২৬ শে মার্চ 

১৯৭১ সালের মার্চ মাস। 

তেজগাঁও এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে রাস্তা চলে গেছে মহাখালী, টঙ্গি হয়ে জয়দেবপুরের দিকে। স্টাফ রোড ছাড়িয়ে আরও কিছুদূর গেলে নতুন এয়ারপোর্টের কাজ চালু হয়েছে। খুব না কি সুন্দর হবে, একেবারে রাজ প্রাসাদের মত। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সব দিক দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও, বড় বড় বিল্ডিং বানাতে মনে হয় কার্পণ্য করে না। আসাদ গেটের পাশে বিশাল জায়গা নিয়ে সেকেন্ড ক্যাপিটাল বানাচ্ছে, আর তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট। এখনকার সংসদ ভবন, এয়ারপোর্ট না-কি বেশি সেকেলে। তাই একেবারে অত্যাধুনিক পরিকল্পনা করেছে। 

নতুন যে এয়ারপোর্ট হচ্ছে, সেটাকে ছাড়িয়ে বেশ বড় জায়গা নিয়ে ডিআইটি উত্তরা মডেল টাউন বানানোর কাজ চলছে। সেখানে যে সব গ্রাম ছিল, ডিআইটি নাম মাত্র দিয়ে সেগুলো হুকুম দখল করে বাড়ি বানানোর প্লট বানাচ্ছে। সাথে সাথে রাস্তা ঘাটও হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু পাকা দালান উঠেছে। উচ্চ পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা একেবারে নাম মাত্র দামে বরাদ্ধ পাচ্ছে। শোনা গেছে, আয়তনে ধানমণ্ডি থেকে বড় হবে। এলাকাবাসীর প্রয়োজনীয় সব কিছু উত্তরাতেই পাওয়া যাবে। তাদের কষ্ট করে ফার্মগেট, মতিঝিল যেতে হবে না। 

মহাখালী থেকে টঙ্গি-জয়দেবপুর রোড ধরে গেলে, হাতের বাম দিকে উত্তরার বেজোড় সংখ্যার সেক্টর। রাস্তার উল্টোদিকে জোড় সংখ্যার সেক্টর। কোন দিকে কোন সেক্টর হবে ঠিক হলেও, আশে পাশে ভিতরের দিকে বেশ অনেকগুলো গ্রাম রয়ে আছে। তবে ভবিষ্যতে ডিআইটি সে গ্রামগুলোও হুকুম দখল করে ফেলবে বলে জোড় গুজব আছে। হাতের বামের তিন নম্বর সেক্টর ছাড়িয়ে ভিতরে গেলে পাঁচ নম্বর সেক্টর। তার পরে এক অজ গ্রাম। নাম আহালিয়া। 

আহালিয়া গ্রামের অল্প কিছু মানুষ চাষাবাদের সাথে যুক্ত। বাকীরা পায়ে হেটে টঙ্গি চলে যেতে পারে। সেখান থেকে বাসে করে ঢাকা কিংবা জয়দেবপুরে যেয়ে কাজকর্ম করে। পাশেই তুরাগ নদীর ধারে শীতকালে বিশ্ব ইজতেমা হয়। একেবারে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত। গ্রামের কিছু মানুষ তখন ইস্তেমা ময়দানে খাবার-দাবার বিক্রি করে বেশ আয় করে নেয়। 

যে সব গ্রামবাসী কাজ কর্ম নিয়ে দূরে চলে গেছে, তাদের অনেকে ইস্তেমার সময়ে ফিরে আসে। আত্মীয়স্বজনে সাথে দেখা হয়, চাইলে ইস্তেমায় শরীক হওয়া যায়। এলাকার ব্যবসায়ীদের সাহায্য করে বাড়তি কিছু আয় রোজগারও করা যায়। গ্রামবাসীর এ রকম ব্যস্ততার সময়ে একজন বাড়ি ফিরে এসেছে। প্রায় দেড় বছর পরে। নাম চন্দন। 

চন্দন বাড়ি এসেছে ডিসেম্বরের শেষ দিকে। প্রথমে বলেছিল, সপ্তাহ কয়েক থেকে চাকরিতে ফিরে যাবে। এখন প্রায় আড়াই মাস হতে চললো। কবে ফিরে যাবে, সে সম্পর্কে কিছু বলছে না। কানা ঘুষা চলছে, বিয়ে করবে। হয়ত গ্রামেই থেকে যাবে। শুভকাঙ্খিদের অন্য কথা, চারিদিকে যেমন গণ্ডগোল, বাড়িতে থেকে গেলেই ভাল। 

গ্রামের মানুষরা জানে চন্দন কুষ্টিয়া সুগার মিলে কাজ করে। মাঝে মধ্যে টাকা পাঠায়। বাড়িতে শুধু মা। দু পাশের দু বাড়িতে দু চাচা পরিবার নিয়ে থাকে। বিপদে আপদে ডাক দিলে আসে। যদিওবা জমি-জমা নিয়ে দীর্ঘ দিনের বিরোধ। কিন্তু ডিআইটি জমি নিয়ে ফেলতে পারে জানার পর বিরোধ বেশ কমে এসেছে। 

চন্দনের খুব কাছের দু জন বন্ধু আছে। তারাই একমাত্র জানে চন্দন এক সময়ে সুগার মিলে কাজ করলেও, এখন আর সেই কাজ করে না। চন্দন এক সু-বিশেষ কাজের সাথে জড়িত।

উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানির কার্ল মার্ক্স তত্ত্ব দিলেন, সমাজতান্ত্রিক শ্রেণীহীন সমাজের। সব মানুষ সমান, কেউ রাজা-প্রজা না। তরুণদের এই মতবাদ ভীষণভাবে আকৃষ্ট করলো। সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিন ও চীনে মাও সে তুঙের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হল। দুই দেশেই সমাজতান্ত্রিক সরকার তৈরি হল। একই মতবাদে ভিত্তি হলেও, দুই দেশের নেতাদের সমাজতন্ত্র কায়েমের কৌশল নিয়ে বিরোধ আরম্ভ হল। মিত্র হওয়ার জায়গায়, তারা একের অপরের শত্রুতে পরিণত হল। 

সমাজতন্ত্রের ধোঁয়া পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা কোণায় ছড়িয়ে পড়লো। পরবর্তীতে কিউবা, উত্তর কোরিয়া সহ আরও কিছু দেশে বিপ্লব হল। কমরেডরা ক্ষমতা দখল করলো। বঙ্গ কিংবা তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও কমরেডরাও শ্রেণীবিহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখা আরম্ভ করলো। কিন্তু বললেই তো আর বিপ্লব করা যায় না। বাঙালি কমরেডরা রুশ ও চীনপন্থি শিবিরে ভাগ হয়ে গেল। সমাজতন্ত্র কায়েমের কৌশল নিয়ে কমরেডরা ব্যাপকভাবে দ্বিধা বিভক্ত হল। 

একদল বাঙালি কমরেড সশস্ত্র বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকলো। তাদের মতে নির্বাচন কিংবা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে বুর্জোয়াদের সরানো যাবে না। চলতে থাকলো তার প্রস্তুতি। ভারতের নকশাল আন্দোলনের অনুকরণে পূর্ব পাকিস্তানেও সমাজতন্ত্রীরা তাদের অস্ত্র, গোলা-বারুদ জড় করতে থাকলো। কিন্তু এই কাজের জন্যে দরকার অর্থের। কিন্তু অর্থ আসবে কোথা থেকে? শোনা যায়, কিছু টাকা পয়সা বিদেশী সমাজতন্ত্রীদের কাছ থেকে এসেছিল। 

একদল বাঙালি কমরেড নিজেরাই নেমে পড়লো, অর্থ সংগ্রহের কাজে। গ্রামে গঞ্জে জোতদার, জমিদার, অর্থবান বুর্জোয়াদের থেকে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়া আরম্ভ করলো। কোন বাড়িতে বন্দুক থাকলে, সেটা লুট করে নিত। তারা নিজেদের নাম দিল কম্যুনিস্ট, সর্বহারা। অবশ্য গ্রামের মানুষরা বলতো ডাকাত। 

সরকার নির্দেশ দিল এই সব অস্ত্রধারীদের নির্মূলের। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হতে থাকলো। পুলিশ গুপ্তচর লাগালো এদের খবর দেয়ার জন্যে। কমরেডরা গা ঢাকা দিল। তখন বলা হত কমরেডরা আন্ডারগ্রাইউণ্ডে চলে গেছে। তবে, আন্ডারগ্রাইউণ্ডে গেলেও, এদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় নি। আওয়ামী লীগকে তারা ভাবতো বুর্জোয়াদের দল এবং শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার শত্রু। 

আহালিয়া গ্রামের শুধু রতন আর সিরাজ জানতো, চন্দন আসলে কুষ্টিয়া সুগার মিলে কাজ নিলেও, ছয় মাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। সে এক বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্য। রতন, সিরাজ দু জনই চন্দনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিন জনে এক সাথে বড় হয়েছে। একই ক্লাসে পড়তো।৩

