কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে………

“শুনেছ, একটা বিয়ে হয়েছে। শুধু বেলী ফুলের মালা দিয়ে। কোন অলংকার না, কোন যৌতুক ......।”

মা, বাবার কথা অবাক হয়ে শুনছে সে। “আর দেখ কালকের বিয়েটা। আনিস সাহেব কত না বেতন পায়! তার মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত ছিল পাঁচশ মানুষের। তার পরে দিতে হয়েছে জামাইকে কত না কি?”

মায়ের থেকে বেশী মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছে, কিশোরী মেয়ে শান্তা। ক্লাস সেভেনে পড়ে। মাত্র প্রকৃতির সাথে বিলীন হবার ব্যাপারটা জানছে। নারীর যে পুরুষের প্রয়োজন তা অনুভব করা আরম্ভ করেছে। কালকের বিয়েটা মেয়ের বাবা-মার জন্যে যন্ত্রণাকর হয়েছে, সেটা বুঝতে কোন অসুবিধা হল না। তা ছাড়া, বিয়ে দিতে মেয়ে পক্ষকে কেন এত খরচ করতে হবে? মেয়েরা কি বাজারের পণ্য? শান্তা ঠিক করলো, সে এমন ছেলেকে বিয়ে করবে যে শুধু তাকেই চায়। তাকে পণ্য না, মানুষ, বন্ধু হিসেবে বরণ করবে।

বাবা বলছিলেন, হুমায়ূন ফরিদীর কথা। সময়টা সত্তরের দশক। খবরটা এ মুখ, ও মুখ করে পত্রিকাতে পর্যন্ত চলে এসেছে। বাঙ্গালিরা আরেকবার গর্বিত হল। যুব সমাজ আরেকবার প্রমান করলো তারা বিশাল কাজ করতে পারে। হাজার বছরের একটা কু-সংস্কার তারা হয়তো ভাঙা আরম্ভ করেছে। স্বাধীন দেশে, নারী তার সম্মান পাবে না; সেটা কেমন করে মেনে নেয়া যায়।

পরের দিন শান্তা স্কুলে যেয়ে, বিয়েটা সম্পর্কে আরও অনেক খবর পেল। ফরিদী জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালেয়ের। নাটক করে। ভালবাসার মানুষকে বিয়ে করেছে কোন শর্ত ছাড়াই। সে ফুল ভালোবাসে। ভালোবাসার বন্ধনের অঙ্গীকার ফুলের থেকে বেশী কিসে আসতে পারে? কিছু রুপ-রস গন্ধহীন সোনা,রুপা নামক ধাতব পদার্থ আর অর্থহীন অর্থ কি করে ভালোবাসার স্বাক্ষী হতে পারে?

শান্তা ঠিক করে রাখল, বিয়ে করলে সে এমন মানুষকেই করবে, যে হুমায়ূন ফরিদীর মত ফুল দিয়ে বিয়ে করতে পারে। পুরোটা মন দিয়ে ভালোবাসতে যার কোন দ্বিধা নাই।

শান্তার ফুল ও ফরিদী প্রেম, বন্ধু-বান্ধবরা সবাই জানত। বেশ কিছু ছেলে সম্পর্ক করতে চেয়েছে, কিন্তু কারোর মধ্যেই শান্তা তার প্রেমকে খুঁজে পায় নি। মাত্র যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ, প্রস্তাব আসলো এক মন্ত্রীর ছেলের জন্যে। প্রচুর প্রভাবশালী মন্ত্রী। কোন যৌতুক তো দিতে লাগবে না, বরং তারাই পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা দিয়ে মুড়ে নিয়ে যাবে। বাবা মহা খুশী। কোন খরচ পত্র লাগছে না। মন্ত্রী পরিবারের সাথে সম্পর্ক হলে, সরকারী চাকুরি উন্নতি হবে সাই সাই করে। তা ছাড়া চাইলে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যোগদান করে এমপি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু, সবাইকে অবাক করে শান্তা ঘোষণা দিল, মন্ত্রীর বিলাত ফেরত ছেলেকে সে কোন ভাবেই বিয়ে করবে না। সে তো কোন পণ্য না; যে কেও তাকে কিনে নিয়ে নেবে।

