কাজের কাজ
কাজ, কাজ, কাজ। কাজের মেলা চাপ। কাজের চাপে দম ফেলার ফুরসত পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। আবার লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে—কাজ পাচ্ছে না। বিশাল একটা মুশকিল; লজ্জা, আর মানসিক চাপের ব্যাপার। বিয়ের সময়ে মানুষ প্রথমেই জানতে চায়, পাত্র কি কাজ করে। কিছু মানুষ, অন্যদিকে, মনের মত কাজ পাচ্ছে না; তাই, কতই না আহাজারি করে! কাজ নিয়ে আবার মেলা কথাও চালু আছে: কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরোলে পাজী; আকামের কাম, কাজ পাগল আরও কত কি?
পদার্থ বিজ্ঞান শাস্ত্র মতে, শক্তি প্রয়োগে বস্তু যদি স্থান পরিবর্তন করে, তবেই তাকে কাজ বলা যায়। এই সংজ্ঞা অনুসরণ করলে, যারা সারাদিন এক জায়গায় বসে কাজ করেন, তারা ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন। এই দলের মধ্যে, বাড়ির দারোয়ান থেকে আরম্ভ করে, বড় সাহেব পর্যন্ত অনেকেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারেন। তারা কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, একই টুলে কিংবা রিভলভিং চেয়ারে বসে কাটিয়ে দেন। তাদের মালিকেরা কিন্তু পদার্থ বিদ্যা প্রয়োগ করে, এই ধরণের কর্মচারীদের বেতন দিতে অস্বীকার করে হট্ট গোলের সূচনা করতে পারেন। কিন্তু সেটা বাস্তবে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা নাই। কারণ বুঝতেই পারছেন, এই ধরণের কর্মজীবীরা হলেন আসল কাজের কাজী।
কিন্তু মানুষ তো আর পদার্থ বিদ্যার নিয়ম ধরে কাজ কর্ম করে না। একেক জনের একেক ধরণের কাজ। কেও মাটি কাটে, কেও অন্যের মাথা ফাটায়, কেও পকেট মারে, আবার কিছু মানুষ নিঃস্বার্থভাবে মাদাম টেরেসার মত মানুষের সেবা করে চলেন। স্কুল, কলেজে থেকে জ্ঞান নিয়ে, মামুর রেফারেন্স আর কানেকশান খাঁটিয়ে, নানা কাঠ খড় পুড়িয়ে , তবেই না চাকরি, মানে কাজ। এ তো আর ছেলের হাতের মোয়া না। জন্মের পর থেকে, বাবা-মা, সন্তানরা বড় হয়ে কে কি কাজ করবে, কত আয় করবে; তার এক জটিল জল্পনা-কল্পনার হিসেব নিকেশ করে ফেলেন।। একেবারেই দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পান ছেলে মেয়েদের সুখের জীবন। আহ কি মজা! তারা একেবারে কাজের কাজ করবে। ভাবতেই আনন্দ চলে আসে। ।
কথা দিয়ে মানুষ কত না কাজ করে। রাজনৈতিক নেতা, উকিল, হকারদের কথা বলাটাই মুখ্য কাজ। ডাক্তারি পাশ করে, বিসিএস দিয়ে--- হয়ে গেল, কাস্টমসের অফিসার। বেচারা সময় মত বুঝে ফেলেছে, কোথায় গেলে বেশী টাকার খোঁজ পাওয়া যাবে। কাজ মানেই চাকরি, চাকরি মানে কত টাকা আয়? এখানে, কিছুটা অপ্রাসাঙ্গিক হলেও, আমাদের মন্ত্রীদের ব্যাপারে একটা প্রশ্ন না করলেই না। আপনারা কি কেও বলতে পারবেন, এত কথা বলার পরে তাদের কি কাজ করার কোন সময় বাকি থাকে? কিংবা যত কথা তারা বলেন, তার থেকে কম টাকা আয় করেন?
প্রশ্নের পিঠে আরও প্রশ্ন এমনিতেই চলে আসে। যে সব লোভী কুলাঙ্গার, মুনাফার লোভে; খাবারে ফরমালিন মেশায়, তাদের কাজকে আমরা কি বিশেষ কোন নাম দিতে পারি? তাদের কাজে অসংখ্য মানুষ, ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে, ছট ফট করে মরে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে মরবে। চলুন ওদের কাজের নাম না দিয়ে ওদেরই এক বিশেষ সম্মানীয় উপাধি দেই: বদ, কুলাঙ্গার, বদমায়েশ, হৃদয়হীন, গনহত্যাকারী! এখন আপনারাই বলুন,এই কয়টা শব্দ কি ঠিক ভাবে তাদের উচিত মর্যাদা দিতে পারবে? না-কি আরও কিছু শব্দ যোগ করার প্রয়োজন আছে?
