীর ভারী হয়ে আসে। অনেকের শরীর তা নিতে পারে না। অক্সিজেনের সিলিন্ডার পিঠের সাথে বেঁধে নিতে হয়। সিলিন্ডার ছিদ্র হয়ে যাবার সম্ভাবনা সব সময় থাকে।

গৌতম বুদ্ধের একটা মূর্তি বসানো হয়েছে এভারেস্টের চূড়ায়। এখন, অনেকটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে মূর্তিটার সাথে ছবি তুলে নিয়ে এসে কর্তৃপক্ষকে দেখানো। তার থেকে প্রমাণ হয় কেউ পৃথিবীর সর্বোচ্চ জায়গা পর্যন্ত আসলেও পৌছতে পেরেছে কি না। ভারতের বাঙ্গালী দীপঙ্কর আর রাজীব এর মধ্যে চূড়া ঘুরে এসেছে। লাগিয়ে এসেছে ভারতের পতাকা। ইদ্রিস আলী ভাবে, বাংলাদেশের পতাকা কখন যে ওখানে উড়বে। রাধানাথ শিকদার দেহরুন নামের এক বাঙ্গালী ১৮৫২ সালে ত্রিকোণমিতি ব্যাবহার করে প্রথম বারের মত এভারেস্টের সঠিক উচ্চতা বের করে।

বাবা ইরান থেকেই সব ব্যবস্থা করে দিলো আকাশীর দার্জিলিং হিমালায় মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে ট্রেনিঙের। দুই দফা যেতে হলো। অবশ্য আরও কিছু বাংলাদেশী ছেলে এর মধ্যে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। তবে আকাশীই প্রথম বাঙ্গালী মেয়ে। নেপাল, ভারত আর বাংলাদেশের বেশ কিছু কষ্টকর পাহাড় আকাশীকে ট্রেনিঙের ভর্তির পূর্ব শর্ত হিসেবে জয় করতে হলো।

ট্রেনিং থেকে ফিরে আকাশী বাবাকে ফোন করে জানালো, সে এখন এভারেস্টে উঠার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে মুসা, মুহিত দুই বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে এসেছে এভারেস্টের চুড়ায়। আগামী বছর, যদি আকাশী একই কাজ করতে পারলে, সেই হবে প্রথম বাঙালি মেয়ে আর তৃতীয় বাংলাদেশী যে কাজটা করে পেরেছে।

১০

আকাশী শ্বশুর বাড়িতে ছিল সব মিলিয়ে ছিল এগার মাস। প্রথম দুই সপ্তাহ তার আদর আপ্যায়নের কোন কমতি ছিল না। কিন্তু বিয়ে হলেও ছেলের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। বয়সে যুবক হলেও, নেশায় সে এমনই বুদ থাকে, যে তার শারীরিক চাহিদা সৃষ্টির কোন কারণ তৈরি হলো না।

শাশুড়ি একদিন বিরক্ত হয়ে বলল, “কি কর একটা যুবক ছেলেকে ধরে রাখতে পার না।” তার পরে শাশুড়ি যেই শলা কলা করার পরামর্শ দিলো, তা শুনেই আকাশীর কান লাল হয়ে গেল। কিছু না বলে উঠে চলে গেল ওখান থেকে।

ওই রাতে শাশুড়ি নিজের হাতে আকাশীকে সাজিয়ে, খুব সংক্ষিপ্ত একটা রাত্রি-কালীন পোশাক পড়িয়ে দিল। আকাশীর ভীষণ লজ্জা লাগছিল। ফিনফিনে কাপড়, পুরো শরীরটা বুঝি বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।

আকাশী ধরেই নিয়েছিল ওর স্বামী আজকে তাকে ছুঁয়ে দেখবে, ধরবে। এই সময়টার জন্যেই সে হয়তো নিজেকে রক্ষা করে এসেছে এতগুলো বছর। নেশা করে, তার পরেও তো স্বামী। যদি নেশা ছেড়ে দেয়, ভালোবাসতে শিখে, তা হলে খারাপ কি। সুন্দর একটা জীবন কে না চায়।

