অরণ্য অন্বেষণ

মেট্রো কার্ডটা খুঁজে পাচ্ছে না।

গত কালই কিনেছে। পুরো এক মাসের পয়সা ভরা। সাব ওয়ে, সিটির বাস দুটোতেই ব্যবহার করা যায়। আজকে ভোর ভোর বের হতে হচ্ছে। আটটার সময় হাজিরা দিতে হবে লোয়ার ম্যানহাটনে। ঘণ্টা খানেকের রাস্তা---পাঁচ ব্লক পায়ে হেটে সাবওয়ে স্টেশনে, সেখান থেকে পাতাল ট্রেন নিয়ে সোজা ম্যানহাটন। ট্রেন থেকে নেমে আবার হাটা। গন্তব্যে পৌঁছতে আরও মিনেট দশেক। তার পরে লিফটে উঠে ১০৬ তলা। সেখানেই সকাল আটটা থেকে অরণ্যের কাজ মানে চাকরি। সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে বাসা ছাড়ার প্ল্যান। চাকরির প্রথম দিন হাতে একটু সময় নিয়ে হাজির হওয়াটাই বুদ্ধিমান।

বালিশের তলা থেকে আরম্ভ করে, ওয়ালেট, বাথরুম, প্যান্টের পকেট সব জায়গা খুঁজেছে। কিন্তু না কোথাও নাই। এক বার দুই করে, মনে হয় এর মধ্যে বাইশ বার হয়ে গেছে। মাথা গরম হওয়া আরম্ভ করল, এইটা কি করে সম্ভব? রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে নিজের হাতে ওয়ালেটের পাশে রাখলো। এখন কিনা গায়েব। ইচ্ছা ছিল মুখে কিছু দিয়ে বের হবার। তা আর হয়ে উঠলো না। দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ গেল। মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা। ছয়টা পঁয়তাল্লিশ। তার মানে এর মধ্যেই পনের মিনিট দেরী হয়ে গেছে। হাতে আর টাকা নেই। না হলে আরেকটা টিকেট কিনে নিতো। গত কালই হাতের সব টাকা শেষ করে ফেলেছে। দেশে টাকা পাঠালো, সাব লেটের টাকা দিতে হলো। তার পরে কিনল মেট্রো কার্ড। এখন কি সেই কার্ড কি-না উধাও। একেবারে গায়েব।

অরণ্যের মাথায় এলো না, এখন সে কি করতে পারে। যার থেকে সাব লেট নিয়েছে, সিদ্দিক ভাইকে ডাকা যেতে পারে। কিন্তু মন সায় দিলো না। বেচারা সারা রাত ট্যাক্সি চালিয়ে মাত্র ঘণ্টা খানেক আগে ঘুমিয়েছে। তাকে কোন ভাবেই ঘুম থেকে তুলে দশ টাকা (ডলার) ধার চাওয়া যায় না। ঘুম ভাঙ্গানোর কারণে তিনি মহা বিরক্ত হতে পারেন। এমনিতেই সে অনেক কষ্ট করে কাঠ-খড় পুড়িয়ে এই বাসায় সাবলেটের বপেয়েছে। তা ছাড়া আর মাত্র কয়েক দিন পরে অন্বেষা আসবে।

অরণ্য পরিষ্কার বুঝতে পারল ব্লাড প্রেশার হাই হচ্ছে। ইতিমধ্যে মাথা বেশ গরম হয়ে গেছে। যে কোন মুহূর্তে নিজের অজান্তেই গলার থেকে চিৎকার বের হয়ে আসতে পারে। তা হলে আরেকটা মুস্কিল হবে। সিদ্দিক ভাই আর ভাবী এক সাথে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে আসতে পারেন। কারণ শুনলে সাথে সাথে বাড়ি ছেড়ে দেবার নোটিস জারী হয়ে যাবে। এ রকম বোকামি করাটা ঠিক হবে না। নিউ ইয়র্কে এমনিতে বাড়ি পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া সাব লেট পাওয়াতে খরচ কিছুটা কম হচ্ছে।

দাঁতে দাঁত চেপে শেষ বারের মত দেখে নিলো কার্ডটা পাওয়া যায় কি না। সাথে সাথে মাথাটা দ্রুত কাজ করে চললো। কার্ড না পাওয়া গেলে কি করা যেতে পারে। প্ল্যান ছিল চারটার সময় কাজ শেষ হলে, জ্যাকসন হাইটে, আগের কাজের জায়গা ঘুরে আসার। সেখানে সে এক পাকিস্তানী ভদ্রলোকের মোবাইল ফোনের দোকানে কাজ করেছে। গত সপ্তাহের বেতন আজকে দেয়ার কথা। সেই চিন্তা করেই, অরণ্য সব টাকা খরচ করার সাহস পেয়েছে।

অরণ্য পুরো বিষয়টা আরেকবার ভাবা আরম্ভ করলো, মেট্রো কার্ড কি করে উধাও হতে পারে। হাতটা কি করে যেন, শার্টের বুক পকেটে চলে গেল। কেমন যেন শক্ত, শক্ত বলে মেনে। কার্ড মহাশয় শার্টের পকেটে দিব্যি বসে আছেন। আর সে কিনা প্রতিটা জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। শার্টের পকেটে চেক করলেই এত ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো না। নিজেকে বড় ধরণের বে-আক্কেল বলে মনে হল। নিজের উদ্দেশ্যে সব চেয়ে খারাপ গালিটা ব্যবহার করতে প্রচণ্ড ইচ্ছে হলো। নাহ তাতেই বা কি লাভ?

