মনের মন্দিরে

শ্যামা পেন্সিল, কাগজ নিয়ে বসেছে স্কেচ করবে। মাথার মধ্যে যে ভাবনাটা আছে সেটা ফুটিয়ে তুলবে কাগজে। এক সময়কার সবচেয়ে প্রিয় কাজ এটা। ‘এক সময়কার’ বললে হয়ত কিছুটা ভুল হতে পারে, এখনও স্কেচ করাটা তার সবচেয়ে ভালোলাগার কাজগুলোর লিস্টে শীর্ষে। কিন্তু ইদানীং স্কেচ করাটা হয়ে উঠে না। প্রথমত, সময় করে উঠাটা কঠিন। দ্বিতীয় হল, বাবা ইদানীং ছবি আঁকাটাকে কেমন যেন বাঁকা চোখে দেখেন। আগে বাবারই শ্যামা’র ছবি আঁকা নিয়ে কত গর্ব ছিল। মানুষের কাছে বলতেন, মেয়ে আমার বড় শিল্পী হবে। এখন তিনি কন্যার ছবি আকার বিরোধী। এবং শেষের কারণ হল, ছবি কিংবা স্কেচ করার তাগিদ অনুভব করে না। তাগিদ তৈরি হওয়ার জন্যে আইডিয়া আসার কথা, সেটাই আসে না।

আজ অনেকদিন পরে মাথায় আইডিয়া ও তাগিদ দুই এসেছে। নিজের রুমের দরজাটা বন্ধ করেই সে বসেছে। বাবা জানতে পারবে না শ্যামা ছবি আঁকছে। শ্যামা’র হাসি লাগলো, বাবা ছবি আঁকার মধ্যে খারাপ কিছু পায় কি করে। যাই হোক, যার কারণে পৃথিবীতে আসা, যার আদর যত্নে এই পর্যন্ত বেড়ে উঠা; তার একটা আবদার সে অনায়াসে মেনে নিতে পারে। ছবি আঁকা নিষেধ করাটা যত অযৌক্তিক হউক না কেন; শ্যামা নিষেধটাকে আবদার হিসেবে ধরে নিয়েছে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্য। একজন অনুরোধ করেছে একটা স্কেচ করে দিতে। শুধু ‘অনুরোধ করেছে’ বললে ভুল হবে; একেবারে নির্দেশ ধরণের আবদার। শ্যামা না বলতে পারে নি। লোকটা অনুরোধ করে না। কেমন যেন মোহনীয় সুরে তাকে যাদু করে রেখেছে।

আগেও বেশ কিছু মানুষ একই অনুরোধ করেছে। কিন্তু আমলে নেয় নি। কিন্তু এইবার শ্যামা ফেলতে পারছে না লোকটার কথা। লোকটার কথার মধ্যে মোহ আছে, নির্দেশ আছে, সম্মোহন আছে। আবার এমনভাবে বলেছে, যেন তার একটা অধিকারও আছে। যেই লোককে সামনা সামনি দেখে নি, তার জন্যে বাবার নিষেধ অগ্রাহ্য করার কোন মানে থাকতে পারে না। মাথার থেকে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেও বারে বারে ব্যর্থ হয়েছে। যতবার ভেবেছে, লোকটার কথা সে রাখবে না, স্কেচ সে করবে না; ততই যেন লোকটা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে লোকটা। এখন সে অনায়াসে লোকটার স্কেচ করতে পারবে।

এতদিন পরে কাগজ, পেন্সিল নিয়ে বসলেও, শ্যামা’র ধারনা ছিল কাজটা করতে বেশী সময় লাগবে না। বিষয়বস্তু জানা আছে, শুধু সেটাকে পেন্সিল দিয়ে কাগজে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এক সময় প্রতিদিনই হয় স্কেচ করত না হয় ছবি আঁকত। মানুষের চেহারা স্কেচ করাতে একেবারে সিদ্ধহস্ত। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের কত স্কেচ করেছে! পাশে বসিয়ে, ছবি দেখে কিংবা একেবারে কল্পনা থেকে ছবি একেছে। তার জন্যে কত বাহবা না কুড়িয়েছে! এক সময়ে ইচ্ছে ছিল আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার। সেখান থেকে গ্রাজুয়েশান করে শিল্পী হয়ে বেশ নাম ডাক কামিয়ে ফেলতে পারবে। ইন্টার পড়ার সময় থেকে বাবা তার ছবি আঁকার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। বেশ অনেকবার প্রতিবাদ করতে চেয়েছে। কিন্তু সেই কাজটা সে করেনি। বাবাকে কষ্ট দিতে মন চায় নি। তার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে কষ্ট পাওয়াটাই উত্তম।

যাই হোক, এইসব নিয়ে চিন্তা করে আর সময় নষ্ট না করে স্কেচ করার দিকে মন দিল। কি দিয়ে আরম্ভ করবে, প্রথমে মুখের আকৃতি দিবে না-কি নাক আঁকবে। দূর ছাই, ওই সব না। সবার আগে লোকটার চোখ আঁকবে। যেই চোখ দিয়ে তাকে দেখে, সেই চোখটার প্রতিকৃতি সবার আগে স্কেচে আসার দাবী রাখে। যখন যেটা মনে আসছে, তখন সেটা কাগজে আঁকছে। কিন্তু না মনের মত হচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে কাগজটা দুমড়িয়ে, মুচড়িয়ে ফেলে দিচ্ছে। তার পরে আবার নতুন করে চেষ্টা। চোখ, নাক, না কি কপাল না কী অন্য কিছু আগে আসবে? কি মুশকিল, সব গুলোতেই দেখি একই ব্যাপার ঘটছে। আঁকা আরম্ভ হচ্ছে এবং যথারীতি কাগজটা ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে মেঝেতে।

