জানালা

পরম স্নেহের দাদু ভাই,

আমার এই পত্র তুমি পাইবে কি-না , তাহা বলিতে পারিতেছি না। অনেকে হয়ত আমাকে পাগল জ্ঞান করিতে পারে। আমার পুত্র, মানে তোমার বাবা, মাত্র কিছু দিন পূর্বে জন্ম গ্রহণ করিয়াছে। সেই আমার প্রথম সন্তান। আমি তাহাকে না লিখিয়া , তোমাকে লিখিতেছি। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, আমার দাদু ভাই একজন লেখক হইবে এবং সে আমার মনের অবস্থা বুঝিতে পারিবে, স্মরণ করিবে, এবং আমার জীবন বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করিবে।

গত বেশ কিছুদিন ধরিয়া তলপেটে খুব বেদনা করিতেছে। সাথে রক্তক্ষরণ হইতেছে। শারীরিক ভাবে অত্যন্ত দুর্বল বোধ করিতেছি। কাজ করিবার শক্তি আর উৎসাহ, কোনটাই পাইতেছি না। তাহার পরেও ছোট শিশুটির জন্যে প্রচুর কর্ম সম্পাদন করিবার প্রয়োজন হয়।

(ক্রমশ)

এক সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য ডুবতো না। লন্ডন ছিল পুরো সাম্রাজ্যের বৃহত্তম শহর। তার পরেই ছিল কলকাতার স্থান; লোক সংখ্যা, শিক্ষা, চিকিৎসা, ক্ষমতা , অর্থনীতিসহ প্রায় সব দিক থেকে। এখনকার যে বাংলাদেশ, তখন তাকে বলা হত পূর্ব-বঙ্গ। পূর্ব আর পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে অবাধ যাতায়াত ছিল। উচ্চ শিক্ষা কিংবা সু-চিকিৎসার জন্যে পূর্ব বঙ্গের মানুষদের যেতো হতো কলকাতায়।

বরিশাল কালেক্টরটে চাকরি করেন কাজী রউফ। ব্রিটিশ রাজের কাজ। অনেক দায়িত্ব, দিন রাত ব্যস্ত থাকতে হয়। তার গ্রামের বাড়ি রহিমপুর; যশোর (বর্তমান ঝিনাইদাহ) আর কুষ্টিয়া জেলার সীমন্ত ঘেষে। অজ পাড়া গাঁ বলতে যা বুঝায়। অবশ্য সে সময়ে প্রায় পুরো বাংলাদেশটাই ওরকম ছিল। ১২ মাইল দূরে আলমডাঙ্গা রেলস্টেশন। সেখান থেকে কলকাতা যাওয়া যায়। আর যশোরে যেতে হলে, প্রথমে আসতে হয় ঝিনাইদাহ, ১৫-১৬ মাইল দূরে। সেখান থেকে বাসে চড়ে যশোর।

আলমডাঙ্গা আর ঝিনাইদাহ যেতে হয় পায়ে হেটে। অনেক কষ্টের কাজ। গ্রামে কোন সুযোগ সুবিধা নাই বললেই চলে, তাই বিভিন্ন কারণে হয় যশোর না হয় কলকাতা যাওয়ার দরকার হয়ে পড়ে। সাথে মহিলা থাকলে, গরুর গাড়ি নিতে হয়। তাতে সময়, কষ্ট, খরচ বহুগুনে বেড়ে যায়। মাঝ পথে ট্রেন অথবা বাস ধরার আগে যাত্রা বিরতি। রসগোল্লা, সন্দেশ, সাথে ডাবের পানি কিংবা শুধু পানি দিয়ে জলযোগ। ক্লান্ত শরীরের কাছে সে একেবারে অমৃত। তার পরে বাস কিংবা ট্রেনে উঠলে, সে তো অনেক আরামের। ফিরতি পথে আবার ঠিক উল্টোটা। জলযোগ করে আবার সেই লম্বা রাস্তা। পায়ে হেটে যাত্রা করা। অনেক সময়ে গরুর গাড়ি পেতে ঝামেলা হয়। অপেক্ষা করতে হয়। অবশ্য আগের থেকে গরুর গাড়ি ঠিক করে গেলে, ঝক্কি কিছুটা কম হয়।