নামের কারণে কি প্রেম হতে পারে? বিরল হলে একেবারে অসম্ভব না। অরণ্যের বাসা ছিল ঢাকার মালিবাগের চৌধুরী পাড়ায়। নাম নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হতো । কিছু মানুষ বলত, আহারে কি সুন্দর নাম। একেবারে অন্যরকম। বন্ধুরা খুব রসিকতা করতো, কোন কিছু পাওয়া না গেলে বলতো, অরণ্যে হারিয়ে গেছে। সেটা ক্লাসে কারো পেন্সিল কিংবা খেলার মাঠের ক্রিকেট বলই হোক না কেন। উদ্দেশ্য একটাই, অরণ্যকে রাগিয়ে কিছু হাসা হাসি করা।

যে আছাড় খেয়ে পড়ে, তার জন্যে ব্যাপারটা ব্যথা-কষ্টের হলেও , অন্যদের কাছে সেটা হাসির খোরাক হতে পারে। অরণ্য; তাকে নিয়ে রসিকতা করলে আগে মন খারাপ করতো। এখন আর করে না। ভালই লাগে অন্যদের রসিকতায়। যেহেতু অরণ্য রাগ না করলে, আসর জমে না; ধীরে ধীরে নাম নিয়ে রসিকতা কমে আসলো। অবশ্য মায়ের বুদ্ধিতে কাজটা সে করতে পেরেছিল। মা বলে দিয়েছিলেন, মানুষের কথায় মন খারাপ না করলেই হলো। নিজেরে বকে বকে, এমনিতেই তোকে বিরক্ত করা ছেড়ে দিবে। ওরা যদি একবার জানতো, তোকে কত না ভালোবেসে আমি এই নামটা দিয়েছি! তুই জীবনে এত বিশাল হবি, যে তোর ছায়ায় অনায়াসে অন্য মানুষ হারিয়ে যাবে।

শৈশব, কৈশোর পার করে অরণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন আরম্ভ করলো। ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্র, তুমুল ব্যস্ত থাকতে হতো। ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময়ে পরিচয় হলো, অদ্ভুত সুন্দর দেখতে একটা মেয়ের সাথে। নাকটা খাঁড়া, চোখটা গোল গোল, এত বড় বড়। প্রায় দিনই শাড়ী পড়ে আসে। সারাক্ষণ হাসি হাসি চেহারা। অরণ্যের মেয়েটার দেখলেই মনে হয়, বুকের কলিজা যেন কেউ ধারাল একটা ছুড়ি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলছে। এই মেয়েকে দেখলে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে— হাজার বছরের প্রেমের কবিতা।

নিজেকে নিজে শাসন করল অরণ্য। কি আবোল তাবোল ভাবছে। ভাগ্যিস মনের ভিতরে কি চিন্তা চলছে, সেটা অন্য কেউ বুঝতে পারে না। না হলে কি মারাত্মক লজ্জার একটা কথা হতো। বন্ধুরা আবার তাকে নিয়ে, নতুন করে হাসাহাসি করার বিষয় খুঁজে পেতো। এ কান ও কান করে মেয়েটার কাছে যদি পোঁছাত, তা হলে মানুষের সামনে মুখ দেখান বন্ধ করে দিতো।

সুমন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অন্বেষার সাথে। বলেছিল, আমার কাসিন। এ বার ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, বাংলা ডিপার্টমেন্টে। পড়া লেখায় খুব ভাল। ঢাকা বোর্ডে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় আর্টস থেকে মেয়েদের মধ্যে থার্ড হয়েছে। ছবি আঁকে, কবিতা লিখে। অরণ্য বুঝল না, এত সুন্দরী একটা মেয়ের এত গুণ কি করে থাকতে পারে! যাকে নিয়ে কবিতা লেখা যায়, সেই কি না কবিতা লিখে।

এক কথা, দুই কথা করে দু জনের কথা আরম্ভ হলো। কথা বলতে বলতে, অনেক কথা হতে থাকলো। কথা হল নাম নিয়ে। অরণ্য বলল নাম নিয়ে সব বিড়ম্বনার গল্প। অন্বেষার হেসে নিলো এক দফা। হাসতে হাসতে বলল, আমারও অনেক গল্প আছে নাম নিয়ে, প্রথমে উচ্চারণ, বানান, অর্থ নিয়ে মেলা প্রশ্ন। শেষে অর্থ জানার পড়ে বলত, আমি না-কি সারা জীবন তোমার (অরণ্যের) অন্বেষণে থাকব।

অন্বেষার অরণ্য অন্বেষণ চলতে থাকলো। দু জনের বিয়ে হলো।

অরণ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে চাকরি পেল বিদেশি এক মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে। বেতন ভালই। অন্বেষা তখনো ইউনিভার্সিটি যায়, বছর তিনেক বাকী মাস্টার ডিগ্রি শেষ করতে। ইচ্ছা কোন কলেজে পড়ান। অরণ্য রসিকতা করে বলতো, পরীক্ষা শেষ হলেই, দু জনকে নতুন এক প্রজেক্টে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তোমার চাকরি কিছু দিন অপেক্ষা করতে পারবে। অন্বেষা মহা উৎসাহে জানতে চাইলো, কি, কি সেই প্রজেক্ট?