আরেকবার, বান্ধবী চুমকির বড় ভাই রঞ্জু শান্তাকে বিয়ে করার জন্যে উঠে পড়ে লাগল। চুমকির থেকে আগেই তার খবর নেয়া ছিল। প্রতিদিন পাঞ্জাবী পরে, ফুল নিয়ে দেখা করার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু, কৃত্রিম ফুল আর প্রেম ধরতে শান্তার বেশী সময় লাগল না। আরেকবার প্রায় কথা দিয়ে ফেলেছিল কমলকে। নামে কমল হলেও, কাজে কর্মে ছিল সে এলাকার মহা মস্তান। একবার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে, শান্ত করে বলল, “ তুমি যদি আমাকে ভালোবাস, আমি সব নোংরা কাজ করা ছেড়ে দেব।” খুব ইচ্ছা করছিলো, নিজের জীবন দিয়ে আরেকটা জীবনকে রাঙ্গিয়ে তুলতে। পরে, শুনল এই ভাবেই কমল মেয়েদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভালোবাসার আভিনয় করে। কিন্তু স্থায়িত্ব হয় হাতে গোনা কিছু দিন। কমল শুধু খোঁজে মধুর স্বাদ।

তার পরেও, শান্তা প্রেমে পড়ল। কলেজের বাংলা টিচার অধ্যাপক মোহনের। মাত্র পড়া লেখা শেষ করে কলেজে পড়ানো শুরু করেছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ভরাট গলা। মেয়েরা মোহন স্যার বলতে পাগল। কয়েকটা মেয়ে এর মধ্যেই উড়ো চিঠি দিয়েছে বাজিয়ে দেখার জন্যে।

শান্তাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মোহন স্যার ক্লাসে আবৃত্তি করলো সুনীলের “কেও কথা রাখে নি”

তবু কথা রাখেনি বরুণা,

এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ

এখন সে যে কোন নারী

কেও কথা রাখেনি,

তেত্রিশ বছর কেটে গেছে, কেও কথা রাখে না।

কবিতাটা শুনতে শুনতেই মনে হল, শান্তার চোখ ভিজে এলো। বুকের কম্পনটা বাড়ল। নিঃশ্বাসটা ভারী হয়ে আসলো। ইশ! একটা মানুষের মনে এত কষ্ট। কেও তার কথা রাখে না ! আবেগ ও বাস্তব মিলে গেলেই, শুধুমাত্র এমন করে কেও বলতে পারে। নিশ্চয়ই এটা তার একেবারের ভিতরের কথা। উফ, তাকে আনন্দ দিতে হবে, কষ্টগুলো মুছে দিতে হবে। একই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল; একেবারে অস্থির অবস্থা। শেষে মনে হল, এই লোকটাকে না পেলে, তাকে খুশী করে না পারলে একেবারে সে পাগল হয়ে যাবে।

অনুষ্ঠান শেষে শান্তা ভীষণ একটা সাহসের কাজ করলো। সরাসরি গেল মোহনের অফিস রুমে। স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, স্যার। আমি “কথা রাখবো”। সে দিন শান্তার পরনে ছিল আকাশী নীল একটা শাড়ী, কপালের চাঁদের সমান একটা টিপ। আসলে নবীন বরণ অনুষ্ঠানের জন্যে বেশ সাজগোজ করে এসে ছিল। আর সাথে ছিল, চোখ দুটোয় মহাসাগরের গভীরতা। যে কোন দুঃখ-কষ্ট অনায়াসে সেখানে ডুবে হারিয়ে যেতে পারে। ওই মুহূর্তে শান্তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে, এমন ছেলে হয়তো পৃথিবীতে ছিল না।

শান্তা-মোহনের দাম্পত্য জীবন বেশ চলতে লাগল। প্রেম করেছিলো প্রায় চার বছর। তার পরে বিয়ে। মোহনের ভাল করে জানা ছিল শান্তার ফুল আর ফরিদী প্রীতির কথা। কারণে অকারণে ফুল নিয়ে আসত শান্তার জন্যে।