সমস্যাটা কোথায়? লোকটার চোখ, নাক, কপাল --সব কিছুর মধ্যে এত অভিব্যক্তি এলো কি করে? যা-ই শ্যামা আঁকুক না কেন, তার মনে হচ্ছে ঠিক যেন হচ্ছে না। বাস্তবে যেমন ঠিক তেমন হচ্ছে না। অবশ্য সেখানেও অসুবিধা ছিল না। কবি, লেখক কিংবা শিল্পী তাদের মাথার যা আছে, সে রকম করেই তাদের শিল্প কর্ম করে। কিন্তু শ্যামার মানসলোকে লোকটার প্রতিটা অঙ্গের যে ভাষা আছে, সেটা কোনভাবেই আসছে না। বেচারি চেষ্টা করেই চলেছে, হচ্ছে না ত হচ্ছেই না। শ্যামা’র প্রচণ্ড জোড়ে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিল। না কাজটা করলে বাড়ির সবাই ছুটে আসবে। এই দিকে সময় যাচ্ছে। যে কোন সময় রাতের খাবারের ডাক চলে আসতে পারে। সে সকালে নাস্তা করে বসেছিল। আর এখন দিন শেষ হয়ে রাত হয়ে গেল। ভাগ্যিস মা বাসায় ছিলেন না। না হলে নিশ্চয়ই ডাকতে আসতেন। তা ছাড়া এমনও হতে পারে, তিনি হয়ত ভেবেছেন শ্যামা কলেজে গেছে। যাই হোক চিন্তা, হতাশা ও চেষ্টার আপাতত অবসান হল। দরজায় টক টক শব্দ। তা মানে মা এসেছেন।

ওই দিকে আরেক প্রান্তে আরেকটা মানুষ প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে ভিন্ন একটা কাজ করতে। তার কাজ আপাতত সহজ বলেই মনে হতে পারে। সে একটা মেয়েকে কথা দিয়েছে, তাকে মানে মেয়েটার চোখ দুটো নিয়ে একটা শিল্প কর্ম তৈরি করবে। সেটা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ কিংবা কোন লেখা হলেই হবে। সুন্দরী মেয়েদের টানা টানা গভীর চোখ কত না সাহিত্য সৃষ্টির কারণ হয়ে আছে। সেই কবে আমাদের জীবানন্দ দাশ লিখে গেছেন, “পাখীর নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন...।” রবি ঠাকুর অবশ্য সবাই টেক্কা দিয়ে বলে গেছেন, “সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।”। ইংরেজি গান যারা শুনেন, তাদের কাছে এলটন জন একেবারে পরিচিত একটা নাম। তিনি সেই তার দরদী কণ্ঠে গেয়েছেন, “Baby's got blue eyes, Like a deep blue sea”। তিনি প্রিয়তমা চোখের মধ্যে পুরো একটা সু-গভীর সাগর খুঁজে পেয়েছেন।

চোখ নিয়ে শিল্প তৈরির ব্যর্থ চেষ্টায় যে লোকটা ব্যতিব্যস্ত আছে; তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। তার নাম শিবলি সাদিক। বাঙালি মানুষ। মেলা বছর ধরে প্রবাসী। ছোট বেলায় শখ করে লেখালেখি যে একটা সময়ে জীবনের সাথে মিশে যাবে, সে রকম ধারনা আগে ছিল না। বেশীর ভাগ লেখালেখি ইংরেজিতে হয়। কম হলেও, বাংলা ভাষাতেও লেখালেখি চলে। বই বের হয়েছে বেশ কিছু। ব্লগ, ফেসবুক, অনলাইনে নিয়মিত তার লেখা দেখা যায়। বেশ কিছু তার একনিষ্ঠ পাঠকগড়ে উঠেছে। তারা পড়ে, মন্তব্য করে, শুভেচ্ছা পাঠায়। তবে কিছু মেয়ে পাঠক, আরেকটু বেশী যে উৎসাহী হয়ে উঠে না; তা কিন্তু না। অবশ্য তার কাছে নজরুলের গানের একটা লাইন প্রিয়, “তুমি আমায় নহ গো, ভালোবাসো মোর গান।” তারা লেখকের ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও, বাস্তবে তারা তার শিল্প কর্মেরই ভক্ত। ব্যক্তি লেখকের জন্যে বাড়তি আগ্রহ থাকার তেমন কোন কারণ সেখানে থাকতে পারে না।

এইভাবেই চলেছে বছরের পর বছর। গুণগ্রাহী পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে। কত ভাবেই না পাঠক তাদের নিজস্ব মতামত জানিয়েছে। কখনও সরাসরি, কখনও বা ইমেল, ম্যাসেজ, বা ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে। শিবলি নিজের ঘর সংসার আছে; কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টির বেলায় সে পুরো একটা মুক্ত বিহঙ্গ। বাস্তব অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, ও কল্পনার সাথে মিশেছে তার সাবলীল উপস্থাপনা। পাঠককে নিয়ে যায় সুখ পাঠের এক অনাবিল আনন্দের ভুবনে। শিবলির ব্যক্তি জীবন ও আনন্দ ভুবন দুটো একেবারে আলাদা দুটো জগত। শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানে কোন জটিলতা নাই।

কয়েকদিন আগে ছোট একটা ঘটনা কেমন জানি সব ওলট পালট করে দিল। শিবলি ফেসবুকে ম্যাসেজ পেল, ‘হ্যালো’। এ রকম ম্যাসেজের সাথে সে খুব ভালই পরিচিত। দু চারটা এটা সেটা কথা বলার পরে, হয়ত কোন কোন গল্প নিয়ে প্রশংসা কিংবা কোন প্রশ্ন করবে। শিবলি ব্যস্ততা থাকলেও, এ ধরণের পাঠকদের খুব গুরুত্ব দেয়। যতটুকু পারে সময় দেয়, প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং লেখা পড়ার জন্যে ধন্যবাদ দেয়। এ বার অবশ্য ঘটনা অন্য দিকে গড়ালো।