কাজী রউফ বয়সে তরুণ হলেও, চিন্তা আর পরিকল্পনায় ছিলেন গ্রামের সবার থেকে অনেক আগানো। ছোট তিন ভাইকে জানালেন, সাত পুরুষের ভিটে বাড়ি ছেড়ে যশোরে জমি কিনবেন। সেখানে বাড়ি বানিয়ে বসবাস আরম্ভ করবেন। তিনি ভাইদের বললেন, শহরে থাকলে পড়ালেখা, চিকিৎসা —সব দিক থেকেই সুবিধা। প্রয়োজনে কলকাতা যাওয়া সহজ। স্টেশনে যেয়ে ট্রেনে চেপে বসলেই হলো । নিজেকে কলকাতায় থেকে পড়ালেখা করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। বাড়ির অন্যরা যাতে কাজটা সহজে করতে পারে, তারই প্রয়াস।

সালটা ছিল ১৯২৮। কাজী রউফ তার দু ভাইকে যশোরে নিয়ে আসলেন। রহিমপুর গ্রামে ছিল তাদের প্রচুর লাখেরাজ জমি। লাখেরাজ মানে হল নবাব আমলে দানকৃত করমুক্ত সম্পত্তি। সাত পুরুষ, এই সম্পত্তির উপার্জনের উপর ভালই কাটিয়ে এসেছেন। ধর্ম-কর্ম, সাহিত্য, শিল্প নিয়ে সময় কেটেছে বেশ। সে রকম পরিবেশ ছেড়ে শহরে চলে আসার সিদ্ধান্ত, অনেককেই শুধু অবাক না হতভম্বও করলো ।

যশোর শহরের সদরে একবারে সাত বিঘা জমি কিনে ফেললেন। পাকা দালানে ভাইদের থাকার ব্যবস্থা হলো । পাশাপাশি তিন কামরায় ভাইরা থাকবে। কাজী রউফের মাথায় কাজ করতো তিনি পরিবারের বড় ছেলে। কত না দায়িত্ব। ভাইদের মধ্যে তিনিই একমাত্র বিয়ে করেছেন। অন্য ভাইরাও বিয়ে করবে, বাচ্চা-কাচ্চা হবে। চারিদিকে মানুষজন গম গম করবে। যদিও মেজ ভাই ঠিক করেছেন, তার কাছে রহিমপুরই ভালো; তার যশোরে এসে থাকার কোন ইচ্ছা নাই। তিনি শহরের বাড়তি সুযোগ সুবিধা ছাড়াই বেশ থাকতে পারবেন। তা ছাড়া সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে, জমিজমা আর সম্পত্তি বারো ভূতে খেয়ে শেষ করে দিবে।

কাজী রউফের কলেজে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়েছিল। তার বয়স বেশী হলে, হবে ১৯। বউয়ের বয়স ১২ কিংবা ১৩। সে সময়ে মেয়েদের আরও ছোট বয়সে বিয়ে হত। মেয়ের বাবা মেয়েকে প্রাণের থেকে বেশী ভালোবাসতেন। সচ্ছল ছিল তাদের পরিবার। আগে কলকাতায় থাকতেন। কিছুদিন আগে গ্রামে ফিরে এসেছেন। তাকে কলকাতা থেকে গ্রামই বেশী আকৃষ্ট করেছিল। মেয়ের ছিল পড়ালেখা করার বাতিক। অনেকেই ভেংচি কাটতো; মুসলমান ঘরের মেয়ে বই পড়তে ভালোবাসে বলে। বাবাকে নিয়ে সমালোচনা হতো কারণ মেয়ের বই পড়ার ব্যাপারে, তার সমর্থন ও সহযোগিতা দুই-ই ছিল।

