রূপ নাই তার সাজন বেশী
মামলা জিনিষটা কিন্তু আমরা ভালো করে চিনি। প্রতিকার কিংবা অন্যকে হেনস্থা করার জন্যে অহরহ মুড়িমুড়কির মত মামলা হয়। সেই এক উকিল ছিল না, মানুষ দেখলেই জানতে চাইত, কেউ কি তোমার মাথায় বারি দিয়েছে, না-কি তুমি দিয়েছো? দুটোর’ ই উত্তর ‘না’ হলে পরামর্শ দিয়ে বলতেন, “ দেরি করছো কেন, যাও কারো মাথায় একটা বারি দিয়ে এসো।” উকিল মহোদয়ের উদ্দেশ্য একটাই, মাথা ফাটাফাটি করে যাতে মামলা করা হয়। মামলা মানেই ব্যবসা। আর ব্যবসা মানেই অর্থের সমাগম। মক্কেলের পকেটে দু পয়সা না গেলেও নিজের পকেটটা ঠিকই ভারী হয়।
সম্ভবত ২০১৫ সালে মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম পশুকে বিবাদী এবং একজন মানুষকে আসামী করে একটা মামলা হয়েছিল। বিষয়টা একটু ভেঙ্গে বলি। ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে ছবি তোলার সময় ব্রিটিশ নেচার ফটোগ্রাফার ডেভিড স্লেটারের ক্যামেরাতে, ম্যাকাক জাতের এক বানর নিজেই তার কয়েকটা ছবি তুলেছিল। অর্থাৎ বানরের তোলা সেলফি । এই ছবিগুলি পরে সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পায়। `পেটা` নামে বন্য প্রাণী রক্ষা বিষয়ক একটি এনজিও ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর আদালতে মামলা দায়ের করে বলে, নাতুরা নামে ছয়-বছর বয়সী ঐ বানর যেহেতু নিজেই ছবিগুলি তুলেছে, তাই এই ছবি ব্যবহার করে যত অর্থ আয় হয়েছে ও হবে, তার কপিরাইটের অর্থ বানরটির সেবা যত্নেই ব্যয় করা উচিত।
তবে আদালত ফটোগ্রাফারের পক্ষে রায় দিয়ে বলেছিল , যুক্তরাষ্ট্রের কপিরাইটের আওতায় পশু অন্তর্ভুক্ত না। ভবিষ্যতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হবে কিনা কিংবা আইন বদলানো হবে কিনা --সে রকম কোন খবর অবশ্য পাওয়া যায় নি। যাই হোক আজকে আমার লেখার বিষয়বস্তু কিন্তু ‘মামলা’ না। বরং বানরটা যেই কাজ করেছিল; সেই ‘সেলফি’ নিয়ে কিছু কথকতা।
এডউইন আলড্রিন ১৯৬৬ সালে চাঁদে যেয়ে নিজের ছবি নিজে তুলেছিলেন। তখন সেলফি শব্দটার ব্যবহার ছিল না। ছবিটা অনেক বিখ্যাত হয়েছিল এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০১২ সাল থেকে সেলফি নেয়া ও শব্দটার ব্যবহার খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সামাজিক গণমাধ্যম মাই ফেস, ফেসবুক সেলফি’র জনপ্রিয়তা তুঙ্গে নিয়ে পৌঁছায়। এখনকার দিনে ছাত্র, যুবা, রাজনৈতিক নেতাদের সেলফি কি শুধু জানলেই চলে না; তাদের সেলফি তুলাতে দক্ষতা থাকাটাও খুব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে মুহূর্তের সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। সেলফি তোলা ও প্রচার এমনভাবে বেড়েছে যে, অনেক সমাজ বিজ্ঞানী একে মানসিক ব্যাধি পর্যন্ত বলতে দ্বিধা করেন না। সেলফি নিতে যেয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে, মৃত্যু হয়েছে; এমন উদাহরণ কিন্তু নেহায়েত কম না। ভারতের মুম্বাইতে পুলিশ শহরের ১৬ টা স্থানে সেলফি নেয়া নিষিদ্ধ করেছে। সে সব জায়গাগুলোতে প্রচুর মানুষ সেলফি তুলতে যেয়ে প্রাণ পর্যন্ত হারিয়েছে।