মেয়েটার নাম শ্যামা। লেখক ও কবিদের নিয়ে তার প্রচণ্ড আগ্রহ। তাদের কল্পনায় যে কতকিছু তৈরি হয়ে পারে, সেটা সে বেশ ভাল করেই জানে। হিন্দি, ইংরেজি বেশ কিছু মুভি সে দেখেছে যেখানে লেখক ও তার কল্পনাকে দেখানো হয়েছে। যত এ ধরণের দেখেছে ততই আগ্রহ বেড়েছে। মনে মনে সে একজন লেখক কিংবা কবিকে খুঁজে বেরিয়েছে। ধারনা হয়েছিল, এ রকম কাউকে পেলে তাকে ভালোবাসবে। হউক না সে বিবাহিত কিংবা বয়স্ক। এই ভালোবাসা অন্য পাঁচটা ভালোবাসার মত না। বাস্তবে তাকে না পেলেও চলবে। কিন্তু সে লেখকের মনজগতের নায়িকা হবে। সেখানে সারাক্ষণ আনন্দ ভৈরবীর রাগ বাজবে। সেটাই হবে তার মিলন গাঁথা। লেখক থেকে সে শিখবে, জানবে। বিনিময়ে শর্তহীন ভাবে দূর থেকে সে ভালোবেসেই যাবে। কাছে তাকে নাই বা পেল, হাতে ছুঁয়ে নাই বা দেখল। তার পরেও সে সেখানে সে সুখ পাবে। সুখ সাগরে ডুব সাঁতার দিয়ে বেড়াবে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ও আর্জেন্টিনার মেয়ে ভিক্টোরিয়া ওক্যাম্পো সাথে প্রেম কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্কের মত। একের জীবনে অন্যের প্রভাবে পরিপূর্ণতা পাবে। কিন্তু হায়রে বোকা এখনকার দিনে এ রকম সাহসী বিশ্ব প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ আসবে কোথা থেকে?

হ্যালো দিয়ে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথা আরম্ভ হলেও আলাপ কিন্তু এগুতে থাকলো। একদিকে শ্যামার লেখকের জন্যে অপরিসীম আগ্রহ ও মমতা; অন্যদিকে লেখকের সাবধানতা যাতে তার থেকে অর্ধেক বয়সের এক তরুণী ভুল জায়গায় ভালাবাসার অর্ঘ্য ঢেলে না দেয়। তার পরেও দু জনের কথা-বার্তা চলতে থাকলো। শিবলি চাইলো এবং শ্যামা তার নিজের দুটো ছবি পাঠাল। যদিওবা এর মধ্যেই তারা ফেসবুকে এক জন আরেকজনের ছবি দেখেছে। কথা যখন চলেছে বা ছেদ পড়ে যায় নি, তা হলে কি বয়স অতিক্রম করে একজন আরেকজনকে পছন্দ করেছে। না সেটা বলা মুস্কিল। তারা কেউ এ প্রসঙ্গটা সরাসরি তুলে নি।

কিছুটা রসিকতা করার জন্যে শ্যামা তার বাম দিকের চোখের একটা ছবি পাঠাল। শিবলি চেয়ে বসলো অন্য চোখের ছবি। শ্যামার মন ভাল ছিল না সে দিন। মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। এইভাবে প্রবাসী একজনের সাথে যোগাযোগ রাখাটা কি ঠিক হচ্ছে। যদিও অন্য মানুষেরা কখনই জানবে না, একজন বয়স্ক লেখক তার মনের মধ্যে আস্তানা গেড়েছে। তবে তার ভবিষ্যৎ জীবন সঙ্গী বিষয়টা জানলে কিভাবে যে নিবে! তার থেকে বরং কষ্ট হলেও এই স্বপ্নিল উপাখ্যানের যবনিকা টানতে হবে। তার পরেও, শিবলির কাছে জানতে চাইল কি হবে দুই চোখের ছবি দিয়ে। উত্তরে লেখক জানাল, “তোমার দু চোখের ছবি পেলে বিশাল এক সাহিত্য লেখা হবে”।

দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকলেও শ্যামার মনে হল, তার চোখ নিয়ে একটা মহাকাব্য লেখা হলে খারাপ কি। সাথে সাথে শিবলিকে একটা ছবি পাঠাল যেখানে তার দু চোখই দেখা যাচ্ছে। এক মিনিটের মধ্যেই শিবলিই শর্ত জুড়ে দিল। “আমি মহাকাব্য তৈরি করবো, কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। তোমাকে আমার একটা স্কেচ এঁকে পাঠাতে হবে।” শ্যামা সাথে সাথে রাজী হয়ে গেল। তার জন্যে যে কোন মানুষের ছবি দেখে মুখের স্কেচ করা কোন ব্যাপারই না।

দু জনই পরের দিন নেমে পড়লো নিজের নিজের কাজে। একজন স্কেচ করবে এবং অন্যজন শ্যামার চোখ নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করবে।

শ্যামা পাখি কেমন যেন চঞ্চল, অস্থির হয়। এই এখানে, এই অন্য কোথাও। পাখি প্রেমিকদের ভালো লাগা শ্যামা সহজেই কেড়ে নেয়। শরীরে রঙের বৈচিত্র্য। সোনালীর সাথে নীল ও হলুদের সংমিশ্রণ। কী নিয়ে এই পাখির এমন অস্তিরতা? সিন্ধান্ত নিতে বুঝি খুব কষ্ট হয়? হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের কালি দেবীর আরেক নাম শ্যামা। আবার কৃষ্ণ বর্ণের আদরের সোহাগিনী স্ত্রীকেও শ্যামা বলা হয়। সুবিশাল যমুনা নদীর মিষ্টি নাম শ্যামা। সব চেয়ে সুন্দরী যুবতী যে মেয়ে সেও শ্যামা।

