আরশিনগর

দশ মিনিটের মধ্যে মিটিং আরম্ভ হবে। আব্দুল্লা গাড়ি চালাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। এখনও বেশ কিছুটা পথ বাকী। তার পরে গাড়ি পার্ক করে বিল্ডিঙে ঢুকে লিফটে চড়ে ৫২ তালা। শেষে ক্লায়েন্টের অফিসের কনফারেন্স রুম খুঁজে বের করতে হবে। সেখানে খুবই জরুরী মিটিং। ব্যবসাটা যাতে হয় সে জন্যে লস এঞ্জেলেস থেকে এসেছে আটলান্টায়। সিএফএনের সাথে ব্যাক এন্ড সাপোর্ট নিয়ে ফাইনাল প্রেজেন্টেশান। সব হোমরা, চোমরারা থাকবে। ওদের সায় পাওয়া গেলেই কেল্লা ফ’ তে। বাইশ মিলিওন ডলারের কাজ তারা পাবে। এর সাথে তার একটা বড় অঙ্কের বোনাস আর প্রমোশনের সম্ভাবনা। এ রকম একটা মিটিঙে দেরী করে পৌঁছান খুবই লজ্জার ব্যাপার ছাড়া আর কি!

আব্দুল্লা’র ইচ্ছা ছিল, হাতে সময় নিয়ে বোর্ড রুমে ঢোকার। তাতে মিটিং শুরু হওয়ার আগে অন্যদের সাথে প্রাথমিক পরিচয় পর্বটা সেরে রাখা যায়। সাথে দু একটা হাল্কা রসিকতা। এতে সুবিধা অনেক। ব্যবসা বিক্রি করতে সুবিধা হয়। তা ছাড়া, কি কি বলতে হবে তার একটা দ্রুত রিভিশন মাথায় গুছিয়ে রাখা যায়। অনেকটা পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে আরও একবার নোট দেখে যাওয়ার মতো! এতো কিছুর জানার পরেও, আগে তো পৌঁছাতে পারছেই না, বরং দেরী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তা ছাড়া আব্দুল্লা’র নিজের কোম্পানির সিইও আজ ভোরে চলে এসেছেন। তিনিও এত বড় ব্যবসা কোন ভাবেই হাত ছাড়া হতে দিতে চান না। তিনিও আব্দুল্লা’র সাথে থাকতে উপস্থিত থাকবেন। শেষ মুহূর্তে যদি আবার কোন ছাড় দিতে হয়। এ পর্যন্ত অনেক কাঠ খড় পুড়াতে হয়েছে। অন্যদিকে সিইও উপস্থিত থাকলে, কাজটা যারা দিচ্ছে, তারাও বুঝতে পারবে আব্দুল্লাহ’র কোম্পানি কাজটা পাওয়া আর করার জন্যে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে।

এত কিছু মাথায় থাকার পরেও, আব্দুল্লা প্ল্যান মোতাবেক কাজ করতে পারছে না। আরও আগে হোটেল থেকে বের হওয়া উচিত ছিল। হাতে কফি নিয়ে বের হওয়ার সময়ে, লিফট থেকে লবির থেকে যাওয়ার পথে, ছোট একটা দুর্ঘটনা হলো। লিফট থেকে বের হয়ে হাতের ডান দিকে কফি কর্নার। আব্দুল্লা সেখানে ডিসপোসেবল কাপে কফি বানিয়ে ছুটলো মেন দরজার দিকে। সেখানে ভ্যালে পার্কিং ‘র লোকজনরা আছে। তাদের বললে, আব্দুল্লা’র রেন্টাল গাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু ফ্রন্ট রিসেপশন এলাকা পার করার সময় ঝামেলাটা হলো। ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল, গুড মর্নিং। আব্দুল্লা সুন্দরী মেয়ের মিষ্টি হাসির জবাব দিতে চলার স্পিড কমিয়ে, ব্রেক করলো মানে দাড়িয়ে পড়লো। কাপের কফি অপ্রত্যাশিত ব্রেকের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। আব্দুল্লা হাঁটা বন্ধ করাতে সেখানে তুমুল আন্দোলন সৃষ্টি হলো। কিছু কফি কাপের থেকে বের হয়ে, আব্দুল্লার কোর্ট ও শার্টে যেয়ে পড়লো।

