বরফের বাসর এবং লাল রুমাল
সময়: রাত এগারটা।
সন: ১৯১২ সাল ১৪ এপ্রিল
স্থান: আটলান্টিক মহাসাগর
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একেবারে পরিষ্কার আকাশ, কিন্তু চাঁদ নাই। চারি দিকে কেমন একটা নিস্তব্ধতা।
৮৮২ ১/২ ফুট লম্বা অতিকায় এক জাহাজ এগিয়ে চলেছে। তার প্রস্থ ৯২ ১/২ ফুট, উচ্চতা ১৭৫ ফুট। এত বড় জাহাজ, এর আগে পৃথিবীতে তৈরি হয় নি।
জাহাজটার নাম টাইটানিক। নির্মাতারা বুক ফুলিয়ে ঘোষণা দিয়েছে, এই জাহাজ কখনো ডুববে না। এপ্রিলের দশ তারিখ সকাল বেলা ৯১৪ জন যাত্রী নিয়ে বন্দর ছেড়েছে। তার পরে ফ্রান্স আর আয়ারল্যান্ড হয়ে যখন নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল, তখন যাত্রী, কর্মচারী সংখ্যা মিলিয়ে ২২০০ ছাড়িয়ে গেল।
প্রথম দু দিন নির্বিঘ্নে গেল। বিলাস বহুল জাহাজে বিলাসিতা আর সময় কাটানোর অনেক ধরণের ব্যবস্থা ছিল। যারা কম দামের টিকেট কিনেছে, তাদের জন্যে আরাম আয়েসের বেশী ব্যবস্থা না থাকলেও, তারাও গল্প গুজব আর তাস খেলে বেশ আছে। জাহাজের কর্মচারীরা জাহাজ পরিচালনা আর যাত্রীদের তদারকি নিয়ে মহা ব্যস্ত।
১৪ এপ্রিলের সকাল বেলা আশে পাশের অন্য জাহাজগুলো টাইটানিককে সাবধান করে অনেক গুলো তার বার্তা পাঠাল। সামনে বরফ, বিশাল বড় বড় বরফ খণ্ড; যা যে কোন জাহাজকে ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে পারে। টাইটানিকের এই পথ দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু ব্রিজে ( জাহাজ যেখান থেকে পরিচালনা করা হয়), সেখানে এই খবরটা পৌঁছাল না।
ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথ রাত ৯.২০ মিনিটে তার নিজের কামরায় বিশ্রামের জন্যে চলে গেলেন। সামনে যে সমূহ বিপদ, তা তিনি ঘুণাক্ষরে আন্দাজ করতে পারলেন না। জাহাজের কর্মচারী, যাদের কাজ ছিল জাহাজের গতি পথের দিকের তাকিয়ে থাকা, তারাও খালি চোখে, অন্ধকারের জন্যে দূরের কিছু দেখতে পারল না। জাহাজ পূর্ণ গতিতে চলতে থাকল।
রাত এগারটা চল্লিশ মিনিটে ফাস্ট অফিসার মারডাকের কাছে খবর আসল জাহাজ বরফ আঘাত করতে চলেছে। তিনি সাথে সাথে জাহাজ বাম দিকে ঘুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। ক্যাপ্টেন স্মিথ তার কামরা থেকেই বুঝলেন বড় ধরণের কোন সমস্যা হয়েছে।
২
ছগির অনেকক্ষণ ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। এ পাশ ওপাশ করছে, কিন্তু চোখ দুটো লাগানো যাচ্ছে না। এক করে করে কত না মানুষ, কত না ঘটনা ভেসে আসছে। সে কোথাকার মানুষ কোথায় যাচ্ছে। সেখানেই বা তার জন্যে কি অপেক্ষা করছে। কেমন একটা তন্দ্রার মত হল।
তুমুল একটা শব্দ আর ঝাঁকিতে ছগির বিছানা থেকে মেঝেতে যেয়ে পড়ল। তন্দ্রার ভাবটা মুহূর্তেই চলে গেল। প্রথমে বুঝতেই পারল না, কিসের শব্দ সে শুনল। এ রকম ঝাঁকি হবার কারণ কি হতে পারে। তার পরে কেমন একটা দোলা চলতে লাগল। প্রথমে মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে। বড় একটা ধাক্কা, তার পরে কেমন যেন কাঁপতে লাগল।
ছগির বিছানায় যেয়ে আবার শুলো। নিজের উপর কিছুটা বিরক্ত হল। এত বয়স হয়ে গেল, বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ার অভ্যাসটা গেল না। তাকে নিয়ে কত না হাসা হাসি হত। কেউ বলত ছগির স্বপ্ন দেখে ভয় পায়, তার পরে ভয়ে সরতে সরতে বিছানার থেকে নীচে যেয়ে পড়ে। অবশ্য গ্রামের বয়স্কা মহিলাদের ধারণা ছিল, ছগির দেখতে শুনতে ভাল, তাই পরীরা তাকে নিতে আসে। কিন্তু ছগির রাজী না হওয়ায়, তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছগিরের নিজের অবস্থান মনে পড়ল। সে তো এই মুহূর্তে সিলেট বিয়ানীবাজারের “তরঙ্গ” গ্রামে নাই। সে পৃথিবীর সব চেয়ে বড় জাহাজ টাইটানিকে করে এমেরিকা যাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক শহরে। সেখানে মেলা চাকরি। তার থেকে কিছু দূরে ক্যালিফোর্নিয়ায়, মাটি খুঁড়লেই সোনা পাওয়া যায়। পৃথিবীর সব জায়গা থেকে মানুষ ছুটে চলেছে সেখানে।
৩
৬২ বছরের ক্যাপ্টেন স্মিথের জাহাজ চালানোর ব্যাপক অভিজ্ঞতা। আসলে তার থেকে দক্ষ মানুষ আর কেও ছিল না বলে, তাকেই সব চেয়ে বড় জাহাজের দায়িত্ব দেয়া হল। আধুনিক প্রযুক্তি আর ক্ষমতা সম্পর্কে ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। কিছু দিন আগে এক সাক্ষাতকারে গর্ব করে বলেছিলেন, পানিতে জাহাজ ডুবার দিন শেষ হয়ে গেছে। পৃথিবী এখন অনেক এগিয়ে গেছে।
টাইটানিকে মোট ৩৫৪৭ মানুষের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু প্রথম যাত্রায় টাইটানিক তার অর্ধেকের কিছু বেশী যাত্রী নিয়ে যাত্রা করল। কিছুদিন আগে কয়লা শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে সব কিছু কেমন উল্টা পাল্টা হয়ে গেল। যেমন যাত্রী হওয়ার কথা, তেমন হল না। কিন্তু তার পরেও জাহাজ কোম্পানি টাইটানিকের যাত্রার দিন পিছাতে রাজি হল না।
সেই সময়কার পৃথিবীর সব চেয়ে বড় জাহাজটাকে চলতে ৬০০ টন কয়লার দরকার ছিল। ইঞ্জিনের উচ্চতাই ছিল ৪০ ফুট। ১৭৬ জন শ্রমিকের কাজ ছিল সারাক্ষণ কোদাল দিয়ে কয়লা ভরা। প্রায় ১০০ টন ছাই প্রতি দিন সমুদ্রে ফেলতে হত। প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় শ্রেণী ছিল জাহাজের। আরাম আর বিলাসিতার কোন কমতি ছিল না। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের আয়েশ আর ব্যবহারের জন্যে নেয়া হয়ে ছিল ২০,০০০ বোতল বিয়ার, ১৫০০ বোতল ওয়াইন। জাহাজে ছিল সুইমিং পুল, স্কোয়াশ খেলার কোর্ট। প্রথম শ্রেণীর টিকেটের দাম এখনকার দিনের মূল্যে এক এক লক্ষ ডলারে উপরে। আর তৃতীয় শ্রেণীর টিকেটের দামটা না হয় একটু পরেই বলি।
টাইটানিক যখন বন্দর থেকে যাত্রা করল, তখন জাহাজটাকে দেখতে আর বিদায় জানাতে ১০০,০০০ এর বেশী মানুষ জড় হল। কারোর চোখ এত বড় যন্ত্র দানব দেখার উত্তেজনায় ছিল বড় বড়; আর কারোর বা চোখ ছিল প্রিয় জনকে বিদায় জানানোর কষ্টে ছল ছল।
এদের মধ্যে এক জোড়া চোখ উদাসীন দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। স্বপ্ন আর বেদনা মেশান দৃষ্টিটা, কেমন যেন একটা অদ্ভুতভাবে জাহাজ ছাড়িয়ে দিগন্তে বিলীন হচ্ছিল। টাইটানিকের গগন বিদারী ভেঁপুর শব্দে মেয়েটা যেন হুশ ফিরে পেল। ক্ষণিকের মধ্যেই, টাইটানিকের ডেকে শত শত যাত্রীর মধ্যে মধ্যে কাকে যেন দৃষ্টিটা খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল, যাকে খুঁজছে তাকে। জোরে জোরে হাত নাড়াতে লাগল। জবাবে, ওই দিক থেকেও একই ভাবে হাত নড়তে থাকল। দু জন দু জনকে চিৎকার করে কি যেন বলতে থাকল। কিন্তু এত মানুষের হট্টগোলে কিছুই বোঝা গেল না।
মেয়েটার নাম সামান্থা।
ছেলেটার নাম ছগির।
৪
ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির নাম শোনে নি এমন বাঙালি সম্ভবত নাই। বাণিজ্য করার নাম করে এসে সমগ্র ভারতবর্ষ শাসন করে গেছে দুশো বছর। শুধু শাসন বললে ভুল হবে, শাসনের নামে শোষণ। এখানকার সব সম্পদ নিয়ে গেছে নিজের দেশে; বাঙালি তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দিয়েছে, যাতে তারা মসলিন কাপড় বুনতে না পারে; ধানের জমিতে বাধ্য করেছে, নীল চাষ করতে। বলতে গেলে তাদের দুঃশাসনের কোন ইয়ত্তা ছিল না।
ব্রিটিশরা এই দেশের সম্পদ নিয়েই ক্ষান্ত হয় নি। বাঙালি বুদ্ধিজীবী আর শ্রমিকদের নিয়ে গেলে তাদের দেশে। কিন্তু আরেক ধরণের বাঙালি নিজের ইচ্ছায় সাগর পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ডে যেয়ে আস্তানা গাড়ল। এরা প্রথমে জাহাজে খালাসি কিংবা লস্করের চাকরি নিত। তার পরে জাহাজ যখন বন্দরে নোঙর করত, তখন এই সব দুঃসাহসিক বাঙালিরা জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে পানিতে লাফ দিয়ে সাঁতরে ডাঙ্গায় যেয়ে উঠত। সেখানে বসত গাড়ত একটু স্বাচ্ছন্দের আশায়, একটু ভাল জীবনের আশায়।
সম্ভবত ইংল্যান্ডে আদি বাঙ্গালিদের মধ্যে সব চেয়ে বিখ্যাত মানুষ হলেন শেখ দীন মুহাম্মদ। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন। ১৮১০ সালে তিনি লন্ডনে প্রথম ভারতীয় রেস্টুরেন্ট খুলেন: হিন্দুস্থান কফি হাউস। তিনি ব্রিটিশদের চুলের শ্যাম্পুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পাশ্চাত্যকে আয়ুর্বেদিক ম্যাসাজ ওয়েলের ব্যবহার তিনিই শেখালেন।
দীন মুহাম্মদের দেখা দেখি বেশ কিছু বাঙালি লন্ডনে রেস্টুরেন্ট খুলে ফেলল। যাদের মেধা কিংবা পুঁজির ঘাটতি ছিল, তারা এই সব ব্যবসায়ে চাকরি নিলো। ভেতো বাঙালি ইংরেজদের ভাত আর বিরিয়ানি খাইয়ে বেশ নাম করে ফেলল। বাঙালিদের বিদেশ বিভুয়ে সোনার হরিণ ছোঁয়ার আশায় ছুটা সেই থেকে শুরু।
৫
তরঙ্গ গ্রামে যেন বাজ পড়ার মত ঘটনা হয়ে গেল। আঠার বছরের ছগির গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। শুধু তাই না, সাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজে করে বিদেশ যাবে। প্রথমে জাহাজে চাকরি নিয়ে বিদেশ। তার পরে সুযোগ মত জাহাজ থেকে নেমে পড়বে। সেখানে মেলা কাজ পাওয়া যায়। বিদেশিরা প্রচুর খরচ পত্র করে। আয় রোজগার হয় অনেক। ছগির মায়ের কানে ফিস ফিস করে বলল, এত এত টাকা পাঠাব। জমি কিনবা, বাড়ি বানাবা। চারর-বাকর রাখবা তিন খান। পায়ের উপর পা তুলে থাকবা সারাদিন। মহা সুখে ঘুমাইতে পারবা। তোমার গরিবি দশা চিরতরে ঘুচবে।
মা কখন এত সম্পদের কথা চিন্তা পর্যন্ত করেন নি। মুহূর্তে চোখটা জ্বল জ্বল করে উঠল। ভাবতেই ভাল লাগে, গ্রামের সব লোক জন তাকে কদর করছে, সম্মান করছে। আসলে ধন সম্পদ না থাকলে কেউ কোন দাম দেয় না। আবার এও মনে হয়, তাকে সুখী করার জন্যে তার একমাত্র ছেলে দেশ ছাড়বে, সেইটাই বা কেমন কথা? অভিমানী গলায় ছেলেকে বলে, আমার এত সম্পদের দরকার নাই। আমার ব্যাটা আমার কাছে থাকলেই আমি আর কিছু চাই না।
ছগিরের সাথে সপ্তাহ দুয়েক আগে দেখা হল সাবেরের সাথে, বিয়ানীবাজারে। এক সময়ে এক সাথে স্কুলে যেত। বন্ধুত্ব ছিল বেশ। তার থেকেই পরিকল্পনাটা পাওয়া। চট্টগ্রাম বন্দরে গেলে জাহাজে সহজেই চাকরি পাওয়া যায়, খালাসির কাজ। তার পরে জাহাজ যখন বিদেশের বন্দরে যেয়ে নোঙর ফেলে, তখন পানিতে লাফ দিতে হয়। ছগির সাবেরেরকে বলল, আমিও যাব তোমার সাথে। আমিও বিদেশ যাব। মায়ের জন্যে জমিদারদের মত পাকা বাড়ি বানিয়ে দেব। আমার মা সোনার পালঙ্কে ঘুমাবে। বিধবা মা আমার, আমারে বড় করতে যেয়ে জীবনে অনেক কষ্ট করেছে।
৬
ফার্স্ট অফিসার ইউলিয়াম মারডক নিজের চোখে দেখলেন বিশাল বড় বরফ খণ্ড। তিনি আর ক্যাপ্টেনের নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করলেন না। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত। দেরী করলেই মহা বিপদ। এতগুলো মানুষের জীবন। তিনি জাহাজ ঘুরানোর নির্দেশ দিলেন। টাইটানিক ঘুরতে আরম্ভ করল। এত বড় যন্ত্র দানব। বললেই তো আর সাথে সাথে ঘুরিয়ে ফেলা যায় না। সময় লাগে। কিন্তু ফাস্ট অফিসার মুহূর্তের মধ্যেই বুঝলেন, তার নির্দেশ ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা নাই।
ক্যাপ্টেন স্মিথ মাত্র কিছু দিন আগে এক বিখ্যাত পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, জাহাজ পানিতে ডুবে যাবে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির যুগে এ রকম ভাবাটাও ভুল। এখন জাহাজ ক্যাপ্টেনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। তিনিও ছুটে আসলেন জাহাজের ‘ব্রিজে’। বুঝে ফেললেন টাইটানিককে আর নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনা যাবে না। যন্ত্র দানবটা বাম দিকে ঘুরছে, কিন্তু তার চোখের সামনেই পূর্ণ গতিতে প্রকাণ্ড বরফ খণ্ডকে আঘাত করল।
ক্যাপ্টেন স্মিথ আর ফার্স্ট অফিসার মারডক দু জনে বুঝলেন, টাইটানিককে নিয়ে মানুষের গর্ব ধূলিসাৎ হচ্ছে।
ক্যাপ্টেন স্মিথ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে এ দিক, ওদিক তাকালেন। তার পরে ফিরলেন ফার্স্ট অফিসারের দিকে।
ফাস্ট অফিসার মারডক তার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখে,মুখে, শরীরে একটাই প্রশ্ন এখন আমরা কি করতে পারি?
কিন্তু তাদের ভাল করেই জানা, জাহাজকে রক্ষা করার কোন উপায় নাই।
আঘাতে টাইটানিকের বড় ধরণের ছিদ্র হয়ে গেল। সাথে সাথেই সমুদ্রের হিম শীতল ঠাণ্ডা পানি ভিতরে ঢোকা আরম্ভ করল।
৭
ছগিরের তরঙ্গ গ্রাম থেকে যাত্রার আগের দিন প্রায় পুরো গ্রাম তাকে দেখতে চলে এল। গ্রামের প্রথম ছেলে সাগর পাড়ি দিয়ে সাহেবদের দেশে যাবে। এ তো সহজ কথা না। সেখানে থাকবে, মায়ের জন্যে টাকা কড়ি পাঠাবে। কিন্তু তার পরেও সবারই মন ভীষণ খারাপ হল। গ্রামের ছগিরকে, চাইলেই তো আর দেখা যাবে। কারণে, অকারণে ছগিরকে কোন কাজের জন্যে ডাকা যাবে না। বয়স্কা মহিলারা তাকে জড়িয়ে কান্না কাটি করলেন। গ্রামের মুরব্বিরা এসে দোয়া করে গেলেন, বাজান দোয়া করি, আল্লাহ যাতে তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ করেন। অন্ধকার হওয়ার আগেই এক এক করে সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল।
রাত হওয়ার সাথে সাথে সাথেই আরম্ভ হল মায়ের কান্না। ছগির অনেক চেষ্টা করল মায়ের কান্না থামাতে, মা আমি ওখানে যেয়েই তোমাকে চিঠি দিব। তুমি পোস্ট মাষ্টার মামারে দিয়া পড়িয়ে নিবে। আমি ভাল থাকব। তুমি এক ফোটাও চিন্তা কর না।
ছগির নিজের ঘরে যেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কালকে অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠতে হবে। কিন্তু চোখ দু টো কোন ভাবেই জোড়া লাগাতে পারছিল না। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব আর কত ঘটনা এক করে মনে আসল। পাশের বাসার সখিনার কথাও মনে আসল। তার হয়ত আরও বেশী কিছু বলার ছিল।
কয়েক দিন আগে তাকে একা পেয়ে সখিনা বলল, তুমি বিদেশ যেও না। তুমি এখানে না থাকলে আমার কি হবে?
