বহে সমান্তরাল

অবশেষে মনে হল সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সালমা বেগমের চোখে পানি দেখা গেল। মুখ আর বুকের থেকে কান্নার শব্দ বের হতে আরম্ভ করলো। ছোট বোন পপিকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, লোকটা কি ভাবে পারলো এভাবে চলে যেতে। এখন আমাদের কি হবে। আগামী শুক্রবার শাম্মিকে দেখতে আসবে। ওকে বিয়ে দিতে না পারলে কেমন করে চলবে?

সালমা বেগমের স্বামী জুলমত আলি বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছে শারমনো ক্লিনিকে। বাদ জুম্মা জানাজা, তার পর মাটি দিয়ে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। অবশ্য বেশির ভাগ মানুষ যে যার বাসায় চলে গেছে। স্বামীর মৃত্যুর খবরে সালমা একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিল। মুখ থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছিল না। উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে বড় জাম গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ছেলে মুন্না শেষ বারের মত চেষ্টা করলো, মা, বাবাকে এখন আমরা গোরস্তানে নিয়ে যাব। তুমি কি একটু বাবাকে দেখে বিদায় দেবে? তখন সালমা একইভাবে নির্বাক হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল; কোন ভাবান্তর হল না। জুলমত বাড়ি থেকে শেষ বারের মত যাত্রা করলো। দু জনের চোখে চোখে কোন কথাই হল না। দু জোড়া চোখের এক জোড়া চোখ যদি বন্ধ থাকে, তা হলে কি আর কথা হয়?

চব্বিশ বছরের দাম্পত্য জীবন এই ভাবেই পরিসমাপ্তি। প্রেম না, দু পক্ষের বাবা-মা রা কথা বলে বিয়ে ঠিক করেছিল। কিন্তু বিয়ের পরে, এক জন যেন আরেকজনকে সাথে একেবারে আঠার মত লেগে থাকতো। একবারে বাধ্য না হলে, কেও কারোর চোখের বাইরে যেত না। মনে হত দু’ জনের জানা জানি যেন শত বছরের। তার পরেও জুলমত যখন সকালে কাজের জন্যে বাসার থেকে বের হওয়ার শেষ কদম দিত, তখন সে ঘুরে একবার তাকাবেই। সালমার সাথে চোখে চোখে কথা হবেই। চোখের ভাষায় জুলমত বলত, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব; আর সালমা বলত, আমি তোমার জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষায় থাকবো।

বৃহস্পতিবার বিকালে জুলমত অফিস থেকে এসে বলল, শরীরটা খারাপ লাগছে। একটু ডাক্তার দেখিয়ে আসি। সালমা খুবই অবাক হল। জুলমত আগে তো কখনো শরীর খারাপ নিয়ে কমপ্লেন করে নি। সাথে যেতে খুব ইচ্ছে হছিল। কিন্তু শাম্মি বাইরে গেছে, ওর জন্যে বাসায় থাকতে হবে। মুন্না বাসাতে ছিল। তাকে ডেকে বলল, তোর বাবার শরীর খারাপ করছে। বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যা।

পিঠাপিঠি ভাই বোন মুন্না,শাম্মি। শাম্মি বড়, মুন্না ছোট; বয়স উনিস আর কুড়ি। দু জনেই ইউনিভার্সিটি যায়। শাম্মি আবার সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস ফাইভের একটা ছেলেকে প্রাইভেট পড়ায়। আজ সেখানেই গেছে। আসতে আসতে রাতের নয়টা বেজে যায়। বেশির ভাগ সময়েই মুন্না যেয়ে নিয়ে আসে। সালমা বলে দিয়েছে, মোবাইলে কল করে দিলে মুন্না যেয়ে নিয়ে আসবে। যদিও ছাত্রের বাসা পায়ে হাঁটার রাস্তায় দশ মিনিট। তার পরে সালমা কখনই রাজী হয় নি, শাম্মিকে একা রাতের বেলা হেঁটে বাসায় ফিরতে দিতে। মায়ের মন তো, সব সময় অজানা আশংকায় দুলতে থাকে। আজকে মাকে যেয়েই, মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে।

পাড়ার ডাক্তার বুকের ব্যথা আর আলামাত শুনে বলল, এখনই হাসপাতালে যান। হাসপাতালে জুলমত আর মুন্না যখন পৌঁছাল, তখন জুলমতের বুকের ব্যথা চরমে। তার পরে হাসপাতালে ডাক্তার দেখতে আরও ঘণ্টা খানেক লাগালো। প্রথমে মুন্না আর জুলমতকে প্রমান করতে হল, তারা হাসপাতালের খরচ পত্র দিতে পারবে।

জুলমতের আয়ু এর পরে আর তিন ঘণ্টা ছিল। চোখ বন্ধ করেই ছিল। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে চোখ খুলে, বড় বড় চোখ করে মুন্নার দিকে তাকালো। তার পরে কি যেন একটা বলার চেষ্টা করলো। মুন্না শুধু একটা কথাই বুঝল,......তোর মা.........। কথা শেষ হওয়ার আগে আবার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মুন্না দৌড়ে যেয়ে একজন নার্স ডেকে আনলো। নার্স এসে জুলমতের হাত ধরে ঘোষণা দিল, রোগী মারা গেছে।

এমেরিকার খুব বড় একটা শহর হিউষ্টন। টেক্সাস ষ্টেটের বন্দর নগরী। সেখানকারই একটা ছোট পাড়া পার্ক ক্রীক। শ খানেক বাসা। বেশির ভাগ এক তালা। তবে কিছু দু তালা বাসাও আছে। মোটামুটি মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষরা থাকে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষেরা আছে। সাদা, কালো, হিসপানিক, বাঙালি, ভারতীয়। এখানকার একজন বাসিন্দা, বব নিক্সন। বয়স কিছুটা বেশী অন্য প্রতিবেশীদের তুলনায়। আসলে সে ই পার্ক ক্রীকের একমাত্র মানুষ যে অবসরপ্রাপ্ত।