মেয়েটার নাম সালেহা বেগম। একেবারে ছোট বয়সে বুঝতে পেরেছিলেন মেয়েরাও জ্ঞান অর্জন করতে পারে, বই পড়তে পারে। এটা শুধু ছেলেদের একার কোন ব্যাপার না। বেগর রোকেয়ার কথা তিনি শুনেছিলেন। বেগম রোকেয়া যে বিশাল আন্দোলনের সূত্র পাত করেছিলেন, তা তাকে নাড়া দিয়েছিল। তার উৎসাহ দেখে, বাবাই তাকে পড়ালেখায় হাতে খড়ি দেয়ার আয়োজন করলেন।

শুধু বাংলা না, এক বারে তিন ভাষায় তার অধ্যায়ন আরম্ভ হলো। বাসায় মৌলবি সাহেব এসে আরবি পড়িয়ে যেতেন। স্কুলে যেয়ে শেখা শুরু করলেন বাংলা, ইংরেজি। অবশ্য সবচেয়ে বেশী পছন্দের ছিল বাংলা। যে ভাষায় কথা বলা হয়, সেই ভাষাতে লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস। পড়তে ভীষণই আনন্দ হতো। পুরো পৃথিবীটাই যদি গল্পের মত সুন্দর হতো!

কলকাতায় বেড়ে উঠা মেয়ে সালেহার শ্বশুর বাড়ি রহিমপুর গ্রামে। যদিও স্বামী রউফ বেশীর ভাগ সময় কলকাতায় থাকতেন, কলেজে পড়াশোনার কারণে।বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যে রউফের জানা হয়ে গেল বালিকা বধূর জ্ঞান চর্চা প্রীতির কথা। প্রথমে একটু সংস্কারে বেধেছিল। বাড়ির বউ পড়া লেখা করে; এইটা কেমন কথা। বউ রান্না-বান্না তদারকি করবে,বাচ্চা- কাচ্চা মানুষ করবে। মহিলাদের পড়ালেখার কি কোন দরকার আছে?

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে, বাড়ির বড় ছেলে কাজী রউফ ফরমান জারী করলেন, সালেহার বই পড়ার ব্যাপারে কেউ ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারবে না। তিনি নিজে অনেকগুলো বই কলকাতা থেকে কিনে এনে দিলেন তার বালিকা বধূর জন্যে। তার পর থেকে কলকাতা থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে শাড়ি, চুড়ির সাথে কিছু বাংলা বই থাকতই।

প্রিয় দাদু ভাই,

তুমি জানিয়া হয়ত অত্যন্ত উৎফুল্ল হইবে, আমি পুস্তক পাঠে অনাবিল আনন্দ লাভ করি। আমার মন, বইগুলোর চরিত্রের সাথে মিশ্রিত হইয়া একাকার হইয়া যায়। আমি প্রতিটি চরিত্রকে পরিষ্কার দেখিতে পাই। তাহাদের কষ্ট, বেদনা এবং আনন্দ আমাকে সম পরিমাণ ব্যথিত ও আনন্দিত করে।

আমি কলিকাতা থাকিতে একবার বঙ্কিমচন্দ্রের সুর দেয়া “বন্দে মাতারাম” সঙ্গীতটি শ্রবণ করিয়াছিলাম। আমারও সবার সাথে কণ্ঠ দিয়া গানটি গাইতে ইচ্ছা করিয়াছিল। আমি যদি ব্রিটিশদের হাত হইতে মাতৃভূমি উদ্ধারের আন্দোলনে যোগদান করিতে পারিতাম!

