পনেরো ঘণ্টা
পনেরো ঘণ্টা। টেক্সাসের ডালাস থেকে দুবাই যেতে এই পরিমাণ সময়টা লাগে। একটা চেয়ার আরামদায়ক হলেও পনেরো ঘণ্টা সেটাতে বসে থাকা চাট্টিখানি কথা না। যারা প্লেনে এই পথে গিয়েছেন, তারা জানেন বসে থাকতে থাকতে কি পরিমাণ অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ব্যাপারটা মাথায় আনলে দেশে যাওয়ার উত্তেজনা নিমিষেই কেমন ম্লান হয়ে আসে। অবশ্য এমিরেটস এয়ারলাইন্স আকাশের বুকে যাত্রীদের আপ্যায়নের কোনো কমতি করে না। কিছুক্ষণ পর পর খাবার, পানি, জুস, কোল্ড ড্রিঙ্কস, চা-কফি দিয়ে যায়। প্রতিটা সিটে মুভি দেখা ও গান শোনার ব্যবস্থা আছে। তার পরেও সময়টা শেষ হতে চায় না। কারণ সেই তো একই জায়গায় বসে থাকা। অবশ্য যারা এলকোহল পান করেন, তাদের একটা সুবিধা আছে। তারা বিনা মূল্যে পান করতে পারেন। চাইলে ঝিম মেরে ভাবের জগতে যেয়ে সময়টা বেশ কাটিয়ে দিতে পারে।
প্লেনে উঠার আগে ভাবছিলাম পাশের সিটে একজন ফ্রেন্ডলি সহযাত্রী পেলে দারুণ হয়। তার সাথে গল্প করে সময়টা বেশ কাটানো যাবে। সাথে সাথে একজনের কাহিনী শোনা হবে। মানুষের জীবন বৃত্তান্ত জানতে বরাবরই আমার খুব আগ্রহ। অনেক সময়ে সেটা আমার লেখালেখিতে কাজে দেয়। গল্পের চরিত্র নির্মাণে ব্যবহার করি। চুপি চুপি বলি, মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল পাশে যদি এক অপরূপা সুন্দরী বসে! তখন সময়টা আরও অর্থবহ হয়ে উঠবে। নাহ, এই ব্যাপারে কল্পনার ফানুস বেশী না বাড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
প্লেনের লেজের দিকে পাশাপাশি তিনটা আসনের জানালার পাশে আমার সিট পড়লো। তার মানে হলো, আমি সিট থেকে উঠতে চাইলে বাকী দু জনকে উঠতে হবে। চাইলে মধ্যখানে কিংবা অন্য পাশের সিট নিতে পারতাম। মধ্যে বসলে পাশের যাত্রী ঘুমিয়ে পড়লে তাদের ঘাড় আমার গায়ে এসে পড়তে পারে। তিন নম্বর সিটের অধিকারীকে বাকী দু জনের জন্যে অনেকটা নিয়মিতভাবেই উঠতে হয়। মানে প্লেনের ইকোনমি ক্লাসে প্রতিটা সিটেই বিড়ম্বনার কোনো কমতি নাই। যাই হোক নিজে আসন গ্রহণ করে বাকী দু জনের অপেক্ষায় রইলাম।
সাধারণত যা হয় না তাই হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তার মানে তিন সিটে আমিই একমাত্র যাত্রী। চাইলে আমি এখন হাত পা মেলে দিয়ে পুরোটা জায়গা নিয়ে শুয়ে-বসে যেতে পারি। কিছুক্ষণ পর তাই করা আরম্ভ করলামও। পা উঠিয়ে বাংলা কায়দায় বসলাম, কম্বল মুরি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। না খুব বেশী উপকার পেলাম না। মনের মধ্যে অস্থিরতা এসে ভর করলো। প্রিয়তমার মিষ্টি মুখটা চোখের সামনে ভেসে আসছিল। প্রবাসী জীবনে আমাদের কতই না একের উপরে অন্যের নির্ভরতা। কয়টা দিন তাকে দেখবো না, তাতেই মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময়। অন্য ভাবনাটাও মাথায় ঠাই নিলো। দেশে বাবা, ভাই, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা হবে। শৈশবের জায়গাগুলোকে দেখা হবে। দশটা দিন বুঝার আগেই সাই করে কেটে যাবে। পুরনো স্মৃতি ঝালাই হবে ঠিকই, কিন্তু আবারও সেটা স্মৃতি হয়ে যাবে।আমারা যদি সব সময়ে সবগুলো প্রিয় মুখকে নিজের কাছে আগলে রাখতে পারতাম; আমাদের সাইবেরিয়ার পাখি হয়ে যোজন যোজন মাইল দূরে উড়ে যেয়ে বসত গাড়তে না হতো; তা হলে হয়তো আমাদের এই জীবনকে এতো বেশিবার ভারাক্রান্ত হতে হতো না, এতো বেশী কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হতো না।
এপ্রিল ৬, ২০১৮
(আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের বিমানে)
কাজী হাসানপ্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com