একজন বাস ড্রাইভারের আত্মকাহিনী

ঘুমে চোখ ভারি হয়ে আসছে কুদ্দুস ড্রাইভারের। ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে গত দুই বছর ধরে বাস চালাচ্ছে। এর আগে ছিল বাসের হেল্পার। তার আগে ট্রাকের হেল্পার। হেল্পারি করতে করতে শিখে নিয়েছে বাস-ট্রাক চালানো। প্রথমে কাজ ছিল গাড়ি স্টার্ট করা আর তেল পানি চেক করা। পরে দায়িত্ব আরেকটু বাড়ল। ধীরে ধীরে চালিয়ে ফেরীতে উঠান। একবার ওস্তাদ রশিদ ড্রাইভারের খুব পেটে ব্যথা আরম্ভ হল। সে কুদ্দুসকে বলল, কিছুক্ষণ গাড়ি চালাবি নাকি। কিন্তু খবরদার মালিককে বলবি না। এক কথায় মহা উৎসাহে কুদ্দুস রাজি হয়ে গেল।

কিন্তু খবরটা ঠিকই মালিকের কানে পৌঁছে গেল। মালিক বলল, এক্সিডেন্ট ছাড়া তুই যখন গাড়ি চালিয়ে আসতে পেরেছিস, তখন তোর আর হেল্পার থাকার দরকার নাই। তোর বেতন বাড়িয়ে দিচ্ছি। তুই শুক্রবার থেকে আমার ‘স্বপ্ন যাত্রা-৩” চালাবি। গাড়িটা খাদে পড়ে যাবার পর থেকে এক মাস ওয়ার্কশপে বসা। আগের ফাজিল সেলিম ড্রাইভার বলে কি-না ও খাদে পড়ে যাওয়া বাস চালায় না। ব্যাটা ভুলে গেছে ও-ইতো বাসটা খাদে ফেলল। এর পর থেকে হেল্পার কুদ্দুস মিয়া হয়ে গেল, কুদ্দুস ড্রাইভার। হেল্পার থেকে হয়ে গেল ওস্তাদ।

কুদ্দুসের পড়ালেখা তেমন একটা হয় নি। অনেক কষ্ট করে নাম দস্তখত করা শিখেছে। কোন কিছু পড়ার প্রশ্নই উঠে না। তার পরেও কোন কিছু তেমন ঠেকে থাকে নি। রঙ, চেহারা আর আকৃতি দেখে ঠিক জায়গায় ঠিকই পৌঁছে যায়। রাস্তাঘাট মনে রাখতে বিশেষ কোন সমস্যা হয় না। মালিককে মাথা নিচু করে বিষয়টা বলল, মনে হয় এই জন্যে আমার লাইসেন্স হবে না। মালিক সাহেব বলল এইটা কোন ব্যাপারই না। সে নিজেই তো প্রথম তিন বছর লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়েছে । তার পরে পয়সা দিয়ে একটা বের করে নিয়েছে। অবশ্য মালিক হয়ে যাওয়াতে গত পাঁচ বছর আর বাস চালাতে হচ্ছে না। এখন তার নিজেরই পাঁচটা বাস। মালিক তিন দিনের মাথায় কুদ্দুসের লাইসেন্স হাজির করল।

সামনে ঈদ। তাই মালিকের ইচ্ছা ছিল গত বছরের মত, তার সব ড্রাইভার যাতে দুই শিফট করে গাড়ি চালায়। তার নিজের লাভ বাড়বে আর সাথে সাথে ড্রাইভার-হেল্পারদের ঈদের বাড়তি আয়। মোটামুটি সবার জন্যেই একটা খুশি-খুশি ব্যাপার। কিন্তু এইবার তা হচ্ছে না। সারা রাস্তা জুড়ে লক্ষ্য-কোটি গর্ত আর গর্ত। বাস চালাতে হয় রিকশার স্পীডে। গর্ত থেকে ওঠা নামা করতে করতে এমন ঝাঁকুনি হয়, যে নাড়ি- ভুঁড়ি হজম হয়ে যাবার জোগাড়। প্রতিবারই দুই-চারজন তো অসুস্থ হচ্ছে। বমি করে বাস নোংরা করছে, গন্ধ ছড়াচ্ছে বাসের চারিদিকে। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যেতে লাগছে চৌদ্দ ঘণ্টা। দিনে একটা শিফটের বেশী গাড়ি চালাতে পারছে না। বাড়তি আয় আসছে না। মালিক- কর্মচারী সবার মেজাজ বেজায় খারাপ। তার পরে মালিককে কিছু কিছু দিন পর পর এক্সেল-স্প্রিং বদলাতে হচ্ছে। গর্তের ধকল বাসের মত এতো বড় একটা যন্ত্র পর্যন্ত নিতে পারছে না।