একই সময়ে পকেটে রাখা সেল ফোনটা বেজে উঠলো। মুহূর্তেই ভুলে গেল গায়ে কফি পড়ার কথা। নিশ্চয়ই কোম্পানির সিইও ফোন করেছেন। হয়ত শেষ মুহূর্তে কোন আইডিয়া এসেছে। তড়ি ঘড়ি করে পকেট থেকে ফোন বের করতে গেলো। আর তখনই হলো বিপত্তি নম্বর দুই। কাপের বাকী কফিটুকু কোর্ট ও শার্টের বড় একটা জায়গা ভিজিয়ে চিপ চিপে করে ফেললো। মুহূর্তেই ইয়া বড় কফির দাগ পড়ে গেলো।

এ রকম কফির দাগ ওয়ালা স্যুট পরে কোন ভাবেই এতো জরুরী মিটিঙে যাওয়া যায় না। আবদুল্লা ছুটে রুমে ফিরে গেলো। সে পোশাক বদলে ফেলবে। সেখানেও ভোগান্তি কম হলো না। শার্টে ইস্ত্রি ছিল না। ইস্ত্রি করে পরে, টাইয়ের নোট বেঁধে বের হতে পাক্কা পনেরো মিনিট লেগে গেল। মিটিং পূর্ববর্তী কার্যক্রমের প্ল্যান সব ভেস্তে গেল। এখন আল্লাহ’য় আল্লাহ’য় কোন ক্রমে মিটিং আরম্ভ হওয়ার আগে পৌঁছাতে পারলেই হয়!

আবদুল্লা ঠোটে কামর দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। নিজের উপর মহা বিরক্তি লাগতে লাগলো। নিজেকে এর মধ্যে পরিচিত গালির মধ্যে চূড়ান্ত খারাপটা কয়েকবার দিয়ে ফেললো। নিজের উপর প্রচণ্ড জিদ হলো। নিজেকে মনে হত লাগলো, সে গাধার গাধা; সব চেয়ে বড় গাধা, একেবারে রাম গাধা। রিসেপশনের মেয়েটার মিষ্টি হাসিটার কথা মনে করে গা জ্বলে যেতে লাগলো। এই মেয়েদের হাসির জন্যে কত যে বড় বিপর্যয় পুরুষ সমাজের হতে পারে, সে নিজে তার একটা জ্বল জ্যান্ত প্রমাণ হয়ে রইলো। রাগে আব্দুল্লা দাঁত কিট মিট করতে থাকলো।

এমন সময়ে মোবাইল ফোন বাজতে আরম্ভ করলো। আব্দুল্লা ধরেই নিল বসের ফোন। তার কেমন প্রস্তুতি এ ব্যাপারে জানতে চাইবে। হয়ত শেষ মুহূর্তে প্রেজেন্টেশানের কোন বিশেষ টেকনিক মনে করিয়ে দিবেন। বস আব্দুল্লাকে বলে রেখেছেন, এই ব্যবসা আমাদের পেতেই হবে।

ফোনের কলার আইডি’র দিকে তাকিয়ে আরেকবার নিশ্চিত হতে চাইল; আসলেও বসের ফোন কিনা। ভাবলো বস টেকনিক বাতলানো ছাড়া আর কি বলতে পারে, কেন সে এখনও জায়গা মতো পৌঁছাতে পারে নি। এর মধ্যে হার্ট বিট, ব্লাড প্রেশার দুই বেড়ে মনে হচ্ছে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে।

তাকিয়ে দেখল, বস না —ইকবাল ফোন করছে।

বিরক্তি শেষ বাঁধটা এবার গুড়িয়ে গেল।

ইকবালের কি আর করার কোন কাজ নাই। এই ঝামেলার সময়ে কি ফোন না করলে চলে না। কাজের সময়ে কি অকারণ কথা বলতে ভালো লাগে?

