চাপে আছি রে ভাই .....
“চাপে আছি ভাই, মেলা চাপে। হাতে একেবারে সময় নাই। চাপ একটু কমলেই ......।”
কথাগুলোর সাথে বাঙালিরা এখন বেশ পরিচিত। পুরো বাক্যটা এক সাথে শুনলেও, বিষয়টা আমরা নানা আঙ্গিকে প্রতিনিয়ত শুনছি। বাঙালি এখন আগের মত নাই। সে এখন চাপে আছে। শুধু একটা না, তাদের এখন মেলা ধরণের চাপ। চাপের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। মাথা আর বুক সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু স্বাধীন দেশের মানুষদের না ‘চির উন্নত মম শির’ হওয়ার কথা। যেই চাপ স্বাধীন দেশের মানুষদের কাত করে দিচ্ছে, তাকে নিয়ে কিছুটা কথা বলার নিশ্চয়ই একটা দরকার আছে।
চাপ বিষয়টা আসলে কি? পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় একক ক্ষেত্রফলের উপর প্রযুক্ত বলকে চাপ বলে। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র না, তাদের জন্যে হয়ত ব্যাখ্যাটা কিছুটা কঠিন হয়ে গেল। সহজ করে বলি। নির্দিষ্ট জায়গায় বল প্রয়োগ করলে, যে প্রতিক্রিয়া হয় তাই চাপ। মহাজ্ঞানী নিউটন তত্ত্ব দিয়ে গেছেন, প্রতিটা ক্রিয়ার-ই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়। তা হলে বিষয়টা এমন দাঁড়ালো, যার যত-বেশী বল সে তত বেশী চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
প্রশ্ন হলো, এই চাপ জিনিসটা বাঙালির জীবনে কেমন করে এলো। সেই কথায় যাবার আগে ছোট একটা গল্প বলি। একবার জনৈক রুগী দেশ সেরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলেন। তার আগে তিনি অন্যান্য ডাক্তারদের দেখিয়ে মেলা ওষুধ খেয়েছেন। কিন্তু কোন লাভ হয় নি। বরং সমস্যাটা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এখন দেশের সব চেয়ে বড় ডাক্তার-ই তার শেষ সম্বল। বড় ডাক্তার ও তার সহযোগীদের চক্ষু চড়ক গাছ, এতো একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। কোন মানুষের ব্লাড প্রেশার মানে রক্ত চাপ এতো প্রচণ্ড বেশী হতে পারে তা তারা আগে কখনো দেখেন নি। ডাক্তার সাহেব অনুসন্ধিৎসু স্বরে জানতে চাইলেন, “আপনার এতো প্রেশার---- নিশ্চয়ই বাবা কিংবা মা’র থেকে পেয়েছেন?” রুগী মহোদয় মিনমিন করে উত্তর দিলেন, “জী না, বাবা মা কারোর প্রেশার ছিল না। তবে মনে হয় এটা স্ত্রী সাহেবার বদৌলতে এসেছে।”
এই চাপ তৈরি হওয়ার জন্যে স্ত্রী সাহেবাকে কোনক্রমেই এককভাবে দোষ দেয়া যায় না। তার নিজের উপর কি কম চাপ? সকালে বাচ্চাদের ঘুম থেকে উঠাও, নাস্তা করাও, স্কুলে পাঠাও-ফেরত আনাও। আরও আছে, বাসার সবার খাবার-দাবার নিশ্চিত করা থেকে আরম্ভ করে কতো না ঝামেলা, মুশকিলের সব কর্মকাণ্ড! সাথে আছে সামাজিক প্রতিযোগিতা; সব চেয়ে চমকপ্রদ শাড়ী, গহনা কিনে পাড়ার সব ভাবীদের হতবাক করে দেয়া। এত কিছুর জন্যে বাড়ির জনাব যথেষ্ট টাকা আনতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে বেচারী বেগম সাহেবাকেও নেমে পড়তে হয় টাকা আয় করার কাজে। তার পরে মেজাজটা আর কতক্ষণ ঠাণ্ডা রাখা যায়। মাথায় রক্ত চড়ে বসে। না চাইলেও আশে পাশের মানুষদের উপর মেজাজের ঝাঁপটা চলে আসে। এর পরে স্বামী সাহেবের প্রেশারের সমস্যা হওয়ার কারণে স্ত্রীকে দোষারোপ করা কি ন্যায় সঙ্গত? দেখলেন-ই তো স্ত্রীর নিজের-ই কত শত প্রেশার!