কিন্তু আমি চাইলেই তো সব হইবে না। আমার বাবা অনেক উদার প্রাণের মানুষ হওয়াতে, কিছু শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম হইয়াছি। সে জন্যেই, আমি তোমাকে এই পত্রটি লিখিতে পারিতেছি। । আমার সম বয়সী অন্য মুসলমান বালিকারা আরবি ছাড়া আর কোন ভাষা শিখিবার সুযোগ পর্যন্ত পায় না। সেই তুলনায় তো আমি মহা ভাগ্যবতী। আমি ঘর থেকে বাহির হইয়া বিদ্যালয় পর্যন্ত যাইবার সুযোগ পাইয়াছি।

(ক্রমশ)

বেশ কিছু ঘটনা অল্প কিছু সময়ের মধ্যে হলো। কাজী রউফ গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে যশোরে আস্তানা গড়ার কাজটা সম্পন্ন করেছিলেন। এর মধ্যে কলেজের পড়ালেখা শেষ হওয়ার কারণে কলকাতায় যেয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে হলো। কলকাতার মেয়ে সালেহার গ্রামে থাকার অবসান হল। স্বামী তাকে নিয়ে এলেন যশোরে। পরিকল্পনা, এখন থেকে তারা এক সাথে থাকবেন।

কিন্তু মানুষের ভাবনার সাথে বিধাতার ভাবনার মিল অনেক সময় হয় না। কাজী রউফ ব্রিটিশ রাজের চাকরির চেষ্টা করছিলেন। পরীক্ষা, ইন্টার্ভিউর পরে অনেক দিন কোন খবর ছিল না। অনেকটা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের চাকরি, সাধারানত বাঙালি মুসলমানদের কম হত। হিন্দু বাঙালিরা এ ব্যাপারে অনেক এগিয়ে ছিল। যশোরে থাকার প্রায় ছয় মাসের মাথায় রাতের বেলা টেলিগ্রাম আসলো চাকরিটা তার হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে কাজে যোগ দান করতে হবে।

কাজী রউফের কাজ হল বরিশালের কালেক্টরেট অফিসে। মাইনে ভাল, সরকারি বাড়ি, চাকরবাকর; সব মিলিয়ে এলাহি কাণ্ড। তিনি দুঃসাহসিক এক কাজ করলেন। স্ত্রীকে নিয়ে যাত্রা করলেন বরিশাল। তার কথা হলো অনেকদিন স্ত্রীকে ছাড়া থেকেছেন; আর না। এখন থেকে নিরবিচ্ছন্নভাবে দু জনে এক সাথে থাকবেন। অচেনা জায়গা হলেও, ধীরে ধীরে মানুষজনের সাথে পরিচয় হবে, হৃদ্যতাও হয়ে যাবে।

সালেহার সংগ্রহের বেশীর ভাগ বই রহিমপুরে রেখে এসেছিলেন। হাতে গোনা কিছু বই সাথে করে যশোরে আনা হয়েছিল। তিনি যশোরে আনা সবগুলো বই গুছিয়ে নিলেন, বরিশাল নিয়ে যাবার জন্যে। পাড়ার মহিলারা গায়ে পড়ে উপদেশ দিয়ে গেলেন, নতুন জায়গায় যাচ্ছো, হাড়ি পাতিল আর সংসারের জরুরী জিনিসপত্র নিয়ে যাও। কাজে লাগবে। সালেহার একই কথা, এই সব জিনিষ পত্র সব জায়গাতে কিনতে পাওয়া যায়। তার সংগ্রহের বই, সব কলকাতা থেকে আনা। এ গুলো যশোরে পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায় না। অন্যরা যদি বুঝতো, তার কাছে বই কত যে প্রিয় বিষয়!

