ম্যাডাম মন্ত্রীর গাড়ি নষ্ট
ম্যাডাম মন্ত্রীর গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না।
সন্ধ্যায় গাড়িটা নিয়ে এমেরিকান এমব্যাসি যেতে হবে। বিশেষ একটা সম্বর্ধনা আছে।
গাড়িটা আবার যেমন তেমন গাড়ি না। ল্যাম্বরগিনি। মডেলের নাম সেসটো এলেমেনতো (Sesto Elemento) এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী গাড়ি। দাম ২.৯ মিলিওন ডলার। সব মিলিয়ে দাম পড়েছে ৩ মিলিওন ডলার। টাকায় হিসাব করতে হলে ৭০ দিয়ে গুন করতে হবে। সে হিসাব করার চেষ্টা এখন না করাটাই ভাল। অনেক বড় একটা সংখ্যা হয়ে যাবে, কথাবার্তা আরও বেড়ে যাবে। যাই হোক, গাড়িটা গত কালই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিশেষ ট্রাকে করে ঢাকায় আনা হয়েছে। কিন্তু, একটা ব্যাপারটা খুবই কনফিডেনসিয়াল রাখা হয়েছে। গাড়িটা স্টার্ট নিচ্ছে না। জানাজানি হলে তুলকালাম কাণ্ড আরম্ভ হয়ে যাবে।
ভাগ্যটা বেশ ভাল কারণ গাড়িটা রাখা হয়েছিল বাড়ির সামনে। ট্রাক থেকে নামিয়ে ওখানে রাখা হয়েছে। সকাল দশটায় একদল সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফার আসলো। ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ড গাড়িটাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। বললেন গাড়ির সম্পর্কে অজানা সব তথ্য। এতদিন পর্যন্ত জার্মান গাড়ি বুগাটটি ভেভরন (Bugatti Veyron) ছিল পৃথিবীর সব চেয়ে দামী গাড়ি। কিন্তু, তা এখন আর নাই। গাড়িটার চেসিস সম্পূর্ণভাবে কার্বন দিয়ে তৈরি। Sesto Elemento শব্দটা ইংরেজিতে অনুবাদ করলে হবে ’sixth element’। কার্বনের এটমিক সংখ্যা হল ছয়।
সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে, বাংলাদেশই প্রথম দেশ যেখানে এই গাড়িটির শুভ আগমন ঘটলো। শূন্য থেকে ঘণ্টায় ১০০ কিলো মাইল উঠতে সময় লাগে বিস্ময়কর ভাবে মাত্র ২.৫ সেকেন্ড। সব মিলিয়ে মাত্র ২০টা গাড়ি তৈরি হবে।
এক বেরসিক সাংবাদিক জানতে চাইলো , এই গাড়ি ঢাকার কোন রাস্তায় চলবে। ঢাকায় তো ট্রাফিক জ্যামের জন্যে গাড়ি নড়ে না। সেখানে এতো অত্যাধুনিক গাড়ির কি দরকার ছিল। ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ড কটমট করে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন কর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি জানেন এই গাড়ি কেনার জন্যে বাংলাদেশের সম্মান কতো বেড়েছে। আজ পৃথিবী জুড়ে বাংলাদেশকে নিয়ে খবর হচ্ছে। তা ছাড়া অনেক দেশ টাকা থাকার পরেও এই গাড়ি কিনতে পারবে না। কারণটা তো আগেই বললাম, সর্বমোট মাত্র ২০ টা গাড়ি তৈরি হবে। অনেক কষ্ট করে, অনেক তদবির করে, ম্যাডাম মন্ত্রী এই গাড়ি বাংলাদেশের জন্যে কিনেছেন। যদিওবা, সম্পূর্ণ টাকা ম্যাডাম মন্ত্রী নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য একটাই, বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করা।