অরণ্য মুচকি হেসে বলল, এই আর কি, অন্বেষার অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে যাবার প্রজেক্ট। প্রেম হল, বিয়ে হল। তার পরে শিশু সন্তানের আয়োজন করতে হবে না।

অন্বেষার ফর্সা মুখ লজ্জায় লাল হল। অরণ্যের দিকে তেড়ে আসল, তবে রে।

অরণ্য কিছুক্ষণ ভিলেনের হাসি হেসে বলল, আমি সিরিয়াস। প্রজেক্টটা দ্রুত চালু করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ছেলেকে বড় করতে হবে, পড়ালেখা করাতে হবে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তার পরেই না নিশ্চিন্তে পরকালে যাত্রা করতে পারব।

অন্বেষার লজ্জা এর মধ্যে চলে গেছে। সেও রসিকতার সুরে উত্তর দিল, ধীরে বৎস, ধীরে। গাছে কাঁঠাল আসার আগেই, গোঁফে তেল দেয়ার দরকার নাই।

হাসি, আনন্দে কেটে যাচ্ছিল দু জনের জীবন। কিন্তু জোয়ার আছে বলেই, ভাটা হয়। অরণ্য যেই বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করতো, তারা তিন মাসের নোটিসে বাংলাদেশে ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেল। মাস ছয়েকের টাকা এডভান্স দিয়ে গেল অরণ্যকে। কান্ট্রি ম্যানেজার অরণ্যকে বললেন, আশা করি এর মধ্যে তুমি ভাল কোন চাকরি পেয়ে যাবে। তোমার মত হার্ড ওয়ার্কিং মানুষের যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে; সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নাই।

অরণ্য তিন মাসের মাথায় চাকরি পেয়ে গেল। বেতন আগের চাকরি থেকে অনেক কম। অরণ্যের আরও খোঁজার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অন্বেষার যুক্তি দিল, বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায়। মেয়েরা জগত সংসারকে দেখে বাস্তবতার আলোকে। অন্বেষা আবেগ দিয়ে কবিতা লিখতে জানে, কিন্তু সিদ্ধান্ত দিলো, একেবারে বাস্তবতার প্রয়োজনে।

অরণ্যের এক দম ভাল লাগল না নতুন কোম্পানি। বাঙালি মালিক না বুঝেই হৈ চৈ করে। নিয়ম, কানুন, কাজ-কর্ম আগের জায়গা থেকে অন্যরকম। ন্যায়-অন্যায় নিয়ে মালিক সাহেবের কোন মাথা ব্যথা নাই। যে কোন মূল্যে তার কাজ হওয়াটা চাই। মালিক যা বলে তাই ঠিক। অন্যদের কথার কোন দাম নাই। বরং ভিন্ন মত দেয়ার কারণে, অপমানিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

বেশ কিছু বন্ধু- বান্ধব বিদেশে চলে গিয়েছিল। বেশীর ভাগই স্কলারশিপ নিয়ে। অরণ্যের বিদেশ যাওয়ার বিষয়টা কখনো মাথায় আনে নি। প্রবাসী বন্ধুরা সবাই এক বাক্যে বলল, চলে আয় এখানে অনেক সুযোগ সুবিধা। তোর মত জিনিয়াসের বাংলাদেশে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। তুই যে ভাবে পারিস, চলে আয়। তার পরে সব ব্যবস্থা হবে।

সেই থেকে অরণ্যের মাথায় বিদেশ যাবার পোকা ঢুকল। খবর নিল কিভাবে যাওয়া যেতে পারে। কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ভিসা নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে জিআরই, টোফেল পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। সময় লাগবে। তার পরেও অনেক সময়ে এমব্যাসি ওয়ালারা ভিসা দেয় না। তখন সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অবশ্য, আরেকটা উপায় আছে। টুরিস্ট ভিসার জন্যে দাঁড়ান।

ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, চাকরির সার্টিফিকেট সহ সব ধরণের আসল-নকল কাগজ পত্র বানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ভিসার লাইনে। অন্বেষার প্রবল আপত্তি ছিল টুরিস্ট ভিসার ব্যাপারে। অরণ্যকে আরেকটু ধৈর্য ধরতে বলল। হয়ত কিছু দিনের মধ্যেই অন্য কোন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি হয়ে যাবে। তখন কাজ নিয়ে এত ভুগতে হবে না। কিন্তু, অন্বেষার কথায় অরণ্যের সিদ্ধান্ত বদলাল না। পুরো দেশটাকেই নিয়ে তার বিরক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেছে। তার একেবারে দৃঢ় ধারণা, এখানে থাকলে জীবনে কিছুই হবে না।

বন্ধু যারা আগে বলেছিল, এই দেশে চলে আসলেই হলো, তারাই ভিসা হয়েছে শুনে কথা ঘুরিয়ে ফেলল। তাদের নতুন কথা, টুরিস্ট ভিসা শেষ হতে আর কত দিন লাগবে। স্ট্যাটাস থাকবে না। ইললিগ্যাল মানে অবৈধ হয়ে যাবি। কম পয়সায় কাজ করতে হবে। এই দেশে পড়া লেখা না করলে, বাংলাদেশের পড়ালেখার কোন দাম দেয় না। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে অড জব করতে হবে। রেস্টুরেন্টে পেঁয়াজ কাটতে হবে, থালা বাসন ধুতে হবে। বাকী জীবন কপাল চাপড়াবি। এ রকম দেশে কেন আসলাম!