যাই হোক কাজ নিয়ে কথা আরম্ভ করেছিলাম, সেখানেই ফিরে আসি। ধান ভানতে যেয়ে শিবের গীত বেশীক্ষণ করাটা সমীচীন হবে না। চাকরির চেয়ারে বসার আগে, বাঙালি সমাজকে ইন্টার্ভিউ ফেস করতে হয়। কত ধরণের প্রশ্নের উত্তর না মুখস্থ করতে হয় তার আগে। চাঁদের কত ওজন, আলোর গতি কত, পৃথিবীর কোন দেশে সব চেয়ে বেশী ডাব হয়, আর কারা বেশী জোচ্চোর, জাতীয় সব প্রশ্নের উত্তর ঠোটের মাথায় রেডি করে রাখতে হয়। সুন্দর করে শুদ্ধ উচ্চারণে উত্তর দিতে না পারলে, সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। চাকরি হওয়ার আগেই বরখাস্ত।। কাজ পাওয়ার আগেই বেকার।
সবার নিশ্চয়ই “মাছি মারা কেরানী” প্রবাদের সাথে পরিচয় আছে। সেই ব্রিটিশ আমলের কথা। তখনও কপি মেশিন আবিষ্কার হয় নি। বড় সাহেব, পুরনো এক নথি বের করে বললেন, যাও হুবহু কপি করে নিয়ে আস। কেরানী মহোদয় নথির লেখা হুবহু নকল করতে লাগল। সমস্যা হল দ্বিতীয় পাতার মধ্যের দিকে এসে। একটা মাছির মৃত দেহ শুকিয়ে চ্যাপ্টা মমি হয়ে লেগে রয়েছে। বেচারা কেরানী লেগে পড়ল, ঠিক সে রকম এক মৃত মাছির মমির সন্ধানে। না পাওয়া গেলে মহাবিপদ, বড় সাহেব ক্ষেপে যেতে পারেন---হুবহু কপি হয় নি বলে। যে কোন মূল্যে কাজটাকে তো রক্ষা করতে হবে।
তবে এখন দিন বদল হয়েছে। লাল মুখো সাহেবরা দেশে ফিরে গেছে সেই কবে! বাঙ্গালিদের প্রমোশন হয়েছে। তারা নিজেরাই সাহেব, বড় সাহেব, ছোট সাহেব, ভাল মানুষ, চোর, বাটপার; সব কিছু। কত ধরণের কত কাজ ই না তারা করছে। প্রতিভা দেখাচ্ছে কত না ভাবে। শুধু চা- কর হওয়া না; চোখের দৃষ্টি তাদের অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে। এভারেস্ট জয় না করে, মিথ্যা ছবি দেখিয়ে, সার্থক ভাবে ভাঁওতা দিয়েছিল সবাইকে এক বাঙ্গালি। আরেক দল বাঙালি বাঘের সাইন বোর্ড গলায় ঝুলিয়ে ইঁদুরের থেকেও নিম্ন মানের প্রতিভা দেখিয়ে চলেছে।
এবারে একটা গল্প বলি। এক বার এক বাবা ঠিক করলেন, তার ছেলে অন্য ভাবে কাজ করার প্রশিক্ষণ দিবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। ছেলেকে ডেকে বললেন, যাও তো বাবা, এই চিঠিটা পোস্ট করে এস। ছেলে বলল, ঠিক আছে, নো প্রবলেম। টাকা দাও আমি পোস্ট করে আসি। বাবা অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন, সবাই পয়সা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনে পোস্ট করে। দেখি তুমি অন্য ভাবে কাজটা করতে পার কি-না। আমি চাচ্ছি, সবাই যে ভাবে কাজ করে, তার থেকে তোমার কাজ করার ধরণটা যাতে অন্য রকম হয়। সবাইকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিবে তোমার বুদ্ধি দিয়ে। যেমন কথা, তেমন কাজ। পুত্র সন্তান চিঠি নিয়ে বের হয়ে পড়ল। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ছেলে ঘরে ফিরে আসলে, বাবা জানতে চাইলেন কাজটা কিভাবে সে এত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করেছে। ছেলেটা স্বগর্বে বলতে লাগল, বাবা যেহেতু তাকে সবার থেকে অন্য রকমভাবে কাজ করতে বলেছেন, তাই ঘর থেকে বের হয়েই,সে চিঠিটা ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে। বাবাকে সে জানিয়ে দিল, বাবার কথা মত কাজটা সে অন্য ভাবে সম্পন্ন করেছে। তবে চিঠি জায়গা মত পৌছবে কি-না, সেই গ্যারান্টি দেয়া যাবে না। বুঝলেন তো কাজ অন্য রকম ভাবেও করা যেতে পারে, কিন্তু পয়সা নাই তো কাজ নাই।
এত কিছুর পরেও দেশ চলছে, তার মানে নিশ্চয়ই কাজ হচ্ছে। বিদেশে গাধার খাটুনি দিয়ে কাজ করে এক দল বাঙালি দেশের ব্যাঙ্কে টাকা পাঠাচ্ছে , আবার অন্য কিছু বাঙালি ঋণের নামে সেই টাকা উঠিয়ে লোপাট করে দিচ্ছে। অবশ্য সেটা বুদ্ধিমান ও মেধাবী বাঙ্গালিদের কাজ বলে স্বীকৃত। এরা অল্প কাজে আকাশ সমান লাভ করেন। যে দল ক্ষমতায় থাকেন, তাদের মতে শুধু তাদের আমলেই কাজ হয়। বিরোধীরা ক্ষমতায় যখন ছিল, সব অকাজ করে গেছে। সে জন্যে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বন্দরের নাম পরিবর্তন থেকে, সব কাজ নতুন করে আরম্ভ করতে হয়। পুরোন মদ নতুন বোতলে ঢেলে, মানুষকে হতবাক করে দেয়ার কি না প্রাণান্তর চেষ্টাই না করা হয়! একেই বলতে হবে প্রকৃত কাজের কাজ।
তবে এটা একেবারে নির্ভুল যে কাজ হচ্ছে, মেলা কাজ হচ্ছে। চারি দিকে শুধু কাজ আর কাজের ছড়াছড়ি।।
কাজের চাপে কারোরই মাথা তুলে তাকানোর সময় নাই।
কাজ নাই তো কথা নাই।
কাজ ছাড়া বাঙালি এখন কথা বলে না।
অথবা বাঁশি শুনে কোন কাজ নেই, সবাই ইতিমধ্যে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
না কি, মহাসমারোহেঃ নাই কাজ তো খই ভাজা চলছে?
সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৪