যাহা রটে তাহা কিছু বটে। গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল, এইবার চন্দন বিয়ে করবে। মা চন্দনকে রাজী করাতে পেরেছেন। এ জন্যে মা কে অনেক কাঠ খড় পুড়াতে হয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে মা চেষ্টা করছেন। দেখতে দেখতে ছেলের বয়স বাইশ পার হয়ে গেল। চাকরি নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল প্রায় ৬ বছর হয়ে গেছে। গ্রামের ছেলেরা আরও অনেক কম বয়সে বিয়ে করে। 

মা বিয়ের কথা বললেই, চন্দন বলতো এখনো সময় হয় নি। বাবারও ইচ্ছা ছিল একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তার সেই সৌভাগ্য হয় নি। বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন। পায়ে গুলি লেগেছিল। উনসত্তরের গণ আন্দোলনে দেশ তখন উত্তাল। চন্দনের বাবা রহিম আলি অন্য কিছু বাঙালির সাথে টঙ্গি রেল স্টেশনের জয় বাংলা শ্লোগান দিচ্ছিলেন। হঠাৎ সিদ্ধান্ত হল রেল লাইন উপড়ে ফেলার। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। তরুণ বাঙালিরা লেগে পড়লো রেল লাইনের তুলে ফেলার কাজে। 

সেই সময়ে পুলিশ গুলি চালালো। গুলি লাগলো রহিম আলির বাম পায়ে, হাঁটুর দু ইঞ্চি উপরে। তার পরেও কয়েকজনের সাহায্যে কোন রকমে গ্রেপ্তার এড়িয়ে বাড়িতে ফিরে এলেন। মেডিকেলে গেলে ভাল হত। কিন্তু সেখানে গেলে পুলিশ ধরে ফেলবে। টঙ্গি বাজারের ডাক্তার শিকদার কোনভাবেই রাজী হলেন না চিকিৎসা করতে। পায়ের গুলি পায়ে থেকে গেল। সাথে হয়েছিল প্রচুর রক্তক্ষরণ। বাসায় ফিরেই জ্ঞান হারালেন অখ্যাত এক বাঙালি আন্দোলনকারী। 

পরের দিন জ্ঞান ফিরলো। আরম্ভ হল প্রচণ্ড ব্যথা আর সাথে আকাশ পাতাল জ্বর। বাজার থেকে কেনা ওষুধ খেয়ে কোন উপকার হল না। তিন দিনের মাথায় ক্ষত জায়গা থেকে গন্ধ বের হওয়া আরম্ভ হল। সম্ভবত গ্যাংরিন। রহিম আলি সাত দিনের মাথায় বউয়ের ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে, চোখ দুটো চিরতরের জন্যে বন্ধ করলেন। বাংলাদেশের মুক্তির জন্যে অজানা, অখ্যাত শহীদ সৈনিকদের কাতারে তিনিও অন্তর্ভুক্ত হলেন। 

মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে তার প্রচণ্ড ব্যথা, কষ্ট হলেও; তিনি পরকালে যেতে পেরেছিলেন ভীষণ বড় একটা স্বপ্ন নিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। সেখানে কোন অভাব থাকবে না, দুঃখ থাকবে না, বঞ্চনা থাকবে না। মারা যাবার আগে অনেক কষ্টে জানতে চাইলেন, চন্দন এসেছে কি-না। মা বললেন, তাকে চিঠি দেয়া হয়েছে। বেচারা রহিম আলি আবারো বিড় বিড় করে স্ত্রীকে বললেন, “চন্দন যেন জয় বাংলা...।” কথা শেষ হওয়ার আগেই তার সব শক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেল।

বাবার মৃত্যুর সাত দিন পর চন্দন বাড়ি এলো। বাবার কবরে যেয়ে সারাদিন ধরে কাঁদলো। বাবার একমাত্র ছেলে হয়ে পরিবারের কোন কাজে আসতে পারলো না। চূড়ান্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো। সে তো শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত লড়ে যাবার শপথ করে এসেছে। এইদিকে মাকে একা রেখেই বা যায় কি করে। তা ছাড়া, মা জানিয়েছেন বাবা তাকে জয় বাংলা বিষয়ক কিছু একটা জানাতে চেয়েছিলেন। 

চাইলেই তোর আর বিপ্লবী কাজ থেকে ইস্তফা দেয়া যায় না। এটা অনেকটা একমুখী রাস্তা। একবার গেলে বের হওয়া যায় না বললেই চলে। বাবার মৃত্যুর পরে চন্দনের মায়ের পাশে দাঁড়ানোটা যে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সেটা সে ভালো করেই বুঝলো। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলো, কি করা যায়। মাকে তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কথা বললো না; উনি যদি আবার আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শুধু জানালো, মা কিছু দিন সময় দিতে হবে। আমার জায়গায় কাজ করতে পারবে এমন মানুষ পেলেই, আমি চলে আসবো। 

চন্দন যখন ক্লাস এইটে পড়ে, তখনকার কথা। বয়স ১৪-১৫ হবে। দাঁড়ি-মোছ গজানো আরম্ভ করেছে। বিশাল কিছু করার প্রচণ্ড মনোবল হয়ত প্রকৃতি হয়ত এ সময়ে এমনিতেই দিয়ে দেয়। তিন বন্ধু চন্দন, রতন, সিরাজ লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি সিগারেট টানে। তখন তাদের উচ্ছলতায় ভরা প্রতিটা মুহূর্ত। একবার দোকানে সিগারেট কিনতে এসে দেখে কারোর কাছেই পয়সা নাই। দোকানিকে সিগারেট দিতে বলে, একে অপরের দিকে তাকালো। কিন্তু কেউ মাথা উঁচু করে তাকালো না। এই সমস্যায় আগে কখনো পড়তে হয় নি। কারোর না কারোর পকেট থেকে কিছু পাওয়া গেছে। 

তিনজনই মনে হল, হঠাৎ দেবদূতের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। পাশ থেকে কেউ এক জন বলে উঠলো, কি টাকা লাগবে না-কি? ঘুরে দেখলো মাঝ বয়সী একজন কথা বলছেন। থুতনিতে সামান্য দাঁড়ি। কাচা পাকা চুল। পরনে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি। বেশ ভদ্রলোক ধরনের দেখতে। লম্বাই বলা যায়। একটু আগে বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছিলেন, তখন এত লম্বা মনে হয়নি। 

ভদ্রলোক শুধু তিন বন্ধুকে সিগারেট কিনে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। একসাথে চা, বিস্কুট খেলেন। মনে হল যেন, তার বয়স এই তিন কিশোর থেকে খুব একটা বেশী না। খেলা-ধুলা থেকে আরম্ভ করে, পরিবার, স্কুল, পড়ালেখা, আন্দোলন নিয়ে কথা হল। তিনি ছোট করে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনের কথা বললেন। সুন্দর করেই বুঝালেন, দেশকে শত্রু মুক্ত করতে হলে, আমাদের এ রকম অনেক ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনের দরকার। 

শত্রু মুক্ত হলে, দেশে দারিদ্র, দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। সবাই সমান মানে সমাজতন্ত্র আসবে। ঘণ্টা খানেক তিনি আড্ডা দিলেন। এর মধ্যেই তিনি চন্দন, রতন, সিরাজের পূর্ণ আস্থা অর্জন করলেন। লোকটার কেমন যেন একটা মোহনীয় ক্ষমতা ছিল। 

বিদায় নেয়ার সময়ে বললেন, “আমাকে তোমরা জালাল ভাই বলে ডাকবে। আমি আগামী শুক্রবার আবার এখানে আসবো। তোমরা এসো। আবার খাওয়া-দাওয়া, কথা-বার্তা হবে।”

চার-পাঁচ বার চায়ের দোকানে আশে পাছে আড্ডা দেয়ার পর, তিন জন গেল জালাল ভাইয়ের আস্তানায়। সেটা কাছেই, পায়ে হেটে যাওয়া যায়। টঙ্গি বাজার ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা ডান দিয়ে নালার পাশ দিয়ে চলে গেছে, তার শেষ মাথায় কয়েকটা টিনের চালের বাড়ি। সেখানকার একটা বাড়িতে জালাল ভাই ওদেরকে সোমবার বিকাল চারটায় আসতে বলেছিলেন। 

টিন বন্ধুর অবাক হওয়ার পালা বাকীই ছিল। আরও গোটা বিশেক মানুষ সেখানে মেঝেতে বসে আছে। জালাল ভাই কথা বলছেন। অন্যরা শুনছে। তিনি কেমন একটা বক্তৃতার ভঙ্গিতে ভরাট কণ্ঠে দরদ দিয়ে কথা বলছেন, “আমাদের হাতে বেশী সময় নাই। পুলিশ আমার কথা জানতে পেরেছে। আমাকে আবার আন্ডারগ্রাউণ্ডে চলে যেতে হবে”। 

জালাল ভাই কথা থামিয়ে তিন বন্ধুকে বাকী সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি বলতে লাগলেন, “এই তিন জন এখনও স্কুলে যায়। আমাদের মূল মন্ত্রে ওরাও বিশ্বাস এনেছে। আমি একেবারে নিশ্চিত আমাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নতুনদের হাত থেকেই হবে।” 