সাংবাদিক সম্মেলনের পরে আরম্ভ হল ফটো সেশন। দেশের সব পত্রিকার আর টিভি ষ্টেশনের ক্যামেরা ক্রুদের গাড়ির ভিতর, বাহির থেকে আরম্ভ করে প্রতিটা এঙ্গেল থেকে ছবি নেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। বুঝা গেলো, ফলাও করে প্রচার করা হবে। ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ড এই দিক ওই দিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন সিএনএন, বিবিসির কাওকে দেখা যায় কি- না। বিদেশীরা নিউজ করলেই আসল সম্মান বাড়ে।
গাড়িটা চালানর জন্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সিঙ্গাপুরের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রীর এক ড্রাইভারকে। নাম তার মিস্টার কিয়েন লীন। শুধু গাড়ি চালানোতেই পারদর্শী না, কুংফুতেও ব্ল্যাক বেল্ট। বেশ কয়েকবার নাটকীয় ভাবে সিঙ্গাপুরের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রীর প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। তাকে নিয়ে একটা সিনেমা বানানোর কাজ খুব শীঘ্রই আরম্ভ হবে বলে শোনা যাচ্ছে। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে, তার পরে তাকে রাজী করিয়ে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ড আর মিস্টার লীন গাড়ির ডেলিভারি নিতে ইটালি গিয়েছিলেন। অবশ্য তার আগে, মিস্টার লীন ল্যাম্বরগিনি গাড়ি চালানো আর তার রক্ষণাবেক্ষণের উপর দু সপ্তাহের বিশেষ ট্রেনিং নিয়েছেন। তখন তাকে রাখা হয়েছিল এক ফাইভ স্টার হোটেলে। বাংলাদেশেও তার থাকার জন্যে গুলশানে একটা ফ্ল্যাট নেয়া হয়েছে। সিঙ্গাপুরে একটা ব্রেক নিয়ে তার পরে তিনি ঢাকায় আসছেন।
মিস্টার লীনের সকাল সাড়ে আটটায় এসে পৌঁছানোর কথা। বিমানের ফ্লাইট লেট। আসতে আসতে বিকাল পাঁচটা। কয়েক বার তাকে ফোন করার চেষ্টা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে মুভ হওয়ার কারণে হয়তো সিঙ্গাপুরের লাইন কেটে দিয়েছেন। তার থেকে জেনে নেয়ার দরকার গাড়িটা স্টার্ট কেন নিচ্ছে না। ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ড এ পর্যন্ত প্রায় বিশ বার চেষ্টা করেছেন। কোন ভাবেই গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। শুধু শুধু ক্লিক ক্লিক শব্দ করে।
গাড়িটাকে স্টার্ট নিতেই হবে। এমেরিকান এমব্যাসির অনুষ্ঠানের কথা পত্র পত্রিকায় এসেছে। জনগণ ছাড়াও প্রচুর হাই অফিসিয়াল গাড়িটা দেখা আর তার সাথে ছবি তূলার কথা অগ্রিম জানিয়ে রেখেছেন। যে ভাবেই হোক গাড়িটা স্টার্ট হওয়ার দরকার। এতো টাকার গাড়ি। তার পরে ব্যাপারটা জানাজানি হলে, মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। হয়তো নিন্দুকেরা ফোড়ন কেটে বলবে, আসলে সব ভুয়া। নকল গাড়ি নিয়ে এসেছে। ওইটা আসলে চলেই না। বুঝলেন না, পাবলিককে ধোঁকা দেয়া আর কি। রাজনৈতিক নেতারা সুযোগ পেলেই যা করে।
ম্যাডাম মন্ত্রী যখন গাড়ি কেনার প্ল্যান চূড়ান্ত করলেন, খবরটা সাথে সাথে কে যেন পত্রিকায় দিয়ে দিল। প্রচুর লেখালেখি আর টক শো তে কথা বার্তা আরম্ভ হয়ে গেল। সংসদে বিরোধী দল পারলে তো প্রতিবাদে চাপড়িয়ে টেবিল ভেঙ্গে ফেলে আরকি। এক এমপি তো হরতাল ডাকার হুমকি পর্যন্ত দিলেন। পাবলিক খেতে পায় না। আর ম্যাডাম মন্ত্রী পৃথিবীর সব চেয়ে দামী গাড়ি কিনবে।