আজকের গল্পের নায়িকা শ্যামা হয়ত তার নামের সবগুলোর অর্থের সংমিশ্রণ। ফর্সা না হলেও, অদ্ভুত মিষ্টি লাবণ্য চেহারায়। ছোট বেলা থেকেই দুরন্ত। ছুটা ছুটিতে ছেলেদের থেকে এগিয়ে থাকতো। যমুনা নদীর মতই হৃদয়টা ইয়া বড়। সবার জন্যেই, সব কিছুর জন্যে সেখানে শুধু ভালোবাসা। পোষা বিড়াল একেবারে তার জানেন জান। কখন খেলো,কখন ঘুমালো জাতীয় খবরগুলো তার রাখা চাই। যতটুকু পারে বিড়ালের খাবার দেয়া, গোসল করানোর কাজগুলো নিজেই করে। ইদানীং হাতে সময় কম হওয়াতে কাজের মানুষদের সাহায্য নিচ্ছে। এই আন্তরিকতা শুধু বিড়ালের জন্যে আছে বললে বড় একটা ভুল হয়ে যাবে। অপরূপা মেয়েটার টান চেনা জানা সবার জন্যে। শুধু তাই না, বাইরের কোন করুণ ঘটনাও শ্যামাকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। রানা প্লাজা ভেঙ্গে যেবার ১৬৭ জন গার্মেন্টস শ্রমিক মারা পড়লো সেবার বেচারি ঘুমাতে পারলো না অনেক রাত। নিজে রক্ত দান করলো, বন্ধুদের নিয়ে ৩ লাখ টাকা তুলে দান করলো আহত মানুষদের চিকিৎসা জন্যে।

চঞ্চলা এই মেয়ের গুণের কোন শেষ ছিল না। তার ছবি আঁকার কথা আগেই বলেছি। পড়ালেখা শীর্ষে না থাকলেও, ক্লাসে প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে সে বরাবরই থাকে। আরেকটা ব্যাপার, জ্ঞানে ও বুদ্ধিতে সে তার বয়সের থাকে ঢের এগিয়ে। শ্যামা নামের সুন্দরী মেয়েটা বই পড়ে; প্রচুর বই পড়ে। সুযোগ পেলেই কোন না কোন বই হাতে উঠিয়ে নেয়। প্রিয় বিষয় কি জানতে চাইলে একেবারে অন্য ধরণের উত্তর পাওয়া যায়; দর্শন। উত্তর শুনলে কেউ হয়ত ঢোক গিলে, কেউবা মুখ ভেংচায়। তবে কথাটা সত্যি। প্রমাণ পাওয়া যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

এ রকম মিষ্টি চটপটে মেয়ের প্রেমে ছেলেদের টপাটপ পড়াটাই স্বাভাবিক। সেই স্কুলে ছোট ক্লাস থেকে আরম্ভ করে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ছেলে দিওয়ানা হয়েছে; তার একটা লিস্ট বানালে কিন্তু নেহায়েত ছোট হবে না। পরের প্রশ্নটা যদি হয়, শ্যামার সাথে শেষ পর্যন্ত কার সাথে প্রেম হল। উত্তরটা অনেককে অবাক করে দিতে পারে। এই পর্যন্ত কোন ছেলেই তার পছন্দ হয় নি। ছেলেদের ধারনা হয়েছিল মেয়েটা বেশী অহংকারী। এইটা নিয়ে শ্যামাকে অনেক সময়ে বিব্রতকর মন্তব্য শুনতে হয়েছে। আসলে বিষয়টা অন্যরকম। ছেলেদের বন্ধু হিসেবে নিতে তার কোন সমস্যা নাই। বরং তাদের সাথে হৈ হুল্লোড় করতে ভালই লাগে। কিন্তু বিশেষ মানুষ? না, এখন পর্যন্ত সে রকম কাউকে সে পায় নি। শ্যামার মনে যে সব দার্শনিক চিন্তা ভাবনা কাজ করে, সম বয়সীরা সেটা বুঝে না, হয়ত জানেই না। যে চিন্তা ভাবনায় সমকক্ষ না, তাকে কিভাবে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে!

দর্শন (philosophy) জ্ঞানের অন্যতম প্রাচীন একটি শাখা। ফিলোসফি শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেছিলেন গ্রিক চিন্তাবিদ ও গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে শব্দটা প্রথম ব্যবহৃত হয়। তিনিই ফিলোসফি শব্দটি ব্যবহার করেন love of wisdom তথা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ অর্থে। শ্যামা কাছে প্রজ্ঞার জন্যে অনুরাগ ও ভালোবাসা হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামি, ভারতীয়, পশ্চিমের দর্শন নিয়ে বেশ পড়াশোনা করেছে। তার এমন একজন মানুষের দরকার সে এই সব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারে। শ্যামা খোঁজে আছে, অপেক্ষায় আছে সেই রাজপুত্র যে শুধু দেখতে, শুনতেই অতুলনীয় না; জ্ঞানের ক্ষেত্রেও বিশাল।

Research শব্দটার বাংলা সবারই জানা। তবে মজার ব্যাপার হল একটা বিষয় অনেকের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেয়। ধরুন বাংলা বিভাগের একজন ছাত্র রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের উপর একটা প্রবন্ধ পড়ে এসে বলল, সে বিষয়টার উপর রিসার্চ করে এসেছে। কথাটায় কিন্তু একটা ভুল হয়ে যাবে। প্রথমে হবে search তার পরে আবার সন্ধান করলে হবে research। বাস্তবে বারে বারে কোন কিছু খোঁজাটাই হল research বা গবেষণা। চঞ্চলা শ্যামা দর্শন, সাহিত্য নিয়ে রিসার্চ মানে বারে বারে পড়তে পড়তে নিজের মধ্যে দুটো জিনিষ আবিষ্কার করলো। ক্ষমতাটা যে তার মাঝে আছে, সেটা আগে বুঝলেও ঠিক প্রকৃতি বুঝত না।

ছোট বেলা থেকেই শ্যামার সামনে কেউ কিছু গোপন করতে পারতো না। মুখ ও চেহারা দেখে বলে দিতে পারতো ভিতরের বিষয়টা কী। একবার মায়ের আলমারি থেকে পাঁচ হাজার টাকা গায়েব। সবার সন্দেহ যেয়ে পড়লো কাজের বুয়ার উপর। কারণ মায়ের জানামতে সেই একমাত্র মায়ের ঘর পরিষ্কার করতে ঢুকেছিল। সবার জেরার চোটে ও চাকরি হারানোর ভয়ে বুয়া কান্না আরম্ভ করলো। এতে সবাই ধরে নিল সন্দেহটাই ঠিক। শ্যামা বুয়ার চেহারার দিকে তাকিয়ে একবারে বলে দিল, “বুয়া কাজটা করে নি।” তার পরে পরে এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “করিম চাচা কাজটা করেছে।” বাড়ির বহুদিনের কেয়ার টেকার করিম চাচা এই কাজটা যে করতে পারে সেটা কেউ ভাবতে পারে নি। করিম চাচার তোষকের তলায় হারানো টাকা আবিষ্কার হল।