বব নিক্সন কিছুটা অদ্ভুত প্রকৃতির। একা একা থাকে। কেও তাকে কখন মেয়ে বন্ধু নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে নি। একেবারেই হৈচৈ, হৈ হুল্লোর করে না। তবে সন্ধ্যার পরে একের পড় এক বিয়ারের বোতল খালি করতে থাকে। গাড়ির শহর হিউষ্টন। ববের একটা গাড়ি থাকলেও, তাকে সপ্তাহে একবারের বেশী গাড়ি চালাতে দেখা যায় না। প্রতি রোববার প্রায় পনের বছরের পুরনো একটা গাড়ি নিয়ে সে চার্চে যায়। পরনে থাকে কাল স্যুট, টাই আর কোটের উপরের পকেটে, কাপড়ের লাল একটা ফুল।

বব সাইকেল চালায়। দু পায়ে প্যাডেল দেয়া সাইকেল। সকালের নাস্তা খেয়ে বেড়িয়ে যায়। দুপুরে ফিরে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম। তার পরে আবার সাইকেল নিয়ে বেড় হয়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সব মিলিয়ে দিনে ছয়-সাত ঘণ্টা সাইকেল চালানো তো হয়েই যায়। কোন কোন দিন সাইকেল নিয়ে পাঁচ -ছয় মাইল পর্যন্ত দূরে চলে যায়। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কোন কিছু তাকে আটকে রাখতে পারে না। বাড়ি, মানুষ, আর কত না ঘটনার না স্বাক্ষী হয়ে থাকে প্রতিদিন বব নিক্সন। সাইকেল চালাতে চালাতে বব ওই গুলো দেখে। কখন যদি সুযোগ হয়, এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। তবে, যান্ত্রিকতার দেশ এমেরিকায় নিজের হাতে অন্যকে সেবার সুযোগ দিনে দিনে কমে আসছে। ফোন উঠালে আর টাকা খরচ করলে, সব কিছুই হাতের কাছে চলে আসে মুহূর্তের মধ্যে। তা ছাড়া কেউ কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। সব কিছুর মধ্যে স্বার্থ উদ্ধারের একটা গন্ধ খুঁজে পায়।

মানুষে বলা বলি করে, ববের সাইকেল চালানোটা একটা নেশা।

কিন্তু সাইকেল চালানোটা কি নেশা হতে পারে?

পার্ক ক্রীক পাড়ার, এক বাসায়, শাম্মির শ্বশুর বাড়ি। বাড়ির মালিক মারা গেছে বেশ কিছু বছর আগে। তার স্ত্রী, আর তার একমাত্র ছেলে খোকন সেখানে থাকে। খোকন হল শাম্মির স্বামী। বাবা জুলমতের মৃত্যুর দুই সপ্তাহের মাথায় শাম্মির বিয়ে হয়।

বিয়েতে শাম্মির প্রবল আপত্তি ছিল। কোন ক্রমেই বাবার মৃত্যুর চল্লিশ দিনের আগে বিয়ে করতে, মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু এমেরিকা প্রবাসী ছেলের মহা তাড়া। মেয়ে তার চোখে ধরেছে। সে দেশে এসেছে এক মাসের জন্যে। এর মধ্যে বিয়ের করে যেতে চায়। এর পরে আবার কবে দেশে আসতে পারবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। ছেলের মা এসে সালমা বেগমের সাথে কথা বলল। বিয়ে এখন দিতেই হবে। না হলে ছেলে দিওয়ানা হয়ে যাবে।

অদ্ভুত। যেই স্বামীকে একটু কিছুক্ষণ না দেখলে সালমা অস্থির হয়ে যেত। তার মৃত্যুর সাত দিনের মাথায় সে কঠিনভাবেই মেয়েকে বলল, তুমি এই ছেলেকে বিয়ে করে ফেলো। এক বারো জানতে চাইল না, তার পছন্দ হয়েছে কিনা কিংবা এখন বিয়ে করতে চায় কিনা। শুধু কঠিনভাবেই জানালো, তোমার বাবা কিছু রেখে যায় নি। এখন কি ভাবে যে সংসার চালাবো। শাম্মির বুঝতে সময় লাগলো না, মা তাকে সংসারের একজন না ভেবে, বোঝা হিসাবে মনে করছে। মা বললে, সে তো আরেকটা টিউশানি নিতে পারে, কিংবা একটা চাকরি।

শেষ অস্ত্র হিসাবে, শাম্মি বলল, আমার পড়া লেখার কি হবে। আমার আগামী বছর বিএ ফাইনাল পরীক্ষা। লাভ হল না, মা বলল, এমেরিকায় গেলে অনেক পড়ালেখা করতে পারবে। দরজা বন্ধ করে শাম্মি অনেকক্ষণ কাঁদলো। ঘরের মধ্যে ছিল, শাম্মির গত তিন বছরের সাথী, ধব ধবে সাদা পোষা বিড়াল। অনেক শখ করে নাম দিয়েছিল মিনি। শাম্মি যতক্ষণ বাসায় থাকে, ততক্ষণ ওর সাথে সাথেই থাকে। মিনিও মনে হল, খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো শাম্মির দিকে। শাম্মিকে সে কখনো কাঁদতে দেখে নি। মিনি এসে শাম্মির একেবারে কাছে এসে বসলো। শাম্মি অবুঝ এক পশুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। এক অবুঝ পশু তার জন্যে যতটুকু অনুভব করে, পৃথিবীতে আর কেউ হয়তো তা করে না। যেই মানুষটা হয়ত করত, সে মাত্র কয়েক দিন আগে, না বলেই ওই পারে চলে গেছে !

বব নিক্সন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সামান্থা জোন্সকে। হাই স্কুলে তারা এক সাথে পড়তো। এমেরিকায় একে বলা হয় হাই স্কুল সুইট হার্ট। বয়সে তারা তখন একেবারে নবীন। মাত্র কলেজে পড়ছে। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিল বিয়ে করবে। এক সাথে থাকতে পারলে কত না আনন্দ। সারা দিন কত কিছুই না করা যায়।

বিয়ে করে যখন দু জনে চার্চ থেকে বের হচ্ছিল, তখন সামান্থা একটা লাল টকটকে কাপড়ের ফুল ববের কোটের পকেটের উপরে পিন দিয়ে লাগিয়ে দিল। মুখটা কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, সুইট হার্ট, কথা দাও, তুমি যত দিন বেঁচে থাক আর যখনই স্যুট পর , আমার এই ফুলটা এই জায়গায় লাগাবে। এমনকি যদি আমি মরে যাই কিংবা তুমি অন্য মেয়েকে বিয়েও কর। আমি এই ফুল নিজের হাতে বানিয়েছি। ফুল বানানো শেখার জন্যে আমি একটা ছয় মাসের কোর্সও করেছি। উদ্দেশ্য ছিল একটাই। তোমার জন্যে একটা ফুল বানিয়ে দেয়া , যা কখনো যাতে ঝরে না পড়ে। আজীবন টিকে থাকে। উত্তরে বব বলল, ডার্লিং ভেবো না। তুমি যেখানে আজ ফুলটা লাগিয়ে দিলে, সেই ফুল সেখানেই থাকবে। মনে রাখে বব একবার কথা দিলে, সেটা রাখে।