একবার ইচ্ছা হলো, ইকবালকে কড়া ভাষায় কিছু বলতে।
ফোনটা কয়েকবার বেজে থেমে গেল।

প্রায় পয়ত্রিশ বছর আগের কথা। আব্দুল্লা, ইকবাল, নসু নামের তিন বন্ধু থাকতো পাহাড়ি শহর চট্টলায়। একই স্কুলে, একই ক্লাসে যেতো। দুষ্টামি, খেলাধুলা, পড়ালেখা নিয়ে শৈশবটা বেশ কেটেছিলো। ওদের মধ্যে ছিল গলায় গলায় ভাব। তেমনি ঝগড়া-ঝাটির কোন কমতি ছিল না।

বাংলা টিচার করিম স্যার ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে সবাইকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের “কপোতাক্ষ নদ” কবিতা মুখস্থ করে আসতে বললেন। এর জন্যে তিনি ফাইনাল পরীক্ষার দশ নম্বর ঠিক করে দিলেন। এ জন্যে সময় বেঁধে দিলে ঠিক দু সপ্তাহ। তার পরেও প্রতি ক্লাসে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন পরীক্ষার দশ নম্বরের কথা। তার মতে, যার এই বিখ্যাত কবিতা মুখস্ত নাই, তার বাংলা শেখা কমপ্লিট হয় নি।

তিনি ক্লাসের সবাইকে বার বার হুশিয়ারি দিলেন, কবিতা মুখস্থ বলতে না পারলে; দশের মধ্যে শূন্য দেয়া হবে, সাথে পাছায় বেতের বারি পড়বে দু খানা করে। পাছা ভর্তি ওই দাগ একেবারে পার্মানেন্ট মার্কারের মত লেগে থাকবে। ক্ষত শুকালেও, দাগ থেকে যাবে বাকি জীবন। তার পরে করিম স্যার একটা অশ্লীল সুর করে বলেছিলেন, বউ ওই দাগ দেখলে কিন্তু উত্তর দিতে পারবে না। তিনি আরও হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন, কবিতা মুখস্থ করতে না পারলে, তিনি শুধু পাছায় দাগ লাগিয়েই ক্ষান্ত হবেন না, অভিভাবকদের কাছে চিঠি পাঠাবেন। জানিয়ে দিবেন, তাদের ছেলেদের দিয়ে আর যাই হোক পড়া লেখা হবে না। চাইলে এখনই রিকশা কিনে দেয়া যেতে পারে। এদের পড়ালেখার পেছনে খরচ করে কোন লাভ নেই। বরং রিকশা চালিয়ে পরিবারের জন্যে কিছু আয় আরম্ভ করতে পারে।

খুবই অপমানের কথা, পাছায় দাগ নিয়ে রিকশা চালাতে হবে। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের সামনে মুখ দেখানো যাবে না। এইটা কোন ভাবেই হতে দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে আব্দুল্লা, নসু, ইকবাল জরুরী মিটিঙে বসলো। নসুর পরিষ্কার কথা, সে কোন ভাবেই এ রকম কঠিন কবিতা মুখস্থ করতে পারবে না। এ রকম কঠিন শব্দ দিয়ে ঠাঁসা কবিতা মুখস্থ করার চেষ্টা করতে গেলে দু একটা দাঁত পড়ে যেতে পারে।

আব্দুল্লাও সমানভাবে হতাশ। এটা কোন কথা হলো, একটা কবিতা মুখস্থ করতে না পারার কারণে ওদের রিকশা চালাতে হবে। রাগে ওর মুখ লাল হয়ে গেল। স্যার যদি জানটেন আমার বাবা কত বড় চাকরি করেন, তা হলে এ রকম কথা বলতে পারতেন না। মানুষে কি বলবে, এত বড় অফিসারের ছেলে কি না রিকশা চালায়। জীবনটা একেবারে বৃথা হয়ে যাবার জোগাড়।

তিন জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলো, যে দিন পড়া দিতে হবে তার আগের রাতে তারা একসাথে আব্দুল্লা’র বাসায় কবিতাটা মুখস্থ করবে। যতক্ষণ তিন জনের কাজটা শেষ হচ্ছে না, ততক্ষণ কেউ ঘুমাতে পারবে না। এই চোদ্দ লাইনের কবিতা মুখস্থ করে একেবারে ঠোটের মাথায় নিয়ে আসবে। স্যার জিজ্ঞাসা করা মাত্রই আবৃত্তি করে শুনিয়ে দিবে। ক্লাসের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। ফিস ফিস করবে তাদের সাফল্য নিয়ে। তা ছাড়া বন্ধু হয়ে আরেক বন্ধুর জন্য এতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে না, তা হলে আবার কিসের বন্ধুত্ব? শুধু তো এক রাতই তো জেগে থাকার বিষয়! নো প্রব্লেম !! মামলা ডিসমিস !!!