এ রকম ঘটনার উদাহরণ অনেক দেয়া যেতে পারে। কে আসল প্রেমিক, কে প্রেমের অভিনয় করছে কিংবা কে কাজ হয়ে গেলে আর চিনবে না জাতীয় ব্যাপারগুলো শ্যামা নিমিষেই ধরে ফেলত। সাধারাণত এগুলো সে নিজের মধ্যেই রাখতো। তবে মা প্রায়ই এসে বিভিন্ন মানুষের ব্যাপারে মতামত নিয়ে যেতেন। শ্যামা বইয়ের মধ্যে পেল Physiognomy নামের একটা বিষয়। এর মূল বিষয়বস্তু হল, মানুষের বাহ্যিক অবস্থা বিশেষত চেহারা দেখে তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব বিচার করা। শ্যামা বিষয়টা বইয়ে ও ইন্টারনেটে অনেক বার পড়লো, মানে research করলো। শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, যে সৃষ্টিকর্তা তার মধ্যে Physiognomy শক্তি দিয়েছেন।

প্রথম আবিষ্কারের প্রায় বছর দুয়েক পরে সে নিজের মধ্যে আরেক ধরণের ক্ষমতা আবিষ্কার করলো। নানী শ্যামাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। একেবারে বলা যায় কলিজার টুকরোর মত। তিনি থাকতেন গ্রামে। আগে দু তিন মাস পর পর আসতেন নাতনিকে দেখতে। নানী-নাতনির মেলা গল্প হত। মাঝে শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি শহরে আসা প্রায় বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু প্রায় প্রতি মাসেই ফল-মূল, খেলনা --এইটা সেইটা পাঠাতেন। শ্যামা নানীর ভালোবাসা খুবই উপভোগ করতো। হঠাৎ একদিন খবর আসলো, নানী পুকুর ঘাটে পড়ে যেয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছেন। আবার তিন দিন পরে খবর এলো নানী মারা গেছেন। শ্যামা বিশ্বাসই করতে পারলো না যে সে নানীকে আর কখনো দেখতে পারবে না।

খবরটা এসেছিল ভোর রাতে। সারাদিন ধরে সে কাঁদল। বিকালের দিকে মনে হল মাথাটা যেন কেমন হালকা হয়ে আসছে। শ্যামা অনুভব করলো সে উড়তে পারছে। উড়ে চলে গেল গ্রামের বাড়িতে। নানী তাকে নিয়ে গেলেন নদীর ধারে। একসাথে তারা অনেকক্ষণ হাটলো আর কথা বলল। শেষে নানীর থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। নিজের মধ্যে সস্থি ফিরে এলো। সে উঠে মায়ের কাছে গেল। এর পর থেকে সুযোগ পেলেই এই কাজটা করেছে। চলে গেছে মিশরের পিরামিড দেখতে কিংবা আলাস্কার বরফ ঢাকা রাজত্বে। শ্যামা শরীরকে রেখে ভ্রমণ করার নাম পেয়ে গেল। একে বলে Astral projection (or astral travel)। এই মতবাদ অনুযায়ী, কিছু মানুষের আত্মা কিংবা অবচেতন মন শরীর থেকে বের হয়ে এসে দূরে কোথাও ভ্রমণ করে আসতে পারে। শ্যামা মহা খুশী হল, তার এই অনন্য সাধারণ ক্ষমতার ব্যাখ্যা পেয়ে।

এই দুই গুণ ও তার শখের পড়ালেখার কারণে শ্যামা জ্ঞানে, বুদ্ধিতে ও চিন্তা ভাবনায় ছিল সম বয়সীদের অনেক এগিয়ে। বন্ধুদের সাথে মিশতো, দুষ্টামি করতো ঠিকই কিন্তু আলোচনায় গভীরতা খুঁজে পেত না। সম কিংবা কাছাকাছি বয়সের ছেলেদের বিশেষ সম্পর্কের প্রস্তাবে এই জন্যে তার কোন আগ্রহ হয় নি। যে দর্শন বুঝে না, Physiognomy’র ধারনা নাই, কিংবা তার সাথে Astral projection এ ভ্রমণ করতে পারবে না; তাকে সে কেমন করে সঙ্গী করে নিবে। তবে শ্যামা একেবারে কঠিনভাবে বিশ্বাস করে, একদিন তার পছন্দের মানুষ মিলবেই। সেই পুরুষ শুধু তাকেই বুঝবে না; দর্শন ও জ্ঞান নিয়ে বিস্তর কথা বলতে পারবে।

পৃথিবীর দু প্রান্তে এক জোড়া মানব-মানবির মধ্যে কথা হচ্ছে। সনাতন ভঙ্গিতে না আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে কথোপকথন হচ্ছে। সামনা সামনি বসে কথা বললে শরীরের ভাষা জানার কিংবা গলার স্বরে তারতম্য ধরা যায়। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ নাই।

হ্যালো দিয়ে আরম্ভ হলেও, কথা হচ্ছে নানা ধরণের হরেক সব বিষয়ে। হাসা-হাসি, অভিমান, জ্ঞান, ভাল লাগার কথাতো আছেই। শিবলি বয়সে বড় হওয়ার জন্যে হয়ত সুযোগটা বেশী নিচ্ছে। বোকা মেয়ে বলে প্রায়ই ক্ষেপাচ্ছে। উত্তরে শ্যামাও বলেছে, “কবি লেখকরা কল্পনা করে, বাস্তব মানুষকে চিনে না। না হলে কেন এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝে না, বয়স একটা সংখ্যা ছাড়া কিছু না। মনটা যদি নবীন থাকে, রোমান্টিক থাকে; বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আরম্ভ করতে সেটা কোন অন্তরাই হতে পারে না।”