মৃদু আলোয় বিশেষ আকাশী আবেদনাত্মক একটা ভঙ্গী করে এসে দাঁড়াল স্বামীর সামনে। ঢুলু ঢুলু চোখ দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে স্বামী ফিসফিস করে বলল, “আরে বউ আমার দেখি বিদেশী বেশ্যার সাজ দিয়েছে।” আবার রসিকতা করার চেষ্টা করলো, “তুমি কি আগে বেশ্যা ছিলে না কি?’ আকাশী মনে হচ্ছিল, তার বুঝি এই ত্যাগ টা ফল দিতে চলেছে। স্বামী এক বার হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলো। আকাশী দেখল, হাতটা কাঁপছে। দাঁড়াতে যেয়ে বিছানায় যেয়ে পড়লো। আকাশী বিছানায় পাশে যেয়ে বসলো। একটা মেয়ে একটা ছেলেকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু না। আকাশী আবিষ্কার করলো এই মানুষটা নপুংসক।

শাশুড়ির বুঝতে সময় লাগল না, আকাশী তার কাজে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ জানতে চাইল না, আকাশীও বলল না। তার পরের প্রতিটা মুহূর্ত ছিল অপমান আর নির্যাতনের। বাড়ির সব কাজ করতে হত আকাশীকে। কিছু এই দিক ওই দিক হলেই, অকথ্য গালাগালি আর মারধর। একদিন কাপড় ইস্ত্রি করতে যেয়ে শাশুড়ির ব্লাউস পুড়িয়ে ফেলল। সাথে সাথেই শাশুড়ি চুল ধরে চড় থাপ্পড় আরম্ভ করে দিলো।

আকাশী এই বার একটা অস্বাভাবিক কাজ করলো। শাশুড়ি হাত চেপে ধরে বলল, “আপনার হওয়ার কথা ছিল মায়ের মত স্নেহময়ী। কিন্তু আপনি আসলে একটা ডাইনী। আমি এখন এই বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। দেখি। আমাকে কে আটকায়।”

১১

ক্লাসমেট মঞ্জু আকাশীর গত তিন বছরের নিত্য সাথী। ক্লাস, মাউন্টেন ক্লাবে প্রাকটিস, পাহাড়ে উঠা, বাসায় পৌঁছে দেওয়া সব ব্যাপারেই তার মহা আগ্রহ। পৃথিবীতে এমন কোন বিষয় নাই যা নিয়ে দু জন কথা বলে না। কিন্তু, একটা ব্যাপারে কথা আরম্ভ হলেই আকাশী অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। বিষয়টা হল প্রেম। মঞ্জু অনেক ভাবেই বোঝাতে চেষ্টা করে, আকাশীকে তার ভাল লাগে। মঞ্জু আকাশীকে ভালোবাসতে চায়।

একদিন মঞ্জু খুব করে চেপে বলল, “আজকে তোমাকে বলতেই হবে, তুমি কেন আমাকে এত উপেক্ষা কর।” অনেকটা বাধ্য হয়েই আকাশী জানালো তার জীবন কাহিনী। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলো। তার পরে মুখ খুলল। শেষে বলল, “আমার জীবনে এখন একটা মাত্র লক্ষ, এভারেস্টের চুড়ায় উঠা। আমার বাবা আমাকে বড় একটা ডাক্তার বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু কোথায় যেন কি হয়ে গেল। আমার বাবা আমাকে খুব যত্ন করে মানুষ করেছে। আমার অসুখ হলে সারা রাত জেগে কাটিয়েছে, স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আগে আমাকে নিয়ে প্রাকটিস করেছে। আমি মেয়ে হয়েও যে খেলা- দু লায় ভালো, এইটা তারই কারণ। আমার প্রতিটা সাফল্য আর ভালো লাগার ক্ষেত্র বাবা তৈরি করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা ফিল্ম ডাইরেক্টরের মত আমার সব ঘটনার পিছনে। শুধু একটা ঘটনা ছাড়া। বাবা নিজেকে অপরাধী ভাবে আমার জীবনের এই এক্সিডেন্টের জন্যে। বাবা বলে, সে দেশে থাকলে এ রকম ঘটনা কখনই হতে না।” আকাশী বলতে থাকে, “আমাকে এভারেস্টের চুড়ায় উঠতে হবেই। সেটা আমাদের প্রতিবাদের ভাষা। একটা বাবা, একটা মেয়ে সবার পক্ষ থেকে ঘোষণা করবে সুন্দর জীবন পাবার অধিকার সবার আছে।”

মঞ্জু অঙ্গীকার করলো, আকাশীকে সে কখন কোন ভাবেই কষ্ট দিবে না।

১২

বাবা ইদ্রিস আলি দেশে এসে ডিভোর্সের কাগজ পত্র ফাইনাল করে ফেলল। উকিল দিয়ে পাঠিয়ে দিলো বহর খানের বাসায়। আকাশী নতুন করে পড়া লেখা আরম্ভ করলো। বাবা নিজে যেয়ে ভর্তি করিয়ে আসে নর্থ -সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। বাবা, মেয়ে পণ করে আর কোন ভাবে পরাজিত হওয়া যাবে না।