ছগির রসিকতা করে বলল, কি আর হবে, তোর বিয়ে হবে পয়সাওয়ালা কোন ছেলের সাথে। পায়ের উপরে পা দিয়ে দিয়ে থাকতে পারবি।
সখিনা রাগ করে বলল, আমার পায়ের উপর পা দেয়ার কোন দরকার নাই। তুমি থাকলেই আমার চলবে।
সখিনা চোখ ভরা পানি নিয়ে দৌড়ে চলে গেল।
৮
এলোমেলো ভাবতে ভাবতে ছগিরের চোখ দুটো লেগে আসল। তার পরেও একের পর এক সব চরিত্র আর ঘটনা যেন ভেসে ভেসে আসতে লাগল। অতীত, বর্তমান মিলে একাকার হয়ে গেল। সে বুঝল না, সে এখন কোন কালে---অতীতে না বর্তমানে? বাবাকে স্পষ্ট দেখল। এক গাদা বাজার করে নিয়ে এসে মা কে বলছেন, ছগির বিদেশ যাবে, ওর যা যা ভাল লাগে, সব রান্না কর। আবার তার কাছে এসে বাবা বললেন, বাবারে মাকে ছেড়ে এত দূর যাস নে। তুই চলে গেলে তোর মা কে দেখবে। একটা বিয়ে করে রেখে গেলেও পারতি। বউ মাকে, নিয়ে না হয় তোর মা থাকত। কিন্তু বাবা কি করে তাকে এই সব কথা বলেন। তিনি তো মারা গেছেন, সেই কবে। বাবার কথা ভাবতে ভাবতেই মনে হল, মা কাঁদছে। সে কি করে ঘুমিয়ে থাকতে পারে?
ছগিরের মনে হল, মায়ের ঘর থেকে একটা না, দুটো কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। বুঝল না, সেটা কি করে সম্ভব। ওই ঘরে মা তো একাই শোয়। খালা, চাচীরা সেই কখন বিদায় নিয়ে চলে গেছে। শুয়ে শুয়ে হাসি লাগল। একটু আগের স্বপ্নের কারণে দুটো কান্নার আওয়াজ মনে হচ্ছে। একটা মায়ের, অন্যটা বউয়ের।
ফজরের নামাজের আজানের সাথে সাথে ছগিরের ঘুম ভাঙল। নিজের উপর রাগ হল, আরও আগে উঠা উচিত ছিল। মায়ের সাথে কিছুটা সময় কাটান যেত। রহিম চাচা বলেছেন, ফজরের নামাজ পড়েই তিনি চলে আসবেন। তিনি ছগিরকে নিয়ে বিয়ানীবাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিবেন। তার পরে সাবের, ছগির দু জনে মিলে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।
মা তার ঘর থেকে ছগিরকে বললেন, বাবা হাতে সময় বেশী না ই। নাস্তা করেই তোকে বের হতে হবে। ছগির তাড়াহুড়া করে মুখ ধুয়ে, গোসল করে, পোশাক বদলে চলে আসল নাস্তা করতে। দেখল মায়ের সাথে সখিনাও নাস্তা নিয়ে বসে আছে। মায়ের অসুখ বিসুখ হলে সখিনা এসে মায়ের সাথে থাকে। হয়ত মায়ের মন খারাপ ভেবে গত রাতে এসে মায়ের সাথে ছিল। মা বলতে লাগলেন, সখিনার সেই রাত থেকে তোর জন্যে বসে আছে। তোকে না কি নিজের হাতে কি একটা দিবে। আমি বললাম, আমাকে দিয়ে যেতে। রাজী হল না। বলল তোকে নিজের হাতে দিবে।
ছগির সখিনাকে বলল, কিরে কি দিবি, দে? সখিনা চোখ তুলে তাকাল। ছগির সাথে সাথে বুঝল, এই মেয়েই সারা রাত মায়ের সাথে গলা মিলিয়ে কেঁদেছে? তার কান্না কাটি করার কি দরকার হতে পারে? সখিনা গম্ভীর হয়ে জানাল, সময় হলে দিব। ছগিরের মাথায় আসল না, একটু পরে সে পথে নেমে পড়বে। তখন সময় হবে কি করে। ছগির এক জন মেয়ের কথার রহস্য ভেদ করার ব্যর্থ চেষ্টা না করে, নাস্তা করাতে মন দিল।
মা উঠে রান্না ঘরে গেলেন কিছু একটা আনতে। “তখনই সময় হল”। মনে হল সখিনা তার কাপড় সরিয়ে বুকের মধ্যে থেকে কিছু একটা বের করল। তার পরে সেটা ছগিরের হাতে গুজে দিল। নাও এটা নাও। না মরা পর্যন্ত এই জিনিষ সাথে সাথে রাখবে কিন্তু। না রাখলে দেখ আমি কি করি। তুমি যারে ইচ্ছা, তারে বিয়ে কর। কিন্তু আমার এই জিনিস তুমি হারাতে পারবে না।
উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে, সখিনা দৌড়ে চলে গেল। তার চোখ দুটো নিশ্চয়ই অশ্রুতে ভরা ছিল। নাকি সারা রাত ধরে কাঁদার পরে, চোখ শুকিয়ে গেছে।
ছগির উপহার খুলে দেখল, একটা রুমাল, লাল রঙের কাপড়ে, হলুদ সুতো দিয়ে লেখা, “ যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে”। রুমালের এক কোণায় ছোট করে লেখা, সখিনা ভালোবাসে ছগিরকে।
মুহূর্তেই মনে হল, এক সময়ে সখিনা তার কাছে বাংলায় লিখতে পড়তে শিখেছে। আসল, তার শেখান বিদ্যার এ কেমন অদ্ভুত প্রয়োগ। সাথেই সাথেই বুঝল, এই মেয়েটার বুক ভর্তি ভালোবাসা তার জন্যে।
বাড়ি থেকে বের হবার শেষ মুহূর্তে, সে কি না বুঝতে পারল ফুলের মত সুন্দর মেয়ে সখিনা তাকে ভালোবাসে। আর কয়েক দিন আগে বুঝতে পারলে কি ক্ষতি হত?
মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে পথে নেমে শেষ বারের মত ঘুরে দেখল। মায়ের পাশে সখিনা এসে দাঁড়িয়েছে। দু জনেই সমান তালে কেঁদে চলেছে।
সখিনার সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্রই, সখিনা কেমন এক রকম ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়তে লাগল।
সখিনার চোখ, মুখের সাথে সাথে হাত, হাত নাড়ানোর ছন্দ যেন কি একটা বলতে চাইল !
৯
শনিবারে সূর্য যখন ডুবু ডুবু করছিল, এম ভি ইস্ট ওয়েস্ট চট্টগ্রাম ছেড়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। তবে সরাসরি লন্ডন না। মাঝে বোম্বে, করাচী, আফ্রিকার বেশ কিছু বন্দর ঘুরে শেষে লন্ডন। যেতে সাড়ে চার মাস লেগে যাবে। জাহাজ ছাড়ার আগের থেকেই ছগির, সাবেরের কাজ আরম্ভ হয়ে গেল। হরেক রকমের মালামাল মাথায় করে জাহাজে তুলতে হল। জাহাজ ছাড়ার পরে আরম্ভ হল আরও কঠিন কাজ, ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ফেলা। ওখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে, জাহাজ চলার শক্তি তৈরি করে।
বয়লারের চারিদিকে ভীষণ গরম। দাঁতে দাঁত চেপে ছগির এক মনে কাজ করে যায়। কোন রকমে জাহাজ লন্ডনে পৌঁছলেই হল। লাফ দিয়ে সাঁতরে চলে যাবে সুন্দর জীবনে। সাবের আগের থেকেই সাবধান করে দিয়েছিল, খবরদার লাফ দিয়ে পালানোর ব্যাপারে কারে সাথে কথা বলা যাবে না; এমনকি নিজেদের মধ্যেও না। দেয়ালেরও কান আছে। কোন রকমের যদি ক্যাপ্টেনের কানে খবরটা যায়, ভীষণ বিপদ। কঠিন শাস্তি হবে। বন্দর আসলে সাবধানতা হিসেবে বেঁধে রাখবে। ভুলে যেতে হবে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন। তাই দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করে যাওয়া আর কোন উপায় নাই। তা ছাড়া, ওদের মত আরও অনেক খালাসী কাজ করছে। কে যেন ওদের মনেও কি একই স্বপ্ন আছে কি-না?