বিয়ের পরে এক সাথে থাকা গেল ঠিকই। কিন্তু বাস্তবতা এসে হাজির হল মুহূর্তের মধ্যেই। এপার্টমেন্ট ভাড়া, খাওয়া দাওয়া, জামা কাপড় থেকে আরম্ভ করে সব কিছুর খরচ বেড়ে দ্বিগুনেরও বেশী হয়ে গেল। আগে সামান্থা মায়ের বাড়ি থাকত; কোন খরচ লাগতো না। বরং কিছু হাত টাকা খরচ করার জন্যে পেত। বিয়ের পরে এগুলো সব বন্ধ হয়ে গেল। অন্য দিকে বব, দুই বন্ধুর সাথে এপার্টমেন্ট শেয়ার করে থাকত। সপ্তাহে ঘণ্টা বিশেকের পার্ট টাইম কাজ করে যা পেত, তা দিয়ে মোটামুটি চলে যেত। কলেজের খরচ সব সরকারী ঋণের থেকে দেয়া হত।

আনন্দের পুলক একেবারে ক্ষণস্থায়ী হল। মাস দু’কের মধ্যে সামান্থা পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে ফুল টাইম কাজ নিল। ববও তার কাজ বাড়িয়ে দিল। চোখে তখন তাদের স্বপ্ন। বব পড়া লেখা শেষ করে অনেক টাকা বেতনের একটা চাকরি পাবে। সামান্থা আবার পড়ালেখায় ফিরে যাবে। তার পরে শুধু প্রাচুর্য, সুখ আর আনন্দ।

কিন্তু না জীবন স্বপ্নের সিঁড়ি ধরে উঠতে পারলো না। সংসার আর কাজের চাপে ববের পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগলো। পরীক্ষায় গ্রেড খারাপ হতে লাগলো। পর পর দু সেমিস্টারে ওয়ার্নিং পেল। শেষ রক্ষা হল না। তৃতীয় বারও যখন উন্নতি হল না, কলেজ তাকে বাদ দিয়ে দিল। ব্যাপারটা অনেকটা মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত দাঁড়ালো। এমনিতেই টানাটানি, তার উপরে স্টুডেন্ট লোনের টাকা শোধ দিতে হবে। দু জনের একেবারে দিশেহারা অবস্থা হল।

শাম্মির এক খালাত বোন রিনি একই শহরে থাকে। কিন্তু কিছুটা দূরে। গাড়িতে যেতে প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যায়। শাম্মির এমেরিকায় আসার পরের দিন-ই দেখা করতে এসেছিল। অনেক দিন পরে দেখা। তাই অনেক হৈ চৈ কথা বার্তা হল। রিনি চলে যাবার পরে খোকন ফিরেছিল।। দু জনের দেখা হল না। শাম্মি খুব আহ্লাদ করে স্বামীকে বলল, রিনি আপু এসেছিল। আমার খালাত বোন। আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। কিন্তু একেবারে বন্ধুর মত। জানো ও গাড়ি চালায়। বলেছে শনিবারে এসে আমাকে মলে নিয়ে যাবে আর আমাকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিবে। কথাগুলো শুনলেও খোকন না শোনার একটা ভান করলো।

তার পরে খোকন গেল তার মায়ের ঘরে। সেখান থেকে যখন বের হল, তখন মুখটা একেবারে গম্ভীর। শাম্মি তো ভয়-ই পেয়ে গেল। ভাবল কি এমন হতে পারে। জানতে চাইলো, কি, কোন সমস্যা? খোকন আরো গম্ভীর হল, কোন উত্তর দিল না। শুধু ঘুমাতে যাবার আগে, বেশ কঠিন ভাবেই শাম্মিকে বলল, আমি চাই না তোমার রিনি আপু এই বাসায় আর কখনো আসুক কিংবা তোমাকে ফোন করুক।

শাম্মি অবাক হল। ভীষণ অবাক হল। মনে হল স্বামী না, স্কুল মাস্টার কথা বলছে। এমেরিকায় থাকা এক জন লোক কি এ রকম করে কথা বলতে পারে? এখানে না সবার সমান অধিকার? তা হলে কি বাঙালি ছেলেদের জন্যে ব্যতিক্রম আছে? এখন বাংলাদেশেও স্বামীরা তাদের বউদের সাথে এমন করে কথা বলে না। বিয়ের আগে বলা হয়েছিল ছিল, ছেলে ইঞ্জিনীয়ার। তা হলে লোকটা দোকানে কাজ করতে যায় কেন? কোন কারণ ছাড়াই রিনির সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিচ্ছে। লোকটার কি কোন দুর্বলতা আছে, যা বের হয়ে যাবে? সারা রাত ঘুম হলো না। একটার পর একটা চিন্তা মাথার মধ্যে আসতে থাকলো। ভোর রাতে একটু তন্দ্রার মত হল। কিন্তু একটু পরেই শাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাঙল। বেশ জোরেই বলছে, শাম্মি তোমার মা ফোন করেছে।

মা বুঝতে পারে নি, বাংলাদেশে যখন দিন তখন এমেরিকায় রাত। কথাটা শাম্মিই বলল; ভোর রাতে যাতে আর শাশুড়ির ঘুম, মায়ের ফোনের শব্দে না ভাঙ্গে। মা এ কেমন, সে কেমন, বলাবলি করার পরে বলল, মারে মিনি আজকে দুপুরে গাড়ির তলায় পড়ে মারা গেছে।