১৭-১৮ বছর বয়সে সালেহা সন্তান সম্ভবা হলেন। রহিমপুর ও যশোরে থাকতে; সন্তান না হওয়ার জন্যে অনেক কথা শুনতে হয়েছে মানুষের কাছে। বাজা, অপয়া বলে তাকে নিয়ে অপবাদ দিয়েছে। কিন্তু তিনি মানুষের কু কথায় একেবারে কান দেন নি। তার যুক্তি ছিল, সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ হলেই সন্তান হবে। এখানে মানুষের কোন হাত নেই। মানুষে বেশী উত্যক্ত করলে, বেচারি, রবীন্দ্রনাথ কিংবা বঙ্কিমের কোন বই খুলে হারিয়ে যেতেন কল্পনার জগতে পাখা মেলে।

সুপ্রিয় দাদু,

ইদানীং আমার খুব বাঁচিতে সাধ হয়। কিন্তু আমি দিব্য লোকের মত দর্শন করিতে পারিতেছি যে আমার হাতে আর সময় নাই। জন্ম নিলে মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যু আতঙ্কে আমি বিন্দু মাত্র ভীত নই। শুধু মনে হয় আরেকটু যদি সময় পাইতাম। মানুষের জন্যে যদি কিছু করিয়া যাইতে পারিতাম। আজকে আরেকটু লিখিবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শরীরে কুলাইতেছে না। মাথা খুব ঘুরিতেছে। আমরা এখন লঞ্চে করিয়া কলিকাতা অভিমুখে চলিয়াছি।

(ক্রমশ)

বরিশাল থেকে কলকাতা যেতে হলে, প্রথমে স্টিমারে করে আসতে হতো খুলনায়। সেখান থেকে রেল পথে কলকাতা। বরিশাল থেকে খুলনা পৌছতে স্টিমারে সময় নিত ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। বরিশাল রাত আটটার দিকে ছেড়ে খুলনা ঘাটে নোঙ্গর করতো সকাল ৬ টার দিকে। খুলনা থেকে ট্রেন ছাড়তো সকাল ৭ টায়; দৌলতপুর,নোয়াপাড়া, যশোর, বনগাঁ, প্রভৃতি স্টেশনে স্বল্প বিরতি দিয়ে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে পৌছাতো বেলা পৌনে এগারোটায়।

শিয়ালদহ রেল স্টেশন ছিল পূর্ব বাংলা এবং আসাম অঞ্চলে যাত্রা শুরু এবং যাত্রা শেষের স্টেশন। এই ট্রেন লাইনের নাম ছিল প্রথমে EBR এবং পড়ে নাম হল B&AR (বেঙ্গল এন্ড আসাম রেলওয়ে)। শিয়ালদহ থেকে খুলনা অভিমুখী ট্রেনটার নাম ছিল বরিশাল এক্সপ্রেস।

সালেহা বেগমের বাচ্চা প্রসবের সময়ে প্রচুর রক্তপাত হলো। ধাত্রী তার যতটুকু জ্ঞানে কুলায়, সেই মোতাবেক কাজ করলো। ফুটফুটে শিশু সন্তান ঠিকই বের করে আনলো, কিন্তু রক্তপাত বন্ধ করতে পারলো না। বরিশালের একমাত্র কলকাতায় শিক্ষিত চিকিৎসক, ডাক্তার কুণ্ডুকে খবর দিয়ে আনা হলো। তার ওষুধে সালেহার কিছুটা বল ফিরে এলেও, রক্তপাত বন্ধ হল না।

কাজী রউফ দোয়া, মিলাদ, মানোত—অনেক কিছুর ব্যবস্থা করলেন। এমনকি বড় বড় কবিরাজদের সাথে কথা বললেন। তাদের কথা মত চিকিৎসা করা হলো। কিন্তু না, কোন কিছুতেই বিশেষ কোন উপকার পাওয়া গেল না। সালেহা আবার নতুন করে দুর্বল হতে লাগলেন। তাকে দেখলেই মায়া হত; চোখ দূটো একেবারে মনে হতো কৌটোর মধ্যে ঢুকে গেছে। কোন কিছুই মুখে দিতে পারেন না। খেলেই বমি। এ দিকে বাসায় আপন লোক বলতে কেও নেই। ছোট বাচ্চাটার সব কিছু নিজের হাতে করতে মন চায়। কাজের লোকদের হাতে বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে না।