প্রধান মন্ত্রী ডেকে পাঠালেন ম্যাডাম মন্ত্রীকে। তিনি তাকে খুব স্নেহ করেন। বাবার বন্ধুর মেয়ে। বললেন, হচ্ছে টা কি? ম্যাডাম মন্ত্রী বললেন, তার হাসবেন্ড আসলে বিয়ের আগের থেকে এই আবদারটা করে রেখেছে। টাকাটা একেবারে সাদা। মতিঝিলের তাদের যে ২২ তলা অফিস বিল্ডিং ছিল, সেটা বিক্রির থেকে এসেছে। প্রয়োজনে পত্রিকা ওয়ালাদের কাছে প্রমাণ পাঠান হবে। এখানে কোন দুর্নীতি নাই। প্রধান মন্ত্রী মেনে নিলেন স্নেহের ম্যাডাম মন্ত্রী কথা। তার পরে খুব একটা অস্বাভাবিক কাজ করলেন। কল করলেন, বিরোধী দলের নেতাকে। বুঝিয়ে বললেন, ম্যাডাম মন্ত্রী বয়স অল্প। শখ করেছে একটা গাড়ি কিনবে। এইটা নিয়ে হৈ চৈ না করলেই ভাল। সুযোগ মত বিরোধী দলকে একটা বড় ধরনের সুবিধা দিয়ে দেয়া হবে। তার পরে কল করলেন এক পত্রিকার মালিককে। তার আবার কয়েকটা টিভি ষ্টেশনও আছে। বিভিন্ন ধরনের সমিতির হর্তাকর্তাও। ফোন রেখে প্রধান মন্ত্রী, ম্যাডাম মন্ত্রীকে বললেন, তোমার হাসবেন্ডকে বলে দিও এরকম খায়েশ যাতে আর কখনো না করে।
ম্যাডাম মন্ত্রীর মুখ হা হয়ে গেল। নিজের চোখে তিনি যা দেখলেন আর কানে যা শুনলেন, তা কি ঠিক? সবাই জানে প্রধান মন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সাথে কথাই বলেন না। তা হলে হয়তো জাতীয় কোন প্রয়োজন হলে, দেশ আর জাতির স্বার্থে তারা কথা বলেন সবার অগোচরে। ম্যাডাম মন্ত্রীর গাড়ি কিনতে সমস্যা করাটাকে, প্রধান মন্ত্রী নিশ্চয়ই, জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করার মত একটা বিষয় বলে মনে করছেন।
গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না শুনে ম্যাডাম মন্ত্রীর মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। হাসবেন্ডকে বেশ বকা ঝকা করলেন। তুমি কি আসলেও ঠিক গাড়ি এনেছ। নাকি কোন ফ্রডের কাছে যেয়ে সব টাকা দিয়ে এসেছ। আমার বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। যে বাজার থেকে পয়সা দিয়ে পচা ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে আসে, তাকে কেন যে ৩ মিলিয়ন ডলার দিয়ে গাড়ি কিনতে পাঠালাম। গাড়ি কোম্পানির এমারজেনসি নাম্বারে নিজে ফোন করলেন। কি মুশকিল। ব্যাটা তো ইংলিশ বুঝে না। প্রথমেই রেকর্ডের ম্যাসেজে ইটালিয়ান আর ইংরেজিতে বলল, ইটালির জাতীয় দিবস উপলক্ষে তারা মোট চার দিন বন্ধ থাকবে। ওয়েব সাইটে যেয়ে দেখা হল। না তেমন কোন কাজের কিছু জানা গেল না। টয়োটা কোম্পানির কান্ট্রি ম্যানেজারকে জরুরি ভাবে ডেকে নিয়ে আসা হল। ভদ্রলোক মুখ বাম ডান করে বললেন, ল্যাম্বরগিনি কোম্পানির মানুষ অথবা তাদের কম্পিউটার ছাড়া ডায়াগনোসিস করা সম্ভব না। তা ছাড়া এই প্রথম তিনি ল্যাম্বরগিনি গাড়ি নিজের চোখে দেখছেন।