সালটা ১৯৭০। বব আর্মিতে যোগ দিল। রিক্রুটার বলল, আর্মি থেকে তিন বছর পর বেরিয়ে আসতে পারবে। তখন ত্রিশ হাজার ডলার আর পড়া লেখা শেষ করার জন্যে সব খরচ পাবে। তা ছাড়া বাকি জীবন চিকিৎসার জন্যে কোন খরচ লাগবে না। এ গুলো সব শোনার পরে, বব সামান্থাকে বলল, ডার্লিং মাত্র তিন বছর। তার পরে আমরা সব ধার দেনা শোধ করে দিতে পারব। আর্মি থেকে বের হয়ে, কোন একটা ছোট শহরে যেয়ে নতুন করে সংসার আরম্ভ করবো। তা ছাড়া আর্মিতে জয়েন্ট করে ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে না গেলে, আমাকে ধরে এমনিতেই জেলে ডুকিয়ে দেবে।

বব, সামান্থাকে মায়ের সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। বলল, মাসে মাসে তোমার খরচ আমি ই পাঠিয়ে দিব। তুমি কোন ভেবো না। মা একাই থাকত। মেয়ে সাথে থাকবে, খরচ ভাগাভাগি করবে; শুনে খুব খুশী হল। সামান্থার বাবা যখন অন্য একটা মেয়ের হাত ধরে চলে যায়, তখন কন্যার বয়স পাঁচ। সামান্থার মা এর পরে আরেকটা বিয়ে করেছিল। প্রায় বছর তিনেক আগে সেই ভদ্রলোকও মারা গেছে।

সামান্থা বিয়ে করে বাসা থেকে চলে যাওয়াতে, মার এক ধরনের ভালই লেগেছিল। যাই হোক কিছুটা হলেও খরচ তো কমল। খাওয়া দাওয়ার জন্যে খরচ কমবে, হাত খরচ দিতে হবে না; ভালই তো।

ভিয়েতনামে যাবার দিন এয়ারপোর্টে বব সামান্থাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি ফিরে আসলে আমাকে কিন্তু একটা বাচ্চা গিফট দিতে হবে। ছেলে হোক মেয়ে হোক, আই ডোন্ট কেয়ার। তবে আমার মত দেখতে হওয়া চাই। সামান্থা ববের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তুমি ফিরে আস। তোমাকে আমি খুব বড় একটা সারপ্রাইস দিব। বব তার কোটের পকেটের সাথে লাগানো সামান্থার দেয়া কাপড়ের লাল ফুলটা দেখিয়ে বলল, এইটা সব সময় আমার সাথেই থাকবে।

সামান্থা ববের থেকে গোপন করলো, তার পেটে ববের বাচ্চা বড় হচ্ছে।

শাম্মিকে এখন রান্না করতে হয়। আগে সখ করে এটা সেটা রান্না করলেও, প্রতিদিন ভাত ডাল, মাছ, মাংস কখন রাঁধে নি। একদিন শাশুরি ঘোষণা দিল, তার পক্ষে রান্না করে বাড়ির বউকে খাওয়ান সম্ভব না। শাম্মিকে হাল ধরতে হল রান্না-বান্নার। প্রায় প্রতি রাতেই দেখতে হত, খোকনের কাল মুখ আর বিভিন্ন ধরনের টিপ্পনি। রাঁধতেও শিখনি। দেশে কি সেজে গুজে প্রেম করে বেড়াতে?

এর মধ্যে শাম্মি একদিন আবিষ্কার করলো, খোকনের সাথে এক সাদা মেয়ের খুব অন্তরঙ্গ ছবি। আবার কিছু ছবিতে, ওদের সাথে একটা পাঁচ ছয় বছরের ছেলেও আছে। ছবি গুলো হাতে নিয়ে শাশুড়িকে কাছে জানতে চাইলো, এ গুলো কাদের ছবি? শাশুড়ি কোন উত্তর দিল না। শুধু বলল, মেয়েদের বেশী কৌতহল থাকা ভাল না। ছবিগুলো যেখানে ছিল সেখানে রেখে দাও।

ওই দিন রাতেই খোকন শাম্মির উপরে চড়াও হল। কিল, ঘুষি, চড়, থাপ্পর মারতে মারতে মাটিতে ফেলে ফিল, হারামজাদী তোর এতো বড় সাহস আমার কাগজ পত্র ধরিস, গবেষণা করিস। আবার জানতে চাস, কার ছবি। তার পরেও ক্রোধ গেল না। লাথি মারতে আরম্ভ করলো। শাম্মি তার পেটটাকে বাঁচানোর জন্যে গুটিশুটি হয়ে বসল। পেটে যাতে কোন আঘাত না লাগে। ওখানে একটা ছোট প্রাণ এর মধ্যে বড় হতে আরম্ভ করেছে।

খোকন এক ঘণ্টা পরে এসে আবার হাজির হল। এই বার মার না, তার নিজের শরীরের ক্ষুধা মেটানোর কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। মার ধর থেকেও এ কম লাঞ্ছনা না। শাম্মি চোখ বন্ধ করে মিনির কথা ভাবতে লাগলো। সেই দৃশ্য চোখে ভেসে আসলো, সে কাঁদছে আর মিনি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মিনি হয়তো ভাবতেই পারে নি, শাম্মি কাঁদতে জানে। কিন্তু শাম্মি এখন কাঁদে, নিঃশব্দে, সব সময়ে!

সমাজতন্ত্র ঠেকাতে যেয়ে ভিয়েতনামে যুদ্ধে এমেরিকা জড়িয়ে পড়ল। দক্ষিণ ভিয়েতনামকে উত্তর ভিয়েতনামের হাত থেকে বাঁচাতে এমেরিকা তার সামরিক বাহুবল ব্যবহার আরম্ভ করলো। এমেরিকা ৮ মিলিওন টন বোমা ফেললো। পরিমানে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ৪ গুন। নাপাম বোমা পর্যন্ত ব্যাবহার করলো। কিন্তু খুব সুবিধা করা গেল না। বাধ্য হয়ে মার্কিন স্থল বাহিনী আসলো উত্তর ভিয়েতনামকে হারানর জন্যে। জঙ্গল, পাহাড়, আর নদী-নালায় ভরা দেশটাতে। গেরিলারা অতর্কিত আক্রমনে মার্কিন বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। প্রচুর এমেরিকান প্রাণ হারাল। অনেকে আবার বন্ধী হল ভিয়েতনামিদের কাছে। কিছু মানুষ নিখোঁজ হল।

সায়গন থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা এক জঙ্গল। পাশ দিয়ে খরস্রোতা এক নদী চলে গেছে। খুবই বিশ্বস্ত সুত্রে খবর এলো সেখানে পাহাড়ের চূড়ার এক ক্যাম্পে ছয় জন এমেরিকানকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে । তাদের উপর খুব অত্যাচার চালানো হচ্ছে। হয়তো মেরে ফেলবে।