মোহন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক আর ফরিদী একজন উঠতি অভিনেতা। দুজনই শীর্ষে উঠার সিঁড়ির ঠিকানা হয়তো পেয়ে গেছে। আরও কিছু হয়তো বিষয় হয়তো তাদের মিলে গেল। পার্থিব কোন কিছুর দিকে তাদের খুব বেশী আকৃষ্ট করে না। শুধুমাত্র ফুল আর প্রেমিকার মুখের হাসি তাদের সম্পূর্ণ ভালোবাসা, তাদের সমগ্র পৃথিবী। মোহন বাংলা ভালোবাসে, তাই বাংলা পড়ায়; কবিতা পড়ে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করে সব কিছু। ফরিদী তার অভিনয় জগতে তার সবটুকূ ঢেলে দিয়েছে। দেশের মানুষ তাকে এক নামে চিনে।

শান্তা-মোহন প্রায়ই কথা বলে ফরিদীকে নিয়ে। ওরা কোন ভাবেই বের করতে পারে না, ফরিদী কি করে যাকে এক সময় বেলী ফুল দিয়ে বিয়ে করেছিল, তার সাথে সম্পর্ক শেষ করে ফেললো। জীবনের বাস্তবতা নিশ্চয় হত্যা করেছে ভালোবাসাটাকে; প্রবাহমান নদীর গতিপথ পাল্টিয়ে দিয়েছে। শান্তা মোহনের হাতে হাত রেখে বলেছিল, “আমরা কিন্তু আমাদের ভালোবাসাটাকে কখনোই শুকিয়ে যেতে দেব না।”

তবে দু জনেই সুবর্ণা মুস্তফারও মহা ভক্ত। তারা মেনে নিয়েছে, ফরিদীর জীবনে সুবর্ণাকে । তার অভিনয়, হাসি, কথা বলা সবই পছন্দের। সুবর্ণার ব্যক্তিত্বে কোন ফাঁক নাই। ওর থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না। ফরিদীকে তার লক্ষে স্থির রাখতে হয়তো সুবর্ণাই ঠিক মানুষ। শুধু একবার, মোহন বলেছিল, সুবর্ণার সাথে আফজালের বিয়ে হলে কিন্তু মানাতো ভাল।

শান্তি নিকেতনে সেমিনার হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের উপর। মোহনকে বক্তব্য রাখতে হবে, পোস্ট মাষ্টার গল্পের উপর। ভরাট গলায় গম গম শব্দ বলতে লাগল, “গল্পে রবীন্দ্রনাথ আসলে নিজেকেই তুলে ধরেছেন। গল্পের মুল চরিত্র পোস্ট মাস্টার তার শ্রেণী ভাঙ্গার কোন চেষ্টাই করে নি। আসলে, রবীন্দ্রনাথ যেমন বিপ্লবী ছিলেন না, তেমনি তার সৃষ্ট চরিত্র বাস্তবতার সমতা এবং ভারসাম্যকে মেনে নিয়েছেন। পোস্ট মাস্টার এগিয়ে চলেছে জীবনের প্রয়োজনে গতানুগতিক প্রবাহের সাথে। অনেকটা ছোট জঞ্জালের, স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার মত।”

মোহন আগের বছর বিশ্বভারতী থেকে পিএইচডি পেয়েছে “রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প এবং সম- সাময়িক সাহিত্য” র উপর। অনেকটা সেই সুবাদে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল। তার কথা শোনার জন্যে বেশ কিছু বিজ্ঞ সুধি জমায়েত হয়েছিল। রবীন্দ্র প্রেমিকেরা মোহনের কথায় কেমন যেন একটা ইঙ্গিত পেল। প্রতিবাদের ঝড় উঠল। সবারই এক মত। পোস্ট মাস্টারের বৈপ্লবিক হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। তাকে গ্রামের পর্ব শেষ করে চলে আসতেই হত। শুধু একজন মোহনের পক্ষে কথা বলল। তার নাম সুমিতা রায়। সে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল, “আপনাদের মধ্যে কে কে আছেন যারা চেয়ে ছিলেন, পোস্ট মাস্টার- রতনের সম্পর্ক ওখানেই শেষ হয়ে যাক। একটাও হাত উঠল না।”