এক অফিসের বড় সাহেব খুব ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, মানে মারাত্মক ধরণের প্রেশার চলছিল। মেজাজটা খুব তিতিয়ে ছিল। অফিসে বসে সমস্যা থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যায় সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন। সেই সময়ে অফিসে ঢুকলো তার এক জুনিয়র অফিসার। অনেকটা উদর পিণ্ডি বুদর ঘাড়ে দেয়ার মত অবস্থা হলো। বড় সাহেব অফিসারকে অকারণে মেলা বকা ঝকা করলেন। অধঃস্থন অফিসার মাথা নিচু করে বড় সাহেবের অযৌক্তিক যন্ত্রণা সহ্য করলেন। কিন্তু বাড়ি যেয়ে আর থাকতে পারলেন না। চা কেন বেশী গরম হয়েছে, এই অজুহাত দেখিয়ে স্ত্রীকে তুমুল কটূক্তি করলেন। স্ত্রী স্বামীর কথা নীরবে সহ্য করলেন। স্ত্রী সাহেবা ১০ বছরের কন্যা মুন্নি বই নিয়ে কেন পড়তে বসে নি, এই কারণে প্রিয় কন্যাকে উত্তম মধ্যম মানে মাইর দিলেন। বয়সে ছোট হলেও মুন্নি মায়ের আচরণে বেজায় বিরক্ত হয়ে বাসার পোষা বিড়ালকে কষে এক লাথি মারলো। বিড়াল পশু হতে পারে, কিন্তু কারণহীন অত্যাচার হজম করতে সেও প্রস্তুত ছিল না। বেচারা অবলা বিড়াল রাগের চোটে ঘর থেকে বের হয়ে এসে সামনের ডান পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলো।
দেখলেন তো এক জায়গায় চাপ তৈরি হলে, কিভাবে ধারাবাহিকভাবে ছড়াতে থাকে। আমাদের পরিবেশ ও সমাজে প্রতিনিয়ত হাজারো চাপ তৈরি হচ্ছে। বাতাসে চাপের তারতম্যের কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, হ্যারিকেন হয়ে আঘাত করে চলেছে। সীমাহীন সম্পদ ও মানুষের ক্ষয়ক্ষতি করছে। তবে সেই দিকে বিস্তারিত যাচ্ছি না। যে কোন ভূগোল বই খুললেই, আপনার পরিষ্কার জানা হয়ে যাবে বাতাসের উচ্চ ও নিম্ন চাপের কারণে কি কি ঘটনা-দুর্ঘটনা হচ্ছে। প্রকৃতির মত মানুষের মধ্যেও দু ধরণের চাপের সৃষ্টি হয়; উচ্চ ও নিম্ন রক্ত চাপ।
রক্ত ছাড়া মানুষ অচল। অক্সিজেন, শক্তি, পুষ্টি রক্তের মাধ্যমেই শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যায়। নির্দিষ্ট স্রোতে (মানে প্রেশারে) রক্ত প্রবাহিত হয়ে থাকে। তারতম্য হলেই, শরীরের চলনে, বলনে, ও আচরণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কেন শরীরে এই চাপের হেরফের? বেশী লবণ খাওয়া ছাড়া, সম্ভবত মূল কারণ দুটো। এক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। অন্যটা হলো পারিপার্শ্বিকতা। তার উদাহরণ একটু আগেই তো পেয়েছেন; ঐ যে বড় সাহেবের চাপ কিভাবে এক এক করে বিড়াল পর্যন্ত পোঁছে গিয়েছিল।
আধুনিক পৃথিবীতে মনে হয় প্রতিটা ক্ষেত্রে চাপ আর চাপ। চাপকে প্রথমে মস্তিষ্ক পরিমাপ করছে, তার পরে হৃদপিণ্ড হয়ে সারা শরীরে চাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ চাপ নিজের মধ্যে সামাল দিতে পারেন। অন্যদের প্রথমে ব্লাড প্রেশার উপরের দিকে উঠে। তার পরে কাজে কর্মে চাপের প্রভাব স্পষ্ট হতে থাকে; মেজাজ খারাপ হয়, শরীর দুর্বল হতে হতে হার্ট এট্যাক, কিডনি ফেলিয়ার জাতীয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী সু-বিশাল ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। এটা ঠেকানোর জন্যে অবশ্য ডাক্তার সাহেবরা রুগীদের প্রেশার কমানোর ওষুধ হরদম প্রেসক্রিপশন করে চলেছেন। তবে সব সময়ে ওষুধ খেয়ে যে প্রেশারের সমস্যা দূর হচ্ছে, তা কিন্তু না।
আধুনিক প্রযুক্তি যেমন গতি এনেছে, ঠিক তেমন চাপকে করেছে বহুমুখী। ফেসবুকে ছবিতে পর্যাপ্ত লাইক না পড়ায় যুবা বয়সের বন্ধুরা অস্থির হয়ে পড়ছে। সব বন্ধু কেন লাইক দেয় নি, তার কারণ খুঁজতে যেয়ে সমস্যা আরও বাড়ে। ফেসবুকে অকৃতজ্ঞ বন্ধুরের অপমান সহ্য করতে না পেরে কত তরুণ-তরুণী যে লজ্জিত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার কোন ইয়ত্তা নাই। এমনকি এখনকার দিনে ছোট কোমল-মতি শিশুদের উপর চাপের কমতি নাই। পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করো , গান-নাচের কম্পিটিশনে ফাস্ট হও ধরণের কত না চাপের মধ্যে দিয়ে তারা যায়। তাই তো দেখি টিভি চ্যানেলগুলোর রিয়েলিটি শোতে জিততে না পেরে শিশুরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