সালেহার অবস্থা দিনে দিনে অবনতি হতে লাগলো। কাজী রউফের মাথায় আসলো না, তিনি আর কি করতে পারেন। স্ত্রীর এত কষ্ট কোনভাবেই সহ্য করা যায় না। ডাক্তার কুণ্ডু সাফ বলে দিলেন, আমি তো কোন আশা দেখি না। পারলে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে বড় মেডিক্যাল কলেজ আছে, বিদেশি ডাক্তার আছে, তারা যদি কিছু করতে পারে।

সালেহার বড় ভাই থাকতেন কলকাতার ইণ্টালী ফাস্ট লেনে। তাকে টেলিগ্রাম দেয়া হল সালেহার শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে। বলা হল, কাজী রউফ সালেহাকে নিয়ে ওই রাতেই কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। সাথে তাদের পুত্র রোকনও থাকবে। ছোট শিশুর মামী যেন স্টেশনে এসে, তার দায়িত্ব কিছুদিনের জন্যে নেন।

প্রিয় দাদু ভাই,

আমি বর্তমানে কলিকাতা মেডিকেল কলেজে। তোমার দাদা আমাকে এখানে প্রচুর ঝামেলা পোহাইয়া ভর্তি করাইয়াছে। আমি অবশ্য বলিয়াছিলাম ইহার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ আমি একেবারে অবগত আছি, আমার দিন শেষ। পৃথিবীর কোন হাসপাতাল কিংবা ডাক্তার আমাকে মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচাইতে পারিবে না। কিন্তু তোমার দাদা আমার কথা গ্রাহ্য করে নাই। ব্যাপক অর্থ-কড়ির অপচয় হইতেছে।

দাদু ভাই, তোমাকে আমার এই পত্র লেখার কারণ সবিস্তারে ব্যাখ্যা দেয়ার মনোবাঞ্ছনা ছিল। সেটি সম্ভব হইতেছে না। আমার শক্তি প্রায় নিঃশেষ। তার পরেও এই পত্র আমাকে শেষ করিতে হইবে। আমার প্রয়াস ছিল এই পৃথিবীতে এমন কিছু করিয়া যাইবার, যাহাতে আমি এই বিশ্ব সমাজের জন্যে কোন অবদান রাখিয়া যাইতে পারি।

বেগম রোকেয়া সম্পর্কে আমি অবগত আছি। আমি তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে চাহিয়াছিলাম। ভাগ্যক্রমে, আমার স্বামী আমাকে পড়া লেখার ক্ষেত্রে সব সময় উৎসাহ দিয়াছেন। রহিমপুর গ্রামে আমি ছোট বালক-বালিকাদের বিদ্যা শিক্ষা দেয়া আরম্ভ করিয়াছিলাম। যশোরে চলিয়া আসার কারণে আমি তাহা চালাইয়া যাইতে পারি নাই। আমার পুনরায় অনুরূপ কাজ আরম্ভ করিবার পরিকল্পনা ছিল।

এই বার আমি তোমাকে আমার পত্র লেখার মুল উদ্দেশ্যটি বলিতেছি। দাদু ভাই, আমি চাই, জ্ঞানের আলো প্রসারের যে প্রচেষ্টা আমি আরম্ভ করিয়াছিলাম; তাহা যেন অব্যাহত থাকে। আমার কথা জানিয়া উদ্বুদ্ধ হইয়া, যদি আরও বালিকা,মহিলা এই ধরণের কাজে আগাইয়া আসে; তাহা হইলে আমি পরকালে থাকিয়াও অপরিসীম শান্তি অর্জন করিব। বুঝিলে দাদু ভাই, এই পুরো পৃথিবীটা হইল একটি বৃহৎ রঙ্গ মঞ্চ। এখানে মঞ্চ একই থাকিয়া যায়, শুধুমাত্র চরিত্রগুলো পরিবর্তিত হয়।