প্ল্যান মোতাবেক কাজ ভালই এগিয়ে যাচ্ছিলো। এক এক করে, তিন জনই প্রথম দু লাইন মুখস্থ করে ফেললো। “সতত হে নদ , তুমি পড় মোর মনে; সতত তোমারই কথা ভাবি এ বিরলে”। ভাবতেই পারেনি, এত সহজেই কাজটা সম্ভব হবে। তার পরে সারা রাত পড়ে রয়েছে। নসু নীলার কথা তুললো। নতুন এসেছে চট্টগ্রামে। আগে থাকত লন্ডন। এখন ওদের উপর তলায় বাড়ী ভাড়া নিয়েছে।

নসু বলতে লাগলো, মেয়েটা সব সময় ইংরেজিতে কথা বলে। খুব একটা বাংলা বলতে পারে না। জন্মের পর থেকেই বিদেশে। কিন্তু তার বাবা ঠিক করেছেন, আর বিদেশ না। তাই সপরিবারে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যেই নীলা তাকে বন্ধু হওয়ার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছে। বাকি দু জন নসুর গল্পে বিলীন হয়ে গেল। ওই বয়সে যা হয়, নসু তার কল্পনা পাখা মেলে দিয়ে নীলাকে নিয়ে কত কিছু না বলল!

গপ্ল করতে করতে কখন যে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, তা আর কারও মনে নেই। সকালে আব্দুল্লা’র মা যখন ওদের ডেকে তুললেন, তখন ওদের হুশ হলো। কবিতা মুখস্থ করার প্রজেক্ট একেবারে ফেল।
করিম স্যার ঠিকই তার কথা মত পড়া ধরা আরম্ভ করলেন। ক্লাসে কবিতাটা মুখস্থ বলতে পারল না শুধু তিন জন।

স্যার ওদের নাম দিলেন গর্দভ ত্রিরত্ন। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করলেন, এই তিন জন বড় হয়ে জীবনে কিছুই করতে পারবে না। খুব বেশি হলে রিকশা চালাবে। তিনি তার ভবিষ্যৎ বাণী পুনরাবৃত্তি করলেন, যারা চোদ্দ লাইনের কবিতা মুখস্থ করতে পারে না, তাদের দিয়ে আর যাই হোক না কেন; পড়ালেখা সম্ভব না।

ঘটনার পর থেকে ‘গর্দভ ত্রিরত্ন’ বেশ বিখ্যাত হয়ে গেল। আসে পাশে সবার কানে এই নতুন উপাধি ছড়িয়ে পড়লো। অন্যরা তাদের ওই নামে ডেকে লজ্জা দিতে চাইতো। কিন্তু রত্ন বলে কথা। তারা মানুষের হাসি ঠাট্টা গায়ে মাখতো না। অন্যদেরকে বেশ ভাব করে বলতো, চাইলেই তো আর রত্ন হওয়া যায় না। এর জন্যে দরকার প্রতিভা। সে তো আর দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। প্রতিভা নিয়ে জন্ম নিতে হয়।

“কফি হাউসের আড্ডা’ টা আর আজ নেই” র মত বয়সের সাথে, জীবনের প্রয়োজনে এক এক রত্ন একেক দিকে ছড়িয়ে পড়লো। বিশাল দেশ এমেরিকার তিন কোণায় তিন জন আস্তানা গাড়লো। তবে আগের মত এক সাথে থাকা না হলেও, যোগাযোগটা থেকে গেলো একেবারে নিয়মিত। এক জনের কাছে অন্য জনের কোন খবরই অজানা থাকত না।