জাহাজ রাত দিন চলে। ছগিরের কাজ দিনে পনের ঘণ্টা। তার পরে বাকি সময়ে স্নান, বিশ্রামের জন্যে। কিন্তু বিছানায় শুলেও, চোখ দুটো আর এক হত না। মায়ের মুখটা ভেসে আসত। তার পরে মনে আসত, সখিনার কথা। তার দেয়া লাল রুমালের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারত না। চোখ দিয়ে হু হু করে পানি বের হয়ে আসত। সে কি করল এইটা, মাকে একা রেখে, সে এইটা কি করল। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হল। সাথে সাথে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হল। একটা মেয়ে তাকে এত ভালোবাসল, সে কিনা বুঝতেই পারল না।
ছগিরের পরিষ্কার মনে হল, সখিনার সাথে তার মিলনের কোন আশাই নাই। সে কবে বিদেশ থেকে ফিরবে, তত দিন সখিনার পক্ষে অপেক্ষা করা অসম্ভব। সে যদি ভালোবাসার কথা জানত, হয়ত, সাগর পাড়ি দেয়ার বুদ্ধি মাথাতেই আনত না। ক্ষেত খামারে কাজ করে সখিনাকে নিয়ে ভালই ঘর বাঁধতে পারত। অভাব থাকত ঠিকই, কিন্তু সুখের কোন কমতি হত না। মাকেও সারা রাত ধরে এক মাত্র সন্তানের জন্যে কাঁদতে হত না।
লাল রুমালের কথাগুলো পড়তে পড়তে ঠিক করে ফেলল, সখিনার সাথে মিলন না হলেও, সে তাকে কোন দিন ভুলবে না। হৃদয়ের গভীরতম জায়গায় সখিনা সব সময়ে বসত বেঁধে থাকবে। সেখান থেকে কেউ তাকে সরাতে পারবে না।
ছগির প্রতিজ্ঞা করল, এই লাল রুমালকে সে কোন ভাবেই হাত ছাড়া করবে না। জীবনের শেষ মুহূর্তেও সখিনার লাল রুমাল তার সাথে থাকবে। এইটার অন্যথা সে কোন ভাবেই হতে দিবে না।
১০
ছগির সাঁতার কেটে যখন ডাঙ্গায় পৌঁছল, তখন তার সম্বল শুধু পরনের কাপড় আর লাল রুমাল। সে না জানে কাউকে, না চিনে পথ ঘাট। ওই দেশের ভাষাও জানা নাই। সাবের তার সাথে লাফ দিয়েছিল। কিন্তু ডাঙ্গায় নেমে তার কোন সন্ধান পেল না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। না শেষ পর্যন্ত তার কোন হদিস মিলল না। বুঝল এখন থেকে যা করার তাকে নিজেই করতে হবে।
সেই সন্ধ্যা থেকে আরম্ভ করে সারা রাত, ছগির তাকিয়ে ছিল পানির দিকে। আশা ছিল এই বুঝি, সাবের এসে উঠবে। এই দিকে শরীরের কাপড় ভেজা। খুব ঠাণ্ডা লাগতে লাগল। অবশ্য সকাল হতে হতে কাপড় বেশ শুকিয়ে আসল। মন খারাপ নিয়ে দুরু দুরু বক্ষে হাটা আরম্ভ করল। তার জানা ছিল, তার আগেও সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ লন্ডনে এসেছে। কিন্তু তাদের সে কোথায় পাবে? শুধু এক জন সিলেটীর দেখা পেলেই হবে। বাকিটুকু সে নিজে সামাল দিয়ে নিবে। প্রথমে একটা কাজ জোগাড় করবে। কিছু টাকা জমিয়ে মায়ের জন্যে পাঠাবে। মাকে বলবে, সখিনার যার সাথেই বিয়ে হউক না কেন, যাতে অনেক খরচ পাতি করা হয়। মেয়েটার যেন কোন দুঃখ না থাকে। ভাবতে ভাবতেই মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। লাল রুমালের লেখা বের করে এক হাজার বার পড়ল, “সে যেন ভুলে না মোরে”।
ছগিরের চোখটা নিজের অজান্তেই চোখের পানিতে ভরে গেল। লাল রুমালটা দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো। পরের মুহূর্তেই মনে হল, সে এইটা কি করছে? কোন কারণে কাঁদলে, মা বলতেন, ব্যাটা ছেলেদের কাঁদতে নাই। কিছুটা বড় হওয়ার পর থেকেই তার চোখে আর পানি আসে নি। কিন্তু এখন কি না সে কাঁদছে। মা জানলে কি বলবেন। আর সখিনা দেখলে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবে। যাকে ভালোবাসে সে যখন কাঁদে তখন কেমন লাগতে পারে? পরের মুহূর্তেই ছগির, নিজে নিজে একটু হাসল। মা আর সখিনা যদি একবার দেখত, তার পুরো বুক জুড়ে ওদের জন্যে কত না ভালোবাসা জমে আছে। সে এ রকম বিদেশ বিভুয়ে না আসলেই পারত। যেহেতু এক বার এসেই পড়েছে, তার এত দূরে এত কষ্ট করে আসার কারণ ব্যর্থ হতে দিতে পারে না। ছগির উঠে দাঁড়াল। মা, সখিনা আর তরঙ্গ গ্রামের কাউকে ছোট করতে পারবে না। তাকে সফল হতেই হবে।
১১
সাবেরের আশা ছেড়ে দিয়ে ছগির হাঁটা আরম্ভ করল। সাদা মুখের মানুষগুলো তার দিকে চেয়ে চেয়ে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। টেমস নদী সাঁতরে পাড়ি দিয়ে,বেশ ক্লান্ত হয়েছিল। সাথে প্রচণ্ড ক্ষুধা। কতক্ষণ হয়ে গেছে পেটে কোন খাবার পড়ে নি। হাঁটতে হাঁটতে সকাল বেলার সূর্য মাথা উপরে আসল। তার পরেও ছগির চলতে থাকল। সূর্য যখন প্রায় পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ছে, তখন রাস্তার ধারে পড়ে থাকা আধ খাওয়া একটা কলা দেখল। ছগির আর দেরী করল না। গব গব করে কলাটা খেয়ে নিলো। আরও খেতে ইচ্ছা করল। গলাটা মনে হচ্ছে পিপাসায় কাঠ হয়ে গেছে। আরেকটু খাবার আর পানির আশায় এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। মনে মনে আল্লাহকে ডাকল, ইয়া আল্লাহ এই বিপদে সহায় হও। ছগির রাস্তার পাশে বসে পড়ল। আর নড়ার শক্তি নাই। আর নড়েই বা কি লাভ। সে যে কোথায় যাবে, তারই তার জানা নাই।
মেঘ ছাড়া বৃষ্টির হওয়ার মত একটা ঘটনা ঘটল। এক বয়স্কা মহিলা তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাতে এক ঠোঙ্গা খাবার আর বড় কাপে পানি। তার কথা বার্তা ছগির কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারল, মহিলা সম্ভবত জানতে চাইছেন, সে ইন্ডিয়া থেকে এসেছে কি না। ছগির মাথা নাড়িয়ে বলল, ইয়েস ইয়েস। বেচারার ভাণ্ডারে দু চারটে ইংরেজি শব্দের মধ্যে ইয়েসটা অন্যতম।
ছগিরের”ইয়েস” কথায় কাজ হল। মহিলা হাতের খাবারের ঠোঙ্গা আর পানি তাকে দিল। ছগিরের আর অপেক্ষা করার উপায় ছিল না। মাথা নিচু করেই পুরো খাবারটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করল। মাথা তুলে দেখল। মহিলা তখনও ঠায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ছগির তার ভাণ্ডার থেকে আরেকটা শব্দ ব্যবহার করল, “থ্যাঙ্কু”। তার পরে উঠে দাঁড়াল। অবাক হয়ে দেখল, মহিলার পাশে অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। নীল চোখ, সোনালি চুল। মেয়ে হিসেবে বেশ লম্বা। হয়ত তার কাছাকাছি হবে। একটা লাল গোলাপ থেকেও বেশী সুন্দর। ছগিরের কেমন লজ্জা লজ্জা লাগল। সে কেমন করে, এত সুন্দর একটা মেয়ের উপস্থিতি এতক্ষণ টের পেল না। মেয়েটাই বা কি ভাবল।
মহিলা ছগিরকে নিয়ে তার গাড়িতে তুললেন। বেশ কিছুটা সময় গাড়ি চলল। মহিলা নিজেই গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে সুন্দরী সেই মেয়ে। মাঝে মাঝে ঘুরে পেছন ফিরে ছগিরের দিকে তাকিয়ে দেখছে। কয়েকবার কি সব বলেছে। ছগির কিছুই বুঝতে পারে নি। শুধু ইন্ডিয়া শব্দটা শুনলেই বলেছে, ইয়েস ইয়েস। বয়স্কা মহিলাও দু চার বার কি যেন জানতে চেয়েছেন। ছগিরের মুচকি হাসা ছাড়া আর কোন উত্তর জানা ছিল না। অবশ্য ছগির এর মধ্যে একটা বিশাল কাজ করে ফেলল। তার সীমিত ইংরেজি জ্ঞান দিয়ে নিজের নামটা ওদের জানাতে পারল---বলল, my name Sagir Chowdhury.
১২
গাড়ির ঝাঁকুনিতে ছগিরের ঝিমুনি আসল, ক্লান্তিতে চোখ দুটো লেগে আসছিল। কিন্তু অপরিচিত দু জন মানুষের উপস্থিতে কি করে ঘুমান যায়? তার পরে দু জনই মহিলা। ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, বুঝতেই পারে নি। পকেটে হাত দিয়ে দেখল, লাল রুমালটা নাই। সাথেই সাথেই সখিনা এসে হাজির হল, আমি বলেছিলাম না রুমালটা কোন ভাবেই হারাতে পারবে না। এখন তুমি কোন ভাবে আমাকে মনে রাখতে পারবে না। আমাকে তুমি ভুলে যাবে। আমাদের সবাইকে ভুলে যাবে। তরঙ্গ গ্রাম কোথায় তুমি সেটা বলতে পারবে না।
মনে হল সে চিৎকার করে বলল, না না সেটা হতে পারে না। তরঙ্গ গ্রামে আমার মা থাকে। তাকে আমি ভুলতে পারি না। ঠিক তখনই মনে হল, তার মা ডাকছেন, বাবা ছগির উঠ। সকাল হয়ে গেছে। চোখ খুলে দেখে বয়স্কা মহিলা তার ঘাড়ে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে ডাকছেন, Sagir, Sagir wake up.। এই মহিলাকেই মা বলে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করল। না তা কেমন করে হয়? সে তো আর আসলে নিজের মা না। তার মধ্যে এত ভালোবাসা আসে কি করে? তার মা তরঙ্গ গ্রামে হলেও, এই স্নেহময়ী তাকে নিজের মার মত স্নেহ করেই ডাকছেন। কিন্তু মহিলা কথা বলছেন একেবারে ভিন ভাষায় ইংরেজিতে। ভাষাটার কথা বলার ধরণ এমন কি না?