উত্তরে লেখক মহোদয় এক গাল হেসে নিল, “আরে বোকা, যে ভাব প্রকাশ হয় নি, সেটা কি কবিতা হতে পারে? ভালোবাসা সাত আকাশের উপরেই থেকে গেলে তো আর ছোঁয়া যায় না। সেই ভালোবাসা রংধনুতে মিশে কিছু পরে হারিয়ে যায়। যার শুরু আছে, পরিণতি নাই; সে রকম কিছু উদ্ভব না হওয়াই অনেক ভাল।”

এ বারের লেখকের অবাক হওয়ার পালা। শ্যামা ক্ষণিকের মধ্যেই উত্তর দিল, “ভাবলাম লেখকের চিন্তা ভাবনা আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা। এখন দেখি সে অন্যদের থেকে ভিন্ন কিছু বুঝে না। আরে মশাই, সব কিছুর পরিণতি কি একই হয়? ভালোবাসার যতটুকু উপস্থিতি, ততটুকুতেই সে মহীয়ান।”

শিবলি যে বিষয়টা জানে না, তা কিন্তু না। পাছে না দূরের সে মিষ্টি মেয়েটা ভালোবাসার পরিণতি খুঁজতে কাছে আসতে চায়। প্রসঙ্গটা হালকা করার জন্যে বলল, “একটা গল্প বলি। এক বনে সিংহ রাজপুত্র, ক্রীড়া মন্ত্রী বানর কন্যার প্রেমে পড়ল। তাকে বিয়ে না করলেই না। না হলে সে বিষপান করে বৃন্দাবনে যেয়ে নিজের প্রাণ নিজে নিয়ে ফেলবে। সিংহ মহারাজা অনেক বুঝালেন। কিন্তু না সিংহ রাজপুত্র তার সিদ্ধান্তে অনড়। মহারাজা প্রযুক্তি অ শিক্ষা মন্ত্রী শিয়ালের সাথে শলা পরামর্শ করে পুত্রের কাছে এসে বললেন, ‘যাও বানর কন্যাকে এই কলাটা দিয়ে দেখ কি করে। সে যদি সবার সাথে ভাগ করে কলাটা খায়; তা হলে বুঝব সে পশু রাজত্বের ভবিষ্যৎ রাণীমা হওয়ার যোগ্যতা রাখে।’ কিন্তু বানর কন্যা কলা হাতে পাওয়া মাত্রই নিমিষে আস্ত কলা মুখে ঢুকিয়ে ফেলল।”

ওই পাড়ের মেয়েটা গল্পটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসল, “কি বলতে চান, আমি বানর?”

লেখক একটু ইতস্তত করে বলল, “না ঠিক সেইটা না। ভয় হয় শেষে না তুমিও না আমাকে কাছে পেতে চাও। দেখলে না বানর সুন্দরী কেমন করে ‘কি করা উচিত’ ভুলে, অন্য বানররা যা করে তাই করে ফেলল। সামান্য কলা’র জন্য রাজরাণী হওয়ার সুযোগ হারাল।”

এইবার শ্যামা রীতিমত রেগে গেল, “আপনি তো বেশ মানুষ। অদ্ভুত গল্প বলে আপনি আমাকে বানর বানাচ্ছেন। আবার বলছেন, রাজরানী হওয়ার সুযোগ হারালাম। সাহস থাকলে একবার রাজরাণী বানিয়েই দেখেন না।”

এইভাবেই দু জনের মধ্যে অম্ল মধুর কথোপকথন চলতে থাকলো। শ্যামার প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হত। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দর্শনের সুন্দর মতবাদ নিয়ে একের পর এক কথা হত। বড় একটা মিল আবিষ্কার হল। দুজনেই ১৩ শতাব্দীর দার্শনিক জালাল উদ্দিনের রুমির ভীষণ ভক্ত। তার দুটো উক্তি প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসতো, “তুমি আসলে নিজেকেই খুঁজে বেরাও” এবং “নিজেকে ক্ষুদ্র ভেবো না। তোমার ভিতরেই আনন্দের বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ঘুরছে।” ভালোবাসার মানুষের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বেশী সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে নিজেকেই সন্ধান করে। আবার কেন নিজেকে সন্ধান করে; সে সুখ চায়, আনন্দ চায়। কিন্তু সে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বুঝতে পারে, তার নিজের মধ্যেই এই আনন্দের ফোয়ারার ভাণ্ডার। যে আনন্দের ফোয়ারা চিনেছে, তার পার্থিব হাহাকার, অভাব আনন্দের ফোয়ারায় ডুবে নিঃশেষ হয়ে যায়।

ফেসবুকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শিবলির মেলা ছবি আপলোড করা ছিল। একদিন শিবলি শ্যামার থেকে একটা বেশ বড় ম্যাসেজ পেল। সেখানে শ্যামা শিবলির গোটা দশেক ছবির বিশ্লেষণ করেছে; প্রথমে ছবি দেয়া, তার পরে বৃত্তান্ত। ছবি নেয়ার সময়ে শিবলি কোন মুডে ছিল, তখন মাথার মধ্যে কী কী খেলছিল ইত্যাদির বর্ণনা। কয়েকটা ছবি আবার বেশ পুরনো; শিবলি তখনকার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি মনে করতে পারলো না। কিন্তু বাকীগুলোর বর্ণনা সাংঘাতিকভাবে মিলে গেল। ছোট বেলার এক বন্ধু ছিল বেলাল। কলেজের ফাস্ট ইয়ারে পড়ার সময়ে হঠাৎ জ্বরে মারা যায়। তাও তো আজ তিরিশ বছরের বেশী হয়ে গেল। বন্ধুর কথা মনে হলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। প্রায় বছর পাঁচেক আগে, ও রকম দিনের ছবি দেখে শ্যামা ঠিক ঠিক বলে দিল লেখকের মনের অবস্থা ও কারণ।

