এসো বসো ভোজনে-
বাঙালি জাতিকে এক ব্যাপারে গোল্ড মেডেল দিতেই হয়। যে কোনো বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে খাওয়ার প্রসঙ্গটা চলেই আসে। হউক সেটা জন্মদিন, বিবাহ কিংবা মৃত্যু বার্ষিকী। মুখরোচক ও শাহী ভুঁড়ি ভোজন ছাড়া বাঙালিদের সন্তুষ্টি পাওয়া বলতে গেলে দুরূহ। বাঙালিই একমাত্র জাতি যে বিয়ে খেতে যায়, ঘুষ খেয়ে মাথায় টুপি দিয়ে সৎ মানুষ সাজে। শুধু তাই না বাঙালির খাওয়ার ফিরিস্তি আরও অনেক বড়। তারা সিগারেট ও মদ—দুই-ই খায়। আবার পরীক্ষায় পাশ কিংবা চাকরি পাওয়ার সুখবর মিষ্টি হাতে না দিলে সামাজিক রেওয়াজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে হৈ হৈ রব তুলে। বাড়িতে অতিথি এলে চা-নাস্তা পরিবেষণ সামাজিকভাবে বাধ্যতামূলক। অন্যথা হলে বাড়ির মান নিয়ে টান পড়ে যায়। অন্যদিকে কিছু অসহায় বাঙালি কিন্তু স্টক-মার্কেট, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পাবলিকের কাছ থেকে মা(ই)র’ পর্যন্ত খায়।
বাঙালি সব চেয়ে বেশী কি খায়? উত্তরটা সম্ভবত সবারই জানা। “ভেতো বাঙালি” নিঃসন্দেহে সব চেয়ে বেশী ভাত ভক্ষণ করে। তবে প্রশ্ন হলো তারা ভাত খাওয়া শিখলো কি করে? ধারণা করা হয় অস্ট্রেলিয়ায় থেকে ধান চাষ ভারত মহাসাগর পারি দিয়ে বঙ্গে এসে পৌঁছায়। পলি মাটির দেশ বাংলাদেশে ভাত বেশ দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায়। একে সহজে ফলানো যায়। দুই, পানি দিয়ে সিদ্ধ করলেই খাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। ইতিহাসে পাওয়া যায় বিত্তবানরা ফেনা ভাতের সাথে গাওয়া ঘি দিয়ে আহার করতেন। অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষের ‘পান্তা ভাতে বাইগন পোড়া’ তে জিহ্বায় পানি চলে আসতো। কিন্তু ভাত সহজ-লভ্য হলেও প্রাচীনকালে দরিদ্র বাঙালির মুখে শোনা গিয়েছিল হাহাকার, ‘হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী’ (চর্যাপদ)। কথাটার অর্থ হলো, ‘ঘরে ভাত নেই তবু অতিথির আসা যাওয়ার কমতি নেই’। শুধু ভাত না বাঙালি চাল নিয়ে আরও সৌখিন সব খাদ্য উদ্ভাবন করেছিল। ‘ডাল-ভাত’, ‘দুধ-ভাত’ ধীরে ধীরে বাঙালির পছন্দের খাদ্য তালিকায় স্থান করে নেয়। দুধ ও সরু চাল মেশানো পায়েস এখনও বাঙালির জনপ্রিয় মিষ্টান্ন।
এই জাতিটা ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ নামেও পরিচিত। ভাতের সাথে মাছ না থাকলে খাওয়াটা বুঝি ঠিক পরিপূর্ণ হয় না। কথায় বলে ‘মাছের নামে গাছও হা করে’। মঙ্গল-কাব্যগুলোতে মাছ ও মাছ-রান্নার প্রচুর বর্ণনা পাওয়া যায়। যারা ভাত ও ডাল আলাদা করে রাঁধতেন, তাদেরই কেউ হয়তো আবিষ্কার করেছিলেন এই দুটো এক করে খিচুড়ি রান্নার করার প্রক্রিয়া। সু-স্বাদু, পুষ্টিকর, বল-বর্ধক খিচুড়ি সহজেই গ্রহণযোগ্যতা পায়। এর সাথে যোগ হয়েছিল ইলিশ মাছ। ইদানীং কালে ইলিশ মাছ উচ্চমূল্যের হয়ে গেলেও, খিচুড়ি-ইলিশ বাঙালিদের শখের খাবারের লিস্টে এখনও একেবারের উপরের দিকের। ইলিশ দুর্লভ হয়ে উঠলে বাঙালি বধূরা বেগুন ভাজা, ডিম অমলেট, আচার সহ নানা পদ যোগ করে খিচুড়িকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ধরে রাখতে পেরেছেন। ভোজন রসিক বাঙালি বন্ধুরা জেনে খুশি হবেন যে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের অর্থ সম্পদের কোনো কমতি না থাকলেও তার প্রিয় আমিষ ছিল মাছ। তার সবচেয়ে বেশী পছন্দ ছিল (গুজরাটি) খিচুড়ি। এমনকি আকবর বাদশাহরও পোলাও ছেড়ে খিচুড়ির স্বাদ গ্রহণে অরুচি ছিল না।