এইবার জালাল ভাই একটু বিরতি নিলেন। সবাই এসে তিন বন্ধুকে কমরেড হিসেবে সম্বোধন করে, হ্যান্ডশেক করলো, স্বাগতম জানালো। জালাল ভাই শুধু এগিয়ে এসে এক এক করে তিন জনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ফিস ফিস করে বললেন, “আজ থেকে তোমরাও কমরেড।” 

জালাল ভাই ঘণ্টা দেড়েক কথা বললেন। তিন বন্ধুর বিস্ময়ের মাত্রা বাড়তে থাকলো। তিনি তো স্কুলের হেড মাস্টার স্যার থেকে সুন্দর করে সব বুঝিয়ে বলছেন। মার্ক্স, লেনিন, মাওকে নিয়ে অনেক অজানা কথা বললেন। বিপ্লবী ফিডেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়াভারের দুঃসাহসিক অনেক ঘটনা জানালেন। ওরা মানসলোকে দৃশ্যগুলো দেখতে পেল। রক্ত টগবগ করতে থাকল। মনে হল ছুটে যেয়ে এখনই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়তে। 

উপস্থিত সবাইকে বিভিন্ন ধরণের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হল। অর্ধেক সংখ্যক সদস্যদের বলা হল, তাদের কাজ হবে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ নিয়ে অধ্যায়ন চালিয়ে যাওয়া। সাথে সাথে অন্যদের উদ্ধুদ্ধ করে কমরেডদের সংখ্যা বাড়ানো। শেষে একে একে সবাই বিদায় নেয়া আরম্ভ করলো। 

এর মধ্যে চন্দন, রতন, সিরাজ জালাল ভাইয়ের জায়গায় কমরেড জালাল বলা আরম্ভ করেছে। তিন বন্ধু খুব রোমাঞ্চিত হল। নিজেদের খুব সম্মানিত মনে হতে লাগল। ওদেরকে এক কোণায় নিয়ে কমরেড জালাল আরও কিছু কথা বললেন। চন্দনকে জানালেন, “তোমাকে নিয়ে আমার অনেক বড় আশা। তুমি চে গুয়াভারের মত বিশাল বড় নেতা হবে। তোমার দুই বন্ধুও নামজাদা কমরেড হবে। পুরো জাতি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।”

বছর খানেক পর চন্দন বাবা-মাকে জানাল, সে কুষ্টিয়া যাবে। সেখানে তার একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। সংসারে টানাটানি ছিল। বাবা বেশী আপত্তি করলেন না। মা জাহানারা একেবারে বেঁকে বসলেন, “পড়ালেখা কর। বাড়িতে থেকে না হয় আশে পাশে কোন কাজ খুঁজে নাও।” বাবা উত্তরে বললেন, “পড়ালেখা করে তোমার ছেলে তো আর জজ-ব্যরিষ্টার হবে না। যেতে যাচ্ছে, যেতে দাও। আমি আরও ছোট বয়স থেকে চাকরি করছি।” 

কুষ্টিয়ায় বিপ্লবী বাহিনীর ঘাটি ছিল। প্ল্যান মোতাবেক চন্দন চাকরির পাশাপাশি বিপ্লবের সামরিক ট্রেনিং নেয়া আরম্ভ করলো। বন্দুক, পিস্তল চালানো, বোমা বানানো, বোমা ছোড়া জাতীয় অনেক কিছু। কাজে পটু হতে বেশী সময় লাগলো না। ছয় মাসের মাথায় সে নিজেই অন্যদের এই সব কাজ শেখানো আরম্ভ করলো। ঢাকার হাই কম্যান্ড থেকে খবর আসলো, চন্দন যাতে চিনি কলের চাকরি ছেড়ে দেয়। পার্টি তার জন্যে মাসোহারার ব্যবস্থা করবে। সেখান থেকে চাইলে কিছু টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারবে। পুলিশের খাতায় তারও নাম চলে গেছে। তাকে এখন আন্ডার গ্রাউন্ড মানে খুব গোপনে কাজ করতে হবে। 

চন্দন অন্যদের অস্ত্র চালানো শেখালেও, নিজে কখনো একশ্যানে যায় নি। একশ্যান বলতে গ্রামের জোতদারদের বাড়িতে আক্রমণ করে অস্ত্র, অর্থ-কড়ি ছিনিয়ে আনা। কালে ভদ্রে নির্দেশ আসে, জোতদারদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। মানে হল তারা বড় ধরণের শ্রেণী শত্রু, বিপ্লবের প্রতিবন্ধক। সিদ্ধান্ত এলো, পদ্মার পারের গ্রাম রামুতে দশ জনের দল নিয়ে অভিযান চালাতে হবে। করিম মাতব্বরকে সরিয়ে দিতে হবে। এর আগে এক দল এই কাজের চেষ্টা করেছিল, তখন করিম মাতব্বরের দল ওদের ঘেরাও করে ফেলেছিল। দলের তিন জনকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। মাতব্বর নিজেই দুজনকে গুলি করেছিল। তিন জন কমরেড শহীদ হয়েছিল বিপ্লব না দেখেই। 

মনের থেকে সায় না পেলেও, চন্দন তার দল বল নিয়ে করিম মাতব্বরের বাসায় চড়াও হল। করিমের দল কোন গোলাগুলি চালানোর সুযোগ পেলো না। বিপ্লবীরা ওদের বেঁধে ফেললো। চন্দন তার দায়িত্ব পালনের জন্যে করিম মাতব্বরের দিকে বন্দুক তাক করলো। মাতব্বরের স্ত্রী, কন্যারা কান্না জুড়ে দিল। চন্দন বন্দুকের ট্রিগার টিপতে পারলো না। হাত থর থর করে কাঁপতে লাগলো। বুকের কম্পন বেড়ে পাঁচ গুণ হয়ে গেল। যেই লোক কয়েকদিন আগে নিজের হাতে তার দু জন সহযোগীকে খুন করেছে , তাকে গুলি করতে কোন দ্বিধাই হওয়ার কথা না। অন্যদের সে শিক্ষা দিয়েছে, শ্রেণী শত্রু বুর্জোয়ারা গরিবের রক্ত চুষে খাচ্ছে। ওদের কোন মাফ হতে পারে না। অন্য কমরেডরা তাড়া দিচ্ছিল কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্যে। গ্রামবাসী ঘিরে ফেললেই বিপদ। 

না পারেনি। চন্দন কাজটা শেষ করতে পারে নি। শ্রেণী শত্রু হলেও, বাঙালি তো, একজন বাবা তো। সে কিভাবে একজন মানুষ খুন করবে। তার অপরাধ যাই হউক না কেন!

চন্দন মাকে কথা দিল, এই বার সে বিয়ে করে বউ রেখে যাবে। তার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কুষ্টিয়া থেকে চলে আসবে। মা যেহেতু জানেন না, চন্দন বিপ্লবী দলের সদস্য, তাই বলল, ফ্যাক্টরিতে তার জায়গায় অন্য মানুষ পেলেই, সে মা আর বউয়ের কাছে চলে আসবে। তার পরে বাড়িতে থেকেই কোন কাজের ব্যবস্থা করে নিবে। অবশ্য চন্দন শুনে এসেছে, তাকে কুষ্টিয়ায় বেশী দিন রাখা হবে না। স্থানীয় প্রশাসন তার সম্পর্কে জেনে ফেলেছে। তাকে তার গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে দেয়া হবে। চাইলে সে বিয়ে করতে পারবে। তার দায়িত্ব হবে নিজের গ্রামের মানুষদের সাথে মিশে যাবার। ঢাকার কাছাকাছি গ্রাম হওয়ার জন্যে, পার্টির তাকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা আছে। ভবিষ্যতে চন্দন গ্রামে থেকেই সমাজতন্ত্র কায়েমের কর্মকাণ্ড চালাবে। 

যেই ভাবা সেই কাজ। উত্তর পাড়ার সিদ্দিক ব্যাপারীর মেয়ে কুলসুমকে মা আগের থেকেই মনে মনে পছন্দ করে রেখেছিলেন। মা প্রস্তাব করতেই সিদ্দিক ব্যাপারী রাজী হয়ে গেলেন। তার অবশ্য সংশয় ছিল দেশের পরিস্থিতি নিয়ে, সারা দেশে জ্বালাও পোড়াও চলছে। মা বললেন, সে গুলো তো সব শহরে হচ্ছে। গ্রামে তো কোন সমস্যা নাই। সিদ্দিক ব্যাপারী সহজেই রাজী হয়ে গেলেন। ঠিক হয়ে গেল, দু সপ্তাহ পরে যেই শুক্রবার, সেই দিন বাদ আছর বিয়ে পড়ানো হবে। 

চন্দন বিপ্লবী কাজ থেকে কিছুদিনের বিরতি নিল। ভাবছিল দল থেকে হয়ত অনুমতি নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু না, কমরেড জালাল অনুমতির ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধু তাই না, দু হাজার টাকা দলের পক্ষ থেকে পাঠালেন বিয়ের খরচ-পত্র সামাল দেবার জন্যে। কৃতজ্ঞতায় দলের জন্যে মাথা নুয়ে আসলো। মনে মনে ঠিক করে ফেললো, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব না হওয়া পর্যন্ত তার সংগ্রাম চলতেই থাকবে। 