দু রকম কথায় অরণ্যের সিদ্ধান্তহীনতা সৃষ্টি হল। ঠিক বুঝল না, কি করা যেতে পারে। ভিসা হয়ে যাবার পরে সে এমেরিকা যাবে না, সেটা কি রকম কথা? কিছুটা সংকোচ হলেও, পুরো বিষয়টা খুলে বলল অন্বেষাকে। অরণ্য ভেবেছিল অন্বেষা বিদেশ যাবার ব্যাপারে বেঁকে বসবে। কিন্তু না, কি অদ্ভুত। অন্বেষা সায় দিল, এত সখ করছ যখন, যাও। সমস্যা হলে ফিরে এসো।

অন্বেষার সমর্থন পেয়ে অরণ্য খুশীতে আত্মহারা হয়ে পড়লো। একটা মেয়ে এত ভাল হয় কি করে। তার প্রতিটি কাজে পাশে এসে দাঁড়ায়। ভাগ্যিস সে মেয়েটাকে ভাল বেসেছিল। না হলে তার যে কি হত। স্রোতের সাথে ভেসে কথায় যে চলে যেত! অন্বেষার কানের কাছে মুখ নিয়ে আবৃত্তি করে বলল, তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি, শত রূপে শত বার।

ছোট বেলার বন্ধু শেখর নিউ ইয়র্কে থাকে অনেক বছর ধরে। সাদা মেম বিয়ে করে ভালই আছে বলে শোনা যায়। দেশেও কারোর সাথে, তেমন যোগাযোগ নাই। এমেরিকায় থাকে এমন বন্ধুদের সাথেো কোন সম্পর্ক নাই। অনেক কষ্টে তার ঠিকানা, ফোন নম্বর বের করলো। বাবা মা মারা গেছেন বেশ আগেই। তার ছোট বোনকে খুঁজে বের করল। শ্যামলী থাকে। সে বলল, ভাইয়া মেম বিয়ে করার পর আমাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এই হলো, তার শেষ ঠিকানা আর ফোন নম্বর। এখনো ঠিক আছে কিনা বলতে পারি না।

শেখর অরণ্যকে নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে থেকে উঠিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে গেল। সে থাকে নিউ ইয়র্ক শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে উডল্যান্ড নামে এক জায়গায়। প্রথম দিনই অনেক কথা বলল। সে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পর পর স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে এমেরিকা চলে এসেছিল। কিন্তু সাথে যে টাকা ছিল, তা দিয়ে এক সিমেস্টার কোন রকমে চলল। তার পরেই আরম্ভ হল টানাটানি। দেশে বাবার থেকে টাকা চাওয়ার কোন মানেই হয় না। এমেরিকা আসার আগে টিকেট আর হাতে এক হাজার ডলার দিয়ে বলেছিলেন, বাবা এই টাকা দিতেই আমাকে গ্রামের জমি বিক্রি করতে হয়েছে। তোর মা কিন্তু জানে না।

কাগজ ছিল না বলে, দোকান রেস্টুরেন্টের মালিকরা কাজ করিয়ে নিয়ে কম পয়সা দিতো। কোন রকমে নিজের চললেও, পড়া লেখার খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। এ রকম হিমসিম অবস্থায় পরিচয় হল জুলির সাথে। আপ ষ্টেট নিউ ইয়র্কের মেয়ে। শ্বেতাঙ্গ, সোনালী চুল আর নীল চোখ। দেখলেই ভাল লেগে যায়। কেমন যেন আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। এক সাথে ওরা কলেজে যেতো। কথায় কথায় চেনা জানা হল, হৃদ্যতা হল। খরচ বাঁচানোর চিন্তা থেকে, দু জন একই এপার্টমেন্ট ভাগাভাগি করে থাকা আরম্ভ করলো।

যুবক বয়সের ছেলে, মেয়ে কাছা কাছি আসলে যা হয়, দু জনের শারীরিক মিলন হতে থাকলো। জুলি সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়লো। দেশে বাবা-মা ‘র কানেও খবরটা পৌঁছে গেল। বাবা শেখরকে দীর্ঘ চিঠি পাঠালেন। বিয়ে না করে মেয়ের সাথে থাকা এবং তাকে সন্তান সম্ভবা করার অপরাধে তিনি ছেলেকে ত্যাজ্য ঘোষণা করলেন। শেষে বাবা যোগ করলেন, অনেক আশা নিয়ে তিনি জমি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন পড়ালেখা করতে। আশা ছিল ছেলে এক দিন বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু সেই ছেলে কি না এই কাজ করলো। আজকের পর থেকে শেখর যাতে বাবা মা’র সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টা না করে।