পৃথিবীর যেখানেই বাঙালির বসতি রয়েছে, সেখানে খিচুড়ি অবশ্যই মিলবে। এক মুঠো চাল, এক মুঠো ডাল মিশিয়ে নিয়ে হাঁড়িতে চড়ালেই তো হয়ে যায় খিচুড়ি। তীর্থ যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে কম শ্রমের খাবার। বর্ষাকাল এলেই বাঙালি মাত্রই একটি নির্ভেজাল খিচুড়ি-প্রেমিক হয়ে ওঠেন—সেই খিচুড়ির সাথে আমিষ বা নিরামিষ যাই থাকুক না কেনো। ‘মনসামঙ্গল’-এ আছে স্বয়ং শিব পার্বতীর কাছে ডাবের জল দিয়ে রান্না করা মুগের ডালের খিচুড়ি খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৈলাসে তো নারকেল গাছ নেই যে ডাব পাওয়া যাবে। তবে ‘মনসামঙ্গল’-এর লেখক বিজয় গুপ্ত জন্মেছিলেন বরিশালে, যেখানে সারা বছরই অঢেল নারকেল এবং ডাব দুই-ই সুলভ ও সহজলভ্য। ফলে বিজয় গুপ্তের পক্ষে ডাবের জল দিয়ে খিচুড়ি রান্নার প্রসঙ্গ আনা সম্ভব হয়েছিল।
ধারণা করা হয় পর্তুগিজরা ভারতে আলুর প্রচলন করেছিল। তারা মরিচ ও তামাকও সাথে করে নিয়ে এসেছিল। বাঙালিরা এগুলোকে আপন করে নিতে একবারেই দেরী করেনি। এই ইউরোপিয়ান বণিকরা ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি’র সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পর্তুগিজ ভাষায় এগুলোর নাম কোবি। যার থেকে হয়তো কপি শব্দটা চলে এসেছে। বাঙালি সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় নানাভাবে খাদ্য আহার প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। খাবারের অভ্যাস দিয়ে কবিগুরু দেখিয়েছেন উপন্যাসের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। বুদ্ধদেব বসু বাংলা খাবার নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে ধনী মানুষ মধুসূদন রুপার থালায় খেলেও তার দৈনন্দিন খাদ্য হলো কলাইয়ের ডাল, কাটা চচ্চড়ি, তেঁতুলের অম্বল এবং মস্ত-বড় বাটি ভর্তি চিনি মেশানো দুধ। এইভাবে তিনি বুঝিয়ে দিলেন বেচারা কুমুদিনী তার বায়বীয় ধরন-ধারণ নিয়ে কি রকম শক্ত লোকের পাল্লায় পড়েছে।” আমাদের রসিক সাহিত্যিক মুজতবা আলী বাঙালিদের খাদ্য সম্পর্কিত আসল দুর্বলতা চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন। তিনি বহু দেশ ঘুরেছিলেন। আফগানি, আরবি, ইটালিয়ান থেকে আরম্ভ করে প্রচুর বিদেশীদের রেসিপির রান্না খেয়েছেন। কিন্তু তার প্রাণ সব সময়ে কেঁদেছে—চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য।
মজার ব্যাপার হলো, মোগলরা আমাদের খিচুড়ির প্রেমে পড়লেও, তারা কিন্তু পারস্য-ইরান, তুরান, তুরস্ক থেকে সাথে করে আমাদের বর্তমান কালের নামী-দামী খাবারগুলো এনেছিল। বলা যায় এগুলো এখন আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে পড়েছে। বিয়ে, বউ-ভাত জাতীয় বড় অনুষ্ঠানে এসবের আয়োজন না থাকলে বুঝি মান থাকে না। পোলাও, বিরানি, কোর্মা-কোপ্তা, বোরহানি নাম শুনলে অনেক বাঙালির জিহ্বায় পানি এমনিতেই চলে আসে। যদিওবা কিছু কিছু বাঙালি ইদানীং স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছেন; তারা অতিরিক্ত ক্যালোরিতে ভরপুর এসব খাদ্য থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশে শাহী খাবারের চল কমার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। পুরান ঢাকার হাজীর বিরানি, ফখরুদ্দিন বাবুর্চির রান্না বলা যায় আমাদের কিংবদন্তিতে স্থান করে নিয়েছে। শোনা যায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজকীয় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বাবর্চিদের বিবেচনা করা হয়।
তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য বললে ভুল হবে পুরো বিশ্বেই এখন বাঙালি রান্না-বান্নার মসলার সৌরভ পাওয়া যায়। লন্ডনে শখ করে মানুষজন পোলাও-বিরানি খেতে রেস্টুরেন্টে যেয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছে। বাঙালি ভাষা-ভাষীরা এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে। দেশ ছেড়ে গেলেও জিহ্বায় তাদের ঠিকই দেশী খাবারের স্বাদ লেগে আছে। এরা দেশের রেসিপিতে ভিন দেশে বাংলাদেশী রান্না করছেন। তাদের জন্যে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে সব ধরণের মসলাই যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, এমেরিকার বড় শহরগুলোতে ব্যবসায়ীরা বাঙালি/ভারতীয় রেস্টুরেন্ট দিয়ে কাস্টমারদের দেশীয় খাবারের চাহিদা মিটিয়ে চলেছেন। তাদের রান্নার বেশ কিছু উপাদান দেশ থেকে এলেও বাকী সবকিছু স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা। ফলে একই রেসিপি দিয়ে ঠিক একইভাবে রান্না হলেও, বিদেশে এই খাবারগুলোতে একটা জিনিষের অভাব থেকেই যায়। সেইটা কি বলার আগে, ছোট একটা গল্প না হয় চট করে বলি।
ঢাকা শহরের এক পাড়ায় বিয়ের বাড়ির রান্না-বান্না হচ্ছিল। সেই পাড়াতেই ছিল বেওয়ারিশ তিন কুকুর। তারা একসাথে চলতো, খেতো, ঘুরতো। বলা যেতে পারে তারা একে অপরের দোস্ত। মানুষের রান্না-বান্না দেখে তাদেরও খুব ভালো-মন্দ খেতে ইচ্ছা হলো। তারা বিভিন্ন ফন্দি ফিকির আটতে লাগলো, যে কিভাবে শাহী খাবারের ভাগ বসানো যায়। মেলা শলা-পরামর্শ করার পর ঠিক করলো, তারা--তিন কুকুর একসাথে সেখানে যাবে না। মানুষেরা বিরক্ত হতে পারে। সিদ্ধান্ত হলো এক এক করে তারা যাবে। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। প্রথম কুকুর বড় বড় হাড়িগুলোর পাশে জিহ্বা বের করে যেয়ে দাঁড়ালো। আশা করেছিল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ একটা কুকুরকে হাড়ির পাশে দেখলে নিশ্চয়ই কিছু খাবার বের করে দিবে। না বিষয়টা সে রকম হলো না। বাবুর্চি হাড়ির পাশে কুকুর দেখে মহা বিরক্ত হয়ে গরম পানি ছুঁড়ে মারলো।
অন্যদিকে বাকী দুই কুকুরের আর তর সয় না। প্রথম জন ফিরলেই, দ্বিতীয়জন যাবে। কিন্তু মনে সংশয় ছিল। মানুষেরা তাদের ঠিক মর্যাদা দিবে তো! প্রথম কুকুরের আসতে দেরী দেখে ভাবলো নিশ্চয়ই ভালো আপ্যায়ন চলছে। বেচারি গরম পানির ছ্যাকা খেয়ে যখন ফিরলো, তখন অন্য দুজন জানতে চাইলো, খাওয়া-দাওয়া কেমন হয়েছে। বেচারা শুধু বলল, “যেতেই গরম, গরম।” কথাটা শোনা মাত্রই দ্বিতীয় কুকুর ছুটলো ভুঁড়ি ভোজের আশায়। দ্বিতীয় কুকুরকে দেখে বিয়ের বাড়ির আয়োজকরা আবার নতুন করে বিরক্ত হয়ে লাঠি দিয়ে জন্তুটার পায়ে বারি মারলো। আঘাত সহ্য করতে না পেরে সে বসে পড়লো। পরের মিনিটেই বুঝলো ওখানে থাকাটা একেবারে নিরাপদ না। সে ফিরে যাওয়া মাত্রই অন্য