বাসের এতো ঝাঁকুনি আর লাফানির পরেও কুদ্দুস ড্রাইভারের চোখ দুটো ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে। আগে, কাজের মধ্যে তেমন ঘুম আসতো না। ইদানীং সমস্যাটা খুব হচ্ছে। তবে একবার সে সত্যি বাস চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মালিকের একটা বাস টঙ্গি-গুলিস্তান রুটে চলে। একবার কুদ্দুস ড্রাইভারের দায়িত্ব পড়লো সেই বাস চালানোর। বাস একটু পর পর জ্যামে পড়তে থাকলো। পাঁচ মিনিট চালানোর পর বিশ মিনিট জ্যামে আটকে থাকলো। তার পরে আধা ঘণ্টা। এর পরের জ্যামে পড়ার দশ মিনিটের মধ্যে চোখটা বন্ধ হয়ে হল। সাথে সাথে নাসিকা গর্জন। কয়েকজন যাত্রী তাকে হৈ চৈ আর ধাক্কা ধাক্কি করে করে উঠালো। তার পর থেকে কুদ্দুস ড্রাইভার ঠিক করলো শহরের মধ্যে বাস চালানো তার কাজ না।

হেল্পারটা নতুন। না হলে ওকে দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া যেতো। এখনো আরও দশ ঘণ্টা! তার পরে বিছানায় শরীরটাকে এলানো যাবে, চোখটাকে বন্ধ করা যাবে। এতো লম্বা সময়ের কথা ভেবে মনটা অস্থির হতে থাকলো। কুদ্দুস বুঝল এইভাবে চলতে থাকলো মহা বিপদের সম্ভাবনা ! কিছু দিন আগে শোনা এক যাত্রীর কথা মনে হল: ‘সড়ক এখন সবাইকে খাচ্ছে। চিত্র পরিচালক, রাজনীতিবিদ, নায়িকা, ছাত্র, জনগণ-কাওকে বাদ দিচ্ছে না’। মনে হল হঠাৎ করে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সব মানুষ তার সামনে এসে হাজির হল। চোখে ভেসে আসল নিজের পরিচিত কতনা ড্রাইভার আর হেল্পারের মুখ। তারা সবাই সড়কেই মারা গেছে। একটু এই ওই দিক হলেই আরও কিছু মানুষ যোগ হয়ে যেতে পারে সেই তালিকায়। ঘুম তাড়ানোর একটা উপায় না বের করলেই না।

বাসের গানের শব্দ বাড়িয়ে দিল, এক হাত দিয়ে আরেক হাতে চিমটি কাটলো। কোন লাভ হল না। শেষে এক পা দিয়ে আরেক পায় লাথি মারল। এতে কিছুটা উপকার পাওয়া গেল। প্রথমে মুখ থেকে অ্যাঁ করে একটা শব্দ বের হল। চোখ থেকে ঘুমটা চলে গেল। কিন্তু তিন মিনিটের মাথায় ঘুমটা ফিরে আসল। আরও শক্ত, গভীর আর ভারী হয়ে।

মাথায় আসল শেষ অস্ত্রের কথা। যদিও এ ব্যাপারে কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে। তার মাথার উপরে লাল কালি দিয়ে বড় করে লেখা আছে: “ চলন্ত অবস্থায় চালকের সাথে কথা বলা নিষেধ”। কথাটা সে হেল্পার থাকাকালীন সময় জেনেছে। একবার চার- পাঁচ বছরের মেয়ে তার মার কাছে জানতে চেয়েছিল, মা, চালক গাড়ি চালানোর সময়ে কি কথা বলা ভুলে যায়?

যাই হোক, কুদ্দুস সিদ্ধান্ত নিল ঘুম তাড়ানোর জন্যে কথা বলতে হবে। তার সব থেকে কাছের যে সিট সেখানে বসে আছেন, চশমা পরা বয়স্কা এক মহিলা। বাস ছাড়ার আগের থেকেই বই পড়ে চলেছেন আর মাঝে মাঝে একটা খাতায় নোট লিখে নিচ্ছেন। তার সব মনোযোগ তার বই, লেখার দিকে। এর মধ্যে যে দু জন অসুস্থ হল, বমি করল সে ব্যাপারে তার কোন ছন্দপতন হয় নি। এক বারও পিছনে ঘুরে তাকান নি।

এরকম এক জন মহিলার সাথে কথা বলতে হবে ভাবতে মনটা হতাশ হয়ে গেল। গত কালই তো ওই একই সিটে এক সুন্দরী যুবতী বসে ছিল। গত কাল কেন যে আজকের এই সমস্যাটা হল না। যাই হোক, নিজের আর সবার জান বাঁচানোর জন্যে তাকে এই আত্মত্যাগ করতেই হবে।

