পথ, পথিক ও পাথেয়
‘মিছিল’ শব্দটার সাথে বাঙালিরা খুবই পরিচিত। এক সময়ে মিছিলে মিছিলে ঢাকা উত্তপ্ত হয়ে উঠত। তারপরে আসতো পরিবর্তন। কিন্তু মিছিল শব্দটার আভিধানিক অর্থ কি? সংজ্ঞা অনুযায়ী সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলাটাই মিছিল। অভিধানে বাংলা প্রতিশব্দ দেওয়া আছে ‘শোভা যাত্রা’। আবার শোভার প্রতিশব্দ বেশ কয়েকটা: শ্রী, ঔজ্জ্বল্য; কান্তি, বাহার। তা হলে মিছিল শুধুমাত্র সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলাই না; একে হতে হবে বাহারী যাত্রা। আমরা রাজপথে যেই মিছিল দেখে অভ্যস্ত সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো আরম্ভ হয় সারিবদ্ধভাবে। গলার সুর ও ছন্দের তালে তালে কিংবা কিছু ক্ষেত্রে মৌন হয়ে এগুতে থাকে। রাজপথ প্রদক্ষিণ করতে করতে অন্যদের সমর্থন ও দাবী আদায় করাটাই মূল লক্ষ্য। কিন্তু প্রায়ই মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার জন্য হামলা হয়। মিছিল যেই শোভা নিয়ে আরম্ভ হয়েছিল, সেটা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। শুরু হয় আতঙ্ক আর চিৎকার।
গত কিছুদিন হলো আমরা একেবারে ভিন্ন ধরণের এক শোভা যাত্রা বা মিছিল প্রত্যক্ষ করছি। ইচ্ছাকৃত ও সারিবদ্ধভাবে না হলেও এক এক করে বহু মানুষ এই যাত্রায় শরিক হয়েছে। এরা কোথায় যাচ্ছে? হুমম! উত্তরটা এক কথায় দেওয়া যায়। গন্তব্য-স্থল আমাদের সবারই জানা। আমি বলছি ইহকাল থেকে পরকালে যাত্রার কথা। গত ছয় মাসে যে পরিমাণ পরিচিতজনের ওই পাড়ে যাত্রা করার খবর পেয়েছি, সেটা সম্ভবত আমাদের সবার জন্যই রেকর্ড সংখ্যক। করোনার নির্মম ছোবল এর জন্য মুখ্যত দায়ী। অবশ্য এই কুখ্যাত রোগ বাদেও অন্যান্য রোগ ও কারণে মৃত্যু হচ্ছে। বয়স যেহেতু বেড়েছে, চেনা-জানা মানুষের পরিধিও সেভাবে বেড়েছে। আবার তাদের একটা বড় অংশ বয়সের কারণে নানা ধরণের রোগে ভুগা আরম্ভ করেছেন। এই কারণে হয়তো এদের ওই পাড়ে যাওয়ার পথটা মসৃণ হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিটা মৃত্যুই কষ্টের। তারপরে এতো অল্প সময়ে এতো ব্যাপক সংখ্যক মানুষের পরকালে যাত্রা ও প্রিয়জনদের হারানোয় আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছি। আমাদের অন্তরটা ভেঙে চুরমার হচ্ছে। মাত্র কয়েক দিন আগে (আগস্ট ২৮, ২০২০) আমাদের প্রিয় দুজন বন্ধু ফারাহ হাসিন ও মোবাশ্বের মোনেমের সন্তান জায়েন শামিয়ান (Zayan Shamayeen) মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ঘুমের মধ্যেই অন্তিম যাত্রা করল। অত্যন্ত মেধাবী জায়েন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় জন হপকিন্স ফার্মেসিতে পড়া লেখা শেষ করে আরেকটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ডিউক ইউনিভার্সিটি হসপিটালে ইন্টার্নশিপ করছিল। তার ইচ্ছা ছিল দেশে যেয়ে ওষুধ ক্ষেত্রে গবেষণা করা। ক্যানাডায় থাকে সদা প্রফুল্ল সংগীত শিল্পী সিরাজী খান ও তার স্ত্রী জুবলী (Sirajee Khan and S.Akhter Jublee)। কথায় কথায় জানলাম তাদের একমাত্র পুত্র সন্তানু কয়েক বছর আগে ক্যান্সারে মারা গেছে। ভীষণ একটা সম্ভাবনা সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে গেল। বাবা মা’র সামনে সন্তানের মৃত্যু থেকে বেশী কষ্টের আর কিছু নাই। নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের থেকে ভারী কিছু আর হতে পারে না।