দাদু ভাই, তোমার নিকট আমার একটিই অনুরোধ, তুমি কিন্তু অত্যন্ত সুন্দর করিয়া গুছাইয়া আমার কথাগুলো বর্ণনা করিবে। বেগম রোকেয়ার মতো, আমার মতো, যাহাতে হাজার হাজার চরিত্র ভারত বর্ষের মঞ্চকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলে। ইংরেজরা যাহাতে দেশ ছাড়িতে বাধ্য হয়। এবং মহিলারা সম্মানের সাথে জ্ঞান অর্জন করিয়া পুরুষের সাথে সম তালে সমাজ গড়ার কাজে ভূমিকা রাখিতে পারে

অফুরন্ত আর্শিবাদসহ,

তোমার দাদী,

সালেহা বেগম

১০ই জুলাই, ১৯২৯

(সমাপ্ত)

সালেহা বেগম মৃত্যুর পর গঙ্গায় অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে হলো পাকিস্থান আর ভারত। পরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হলো। সালেহার পুত্র রোকন পাকিস্থান সরকারের কর্মচারী ছিলেন। তার ভারত কিংবা কলকাতা আসার অনুমতি ছিল না। বেচারার মনে, মা’ কে নিয়ে অভিমানের কোন কমতি ছিল না। মা কি করে মাত্র চার মাস বয়সে তাকে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছিলেন।

নিজের মা ছিল না বলে, অন্য আত্মীয় স্বজনদের অনুগ্রহে বড় হতে হয়েছিলো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাকে নিয়ে অভিমান কমেছিলো। নিজেই যুক্তি তৈরি করেছিলেন, সৃষ্টি কর্তার কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা, এক মাত্র তিনি নিজেই জানেন। এইটা মানুষের বুঝার কর্ম না।

রোকন কৌতূহলী হয়ে তার ফুফু, চাচীদের কাছে মায়ের কথা জানতে চেয়েছেন। সবাই তাকে জানিয়েছেন, সালেহা বেগম সবার মন জয় করে রেখেছিলেন। কারোরই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল না। বরং তার আদর যত্নে সবাই বিগলিত ছিলো। তারা সালেহার বই পড়ার বাতিকের কথা জানিয়েছিলেন।

রহিমপুরের বাড়িতে রোকন তার মায়ের বেশ কিছু বইয়ের সন্ধান পান। তিনি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে মায়ের পাঠ করা বইগুলো এক এক করে পড়ে ফেললেন। সেখানে অন্যান্য বইয়ের মধ্যে ছিল, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মীর মোশাররফ হোসেনের রচনা সমগ্র। তিনি সবগুলো বই সাথে করে নিয়ে আসলেন যশোরে। পরে সরকারি চাকরির কারণে তার আর যশোরে থাকা হয় নি। মায়ের এত সাধের বই গুলো এক এক করে, সংগ্রহ থেকে সব উধাও হয়ে যায়।

১৯৮০ সালে রোকন কলকাতায় যেয়ে মায়ের কবরের খোঁজে বের হন। তিনি শুনেছিলেন তার মা গোবরা কবরস্থানে সমাহিত হয়ে আছেন। কিন্তু দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরে তার কবরের সঠিক জায়গা কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রায় ৪ বর্গ মাইল জুড়ে সেই বিশাল কবরস্থান। অনেকটা হতাশ মনে ভাবতে লাগলেন কি করা যায়।

ভাগ্যক্রমে সেখানকার অফিসে এক কর্মচারী জানালেন, তাদের কাছে সব কবরের লিখিত রেকর্ড আছে। তিনি শুনেছিলেন, তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল ১৯৩০ সালে। কিন্তু কোন মাসে সে সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। ওই বছরের দেয়া প্রতিটা রেকর্ড দেখলেন। না সালেহা বেগমের নাম পেলেন না।