সেমিনারের পরে সুমিতা আসলো মোহনের সাথে কথা বলতে। মিষ্টি করে বলল, “আপনাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমি আপনাকে ভালবাসতে চাই। আপনিও কি পারবেন আমাকে ভাল বাসতে? নাকি পোস্ট মাস্টারের মত ‘এই পৃথিবীতে কে কাহার’ বলে দৌড় মেরে পালাবেন।” মোহন বেশ নাটকীয় করে উত্তর দিল, “অবশ্যই পারব।” সুমিতা এক গাল হেসে বলল, “আমি তো জানি আপনি বিবাহিত।” প্রথমে থতমত হলেও উত্তরে মোহন বলল, “বিবাহিত হলে, যে ভালবাসা যাবে না, এমন তো কোন কথা নাই। আমি সুন্দরের পূজারী। এমন সুন্দরী এক জন নারী যে আমার পক্ষ নিতে ভয় পায় না, তাকে ভালো না বেসে কোন উপায় নাই। আপনাকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসবো।”

আসলে সুমিতা নিজেও বিবাহিতা। কিছুটা দুষ্টামি করতে চেয়েছিল মোহনের সাথে। কিন্তু ভালোবাসা তাদের ঠিকই হয়ে গেল। যোগাযোগ থাকল নিয়মিত। মোহন ভাবল তার ভালোবাসাগুলো যেন কেমন অদ্ভুতভাবে আসে। কিছু বুঝার আগেই। শান্তার মতই সুমিতা আসলো তার জীবনের একেবারে নিভৃতে, কোন ঘোষণা ছাড়াই। কোন চিন্তা করার আগেই ভিতর থেকেই তার সায়টা বেরিয়ে এলো। মনে পড়লো, ছোট বেলার বন্ধু বেলালের কথা। বেচারার একটা মেয়ের মন জয় করার জন্যে কত না প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল। দামী পোষাক-আষাক পরা, প্রেমপত্র লেখা, গান গাওয়া ধরণের কতোনা আয়োজন। একবার তো পাশের পাড়ায় রীতিমত মার খেয়ে আসলো। অপরাধ ছিল সীমার বাড়ীর সামনে সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা।

মোহন সে বার কোলকাতায় ছিল এক সপ্তাহ। সেমিনার শেষ করে শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসলো। উঠল এক হোটেলে। সুমিতা কোলকাতার মেয়ে। দু জনে এক সাথেই ফিরল। সুমিতা দিনের বেশীর সময় কাটাত মোহনের সাথে। কত কিছু না দেখা হল, গড়ের মাঠ, ইডেন পার্ক, কফি হাউস। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমের কলকাতায় বাংলা ভাষাকে খুব বেশী খুঁজে পাওয়া গেল না। হিন্দির ব্যবহার অনেক বেশী বেড়ে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়; এক সময়কার ভারত বর্ষের রাজধানী কোলকাতা থেকে কি বাংলা হারিয়ে যাবে?

সুমিতা মোহনের মতই কবিতা জানে, মোহনের সাথে গলা মিলিয়ে আবৃত্তি করেঃ

অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না।

অমন সুধাকরুণ সুরে গেয়ো না।

সকালবেলা সকল কাজে আসিতে যেতে পথের মাঝে

আমারি এই আঙিনায় দিয়ে যেয়ো না।

অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না।

মোহনকে সুমিতার আঙ্গিনা থেকে দীননয়নে আর করুণ সুরে বিদায় নিয়ে চলে আসতে হল। বাড়ি এসে, শান্তাকে বেশ উৎসাহের সাথে বলতে লাগল, সুমিতার সব কথা। কথা শুনতে শুনতে, শান্তার উজ্জ্বল মুখ মলিন হতে লাগল। মুখটা একেবারে বিষাদময় হল, যখন মোহন জানালো, জানো ও কিন্তু একেবারে আমার মত। আমার মত কবিতা জানে, আমার সাথে গলা মিলিয়ে আবৃত্তি করতে পারে। কিন্তু অধ্যাপক মোহন শুধু কবিতা জানে, মানুষ বুঝে না। শান্তার পরিবর্তন তার চোখে ধরাই পড়ল না।

