মা ‘র কথা
এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা, চব্বিশ ঘণ্টা। এক দিন, দু দিন করে এক সপ্তাহ। দু সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ করে এক মাস। তার পরে দু মাস, তিন মাস করে পুরো একটা বছর পার হচ্ছে। দিনটা ছিল ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসের তিন তারিখ। এখন পুরো একটা বছর পার হয়ে গেছে। মা বিহীন জীবনের একটা বছর শেষ হল। মাকে ছাড়া কেমন ছিলাম, আছি এবং কেমন যাচ্ছে দিনগুলো?
সবার-ই জন্মের সূত্রপাত মায়ের পেটে। দশ মাস, দশ দিন পার করে পৃথিবীর আলো দেখা। মায়ের কোলে কিছুটা বড় হয়ে, হাঁটি হাঁটি করে চলতে শেখা। তার পরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা। যৌবনে এসে পড়া লেখার পার্ট শেষ করে নিজের দায়িত্ব নিজে বুঝে নেই, মানে আয়-রোজগার আরম্ভ করি। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে ছিল মায়ের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, সহযোগিতা কিংবা উপদেশ ও আশীর্বাদ। সেটা যত জটিল কিছুই হউক না কেন, তার সব সময়ে ছিল সাহসী অভিমত।
দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কারণে মায়ের সাথে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল যোজন যোজন মাইলের। তার পরেও, দুঃসময়ে তাকে বলেছি, “দোয়া করবেন”। কিভাবে যেন তিনি সন্তানের সমস্যার কথা আগেই বুঝে ফেলতেন। হয়ত এটা টেলিপ্যাথি। কেমন একটা অদ্ভুত মায়াবী আপন স্বরে বলতেন, “কয়দিন দিন ধরে তোমার কথাই বেশী মনে হচ্ছে”। বুঝতেই পারতাম, আমার প্রয়োজনের কথা তিনি আগেই ঠাওর করেছেন। সে জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে তিনি আগের থেকেই আর্জি পেশ করে চলেছেন। তিনি আমার অনুরোধের অপেক্ষা করেন নি।
সময়ে সমস্যার জাল থেকে ঠিকই বের হয়ে আসতাম। বুঝে নিতাম মায়ের দোয়ার কত প্রচণ্ডই না শক্তি। হউক না সেটা অসুখ-বিসুখ থেকে সেরে উঠা, কিংবা নতুন কোন চাকরি পাওয়ার প্রার্থনা। পৃথিবীর সব মা সন্তানকে শুধু জন্মই দেন না, তাদের জীবনের প্রত্যেকটা পর্যায়ে সাথে জড়িত থাকেন। না হলে, সেই সুদূর থেকে মা জানবেন কি করে, যে ছেলে অসুস্থ কিংবা তার নতুন একটা চাকরি পাওয়াটা ভীষণ জরুরী।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এমেরিকা থেকে ঢাকা গিয়েছি বা, মা ও পরিবারে সবার সাথে দেখা করতে। সাথে আমার দুটো বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান ছিল। মাত্র অল্প কয়েক দিনের সফর। সে জন্যে ব্যস্ততাও ছিল অনেক। মাকে মনের মত সময় দিতে পারছিলাম না। তার পরেও, পরিকল্পনা মোতাবেক সব কিছুই চলছিল। ২২ তারিখে ফেরার কথা। ২০ তারিখে এক দুর্ঘটনায় পড়লাম। ডান হাত, বাম পা ভেঙ্গে বিচ্ছিরি অবস্থা। ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হল।