সেলফি’র জন্যে এ রকম আগ্রহ হওয়ার কি কারণ হতে পারে। মানুষ মাত্রই নিজেকেই সব চেয়ে বেশী ভালোবাসে। সে নিজেকে দেখতে চায়, বুঝতে চায়, ভালোবাসতে চায়। গ্রুপ ফটোতে মানুষ নিজেকেই সবার আগে খুঁজে। তার পরে অন্যদের সাথে তুলনা করে। সেলফি’ কে এই মনোভাবেরই এক ধরণের বহি প্রকাশ বলা যেতে পারে। তাই সুযোগ পেলে আর সেলফি তুলতে জানলে, মানুষ নিজেকে ছবিতে হিরো বানিয়ে ফেলতে খুব বেশী দ্বিধা করে না।
সেলফিতে নিজেকে নয়ন ভরে দেখার সাথে সাথে যে ব্যাপারটা চলে আসতে পারে, সেটা হলো নিজেকে আরেকটু বেশী চেনা ও জানা। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের চিন্তাভাবনার মূলমন্ত্র-ই ছিল “নিজেকে জানো” (know thyself)। সেলফিতে আসে শুধু বাইরের দিকটার ছবি। ভিতরটা ঢাকা থেকে যায়। কিন্তু ভিতরটাই মানুষের আসল পরিচালিকা। চলুন না ভিতরটা জানা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কিছুটা ঝালাই করে নেই।
হাদিসে বলা হচ্ছে, যে নিজেকে জানে সেই মহান আল্লাহ তা আলাকে জানতে পারে। পবিত্র কোরান শরিফে আমারা বিভিন্ন জায়গায়, নিজেকে জানার গুরুত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়। সুরা আল শামস (৭৫ঃ ৯) বলা হচ্ছে, “অবশ্যই সেই সফল হয়, যে নিজেকে বিশুদ্ধ করে”। সুরা আর রাদ (১৩ঃ১১) বর্ণিত আছে, “আল্লাহ সুবহান আ তা আলা মানুষের অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের হৃদয়ে কি আছে, সেটা বদলায়”। তা হলে এটা একেবারে স্পষ্ট, আমরা যদি আমাদের উন্নতি চাই, তা হলে আমাদের ভিতরটাকে বিশুদ্ধ না করা ছাড়া কোনো উপায় নাই।
এখন একটু দেখে আসি নিজেকে জানা ও চেনা সম্পর্কে বিজ্ঞ-পণ্ডিতরা কি বলেছেন। এডাম স্মিথকে আধুনিক অর্থনীতি শাস্ত্রের জনক বলা হয়। অনেকটা তার মতবাদের উপর ভিত্তি করে বর্তমান পৃথিবীর মুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তিনি Money Game বইয়ে বলেছেন, “প্রথম যেই কাজটা করতে হবে সেটা হলো নিজেকে জানা। যে নিজেকে জানে সেই নিজের থেকে বের হয়ে এসে, নিজের কার্যক্রম পর্যবেক্ষকের মত দেখতে পারে।” বুঝলেন নিশ্চয়ই, নিজের ভালো-মন্দ বিচার করতে চাইলে, প্রথমে নিজেকে জানা ছাড়া কোনো উপায় নাই।
এইবার বলি পিথাগোরাসের কথা। অংক ও জ্যামিতি শাস্ত্রবিদ পিথাগোরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০ সালে গ্রিসে জন্মগ্রহণ করেন। তার অংক-জ্যামিতি’র বিভিন্ন তত্ত্ব এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, “নিজের রাজত্বকে খুঁজে না পেলে মুক্তি পাওয়া যায় না। নিজেকে শাসন করতে না পারলে কেউ মুক্ত হতে পারে না। (“No one is free who has not obtained the empire of himself. No man is free who cannot command himself.” ― Pythagoras) । আমরা স্বাধীন দেশে মুক্ত চিন্তা নিয়ে খুব হৈ চৈ করি। কিন্তু আমরা কি আসলে নিজেকে শাসন করতে জানি? না-কি অন্যকে দমিয়ে রাখার মধ্যেই আত্মতুষ্টি!