শান্তার কাছে মোহনের আবৃত্তি, মোহন বাঁশির মতই। শান্তা এই প্রথম বুঝল, সে মোহনের একটা জায়গার শুন্যতা ভরিয়ে দিতে পারে নি। সে তো কবিতা জানে না, মোহনের সাথে গলা মিলিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে পারে না। মোহন কোন সংকোচ ছাড়াই বলতে লাগল, “জানো কফি হাউসে বসে যখন আবৃত্তি করছিলাম, ‘ তোমাকেই যেন ভালবাসিয়াছি শত রুপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার’, তখন সুমিতা আমার হাতটা ওর হাতে নিয়েছিল।” শান্তা মোহনকে ছেড়ে উঠে চলে গেল। বুঝল কোথায় যেন সুখের সুরটা কেটে যাচ্ছে। একটা কাল দেয়াল উঠা আরম্ভ করেছে।

মোহন তখন অন্য এক জগতে। কোলকাতায় তোলা ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ঠিক করতে লাগল, কোন কোন ছবি ফেস বুকে দেয়া যায়। পরিচিত বন্ধুরা নিশ্চয়ই হিংসায় পুড়ে মরবে ওদের ছবিগুলো দেখে। ভাববে বয়স চল্লিশের উপরে, তার পরেও মেয়েদের কাছে তার চাহিদা আগের মতই আছে! বেশ একটা সুখ সুখ অনুভুতি হল।

মনে এলো সুমিতার কথা। সে নিশ্চয়ই মন খারাপ করে তার কথা চিন্তা করছে। দেখা যাক তাকে ফেস বুকের চ্যাটে পাওয়া যায় কি না।

দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকল অনেক কিছু। মোহনের বাবা হার্ট এ্যাটাকে মারা গেল। ছোট বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে অনেক খরচ হয়ে গেল। বাকী জমানো টাকা, এক হায় হায় রিয়েলটি কোম্পানি মেরে দিল। তার পরে মায়ের ধরা পড়ল ক্যান্সার। তার জন্যে দরকার হয়ে পড়ল মেলা টাকার।

মোহনের বেতনের টাকা দিয়ে সংসার মোটামুটি চলে যেত। কিন্তু বাড়তি খরচ সামাল দিতে হলে প্রয়োজন বাড়তি অর্থের। কিন্তু তাই বা সম্ভব কি করে? বেতন তো শুধু সামান্য কিছু বাড়ে বছরে একবার। তার পরে শান্তা কোন চাকরি করে না।

প্রস্তাবটা শান্তাই দিল। এরকম পরিস্থিতে সে বাইরে কাজ নিলে কেমন হয়। মোহনের পৌরুষে বাঁধল। তার প্রয়োজনে ঘরের বউ বাইরে কাজ করবে সেটা কি করে মানা যায়। বেশ শক্ত করেই বলল, “আমাকে করুণা করার কোন দরকার নাই।”

এর মধ্যে আরেক ঘটনা হল। এক দিন রাতে শান্তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। সে আর সহ্য করতে পারছিল না। চোখ মুখ সব নীল হয়ে যাওয়া আরম্ভ করলো। মুখ থেকে গো গো শব্দ বের হচ্ছিল। মোহন ছুটে নিয়ে গেল হাসপাতালে। শান্তার একটোপিক প্রেগন্যান্সি হয়েছিল। টিউবের বাইরে ফারটিলাইজেশান। আরেকটু দেরী হলে শান্তাকে বাঁচানো যেত না। কিন্তু, একটা শিশু জীবনের যে সুত্রপাত হয়েছিল, ডাক্তাররা তা নিঃশেষ করতে বাধ্য হল।

দূরত্ব বাড়া আরম্ভ হল। শান্তার নিজেকে মনে হল অপরাধী। একটা শিশু তার মধ্যে এলো, কিন্তু সে তাকে বাঁচাতে পারলো না। নারী হিসাবে সামান্য কাজটা করতে পারলো না। হয়তো একটা সুযোগ ছিল মোহনকে ঋণী করার। না হল না। পরিণামে আসলো ডিপ্রেশান। সারাদিন এক কোণায় বসে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তবে, এর মধ্যেও মনে হত মোহন এসে যদি একবার মিথ্যা ক্রে হলেও বলতো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

