দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ

বেশ কিছু বছর আগের কথা। মনে যেহেতু আছে সালটা বলে দেই; ১৯৯১। দেশের থেকে বের হয়েছি যুক্তরাষ্ট্রে আবাস গাড়তে। মা, বাবা, জন্মভূমি ফেলে আসার কারণে বুকের ভিতরে এভারেস্ট সমান কষ্ট। তার সাথে হাজারো সংশয়! নতুন জায়গার কেমন পরিবেশ পাবো, মানুষরাই বা সেখানে কেমন আর আমিই বা কিভাবে ওদের সাথে মিশবো, কাজ-কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করবো। প্লেনের পাইলট ঘোষণা করলেন, তোমরা চাওতো জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে পারো। বিমান এখন এমেরিকার আকাশ সীমানায়। প্লেনটা ইতিমধ্যে নিচের দিকে নামা আরম্ভ করেছে। কিছুক্ষণ পর স্ব-শরীরে নামবে জানার পরেও, প্রচুর যাত্রী উৎসাহী হয়ে জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকালো। ভাবলাম জানতে হবে কি আছে এই এখানে, যে দেশটা সারা বিশ্বের কাছে বিস্ময় হয়ে আছে।

যাত্রা পথ ছিল ঢাকা থেকে ব্যাংকক, সেখান থেকে টোকিও হয়ে এমেরিকার পশ্চিমের শহর সিয়াটল। সেখানেই ইমিগ্রেশন, কাস্টমস। তার পরে ধরতে হবে চূড়ান্ত গন্তব্য হিউষ্টনের প্লেন। এতো লম্বা ভ্রমণে শরীর একেবারে কাহিল অবস্থা। প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালাম। এমেরিকার ইমিগ্রেশান নিয়ে নানা ভীতিকর কাহিনী জানা ছিল। কিন্তু না, সব শোনা তথ্যই ভুল প্রমাণিত হলো। অসামান্য সুন্দরী এক মহিলা ইমিগ্রেশন অফিসার স্মিত হাসি (smile) দিয়ে এমেরিকায় সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। দেশে সেই সময়ে অপরিচিত কোনো মহিলার দিকে তাকানোর রেওয়াজ ছিল না। তার পরে অনেকটা অকল্পনীয় ছিল প্রথম দেখায় কোনো সুন্দরী থেকে মিষ্টি হাসি উপহার পাওয়া। যাই হোক দুই-ই মিললো। হাসির বিনিময়ে আমিও শুকনো মুখে ঠোট বাঁকা করে হাসার চেষ্টা করলাম। অন্ততপক্ষে আমার জানা ছিল স্মিত হাসির প্রতি উত্তরে মিষ্টি করে একই রকম করে হাসতে হয়।

পরের ঘটনা বলার আগে, স্কুল জীবনের ভিন্ন একটা ঘটনা বলি। চট্টগ্রামের এক মিশনারি স্কুলের ছাত্র ছিলাম। সেখানে আমাদের ব্রাদার এলবেরিক নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। শ্বেতাঙ্গ এই শিক্ষকের বাড়ি ছিল ক্যানাডা। তিনি একবার বলেছিলেন, তার চোখে বাঙালি, পাঞ্জাবী, শিখদের মধ্যে চেহারা ও আকৃতিতে তেমন কোনো পার্থক্য ধরা পড়ে না। আমাদের বেশীর ভাগ বাঙালি’র যেমন চীনা, কোরিয়ান আর জাপানীদের আলাদা করে সনাক্ত করতে কষ্ট হবে। যাই হোক ফিরে আসি, আমার এমেরিকা জীবনের প্রথম দিনগুলোতে। সিয়াটলে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস শেষ করে প্লেন বদলে টেক্সাসের হিউষ্টনে চলে এলাম। দু জায়গার দূরত্ব প্রায় পনেরো শত মাইল। আকাশ পথে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এক দিন পর বেরাতে গেলাম হিউষ্টনে প্রসিদ্ধ গেলারিয়া মলে। আলো, রং ও সৌন্দর্যের ঝলকানিতে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লাম। সে যুগে ঢাকায় কোনো শপিং মল ছিল না। কেনাকাটার প্রধান জায়গা ছিল নিউ মার্কেট, বায়তুল মোকারম, ও গাউসিয়া।