মহিলা ছগিরের হাতে কিছু ব্রিটিশ টাকা (পাউন্ড) তুলে দিয়ে বললেন, This is an Indian Restaurant. Go. You will find your countrymen
ফুলের মত সুন্দরী মেয়েটা ছগিরকে অবাক করে একেবারে কাছে এসে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে জানতে চাইল, Who is Sakhina?
ছগির ধীর পায়ে রেস্টুরেন্টের ভিতর যেয়ে ঢুকল। তার আগেই অবশ্য পরিচিত খাবারের গন্ধ নাকে গেল। মনে হল ভিতরে হয়ত বিয়ে বাড়ির রান্না হচ্ছে। সারি সারি টেবিল চেয়ার। সাহেব, মেমরা বসে কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া দাওয়া করছে। মনে হল বেশীর ভাগ মানুষই পোলাও-বিরানি খাচ্ছে। এইদিক ওইদিক তাকাল, দেশী কোন মানুষ পাওয়া যায় কি-না। ভাগ্যটা প্রসন্নই বলতে হবে। টাই পরা এক ভদ্রলোক তাকে দেখেই বুঝে ফেলল ছগির এখানে কেন এসেছে। একবারে খাঁটি সিলেটী ভাষায় বলল, সিলেট তুন আইসো নি?
১৩
টাইটানিকের জন্মের বছরটায়, আবহাওয়াটা কেমন জন্য অন্য রকম ছিল। শীতকালটা বেশ উষ্ণ ছিল। ১৪০০ বছরের মধ্যে চাঁদ পৃথিবীর সব চেয়ে কাছে চলে এসেছিল। শুধু তাই না পৃথিবীও সূর্যের নিকটতম দূরত্বে ছিল। গ্রিনল্যান্ডের আস্ত বরফগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে জাহাজ চলাচলের পথে ভেসে চলে আসল। নাবিকরা বিষয়টা ভাল করেই জানত। টাইটানিককে বিশাল বরফের টুকরো ব্যাপারে সাবধান করে বার্তা এসেছিল। কিন্তু তার পরেও টাইটানিক কেন প্রায় পূর্ণ গতির কাছাকাছিতে চলছিল, তা এখন বলা মুস্কিল। চারিদিকের বিপদের সাথে যোগ হয়েছিল ঘুট ঘুটে অন্ধকার। খালি চোখে দূর থেকে বিশাল বরফের টুকরো দেখা অসম্ভব কাজ ছিল। ওয়াচ ম্যানরা দায়িত্বে ছিল। তারা যখন টাইটানিকের চলার পথে বিশাল বরফের খণ্ড দেখল,তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ফাস্ট অফিসার মারডকের জাহাজ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা ব্যর্থ হল। ৯০ ফুট উচ্চতার জাহাজ যেয়ে আঘাত করল ১০০ ফুট উচ্চতার বরফ খণ্ডকে। মুহূর্তেই মানুষের মিথ্যা গর্ব ধূলিসাৎ হল। টাইটানিকের নিচের অংশ ছিদ্র হয়ে গেল।
৪০ বছরের অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন স্মিথ যা একেবারে চিন্তা করেন নি, তাই হল। বুঝতে দেরী হল না , টাইটানিকের পানিতে তলিয়ে যাওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। মাথায় এলো না, তার এখন কি করা উচিৎ। জাহাজে পর্যাপ্ত লাইফ বোট নাই। সব মিলিয়ে আছে ২০ খানা । সেখানে ১১০০ র বেশী মানুষের ঠায় হবে না। তার মানে অর্ধেকের বেশী মানুষকে ডুবে মরতে হবে। তিনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নিবেন, কাকে নৌকায় উঠিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিবেন। কাকেই বা জেনে শুনে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন।
টাইটানিক থেকে একের পর “আমাদের বাঁচাও” ( SOS—Save our Souls) তার-বার্তা পাঠান হল। কিন্তু হাতে একেবারে সময় নাই। কিছু একটা এখনই করতে হবে। না হলে সবারই মৃত্যু। ফাস্ট অফিসার মারডক দেখলেন ক্যাপ্টেন স্মিথ জাহাজের রেলিং ধরে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছেন। ফাস্ট অফিসার বললেন, স্যার লাইফ বোটগুলো পানিতে এখনই নামাতে হবে। যত জনকে বাঁচান যায়, ততই ভাল। ক্যাপ্টেন জানতে চাইলেন, কাকে রেখে আমরা কাকে নৌকা দিব? ফাস্ট অফিসার এক বাক্যে বললেন, মহিলা, শিশু আর বয়স্কদের আগে নৌকায় স্থান করে দেওয়া হবে।
তা হলে বাকীদের কি হবে?
ক্যাপ্টেন স্মিথ আর ফাস্ট অফিসার মারডক ভাল করেই জানেন পানিতে সাঁতরে কেও রক্ষা পাবে না। তুমুল ঠাণ্ডা পানিতে হাইপোথারমিয়ায় মৃত্যু একেবারে অবধারিত।
১৪
ছগিরের চাকরি পেতে সময় লাগল না। ছোট বেলা থেকেই চট পটে। নতুন কিছু শিখতে তার খুব আগ্রহ, আর শিখেও ফেলে সবার আগে। সিলেটী মালিকানায় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের কাজ এক এক করে সব শিখে নিলো। বিদেশ বলে কথা, এখানকার সব নিয়ম কানুন একেবারে অন্য রকম। প্রথমে শিখল বিদেশী কায়দায় থালা বাসন ধোয়া, পেঁয়াজ কাটা। তার পরে খাবার পরিবেশন করা থেকে আরম্ভ করে রান্না-বান্না সব। সামান্য কিছু পড়া লেখা জানা ছিল বলে, মালিক শেখ নিয়ামত তাকে হিসাব রাখার বাড়তি দায়িত্ব দিলেন। এক বছরের মধ্যে ছগির টাই পড়া ম্যানেজার হয়ে গেল। মাকে চিঠি লিখল, মা এখন আমার অনেক সম্মান। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা আমাকে সালাম দিয়ে কথা বলে।
আরেকটা ব্যাপারে ছগির বেশ দক্ষতার পরিচয় দিল। অনেক অল্প সময়ে ইংরেজি ভাষা রপ্ত করে নিলো। অন্যরা যেখানে কয়েকটা শব্দ দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছিল। সেখানে ছগির সবাইকে একেবারে অবাক দিল। তার চোস্ত ইংরেজি শুনলে কেও বলতে পারত না, ছগির মাত্র কয়েক দিন আগে এই দেশে এসেছে।
ছগির ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের প্রথম রাতেই আবিষ্কার করল, সখিনার দেয়া লাল রুমাল সে হারিয়ে ফেলেছে। নিজের উপর খুব রাগ হল। সে কেমন করে এ রকম একটা কাজ করতে পারল। সে সখিনাকে কথা দিয়ে এসেছে, সে রুমাল সব সময় সাথে সাথে রাখবে। ভাবতে লাগল সে কোথায় রুমাল ফেলে এসেছে। জাহাজ থেকে নামার পরেও তার সাথেও ছিল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হল। কিন্তু ব্যাটা ছেলেদের তো কাঁদতে নাই!
তিন দিনের মাথায় ছগিরের কাছে রুমাল ফিরে আসল। সেই মায়ের মত মহিলা আর তার মেয়ে রেস্টুরেন্টে আসলেন। কিছু খাবার অর্ডার দেওয়ার পরে ছগিরকে খোঁজ করলেন। নিজের পরিচয় দিলেন, আমি মিস মারিয়া আর বললেন এই আমার মেয়ে সামান্থা। সোনালি চুলের অপরুপা মেয়েটা ছগিরের চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসল। ছগির ভাষা হারিয়ে ফেলল। মেয়েটার হাসির উত্তরে সেও একটু হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু এর মধ্যে তার বুকের কাঁপুনি বেড়ে গেছে। মেয়েটা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সখিনার বানান লাল রূমাল বের করে ছগিরের দিকে এগিয়ে দিল। ছগির বুঝল শুধু তার হৃদকম্পনই বেড়ে যায় নি, হাতও কাঁপছে। কিন্তু এটা বুঝল না, এ রকম হচ্ছে কেন? যুবক বয়সের, এক জন মেয়ে, এক জন ছেলের কাছাকাছি এসে মিষ্টি করে হাসলে; ছেলেদের কি এ রকমই হয়?