কুদ্দুস ড্রাইভার কয়েক বার খুক খুক কাশল; মহিলার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে। না খুব একটা লাভ হল না। বেশ জোড়ে বলল, খালাম্মা কি চিটাং যাচ্ছেন? অনেকটা অবাক করে দিয়ে মহিলা বললেন, হ্যাঁ মেয়ের সাথে ঈদ করতে যাচ্ছি।............ তুমি নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পেরেছ। আমি অল গ্রিন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর। আমি প্রায় টিভি চ্যানেলগুলোর টক শো তে যাই।

কুদ্দুস মনে মনে হাসল। সে একজন নিরক্ষর মানুষ আর সে কি-না দেখবে বাংলাদেশের টিভির টক শো ! তবে সুযোগ পেলে সে হিন্দি ছবি দেখে। হিন্দি ছবি নাচগুলোর কথা মনে করে কিছুটা পুলক আসল।

মহিলা বলে চললেন, বুঝেছ আগামী সপ্তাহের ঢাকায় যে ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার হচ্ছে বাংলাদেশের নিরাপদ সড়কের উপরে, সেখানে আমাকে পেপার পড়তে হবে। আমি এমনকিছু প্রস্তাব করবো, যাতে বাংলাদেশের সড়ক সব সময়ের জন্যে নিরাপদ হয়ে যাবে। সেমিনারের তিন দিন আগে প্রধান মন্ত্রীর সাথে দেখা করে জানিয়ে রাখব আমার প্রস্তাবগুলো। অনেকটা সরেজমিনে অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্যে আজকে বাসে করে যাচ্ছি। আমি তো সাধারণত প্লেন ছাড়া দূরে কোথাও যাই না।

কুদ্দুস ড্রাইভার অবাক হয়ে কথা শুনতে লাগলো। কত না ভালই হয়, যদি এতো দুর্ঘটনা না হয়। মানুষের জীবন বাঁচে আর ভোগান্তি কমে। মনে হল বাস থামিয়ে ভদ্র মহিলার কথা শুনতে। খুব ইচ্ছে হল জানতে, কি করলে এইটা সম্ভব! সাহস করে বলল, খালাম্মা কিছু মনে না করলে বলবেন, এইটা কি করে হতে পারে। আমি অশিক্ষিত মানুষ। তার পরেও, শুনলে খুব ভাল লাগত।

ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ভদ্র মহিলা বক্তৃতা ঢঙয়ে আরম্ভ করলেন, সড়কের সমস্যা দূর করতে হলে, প্রথমে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা ও দুর্নীতি বন্ধ করা। তার পরে দেশ থেকে আইন করে হরতাল তুলে দিতে হবে, আর সড়ক নিয়ে সরকারী কিংবা বিরোধী দল কাওকে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। বাজেটের কমপক্ষে শতকরা বাইশ ভাগ সড়কের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটা রাস্তা আয়তনে কমপক্ষে দ্বিগুণ করতে হবে। প্রতিটা রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দিতে হবে। সাথে সাথে সব স্কুলের ছাত্র আর শিক্ষকদের সড়ক নিরাপত্তার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এগুলো করলে, শুধু সড়কের সমস্যাই দূর হবে না, দেশের সামগ্রিক উন্নতি হবে শনৈ শনৈ।

কুদ্দুস ড্রাইভার ঢোক গিলে বলল, খালাম্মা আপনি নিশ্চয়ই খুব জরুরি কথা বলেছেন। তবে আমি বেশী কিছু বুঝতে পারি নি। এ গুলো করলে হয়তো অবশ্যই দেশের অনেক ভাল হবে। কিন্তু, তাতে কি শহরের জ্যাম বন্ধ হবে, রাস্তার গর্ত কি বন্ধ হবে, চিকন রাস্তাগুলো কি মোটা হবে? আপনি তো বলেন নাই, আপনি, আমি আর আমরা কি করতে পারি। শুধু বলেছেন অন্যদের কি করতে হবে। আমার অশিক্ষিত মাথা শুধু একটা কথা বলে, আমরা যদি বের করতে পারি, আমরা নিজেরা কি করার ক্ষমতা রাখি তা হলে অনেক উপকার এমনিতেই হবে। যে গাড়ি চালায় সে সাবধানে গাড়ি চালাতে পারে, যে রাস্তা পার হচ্ছে সে খালি রাস্তার জন্যে অপেক্ষায় থাকলে পারে। প্যাসেঞ্জাররা ড্রাইভারকে সাবধানে চলতে বাধ্য করলে বিপদের সম্ভাবনা নিজে নিজেই কমে যায়। যার যেই কাজ করার কথা, সে সেই কাজটা করলে আমাদের মানুষরাও এখনই অন্য দেশের মানুষদের মত অনেকটা নির্ভয়ে রাস্তায় চলা ফেরা করতে পারে। একজনকে আর বলতে হয় না, অন্য জনের কি করার দরকার।

সেপ্টেম্বর ১০, ২০১১

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com