শপিং মলে জিনিসপত্রের দাম দেখে বাংলাদেশের টাকায় কত হতে পারে সেই অঙ্ক কষে যাচ্ছিলাম। যদিও সেই মুহূর্তে আমার কোনো কিছুর কেনার দরকার ছিল না, তার পরেও মনে হচ্ছিল দেশের তুলনায় এখানে সব কিছুর-ই একেবারে অগ্নি মূল্য। এই দেশে এসে কি তা হলে ভুল করলাম! দেশে কতো প্রিয়জন ও বন্ধু-বান্ধব না ছিল! ওদেরকে চাইলেই দেখতে পারবো না ভাবতেই বুকটা কেমন ভারী হয়ে এলো। এই সব কষ্টকর ভাবনার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম। ভাগ্যটা খুবই সুপ্রসন্ন বলতে হবে। অসম্ভব সুন্দরী একটা মেয়ে আমার থেকে দু হাত দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। লম্বা, স্লিম, খাড়া নাক, সোনালী চুলের মেয়েটা আমার উদ্বিগ্ন চেহারাটা খুব যত্নে পর্যবেক্ষণ করছিল। আর আমি কি-না সেটা লক্ষ্য করি নি। অকারণ চিন্তায় বুদ হয়ে ছিলাম। নিজেকে কড়া একটা বকা দিতে ইচ্ছা হলো।

নারী সে বাংলাদেশ, আফ্রিকা, এমেরিকা কিংবা পৃথিবীর যেখানকারই হউক না কেন, পুরুষের চেহারা দেখলেই তারা ভিতরের হাড়ির খবর সব জেনে ফেলে বলে আমার বিশ্বাস। না হলে অপরিচিত মেয়েটা আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছে কেনো? এই মেয়েটা হয়তো আমার ভিতরের সব কিছু জেনে ফেলেছে। ভিতরটা আমার দেশ ও সেখানকার সবার জন্যে হু হু করে কাঁদছে। কেমন একটা লজ্জার ব্যাপার। কান্না-কাটি করা একেবারে পুরুষালী ব্যাপার না! এখন কি করা যায়? তাড়াতাড়ি আরেক দিকে চলে যাবো? সেইটাই বা কেমন দেখাবে? ডানা কাঁটা পরীটাই বা কি ভাববে? নিজেই অবাক হলাম, আমার মস্তিষ্ক এতো সামান্য সময়ে এতো কিছু বিশ্লেষণ করছে কি করে! স্কুল জীবনে জটিল অঙ্ককে সরল করতে যেয়ে কেমন নাস্তানাবুদই না হতাম। তখন আমার স্থির বিশ্বাস ছিল, মাথায় আমার যতটুকু না মগজ, তার থেকে বেশী ছিল গৃহ পালিত জন্তুটার উচ্ছিষ্ট।

এইবার আমাদের চোখাচোখি হয়েই গেল। মেয়েটা আমাকে চমৎকার অনাবিল, মন ভালো করার সুন্দর একটা স্মিত হাসি উপহার দিলো। লিওনার্দো ভিঞ্চি এই হাসি চাক্ষুষ করলে মোনালিসা ছবিতে পরিবর্তন আনতেন; কিংবা মেয়েটার ঠিক এই হাসিটা নিয়ে বিশ্ব কাঁপানো আরেকটা শিল্প কর্ম সৃষ্টি করতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি ছবি আঁকতে পারি না। বাঙালি পুরুষদের মধ্যে প্রচুর কবি আছেন। নিজেকে হতভাগা মনে হলো; আমার সে রকম প্রতিভাও নাই। রবি ঠাকুরের ছিটে ফোটা পেলেও “দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ” জাতীয় কোন একটা কবিতা না হয় চট করে লিখে ফেলতাম। না মেয়েটা আমাকে আর কল্পনার সাগরে ভাসতে দিলো না। আরেকটু কাছে এসে জানতে চাইলো, “আমি কি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি?” কথাগুলো ইংরেজিতেই বলল। একটা বিদেশী ললনা আমাকে সাহায্য করতে চাইছে। আমাকে দেখতে কি এতই অসহায় লাগছে?