ইকবালের আবাস হলো যুক্তরাষ্ট্রের সব চেয়ে দক্ষিণের মানে নীচের দিকে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে। আব্দুল্লা’র কথা আগেই বলা হয়েছে। সে থাকে একেবারে পশ্চিমে; ক্যালিফোর্নিয়ায়। আর সর্বশেষ রত্ন নসু আস্তানা গাড়লো, পূর্বের এক অঙ্গরাজ্য কানিকটিকাটে। আয়তনে বিশাল এমেরিকার পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যেতে প্লেনে করেই সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। তার মানে হল ঢাকা থেকে যাত্রা করলে, সম পরিমাণ সময়ে, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে একেবারে আফ্রিকার কাছাকাছি। তিনজনের একই দেশে বসত হলেও ভৌগলিক দূরত্ব দাঁড়ালো অনেক। কিন্তু এখানকার দিনে, বিজ্ঞানের কল্যাণে, যোগাযোগ রাখার জন্যে সময়, অর্থ ব্যয় নিয়ে ভাবতে হয় না। চাইলেই ফোনে, যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ মনভরে কথা বলা যায়। তার পরেও অনেক সময়ে কথা বলাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কাজের চাপ, সাংসারিক ঝামেলা নিয়ে আব্দুল্লা, নসু ব্যতিব্যস্ত থাকলেও; ইকবাল এখানে কোন ছাড় দিতে রাজী ছিল না।

ইকবালের সপ্তাহে কয়েকবার দুই বন্ধুর সাথে কথা বলা চাই-ই চাই। এক বার নসুর মেয়ে ইলা সিঁড়ি থেকে পড়ে যেয়ে পা ভেঙ্গে ফেললো। সাথে হলো গলায় ইনফেকশান। ইকবাল দিনে তিন বার করে ফোন করে সব খোঁজ খবর নিলো। ইলার জন্যে এক বস্তা খেলনা আর বিশাল একটা বারবী পুতুল ওভারনাইট কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিলো। শুধু তাতেই ক্ষান্ত হলো না, নিজে শেষে চলে এলো ইলাকে দেখতে।

নসু কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলেছিল, তোর এত ঝামেলা করার কি দরকার ছিল? এইগুলো তো এমন কোন অসুখ না। সময়েই ঠিক হয়ে যায়। ইকবাল গম্ভীর হয়ে বলল, তুই কি বুঝবি। আমার তোদের জন্যে বুকের মধ্যে কেমন লাগে। তোর বাচ্চা কি আমার বাচ্চা থেকে কোন ভাবে আলাদা? নসু কথা শুনে, বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল, দোস্ত তোর বুকের মধ্যে এত মায়া যে কোথা থেকে এলো।

ইকবাল শুধু নিজে আব্দুল্লা আর নসুর খবর নিয়ে শান্ত হতো না; এক জনের কাছে অন্য জনের খবর পৌঁছে দিতো। কেউ ব্যস্ততা দেখিয়ে এর থেকে সরে থাকতে পারতো না। এক বারে সব খবর দেওয়ার সময় না হলে, আবার ফোন করতো। পুরো আপডেট তাকে দিতেই হবে। শেষে ধমকের সুরে বলতো, কি রে তোরা নাকি দু সপ্তাহ হয়ে গেছে, নিজেরা ফোনে আলাপ করিস নি। শুন, কালকের মধ্যে ফোন করে তোরা কথা বলে নিবি। আমি কিন্তু ফোন করে খবর নিবো। তার পরেও যদি কথা না বলেছে, ইকবাল ত্রি-ওয়ে কনফারেন্স কলের ব্যবস্থা করে ছাড়তো।

এ রকম এক কনফারেন্স কলে, ইকবাল ঘোষণা দিলো, আমি বাংলাদেশ থেকে তিনটা রিকশা আনাচ্ছি। নাম দিচ্ছি ‘ত্রিরত্ন রিকশা এক্সপ্রেস’। মুহূর্তেই তিন জন শৈশবের স্কুল জীবনের সেই দিনটাতে ফিরে গেল। নসু সব সময়েই ফাইজলামোতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সে বলল, এখনও ওই কথা চিন্তা করলে, আমার পাছায় ব্যথা আরম্ভ হয়ে যায়। সাথে সাথেই তিন দিক থেকে হাসির রোল আরম্ভ হয়ে গেল।
আব্দুল্লা’র হাসির চোটে কাশি আরম্ভ হয়ে গেলো। কাশতে কাশতে জানতে চাইলো, পাছার বাম না ডান দিকে। নসু হাসতে হাসতে বলল, মনে হচ্ছে পাছায় বেতের বারি আমি একাই খেয়েছিলাম ওই দিক থেকে ইকবাল যোগ করলো, শিক্ষকের কথা তো, মিথ্যা হতে পারে না। তাই তো দেশের থেকে রিকশা আনাচ্ছি। তিন জনে মিলে রিকশা চালাবো —ত্রিরত্ন এক্সপ্রেস। নসু ওই দিক আবার বলল, কি রে ‘গর্দভ' শব্দটা বাদ দিলি কেন?

