বাংলা রাজনীতির চর্যাপদ
ত্রান মন্ত্রী আব্দুর শুকুর চর্যাপদ। দেশের শীর্ষ মন্ত্রীদের মধ্য একজন। প্রচণ্ড দাপট নিয়ে চলেন। গত নির্বাচনে শতকরা নব্বই ভাগ ভোটে পেয়ে জিতেছেন। স্কুল জীবনে একবার বাংলা ছাড়া সব বিষয়ে তার নম্বর ছিল ৩৬ এর নীচে। বাবা রিপোর্ট কার্ড দেখে বলেছিলেন , তুই একটা চর্যাপদ। তিনি এই নাম করণের ব্যাখা না দিলেও, নামটা প্রায় সাথে সাথেই ব্যাপক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। মাস্তানি, চাঁদা , আর রাজনীতিতে নামটা খুবই কাজে দিল।
চর্যাপদ গেল বার প্রতি মন্ত্রী হলেও এবারে পুরো মন্ত্রী । প্রতি মন্ত্রী থাকা অবস্থায় দলকে আর নিজেকে শক্তিশালী করে ছিলেন। সে জন্যে দলের হাই কম্যান্ড তার উপরে মহা সন্তুষ্ট। বয়স তেত্রিশ, এর মধ্য পুরো মন্ত্রী। খারাপ না, ২০ বছরের ক্যারীয়ারে এতদূর আসতে পারাটা। সুনীল গঙ্গাপাধ্যায় বেঁচে থাকলে না হয় শুনিয়ে আসা যেত," তেত্রিশ বছর পার হয় নি, সবাই কথা রেখেছে, সব কিছু হয়েছে।” বাঙালি কবিগুলো যে কি, শুধু হতাশা আর ছ্যাক খাওয়ার কবিতা লিখে! তার জীবনে স্কুলের পরীক্ষা ছাড়া সব কিছুই আশার, সব কিছুই পাওয়ার। রাজনীতিবিদ কি সবাই হতে পারে? এর জন্যে প্রয়োজন সুবিশেষ যোগ্যতা। না হলে, দেশের মানুষজন করত না; সবাই রাজনীতিবিদ হয়ে যেত।
কিন্তু দুঃখ একটাই। এর পরে আর উপরে উঠা হবে না । প্রধান মন্ত্রী পদটা দু- পরিবারের মালিকানায়। যাই হোক চর্যাপদ অনেক ভেবে চিন্তে ত্রান মন্ত্রালয় নিলেন । নিজের আর দলের ইহকাল আর পরকাল নিয়ে যাতে আর ভাবনা না থাকে। এই কালে পুণ্য না করলে, কি আর ওই পারে আরাম করা যায়?
শীতের প্রবল ঠাণ্ডায় যে সব গরিব মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, তাদের জন্যে তিনি ফ্রান্স থেকে স্পেশাল কম্বল কিনলেন। দামটা কিছু বেশী, কিন্তু গরিব মানুষ বলে কথা। এই বিশেষ কম্বল তাদের সব সময়ের সঙ্গী হবে। শুধু ঠাণ্ডা, না, বৃষ্টি আর রোদের হাত থেকেও বাঁচাবে। মানুষ বুঝে পেল না, এক কম্বল দিয়ে এত ধরণের কাজ কি করে সম্ভব। জনগণ অধীর আগ্রহে কম্বলের অপেক্ষায় দিন গোনা আরম্ভ করল।
কিন্তু কম্বল কেনার দশ দিনের মাথায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি করে ত্রাণ মন্ত্রী আব্দুর শুকুর চর্যাপদ জানালেন, অতীব দুঃখের সাথে জানান যাচ্ছে যে, সোমালিয়ার জলদস্যুরা সব কম্বল ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। কম্বল ভর্তি জাহাজ আফ্রিকা ঘুরে আসছিল; সেখানেই এই অঘটন হয়। তিনি অনেক কষ্ট করে শুধু জাহাজ আর নাবিকদের উদ্ধার করেছেন। পত্রিকাগুলো খবর ছাপালো আব্দুস শুকুর চর্যাপদের সব কথাই ভূয়া। শীতেও রক্ষা করবে, পানিতে ভিজবে না—এমন কোন কম্বল পৃথিবীতে নাই। তিনি কম্বল নিয়ে সবাইকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছেন, আর জাহাজও ছিনতাই হয় নি। সোমালিয়ায় জাহাজ ছিনতাই বন্ধ হয়ে গেছে সেই কবে। নিশ্চিত সূত্র থেকে জানা গেল, ফ্রান্সে তার ব্যাংক একাউন্টে ৫ মিলিওন ডলার জমা পড়েছে ।
আব্দুস শুকুর চর্যাপদ ভীষণ একটা সমস্যায় পড়লেন। প্রথমে ভাবলেন পত্রিকা অফিসগুলোতে ভাংচুর আর সম্পাদকদের ধমকিয়ে বলবেন, নতুন করে খবর ছাপাতে ত্রান মন্ত্রী চর্যাপদের কম্বল, আসলেও জলদস্যুরা ছিনতাই করেছে। কিন্তু আবার মনে হল, তা ধোপে টেকার সম্ভাবনা নাই। এই দিকে টেলিভিশনের টক শো ওয়ালারাও খুব যন্ত্রণা আরম্ভ করেছে। এক জন তো বলেই বসল, ত্রাণ মন্ত্রী বাঙালিকে ভোঁদাই জ্ঞান করেছেন। সবই জনগণের টাকা মেরে দেয়ার ধান্ধা।