কম্যান্ডো বাহিনী ডেলটা ফোর্সকে দায়িত্ব দেয়া হল এদের উদ্ধার করে নিয়ে আসার। এরা এই জাতীয় কাজ আগেও বেশ কয়েকবার করেছে। তার পরেও ৪ দিন তারা ব্যাপক ভাবে কাজটার মহড়া করলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে তাদের প্যারাসুট জাম্প করে নামতে হবে। তার পরে নদীতে সাঁতার কেটে, ক্যাম্পের পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেল করে পাহাড়ে উঠা আরম্ভ করবে। চলা ফেরা শুধু রাতে করবে। দিনের বেলা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকবে। ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে হিসাব অনুযায়ী সাড়ে তিন দিন লাগবে। তার পরে ঘণ্টা দুয়েক জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করে, ভোর রাতে আক্রমণ করে বন্দীদের মুক্ত করা হবে। ঠিক এ সময়ে হেলিকপ্টার এসে তাদের জায়গাটা থেকে নিয়ে যাবে। দলটার সদস্য ছিল পনের জন বাঘা বাঘা কম্যান্ডো।

সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হল। কিন্তু সবাই যখন হেলিকপ্টারে উঠছিল, তখন আরম্ভ হল ভিয়েতনামীদের বৃষ্টির মত গুলি। বেশ কয়েক জনের গায়ে গুলি লাগলো। তার পরেও তারা হেলিকপ্টারে উঠে যেতে পারল।

উঠতে পারলো না একজন। অন্যরা যাতে হেলিকপ্টারে উঠতে পারে, সে জন্য সে কভার দেয়ার কাজ করছিল। অবিরাম শত্রপক্ষকে মেশিন গান দিয়ে গুলি করে যাচ্ছিল। ঠিক যখন সে হেলিকপ্টারে উঠতে যাবে, তার গুলি লাগলো কপালে। বাম দিক দিয়ে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বের হয়ে গেল। রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হেলিকপ্টার তাকে ছাড়াই উপরে উঠে গেল।

আহত এমেরিকান কম্যান্ডোর নাম বব নিক্সন।

এক দিন শাশুড়ি, খোকন দু জনই বাসায় ছিল না। শাম্মি ফোন করলো রিনিকে। অনেকক্ষন ধরে শব্দ করেই কাঁদল। বলল, মনে হচ্ছে এমেরিকা না, এক নরকে এসে পড়লাম। সারাদিন বাসার সব কাজ কর, রাত হলে মারধর খাও আর অপমানিত হও। আমি প্রেগন্যান্ট, তার পরেও কেও জানতে চায় না আমার কোন কষ্ট হচ্ছে কি-না।

শাম্মি রিনির থেকে খোকন সম্পর্কে অনেক খবর পেল। রিনি বলল, খোকন সম্পর্কে এখানকার বাঙ্গালিরা কম বেশী সবাই জানে। এক সেমিস্টার করে, আর পড়া লেখা করে নি। এক দোকানে কাজ করত। সেখানকার সেফ (সিন্দুক) খুলে তিন দিনের বিক্রির টাকা গায়েব করে দিয়েছিল। পরে আরও দু বন্ধুকে ব্যবসার পার্টনার বানানোর নাম করে তাদের সব টাকা পয়সা নিয়ে সর্বশান্ত করেছে। আরও অনেক ঘটনা শোনা যায়। কয়েকবার জেল পর্যন্ত খেটেছে।

গার্ল ফ্রেন্ড, পার্টি, মদ আনন্দ তার প্রিয় কাজ। অবশ্য, এক সাদা মেয়ের সাথে ফষ্টি নষ্টি করতে যেয়ে বিপদে পড়েছিল। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এখন তাকে চাইল্ড সাপোর্ট দিতে হয়। শোনা যায়, এখন ওদের সম্পর্ক ভাল। ছেলে ও তার মা কে নিয়ে এদিক সেদিক বেড়াতে যায়। শাম্মির ওই ছবিগুলোর কথা মনে পড়ল।

রিনি বলল, তোমরা যে কেন বিয়ের আগে এই ছেলে সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলে না। আমাকে একটু জানালেও তো পারতে। শাম্মি কোন উত্তর দিল না, মনে পড়ল বাবার মৃত মুখ আর মায়ের সেই অসহায়া মুখ, তাকে কঠিন ভাবে বলছে, তোমার বাবা কিছু রেখে যায় নি। এখন কি ভাবে যে সংসার চালাবো।

১০

বব ছয় বছর কাটালো ভিতেয়নামিদের কয়েদখানায়। সারা শরীরে তার অত্যাচারের চিহ্ন। কয়েদখানায় আসার আগে হাসপাতালে ছিল তিন মাস। তার তো বাঁচার কথা ছিল না। কপালের গুলির ক্ষত তারা সারিয়ে তুলল। প্রথম দিকে খুব অত্যাচার চলত, এমেরিকানদের সম্পর্কে তথ্যের জন্যে। পরে যখন ওরা বুঝল, ববের থেকে নতুন কিছু জানার নাই, তখন ভোগান্তি ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। ভিয়েতনামিরা ববকে ধরার পরে, সব কিছু ছিনিয়ে নিল। অস্ত্র-শস্ত্র, জামা কাপড় সব কিছু। কিন্ত বব ইংরেজি জানা এক ইনভিষ্টিগেটারকে খুব করে বলল, আমার প্যান্টের পকেটে যেই কাপড়ের লাল ফুলটা ছিল, তা আমার কাছে রাখতে দাও। ইনভিষ্টিগেটারের হয়তো দয়া হল। খুঁজে নিয়ে ফুলটা দিয়ে গেল। তার পরে ববের কাজ ছিল, সুযোগ পেলেই ফুলটার দিকে অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকা।

৩০ এপ্রিল, ১৯৭৫ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। তার পরে আরম্ভ হল, দু দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়। ববের ফিরতে আরও এক বছর লেগে গেল। দফায় দফায় বিনিময় চলছিল। বব বারে বারে হিসেব করলো, সে কত দিন পরে দেশে ফিরছেঃ ৫ বছর, ১০ মাস, ৭ দিন, ৬ ঘণ্টা, ৩ মিনিট। সেকেন্ডটা হিসাব করতে পারলো না। যাওয়ার সময়ে আসলে মনে করে আসলে সেকেন্ডটা দেখা হয় নি। আর ভাবতে লাগলো, সামান্থা কি সারপ্রাইজ তাকে দিবে। না-কি এত দিন পরে সারপ্রাইজের কথা ভুলেই গেছে।