ঢাকায় থাকা দীর্ঘায়িত হল। প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে কিছুদিন বসবাসে বাধ্য হলাম। তখন মা নিজেও অসুস্থ। খুব কষ্ট করে লাঠি নিয়ে হাঁটেন। উত্তরা থেকে বনানী আসতেন আমাকে দেখতে। আমি তখন আরেকজন মহামানবী আমার বড় ভাবীর তত্ত্বাবধানে। তার পরেও মায়ের চোখে দেখতাম কত না আকুলতা। আমার কষ্ট তিনি নিতে পারছিলেন না। নীরবে, অগোচরে চোখের জ্ল মুছতেন। সাথে থাকত সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ, তার সন্তান যেন খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে। আমাকে সাহস দিয়ে বলতেন, “কোন চিন্তা কর না, বাবা। তুমি কয়েক দিনের মধ্যে ভাল হয়ে যাবে”। সুস্থ আমি ঠিকই হয়েছি। বাড়তি হিসেবে পেয়েছিলাম, মাকে আরও কিছুদিন দেখার সুযোগ। বিদায়ের দিন অনেক কাঁদলেন। জানি না, তিনি জানতেন কি-না সেটাই আমাদের শেষ দেখা। তার পরে এমেরিকা থেকে ফোন করলেই বলতেন, “বাবা কি যে মায়া বাড়িয়ে দিয়ে গেলে, এখন সারাক্ষণ তোমার কথাই মনে পড়ে”।
মায়ের ভালোবাসায়, উদ্বিগ্নতায় কত না শান্তি, কত না সুখ। এই ভালোবাসা অর্জন করতে হয় না, সংরক্ষণ করতে হয় না। হয়ত এখানে ফল্গু নদীর উপমা চলে আসতে পারে। গ্রীষ্মকালে নদীটার এক বড় অংশ একেবারে শুকিয়ে যায়। কিন্তু কিছুটা বালি খুঁড়লেই ঠিকই পানি বের হয়ে আসে। এ জন্যেই এই নদীকে অন্তঃসলিলা বা মাটির নিজের প্রবাহ বলা হয়ে থাকে। ঠিক এ রকম, মায়ের ভালোবাসা সময় ও দূরত্বের ব্যবধানে নিঃশেষ হয় না। অন্তরালে বয়েই চলে। যার কোন শেষ নাই, কোন সীমানা নাই। সময় ও দূরত্ব সেখানে কোন বিষয়-ই না। এখন ভাবি, সে দিন যদি জানতাম সেটাই মায়ের সাথে শেষ দেখা, তা হলে মায়ের ভালোবাসার নদীকে একেবারে স্থির হয়ে প্রচণ্ড জোড়ে আঁকড়ে ধরে রাখতাম। যডি পিকাউল্ট নামে এক মার্কিন উপন্যাসিকের কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, “কান্নার জন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হচ্ছে মায়ের বাহু” (“The best place to cry is on a mother’s arms.” —Jodi Picoult)। কিন্তু হায়, এখন কাঁদবো কি, কান্নার জায়গায়-ই যে চলে গেছে।
আমার মায়ের গল্পের ভাণ্ডার ছিল বিশাল বড়। কাছের মানুষদের বলতেন কত না সব চমকপ্রদ ঘটনা। বলাই বাহুল্য, একই ঘটনা আমরা অনেকবার করে শুনেছি। সে রকম একটা গল্প বলি। আমার মা তখন একেবারে ছোট। হয়ত বয়স ছয়-সাত। বড় খালার (আমার মায়ের বড় বোন) তখন মাত্র বিয়ে হয়েছে। তিনি বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গেলেন। তখন তার স্বভাব ছিল, কাউকে পছন্দ না হলে, তাকে সুযোগ মত একটা চিমটি দিয়ে দেয়া। সে ব্যাপারে তার সাহসের কোন কমতি ছিল না। বড় বোনের শাশুড়ি একবার চিৎকার করে উঠলেন; কে যেন তাকে পেছন দিক দিয়ে চিমটি দিয়ে দিয়েছে।
কি অদ্ভুত, না? স্থান ও ঘটনা থেকে যায়; অন্য সব কিছু পরিবর্তিত হতে থাকে। অনেকটা মঞ্চে এক দলের নাটক করে চলে যাওয়ার মত। অন্য দল এসে পুরো মঞ্চটাকে নতুন করে সাজায়। নতুন নাটক হয়। তার পরে পরবর্তী দলের পালা। এইভাবে চলছে তো চলছেই। এখন আমরা মঞ্চে আছি। পালা শেষ হলেই বিদায় পর্ব। কিংবা ধরুন একটা ট্রেন কুউক ঝিক ঝিক করে চলছে। জংশন আসলেই কিছু যাত্রী নেমে যাচ্ছে। অন্যদের জংশন পরবর্তীতে আসবে। কিন্তু কার জংশন কখন আসবে, তা কারোর জানা নাই। আমার মা নেমে গেছেন তার জংশনে, এক এক করে আমাদের সবার-ই জংশন এসে হাজির হবে।
