লেখকের কাব্য
বাংলাদেশে না-কি সবাই কবি! গুণতে নিলে শেষ করাটা মুশকিলের একটা কাজ হবে। লোকে বলে সংখ্যায় কৃষ্ণ বর্ণের যে পক্ষীকুল সারা দেশে ছড়িয়ে আছে তাদের থেকেও বেশি বৈ কম হবে না । বিজ্ঞ পণ্ডিতদের মতে রূপসী বাংলার সৌন্দর্য, পরিবেশ ও আবহাওয়া জনগণকে সহজেই কবি বানিয়ে ফেলে। মানুষ এমনিতেই ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়; তার পরে ভিতরের অনুভূতি ফল্গু ধারার মতো বের হয়ে আসে কবিতা হয়ে। কিন্তু ‘কবি কবি ভাব, ছন্দের অভাব’ হলেও বিশেষ কোনো সমস্যা নাই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও অন্যান্য প্রখ্যাত কবিদের সৃষ্টি থেকে ধার করে ভারী গলায় আবৃত্তি করা যেতে পারে। তাতেই শ্রোতা গদগদ হয়ে যায়। আর লেখক? উনারা গদ্য লিখেন। কবিতার তুলনায় তাদের সৃষ্টির আয়তন দীর্ঘ। ছন্দ অনুসরণের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও লেখায় পর্যাপ্ত রস না থাকলে পাঠক মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।
কবিতা মান সম্পন্ন হলে পাঠক বারে বারে পড়ে, আবৃত্তি করে, বিষয়বস্তু নিয়ে প্রচুর খোশ গল্প করে। পাঠ্য পুস্তকের গদ্য বাদ দিলে, লেখকের সৃষ্টি কর্মের সেই সৌভাগ্যে খুব কমই হয়। ‘চুল তার কবেকার…, কিংবা ‘আমাদের গেছে যে দিন…’ কবিতার খণ্ডাংশ যেমন হাজারও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে, তেমন কৃতিত্ব গদ্যের ভাগ্যে কদাচিৎ ঘটে। লেখক দীর্ঘ কিংবা নাতি দীর্ঘ যা রচনা করেন, পাঠক সাধারণত সেটা দ্বিতীয় বার পাঠে তেমন উৎসাহী হন না। তবে এমন বলছি না কিছু গল্প, উপন্যাস পাঠক একাধিকবার পড়েন না। তবে তার পরিমাণ কবিতার তুলনায় একেবারে নগণ্য। কবিতা লিখতে প্রচুর সময় লাগতে পারে, কিন্তু সেটা মহাকাব্য না হলে আয়তনে তো সংক্ষিপ্ত হয়। অন্যদিকে ইদানীং কালের অণু গল্প বাদ দিলে ছোট গল্পের শব্দ সংখ্যা কবিতা থেকে বেশি হবে বলেই ধরা যেতে পারে। কবিতা লিখতে শব্দ, ছন্দ, প্রবাহ ও ভাব প্রকাশের বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন যেখানে অল্প কথায় নিয়ে আসতে হয় তার পরিবেশনা। লেখকের অল্প কথায় প্রকাশের সীমাবদ্ধতা না থাকলেও সুষ্ঠু ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে না পারলে গদ্যের ভূপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
বন্ধুরা এখানে সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, কবিতা ও গল্পের তুলনামূলক আলোচনা করাটা আমার লক্ষ না। যারা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেন, তারা সেই যোগ্যতা রাখেন। এই অধমের পক্ষে সেই কাজটা করাটা অসম্ভব। তবে কেনো প্রসঙ্গটা আনলাম? বলছি। কতটুকু পথ চললে একজনকে পথিক বলা যায় সেটা যেমন আমার জানা নাই; ঠিক তেমন কি পরিমাণ গদ্য সৃষ্টি করলে একজনকে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়, সেটা ঠিক আমার বোধগম্য না। তবে যেহেতু আমি আজ বহুবছর ধরে টুকটাক লেখালেখি করার চেষ্টা করে চলেছি; সে জন্যে আমি ‘লেখক’ সম্মানের যোগ্য না হলেও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে লেখক বলেই জ্ঞান করে।
নিজের ব্যাপারে বলার আগে লেখকদের জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা দেই। অনেকেরই জানা একটা গল্প বলি। বেশ কিছু দিন আগেকার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে একটা লেখক সম্মেলন হচ্ছিল। তিন লেখক বন্ধু সু-উচ্চ হোটেলের ৭৫ তালায় একটা বড় রুম বুক করেছিল। তিনটা খাট থাকাতে হয়তো কিছুটা অর্থ সাশ্রয় হয়েছিল। সম্মেলন শেষ করে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। তারা হোটেলে এসে শুনল তিনটা লিফটই কাজ করছে না। কিন্তু তাদের রুমে যেতেই হবে। লিফট ঠিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা সম্ভব না। এখন একমাত্র উপায় সিঁড়ি বেয়ে উঠা। এতো আর চাট্টি খানি কথা না। ঠিক হলো, প্রথম-জন যে হাসির গল্প লিখে সে প্রথম ২৫ তলা উঠা পর্যন্ত কেউ যাতে হতাশ না হয়ে পড়ে, তার জন্যে সব মজার সব কাহিনী বলবে। পরের জন ২৬-৫০ তলা পর্যন্ত তার লেখা সব ভৌতিক গল্প এক এক করে বলবে। তৃতীয় লেখক সুযোগ পাবে ৫১-৭৫ তলা পর্যন্ত। এতে সময় ভালো কাটবে, বাকীরা কি লিখছে তার একটা ধারনাও হয়ে যাবে। যা ভাবা সেই কাজ। ২৫ তলা পর্যন্ত কিছু গল্প হাসির গল্প শুনতে তাদের একেবারে পেটে খিল পড়ার দশা। এর পরে আরম্ভ হলো ভৌতিক কাহিনী। এইগুলো শুনে তিনজনেরই ভয়ে শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে গেল। এইভাবে প্রথম দু জনের বর্ণনা শুনতে শুনতে ৫০ তলা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এইবার তৃতীয়-জনের পালা। সে গলা খুক খুক করে বলল, “আমি তো রুমের চাবি গাড়ির মধ্যে রেখে এসেছি।” বলাই বাহুল্য তৃতীয়-জন দুঃখের গল্প লিখতে পারদর্শী।
লিখছি তো সেই ছোট বেলা থেকেই। মাঝে প্রবাস জীবনে এসে দীর্ঘ দিন আর কলম ধরা হয়নি। পরে ভালোবাসার কাজটা আবার করছি। শত ব্যস্ততা থাকলেও মনে কাজ করে ইস একটু যদি বাড়তি সময় ও সুযোগ পেতাম, লেখালেখি করতে পারতাম! নিয়মিতভাবে না হলেও বাড়তি কিছু পড়তে ও লেখার চেষ্টা করি। আজকে বেশ কিছু বছর ধরে ঢাকার একুশে বই মেলায় নিয়মিতভাবে বই বের হচ্ছে। কয়জন কিনছে কিংবা কয়জন পড়ছে, সেটা বলতে পারব না। মেলায় উপস্থিত থাকতে পারি না, প্রচার পাই না। তারপরেও পাঠকরা তাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা পৌঁছে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না। তারপরে বিদেশে থেকে বাংলায় সাহিত্য চর্চা করি, সেটা হয়তো দেশের কিছু মানুষ খোলা মনে গ্রহণ করতে পারে না। সেইটা বড় কোনো ব্যাপার না। পাঠকের সংখ্যা আকাশচুম্বী না হলেও আমার প্রত্যেকের ভালোবাসা আমাকে কৃতজ্ঞ করেছে। কি যেনো কথাটা, সংখ্যার থেকে থেকে গুণগত ব্যাপারটা বেশি জরুরী। । ।
একবার এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। আমি ছিলাম ছেলে পক্ষের। মেয়ের দিককার মানুষদের সাথে তেমন পরিচয় নাই। তার পরেও আগে দেখা হয়েছিল, এমন দু-একজন মিলে গেল। কিভাবে যেনো রটে গেল আমি গল্প লিখি। কয়েকজন এসে অনেকটা নিজের থেকেই গল্পের আইডিয়া দিয়ে গেলেন। এর মধ্যে প্রায় আশি বছরের কাছাকাছি বয়সের এক ভদ্রলোক এসে আমার পাশে বসলেন। দু চারটে প্রাথমিক আলাপের পরেই তিনি নিজের তার একটা স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইলেন। আমি মহা-উৎসাহে বললাম, “অবশ্যই, অবশ্যই।” মানুষ বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের গল্পের ঝুলি বাড়তেই থাকে। তবে বেশির ভাগ সময়ে এ রকম বয়সীদের স্মৃতি শক্তি কেমন এলো মেলো হয়ে যায়। কিন্তু এই ভদ্রলোক বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও গলার স্বর ভেঙে আসলেও খুব গুছিয়েই ছোট বেলার একটা ঘটনা বর্ণনা করলেন।
বাঙালিদের ছোট বেলায় মিষ্টি সুন্দর ছোট একটা নাম থাকে। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে এই স্নেহের (অনেকে যাকে বলে’ডাক’) নাম গুলোর ব্যবহার কমতে কমতে প্রায়ই হারিয়ে যায়। পোশাকি নাম মুখ্য হয়ে যায়। অবশ্য ইদানীং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কিছু সৌখিন ব্যক্তি বাহারি নামে শেষে সেই স্নেহের নাম জুড়ে দেন। এই ভদ্রলোকের সে রকম একটা ছোটবেলার স্নেহের নাম ছিল, ‘মানিক’। কালের আবর্তনে সেটা এখন প্রায়ই হারিয়ে গেছে। আব্দুর রহিম নামেই সবাই তাকে চিনেন। যাই হোক ফিরে আসি তার ঘটনায়। তার নেশা ছিল গল্প বই পড়ার। শুধু পড়া বললে কম হবে। গল্পের চরিত্রগুলো পর্যন্ত তাকে আক্রান্ত করত। সেদিন ছিল তার ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা। সকালে মা দেখলেন উঠানে বসে মানিক হাপুস-হুপুস করে কাঁদছে। মা অধীর হয়ে জানতে চাইলেন, “বাবারে কি হয়েছে?” মানিক কান্না সামান্য কমিয়ে বলল, “দেবদাস মারা গেছে।” স্বল্প শিক্ষিত মায়ের জানা জানা ছিল না দেবদাস কে। তিনি ভাবলেন তার সন্তানের কাছের কোনো বন্ধু মারা গেছে। মা ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “বাবারে পরীক্ষা শেষ করে দেবদাসের বাসার থেকে ঘুরে আসিস। কেউ মারা গেলে তাদের পাশে দাঁড়াতে হয়।” বলাই বাহুল্য বই পোকা মানিক স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে শরৎচন্দ্রের দেবদাস বইয়ের মধ্যে বুদ হয়ে ছিল। উপন্যাসের মূল চরিত্রের করুণ মৃত্যু তাকে ভীষণ ব্যথিত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ তখন জীবিত। চারিদিকে তার গান, কবিতা ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সময়ে আরেকজন বাঙালি নিরবিছিন্নভাবে উপন্যাস লিখে অপামর পাঠক সমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছিলেন। তার নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রবীর আলোকচ্ছটা তাকে ম্লান করতে পারেনি। এক অনুষ্ঠানে তাকে কিছু ভক্ত জানতে চাইলেন, তার লেখা উপন্যাস পড়ে বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না; কিন্তু রবী ঠাকুরের লেখা বুঝতে মাঝে মধ্যেই বেগ পেতে হয়। কারণটা আসলে কি। জবাবে শরৎচন্দ্র এক গাল হেসে ব্যাখ্যা করেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেন আমার মতো মানুষের জন্য, আর আমি লিখি এমন পাঠকদের জন্য যাদের রবী ঠাকুরের লেখা ধরতে অসুবিধা হয়।” সেই শরৎচন্দ্রের অমর সৃষ্টি দেবদাস বহু বছর আগে শুধুমাত্র এক কিশোর পাঠককেই কাঁদিয়েছিল, বিশাল সংখ্যক বাঙালি পাঠককে গদ্যের রস আস্বাদন করিয়ে চলেছে। এখানে হুমায়ুন আহমেদের নাম কিন্তু বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তিনি গল্প, উপন্যাসে সার্থকভাবে বাঙালি পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন।
তারপরেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অধিকাংশ লেখকের বই পর্যাপ্ত পরিমাণে বিক্রি হচ্ছে না। সমস্যাটা কি পাঠকের না লেখকের, সেটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অর্থনৈতিক চাহিদা হয়তো বিষয়টা আরও জটিল করে দিয়েছে। কর্মব্যস্ত পাঠকের বিনামূল্যে ফেসবুকে ছবি ও পোস্ট দেখার পর খুব কমই সময় অবশিষ্ট থাকে। অন্যদিকে বইমেলায় শত শত বই প্রকাশিত হলেও সেখানে প্রকাশের যোগ্যতা বিচারেরে কোনো মানদণ্ড নাই। ফলে আগাছায় জঙ্গল ভরে যাওয়ার দশা। ভালো ঘাস খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়েছে। এক বাঙালি লেখক বলে গিয়েছিলেন, তাকে নিজের বই নিজেকে কিনতে হয়েছে। কিন্তু বই পড়ার উপকারিতা কেই অস্বীকার করেন না। প্রতিটা বই-ই নতুন এক জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সাথে সাথে কল্পনা শক্তি বাঁড়ায়, সৎ চরিত্র গঠনে দিক-নির্দেশনা দেয়া। সর্বোপরি স্মৃতিশক্তি পোক্ত করায় ভূমিকা রাখে। আমরা তো জানি বয়সের কারণে ইদানীং কালে ক্রমবর্ধমান হারে বয়স্ক মানুষ স্মৃতি-ভ্রমের সমস্যায় ভুগছেন। যাই হোক, বই পড়ার যেখানে এতো উপকারিতা সেই বই কিনতে ও পড়তে এতো অনীহা কেনো?
শেষে, একটা গল্প বলি। এক স্কুলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে কিছু বন্ধুর অনেক বছরে দেখা। কুশল বিনিময়ের পর কে এখন কি করছে সে সব নিয়ে বলাবলি আরম্ভ হলো। শেষের একজন জানালেন, তিনি একজন লেখক। মুহূর্তেই আরেকজন চাইলেন, “এই পর্যন্ত কি কিছু বিক্রি হয়েছে?” লেখক বন্ধু নিচু স্বরে উত্তর দিলেন, “তা আর বলতে, এর মধ্যে বাড়ি, গাড়ি, বেশির ভাগ আসবাবপত্র বিক্রি করতে হয়েছে……।”