সব শেষে শিবলি সাদিকের সাম্প্রতিক একটা ছবি। তার নিচে লেখা, লেখক শ্যামা নামের সুন্দরী মেয়ের কথা ভাবছে। তাকে নিয়ে খুবই তার দ্বিধা। দু জনে বয়সের বিস্তর পার্থক্য। শিবলি খুব চিন্তিত মেয়েটা না আবার তার প্রেমে পড়ে যায়। পাঠিকারা যে আগে প্রেমের প্রস্তাব করে নি, তা কিন্তু না। সময়ের সাথে পাঠিকারা মোহ অতিক্রম করেছে। কিন্তু এই মেয়েটা ভারী অন্য রকম। বয়সে কম হলেও চিন্তায়, চেতনায় একেবারে অনন্যা। কিন্তু বিবেকহীন সমাজ অন্তরের ফোয়ারাকে মানে না। সে তার কিছু গৎ বাঁধা শৃঙ্খলা না মানলে নির্মম আচরণ করে। মানুষের জীবন ভেঙ্গে চুরে তছনছ করে দেয়।

মিলে গেল। একেবারে শতকরা ১০০ ভাগ। কিন্তু এইটা কি করে সম্ভব? ব্যাপারটা তার মাথায় আছে। তবে এমন না যে সে একই বিষয় সারাটা দিন ধরে চিন্তা করছে। মেয়েটা দেখি ভিতরের খবর সব জেনে ফেলেছে। অন্য ছবির বর্ণনাগুলো না মিললে, বলা যেত, ‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।’ এ যে দেখি Physiognomy’র এক উচ্চতর সংস্করণ। এত বড় শক্তি নিজের থেকে অর্জন করা সম্ভব না। এইটা অবশ্যই প্রকৃতির বিশেষ উপহার।

লেখক শিবলি সাদিক বেশ কিছু বছর আগে একটা গল্প লিখেছিল, যেখানে প্রধান চরিত্রের নিঃসঙ্গ মেয়েটা ফেসবুকে বন্ধুদের ছবি দেখে ভিতরের সব কিছু জেনে ফেলত। কিন্তু একবার সে এমন একজনের ছবি পেল, যার সে তো কিছুই বলতে পারে নি; বরং নিজেই নিজের একেবারের ভিতরের সব কথা বলতে থাকে। এই বলা থেকে সস্থি পায়। সারাদিনের ধকলে যে জীবনী শক্তি ব্যয় হয়ে, তা আবার ফিরে পায়। লেখক সাহেব জানে তার নিজের মধ্যেও প্রকৃতি প্রদত্ত Physiognomy আছে। না হলে সেই বা এ রকম গল্প লিখলো কি করে। হয়ত সব লেখকেরই কম বেশী এই ক্ষমতা থাকে। না হলে অন্য আরেকজনের ভিতরের অনুভূতি ফুটিয়ে তুলবে কি করে? তবে শ্যামা’র Physiognomy অনেক বেশী প্রবল। তারপরেও মনে হচ্ছে, কিভাবে যেন গল্পের কল্পনার চরিত্র বাস্তবে এসে ধরা দিয়েছে। শ্যামা তার ভিতরের সব কথা জানে। ভাল, মন্দ কিছুই বাকী নাই। তাও আবার সরাসরি না দেখে, শুধুমাত্র ছবি দেখে।

আলাপ হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। দু জনেই এই কবির বিশাল ভক্ত। তাকে শুধু কবি বললে কম বলা হবে। দৃষ্টির গভীরতা, মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ ও নিখুঁত বর্ণনা তাকে একজন দার্শনিক পর্যায়ে পোঁছে দিয়েছে। শিবলি একবার রসিকতা করে বলেছিল, “রবীন্দ্রনাথ একজন বিশাল Astral projection ভ্রমণকারী। তিনি শুধু প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে ভ্রমণ করেন নি; মানুষের সম্ভবত প্রতিটা পর্যায় পাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন। না হলে এত বিস্তারিত বর্ণনা তিনি দিলেন কি করে।”

শ্যামার ভীষণ ভাল লাগছিল প্রিয় কবি সম্পর্কে একজন লেখকের কাছ থেকে নতুন কিছু শুনতে। একজন লেখকই শুধু পারে আরেকজন কবি কিংবা লেখক সম্পর্কে এমন সুন্দর কিছু বলতে। শিবলি সাদিক বলে চললো, “আমি বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষের চাওয়া, না পাওয়া নিয়ে লিখি। লেখা শেষে আবিষ্কার করি, আমার আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠিক সে রকম কোন পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করে গেছেন; আমার কথায় ভ্রমণ করেছেন। তার কোন কবিতা কিংবা কোন গানে আমি তার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়ে যাই। সুযোগ পেলেই তার কোন গানের কলি ব্যবহার করি, অথবা তার বিখ্যাত কোন কথা গল্পের শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করি।”

মঝে আলাপ চারিতার একটা লম্বা ছেদ পড়লো। দু জনেরই ব্যস্ততা ছিল। হাতে পর্যাপ্ত সময় না থাকলে তারা কথোপকথন চালু করতো না। এখনেও অদ্ভুত একটা মিল। কিভাবে যেন বুঝে নিত অন্যজনের হাতে সময় আছে কি-না। এইভাবে সু সপ্তাহ গড়িয়ে গেল। অবশেষ দু জনের সময় হল ম্যাসেঞ্জারে বসার। হাই, হ্যালো বলার পর শ্যামা কিছু একটা বলবে কি-না ভাবছিল। শিবলি শ্যামাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “আমি জানি, তুমি কি বলতে চেয়েও বলতে পারছো না।”

শ্যামা অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,”অসম্ভব তুমি কোন ভাবেই জানতে পারো না, আমি কি বলতে চাচ্ছিলাম।” শিবলি এক গাল হেসে নিয়ে জানাল, “আরে বোকা মেয়ে, তুমি কি ভেবেছো, তোমার একারই Physiognomy আছে। তুমি কালকে ফেসবুকে যে নতুন ছবি দিয়েছো, তার থেকে আমি জানি তোমার ভিতরে কি কাজ করছে।”