ফ্রান্সের একটা পত্রিকাও অনুসন্ধান করে ছাপাল, চর্যাপদের একাউন্টে ৫ মিলিওন ডলার জমা পরার বিষয়টা সত্য। দেশের পত্রিকাগুলোও কম যায় না। তারাও রসিয়ে রসিয়ে চর্যাপদের কাল্পনিক কম্বলের আলোচনা দেয়া আরম্ভ করল। সব রাগ যেয়ে পড়ল বিরোধী দলের নেতাদের উপর। সাংবাদিকদের না জানালে, পাবলিক বিষয়টা জানতে পারত না। ওরা ক্ষমতায় থাকার সময়ে কত কথা সে চেপে গেছে। গোপনে তার কাছে আসলেই, তিনি সবাইকে টু পাইস দিয়ে সন্তুষ্ট করে দিতে পারতেন । বিরোধী নেতাদের উদ্দেশে তিনি বললেন, শালা বান ….., মাদার …, নেমক হারাম আরো অনেক কিছু ।
চর্যাপদ ঠিক করলেন, ব্যাপারটা যেহেতু রাজনৈতিক, উত্তরও দিতে হবে রাজনৈতিক ভাবে। প্রয়োজনে পাঁচ মিলিয়ন থেকে এক মিলিওন খরচ করতে পিছপা হবেন না। মন্ত্রীর চাকরী থাকলে কত মিলিওন আসবে।
খবর দিলেন সাঙ্গ, পাঙ্গ আর উপদেষ্টাদের। গভীর রাত পর্যন্ত চলল তাদের বৈঠক। রাত দুটোর দিকে কিছু মানুষ টলত টলতে বাড়ি ফিরলেন। পত্রিকা আর বিরোধী দলকে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো। ত্রাণ মন্ত্রী ওই রাতের বেলাতেই হাই কমান্ড থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি জোগাড় করে ফেললেন। তিনি তো যেমন, তেমন মানুষ না। তিনি হলেন চর্যাপদ। বাংলা রাজনীতি, সাহিত্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য; তিনি হয়েছেন মহা বিখ্যাত। দেশের মানুষ তাকে এক নামেই চেনে। তিনি বাংলাদেশের ত্রাণ মন্ত্রী। জাতি ও দলের জন্যে তার অবদান এক সময়ে ইতিহাস বইয়ে স্থান পাবে।
পরিকল্পনা মোতাবেক, আগামী দুই দিন সারা শহরের চীকা,পোস্টার, মহল্লায় মহল্লায় মাইকিং আর মিছিল হবে। তৃতীয় দিন হবে পলটনের ময়দানে বিরাট জন সভা। সেখানে প্রধান অতিথী হয়ে বক্তৃতা দেবেন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় ত্রান মন্ত্রী আব্দুস শুকুর চর্যাপদ। জনসভায় একটা ঘটনা; ঘটানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হল। তার থেকে খেলা উল্টিয়ে যাবে, সব দোষ যেয়ে পরবে বিরোধী দলের উপর। আর পরিত্রান পাবেন, ত্রাণ মন্ত্রী চর্চাপদ। শুধু তিনি না, সরকারের অন্যরাও অনেকদিক থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচবে।
চর্যাপদ নিজেই কলম নিয়ে খচ খচ করে প্রয়োজনীয় সাহিত্য রচনা করে ফেললেন।
২
ত্রাণ মন্ত্রী আব্দুর শুকুর চর্যাপদ রচিত নীচের মাইকিং চলতে লাগলঃ
ভাইসব, আগামী বুধবার ৩ রা এপ্রিল ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে বিরাট জনসভা। এতে প্রধান অতিথি হয়ে বক্তৃতা করবেন, দেশের একমাত্র গরিবের প্রতিনিধি এবং ত্রান মন্ত্রী আব্দুস শুকুর চর্যাপদ। কম্বল ছিনতাইয়ের সত্য গল্প তিনি নিজের মুখে জনগনের উদ্দেশ্যে বলবেন। আপনারা দলে দলে এই জনসভায় যোগদান করে একে সাফল্যমন্ডিত করে তুলুন। আবার—ভাইসব
চীকা ও পোস্টার লিখে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তার পরেও নিজের লেখা। এরশাদ সাহেবের মত অন্যের লেখা, নিজের বলে চালাতে ইচ্ছে হল না। সারা শহরের দেয়াল তার রচনায় ভরে গেল। জনগণ দেখতে দেখতেই, তার রচিত সাহিত্য ভালবাসতে শিখবে। তিনিই বাংলা সাহিত্যেও নতুন ধারার প্রবর্তক হয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
পোস্টারে আর চীকায় লেখা হলঃ
ত্রান মন্ত্রী চর্যাপদ,
বুড়ী গংগা, মেঘনা , যমুনা যতদিন বহমান
জলদস্যুদের কম্বল চুরিতে
তোমার নাই কোন রকম অপমান
মিছিল সাহিত্য, তার কাছে, চীকা পোস্টার সাহিত্য থেকে ভাল সৃষ্টি হয়েছে বলে, বেশ আনন্দ হল। যতটুকু ছন্দে ঘাটতি আছে; মিছিলের সুরে তা সামাল হয়ে যাবেঃ
জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো
চর্যাপদের চাকরী গেলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে
কম্বল চুরি করার গল্প, বিশ্বাস করে যারা
সাম্রাজ্যবাদের পোষা বেড়াল তারা।
বক্তৃতা লিখতে বেশী ঝামেলা হল না। মুখের কথাই মাইক্রোফোনের পেছনে চিৎকার করে বলা আর কি!
নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা পরে মিটিং আরম্ভ হল। পলটনের ময়দান লোকে লোকারণ্য করা হল। প্রধান অতিথি হিসেবে চর্যাপদ সর্ব শেষে বক্তৃতা আরম্ভ করলেন ঃ
প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
-----------গত বাধা রাজনৈতিক বক্তৃতার সুচনা----------
ভাইসব, বিরোধী দল সব কিছুতে বিরোধিতা করে। বিরোধিতা করতে করতে ওদের মাথাই খারাপ হয়ে গেছে। এখন তারা আমার মত একজন নিষ্পাপ মানুষের নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। এই দেশের সবাই জানে আমার চরিত্র ফুলের মত পবিত্র। তারা আমার কথার বিশ্বাস করে না; বিরোধিতা করে বলে কিনা কম্বল ছিনতাই হয়নি । কম্বলের টাকা আমার বাংকের একাউন্টে গিয়েছে। কিন্তু এ কথা তারা জানলো কি করে। তারা কি সোমালিয়ার জলদস্যুদের দলের সদস্য? না হলে যে কথা জলদস্যুরা পর্যন্ত জানে না, সে কথা বিরোধী দলের নেতারা আর তাদের দোসর পত্রিকাগুলোই বা জানলো কি করে!
বিরোধী দল এখনো আমাকে চিনে শেষ করতে পারে নি। বাংলা রাজনীতি আর ভাষায় আমার বিশেষ অবদানের জন্য আমার উপাধি দেয়া হয় চর্যাপদ। সব নেতাদের উপাধি নামের প্রথমে থাকে, যেমন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু আমার উপাধি নামের শেষে। এইটা সাধারণ কোন ব্যাপার না। আমিই একমাত্র মন্ত্রী যে কুড়ে ঘরেও থেকেছে আর এখন থাকি গুলশানে সাত তালার উপরে। আমি নীচ আর উপর --দুই জায়গার মানুষ। আমার থেকে গরিবের বড় বন্ধু কে হতে পারে? সে জন্যই প্রধান মন্ত্রী আমাকে বিশেষ অনুরোধ করে ত্রান মন্ত্রী বানিয়েছেন।
গত ছয় বছরে যতবার বন্যা হয়েছে, শীত পড়েছে আমি ততবারই বিদেশ সফরে গিয়েছি। আপনারা তো জানেন, আমি জনগণের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। সেখান থেকে আপনাদের জন্য সাহায্য এনেছি। সেই সাহায্য যাতে দুষ্টু লোকের কাছে যেয়ে না পড়ে, সে জন্য আগের থেকেই তাদের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করেছি, সম্পর্ক তৈরি করেছি। সোমালিয়ার জলদস্যুরা এদের মতই একজন। তারা আমাকে কথা দিয়েছে, তারা রয়টারকে আজকেই ফোন করে বলবে কম্বল ছিনতাইয়ের কাজটা আসলে সত্যি। আমি না, সোমালিয়ার জলদস্যুরা কম্বল ছিনতাই করেছে।
পরিশেষ
এই পর্যায় চর্যাপদ একটা পানির বোতলে চুমুক দিলেন, মাইকের সুইচটা বন্ধ করে পাশে দাঁড়ানো সহকারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, পেট্রোল বোমাগুলো ফুটতে এত দেরী হচ্ছে কেন? বক্তৃতার জন্যে আমার লেখা পয়েন্ট তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সু কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে আব্দুর শুকুর চর্যাপদ মাইকের একটা সুইচ বন্ধ করলেও, আরেকটা মাইকের সুইচ খোলা ছিলো।
মুহুর্তের মধ্যেই যে যে দিকে পারল, সে দিকেই জান নিয়ে ছুটতে লাগলো।
আগস্ট ১১, ২০১০