কিন্তু সহ যাত্রীকে ছেড়ে এগিয়ে যাওয়া যে ভীষণ কষ্টের! আমার মায়ের লাশ বহনকারী গাড়ি যখন বাড়ি ছেড়ে রওয়ানা হচ্ছিল, তখন আমার ভাতিজি তিন্নু গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল, “না, আমরা দাদীকে নিয়ে যেতে দিব না”। শুধু কথাটা বলেই সে শান্ত হল না। গাড়িতে সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাদীকে চলে দিতে কোনভাবেই সে রাজী না। তিন্নু আমার বড় ভাইয়ের বড় মেয়ে। সবার চোখের মণি। এবং পরিবারের প্রতিটা সদস্যও, তার কাছে সমানভাবে ভীষণ প্রিয়। পুরো পরিবার যা চাচ্ছিল, তিন্নু সেই কাজটাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা কে অন্যরকম! আর মানুষের ক্ষমতা কত-ই না সীমাবদ্ধ!! মুহূর্তেই শত কষ্ট ও মিষ্টি আনন্দে ভরা জীবনগুলো স্মৃতি হয়ে যায় !!!
সীমিত আয়ে বড় একটা সংসার মাকে সামাল দিতে হত। একটা সময়ে তার কিছু কাজ কর্ম হয়ত মানতে কষ্ট হয়েছে। এখন সে সব কাজের মর্মার্থ বুঝতে বেশী কষ্ট হয় না। তার লক্ষ ছিল একটাই, পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য। এ জন্যে বিরামহীন প্রয়াসের তার কোন কমতি হয় নি। ঘর বাড়ি গুছানোতে ছিল মহা আনন্দ। মৃত্যু হয়েছিল তার রাতে, আর তিনি কি না ঠিক আগের সারাটাদিন ঘর বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। হায়রে, নশ্বর মানুষের জীবন!
বর্তমান কালের হলিউডের এক বিখ্যাত নায়ক লিওনার্দো ডিকাপরিও। তিনি বলেছিলেন,”আমার মা একজন জীবিত বিস্ময়”। (“My mother is a walking miracle.” —Leonardo DiCaprio)। পৃথিবীর প্রতিটা মা-ই সংসার ও পরিবারের জন্যে নিরলস-ভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন; একেবারে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে। আমার কাছে আমার মা’ও একজন বিস্ময়। তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মনে হত, পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে আমার মা আছেন। তিনি যত দূরেই থাকুন না কেন, আমার চিন্তায় অধীর হয়ে আছেন। প্রতিটা মুহূর্তে আমার মঙ্গল কামনা করে চলেছেন।
মা আমার, প্রতিটা সন্তানকে সু-শিক্ষায় মানুষ করার পূর্ণ চেষ্টা করে গেছেন। বাকীটুকু এখন আমাদের সন্তানদের হাতে। ধর্মের বিধান, আমাদের প্রতিটা দোয়া ও ভাল কাজের নেকি তার কাছে পৌঁছে যাবে। শেষে আল্লাহ সুবহান আ তা আলা’র শিখিয়ে দেয়া দোয়া, আমি আমার ও সবার বাবা-মা’র জন্যে করছি, "রাব্বির হামহুমা কা-মা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা !...... ‘‘হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন।’’(সূরা বনি ইসরাইল- ২৪)। আমিন।
এপ্রিল ৩, ২০১৬
কাজী হাসান
প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com