কিছু দিন ধরে শ্যামা শিবলিকে তুমি করে বলছে। শ্যামার আর ওকে আপনি বলতে ইচ্ছা হয় নি। অন্তরঙ্গ মানুষকে কি আর তুমি বলা যায়? এবার কিছুটা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো, “বলো দেখি, আমি কি বলতে চাইছিলাম?” শিবলি মুখ খুললো, “তুমি আমাকে নিয়ে মেলা জায়গায় বেরিয়েছো। একসাথে আমরা কাশ বনে ঘুরেছি। গ্রামের হাট থেকে আমি তোমাকে দু হাত ভর্তি চুড়ি কিনে দিয়েছি। তার পরে আমরা হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের ধারে বসে স্রোতের গর্জন শুনতে শুনতে সূর্যাস্ত দেখেছি। আমরা জ্যোৎস্না ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। এভারেস্টের চুড়ায় উঠে সারা শরীরে বরফ মাখামাখি করেছি।”

এইবার শ্যামা’র অবাক হওয়ার কোন সীমা পরিসীমা থাকলো না। সে তো আসলেও গত কয়েক দিনে কাজগুলো বারে বারে করেছে। তা হলে কি আসলে সে শিবলিকে নিজের কাছে পেতে চাইছে। কিন্তু তাকে প্রথমেই সাবধান করে দিয়েছিল, অন্য পাঁচজনের মত সে যেন লেখককে কাছে পেতে না চায়। ওইদিক থেকে আবার ম্যাসেঞ্জারের টং করে শব্দ করলো, “কি ব্যাপার। চুপ কেন। আসল জিনিষটা তো বলাই হয় নি। আমরা দু জনে একসাথে কতবার না আবৃত্তি করেছিঃ

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি

শত রূপে শত বার

জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।

চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়

গাঁথিয়াছে গীতহার,

কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,

নিয়েছ সে উপহার

জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।”

এই বার শ্যামা সোহাগী কণ্ঠে জুড়ে দিল, “আমার প্রিয় অংশ ছিল কিন্তু শেষের টুকুঃ

নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ,

নিখিল প্রাণের প্রীতি,

একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে

সকল প্রেমের স্মৃতি

সকল কালের সকল কবির গীতি।”

Astral projection’ র ক্ষমতা যারটা তার কাছেই থাকে। ডানা মেলে, চলে যেতে পারে দূরে কোথাও। এইটাকে কল্পনা বলা যাবে না। কারণ এইটা হচ্ছে বিশেষ এক ধরণের ভ্রমণ। ভ্রমণকারীরা ফিরে এসে একেবারে সফরের পূর্ণাঙ্গ চিত্র দিতে পারে। বাঙালিদের মধ্যে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধরণের সব চেয়ে বড় Astral projection ভ্রমণকারী। অবশ্য এই মতামত একান্ত লেখক শিবলি সাদিকের। তবে দু পক্ষের একই সাথে Astral projection থাকা এবং একই সাথে ভ্রমণে বের হওয়ার ঘটনা আগে শোনা যায় নি। Astral projection সাথে Physiognomy যোগ হওয়াতে ব্যাপারটা আরও অনেক ধাপ আকর্ষণীয় পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেছে। এই বিচিত্র পৃথিবীতে কত-ই না আশ্চর্যের ঘটনা ঘটে!

এর পরের ঘটনা গুলো বেশ দ্রুতই হয়ে গেল। পাঠিকা ও লেখক ঠিক করলো, এইভাবে সম্পর্ক গড়াতে থাকলে বাস্তবতা দু পক্ষকে অনেক জটিলতায় ফেলবে। তাদের সম্পর্ক এখন এমন পর্যায়ে চলে এসেছে ইহজগতিক সংযোগ না রাখালেও কোন সমস্যা নাই। দুটি হৃদয় যেখানে এক, সমাজের কি সাধ্য সেটাকে বিভক্ত করার। তবে দু জনে তাদের ভালোবাসার ইহজগতিক একটা স্মৃতি রাখতে চেয়েছিল। শ্যামা বলেছিল, তার চোখ দুটো নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করতে। শিবলি বলেছিল, তার একটা স্কেচ এঁকে দিতে। না হয় নি, তারা পারে নি তাদের আদি-প্রকৃতিক (super natural) বিশাল ভালোবাসাকে ইহজগতিক মাধ্যমে ধরে রাখতে। তবে শেষ বারের মত, এক সাথে বলে প্ল্যান করে, তারা Astral projection ভ্রমনে গিয়েছিল। এক সাথে গেয়েছিলঃ

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে

আমার নামটি লিখো-- তোমার

মনের মন্দিরে।

আরও কিছু দিন পরের কথা। শিবলির ইচ্ছা হল, পুরনো কিছু স্মৃতি মিলিয়ে দেখতে। ফেসবুকে শ্যামাকে দেখতে ইচ্ছা হল, ম্যসেঞ্জারে চিঠিগুলো আবার পড়তে মন চাইল। কি আশ্চর্য ফেসবুকে শ্যামা নামের তার কোন ফ্রেন্ডই নাই এবং ছিলও না। ম্যাসেঞ্জারেও খুঁজে দেখলো। নাহ, সেখানেও শ্যামা নামের কোন অস্তিত্ব নাই। কিন্তু এইটা তো একেবারে অসম্ভব। এত কথা, বার্তা আলাপ পরিচয় সবাই কি মিথ্যা? মিথ্যা হলে, এত কিছু কি করে এক এক করে ঘটলো। তা হলে কী পুরোটাই লেখকের মনের কল্পনা প্রসূত? এইটা কি শুধুই একটা গল্পের প্লট ছিল? কিন্তু, এই ভালোবাসা তো কোনভাবেই ভুল হতে পারে না। লেখক এটা এখন বাস্তবে খুঁজে না পেলেও, মনের মন্দিরে কিন্তু ঠিকই সযত্নে রাখবেঃ আ-জী-ব-ন!

সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৬

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com

www.lekhalekhi.net