শেখর অরণ্যকে বলল , এক বার যখন এসে পড়েছ; তোকে সংগ্রাম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ধৈর্য নিয়ে লেগে থাক। তোর মত স্মার্ট ছেলে এই দেশে অনেক দূর এগুতে পারবে।

শিক্ষিত, স্মার্ট অরণ্যের জন্যে এমেরিকা টিকে থাকাটা সহজ হলো না। শেখরের বাসা অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ছেড়ে দিতে হলো। যদিও সে বলেছিল, আপাতত এখানেই থাক। থাকার, খাওয়ার খরচ লাগবে না। আসে পাশে কোথাও কাজ নিয়ে নে। পরে গুছিয়ে নিয়ে নিজের মত থাকতে পারবি। কিন্তু ওই ছোট শহরে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার হয়েও, চাকরি পেল না।

নিউ ইয়র্ক শহরে থাকার একটা ব্যবস্থা অরণ্য করে ফেললো। বরিশালের তিন জন এক এপার্টমেন্টে মেস করে থাকত। সেলিম ছিল ওদের এক জন। শেখরের পরিচিত। চাকরি হচ্ছে না শুনে, নিজে এসে নিয়ে অরণ্যকে নিয়ে গেল। বলল, আমাদের সাথে থাকবে আর নিউ ইয়র্কের কয়েক কদম হাঁটলেই এমনিতেই চাকরি হয়ে যায়।

ইঞ্জিনিয়ার অরণ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরি না হলেও, এক গাড়ির বডি সপে (ওয়ার্কশপে) চাকরি হয়ে গেল। কাজ শিখতে সময় লাগল না। অবাক হয়ে হিসেব করল, এই কাজ করেও সব খরচ করার পরে হাতে ভাল সঞ্চয় হচ্ছে। হিসেব করে দেখল, বাংলাদেশে সারা মাস চাকরি করে যা আয় করত, তার থেকে বেশী টাকা বেঁচে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই তার মধ্যে এমেরিকার স্বপ্ন পোক্ত হওয়া আরম্ভ করলো।

অন্বেষাকে ফোন করে বলল, এমেরিকায় আসলে সবাইকে প্রথমে কষ্ট করতে হয়। আমি টাকা জমাচ্ছি। আমার রুম মেট, সেলিম বলেছে, উকিলকে দশ হাজার ডলার দিলে কাগজ পত্র বানিয়ে দিবে। গ্রিন কার্ড হয়ে যাবে। তোমাকে নিয়ে আসতে পারবো। কোন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি যেয়ে মাস্টার্স করে ফেলবো। তার পরে মনের মত বেতনের চাকরি আর সেই স্পেশাল প্রজেক্টে ব্যস্ত হয়ে পড়বো। বুঝতে পেরেছ, আমাদের এমেরিকান বাচ্চা হবে।

অরণ্য উত্তেজিত হয়ে বলে চলেছে, জানো শেখরের বাসার দাম কত ? এক মিলিওন ডলার। ও বলেছে, আমি ওর বাড়ি থেকে বেশী দামী বাড়ি কিনতে পারবো। আমার জন্যে নাকি এইটা কোন ব্যাপারই হবে না। অরণ্য স্বপ্নের সাগরে স্বপ্নের জাল ফেলে; স্বপ্নের মাছগুলো শিকার করার ইচ্ছায় হারিয়ে গেল।

উকিল শেখ রহিম বললেন, আপনার জন্যে এমন কেস দাঁড় করাব যে, ইমিগ্রেশান জজ হুজুর হুজুর করে কেস এপ্রুভ করে দিবে। ধাই করে গ্রিন কার্ড হয়ে যাবে। কিন্তু, আট হাজার টাকার এডভান্স করতে হবে। বাকী টাকা হাতে গ্রিন কার্ড আসার পরে দিলেই হবে।

এতগুলো টাকা, উকিলকে, কাজ হওয়ার আগেই দিয়ে দিবে, এইটা কেমন কথা? মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। যদি টাকা মেরে দেয়। খবর নিতে লাগল বিষয়টাকে নিয়ে। এই উকিলকে টাকা দিয়ে বেশীর ভাগ মানুষের কাজ হয়েছে। গ্রিন কার্ড করিয়ে দিয়েছে , এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম না। উকিল শেখ রহিম শেখ সম্পর্কে বড় কোন অভিযোগ পেলো না। অবশ্য কিছু কেস যে হারে নি, তা কিন্তু না।

কিছু দিনের মধ্যে আরও মানুষদের সাথে পরিচয় হলো। অনেক বাঙালি ট্যাক্সি চালিয়ে ভাল টাকা আয় করছে। চাইলে সারাদিন চালানো যায়। আবার রাতে কাজ করলে আয় হয় বেশী। প্রথমে সংকোচ হলো, এক জন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ট্যাক্সি চালাবে; মানুষে শুনলে কি বলবে। হাসল, গাড়ির মেরামতের কাজ করতে পারলে, ট্যাক্সি চালাতে দোষ কথায়? কয়েক দিন আগে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল; তিনি দেশে আর্মির প্রাক্তন মেজর। আরেক জন দেশে ডাক্তার ছিলেন। তা ছাড়া কাজ তো কাজই। চুরি তো আর করছে না। সব চেয়ে বড় কথা, সে একা মানুষ। যতটুকু শরীরে কুলায় কাজ করবে। অনেক টাকা জমাতে হবে। গ্রিন কার্ড করতে হবে, অন্বেষাকে আনতে হবে। দু জনে মিলে অসমাপ্ত প্রজেক্টটা শেষ করতে হবে।