কপালে যাই থাকুক না কেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসটা যেন কেমন ছিল। চারিদিকে শুধু মিছিল, শ্লোগান, আন্দোলন। সাথে যোগ হল অসহযোগ। তার পরে দোকান-পাটে মালামাল তেমন আসছে না। টঙ্গি বাজারে হাতে গোণা কয়েকটা দোকান। বেশির ভাগই মুদির দোকান। শাড়ি কাপড়ের দোকান মাত্র একটাই। 

চন্দনের মা কুলসুম আর হবু বেয়াইনকে নিয়ে গেলেন টঙ্গি বাজারের সেই কাপড়ের দোকানে। কিন্তু তাদের চূড়ান্ত হতাশ হতে হল। দোকানে লুঙ্গি, গামছা, আর কিছু বসত বাড়িতে পড়ার সস্তা শাড়ি ছাড়া তেমন কিছু নাই। ওই দিকে চন্দন বলে রেখেছে, ভবিষ্যত বউয়ের জন্যে তার লাল শাড়ি লাগবেই। সেই জন্যে সে মায়ের হাতে পুরো এক হাজার টাকা তুলে দিয়েছে। 

এখন একমাত্র উপায় হল ঢাকা নিউ মার্কেটে যেয়ে দেখে শুনে শাড়ি ও অন্যান্য বিয়ের জিনিষ-পত্র কেনা। কিন্তু সেটা ভাবলেই তো হল না। এত দূর যাওয়া চাট্টিখানা কথা না। টঙ্গি থেকে মহাখালী, সেখান থেকে ফার্মগেট। তারপরে রিকশা নিয়ে নিউ মার্কেট। তিন জন্যে ফিরে এল বাড়িতে। তা ছাড়া তিনজন মহিলা গেলে, পথে যদি কোন সমস্যা হয়! 

চন্দন একেবারে অবাক। এত তাড়াতাড়ি কেনাকাটা হয়ে গেল? মায়ের থেকে সব শুনে বলল, “রতনকে তোমাদের সাথে দিচ্ছি। তোমারা কাল নিউ মার্কেটেই যাও।” চারিদিকে আন্দোলন, হৈ চৈ,মারামারি,ভাংচুর চলছে। চন্দনের মা খুশীই হলেন। সাথে একটা ব্যাটা ছেলে থাকলে ভালই হয়। 

রতন যেদিন চন্দনের মা, তার হবু শাশুড়ি ও কুলসুমকে নিয়ে ঢাকার নিউ মার্কেটের উদ্দেশ্য যাত্রা করলো; সেদিন ভোর বেলাটা অন্য দিনগুলোর মতই শান্ত, সুন্দর ছিল। শীতের ঠাণ্ডা ভাবটা বেশ কমে এসেছে। মনে হল, ঝরঝরে একটা দিন হবে। শুনেছে ঢাকা শহরে খুব আন্দোলন হচ্ছে। বাস স্ট্যান্ডে ভিড় নাই বললেই চলে। সবাই বলছে আরও গণ্ডগোল হবে। আর্মি নেমে কারফিউ দিতে পারে। শেখ সাহেবকে বন্দী করবে। তা হলে চারিদিকে অসন্তোষ আগুণের মত ছড়িয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। তার মধ্যে এতদূর যাত্রা করার মধ্যে কেমন একটা আশঙ্কা কাজ করছিল। যদি কোন সমস্যা হয়, যদি কোন বিপদ হয়, যদি কোন ক্ষতি হয়! 

সবার মনে একই চিন্তা কাজ করলেও, কেউ মুখ ফুটে কিছু বলল না। কোন আলোচনা করল না। বিয়েটা যেহেতু হচ্ছে, কাজগুলো তো করতেই হবে। গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন চলছে, তো চলছেই। হাতে সময় না থাকাতে, চন্দন বিশেষ কোন আপত্তি করল না। সম্ভব হলে নিজেই ওদের সাথে যেত। কিন্তু বিয়ের আগে, হবু বউয়ের সাথে বের হলে মানুষ কথা বলবে। তার পরেও চন্দন ওদের সাথে টঙ্গি বাজারের বাস স্ট্যান্ডে এসে বাসে উঠিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস ছেড়ে দিল মহাখালীর উদ্দেশ্যে। চন্দনের মন খচ খচ করতে লাগল। সময় বাড়ার সাথে সাথে, চন্দনের অস্থিরতাও কেমন বাড়তে লাগল। 

বেচারারা যদি জানতো, ঝকঝকে সুন্দর দিনটা কেমন একটা ভীষণ অন্ধকার রাত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। 

দিনটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ।

মহাখালীতে নেমে বেবি ট্যাক্সি নিয়ে একবারে নিউ মার্কেটে পৌঁছে গেল। কোন ঝামেলাই হল না। রতন যেয়ে বসল ড্রাইভারের পাশে, বাকী তিনজন পিছনের সিটে। প্রায় ঘণ্টা চারেক লেগে গেল দেখে শুনে বাজার সারতে। মাঝে অবশ্য তারা একটি বিরতি নিয়েছিল চা সিঙ্গারা খাওয়ার জন্যে। 

খেতে খেতেই কুলসুম তার মাকে কি যেন ফিসফিস করে বলল। মা’ও একই ভাবে উত্তর দিল। এভাবেই চলতে থাকল দু জনের কথা বলা বলি। শেষে কুলসুমের মা জানালেন, তার ছোট ভাই থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অফিসে চাকরি করে। কুলসুমের প্রিয় শফি মামা। তার বড় মেয়ে সখিনা কুলসুমের কাছের মানুষ, একেবারে প্রিয় বান্ধবীর থেকেও বেশী। দু পরিবারের মধ্যে বেশ যাতায়াত আছে। রতন ও জাহানারা বেগমের সেটা ভাল করে জানা আছে। সবাই একমত হল কুলসুমের মামার বাসায় যেয়ে ঘণ্টাখানেকের বেরিয়ে আসার। যদিওবা মামার সপরিবারে কুলসুমের বিয়েতে আসার কথা। 

মামা ওদের দেখে মহাখুশি হলেন। মামীকে বলে দিলেন, ভাল রান্না-বান্না করতে। ভাগ্নির বিয়ের আগে এই শেষ আসা। এর পরে জামাই নিয়ে আসবে। মামার মনটা কেমন একটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। সেই ছোট মেয়ে কুলসুম দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল! এখন তার আবার বিয়ে। সাথে সাথে নিজের মেয়ের কথা মনে হল। সখিনাও তো প্রায় সম বয়সী। মামা বাজারের থলে নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। যদিওবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ অঞ্চলে একেবারে বিরতিহীনভাবে মিছিল, মিটিং চলছে। চারিদিকে চাপ চাপ উত্তেজনা। দেখা যাক বাজার থেকে মাছ- মাংস কিছু পাওয়া যায় কিনা। 

কিছুটা হতাশ হয়ে ফিরলেন। বাজারের তেমন কিছু উঠে নি। বেশীর ভাগ দোকান-ই খুলে নি। সবজি, মাছ বিক্রেতাদের সংখ্যা হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন। মাংসের দোকানগুলো খুলে নি। এক মাছ বিক্রেতার শেষ রুই মাছটা তিনি কিনলেন। আর সাথে কিছু পোলাওয়ের চাল। মামী আস্ত মাছ দেখে বেশ বিরক্ত হলেন। বাড়িতে অতিথি থাকায় কোন শব্দ করলেন না। তবে মুখ কালো করে মামার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি দিলেন। সবাই বুঝতে পারলেন, আস্ত মাছ কেটে, পরিষ্কার করে ধুতে বেশ সময় লাগবে। অতিথিরা বেশ কয়েকবার না খেয়ে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মামা নাছোড়বান্দা। না খাইয়ে ছাড়তে কোনভাবে রাজী হলেন না। তিনি বললেন, প্রয়োজনে তিনি বেবি ট্যাক্সির ব্যবস্থা করবেন। একটানে টঙ্গি আহালিয়া গ্রামে নামিয়ে আসবে। 

মাছ, ভাত, ডাল সবজি রান্না করতে পুরো ঘণ্টা দুয়েক লেগে গেল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে আরও কিছুটা সময়। বিদায় নিতে নিতে একেবারে সন্ধ্যা। রতন বলল, রিকশা নিয়ে চলে যাবে শাহবাগ। সেখান থেকে মহাখালী হয়ে টঙ্গি যাবার বাস মিলে যাবে। কিন্তু না, চার জনের দল বেশী দূর এগুতে পারলো না। রোকেয়া হলের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখা হল, এক দল মিলিটারির সাথে। ওখান থেকে একজন পাক সেনা চিৎকার করে বলল, “হল্ট, হল্ট। কিদার যারা।” 

রিকশা, গাড়ি চলাচল ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। চার জন আর এগুতে পারলো না। মন খারাপ করে ফিরে আসতে হল মামার বাড়িতে। গ্রামে প্রত্যেকের পরিবার মহাচিন্তা করবে। যোগাযোগ কিংবা খবর পৌঁছানোর কোন উপায় নাই। গ্রামে না আছে কোন ফোন, না আছে বিদ্যুৎ। মামার অবশ্য এরকম আশংকা ছিল, এমনটাই হতে পারে। ওরা হয়ত আজ গ্রামে ফিরে যেতে পারবে না। 

মামা ভাবতে লাগলেন, কি হতে চলেছে। সারাদেশে কাজকর্ম হচ্ছে না। মানুষজন চাপা গলায়, মিলিটারি নিয়ে কথা বলছে। শহরে এত মিলিটারির গাড়ির চলাফেরার কি কারণ হতে পারে। হয়ত আন্দোলন, মিছিল, ভাংচুর ঠেকানোর চেষ্টা করবে। এদিকে শেখ সাহেব তো বলেই দিয়েছেন, “এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আবার তিনি নির্দেশও দিয়েছেন, যার যেই অস্ত্র আছে, সেটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। 

সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছিল না, বিষয়টা কোন দিকে গড়াচ্ছে। লাঠি, ইট-পাটকেল দিয়ে কি আর মিলিটারির বন্দুক, কামান আর ট্যাঙ্কের সাথে যুদ্ধ চলে!