কান্ট্রি ম্যানেজার সাহেব খবর দিলেন গত কালই কোরিয়ান গাড়ি কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ঢাকা এসেছেন। সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করবেন বাংলাদেশে গাড়ি বানানোর একটা প্ল্যান্ট বসানো যায় কিনা। তাকে অনেক তদবির করে ধরা হল। ভদ্রলোক গল্ফ খেলছিলেন। অনেক কষ্টে তাকে ঘটনা বুঝান হল। সব শুনে বললেন, মনে হচ্ছে সফটওয়ারের প্রব্লেম। তবে তার কাছে ম্যানুয়াল পাঠিয়ে দিলে তিনি দেখতে পারেন, কিছু করা যায় কি না। কিন্তু বিধি এখানেও বাম। গাড়ির ম্যানুয়াল মিস্টার লীনের কাছে। ইটালির থেকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে রেখেছেন। ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ডকে তিনি বলেছেন, বইয়ের প্রতিটা অক্ষর তার মুখস্থ থাকা চাই।
রেডিও আনন্দ-বেদনা কি করে যেন খবর পেয়ে গেল। তারা প্রচার আরম্ভ করলো। তিন মিলিওনের ল্যাম্বরগিনি সেসটো এলেমেনতো স্টার্ট নিচ্ছে না। রেডিও আনন্দ-বেদনার মালিক ভুলে গিয়েছিলেন কর্মচারীদের বলতে, গাড়ি নিয়ে কোন রসিকতা করা যাবে না। তিনি আবার এই মুহূর্তে দেশের বাইরে। অন্য চ্যানেলগুলো অনেকটা বাধ্য হয়ে; গাড়িটা কেন স্টার্ট নিচ্ছে না, তা নিয়ে লাইভ টক শো চালু করে দিল। না হলে পাবলিক তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠাতে পারে। দেশ জুড়ে সবাই তাদের নিজেদের মতামত জানাতে লাগল।
বাড়ির বাইরে এলাহি কাণ্ড আরম্ভ হয়ে গেল। প্রচুর জনতা আর তাদের সাথে সাথে পত্র পত্রিকার লোক জন। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে পুলিশ বাহিনীকে আসতে হল। কিন্তু, এতো কিছুর পরেও আসল সমস্যার কোন সমাধান হল না। ঘরে বাইরে শুধু অশান্তি আর অশান্তি। কি করে কে ম্যাডাম মন্ত্রী আজকের এমেরিকান এমব্যাসির অনুষ্ঠানে মুখ দেখাবেন।
ম্যাডাম মন্ত্রীর ছয় বছরের ছেলে মুন্না এতো ঘটনা কেন ঘটছে সেটাই প্রথমে বুঝতে পারল না। পরের কাজের ছেলে আব্দুল তাকে বলল কি বিষয়। ব্যাপারটা নিয়ে সেও চিন্তিত হয়ে পড়লো।
এই দিকে ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ড প্রতি পনের মিনিট পর পর যেয়ে গাড়িটা স্টার্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দোয়া-দরুদ যা যা মনে আসছে, সব পড়ছেন। যদি সৃষ্টি কর্তা একটু দয়া করেন। মুন্না বাবার সাথে সাথে গাড়িতে গেল। তাকিয়ে দেখতে লাগল বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। গাড়ি আবার ক্লিক শব্দ করলো। কিন্তু স্টার্ট নিলো না। ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ড প্রচণ্ড হতাশ হয়ে বাতাসে তার দুই হাত ছুড়লেন আর মনুষ্য মলের ইংরেজি শব্দটা উচ্চারণ করলেন, ‘শী………………...ট’।
মুন্না বলল, আমি জানি গাড়ি কেন স্টার্ট নিচ্ছে না। বাবাকে আঙ্গুল দিয়ে ছোট একটা স্ক্রিন দেখাল। সেখানে দেখাচ্ছে গাড়িতে তেল নাই। ম্যাডাম মন্ত্রীর হাসবেন্ড ব্যাপারটা দেখলেন আর বুঝলেন। হাফ ছেড়ে বাঁচার অবস্থা। বেশ জোরেই ম্যাডাম মন্ত্রীকে বললেন, ব্যাটারা তিন মিলিওন ডলার নিলো, কিন্তু গাড়ির মধ্যে তেলটা পর্যন্ত ভরে দিল না।
কাজী হাসান
জুন ২৯, ২০১১