অন্যদিকে মোহনের মনে আর সব পুরুষ মানুষের মতই শখ ছিল, বাবা হওয়ার। কিন্তু অজান্তেই মারা গেল সেই সম্ভাবনা। বন্ধু সুজন বলছিল, শান্তার যেহেতু একবার গর্ভপাত করাতে হয়েছে, পরের বারেও একই সম্ভবনা থেকে যাচ্ছে। কথাটা যদি সত্যি হয় তা হলে কি তার বাবা হওয়াটা হবে না।

একবার ইচ্ছে করলো শান্তাকে যেয়ে বলতে, যার উপর তোমার কোন হাত ছিল না সেটা নিয়ে মন খারাপ করার কোন মানে হয় না। আমরা তো আছি এক জন আরেক জনের জন্যে। শান্তা সারাটা দিন ধরে কাঁদে। স্বামী হিসাবে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো কি তার দায়িত্ব না? না সে কাজটা করতে পারলো না। অন্য কোন মেয়ে যদি তার স্ত্রী হত, তা হলে একই সমস্যা হয়তো হত না। গর্ভপাত করাতে হত না। মোহন বুঝল, এরকম চিন্তা করাটা মারাত্মক ভুল হচ্ছে। বিধাতা তার সিদ্ধান্ত তার মত করেই নেন।

মোহন অস্থির হয়ে উঠল। তার একটা আশ্রয়ের দরকার। দরকার শক্তির। না হলে সে বিলীন হয়ে যাবে। ইমেল করলো সুমিতাকে জানাল যে সে তিন দিনের জন্যে কলকাতায় আসবে। হাতে হাত রেখে কবিতা পড়াটা এখন ভীষণ দরকার।

প্রথম বারের মত শান্তা অগ্রাহ্য করলো মোহনকে। ছোট বেলার বন্ধু মিতা, একদিন দেখা করতে আসলো। আঁতকে উঠল শান্তার চেহারা দেখে। সব কিছু শুনে বলল, “তোকে এই ঘর থেকে বের হতে হবে। চাকরি শুরু কর কোথাও। ব্যস্ত থাকলে আর নিজের পায়ে দাঁড়ালে দেখবি অনেক কিছু সহজ হয়ে গেছে।”

তিন দিনের মাথায় মিতা একটা ইনটারভিউ'র ব্যবস্থা করে দিল। একটা এড ফার্মে। মাত্র তিন বছরের ব্যপূর্ণ ব্যবসা। এর মধ্যে চারিদিকে প্রচুর সুনাম নাম হয়ে গেছে। তাদের একটা মানুষ দরকার যে স্ক্রিপ্ট লিখতে পারবে। ওরাই কাজ শিখিয়ে নেবে। বেতন বেশ ভাল, মাসে ২০ হাজার টাকা। ফার্মের মালিকের নাম মহসিন। মিতার ছোট ভাইয়ের বন্ধু। কথায় কথায় বের হল সেও এক সময় মোহনের ছাত্র ছিল।

মোহন মেনে নিল না শান্তার চাকরি করাটাকে। চোখা চোখী হলেই চোখ নামিয়ে নিত। এক দম্পতির ‘যাপিত জীবনের’ সুত্রপাত হল। রাত করে ঘরে ফিরতে আরম্ভ করল। প্রায় দিনই আসতো দুলতে দুলতে। মুখ, গায়ের থেকে বের হত বোটকা মদের গন্ধ।

প্রতি মাসে বেতন পাওয়া মাত্র, শান্তা বারো হাজার টাকা রেখে আসত মোহনের পড়ার টেবিলের উপর। মোহন কোন প্রশ্ন করতো না, কোন মন্তব্যও করতো না। তবে, শান্তা একদিন দেখল টেবিলে বেশ বড় রকমের সুন্দর একটা বার্থ ডে কার্ড। নিশ্চয়ই মেল করার জন্যে রেখে দিয়েছে। খামের উপরে সুমিতার নাম, ঠিকানা লেখা। এখনো খামের মুখ বন্ধ করা হয় নি। কিছুটা কৌতহল নিয়ে খুলে দেখল। লেখা, জন্মদিনে তোমায় ভালবাসা, তোমার মধ্যেই আছে আমার পরিপূর্ণতা। অপেক্ষায় আছি সেই দিনের, যেদিন তুমি থাকবে আমার পাশে।