শফি মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল অফিসের কেরাণী। বয়স পঁয়তাল্লিশ। মাথা ভর্তি টাক। সে জন্যে দেখতে আরও বেশী বয়স্ক লাগে। বেশ লম্বা। প্রায় ছ’ ফুটের কাছাকাছি। এত লম্বা হওয়ার কারণ কি জানতে চাইলে, তিনি বেশ গর্ব করেই বলেন তার পূর্ব পুরুষ এসেছে সেই আরব দেশ থেকে। তিনি আগে ছিলেন টাইপিস্ট, এখন প্রমোশন পেয়ে কেরাণী। হল ছাড়িয়ে কিছুদূর গেলেই হাতের ডান দিকে টিচারদের কয়েকটা কোয়ার্টার। তার পিছনে হলের কয়েকজন স্টাফের থাকার ব্যবস্থা। সেখানেই মামা তার পরিবার নিয়ে থাকেন। 

টিন শেড বাসা। ছোট ছোট দুটো কামরা, বাথরুম আর রান্না-ঘর। সামনে এক চিলতে বারান্দা। এক মেয়ে সখিনাকে নিয়ে তাদের ছোট সংসার। বাড়িতে বাড়তি জায়গা না-ই বললেই চলে। সেখানে চার জন অতিথির থাকার ব্যবস্থা করাটা বেশ কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াল। সাথে রতন না থাকলে, এত বেশী ঝামেল হত না। বাড়িতে এতগুলো মেয়ে মানুষের মাঝে জোয়ান এক জন ছেলেকে শুতে দেয়াটা কেমন দেখায়। 

রতন ঠিকই বিষয়টা ধরে ফেলল। সে নিজের থেকেই প্রস্তাব দিল, সে বাইরের বারান্দায় রাতটা পার করে দিবে। এক রাতেরই তো ব্যাপার। তা ছাড়া খোলা আকাশের নিচে ঘুমানোর তার অভ্যাস আছে। মামা নিম আপত্তি করলেন, “না তা কেন? মেহমান কি করে বারান্দায় শোয়? তা ছাড়া ভোর রাতে বেশ ঠাণ্ডা পরে।” রতন মামার কথায় কান দিল না। বারান্দার এক কোণায় বিছানা করে শুয়ে পড়লো। 

রতনের মাথায় একটাই চিন্তা খেলতে লাগল, সকালে কারফিউ ভাঙ্গা মাত্রই, সাথের মানুষদের নিয়ে আহালিয়া গ্রামের উদ্দেশ্য বের হয়ে পড়বে। শহরের মিলিটারির দাপাদাপি, কারফিউ তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। কেন যে এ সময়ে চন্দনের কথা রেখে শহরে আসতে রাজী হয়েছিল। আসল এ রকম সময়ে গ্রাম থেকে আসাটাই ঠিক হয় নি। চন্দনটাই বা কেমন? হঠাৎ বিয়ে করার জন্যে তাড়াহুড়া আরম্ভ করলো। কয়েকদিন অপেক্ষা করলে কি যায় আসতো। 

মাথার মধ্যে চিন্তাটা বেশীক্ষণ কাজ করতে পারল না। চোখটা যে কখন বন্ধ হয়ে এসেছে বুঝতেই পারে নি। সারাদিনে ধকল কম হয় নি। সেই ভোরবেলা উঠা, টঙ্গি থেকে বাসে নেয়া, নিউ মার্কেটে কেনা কাঁটার জন্যে হাটাফেরা, মামার বাসায় ভুঁড়ি ভোজন ---সব মিলিয়ে শরীরটাকে বেশ কাহিল বানিয়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া সাথে তিন জন মহিলাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হয়েছে। পাছে কোন সমস্যা হলে প্রিয় বন্ধুকে কি উত্তর দিবে। আসলে ঘাড়ে দায়িত্ব থাকলে মন-শরীরে অবসাদ আসতে বেশী সময় লাগে না। 

হঠাৎ মনে হল চন্দন ডাকছে, “তাড়াতাড়ি আয়। নিউ মার্কেট থেকে শাড়ি কিনে আনতে এত সময় লাগে না-কি? এই দিকে কত কাজ পড়ে আছে।” চন্দন দৌড়াচ্ছে, হাতে ইয়া বড় একটা বন্দুক। রতন ওর পিছু নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ঘরের দরজা ভেঙ্গে দু জনে ঢুকে পড়ল। ঘুমন্ত ভুঁড়িওয়ালা এক মানুষ উঠিয়ে তার দিকে চন্দন বন্দুক তাক করলো। রতন গুণতে লাগলো, “১,২,৩।” 

রতন ভাবতে লাগল, চন্দন তাকে এ রকম একটা ঘটনার কথা বলেছিল। জোতদারকে অনেক চেষ্টা করেও সে গুলি করতে পারে নি। রতন বুঝল, চন্দন এইবারও কাজটা করতে পারবে না। চন্দনের হাত কাঁপছে, বন্ধুকের নল ঘুরে অন্যদিকে সরে গেছে। রতন চন্দন থেকে বন্দুক কেড়ে নিল। বদমায়েশ জোতদারের ভুঁড়িতে বন্দুক ঠেকিয়ে দিল। কি অদ্ভুত তার হাত মোটেই কাঁপছে না। সে পারবে, সে কাজটা অনায়াসে করতে পারবে। কিন্তু সেও তো আগে কখনো গুলি করে নি। গুলি করলে মানুষটা মারা যাবে। শুধু মারা যাবে বললে ভুল হবে। খুন হয়ে যাবে। 

প্রচণ্ড একটা শব্দ হল। মনে হচ্ছে রতন গুলি করতে পেরেছে। জীবনে প্রথম সে একটা খুন করলো। কেমন একটা ভয় ভয় ভাব কাজ করা আরম্ভ করল। শব্দটা আবার হল। কই না তো, সে এবার গুলি করে নি। তা হলে আবার কেন গুলির শব্দ। একটা দুটো না, অনেক গুলির শব্দ আসতে লাগলো। 

ঘুমের মধ্যে না, বাস্তবে গুলি হচ্ছে। রতন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠলো। গুলির শব্দের একটু বিরতি হলেই, মানুষের চিৎকার, আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে। বিষয়টা কি হতে পারে, রতনের মাথায় খেললো না। মনে হচ্ছে জগন্নাথ হলের দিক থেকেই গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। মুহূর্তেই সন্ধ্যা বেলায় দেখা পাক মিলিটারির চেহারাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তবে কি ওরাই, জগন্নাথ হল আক্রমণ করেছে। ঘুমন্ত ছাত্রদের মারছে। তাদেরই আর্তচিৎকার সে শুনতে পারছে। 

রতন বুঝতেই পারে নি, কখন যে শফি মামা তাকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেছেন। ভিতরে সবাই আতঙ্কে একবারে এক কোণায় ঘাপটি মেরে বসে রইল। ভয়ে কেউ বাতি জ্বালাল না। 

কার যে এখন কি করা উচিত, কারোর মাথায় সেটা এলো না।

প্রায় ঘণ্টা তিনেক অনবরত গুলির শব্দ ও মানুষের কান্না, হাহাকার শোনা গেল। পরের দিকে গুলির শব্দ কমা আরম্ভ করল। কিন্তু মানুষের আর্ত চিৎকার আরও বেশী স্পষ্ট হল। সবাই বুঝতে পারছে, বিষয়টা কি; কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছে না। পাছে যদি শব্দ হয়, বিপদটা এখানে এসে হাজির হয়। মামা অবশ্য একবার দরজা খুলে বের হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মামী তাকে জাপটিয়ে ধরে রাখলেন। কোনভাবেই তিনি স্বামীকে বাইরে যেতে দিয়ে রাজী নন। বাইরে শত শত বুলেটের শব্দ হচ্ছে। মাত্র একটা বুলেটই স্বামীকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাদের পুরো পরিবারের কাছ থেকে। 

রাতের অন্ধকার কমা আরম্ভ করলো। এর মধ্যে গোলা গুলি বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কিছু আর্তচিৎকার ভেসে আসছে, “বাঁচাও, বাঁচাও...পানি, পানি।” মামার পরে রতনও বেশ কয়েকবার দরজা খুলে বাইরে যেতে চেয়েছে। মামা তাকে কোনভাবেই ছাড়েননি। 