১৫
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ছগিরের মত প্রায় হাজার পঞ্চাশেক ভারতীয় সাগর পাড়ি দিয়েছিল। এদের বেশীর ভাগই ছিল বর্তমান সিলেট/আসাম অঞ্চল থেকে । কি কারণে একই অঞ্চল থেকে এত মানুষ বিদেশে গেল, তার উত্তর হয়ত ঐতিহাসিক, সমাজ বিজ্ঞানীরা ভাল দিতে পারবেন। প্রবাসীরা বয়সে তরুণ ; শুধুমাত্র পুরুষ হওয়ার জন্যে অন্য রকম এক সমস্যায় পড়তে হল, স্বজাতির মেয়ে না থাকার জন্যে। তারা হন্যে হয়ে স্থানীয় মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগল। বেশ কিছু বাঙ্গালি সম্পর্ক গড়তে পারল। সামান্য কিছু বাঙালি বিদেশী ললনাদের বিয়ে করে সংসার আরম্ভ করতে পেরেছিল।
সামান্থা যে ছগিরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসেছিল আর তার সাথে সাথে, যে সে নার্ভাস হয়ে পড়েছিল, তা এক মুখ, দু মুখ করে করে রেস্টুরেন্টে রাষ্ট্র হয়ে গেল। সম বয়সীরা ক্ষ্যাপাতে লাগল। ছগির যত না বলে, তার জন্যে তরঙ্গ গ্রামে সখিনা নামে এক মেয়ে অপেক্ষায় আছে, সবাই তত হাসে। বলে, সাগর পাড়ি দিয়ে এই দেশে আসা যায়। তাদের মত মানুষের ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। দেশের বাড়িতে টাকা পাঠান যায়, দূর থেকে মায়ের দোয়া পাওয়া যায়। তার অধিক কিছু না। দূর থেকে শুধু মন খারাপ করে চোখের পানি ফেলা যায়।
ছগির প্রথমে ঠিক করল, সখিনার লাল রূমাল নিয়ে বাকী জীবন কাটিয়ে দিবে। নাই বা হল দেশে ফিরে যাওয়া, নাই বা হল সখিনাকে কাছে পাওয়া। তিন মাসের মাথায় পাশের গ্রামের আরেক বাঙালি সাগর পাড়ি দিয়ে লন্ডনে এসে হাজির হল। নাম কুদ্দুস, ছগিরের সাথে আগের পরিচয় ছিল। তার মুখেই শুনল, ছগিরের বাড়ি ছাড়ার এক মাসের মাথায় সখিনার বাবা, জয়নুল ব্যাপারীর সাথে সখিনার বিয়ে দিয়েছেন। সখিনা এখন বড় বাড়ির ছোট বউ। তার আবার দু জন সতীন আছে। কষ্টে ছগিরের বুক ফেটে আসল। নিজেকে ভীতু মনে হল। তারই উচিৎ ছিল, বিদেশে না এসে সখিনাকে বিয়ে করা। ব্যাটা মানুষদের জন্যে গ্রামে কাজের কি অভাব। অন্য মানুষরা গ্রামে থেকে ঘর সংসার করছে না!
১৬
কুদ্দুস-ছগিরের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না। দু জন দু জনের সুখ দুঃখ ভাগ করে নিলো। এক সময়ে ছিল শুধু মুখের পরিচয়, এখন হল তারা জানি দোস্ত। ছগির তাকে সখিনা দেয়া লাল রুমালের বিষয়টা বলল। এও জানাল, সে এই রূমালকে কখনই হাত ছাড়া করবে না। কুদ্দুস ছগিরকে অবাক করে দিয়ে বলল, দোস্ত লাল রূমাল তোর কাছেই থাকবে। কিন্তু তোর জীবন থেমে থাকতে পারে না। তোকে জীবনে অনেক দূর আগাতে হবে। তুই যদি ভাল থাকিস, তোর মা, সখিনা দূর থেকে ঠিকই বুঝবে। অনেক শান্তি পাবে, তোকে নিয়ে গর্বে ওদের বুক ফুলে উঠবে।
ছগির কথাটা ভেবে দেখল। কুদ্দুস একেবারে খাঁটি কথা বলেছে। তার মা, সখিনার মত সেও কষ্টের জ্বালায় পুড়ছে। ওদের জ্বালা কমতে পারে, শুধুমাত্র, তার এই দেশে সফলতায়। কিছুটা সফলতা এসেছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। রেস্টুরেন্টের সব কাজ শেখা হয়েছে। নিয়ামত চাচা তাকে ম্যানেজার বানিয়েছেন। মাকে বেশ কিছু টাকা পাঠিয়েছে। মাকে বলেছে, পাকা বাড়ি বানাতে। মা পোস্ট মাষ্টার মামাকে দিয়ে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, আমি একা পাকা বাড়ি দিয়ে কি করব। তুই বাবা ফিরে আয়। তোকে ছাড়া আমার কোন কিছুই চাই না।
চিঠিটা পড়তে পড়তে চোখটা ভিজে আসল। বেচারা মা যদি জানত, তার পক্ষে ফিরে যাওয়া কত কঠিন।
নদীর পানি বয়ে গেলে কি ফিরে আসে?
মা যদি জানত!
১৭
টাইটানিকে তুমুল হট্ট-গোল দেখা গেল। নাবিকদের পর্যন্ত জানা নেই কিভাবে লাইফ বোটগুলো নামাতে হয়। প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করেও বাতিল করা হয়েছিল, সবচেয়ে নিরাপদ জাহাজ তার প্রথম সফরেই ডুবতে বসবে, তা কেও কি চিন্তা পর্যন্ত করেছিল? ক্যাপ্টেন স্মিথ নেতৃত্ব দেবার মত মানসিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। ফাস্ট অফিসার মারডক নাবিকদের নির্দেশ দিলেন কিভাবে নৌকাগুলো নামান যেতে পারে। বেশ কিছু নাবিক নিশ্চিত মৃত্যু জেনে কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল।
জাহাজে ঘোষণা দেবার ইন্টার-কম ব্যবস্থা ছিল না। বেশ কিছু যাত্রী, জাহাজ যে ডুবে যাচ্ছে, তার খবর সাথে সাথে পেল না। যখন তাদের কানে কথাটা গেল, তারা ভীত স্বম্ভ্রস্থ হয়ে লাইফ বোটগুলোর চারিদিকে ভিড় জমাল। নৌকা নামানোর কাজে সাহায্য করতে সাহসী যাত্রীরা এগিয়ে এলো। তাতে সুবিধার থেকে অসুবিধা বেশী হল। অনেকে যাত্রী শুধু মহিলা, শিশু, বয়স্কদের নৌকায় জায়গা দেয়ার প্রতিবাদ করতে শুরু করল। এ রকম সিদ্ধান্তের জন্য ক্যাপ্টেন স্মিথকে ধিক্কার দিতে লাগল। তাদের জীবনের মূল্য কোন ভাবেই অন্যদের থেকে কম হতে পারে না।
এই দুর্যোগের সময়ে অকল্পনীয় ধরণের ঘটনা হল। জাহাজের আট সদস্যের অর্কেস্ট্রা এগিয়ে এলো। ভীত স্বম্ভ্রস্থ মানুষকে শান্ত করার জন্যে বাজনা বাজাতে আরম্ভ করল। একের পর এক গান আর বাজনা চলতে লাগল। তারা বাজালেন সেও সময়কার বিখ্যাত মর্ম স্পর্শী সব গান: Autumn, Neared to My God……Propior Dio.
সঙ্গীত কি মানুষের জীবনের শেষ মুহূর্তের ভয়, ভীতি, আতঙ্ক থেকে দূরে রাখতে পারে?
সঙ্গীতের সুরের জগতে হারিয়ে গিয়ে কি অপার্থিব জগতে প্রবেশ সম্ভব?
টাইটানিকের অর্কেস্ট্রা; সেই কঠিন পরীক্ষা সুচারু ভাবে দিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আগে কখনো হয়েছিল বলে কারো জানা নাই।
১৮
ছগিরের রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ ভালই চলতে লাগল। একটা সন্তুষ্টি চলে আসল। মাকে প্রতি মাসে একটা চিঠি আর জমানো টাকা পাঠাতে লাগল। সারাদিন কাজে-কর্মে ব্যস্ততায় সময়টা কেটে যায়। বিছানায় শোয়া মাত্র ভর করে, দুনিয়ার সব অবসাদ। মায়ের কথা, সখিনার কথা, ছোট বেলায় বাবা হারানোর কথা, ভিটে বাড়ির কথা, বন্ধুবান্ধবদের কথা বারে বারে চোখের সামনে ভাসতে থাকে। অস্থিরতা চলে আসে। বালিশের নিচের থেকে লাল রূমালটা ডান হাতে চলে আসে।
রুমালের দিকে তাকিয়ে কত না বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে, তার হিসেব এখন কারোর কাছেই নাই। একই বাক্য, একই কথা বারে বারে পড়তে পড়তে মাথা ঝিম ঝিম করা আরম্ভ করেছে:“ যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে”। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছে, না না আমি ভুলব না, আমি ভুলতে পারি না। ভোর রাতের দিক থেকে হয়ত চোখ দুটো লেগে এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই একটা ধপাস শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছে। চোখ খুলেই দেখেছে সে মেঝেতে পড়ে আছে। লাল রূমাল ঠিকই হাতের মুঠোর মধ্যে!
কেও তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেললে, কেমন একটা লজ্জার ব্যাপার হবে।
তার পরে আর শোয়া হয় নি।
নতুন দিন এই ভাবে শুরু হয়েছে।
আগে হিসেব করত, এই দেশে তার কত দিন হয়েছে। এখনও সকালে কাজে বের হওয়ার, ছগির আগে মত একই কাজ করে। কিন্তু হিসেবটার মধ্যে কেমন একটা গণ্ডগোল হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও বের করতে পারে না, সে কত দিন আগে তরঙ্গ গ্রাম ছেড়েছে !