এতো কষ্টের বোঝা নিয়েও আমাদেরকে জীবনের বাকি সময়টুকু পার করতে হয়। পরম করুণাময় এতো শোক সহ্য করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই আমাদের দেন; না হলে এই কঠিন কাজটা আমরা হয়তো করতেই পারতাম না। প্রতিটা প্রিয়জনের মৃত্যুই আমাদের হারানোর হাহাকারের পাশাপাশি নিজের মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সবারই এই পৃথিবীতে স্থায়িত্ব একেবারেই সামান্য কিছু মুহূর্ত। কেউ আগে যাচ্ছে, কেউ বা পরে। কিন্তু একে কেউই এড়িয়ে যেতে পারবে না। তবে আমার অভিমত হলো যেই ব্যাপারটা অবশ্যম্ভাবী সেটা থেকে ভীত না হয়ে সাহসের সাথে প্রস্তুত থাকাটাই শ্রেয়। তাতে নিজের মৃত্যুর আতঙ্কটা কমবে এবং প্রিয়জনের চলে যাওয়াটা বেদনা সহ্য করাটাও সহজ হবে।
কলেজে অধ্যয়নের প্রথম দিকে John Donne’র একটা ইংরেজি কবিতা পড়েছিলাম, তার শেষের দুটো লাইন খুব মনে পড়ছে:
One short sleep past, we wake eternally
And death shall be no more; Death, thou shalt die.
ছোট একটা নিদ্রার পরে, পরকালে যেয়ে আমাদের ঘুম ভাঙবে।
তার পরে আর মৃত্যু থাকবে না, মৃত্যুর মৃত্যু হবে।
কবি John Donne’র মতো ব্যক্তিগতভাবে আমি মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে চাই। পরকালে সৃষ্টিকর্তার সাথে সাক্ষাতের জন্যে আমি উদগ্রীব হবো। কিন্তু আমার মৃত্যু যাতে আমার পরিবার আর অন্য কারোর জন্যে ভোগান্তির কারণ না হয়, সেটাই কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করি।
জন টেইলার নামে একজন বিজ্ঞ মানুষ বলেছিলেন, “আমরা আমাদের প্রিয় মানুষকে হারানোর জন্যে দুঃখ করি, তবে ওই পারের অন্যরা তাকে পাওয়ার জন্যে উল্লসিত হয়।” আমাদের প্রয়াত আপন আর প্রিয় মুখগুলো, নিশ্চয়ই পরকালের ভালো মানুষের দল ভারী করে চলেছেন। এই তো মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার, তার পরেই আমরা তাদের সাথে অনন্তকালের জন্যে মিলিত হবো। তখন তাদের হারানোর আর কোন ভয় থাকবে না।
কিন্তু তার পরেও, প্রতিটা আপন, প্রিয়, পরিচিত জনের মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে, কষ্ট দেয়, বুকটা ভেঙ্গে চুরমার করে। আমরা কাঁদি একটু স্বস্তির আশায়। আমাদের পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের ভাষায়, “এসে জড়া-জড়ি কাঁদি, কেঁদে যদি হয় সুখ।”
প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে কাজ করে চলে। যার যখন ডাক আসবে, সে তখনই এই মায়ার পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। লেখার প্রথমে মৃত্যুর মিছিলের কথা বলেছিলাম, সেটা অবশ্যই সব সময়েই চলছে। করোনা ভাইরাসের বদৌলতে সেটা এখন জোরাল। শেষে এতটুকু বলি এই মিছিলে আমরা যখনই শরীক হই না কেনো, সৎ ও সাহসী হলে অনন্তকালের যাত্রা শুভ হবে। ইতিমধ্যে আমরা সবাই জেনেছি যে মিছিল শব্দটার প্রতিশব্দ হলো ‘শোভা (শ্রী, ঔজ্জ্বল্য; কান্তি, বাহার) যাত্রা।