শেষে দূরের কিছু মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসা আরম্ভ করল, “আস সালাতু খায়রুম নওম...... ঘুমের থেকে নামাজ উত্তম”। কিন্তু যেই বান্দার বুক পাক মিলিটারির গুলিতে এই রাতেই ঝাঁজরা হয়েছে, সে উঠবে কি করে, (মুসলমান হলে) কি করে নামাজ পড়বে? সেতো ঘুমাতে যাওয়ার আগেই জানতো না, এই ঘুমই ইহ জগতে তার শেষ ঘুম। 

আলো ফোটার সাথে সাথেই মামা রতনকে নিয়ে চললেন রাতে কি হয়েছে জেনে আসার জন্যে। পূর্ব দিগন্তকে খুব বেশী লাল মনে হল। এ রকম তারা তো আগে দেখে নি। তা হলে এইটা কি কোন বড় এক দুঃসংবাদের আলামত। বেশী দূর যেতে হল না। জগন্নাথ হলের দিকে এগোতেই রাস্তার মধ্যে কয়েকটা লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেল। মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে আছে। তার মানে পেছন থেকে গুলি করেছে। হয়ত বাঁচার জন্যে ছুটে চলে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু একমাত্র কাপুরুষ হলে যেই কাজ করতে পারে, পাক মিলিটারি বাহিনী সেই কাজ করেছে। নিরস্ত্র বাঙালিদের পিছন দিক দিয়ে মেরেছে। এখনও লাশগুলোর পাশে রাস্তায় জমাট রক্তের ছাপ। কিছু লাশের চোখ পর্যন্ত খোলা। চোখে পূর্ণ বিস্ময়ের ভাষা, “এইটা কি করে সম্ভব?।” 

দু জনে আর সোজা রাস্তায় হলের দিকে গেল না। ঘুরা পথে প্রায় নিঃশব্দে হলের হলের পুকুর পাড়ের উল্টো দিকে পৌঁছল। ওইদিকটায় বেশ কিছু ঝোপ-ঝাড় , গাছ পালা। সারি সারি কাঁঠাল, আম, জাম গাছ। গাছগুলো মৃদু বাতাসে নড়ছে। গত রাতে তারা যে ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছে, সেটা তারা নিশ্চয়ই মানতে পারছে না। বাতাসের তালে কেমন নড়ছে এবং মনে হচ্ছে ফোঁপানো কান্নার শব্দ হচ্ছে। গাছ হলেও তো প্রাণ আছে। তারাও একই প্রকৃতির অঙ্গ। কিছুক্ষণ আগে যারা এই প্রকৃতিতে যারা শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিল, তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলেছে হানাদারগুলো। 

গাছের আড়ালে ঝোপের ভিতরে নিজেদের লুকিয়ে মামা, রতন তাকিয়ে পাক হানাদারদের নৃশংসতা দেখতে লাগল। মাঝে চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বার্তা হয়েছে। মামা একবার হলের গেতে যেয়ে নিজের পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রতন রাজী হয় নি, ফিস ফিস করে বলল, “মামা, এই হলে আপনি চাকরি করেন জানলেই, সাথে সাথেই গুলি করে মেরে ফেলবে।” 

জগন্নাথ হলের সামনে দুটো মিলিটারির ট্রাক দাঁড়ানো। সেখানে লাশ উঠানো হচ্ছে। কয়েকজন বাঙালিকে মনে হয় কাজটা করতে বাধ্য করেছে। কারণ বন্দুকের নল ওদের দিকে তাক করা। মুখ দিয়ে বন্দুকের মতই অশ্রাব্য গালি গালাজ বের করছে, “শালা বাঙালি গাদ্দার হ্যা, কাফের হ্যা।” মামা, রতনের বুঝতে অসুবিধা হল না, জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্রদের খুন করা হয়েছে। এখন অন্য কিছু বাঙালিকে দিয়ে লাশ ট্রাকে উঠিয়ে নিচ্ছে। তার পরে হয়ত কোন গর্তে মাতি চাপা দিয়ে তাদের পাপ গোপন করবে। 

রতন কয়েকবারই মামার কাছে জানতে চেয়েছে, এভাবে ছাত্র খুন করার কারণ কি হতে পারে? মামারও ঠিক উত্তর জানা ছিল না, “হলের বেশীর ছাত্র হিন্দু, তাই বলে কি-না?” হিন্দু হয়েছে তো কি হয়েছে? সেই জন্য ঘুমন্ত ছাত্রদেরকে মারতে হবে। ওরা জানতো, আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানীরা ক্ষমতা দিতে চাচ্ছে না, গড়িমসি করছে। কিন্তু এর সাথে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের খুন করার কি সম্পর্ক থাকতে পারে। 

দু জনের গোপনে পাকিস্তানীদের পর্যবেক্ষণ ও চাপা গলায় আলাচনা বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। এক মিলিটারি নায়েক প্রস্রাব করার জন্যে একটা জুতসই জায়গা খুঁজছিল। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের অন্য পাড়ের ঝোপের কাছে চলে এল। মূত্র ত্যাগের জন্যে স্থানটা বেশ মনঃপুত হল। যেই ভাবা সেই কাজ। ঝোপের মধ্যে কিছুটা ঢুকে প্যান্ট খুলে কাজটা আরম্ভ করলো। আর তখন-ই চোখে পড়ল, দশ হাত দূরে লুকিয়ে থাকা দু বাঙালি। 

পাক্কু ভূত দেখার মত ভয় পেল। চিৎকার করে বলল, “হিন্দুস্থানি স্পাই হ্যায়। শ্যালা লোককে মার ঢালো।” যেই বলা সেই কাজ। কাঁধের বন্ধুক হাতে নিয়ে ছুটে আসতে লাগলো দু জনের দিকের। কিন্তু বুদ্ধু পাক্কু কাজটা করল, প্যান্ট কোমরে না আটকিয়েই। ফলে তার বুদ্ধি যেখানে, মানে হাঁটুতে প্যান্ট আটকে গেল। আর যায় কোথায়, দুই কদম না যেতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কিন্তু পাক নায়েক পড়ার আগে কাজটা করে ফেলল। বন্দুকের ট্রিগারটা চেপে ধরল। 

গুলির বিকট শব্দের সাথে সাথে এক বাঙালির আর্তনাদ শোনা গেল, “ও মা, মা গো”।

১০

চন্দনের হিসেব অনুযায়ী, রতন মা, হবু শাশুড়ি ও ভবিষ্যৎ বঁধু সন্ধ্যা হওয়ারা আগেই ফিরে আসবে। সে নিজে যেয়ে সেই বিকেল চারটা থেকে টঙ্গি বাস স্ট্যান্ডে যেয়ে বসে আছে। ভিতরে কেমন একটা টেনশন কাজ করছে। রতনকে না দিয়ে সে নিজে গেলেই পারতো। কিন্তু তাই বা কেমন দেখাত? বিয়ের আগে কি আর ভবিষ্যৎ বউয়ের সাথে কোথাও যাওয়া যায়? ছোট গ্রাম। মানুষ ঠিকই জেনে ফেলবে। অনেক কথা উঠবে। তখন মুখ দেখানোই মুশকিল হয়ে যাবে। 

অন্যদিনের তুলনায় আজ যানবাহনের চলাচল বেশ কম। লোক মুখে শুনলো, ঢাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে মিলিটারি। কেউ ঠিক বুঝতো পারল না, বিষয়টা কি হতে পারে? যদি ভারতের সাথে আবার যুদ্ধ লাগে, তা হলে মিলিটারি থাকবে বর্ডার এলাকায়। শহরের মধ্যেই বা কেন? এ দিকে শেখ সাহেবের সাথে আলোচনা চলছে। তিনি প্রধান মন্ত্রী হয়ে গেলে আর কোন চিন্তা থাকবে না। ভাবতেই ভাল লাগে, বাঙালিরা পুরো পাকিস্তান শাসন করছে। 

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার নামল। এর মধ্যে এক ট্রাক মিলিটারি টঙ্গি বাজারে এসে হাজির। খবর আসল জয়দেবপুরে মেলা গণ্ডগোল হচ্ছে। জনগণ রাস্তায় গাছ পালা কেটে ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছে। মিলিটারিকে চলাচল করতে দিবে না। কোথায় যে এর শেষ? চন্দনের মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। বাড়ির মানুষ বাড়ি ফিরে আসলেই তার আপাতত শান্তি। 

মিলিটারি দেখে টঙ্গি বাজারে যে কয়টা দোকান খোলা ছিল, তাদেরও দোকানের শাটার ঝম ঝম করে পড়ে গেল। রেডিও পাকিস্থান থেকে ঘোষণা এসেছে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে কারফিউ। তার মানে ঢাকার থেকে কোন গাড়ি আসবে না। তা হলে ওরা ঢাকার থেকে ফিরে আসবে কি করে? চন্দন বাজার থেকে একটি দূরে এক দেয়ালে পাশে যেয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে ঢাকার কোন গাড়ি আসলে একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়। মনে এখন ক্ষীণ আশা আছে, যদি দেরি হলেও রতন, মা ও কুটুম বাড়ির দুজনকে নিয়ে ফিরে আসে। 