বব দেশে ফিরে আবিষ্কার করলো, তার সুইট হার্ট সামান্থা অন্য আরেকজনের ঘরণী। ওদেরই স্কুলের আরেক বন্ধু জনকে বিয়ে করেছে। বব জানতে চাইলো, কেন কেন তুমি আমার জন্যে আপেক্ষা করলে না। সামান্থা বলল, আমরা তো জানি ভিয়েতনামিরা তোমাকে মেরে ফেলেছে। তা ছাড়া তুমি কোন চিঠি, পত্র, খবর দাও নি। আমি কি করে জানবো, তুমি বেঁচে আছো?

সামান্থা বলতে লাগল, তুমি ভিয়েতনাম যাওয়ার তিন মাসের মাথায় মা মারা গেল। আমার পেটে তখন তোমার বাচ্চা। আমি তখন দিশেহারা হয়ে পড়লাম কি করবো, কোথায় যাবো, কে আমার পাশে আশে দাঁড়াবে। কি ভাবে এই বাচ্চা আমি মানুষ করবো।

১১

আজ শাম্মির মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হল। একটা মানুষ তাকে কতটা ঠকাতে পারে। এক সে সময় সে স্বপ্ন দেখত, পড়ালেখা শেষ করে চাকরী করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আর যাই হোক কেউ তাকে অসম্মান করবে না। কিন্তু সে কি জীবন পেল, সারাক্ষণ শুধু লজ্জা, অপমান আর অত্যাচার। কোন বাঙালীর সাথে কথা বলা তার কঠিনভাবে নিষেধ। তার পরেও, বাইরের জগতের সাথে খোঁজ খবর পেতে মন চায়। সে জন্যে সুযোগ পেলেই লুকিয়ে ফোনে কথা বলে রিনির সাথে।

মাসে একবার মায়ের সাথে কথা বলার অনুমতি আছে। মা জানতে চাইলে বলে, ভাল আছে। কোন অসুবিধা নাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, মাকে একবার বলে, তুমি আমাকে কেন এই নরকে পাঠালে। কিন্তু মা তার জামাইয়ের উপরে মহা খুশী। খোকন তার শাশুড়িকে মাসে দুই শ ডলার করে পাঠায়। শাম্মি কখনো খোকনকে টাকা পাঠাতে বলে নি। তবে কি মা নিজেই.........। খোকন প্রায়ই এ নিয়ে শাম্মিকে ঠাট্টা করে, ফকিরনীর মেয়ে।

যাই হোক শাম্মি খোকনকে বলল, আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিলে ভাল হয়। আমার জানার দরকার, তোমার যে বাচ্চা আছে সে কথা আমাকে বল নি কেন। বাচ্চার মা তোমার এখন গার্ল ফ্রেন্ড সেটা আমি ভালই বুঝতে পারি। কথাটা শুনে খোকন তেলে বেগুলে জ্বলে উঠলো। আরম্ভ হয়ে গেল মারপিট। মারতে মারতে বলল, তোর এই গুলো জানার কোন দরকার নাই। এই দেশের সবারই এরকম দু-চার টে গার্ল ফ্রেন্ড থাকে। কথাটা মনে থাকে যাতে।

১২

জটিলতা আরম্ভ হল সামান্থা আর জনের জীবনে। বব ফিরে আসাতে, জন সামান্থাকে বলল, তুমি ববের কাছে চলে যাও। ওর বাচ্চা ওর কাছে ফিরে মানুষ কর। সামান্থা এটাতে রাজী হল না। আমি কি জড় পদার্থ। একবার এইখান, এরেকবার ওইখান করে বেড়াব। জন খুব দ্রুত আগ্রহ হারাতে থাকল সামান্থার উপর থেকে।

জন চলে গেল আরেক মেয়ের হাত ধরে। অনেক করে বলার পরেও সামান্থা ফিরে আসলো না ববের কাছে। তার খুব আত্মসম্মানে লাগলো। একই কথা আবার পরিস্কার করে বলল, আমি চাকরি করবো। আমার মেয়েকে আমি বড় করবো। আমার কারোর সাথে থাকার দরকার নাই।

বব আর নিয়ম মত চাকরিতে ফিরে গেল না। আর্মি থেকে প্রাক্তন আহত সৈনিক হিসাবে যে ভাতা পাচ্ছিল, তা দিয়ে মোটামুটি চলে যায়। তার পরে প্রতি মাসে কিছু টাকা জমিয়ে সামান্থাকে দিয়ে আসে মেরীর জন্যে খরচ করতে।

মেরীর বয়স যখন ১২ তখন সে জানতে পারলো জন না, বব তার আসল বাবা। ব্যাপারটা মেরীর খুবই অন্য ভাবে নিলো। ববের সাথে ভয়ানক খারাপ ব্যবহার করলো। বলল, তুমি কাপুরুষ। নিজের মেয়ের জন্যে যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তা তুমি কর নি। আমি তোমাকে আমি চাই না, আমি তোমাকে ঘৃনা করি। তুমি আমার সামনে কখনো আসবে না।

১৩

খোকনের মা মারা গেছে তিন বছর হল। শাম্মির মেয়ের তিন্নি দেখতে ঠিক মায়ের মত। ছয় বছর বয়স। ফার্স্ট গ্রেডে যায়। শাম্মি গাড়ি চালাতে পারে। ওই মেয়েকে স্কুলে আনা নেয়া করে। বাজার- গ্রোসারি করে। নিজের চেষ্টাতে গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছে। খোকনের পুরনো গাড়িটা চালায়। খোকন এই সব নিয়ে কোন কথা কখন বলে নি। তবে শাম্মি কিছু বাড়তি কিছু কাজ করছে, তাতেই হয়তো খুশী।

এক দিন বাড়ির সামনে ফুল গাছে পানি দেয়ার সময়ে, দেখল সাদা এক বয়স্ক লোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। খুব অবাক হল। সে সাধারণত দেখে অল্প বয়সের ছেলে মেয়েরা সাইকেল চালায়। কিন্তু এতো বয়স্ক এক জন? লোকটা মিষ্টি হেসে হ্যালো বলে চলে গেল।