উকিল সাহেব আসলেও বিশাল এক কাজ করে ফেললেন। খাঁটি বাঙালি অরণ্যকে উর্দু ভাষী বিহারি বানিয়ে দিলেন। ঢাকায় অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এখন তার জন্যে দেশে ফিরে যাওয়া খুবই বিপদজনক। একেবারে জান নিয়ে টান পড়তে পারে। ইমিগ্রেশান জজ অত্যাচারের বিস্তারিত বর্ণনা শুনে অস্থির হয়ে পড়লেন। উকিল সাহেব জজকে শুধু বর্ণনা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না; তার বক্তব্যের পক্ষে এক গাদা কাগজ- পত্র, ছবি পেশ করলেন। অরণ্যের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুর হয়ে গেল।

শুধু দশ হাজার ডলার না, অরণ্যকে অন্য আরেক ধরনের মূল্যও দিতে হলো। সারাদিন বসে গাড়ি চালানোর জন্যে ওজন বেড়ে গেল প্রায় পনের পাউন্ড। কোমর, পেট ফুলে ইয়া বড় হয়ে গেল। বংশের খানদানি অসুখ ব্লাড প্রেশার গ্রাস করা আরম্ভ করলো। কাজের শেষে শরীর খারাপ লাগতো, মাথা ঘুরতো। প্রথমে বিষয়টাকে কোন আমল দিল না। রুম মেট এক গাল হেসে বলেছিল, এইটা হল এমেরিকা আসার সাইড এফেক্ট। যাও ডাক্তারের কাছ থেকে প্রেশারের ওষুধ নিয়ে খাওয়া আরম্ভ করো। বুঝলে এই দেশ হল ঠেকা দিয়ে চলার দেশ। রক্ত পড়লে ব্যান্ড এইড দিতে হয়। অসুখ হলে ওষুধ খেতে হয়। সমস্যা শেষ হয় না, শুধু চাপা দেয়া থাকে। বেদনা থাকলেও, কষ্ট থাকবে না। কিন্তু একটু উনিশ-বিশ হলেই আবার রক্তক্ষরণ আরম্ভ হয়ে যাবে।

প্রেশারের কথা শুনে অন্বেষা আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। ওই দিনই জিদ করে অরণ্যকে ডাক্তারের কাছে যেতে বাধ্য করলো। ডাক্তার ওই টেস্ট সেই টেস্ট করে বলল, তোমাকে প্রেশারের ওষুধ লিখে দিলাম। তোমাকে বাকী জীবন ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। খবরদার ওষুধ কিন্তু মিস করবে না। না হলে বিপদ ঘটে যেতে পারে।

একই উকিলই অন্বেষার ইমিগ্রেশানের এপ্লায় করে দিলেন। তার জন্যে দিতে হল আড়াই হাজার ডলার। তিনি রসিকতা করে বললেন, আড়াই হাজার ডলার দিলেন, তাই, আপনার স্ত্রী আড়াই বছরের মাথায় এমেরিকায় চলে আসবেন। তখন আপনারা স্বামী-স্ত্রী মিলে দু জনে সুখে শান্তিতে থাকবেন। অরণ্য হিসেব করল, আড়াই বছর শুনতে অনেক, কিন্তু; দেখতে দেখতে কেটে যাবে। বড় কিছু একটা পেতে হলে, কিছু ত্যাগ স্বীকার না করে কি উপায় আছে?

অরণ্য অন্বেষাকে ফোন করে বলল, আমি একটু পিছিয়ে গেলাম। তুমি আসার পরেই কোন মাস্টার্স ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাবো। বয়স নিয়ে তুমি ভেবো না। এই দেশে একটু বয়স বাড়লে কোন যায় আসে না। অনেক বয়স্ক মানুষ এখানে লেখা পড়া করে। ইভনিং ক্লাসে যায়।

অন্বেষা ওই দিক থেকে উত্তর দিল, তুমি এখন ই ভর্তি হয়ে গেলে সমস্যা কি? অরণ্য সাথে সাথে জানাল, তুমি পাশে নাই বলে কোন অনুপ্রেরণা পাচ্ছি না। তুমি আসলেই সব নতুন উদ্যমে চালু হবে। তা ছাড়া টাকা পয়সা যা জমেছিল, সব উকিলের পেছনে চলে গেছে। আবার নতুন করে কিছু জমিয়ে নেই।

অরণ্য মহা উৎসাহ বলতে থাকল, বুঝলে বুঝলে; আমাদের ছেলে মেয়েরা জন্মগত সূত্রে এমেরিকান হবে। চাইলে এমেরিকার প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হতে পারবে। প্রেসিডেন্ট অফ দি ইউনাইটেড স্টেটস অফ এমেরিকা। দি গ্রেটেস্ট কান্ট্রি ইন দি ওয়ার্ল্ড।