ইকবালের খোঁজ খবর নেয়ার বাতিক শুধু ত্রিরত্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না। শৈশব থেকে আরম্ভ করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়ার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার হাল হকিকত তার জানা চাই। কে কোথায় থাকে, কি করে, কে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে, কার বাচ্চার পড়ালেখায় কেমন ফলাফল, কে অসুস্থ — তার সব কিছু ইকবালের জানা, একেবারে নখ দর্পণে। তার পরের কাজ হলো, পরিচিতদের মধ্যে খবরগুলো বিতরণ করে দেয়া।

কারো কোন প্রয়োজন থাকলে ইকবাল তার সুরাহার সব চেষ্টাই করতো। বক্সীবাজারের পাড়ার বন্ধু বুড্ডার বাসা ভাড়ার ব্যবস্থা করলো। কিছু দিন আগে পরিচয় হয়েছিল সিদ্দিক নামে এক ভদ্রলোকের সাথে। সে তার মায়ের জন্যে একটা ভাড়া বাড়ি খুঁজছিল। চাকরির ইন্টার্ভিউয়ের আগে, পরীক্ষা হলে ঢুকার আগে, কিংবা কোন সার্জারির আগে ইকবালের কল আসবেই। কোন চিন্তা নাই, আমি দোয়া করছি।

ক্লাস ফাইভের এক বন্ধু রোমেলকে খুঁজে পেল ফেসবুক থেকে। সাথে সাথেই ইকবাল তার সাথে যোগাযোগ করলো। কথা প্রসঙ্গে সে জানালো, তার এক বন্ধুর কলিগের ছেলে টেক্সাস যাচ্ছে পড়া লেখা করতে। কিন্তু ছেলের বাবা মা খুবই চিন্তিত; ছেলে অজানা-অচেনা জায়গায় যেয়ে কি ভাবে কি করবে। ইকবাল বলল, কুছ পরওয়া নেই। সে নিজে যেয়ে ভদ্রলোকের ছেলেকে এয়ারপোর্ট থেকে নিজের বাসায় নিয়ে আসলো।

এক বার ইকবাল নসুকে ফোন করে বেশ উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগলো, জানিস উত্তমকে খুঁজে পেয়েছি। নসু অনেকটা নির্বিকারভাবে উত্তর দিল, কোন উত্তম। নসু ইকবালের এই ধরনের ফোনের সাথে ভাল করেই পরিচিত। ইকবাল মহা উৎসাহে বলতে লাগল, ওই যে কলেজে আমাদের সাথে পড়তো। পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করলো। এখন চৌদ্দগ্রাম কলেজের প্রফেসার।

ইকবালের কথা শেষ হওয়ার পরে নসু বলল, দোস্ত কিছু মনে করিস না। এই সব খবর রেখে তোর কি লাভ। তুই যেমন ব্যস্ত, আমরাও তেমন। যাদেরকে আমরা ছেড়ে এসেছি সেই কবে, তাদের অবস্থান আর অবস্থা জেনে আমাদের কি হবে?

ইকবাল বেশ রাগ করে বলল, তুই আসলেই ত্রিরত্নের সব চেয়ে বড় গর্দভ। ফুলের মালা দেখেছিস কখনো? সবগুলো ফুল একসাথে করে রাখতে দরকার হয় সুতার। না হলে একেকটা ফুল একেক দিক পড়ে যায়। সুতা ছাড়া মালাও হয় না। এত সুন্দর একটা জিনিষও তৈরি হয় না। বন্ধুরে, আমি সেই কাজটাই করে চলেছি। সবাইকে এক জায়গায় ধরে রাখার চেষ্টা করছি। না হলে তো আমরা সব ঝরে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কতগুল ফুল হয়ে যাব রে!