১৯
সামান্থা রূমাল ফিরিয়ে দেয়ার পর বেশ অনেক দিন রেস্টুরেন্টে আসে নি । ছগির অন্যদের থেকে শুনেছিল, মা আর মেয়ে সপ্তাহে কমপক্ষে দু একবার খেতে আসে। ইন্ডিয়ান ফুড তাদের নিশ্চয়ই খুব প্রিয়। সে জন্যে অন্যরা ছগিরের সাথে সামান্থার কল্পনার ফানুস উড়িয়েছিল। অবশ্য এইটাও ঠিক এর আগে সামান্থার কারো সাথে এত মিষ্টি করে হেসে কথা বলে নি। ছগিরের মন সখিনার জন্যে পড়ে থাকলেও, স্বর্ণকেশী সামান্থাও বুকের এক কোণায় জায়গা করে নিলো। অন্যরা যখন তাকে সামান্থাকে নিয়ে ক্ষ্যাপায়, তখন কেমন যেন একটা ভাল লাগা কাজ করতে আরম্ভ করল। নিজেকে স্বার্থপর মনে হত। সখিনা ছাড়া কাউকে ভাবা তার উচিৎ হবে না। কিন্তু সখিনা এখন অন্য মানুষের স্ত্রী। তার পরে, কুদ্দুস বলেছে, ছগির সুখে থাকলে তার মা, সখিনা দু জনে দূর থেকে জানতে পারবে।
বেশ অনেক দিন পরে সামান্থা আবার রেস্টুরেন্টে আসল। সাথে মা নাই, সে একাই। এর মধ্যে ছগির ম্যানেজার হয়ে গেছে। টাই, কোর্ট, প্যান্ট পরে । সামান্থা কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে ওয়েটারকে কুদ্দুসকে জিজ্ঞাসা করল, ছগির কি এখনও এখানে কাজ করে? তাকে কি একটু ডাকা যাবে? কুদ্দুস মুচকি হেসে কোন উত্তর নি দিয়ে চলে গেল। কানে কানে কুদ্দুস ছগিরকে কিছু বলল। কথাটা মনে হয় ভাল কাজ দিল। ছগির হাতের কাজ ছেড়ে দিল এক দৌড়।
ছগির সামান্থার সামনে হাঁপাতে হাঁপাতে যেয়ে পৌঁছল। বলতে লাগল একেবারে শুদ্ধ ইংরেজিতে, I am sorry that you are unhappy at our service. How can I make you satisfied now? (আমাদের সার্ভিসে অখুশি হওয়ার জন্যে আমি খুব দুঃখিত। এখন আমরা কি করলে তুমি সন্তুষ্ট হবে?)
সামান্থা ছগিরের দিকে ঘুরে তাকাল। সেই গাড়িতে করে নামিয়ে যাওয়া ছগিরের সাথে আজকের ছগিরের আকাশ পাতাল পার্থক্য। কথা বার্তার সাথে সাথে বেশ ভুষায় পর্যন্ত ছগির পুরাদস্তুর সাহেবের প্রতিচ্ছবি। ছগিরকে যখন সামান্থা চিনতে পারল, তখন হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসির ফাঁকে ফাঁকে বলল, ছগিরকে এই বেশে সে কল্পনাতেও আশা করে নি।
হাসি থামার পরে দু জনের কিছুক্ষণ কথা বলল। ছগির প্রথমেই জানতে চাইল, তুমি মানে তোমরা এত দিন আস নি কেন? সামান্থা গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমার মা মাস তিনেক আগে মারা গেছেন। ছগির এই খবরের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। বিদেশী যেই মহিলার মাঝে মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিল, তাকেও আরেকবার চাইলেও দেখতে পারবে না? নিজের থেকেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে এল। সামলে নিয়ে বলল, আমি কি তার কবর দেখতে যেতে পারি?
সামান্থা বলল, আমি তো প্রায় যাই। তোমার ছুটি কবে, বল; আমি এসে নিয়ে যাব।
ঠিক হল পরের শনিবার ছগির সামান্থার সাথে বের হবে।
২০
গোরস্থান থেকে ফেরার সময় দু জনে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলল। সামান্থার অবশ্য ধারণা ছিল ছগির কি করে এই দেশে এসেছে। তার পরেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিলো। বিদেশ আসার সিদ্ধান্ত, জাহাজে চাকরি নেয়া, জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে সাঁতরে ডাঙ্গায় উঠা, সাবেরকে হারিয়ে ফেলা এবং শেষে সামান্থা, আর তার মায়ের সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা। কথা শুনতে শুনতে সামান্থার চোখ পানিতে ভিজে উঠল। একটু চুপ থেকে, সামান্থা বলল, পৃথিবীর নিয়মটা যেন কেমন অদ্ভুত। তুমি তোমার মা কে ছেড়ে চলে এসেছে, আর আমার মা আমাকে ছেড়ে পরকালে চলে গেল।
ছগিরের শোনা হল সামান্থার অনেক কথা। বাবা ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন। তার নিজেরও জন্ম মাদ্রাজে। সুন্দর সুখের সংসার ছিল তাদের। চাকর-বাকর, আরাম-আয়েসের কোন কমতি ছিল না। কিন্তু বেশী দিন সুখ- আনন্দ স্থায়ী হয় নি। বাবা একবার ট্যুরে গেলেন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিন দিন পরে ফিরে আসলেন, গায়ে আকাশ-পাতাল জ্বর। হাসপাতালে ভর্তি করা হল। যম মানুষের টানাটানি চললো কিছুদিন। বাবা সপ্তাহ খানেক টাইফয়েডে ভুগে মারা গেলেন। মা ইংল্যান্ডে ফিরে আসলেন তাকে নিয়ে। নিজের হাতে মানুষ করলেন আদরের কন্যাকে। তিনিও কিনা ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। বলতে বলতে সামান্থা কান্না ধরে রাখতে পারল না। ডুকরে কেঁদে উঠল।
ছগির বুঝল না, সে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে পারে। একবার সামান্থার মাথায় হাত দিতে ইচ্ছা করল। আরেকবার মনে হল,ওকে বুকে নিয়ে বলে, তুমি কেঁদে না। আমি তোমার পাশে আছি। পরের মুহূর্তেই ভাবল, এই সব কি মাথার মধ্যে আসছে? সামান্থা কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলো। এর মধ্যে বেচারির চোখ, মুখ, গাল লাল হয়ে গেছে। ছগিরের মেয়েটার জন্যে ভীষণ মায়া হল। পকেট থেকে সব সময়ের সঙ্গী, লাল রুমালটা বের করে সামান্থাকে দিল; চোখ মুখ মুছার জন্যে। সামান্থা বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল লাল রূমালটা হাতের মুঠিতে নিয়ে।
ছগির এই প্রথম এক জন স্বর্ণ কেশী মেয়েকে কাঁদতে দেখল। কি অদ্ভুত, মানুষ কত ভাষায় না কথা বলে।
কিন্তু কান্নার ভাষা কেমন করে একই রকম হয়?
২১
তিন দিন পরে সামান্থা আবার রেস্টুরেন্টে আসল। কিছু খাবার অর্ডার সামনে নিয়ে এ দিক ও দিক করতে থাকল। ক্ষুধা থাকলেও খাবার মুখ দিয়ে যাচ্ছে না। কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছে। গত কয় রাত ভাল করে ঘুম হয় নি। শুধু ছগিরের মুখ ভেসে আসে। এত দিন সারাক্ষণ মা সাথে সাথে থাকতেন। নিঃসঙ্গ মাকে ছাড়া অন্য কোন ভাবনা মাথায় আসে নি। তাই কোন ছেলের সাথে মেশা হয় নি। এ রকম হওয়াটা কি বয়সের কারণ, না কি সে এই ইন্ডিয়ান ছেলেকে ভালোবাসতে চায়।
মা ইন্ডিয়ান খাবার পছন্দ করতে শিখেছিলেন বাবার কাছ থেকে। মার সাথে খেতে খেতে এক সময়ে সামান্থারও ইন্ডিয়ান খাবার প্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু ওখান থেকে আসা এক ছেলের জন্যে সে দুর্বল হয়ে পড়বে, সেটা সে কখনো ভাবতে পারে নি!
অস্থিরতা যাচ্ছিল না। এ রকম কেন হচ্ছে। আজকে সে তো আসলে খেতে আসে নি। ছগিরের টানে ছুটে এসেছে। ছগির মনে হয় ব্যাপারটা বুঝল। অনেক চেষ্টা করার পরেও, কাজ শেষ করতে অনেক সময় লেগে গেল। সামান্থা অনেকটা লজ্জার মাথা খেয়ে ছগিরের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কয়েক দিন আগে যাকে চিনত না, তার জন্যে এত টান কিভাবে আসে?
তার পরে দু জনে বের হল। পাশাপাশি হাঁটছিল। অনেকটা নির্দ্বিধায় সামান্থা ছগিরের হাত ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাত ছগিরের হাতের মধ্যে চলে গেল। ছগির প্রথমে বুঝল না, বিষয়টা কি হচ্ছে। এর আগে কখন কোন মেয়ের হাত এই ভাবে ধরার সুযোগ পায় নি। খুব ভাল লাগতে লাগল। মনে হল শুধু নরম তুল তুলে হাত না; পুরো মানুষটাই তার কাছে আশ্রয় চাচ্ছে। সে কেমন করে না বলতে পারে? হউক না সে অন্য কোন ভাষার মানুষ। সে তো ওদের ভাষা পারে। না- সে কোন ভাবেই না বলতে পারবে না। সখিনার ভালবাসা বুঝতে না পারার কষ্ট, তাকে প্রতিটা মুহূর্তে তাড়িয়ে বেড়ায়। না, সে কোন ভাবেই এই মেয়েকে না বলতে পারবে না। তাকে বাকীটা জীবন সাথে সাথে রাখবে। বুকের মধ্যে আগলে রাখবে।
সামান্থার প্রশ্ন চিন্তাটা ভেঙ্গে দিল। ও জিজ্ঞাসা করল, তোমার পকেটে কি ওই লাল রূমালটা আছে? ওটা কি সব সময় তোমার সাথে থাকে?