অন্বেষা হাসতে হাসতে হাসতে বলে, থাক থাক বাঙালি সাহেব নিজে হলে বিহারি । আর ছেলে মেয়েদের বানাচ্ছে প্রেসিডেন্ট অফ দি ইউনাইটেড স্টেটস অফ এমেরিকা।

কথা, হাসা-হাসি চলতে থাকে। মুহূর্তেই মনে হয় দূরত্ব হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। এক জন আরেক জনের খুব কাছে চলে আসে। ভালোবাসার শক্তি ও গতিকে পৃথিবীর কোন কিছুই হার মানাতে পারে না।

মানুষের পরিকল্পনার সাথে প্রকৃতি আবার বড় ধরণের রসিকতা করলো। অরণ্য প্রায় রাত তিনটের দিকে ট্যাক্সি চালিয়ে ফিরছিল নিউ জার্সি থেকে। হঠাৎ করে মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। তার পরে আর মনে নেই।

ডাক্তারের কথা মিলে গেল। অরণ্য আগের কয়েক দিন প্রেশারের ওষুধ খায় নি। তার পরে রাত জেগে কাজ করার কারণে ধকল ছিল বেশী। অরণ্যের গাড়ি যেয়ে ব্রিজের রেলিঙে যেয়ে আঘাত করলো। ভাগ্যিস সে সময়ে গাড়িতে কোন যাত্রী ছিল না। মাথা ফেটে গেল, ডান হাত, ডান পা দুই ভাঙল। দশ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাসায় আরও দু মাস কাটাতে হল। বিশ্রাম ছাড়াও থেরাপি নিতে হলো। জমান টাকার প্রায় শেষের দিকে চলে গেল।

শরীরটা ভাল হলেও, ব্লাড প্রেশারের সমস্যা একেবারে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। ডাক্তার প্রেশারের ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। ডাক্তাররা পরামর্শ দিলো ট্যাক্সি চালানো ছেড়ে দিতে। অবশ্য, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অপরাধে, ট্যাক্সি চালানোর লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেল। দুর্ঘটনার আগেও নিউ ইয়র্কের পুলিশ তাকে কয়েক বার জোড়ে গাড়ি চালানোর অপরাধে দণ্ডিত করেছিল। সব মিলিয়ে কোর্ট থেকে সিদ্ধান্ত হলো, অরণ্য গাড়ি চালালে নিজের জন্যে হুমকি, আবার অন্যদের জন্যে সমূহ বিপদের কারণ হতে পারে।

শরীর খারাপের সাথে সাথে মনের মধ্যে হতাশা এসে বাসা বাঁধল। কোন কিছুই ভাল লাগে না, কোন কিছুই হবে না মনে হতে লাগল। অন্বেষার সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিলো। অকারণে তার সাথে অভিমান হতে লাগল। বিদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে বারে বারে নিজেকে ধিক্কার দেয়া আরম্ভ করল। অন্বেষা বাংলাদেশ থেকে ফোন করে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করল, মানুষের জীবনে বিপদ-আপদ আসতেই পারে। তোমাকে শক্ত হবে। সময়ের সাথে ভাল দিন ফিরে আসবে।

অরণ্য বড় একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার আবার ভাল দিন! আয় রোজগার না থাকলে নিজেই বা খাব কি, আর তোমার জন্যেই বা কি করব? অন্বেষা উত্তরে বলল, ছি লক্ষ্মীটি এমন করতে হয় না। আমার তো আসার সময় হয়ে আসছে। আমি পাশে থাকলে তোমার কোন চিন্তা থাকবে না। তুমি না ব্যাটা ছেলে, তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। খোঁজ নিয়ে দেখ, এমেরিকায় তোমার জন্যে অনেক কাজ অপেক্ষা করছে।

আয় কম হলেও, অরণ্যের চাকরি হয়ে হল এক পাকিস্তান থেকে আসা মানুষের মোবাইল ফোনের দোকানে। বেশ অমায়িক লোক। ট্যাক্সি চালানোর থেকে অনেক আরামের কাজ। সারাদিন এক জায়গায় বসে থাকতে হয় না। একটু এই দিক, ওই দিক হাটা চলা করতে পারে। ডাক্তারের সাবধানতা ছিল, বেশীক্ষণ এক জায়গা, এক ভাবে বসে থাকলে রক্ত ক্লট হতে পারে। তার থেকে আবার, প্রেশার বেড়ে যাবে। অন্যান্য সমস্যা এক এক করে হাজির হবে।

ছোট একটা খবর, অরণ্যের শরীর, মন দুটোকেই চাঙ্গা করে দিল। এমেরিকান এমব্যাসি থেকে চিঠি গেছে অন্বেষার কাছে, সামনে ভিসার জন্যে ইন্টার্ভিউ। সাথে কিছু কাগজ পত্র রেডি করে নিয়ে যেতে বলেছে। অরণ্যের, আনন্দে অনেক দিন পরে নাচতে ইচ্ছে হল; তা তা থৈ থৈ । গত কিছু দিন অন্বেষার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্যে বারে বারে সরি বলল। মুখটা সারাক্ষণ হাসিতে ভরে থাকল। অন্বেষা আসা মাত্রই অসমাপ্ত প্রজেক্টের কাজটা পুনরায় চালু করতে হবে। এ যে বিরাট দায়িত্ব। ভবিষ্যৎ এমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাদের দু জনের ভালোবাসা থেকেই তৈরি হবে।