শান্তার মনে হল বেহালার শেষ তারটাও বুঝি ছিঁড়ে গেল। সে মোহনের চাহিদা মেটাতে পারছে না---না শরীরের, না মনের। তার এখন কি করা উচিৎ? সে তো কথা দিয়ে রেখেছে, কথা রাখার। মোহনকে ছেড়ে চলে গেলে কি সমাধান হবে। তার জীবনে কি পরিপূর্ণতা আসবে? সে তো কথা রাখছে, যার আক্ষেপ ছিল কেও কথা রাখে না, সেই তো দেখা যাচ্ছে কথা রাখছে না। মনে পড়ল সুনীলের কবিতার আরো কয়েকটা লাইনঃ

নাদের আলি আমি আর কত বড় হবো?

আমার মাথা এই ঘরের ছাদ

ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তুমি আমায়

তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

কিন্তু, মোহন নিজের থেকে তো কিছু করতে পারে না। শান্তাকেই তো মোহনের কাছে এসে প্রেমের প্রস্তাব দিতে হয়েছিল। গ্লাসে পানি ঢেলে দেয়া থেকে আরম্ভ করে, কোন পোষাক পরে বের হতে হবে তাও তাকে ঠিক করে দিতে হয়। তা হলে শান্তাকেই কি ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যাতে মোহন তার প্রকৃত ভালোবাসার ঠিকানায় পৌঁছায়।

১০

এখন দরকার ছাড়া মোহন শান্তার সাথে কথা বলে না। রাত হলে মোহন লিখতে বসে অথবা ফেসবুকে থাকে। বেশির ভাগ সময় কাটায় সুমিতার সাথে। এই সময়টা শুধু দেখা যায়, মোহনের মুখে কোন বিষাদের ছায়া নাই। শান্তা কয়েকবার দেখেছে, মোহনকে এক চোখে তাকিয়ে থাকে কম্পিউটারে সুমিতার ছবির দিকে। মাঝে মাঝে আবার ফিস ফিস করে কি যেন আবার বলে।

শান্তার একবার বেশ কিছু কাজ জমে ছিল অফিসে। খেয়ালই করে নি এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে বের হতে যেয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। মনে হল, বাসায় তো আর তার অপেক্ষায় কেও নাই। কি হবে এই ভাবে ছুটে যেয়ে। মোহন তো আসবে সেই মাঝ রাতে। যদি মাতাল হয়ে আসে, তা হলে তো সরাসরি ঘুমিয়ে পড়বে। আর হুশ থাকলে কম্পিউটারে যেয়ে বসবে। উফ, এই জীবন তো সে চায় নি। একটা মানুষকে ভালোবেসে আর কবিতা শুনে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু, এইটা কি পেলো। একেবারে ভিতর থেকে অনেক দিনের জমানো দমকা কান্না বেরিয়ে আসতে লাগল।

মহসিন শান্তার অফিসের পাস দিয়ে যাবার সময় শুনল কান্নার শব্দ। কাছে এসে জানতে চাইল, “কি হয়েছে আপনার?” শান্তা কোন কথা বলতে পারলো না। ডুবন্ত মানুষ যেমন ভেসে থাকা পাট খড়ি আঁকড়িয়ে ধরে, তেমনি সে মহসিনের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকল। কিন্তু এত দিন পর্যন্ত ওদের মধ্যে তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। বেশ অনেকবার কান্না থামাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু না আরো প্রবল বেগে আসলো। মহসিন আশ্রয় দিল শান্তাকে। অফিসে সেই সময় কেউ ছিল না। শান্তা কেঁদে কেঁদে শান্ত হল।

১১

শুক্রবার ছুটির দিন। কাল মোহন বাসায় ফিরে নি। শান্তা সারারাত জেগে ছিল। সকালে এক কাপ চা আর পত্রিকাটা নিয়ে বসল কিছুটা সময় কাটানোর জন্যে। ভিতরের সিনে পাতার দিকে চোখ গেল। ডান দিকের কোণায় মোহনের ছবি। তার কাহিনী চিত্র “বেদের মেয়ে বাইদানী” মুক্তি পেয়েছে। আরও তিনটা একই ধরনের ছবি মুক্তির পথে। শান্তার শরীর রি রি করে উঠলো। বাংলায় পিএইচডি পাওয়া মানুষ এই গুলো কি করছে। মানুষ কি টাকার জন্যে তার রুচি জ্ঞান হারাতে পারে?