মেয়েটাকে কেমন চেনা চেনা লাগলো। কোথায় যেনো দেখেছি। না সেইটা অসম্ভব। এই জায়গায় আমার জীবনে প্রথম আসা। তার পরে বাঙালি মেয়ে হলে একটা সম্ভাবনা ছিল। সুন্দরী মেয়েদেরকে আমার সব সময়ে পরিচিত বলে মনে হয়। আমার-ই বা কি দোষ? সুন্দরের পূজারি মন সব সময়ই সুন্দরকে ধারণ করে; সুন্দরকে খুঁজে বেরায়। তার পরেও মনে হলো, বিষয়টা অন্যরকম। মেয়েটাকে আমি মাত্র দু দিন আগে সিয়াটলে দেখেছি। এই মেয়েটাই তো সেই ইমিগ্রেশন অফিসার, আমাকে নতুন দেশে স্বাগত করেছিল। কিছুটা পার্থক্য অবশ্য হয়েছে। তখন পরনে ছিল সরকারী ইউনিফর্ম। এখান পরেছে পেন্সিল হিল, কালো স্কার্ট, হাল্কা গোলাপি রঙের টপস, ঠোটে টকটকে লাল লিপস্টিক। চোখেও দারুণ কারুকাজ। বড় বড় কালো চোখগুলো যে আটলান্টিক মহাসাগর থেকেও গভীর। সাথে অস্থির করা সেই-ই মায়াবী দৃষ্টি। হলিউডের যে কোনো নায়িকার থেকে বেশী সুন্দরী মনে হচ্ছে। তাদের কেউ মেয়েটাকে দেখলে নির্ঘাত ঈর্ষা করতো। এ দিকে আমার ভিতরে ভুমিকম্প হওয়ার দশা। হৃদকম্পনটা বাড়তে লাগলো। মেয়েটা চাকরির জায়গা সিয়াটল। এতো দূর আসলো কি করে? হয়তো উই-ক্যান্ডে বেরাতে হিউষ্টনে এসেছে। আত্মীয় স্বজন এই শহরে থাকতেই পারে। আমাকে দেখেই চিনে ফেলেছে। আমার অসহায় চেহারা দেখে আবারও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছে।

এই ঘটনার পর পরবাসে মেলা বছর পার করে দিয়েছি। সময় লাগলেও বুঝেছি, সিয়াটলে ইমিগ্রেশনের সেই সুন্দরী আর হিউস্টনের ডানা কাটা পরী দু জন পৃথক অপরূপা নারী ছিলেন। সেই সময় পর্যন্ত আমার খুব বেশী শ্বেতাঙ্গ নারী কাছের থেকে দেখার সুযোগ হয় নি। সে জন্যে দু জনকে একই মানুষ ভেবে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। কিছুক্ষণ আগে আমার স্কুল জীবনের শিক্ষক ব্রাদার এলবেরিকের কথা বলেছিলাম। তিনি বাঙালি, পাঞ্জাবী ও শিখদের আলাদা করে বুঝতে কষ্ট হতো। অনেকটা আমাদের অনেকেরই দু জায়গায় দুটো রয়েল বেঙ্গল দেখলে একই বাঘ দুবার দেখেছেন বলে মনে হতে পারে। পুরো ঘটনাটা এক প্রবাসী বন্ধুকে বলেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন আরও অদ্ভুত ঘটনা। তার কলেজের প্রথম সেমিস্টারে সোমবারে ইতিহাস ও শুক্রবারে ছিল অর্থনীতির ক্লাস। বন্ধুটার পুরো এক সেমিস্টার লেগে গিয়েছিল বুঝতে যে দু বিষয়ে দু জন পৃথক শিক্ষিকা ক্লাস নিতেন। বন্ধুটার কাছে দু শিক্ষিকার চেহারা থেকে আরম্ভ করে হাসি পর্যন্ত ছিল হুবহু এক। কিন্তু সময়ের সাথে তারও শ্বেতাঙ্গিনি পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বেড়েছে। সেও এখন খুব ভালো করেই জানে প্রতিটা সুন্দরীদের হাসি ও শারীরিক আকৃতি অনন্য। মিল থাকতে পারে কিন্তু প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র।

উপরের ঘটনাগুলো মনে এলে সে সময়ে নিজের সারল্য ও সঠিক পর্যবেক্ষণের করতে না পারার কথা ভেবে হাসি পায়। পর্যবেক্ষণের কমতির জন্যে কেমন অকারণ পুলকিত না আমি হয়েছিলাম! তার পরেও বলি হাসি আমাদের জীবনে খুবই একটা প্রয়োজনীয় উপাদান। হাসি তাৎক্ষনিক-ভাবে আনন্দ এনে দিতে পারে। হউক না সেই হাসি স্মৃতি থেকে নেয়া নিজের অজ্ঞতা কিংবা দুর্বলতা নিয়ে কোনো ঘটনা। তবে এখন সুযোগ যেহেতু আমি পেয়েছি হাসি নিয়ে না হয় আরও কয়েকটা কথা বলি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা ছিলেন মার্টিন লুথার কিং। গান্ধীজীর অহিংসা নীতি অবলম্বনে আন্দোলন করে কালো মানুষদের অধিকার আদায়ে বড় ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি একবার বলেছিলেন, স্বর্গে হাসার অনুমতি না থাকলে তিনি স্বর্গেই যেতে চান না। শাস্ত্র তো বলেই রেখেছে, হাসি হচ্ছে সেরা ওষুধ (Laughter is the best medicine)। শেষে ফরাসী একজন বিখ্যাত অভিনেতার কথা বলি। তিনি বলে গেছেন, “আপনি হাসেন না, কারণ বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন; আসলে আপনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, কারণ আপনি হাসেন না।”

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮
কাজী হাসান
প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com