১৪

লোকটা বব। ছোট একটা বাসা কিনে এই পাড়াতেই থাকে। খোকন-শাম্মির বাসা থেকে দেখা যায়। প্রায় বছর চারেক হয়ে গেছে সে সাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। সামান্থা মারা যাওয়ার পর থেকে তার এই ভাবে সময় কাটে। অনেক দিন সামান্থা ক্যান্সারে ভুগেছে। শেষের এক বছর বব অনেকটা জোর করেই সামান্থাকে তার বাড়ি নিয়ে এসেছিল। হাসপাতাল থেকে জানিয়ে দিয়েছিল, ওদের আর কিছু করার নাই।

সামান্থা ববের বাড়িতে আসাতে মেরী আরও বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। বাবা-মাকে শাস্তি দেবার জন্যে উশৃংখলতা চরমে গিয়ে পৌছায়। ড্রাগ, সেক্স আর আনন্দ নিয়ে মেতে উঠে। সামান্থা মারা যাবার আগে ববের হাত ধরে বলেছিল, আমাদের মেয়েকে তুমি মাফ করে দিও। আর যত দিন তুমি বেঁচে থাক, ওকে দেখে রেখ।

বব কথা রেখেছিল। যতটুকু সম্ভব মেরীকে সে কারণে, অকারনে সাহায্য করছিল। প্রতি মাসে কিছু টাকা, কিছু গিফট নিয়মিত ভাবেই পাঠাতো। সামান্থার কথাও মিলে গেল। মেরী আরও কিছু পরে মা হল। বব শখ করে অনেক কিছু নিয়ে নাতিকে দেখতে গেল। যেতে যেতে ভাবছিল মেরী তাকে তাড়িয়ে না দেয়।

অবাক কাণ্ড। মেরী তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল। বলল, বাবা আমাকে মাফ করে দিও। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি। আমিও তো এখন মা। ববও আনন্দে কাঁদতে থাকলো। সে মনে করতে পারলো না, এর আগে সে কখন কেঁদেছে কি না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল। ইস, যদি সামান্থা দেখে যেতে পারত।

১৫

শাম্মির সাথে প্রায় প্রতিদিনই ববের দেখা হয়। বব সাইকেল থামিয়ে এইটা সেটা কথা বলে। কিন্তু, কেও কাউকে নিজের জীবনের কথা বলে না। কথা হয় আবহাওয়া, ফুল, ফল, পাখি, ধর্ম আর এমেরিকা, বাংলাদেশে নিয়ে। শাম্মির কিছুটা দম ছেড়ে নিঃশ্বাস নেয়ার একটা উপায় হল।

শাম্মি বব থেকে জানতে চাইলো, তুমি সাইকেল চালিয়ে বেড়াও কেন? বব বলল, সাইকেল চালিয়ে গেলে আমি মানুষকে একটু বেশিক্ষণ দেখতে পাই। আমার কল্পনার জগত পাখা মেলে সহজেই। মানুষ দেখে আমি তাদের অতীত, বর্তমান বুঝে ফেলি সাথে সাথে। একটা উপকার আছে অন্যদের কথা চিন্তা করাতে, নিজের মনকে দূরে রাখা যায় নিজের থেকে। আমি এখন মানুষের মুখ দেখে বলে দিতে পারি, সে কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

পরের দিন ঈদ। শাম্মি দাওয়াত দিল ববকে দুপুরে ওদের সাথে খেতে। বলল, all Bangladeshi food. বব সানন্দে রাজী হল। রাতে খোকনকে বলল, কালকে বব আসবে। খোকন কোন উত্তর দিল না। শাম্মি বেশ কিছু দিন আগেই খোকনকে ববের কথা বলেছিল। তখন সে বলেছিল, কখন দরকার লাগলে বুড়াকে কাজে লাগান যাবে।

একটা কাল স্যুট পরে বব আসলো। কোটের পকেটের উপরে রঙচটা একটা লাল কাপড়ের ফুল। শাম্মি, খোকন, তিন্নি—সবার জন্যে গিফট নিয়ে এসেছে। অনেক দিন পরে শাম্মির মন আনন্দে ভরে উঠলো। মনে পড়ল, ঈদের দিনে বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার কথা। বব যদি বাঙালি হত, তা হলে নিশ্চয়ই সেই কাজটা করতো।

খাবার টেবিলে অনেক কথা বার্তা, রসিকতা হল। যেই খোকন বাসায় সহজে তেমন একটা কথা বলে না; সে অনেক কিছু বলা বলি করে, হাসাহাসি করলো। বব সবার সাথে হ্যান্ড শেক করে বিদায় নিল।

১৬

এক দিন খোকন একটা মোবাইল ফোন শাম্মিকে দিয়ে বলল, এইটা সাথে সাথে রেখো। মেয়েকে নিয়ে বাইরে ঘুরা ফেরা কর, কখন বিপদ হলে ব্যবহার করো। কিন্তু বিপদ হওয়ার আর দরকার পরে না। বাবা ওই ফোনে ফোন করে মেয়ের খবর নেয়, মেয়ের সাথে কথা বলে। শাম্মির জন্যে কিছুটা ভাল হল। সে এখন বেশ সহজেই ফোন করে রিনির সাথে কথা বলতে পারে।

রিনি এক দিন বলল, এই দেশে মেয়েদের পক্ষে অনেক ধরনের আইন আছে। স্বামী অত্যাচারী, এই খবর জানাজানি হলে পুলিশ স্বামীকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি বাসায় আসা বন্ধ করে দিতে পারে। ডিভোর্স হলে স্বামীর সব সম্পদ অর্ধেক ভাগ হয়ে যায়। আরও বলল, যদি মনে হয় তুমি আর নিতে পারছ না, তা হলে আমার কাছে চলে এসো। আমিই যা করার, করবো। তোমাকে শুধু শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে।