বাবা ইরান থেকে এসে মাকে একটা দামী ফ্ল্যাট আর গাড়ি কিনে দেয়। দেশের বাড়িতে তার বাবার নামে একটা ছোট স্কুল আর মসজিদ বানায়। কিছু গরীব আত্মীয় স্বজনকেও সাহায্য করে।

দেশে বাবার একটা চাকরিও হয়ে গেল। কাজের পরে যত টুকু সম্ভব মেয়ের সাথে সময় কাটায়। এর মধ্যে মাউন্টেন ক্লাব আকাশীর এভারেস্ট উঠার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করলো। কিন্তু বাধ সাধলো টাকা, আরও সাত লক্ষ টাকার দরকার। বাকি বারো লক্ষ টাকা স্পন্সররা দিতে রাজী হয়েছে।

বাবা ইদ্রিস আলি মহা চিন্তায় পড়লো কিভাবে বাকি টাকার পাওয়া যায়। জমানো টাকা সব শেষ হয়ে গেছে। বাবা তার গ্রামের বাব-দাদার ভিটা-বাড়ি আর ধানের জমি বিক্রি করে দিলো।

১৩

চৌদ্দ জনের দল এভারেস্টের চুড়া জয়ের জন্যে যাত্রা করেছিল। তার মধ্যে ছিল, ছয় জন নেপালি শেরপা। পয়সার বিনিময়ে তার অন্যদের সাহায্য করে পাহাড়ে উঠতে। বাকি আট জন এসেছে সাতটা বিভিন্ন দেশ থেকে। ভারত থেকে দুই জন।

মোট তিনটা দুর্ঘটনা হলো। তের হাজার ফুট উপর জার্মানির ডেভিড পা পিছলে পড়ে গেল। ওখানেই মৃত্যু। বিশ হাজার ফুট উপরে এসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো ভারতের মাধব। ফিরে যেতে হল তাকে। তৃতীয় দুর্ঘটনায় পড়লো আকাশী নিজে।

মাত্র যখন এক শ ফুট মত বাকি, গৌতম বুদ্ধের মূর্তি দেখা যাচ্ছে, তখন আকাশীর অক্সিজেনের সিলিন্ডার লিক করা আরম্ভ করলো। শেরপারা ঘণ্টা খানেক চেষ্টা করে সেটা মেরামত করলো। নির্ঘাত মৃত্যু থেকে বাঁচলো বাংলাদেশের মেয়ে আকাশী।

১৪

নাইমা আলি আকাশী গৌতম বুদ্ধের মূর্তির পাশে বাংলাদেশের পতাকা পুতে দিলো। অন্যরা ছবি তুললো। চারিদিকে সাদা বরফ। মনে হল, পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচু জায়গায় বিধাতা যেন নিজের হাতে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য ও নীরবতা বানিয়ে, নিজেই তা রক্ষা করছেন। এর ভাষা যে জানতে চায়, সেই শুধু বুঝতে পারে। পাহাড় আর আকাশ বলে দিচ্ছে প্রকৃতিটা মস্ত বিশাল। দুঃখ-কষ্টে ক্লান্ত, হতাশ হওয়ার কোন কারণ নাই। প্রকৃতিই স্পষ্ট জানাচ্ছে পাহাড়ের মত সোজা হয়ে দাঁড়াতে আর হৃদয়কে আকাশের মত ছড়িয়ে ভালোবাসাতে।

আকাশীর অবচেতন মনে প্রতিটাক্ষণ বাবা থাকলেও, এই মুহূর্তে তাকে খুব বেশী করে মনে পড়লো। তার সীমাহীন ভালোবাসা ঠিক যেন এভারেস্ট, আকাশ, বরফ এবং পুরো প্রকৃতির মত। সব বাবারা হয়তো এরকমই। কাজ, সংসার, বাস্তবের কতনা এভারেস্ট তাদের জয় করতে হয় প্রতিনিয়ত। কত না কষ্ট, অপমান, গ্লানি সহ্য করে সংসার মাঝির নৌকা বেয়ে চলতে হয়। আবার সেই সব নৌকোগুলোতে বেশির সব সময় থাকে না জয়গানের কোন আয়োজন। আসলো বাবারা unsung heroes হয়েই থাকে, হয়তো।

জুন ১০, ২০১১

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক—quazih@yahoo.com