কিন্তু না। চন্দনের আশায় একেবারে গুড়ে বালি। সন্ধ্যার পর ঢাকার দিকে থেকে কোন গাড়ি এলো না। আবার টঙ্গি ছেড়ে কোন গাড়ি গেল না। অবশ্য দু দিক থেকে মিলিটারির ট্রাকগুলো আসা যাওয়া দেখতে পেল। এর মধ্যে ওরা পুরো বাজার এলাকাটা ছেয়ে ফেলল। কোন কোন সৈনিক সিগারেট টানছে, নিজেদের ভিতরে কথা বলছে। চন্দনের মনে হল, কেমন যেন ওদের মধ্যে উত্তেজনা। মাথায় আসল না এখানে অস্থির হওয়ার কি কারণ হতে পারে। 

বেচারা চন্দনের যেমন মা ও অন্যান্য কথা নিয়ে টেনশন হচ্ছিল, ঠিক সে রকম নিজেকে নিয়েও ভয় ভয় লাগছিল। মিলিটারিদের হয়ত কোন বদ মতলব আছে। না হলে এখানে ওদের এত জমায়েত করার কি দরকার। আবার কারফিউ দেয়ার-ই বা কি থাকতে পারে। জনগণ কি আর সৈনিকদের সাথে যুদ্ধ করে? তবে চন্দন এতটুকু বুঝে নিল, তার এই জায়গায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। 

না চাইলেও, চন্দন অন্ধকারের মধ্যেই বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। একটু ঘুরা রাস্তা দিয়ে ফিরল। পথে আর কোন মিলিটারির সাথে দেখা হল না। দেখা হলে, সমস্যা হয়ে যেত। কারফিউ ভাঙ্গার জন্যে হয়ত শাস্তি পেতে হত। ধরে নিয়ে গেলে আরও বিপদ। সামনে বিয়ে, মা’র বিয়ের বাজার নিয়ে সন্ধ্যাতেই ফিরে আসার কথা ছিল। নিশ্চয়ই সকাল হলে ফিরে আসবেন। তা ছাড়া তার রাজনৈতিক পরিচয় ফাঁস হয়ে গেলে মহা বিপদের সম্ভাবনা। নানা কথা ভাবতে ভাবতে চন্দন আহালিয়া গ্রামে নিজের বাসায় ফিরে এলো।

১১

পাক সেনা বাহিনীর নায়েক যেই মুহূর্তে শফি মামা আর রতনকে দেখল, ওরাও ঠিক একই মুহূর্তে পাক্কুকে দেখল। অবশ্য সেনার পায়ের শব্দ আগেই শুনেছিল। আশা ছিল, পাক সেনা তার কাজ করেই অন্যদের কাছে ফিরে যাবে। ওদেরকে দেখতে পাবে না। যাই হোক দু জন সাথে সাথেই বিপদ বুঝতে পারল। এক দৌড়ে সেখান থেকে পালানোর জন্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাক সেনার ছোরা গুলি রতনের পিঠে যেয়ে লাগলো। আহালিয়া গ্রামের ছেলে রতনের মৃত্যু হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সামনে, পুকুরের জংলা পাড়ে। ঠিক জানা হল না সেই সময়ে রতনের মাকে শেষবারের মত দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল; না -কি কষ্টে বের হয়ে এসেছিল মুখ থেকে, “ও মা, মা গো।” 

শফি মামার পক্ষে সম্ভব ছিল না রতনের সাহায্যে এগিয়ে যাবার। তার বুঝতে কোন অসুবিধা হল না, দাঁড়ালেই নির্ঘাত মৃত্যু। প্যান্টে পেঁচিয়ে সৈনিকের উঠে দাঁড়ানোর আগেই চোখের দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে হবে। গুলির শব্দ শুনে অন্য সৈন্যরা নিশ্চয়ই ছুটে আসবে। মামা হয়ে ভাগ্নেকে রেখেই তাকে ছুটতে হল। মামা শেষ বারের মত রতনের দিকে তাকালেন। তারও বুকের পেছন থেকে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই এ রকম পড়ে থাকা কিছু বাঙালির লাশ তারা পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। 

মামা অনেক রাস্তা ঘুরে ঘণ্টা চারেক পরে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল মামা আর রতনের ফিরে আসার। আর মামা এসে খবর দিলেন রতনকে খুন করা হয়েছে। তিনি কোন রকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছেন। সাথে সাথে সবাইকে সাবধান করে দিলেন, “খবরদার একটুও শব্দ করা যাবে না। পাক বাহিনী একেবারে আশে পাশে। কান্নাকাটি শুনলেই এখনে এসে হাজির হবে। তখন সবার-ই একই পরিণতি হবে।” আরম্ভ হল এক বাঙালি পরিবারে নিঃশব্দে কান্নার কঠিন সময়। চন্দনের মা প্রায়-ই নিজেকে সামাল দিতে পারছিলেন না, “এত সুন্দর একটা ছেলে; বলা নেই, কওয়া নেই--মেরে ফেলল। কারোর কি কিছু করার নাই? ” 

মামা চিবিয়ে চিবিয়ে ধীর গলায় উত্তর দিলেন, “আছে। অবশ্যই আছে। ওদেরকে আমরা একই শাস্তি দিব। পাক জানোয়ার থেকে আমরা এই দেশকে মুক্ত করব।” একটু থেমে নিয়ে মামা প্রচণ্ড ক্রোধে আবার উচ্চারণ করলেন, “জয় বাংলা। বাংলার জয় হবেই। এ অত্যাচার আমরা মানি না। ” অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, “আমি সামান্য চাকুরীজীবী মানুষ। সব সময় রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছি। কিন্তু আর না। আমি এই খুনের প্রতিশোধ নিব-ই নিব।” 

শফি মামা বুঝলেন, যে কোন সময়ে পাক বাহিনী তার খোঁজে এসে হাজির হবে। তার আগেই পালাতে হবে। বাইরে এখনও কারফিউ চলছে। এর মধ্যে বের হলে বিপদের সম্ভবনা ১০০ গুণ বেড়ে যাবে। তার থেকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। কারফিউ একটু শিথিল হলেই, পুরো পরিবারটাকে আহালিয়া গ্রামে বোনের কাছে নিয়ে রাখবে। সেখান থেকে যাবে যুদ্ধ করতে। জানা নেই কোথায় গেলে প্রশিক্ষণ পাবে, কোথায় গেলে অস্ত্র পাবে। এদের সাথে খালি হাতে লড়া কোন ভাবেই সম্ভব না। মামা একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যুদ্ধে তাকে যেতেই হবে। এইভাবে একের পর এক নিরস্ত্র মানুষকে খুন, কোনভাবেই মানা সম্ভব না। মুখ থেকে কথাটা আবার বের হয়ে এলো, “জয় বাংলা”। 

মামার বন্ধু সুলায়মানের বাসা পাশের পাড়ায় পলাশী ব্যারাকে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই অন্ধকার রাস্তায় রাতে থাকার জন্যে সেখানে চলে গেলেন। মামীকে বলে গেলেন, রাতে পাক বাহিনী আসলে বলতে তিনি গ্রামের বাড়ি গেছেন সপ্তাহ খানেক আগে। উনার চিন্তা ছিল, বাড়ি সার্চ করলে তাকে কি, কোন পুরুষ মানুষই পাবে না। নিশ্চয়ই তারা মহিলাদের উপর কোন যন্ত্রণা করবে না। তাকে না পেয়ে বাড়ির অন্যান্যদের দেহাই দিবে। অন্যান্যরা বলতে মামী, তার বোন জাহানারা ও এবং সখিনা ও কুলসুম।  

কিন্তু মামার হিসেবে একটা বড় ধরণের ভুল ছিল। তিনি এই বর্বর বাহিনীর নির্মমতা নিজের চোখে দেখেছেন। কিন্তু তার জানা ছিল না এরা পশুদের থেকেও অধম। রাতে ঠিকই পাক বাহিনী এলো মামাকে খুঁজতে। মামার দৈহিক বর্ণনা দেওয়াতে হয়ত কেউ বাসা চিনিয়ে দিয়েছে। লম্বা, টাক মাথা --এই অঞ্চলে বেশী নাই। পাক বাহিনীর সাথে এলো সেলিম মোল্লা। অফিসে মামার এসিসস্টেণ্ট। বেশ কয়েকবার ষড়যন্ত্র করেছিল মামার পদটা দখল করার জন্যে। এইবার সে পাক্কুদের দিয়ে মরণ ছোবল দেয়ার সুযোগটা লুফে নিয়েছে। 

পাক্কুরা মামাকে না পেয়ে প্রতিটা কামরা সার্চ করল। ওয়ারল্যাসে জানাল, “গাদ্দার ভাগ গিয়া , লেকিন ইদার দো খুবসুরত জোয়ান আওরাত হ্যা। জেনারেল সাব অর্ডার দিয়া জোয়ান লারকি সাব ক্যান্টনমেণ্ট লে জানে কি লিয়ে।” ওই দিক দিকে উত্তরটা সম্মতি সূচক আসলো। দু জন যেয়ে ধরল চন্দনের হবু বউ কুলসুমকে, ও আরও দু জন সৈনিক যেয়ে ধরল কুলসুমের মামাত বোন সখিনাকে। চন্দনের মা ছুটে সৈনিকদের হাত থেকে মেয়ে দুটোকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। 