আসুন এবার একটা প্রচলিত প্রবাদ নিয়ে কিছু কথা বলি। প্রবাদটা হল:
খালি কলসি বাজে বেশী,
ভরা কলসি বাজে না।
রূপ নাই তার সাজন বেশী,
রূপের মাইয়া সাজে না।
ভিতরে যার জ্ঞানের বহর সামান্য কিংবা শূন্য, তার কিন্তু আবার নিজেকে জাহির করার বাতিক অনেক বেশী। অনেকটা অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী হওয়ার দশা। সে অকারণ তুষ্টিতে ভুগে, ভাবে তার ভিতরটা পরিপূর্ণ। সেখান থেকেই সব সমস্যার উৎপত্তি। নিজের সব কাজকে সঠিক বলে প্রমাণ করার সীমাহীন প্রয়াস চালায়। এতে শুধু অন্যের না নিজেরও ক্ষতি হতে থাকে। একজন প্রখ্যাত লেখিকা ও উদ্দীপনা মূলক বক্তা ভিরোনিকা টুগালেভারের বলেছেন, “নিজেকে জানতে হলে, তোমাকে নিজেকে ইতিমধ্যে চিনে ফেলেছে, অবশ্যই এই মিথ্যা অহমিকা ছাড়তে হবে” (“To know yourself, you must first sacrifice the illusion that already you do.” ― Vironika Tugaleva)।
ভারতীয় পণ্ডিত, রামানা মহারিশি বলেছেন, নিজেকে চেনার চেষ্টা করাটাই হবে পৃথিবীতে সব চেয়ে বড় অবদান রাখতে পারা। (“Your own Self-Realization is the greatest service you can render the world.”― Ramana Maharshi) । নিজেকে চেনার মধ্যেই সৎ হয়ে পৃথিবীতে নিজের অবস্থানকে অর্থপূর্ণ করা যায়। নিজেকে চিনেই বিবেকের নির্দেশনা অনুযায়ী ভাল কাজগুলো করা যায়। একজন মানুষের বিবেক কোন অবস্থাতেই অন্যায় কাজে সায় দেয় না।
এতক্ষণ-তো নিজেকে জানা ও চেনা নিয়ে বেশ কিছু কথা হলো। যদিও বিশাল বড় বিষয়, তার পরে আসুন না প্রশ্ন করি, নিজেকে জানতে হলে কি করাটা বাঞ্ছনীয়? মানুষের ভিতরে আছে বিবেক ও আত্মা। বিবেক নির্ভুলভাবে ন্যায় ও সত্যের সংজ্ঞা দিয়ে থাকে। আত্মাকে ধরা যায় সেই ন্যায় ও সত্য কার্যকর করার ক্ষমতা। তা হলে আবার প্রশ্ন হতে পারে, আমাদের ভিতরের ও বাহিরের কার্যক্রমের এত বিস্তর পার্থক্য কেনো? সারাই বিশ্বেই বা এতো অন্যায়ের ছড়াছড়ি কেনো? কারণ সম্ভবত দুটো হতে পারে, এক মানুষ ‘নিজেকে’ মানে বিবেক ও আত্মাকে অস্বীকার করছে। দুই, বাইরের চাকচিক্য, লোভ, স্বার্থপরতা আমাদের ভিতরটাকে কলুষিত করছে।
পরের প্রশ্ন হতে পারে, এই কলুষিত হওয়াটা কি বন্ধ বা কমানো সম্ভব? অবশ্যই সেটা করা যেতে পএরে নিজের বিবেক ও আত্মাকে শক্তিশালী করে। সে জন্যে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ভিতরটাকে আলোকিত করাটা দরকার। প্রক্রিয়াটা পরিপূর্ণ করতে একটা জীবন কালের সময় হয়তো যথেষ্ট না। তবে কোনো ভাবেই হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। চেষ্টা অবশ্যই চালিয়ে যেতে যাবে। বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী পশ্চিমা বিশ্বে ধারনা করা হয়, মৃত্যুর সাথে সাথে সচেতনতা বা বিবেক ও আত্মার পরিসমাপ্তি হয়। কিন্তু প্রাচ্যের ধারনা ভিন্ন। আত্মা-ই হলো একজন প্রকৃত “ব্যক্তি”। বাহ্যিক শরীর ও কার্যক্রম তার রূপ মাত্র। আত্মা কাল ও সময় অতিক্রমকারী এবং অসীম। আত্মার গভীরতা মানুষকে প্রকৃতির সাথে একাত্ম করে। সেইটাই সৌন্দর্য, সেইটাই সত্য। সেই সৌন্দর্য ও সত্য থেকেই প্রকৃতির সাথে বিলীন হওয়া যায়। সৃষ্টি কর্তার নৈকট্য অর্জন করা যায়।
আবার ফিরে আসি সেই বানর মহোদয়ের কর্মকাণ্ডে। বেচারার সেলফি তুলে নিজেকে দেখতে খায়েশ হয়েছিল, নিজের ভিতরের গভীরতা মাপতে ইচ্ছে করেছিল। বেচারার ব্যবহারের জন্য তো মানুষের মত আয়না নাই কিংবা সেলফি তোলার এত সহজ সুযোগ নাই। তাই হাতের কাছে মানুষের ক্যামেরা পেয়ে, সে সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চায়নি। না -কি আপনারা অন্য কিছু বলবেন?
যাই হোক, পরের বার আমরা যখন সেলফি তুলবো কিংবা নিজের সেলফি ছবি দেখবো, তখন না হয় চট করে নিজেদের ভিতরের গভীরতা মেপে নিয়ে নিজেকে জানার চেষ্টা করি। সেই সাথে সাথে প্রকৃতির সাথে নিজেদের সংযুক্ত করার এবং সৃষ্টিকর্তার নৈকট্যে পাওয়ার সঠিক কাজটা করি।