দুই বন্ধুকে জানাল, যে তাকে যাওয়া মাত্রই বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এইবার তৃতীয় কুকুর ছুটলো। মানুষদের এইবার বিরক্তির চূড়ান্তটা হলো। বারে বারে কুকুর এসে বিরক্ত করছে। এ রকম উটকো ঝামেলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তারা কুকুরটাকে বেঁধে রাখলো। ভোর রাতে যখন ছাড়া পেয়ে বেচারা কুকুর ফিরে যেয়ে বন্ধুদের সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করলো, “আমাকে তো আসতেই দেয় না।”
আবার ফিরে আসি প্রসঙ্গে। কথা হচ্ছিল বাঙালিদের খাবার-দাবার নিয়ে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নিম্নবিত্তদের খাবারের তালিকায় খুব একটা বেশী পরিবর্তন আসেনি। তবে ইদানীং শোনা যাচ্ছে, দিনে দিনে আটা ও ময়দার তৈরি রুটি, পরাটার কদর বেড়ে চলেছে। যারা বাড়তি খরচ করার সক্ষমতা রাখেন, তারা এখন দেশে বসেই পৃথিবীর নানা প্রান্তের সু-স্বাদু খাবারের রসনা তৃপ্ত করতে পারেন। চীনা খাদ্য, বার্গার, চিকেন ফ্রাই, থাই, ইটালিয়ান পাস্তা, পিজ্জা থেকে আরম্ভ করে আরব, আফ্রিকার সু-স্বাদু রান্না এখন দেশেই করা হচ্ছে। তার পরেও পকেট যতই ভারি হউক না কেনো, বাঙালির এখনও সেরা প্রশান্তি ভাত, ডাল আর মাছে। কিন্তু জাক-জমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হলেই তার দরকার হয়ে পড়ে মোগলদের সাথে চলে আসা সব নামী-দামী ‘শাহী’ খাদ্যের।
আমি ক্ষুদে এক বাঙালি। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আমি নিজেও অন্য বাঙালিদের ব্যতিক্রম না। কিছুক্ষণ আগে যে তিন কুকুরের গল্প করছিলাম, তাদের শেষের কুকুরটার মতো আমি বাংলা খাবারের স্বাদের মধ্যে বাঁধা পড়ে আছি। বিয়ের বাড়ির বিরানি, মুরগির রোস্ট আর বোরহানি আমার প্রিয় খাদ্য তালিকায় একেবারে উপরের দিককার। যদিও এখন বয়স বাড়ার কারণে ওগুলোর থেকে দূরে থাকতে কিছুটা চেষ্টা অবশ্য করি। গতবার যখন দশ দিনের সফরে দেশে গেলাম, ধারণা ছিল কোনো না কোনো বড় অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে যাবো। দেশে তো এখন সারা বছরই অনুষ্ঠান ও শাহী খাওয়ার ছড়াছড়ি। সাথে ক্ষীণ আশা ছিল একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেলে একেবারেই সোনায়-সোহাগা। না ভাগ্যটা তেমন সু-প্রসন্ন হলো না। বড় বড় ডেকচিতে রান্না হয় এমন কোনো দাওয়াত পেলাম না। কিন্তু দেশে আসবো আর মনের খোরাক অপূর্ণ থেকে যাবে, সেইটাই বা কেমন কথা?
আগেই বলেছি, বিদেশে বিরানি, মুরগীর রোস্ট, আর বোরহানি একটু সচেষ্ট হলেই পাওয়া যায়। কিন্তু কথায় বলে না, “তেল হলো, নুন হলো, মসলা হলো; কিন্তু স্বাদ হলো না।” এই কারণেই প্রবাসীরা দেশে এসে বাংলাদেশী রান্না খেতে চান। আমার বিষয়টা তাই। দেশে থাকতে মোগলদের আনা খাবারগুলোর যে স্বাদ পেয়েছিলাম তা কোনো ভাবেই আমার জিহ্বা ও মস্তিষ্ক ভুলতে পারে না। সেজন্য খবর নিতে আরম্ভ করলাম, বিয়ে বাড়ির স্বাদের খাবার কিভাবে পাওয়া যায়। খবর পেলাম বিয়ে বাড়িতে রান্না করেন এমন বাবুর্চিদের কিছু রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে তারা একইভাবে তৈরি বিয়ের বাড়ির বিখ্যাত খাদ্যগুলো রান্না করেন। প্রথমে উৎসাহিত হলেও পরে একটু দমে গেলাম। কারণ একেবারে পরিষ্কার, খাঁটি উপাদান ব্যবহার না করলে আমার জন্যে তো বিপদ!