এর মাস ছয়েক পরে খোকন আবার শাম্মির উপরে চড়াও হল। এবার অপরাধ ডালে লবন কম হয়েছিল। হয়তো সমস্যা ছিল অন্য কোথাও। একেবারে মদ খেয়ে নেশায় চুর হয়ে ছিল। অনেক ব্যাপারে গালাগালি করলো। শেষে বলল, কি মনে করিস। আমি বুঝি না। বুড়ার সাথে ফষ্টি নষ্টি। আর স্বামীর দিকে মুখ তুলে তাকাস না। কথাটা শাম্মি মেনে নিত পারলো না। বলল, খবরদার ববকে নিয়ে কোন কথা বলবে না। ওকে আমি বাবার মত ভাবি। উত্তরে খোকন বলল, মাগী বলে কি। প্রেমিককে বলে বাপ। আসলে বাপ না বব ডার্লিং। কথাটা শেষ করে, হাতের পাশে একটা ফুলদানী ছিল তা ছুড়ে মারল। যেয়ে লাগলো শাম্মির কপালে। রক্তে মুখ ঢেকে গেল। চিৎকার করে বলল, কালকেই আমার বাসা থেকে চলে যাবি। তোর মত মাতারির আমার দরকার নাই।

সকালের ঘর থেকে বের হবার আগে, খোকন শাম্মিকে আবার শাসিয়ে গেল, ফিরে এসে আর তোকে দেখতে চাই না। রিনি ঘটনা শুনে ছুটে আসলো। বলল, তোমার এখানে থাকার দরকার নাই। শাম্মি স্যুটকেস গুছিয়ে তিন্নিকে নিয়ে গাড়িতে যেয়ে উঠলো। তিন্নি গাড়ির থেকে বাবাকে ফোন করে বলল, বাবা আমরা চলে যাচ্ছি......রিনি খালামনির সাথে।

খোকন মেয়েকে বলল, শাম্মিকে ফোনটা দিতে। তার পরে সাময়িকে ফোনে চিৎকার করে বলতে লাগলো, মাগী বাড়ি ফিরে যা। না হলে তোকে গুলি করে মারব, তোর মেয়েকেও মারব। আমারে তুই চিনিস না। ফোনটা রেখে শাম্মি কাঁদতে কাঁদতে বলল, রিনি আপু গাড়ি ঘুরাও। আমি কোথাও যাব না। শাম্মির মনে হল, ওই লোক যদি সত্যি ওদের মেরে ফেলে কিংবা তিন্নিকে গুলি করে মারে। মাকে যে টাকা প্রতি মাসে পাঠায় তা বন্ধ হয়ে গেল মায়ের চলবে কি-করে? মায়ের তো আর কোন রোজগার নাই।

শাম্মির জন্যে সব নিষিদ্ধ হয়ে গেল। বাড়ির ফোন আর মোবাইল ফোন দুটোরই লাইন কেটে দিল। বাড়ির থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তার পরেও জানালা দিয়ে দেখতো; বিকেল হলে, বব সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। হয়ত বোঝার চেষ্টা করছে শাম্মি আর গাছে পানি দে না কেন।

১৭

এক দিন দুপুর বারোটার দিকে দরজায় কলিং বেলের শব্দ। শাম্মি খুব অবাক হল, এই সময়ে তো কারো আসার কথা না। দরজা খুলতেই দেখল, দু জন পুলিশ দাঁড়িয়ে। ববের একটা ছবি দেখিয়ে বলল, তুমি একে চেন? শাম্মি বলল, হ্যা, ওই যে ওই বাড়িতে থাকে। পুলিশরা জানতে চাইল, শেষ কবে দেখেছ? শাম্মি অনেক চিন্তা করে বলল, হয়তো সপ্তাহ তিনেক আগে।

কিছুক্ষণ পরে দেখল, ববের বাড়ির সামনে এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সহ আরও অনেক মানুষের ভিড়। বুকটা কেঁপে উঠলো। ববের কিছু হয় নি তো! কাপড়টা পালটে ছুটে গেল ববের বাড়ির দিকে। হলুদ টেপ দিয়ে পুরো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে দিয়েছে। যেই পুলিশটা কিছুক্ষণ আগে শাম্মির সাথে কথা বলেছে তাকে পেল। তার থেকে জানতে চাইলো, কি হয়েছে।

পুলিশ বলল, ববের মেয়ে থাকে অন্য আরেক শহরে। গত তিন সপ্তাহ ধরে বাবার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে পুলিশকে ফোন করে। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ডুকে দেখে, কমপক্ষে দু সপ্তাহ আগে সে মারা গেছে। তার শরীর এর মধ্যে বিকৃত হয়ে জীবাণু আর গন্ধ ছড়াচ্ছে। শাম্মির আর শুনতে ইচ্ছা করলো না।

শাম্মির রাস্তার অন্য পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, এইটা কি করে সম্ভব। একটা মানুষ মরে গেল, আর কেও জানল না। শরীর মরে পচে গেল, তার পরে পুলিশ তাকে দরজা ভেঙ্গে বের করলো।

পরের দিন আবার দরজায় বেল। শাম্মি যেয়ে দেখল, চল্লিস-পয়তাল্লিস বছরের এক মহিলা দাড়িয়ে। সে বলল, আমি মেরী। ববের মেয়ে। বাবার কাছে তোমার কথা শুনেছি। বাবাকে একদিন লাঞ্চ করানোর জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তার পরে কথায় কথায় বলল, বাবার মৃত শরীরের হাতের মুঠোয় সেই কাপড়ের লাল ফুলটা ছিল। তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিলে, বাবা যে দিন তোমার বাসায় এসেছিল, সেদিন তার কোটের পকেটের উপরে ওই ফুলটা ছিল। ওটা আসলে আমার মায়ের হাতে বানানো। তার পরে সে ফুলের পুরো গল্পটা বলল।

১৮

প্রায় দিন বিকালে শাম্মি জানালার পাশে যেয়ে বসে। কল্পনায় বব হয়। নিজের কষ্ট বিস্মৃত হয় কিছু সময়ের জন্য। ভাবতে থাকে সে ঠিক ববের মত সাইকেল চালিয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। অনেক মানুষ, বাড়ি, ঘটনা দেখতে থাকে। অনেক কিছু মানুষের চেহারা দেখেই বুঝে ফেলে। দেখে ওই যে ওই লোকটা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তার আজকে মায়ের মৃত্যু দিবস, আর ওই যে ওই মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসছে, নতুন প্রেমে পড়েছে............। খুব ভাল, খুব মজা তো !

মিনি, বব, মা, বাবা, মুন্না সবাই কেমন একাকার হয়ে যায় এই সব কল্পনার অপরিচিত মানুষগুলোর মাঝে।

অক্টোবর ২৩, ২০১১

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com