মিটিং শেষ করে বের হতে হতে বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ব্যবসাটা আব্দুল্লা তার কোম্পানির জন্যে নিতে পেরেছে। বেশ একটা আত্মতুষ্টি চলে এলো। এইবার প্রমোশন কেউ ঠেকাতে পারবে না। হঠাৎ মনে হলো, সারাদিন ফোনটা বাজে নি। কিন্তু এইটা বা কি করে সম্ভব? কিন্তু নিজেই যে মিটিং আরম্ভ হওয়ার ঠিক আগে আগেই ফোন বন্ধ করেছিল, সেটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল।

ফোন অন করেই দেখলো ইকবাল ভয়েস মেল রেখেছে। বেচারা জন্যে মায়াই লাগলো। সকালে কল করার জন্যে সে কি বিরক্তই না হয়েছিল। আসলে আব্দুল্লা’র জানা ছিল ইকবাল কি বলতো, দোস্ত কোন চিন্তা করিস না। আমি দোয়া করে দিয়েছি। এই কাজ তোরা পাবি। ইকবাল আসলে ভাল করেই জানতো, আব্দুল্লা কাজটা পাওয়ার ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন। ভাবল হোটেলে ফিরে সবার আগে ইকবালের ভয়েস মেল শুনবে, তার পরে ফোন করে কিছু রসিকতা করবে। কি রে, ত্রিরত্ন এক্সপ্রেসের রিকশা কবে এসে পৌঁছাবে। আমি তো রিকশা চালানোর জন্যে প্রস্তুত।

এর মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠল, নসুর ফোন। এ সময়ে নসু ফোন করে না। সাধারানত সবাই ঘুমানোর পরে নসু কল করে। এইটা সেইটা নিয়ে কথা বলে। কথা-বার্তা, হাসাহাসি চলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। আব্দুল্লাহ চিন্তিত মনে ফোনটা কানে দিয়ে বলল, কি রে নসু এই সময়ে? কি বিষয়??

নসু বলতে লাগল, খুবই খারাপ খবর পেলাম। এই মাত্র টেক্সাস থেকে খবর পেলাম, ইকবাল আর নাই। গাড়ি চালাচ্ছিলো। সিভিয়ার হার্ট এটাকে মারা গেছে। ওর মেয়েই ফোন করে খবরটা জানালো।
আব্দুল্লাহ চিৎকার করে উঠল, অসম্ভব, ও আমাকে আজকে সকালেই ফোন করেছিল। অবশ্য কথা হয় নি।

আব্দুল্লাহ হোটেলে যেয়ে বারে বারে ইকবালের ভয়েস মেল শুনতে লাগলো, দোস্ত কোন চিন্তা করিস না। আমি দোয়া করে দিয়েছি। এই ব্যবসা তোরা পাবি।

আব্দুল্লা’র দু চোখ ভিজে আসলো। যার সবার জন্যে এত ভাবনা, তার নিজের জন্যে কি কোন ভাবনা ছিল? এখনকার দিনে, এত কম বয়সে, এমেরিকার মতো উন্নত দেশে এত শত চিকিৎসা থাকার পরেও; কেও কি হার্টফেল করে মারা যায়। ব্যাটা নিশ্চয়ই নিজেকে ব্যাপারে একেবারে খামখেয়ালি ছিল ।

হয়ত এমনই হয়। যে মালা গাঁথে, সে হয়ত মালা গাঁথতে গাঁথতে, নিজের কথাই ভুলে যায়।

মালী ছাড়া যে ফুলে রং থাকে না, মালা গাঁথা বন্ধ হয়ে যায়, মালী হয়ত সেটা ভুলে বসে থাকে।

(গল্পের চরিত্র আর মূল ঘটনা বাস্তব। তবে বেশ কিছু dramatization ব্যবহার করা হয়েছে। ইকবাল মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ২০১৪ সালের ৫ই এপ্রিল পরকালে যাত্রা করে। অন্য বন্ধু নসু মাত্র কয়েকদিন আগে আগস্ট ২, ২০১৮ তারিখে না ফেরার দেশে চলে গেছে। ঘটনাগুলো আছে, চরিত্র দু জন নাই। পৃথিবীর নিয়মটাই এ রকম। প্রয়াত নসুর সম্মানে লেখাটা রিপোস্ট করলাম।)

নভেম্বর ১১, ২০১৪

কাজী হাসান
প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com