একেবারে বিশুদ্ধ রান্না না হলে দীর্ঘ দিনের প্রবাসী উদরের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে যাবার আশংকা থাকে। ফলশ্রুতিতে সফরের আনন্দ একবারেই মাটি হয়ে যাবে। আবার হলফ করে কেউ বলতে পারবে না যে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে যেখানে রান্না হয়, সেখানে সব নিয়ম কানুন মেনে চলা হয়। এইদিকে আমার প্রিয় খাবার না খেয়ে ফিরে যেতেও মন চাইছিল না। কিন্তু দেশে অবস্থানের সময়টুকু অসুস্থ হওয়া চলবে না। হাতে যে সব কাজ নিয়ে এসেছি, সেগুলো শেষ করে যেতে না পারলে একটা ঝামেলার সম্ভাবনা থাকে। বিষয়টা নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। তাতে একটু ঝুঁকি হয়ে যায়; কিন্তু তারপরেও সই। কি যেনো ইংরেজি কথাটা, no risk no again---ঝুঁকি না নিলে কোনো কিছু অর্জন করা যায় না। আমার ঢাকার থেকে ফিরতি ফ্লাইট ছিল রাতের নয়টায়। দুপুরের এগারোটার দিকে বিয়ে বাড়ির খাবার রান্না করে এমন একটা বাবুর্চির রেস্টুরেন্ট যেয়ে হাজির হলাম। মনের আনন্দে সবগুলো শাহী খাবার অর্ডার দিলাম। প্লেনে উঠার আগেই একেবারে সাধ মিটিয়ে এইগুলো খাবো। সমস্যা যদি বেঁধেই যায় তা হলে যাত্রা পথেই কিংবা বিদেশে নিজের বাড়িতে ফিরে যাবার পরেই হউক; যা আছে কপালে।
পারস্যের জগৎবিখ্যাত কবি শেখ সাদী’র দামী সাজ-সজ্জা ছিল না বলে একবার তাকে গণ্যমান্যদের ভোজ উৎসবে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে পোশাক পাল্টে তিনি যখন ভিতরে ঢুকতে পারলেন, তখন দেখা গেল তিনি তার খাবারগুলো সব তার কাপড়ের উপরে ঢেলে দিচ্ছেন। তার যুক্তি দামী পোশাকের জন্যে তাকে যেহেতু ঢুকতে দেয়া হয়েছে, সে কারণে খাবারের আসল দাবীদার হলো তার পরিধেয় পোশাক। শেষে যে সব বাঙালি ব্যাপকহারে ঘুষ, মদ, সিগারেট, চিনি ও অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্যগুলো খেয়ে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছেন, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলি। আপনারা কিন্তু আপনাদের বদ নেশায় আসক্ত হওয়ার অজুহাত হাজার বছরের পুরনো বাঙালি সংস্কৃতির উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। বরং লোভ, মোহ, বিত্ত, হতাশার কারণে আপনাদের স্বভাব পরিবর্তিত হয়েছে। তার থেকেই আপনারা ক্ষতিকর কাজগুলো করছেন। তবে এ ধরণের ক্ষতিকর স্বভাব তো আপনি চাইলেই শুধরে নিতেই পারেন। কারণ স্বভাব হচ্ছে মানুষের দাস। যৌক্তিক ও বুদ্ধিমান মানুষ তো তার কোনোভাবেই বদ-অভ্যাসের দাস হয়ে থাকতে পারে না। তার পরেও যদি আপনারা ভাবেন আপনাদের জন্যে সেটা করা খুবই কষ্টকর, তা হলে আপনাদেরকে শেখ সাদীর একটা কথা মনে করিয়ে দেই, “ধৈর্য ধরো। কোন কিছু সহজ হওয়ার আগেই সব কিছুই কঠিন।”(Have patience. All things are difficult before they become easy)
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৯
কাজী হাসান
লেখক: quazih@yahoo.com