ছগির রুমালের গল্প বলতে বলতে কিছুটা উদাস হল। রুমালে কি লেখা আছে তাও বলল। বুকের কোণায়, কষ্টের পাহাড়কে আরও বেশী ভারী মনে হল। সামান্থা বিষয়টা ধরতে পারল। ছগিরকে অবাক করে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে? আমাদের ভালোবাসায় দেখবে, সব দুঃখ কেমন হালকা হয়ে ভেসে যাবে।
ছগিরও ওকে জড়িয়ে ধরল, আমি অবশ্যই তোমাকে ভালোবাসব।
২২
ভালোবাসার সংসারে গড়তে বেশী সময় লাগল না। বছর খানেকের মধ্যে দু জনে বিয়ে করল; ঘর সংসার আরম্ভ করল। সাথে সাথে বাড়ল খরচ। ছগিরের বাঙালি মানসিকতা, সামান্থাকে ঘরের বাইরে কাজ করতে দিতে রাজী হল না। টানাটানি বাড়তে লাগল। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে চাকরির পয়সায় বাড়ি ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া খরচ মেটাতে হিমসিম অবস্থা হল। তার পরে মায়ের জন্যে কিছু টাকা পাঠাতে হয়। টাকা পয়সার কমতি সংসারে চাপ সৃষ্টি করল। সামান্থা কয়েকবার ঘরের বাইরে যেয়ে কাজ করে বাড়তি কিছু আয় করার অনুমতি চেয়ে হতাশ হল।
বেচারা ছগির ভেবে পেল না, সে কিছু বাড়তি আয় কি ভাবে করতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় কাজের চেষ্টা করল, কিন্তু তেমন কোন উপায় করতে পারল না। ইংল্যান্ডে তখন মন্দা চলছে। অনেক স্থানীয়দের পর্যন্ত কাজ নাই। ছগির বিদেশী, তার পরে তেমন কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা নাই। সামান্থাই অন্য ধরণের একটা বুদ্ধি দিল। সে সময়ে ইংল্যান্ড থেকে অনেক মানুষ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এমেরিকায় চলে যাচ্ছিল। ওখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা রমরমা। ক্যালিফোর্নিয়া নামের এক জায়গায় মাটি খুঁড়লে সোনা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। কোন রকম এমেরিকায় যেয়ে পৌছতে পারলে, পিছনে ফিরে আর তাকাতে হবে না।
কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না। জাহাজে করে যেতে হয় এমেরিকায়। ছগির সামান্থাকে রসিকতা করে বলল, যে ভাবে চট্টগ্রাম থেকে খালাসির চাকরি নিয়ে ইংল্যান্ডে এসেছিল সেই চেষ্টা করবে কি – না। সামান্থা কঠিন ভাবে বলল, না। আমার পানি খুব ভয় লাগে। কত মানুষ জাহাজ ডুবিতে মারা যায়। সে রকম সময়ে খবর আসল টাইটানিকের প্রথম যাত্রার খবর। পত্র পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল, এ জাহাজ কখন ডুববে না। সামান্থা বলল, তুমি এই জাহাজেই যাবে। টাইটানিকের টিকেটের দাম অন্য জাহাজ থেকে অনেক বেশী। সব চেয়ে কম দামী, থার্ড ক্লাস টিকেটের দাম ৭৫ পাউন্ড (এখনকার হিসেবে প্রায় ১৫০০ ডলারের সমান—) । ছগির বলল আমার কাছে এত টাকাও নাই, আমার যাওয়াও নাই।
পরের দিন সামান্থা ছগিরের হাতে ১০০ পাউন্ড তুলে দিয়ে বলল, তুমি টাইটানিকেই যাচ্ছ। অবাক হয়ে ছগির বলল, তুমি এত টাকা কোথায় পেলে? সামান্থা জানাল, আমি মায়ের অলংকার বিক্রি করে দিয়েছি। ছগির রাগ করে বলল, তুমি এই কাজ করতে পার না। আমি এই টাকা নিব না। সামান্থা ছগিরের কানের কাছে মুখ দিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল, তুমি এমেরিকায় যেয়ে টাকা জমিয়ে প্রথমে আমাকে নিয়ে যাবে; তার পরে আমাকে মায়ের বিক্রি করা অলংকার কিনে দিবে।
এর পরে সামান্থা ছগিরের কানে ছোট একটা কামড় দিল, তার পরে লম্বা একটা চুমু। তার পরে ফিস ফিস করে বলল, মিস্টার আমার পেটে কিন্তু তোমার বাচ্চা বড় হচ্ছে।
ছগির প্রথমে উঠে দাঁড়াল, বুঝার চেষ্টা করল সামান্থার কথার কি অর্থ। পরের মুহূর্তে শূন্যে লাফ দিয়ে হাত ছুঁড়ে বলল, ইয়েস !!আমি জানতাম। ইয়েস!! ইয়েস!!!
সামান্থা ছগিরকে বলল, তোমার লাল রুমালটা বের কর দেখি। ছগির অবাক হয়ে দেখল, রুমালে হলুদ সুতা দিয়ে লেখা, Go bird tell him that he does not forget me. আবার আরেক কোণায় লেখা, Samantha loves Sagir.
২৩
টাইটানিকে হু হু করে পানি ঢুকছে। চারিদিকে জান বাঁচানোর জন্যে মানুষের আর্ত চিৎকার আর বিরাট হট্টগোল। সবাই লাইফ বোটের কাছে ভিড় করলো। কিন্তু শুধু শিশু, মহিলা আর বৃদ্ধদের উঠিয়ে নৌকা নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। ছগির ফাস্ট অফিসার মারডকের আহ্বানে নৌকা নামানোর কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। মনে একটা ক্ষীণ আশা, হয়ত শেষের দিকে কোন নৌকায় তার ঠাঁই মিলে যাবে। কিন্তু শেষ নৌকাও পানিতে নেমে গেল। ছগির চিৎকার করে বলল, আমাকে তোমরা নৌকায় নাও। আমার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। আমাকে বাঁচতে হবে। কিন্তু বেচারার কথা কারোর কানে যেয়ে পৌঁছল না।
এর মধ্যে অনেকেই পানিতে লাফ দিয়ে পড়ে সাঁতার কাটার চেষ্টা করে শান্ত হয়ে পড়েছে ।
সিলেটের তরঙ্গ গ্রামের ছেলে ছগিরও পানিতে লাফ দিল। শেষ চেষ্টা, সাঁতরে যদি প্রাণ বাঁচান যায়! তরঙ্গ গ্রামে খালের বড় সাঁকোর থেকে কতবার সে লাফ দিয়ে পানিতে পড়েছে। ঝপ করে একটা শব্দ হত। কি আনন্দ, কি আনন্দ। সাঁতার কেটে ডাঙ্গায় উঠে, সাঁকোর থেকে আবার লাফ দিত। ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকত এই বিরামহীন আনন্দ মেলা।এই বার লাফ দেয়ার সময় কোন আনন্দ হল না। মনটা ভরে উঠল তিক্ত বিষাদে।
আটলান্টিকের পানি সেই মুহূর্তে মারাত্মক বিপদ জনক ঠাণ্ডা। তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট ( -২ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। যারা পানিতে পড়েছিল কিংবা সাঁতার কাটার চেষ্টা করেছিল, তাদের সাথে সাথে হাইপোথারমিয়া হল। প্রচণ্ড কাঁপুনির সাথে হৃদকম্পন কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেল।
২৪
টাইটানিকের বিপদ বার্তা পেয়ে ভোর চারটার দিকে জাহাজ আর এম এস কারপাথিয়া যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
লাইফ বোটে জায়গা থাকতেও রেষারেষির কারণে পাঁচশ মানুষকে উঠানো হয় নি। কিছু মানুষ আতংকে হার্ট ফেল করে মারা গেছে। আর বাকীদের মৃত্যু হল হাইপোথারমিয়ায়। ঠাণ্ডায় মৃত মানুষগুলো জমে সব বরফ হয়ে রইল।
ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া শত শত লাশের মধ্যে এক জন বাঙালির লাশও ছিল। তার হাতের মুঠোয় ছিল সেই লাল রূমাল, “যাও পাখি বল তারে……… that he does not forget me”।
ছগির কথা রেখেছিল। মা, সখিনা, সামান্থাকে সে ভুলে নি, এক মুহূর্তের জন্যেও, এক বারের জন্যেও না।
কিন্তু একটু ভাল জীবনের আশা, একটা সুন্দর গোছান জীবনের স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেল। দু দু বার দেশান্তরী হয়েও সোনার হরিণ আর ছোঁয়া হল না।
ওর অপেক্ষায় মা, সামান্থা; হয়ত সখিনা এখনও দিন গুনছে!
তবে টাইটানিকের অর্কেস্ট্রার সুর একটা ব্যাপার প্রমাণ করেছে, মৃত্যুতে মানুষ বিধাতার কাছাকাছি হয়ঃ Neared to My God……Propior Dio.
৮ আগস্ট, ২০১৪
কাজী হাসান
প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com