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আর না। মোহনের সাথে সে আর থাকবে না। তাকে সে সুযোগ করে দিবে। সে যাক তার মানুষের কাছে, যে একেবারে তারই প্রতিচ্ছবি। কবিতা জানে, কবিতা আবৃত্তি করতে পারে একেবারে তার সাথে গলা মিলিয়ে। মোহনের যেখানে স্বাচ্ছন্দ সেখানেই সে চলে যাক, সেখানেই সে সুখে থাকুক।

১২

ছবির প্রযোজক, পরিচালক বিরাট একটা পার্টির আয়োজন করেছিল, “বেদের মেয়ে বাইদানী” মুক্তি উপলক্ষে। মোহনের মদ পান একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে । বমি করতে করতে জ্ঞান হারায়। ওখান থেকেই ধরা ধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

ডাক্তাররা বলে, লিভারের অবস্থা খুব খারাপ। কমপক্ষে সপ্তাহ দুয়েক থাকতে হবে। হয়তো বিদেশে যাবার দরকারও হতে পারে।

মোহন মুখরোচক খবরটা হাসপাতালে দ্বিতীয় দিনই পেল।। শান্তা তার থেকে দশ বছরের ছোট মহসিনকে বিয়ে করবে। হাসপাতালের বসেই সাত দিনের ব্যবধানে মোহন দুটো চিঠি পেল। প্রথমেরটা ডিভোর্সের নোটিস। পরেরটা, একটা চিঠি শান্তা থেকে। অল্প কিছু লেখা। তুমি যার কাছে গেলে নিজেকে বিকাশ করতে পারো, তার কাছেই যাও। আমি জানি তুমি বিশাল কিছু একটা করার ক্ষমতা রাখো।

১৩

শান্তা এখন মহসিনের ঘরণী। অফিসে খুব একটা আসে না। কবিতার বই দেখে, কবিতা পড়ে। বুঝার চেষ্টা করে এর মধ্যে কি আছে যে তার চূড়ান্ত ক্ষতি এই কবিতার কারণেই হল।

একা ছিল ঘরে শান্তা। বেশ জোড়ে জোড়ে কবিতা পড়ছিল। হয়তো আবৃত্তি বলা যেতে পারে। ফোনটা বাজতে থাকল। কবিতা থামিয়ে ফোন ধরল। ওই দিক থেকে মহসিন উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, “জানো আমরা আমাদের পরের কমার্শিয়ালে হুমায়ূন ফরিদীকে কাস্ট করবো”।

শান্তা সাথে সাথে ফিরে গেল তার সেই সোনালী অতীতে। মনে এলো, সেই ফুল আর ফরিদী প্রেমের কথা। এ কথা গুলো সে কখনো মহসিনকে বলে নি। ভাবনায় সুবর্ণা আসলো সাথে সাথে। সেও তো এতো ভালোবাসার ফরিদীকে ত্যাগ করেছে। সুবর্ণাও কি ফরিদী থেকে প্রচণ্ড বিশাল কিছু আশা করতো, যার জন্যে সে এই জগতের সব চেয়ে দামী জিনিসটাকে ছেড়ে দিয়েছে? কি আশ্চর্য ভাবে যেন মানুষের জীবনের ঘটনাগুলো মিলে যায়।

শান্তা একবার ভাবল, মোহনের সাথে দেখা করে বলতে, সেও এখন কবিতা বুঝে, হয়তো তার সাথে গলা মিলিয়ে আবৃত্তিও করতে পারবে। কিন্তু না, তারা দু জন এখন দুই ভুবনের বাসিন্দা। সেটা আর কোন ভাবেই সম্ভব না। কবিতাটা আবার পড়া আরম্ভ করলোঃ

“আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা গড়িব না ধরনীতে

মুগ্ধ ললিত অশ্রু ললিত গীতে.......”

মে ২৪, ২০১১

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com