কিন্তু তিনি কি আর পারেন কাপুরুষ সৈনিকদের নোংরা থাবা থেকে মেয়ে দুটোকে উদ্ধার করতে? তিনি মেয়ে দুটোকে রক্ষা করতে এক পাক্কু হাতে কামর দিয়ে দিলেন। রাগে সৈনিক তাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। ওদের যে দলপতি, সম্ভবত কোন অফিসার, কোমর থেকে পিস্তল বের করে জাহানারার বাম পায়ে গুলি করে দিল। গুলি পায়ের আঙুলে লাগল। তিনি গুলি লাগার আকস্মিকতায় প্রথমে একটু দমে গেলেন। পরের মুহূর্তেই যেই অফিসার গুলি করেছে, তার পা জড়িয়ে ধরে অনুনয় করে বললেন, “দোহাই লাগে, আল্লাহ’র ওয়াস্থে আমার মেয়ে দুটোকে ছেড়ে দাও।” কিন্তু উত্তরটা হল মারাত্মক। জাহানারাকে লাথি দিয়ে সরিয়ে অফিসার বলল, “কাফের লোক আল্লাহ’ বলতি হ্যা। কিতনা হিম্মত।” অন্যদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় মামী ইয়া আল্লাহ বলে এক চিৎকার করলেন। তার সাথেই সাথেই জ্ঞান হারালেন। কুলসুমের মাও চেষ্টা করলেন, মেয়ে দুটোকে বাঁচাতে। বিনিময়ে বন্দুকের বাটের বারি পড়তে থাকল তার সারা শরীরে। 

কুলসুম ও সখিনা দু জনকেই পাক সেনাবাহিনীর ট্রাকে নিয়ে তুলা হল।

১২

এর পরের চার দিন চন্দনের ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে কাটলো। রতনের পরিবার ও ভবিষ্যৎ শ্বশুর বাড়ি থেকে বারে বারে খবরের জন্যে যোগাযোগ করছিল। কিন্তু তার কাছে কোন খবর ছিল না। অনেক ভেবে চিন্তে জানাল, “মনে হয় গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল, তাই আসতে কোন সমস্যা হচ্ছে।” চন্দনের বিশ্বাস ছিল রতন গ্রামের ছেলে হলেও, খুব চালাক-চতুর। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল। কিন্তু বাবার অকাল মৃত্যু হওয়ার জন্যে ব্যবসার হাল ধরতে হয়েছিল। না হলে হয়ত পড়ালেখা করে বড় অফিসার হতে পারত। তার বিভিন্ন কাজে মেলা অভিজ্ঞতা। সেই জন্যে রতনকে বলে কয়ে রাজী করিয়ে সাথে পাঠিয়েছিল। যেই সমস্যাই হোক না কেন, রতন ঠিকই সামাল দিয়ে ফেলবে। 

চন্দন দিনের বেশীর ভাগ সময়েই টঙ্গি বাস স্ট্যান্ডে যেয়ে বসে কাঁটাল। কোন বাস এসে দাঁড়ালেই, আশায় বুক বেঁধে যাত্রীদের নামাটা দেখে। এইভাবেই কোন বাস থেকে নিশ্চয়ই মা নামবে, রতন নামবে, শাশুড়ি ও হবু বধূ কুলসুম নামবে। অপেক্ষার পালা আর শেষ হয় না। সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়। একসময় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়। রাস্তায় শুধু মিলিটারির গাড়ি। এর মধ্যে খবর আসে ঢাকায় মিলিটারিরা হাজার হাজার ঘুমন্ত বাঙালি খুন করেছে। কিন্তু চন্দনের বদ্ধমূল ধারণা, মা খুন হতে পারেন না। তিনি অবশ্যই তার চোখের সামনে কোন এক বাস থেকে নামবেন। 

চার দিনের মাথায় বিকালের দিকে শফি মামা ধরাধরি করে বাস থেকে মা’কে নামালেন। চন্দন ছুটে গেল বাসের দিকে। শফি মামার সাথে আগের থেকে পরিচয় ছিল। তিনি মাঝে মধ্যে গ্রামে আসতেন বোন মানে তার হবু শাশুড়ির ও ভাগ্নিকে দেখতে। সেই থেকে গ্রামের সবার সাথেই তার চেনা জানা। চন্দন বুঝতে পারল না, শফি মামার সাথে ওদের দেখা হল কি করে। তার পরেও মনে অনেক শান্তি পেল, ওরা ফিরে তো এসেছে। সেটাই বড় কথা। 

শফি মামা ও মায়ের পরে মামী, হবু শাশুড়ি নামলেন। চন্দন চেয়ে রইলো এই বুঝি, রতন নামলো। শেষে নামবে সেই সুন্দরী মেয়েটা যাকে সে বিয়ে করবে। কিন্তু ওদের দু জনের কেউ নামলো না। মামা নাম্বার পরে মাথা নিচু করে মামী নামলেন। চন্দনের মনে হল মা’ জানি কেমন করে খোঁড়াচ্ছে, হাটতে পারছেন না। মামা তাকে ধরে ধরে আগাচ্ছেন। চন্দন তাড়াতাড়ি মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। মা চন্দনকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বেশ জোরেই কেঁদে উঠলেন, “হারামজাদারা আমাদের সর্বনাশ করেছে।” 

মামার বাড়িতে পাক বাহিনীর অভিযানের পরে, বাড়িতে শুধু তিন মহিলাই ছিলেন। শেষে শফি মামার বন্ধু অনেক কষ্টে ওদেরকে ঘর থেকে বের করে এনে মামার কাছে এনে দেন। এক বেবি ট্যাক্সি ওয়ালা তিন গুণ ভাড়া নিয়ে তাদের মহাখালী পর্যন্ত নামিয়ে দেয়।। সেখানে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে তার এই বাসে চেপে টঙ্গি পর্যন্ত এসেছে। কপাল তাদের ভাল-ই বলতে হবে। পায়ে কাপড় পেঁচানো জাহানারা কোন খান সেনার চোখে পড়েননি। 

চন্দনের বাবার মত তার মায়েরও পায়ের গ্যাংরিন হল। চন্দন অনেক চেষ্টা করেও একজন ডাক্তার আনতে পারলো না। গুলি লেগেছে শুনলে ডাক্তার ভয় পেয়ে যায়। পাছে আবার কোন ঝামেলায় পড়ে। গুলি লাগা জায়গাটা প্রথমে পাকল। তার পরে জায়গাটা থেকে কেমন পচে যেয়ে মাংসের গন্ধ বের হওয়া আরম্ভ হল। সাথে শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। মারা যাওয়ার আগে মা চন্দনকে বিড় বিড় করে বললেন, “আমার বউ মা আর ওই সোনা মেয়েটাকে জানোয়ারদের কাছ থেকে নিয়ে আয়।”

১৩

চন্দন শফি মামা’র কাছ থেকে গত কয়েকদিন ঘটনা সব শুনল।

শেষে মামা চিৎকার করে বললেন, “আমার মেয়েকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে, আমি এর প্রতিশোধ নিব।” 

চন্দনও একই সুরে বলল, “ওরা আমার বাবা, মা, বউ ---সবাইকে ধ্বংস করেছে। ওদেরকে এই দেশ থেকে বের না করা পর্যন্ত আমি কোন বিশ্রাম নিব না”। শুধু কি তাই, বিনা অপরাধে তারা হাজার হাজার নিরাপরাধ ঘুমন্ত বাঙালি খুন করেছে। বাংলার মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কোন ক্ষমা হতে পারে না। তাদেরকে তাদের অপরাধের জন্যে শাস্তি পেতেই হবে। 

তার পরে দু জন প্রচণ্ড ক্রোধে সমস্বরে চিৎকার করে বলল, “জয় বাংলা।”

মামা বললেন, “আমরা দেশটাকে পশুমুক্ত করে স্বাধীন করবই, ইনশাল্লাহ।” 

দু জন বাঙালির সমস্ত শরীরের রক্ত তখন টগবগ করছে। তারা একেবারে পরিষ্কার জানে, তাদের মত আরও হাজার-লক্ষ বাঙালির শরীরের রক্ত একই কারণে, একই ভাগে টগবগ করছে। তারা পাক্কুদের অনেক অনাচার সহ্য করেছে; কিন্তু কোনভাবেই মা-বোন-বউয়ের উপর অত্যাচার মেনে নিবে না। দেশের নিরীহ মানুষদের মেরে সাফ করে দিবে, সেটা মুখ বুঝে সহ্য করবে না। 

পাক হানাদার পশুদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব পেতেই হবে।

চন্দন এক সময়ে শ্রেণী শত্রুকে গুলি করতে পারে নি ঠিকই, কিন্তু পাক হানাদার জানোয়ারদের গুলি করে মারতে সামান্যতম হাত কাঁপবে না। 

ওদের শেষ করতে না করলে, শত শত কুলসুম, সখিনা কিভাবে মুক্ত হবে? এক মাত্র তা হলেই বাঙালি সীমাহীন নির্যাতন থেকে মুক্ত হবে; বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।

 

এপ্রিল ১৬, ২০১৭ 

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com

www.lekhalekhi.net