কিন্তু মা কে যে খুঁজে পেতেই হবে। তিনি এখানেই কোথাও শুয়ে আছেন। ১৯৩০ সালের রেকর্ড বইয়ে তার নাম পাওয়া গেল না। তিনি ঠিক করলেন, ১৯২৯ আর ১৯৩১ সালের রেকর্ড খুঁজে দেখবেন। তার মন বলছে, তিনি মাকে অবশ্যই খুঁজে পাবেন। ভাগ্য এই বার সুপ্রসন্ন। পাওয়া গেল মাকে। ১৯২৯ সালের রেকর্ড বইয়ে। মৃত্যু ১২ই জুলাই, সমাহিত ১৩ ই জুলাই। স্বামী কাজী রউফ। অবস্থানঃ কবর ১, লাইন ১ । ঠিকানাঃ ইন্টারলী ফাস্ট লেন। যেহেতু জমি কেনা ছিল না, নির্দিষ্ট সময় পরে অন্য মরদেহ সেখানে সমাহিত করা চলছে।

মায়ের অবস্থান খোঁজা আরম্ভ করেছিলেন সেই সকালে। দুপুর, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার কাছাকাছি সময়ে তিনি মায়ের হদিস পান। গোরস্তান অফিসের কর্মচারী অবাক হয়ে বললেন, তিনি কাউকে এত অধ্যবসায় নিয়ে কোন মৃত মানুষকে খুঁজতে দেখেন নি। কিন্তু কর্মচারী যদি জানতেন, মায়ের পাশে যেয়ে দাঁড়ানোর জন্যে রোকন অর্ধ শত বছরের বেশী সময় ধরে অপেক্ষা করে আছেন।

অফিস ঘরের ঠিক পাশেই মায়ের অন্তিম ঠিকানা। মায়ের কবরে পাশে দাঁড়িয়ে রোকন মাকে তার না বলা সব কথা বললেন। হয়ত মা এগুলো আগের থেকেই জানতেন। সন্তানের সব কথা মা এমনিতেই জেনে ফেলে। তার পরে দোয়া পড়ে, ছেলে, তার মায়ের কবর থেকে জীবন সংসারে ফিরে আসলেন, মা তুমি ভালো থেকো। আমাকে সেই ছোট চার মাস বয়সে ফেলে আসার জন্যে কষ্ট পেও না।

রোকন চললেন ইন্টারলী ফাস্ট লেনে; মামা বাড়ির খোঁজে। মামা মারা গেছেন সেই কবে। পাওয়া গেল মামাত ভাই খুরশিদকে। এর আগে তার মামা কিংবা মামাত ভাইয়ের কথা জানা ছিল না। পরিচিত হওয়ার পর খুরশিদ রোকনকে বললেন, ভাই তুমি আমাকে বাঁচালে। আমার বাবা তার ছোট বোনের কথা খুব বলতেন। তিনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন, আমি যেন তার একটা জিনিষ তোমার কাছে পৌঁছে দেই।

খুরশিদ রোকনকে একটা জীর্ণ বই দিয়ে বললেন, এই বইটা তোমার মা মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত পড়েছেন। তিনি তার বড় ভাইকে বলে গিয়েছিলেন, এই বইটা তুমি সাবালক হওয়ার পর, তোমাকে পৌঁছে দেই। কিন্তু পরে সেই কাজটা করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। এই বইয়ে ভিতরে তোমাকে লেখা, তোমার মায়ের একটা চিঠি আছে।

রোকন বইয়ের মধ্যে চিঠিটা আবিষ্কার করলেন। একান্ন বছর আগে লেখা।

কিন্তু চিঠি তাকে না, তার ছেলে, মানে সালেহা বেগম তার নাতিকে উদ্দেশ্য করে চিঠিটা লিখে গেছেন।

নভেম্বর ৩০, ২০১৪

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com