শেখর, অরণ্যের জন্যে নতুন কাজের ব্যবস্থা করলো। তার এক বন্ধু বার-টেন্ডারের কাজ করত। তেমন কঠিন কাজ না। কিন্তু রোজগার বেশ ভাল। বড়লোক সাহেব-মেমদের মদ পরিবেশন করা, ককটেল বানিয়ে দেয়ার কাজ। অরণ্য এক মাসের কোর্স করে, এই কাজের লাইসেন্স বানিয়ে নিলো। মাথার মধ্যে আবার স্বপ্নের জাল ছড়াতে লাগল। সে আবার টাকা জমাবে। ঘর সংসার করবে। ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যেয়ে মাস্টার ডিগ্রি শেষ করবে। সে আবার ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করবে।

ভবিষ্যৎ এমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাবা তো আর যেমন তেমন কাজ করতে পারে না।

১০৭ তলার পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং। নাম টুইন টাওয়ার, আরেক নাম হল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। পৃথিবীর সব বেয়ে উঁচু মানুষের তৈরি স্থাপনা। এমেরিকা অনেকটা তার অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছে এখানে। নর্থ টাওয়ারের ১০৬-১০৭ তলা জুড়ে বিশাল এক রেস্টুরেন্ট, নাম উইন্ডোজ অফ দা ওয়ার্ল্ড (বিশ্বের জানালা)। পুরো নিউ ইয়র্ক শহর দেখা যায় জানালা দিয়ে। তার ভিতরে রাজকীয় মদ্য পানের জায়গা, নাম দা গ্রেটেস্ট বার অন দা আর্থ।

দা গ্রেটেস্ট বার অন দা আর্থে চাকরি পাওয়া খুব একটা সহজ কাজ না। বেতন ভাল। সাথে অনেক টাকা কাস্টমারদের থেকে টিপস হিসেবে পাওয়া যায়। অরণ্য সেই অসাধ্য সাধন করল। বারটেন্ডারিং স্কুলে ভাল রেজাল্ট আর শেখরের বন্ধুর সহায়তায়, সেখানে তার চাকরি হয়ে গেল। গত কালই ফাইনাল ইন্টার্ভিউ’র পরে চাকরির অফার পেয়েছে।

অনেকেরই ঈর্ষার কারণ ছিল এই বিশাল বিল্ডিং আর হাজার, হাজার মানুষের কাজের জায়। বড় আতঙ্কের কারণ, সন্ত্রাসীরা এই বিল্ডিঙের দিকে লক্ষ্য ঠিক করে রেখেছে। ১৯৯৩ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসীরা ট্রাক বোমা ফাটিয়ে বিল্ডিংটা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সে বার তারা সফল হয় নি। তার পরেও ব্যর্থ চেষ্টায় ৬ জন মানুষ নিহত হয়, এক হাজারের বেশী আহত হয়।

কিন্তু আল কায়েদার সন্ত্রাসীরা সফল হয় ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে। একই সঙ্গে তারা চারটা বিমান ছিনতাই করে। এমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১১ সকাল ৮ঃ৪৬ মিনিটে নর্থ টাওয়ার আঘাত করে। উইন্ডোজ অফ দা ওয়ার্ল্ডের উপস্থিত সব কাস্টমার আর কর্মচারী সেই আক্রমণে নিহত হয় বলেই সবার ধারণা। সরকারি হিসেবে টুইন টাওয়ারে ওই দিন ২৯৯৬ জন মানুষ প্রাণ হারায়।

বিমানটা যখন আঘাত করল, অরণ্য তখন ম্যানেজারের কাছ থেকে বারের কাজ বুঝে নিচ্ছিলো।

মাত্র তিন দিন পরে অন্বেষার নিউ ইয়র্কে আসার কথা। অরণ্য সব প্ল্যান করে রেখেছে। অসমাপ্ত প্রজেক্টের কাজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির কাজ, ভবিষ্যৎ এমেরিকার প্রেসিডেন্ট বানানোর কাজ—সব এক এক করে করতে হবে।

১০১ টা লাল গোলাপ নিয়ে অন্বেষাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করবে। সারা রাত ধরে গল্প করবে। অন্বেষার ক্লান্ত থাকবে; তার পরেও বলবে শাড়ী পরে কপালে বড় একটা টিপ দিতে। লাল টিপ হলে ভাল হয়। লাল যে তার প্রিয় রং। একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে বলবে, এসে নীপ বনে, ছায়া বীথি তলে।

ঠিক সেই আগেকার মত। বিয়ের আগে যখন প্রেম করত, ঠিক সেই সময়কার মত।

শেষে অন্বেষাকে কানে কানে বলবে, অন্বেষা তুমি এখন অরণ্যে হারিয়ে যাও।

এখন শুধু অরণ্য অন্বেষণ।

(সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী আক্রমণে প্রায় পনের জনের মত বাঙালি প্রাণ হারায়। তবে সঠিক হিসেব হয়ত আরও বেশী হতে পারে। কিছু বাঙালির বৈধ কাগজ পত্র না থাকায়, তাদের সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় নি বলে ধারণা করা হয় )

ডিসেম্বর ১৩, ২০১৪

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com