শিশুদের স্বভাবজাত বেড়ে উঠায় সমাজ কত না অন্তরায় তৈরি করছে। উঠতি বয়স হলে আরেক ধরণের চাপ আসে। অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে বয় ফ্রেন্ড বা গার্ল ফ্রেন্ড জোগাড় করতে হয়। কিন্তু এ রকম যুগলে মধ্যে কি আর প্রেম থাকে? প্রেম তো জোর-জবরদস্তি করে হয় না। প্রেম ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মত এমনিতেই নেমে আসে। ভালোলাগা ও ভালোবাসা একের পর এক ক্রমান্বয়ে এসে সিক্ত করতে থাকে কপোত-কপোতীদের। এখানে তাড়াহুড়া কিংবা বাধ্য করলেই ছন্দ পতনের সমূহ সম্ভাবনা।
বাইরের ও শরীরের প্রেশার মিলে অনেক সময়ে জটিল আকার ধারণ করছে। কেউ হয় হতাশ, অন্যরা টেনশনে ভুগতে থাকে সারাক্ষণ। শেষে শরীর ভর্তি মেলা অসুখ বিসুখ নিয়ে বসবাস। জীবনটা একেবারে বিষাদ-পূর্ণ হয়ে উঠে। আবার কিছু মানুষ নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় ভেবে জীবনের নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলছে। আত্মহত্যার মত চূড়ান্ত নির্মম কাজ করছে। এখানে ধর্মের একটা কথা না বললেই না, “বান্দা সামাল দিতে পারবে না, এমন কোনো চাপ বা বোঝা সৃষ্টিকর্তা মানুষেকে দেন না।” তবে মানুষ নিজে সমস্যাটাকে জটিল করে ছাড়ে। চাপে পড়ে সে আতঙ্কিত হতে থাকে। এক আতঙ্ক আরও অনেক আতঙ্কের জন্ম দেয়। শেষে আতঙ্কে আতঙ্কে জীবনটা বিভীষিকাপূর্ণ হয়ে উঠে।
এইবার আমার অফিসের এক সুন্দরী সহকর্মীর কথা বলি। তার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ভারী মিষ্টি চেহারা, যখন কথা বলে তখন কেমন এক অদ্ভুত সুন্দর সৌন্দর্য খেলে যায়। আমি চেয়ে থাকি। কারণে-অকারণে শব্দ করে হাসে। চারিদিকে একটা আনন্দের রিনিঝিনি বুঝি ছড়িয়ে পড়ে। তখন তাকে দেখতে ভীষণ অপরূপা মনে হয়। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রই। ব্যাপারটা আমাকে আগ্রহী করে তুললো। একটা দুটো কথা হতে হতে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে তার জীবনের অনেক কিছুই জানা হলো। বেচারী ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। মেলা চিকিৎসার পর, এখন সে ক্যান্সার মুক্ত। দীর্ঘ সময় হাসপাতাল, রেডিয়েশন, কিমো, সার্জারি, ওষুধ নিয়ে বসবাস করতে হয়েছে। প্রতিটা মুহূর্ত নিদারুণ শারীরিক কষ্ট ও হতাশায় ভুগতে হয়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছিল পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জটিলতা।
আমি একবার সুযোগ বুঝে জানতে চাইলাম, সে কেমন করে এতো সমস্যার পরেও এই ভুবন মোহিনী হাসি দিয়ে প্রায় সব সময় মেতে থাকতে পারে। কথাটা শুনে সে আরেক-দফা হেসে জানাল, সে এই প্রাণ খুলে হাসা রপ্ত করেছে ক্যান্সারে ভুগার সময়ে। তখন তার যেই প্রচণ্ড চাপ চলছিল, তার কারণে কাঁদাটা কিংবা সারাক্ষণ মন খারাপ করে রাখাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সে না কেঁদে, উল্টো হাসা রপ্ত করেছে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা কষ্টের মধ্যে যে একটা শিক্ষা মানে পসিটিভ ব্যাপার আছে, সেটা সে বের করতে আনতে শিখেছে। তাই ঘটনা যেমন-ই হউক না কেন, সশব্দে হাসা তার চাই। কেঁদে সে পরাজিত হতে চায় না। হাসির শব্দের মাধ্যমে সে ঘোষণা করে, সে হারতে জানে না। সে অবশ্যই একজন বিজয়ী। শেষে হাসা একটু কমিয়ে বলল, “বন্ধু জানোই তো হাসি হলো পৃথিবীর সেরা ওষুধ (Laughter is the best medicine)।”
চাপ মানে টেনশন আছে এবং থাকবে। ওষুধ ছাড়াও চাপ সামাল দেয়ার অগণিত উপায় আছে। আড্ডা, গান শোনা, গল্পের বই পড়া, দেশ ভ্রমণ ইত্যাদি সব-ই চাপ কমায়। তবে চাপে চাপে ভারাক্রান্ত না হওয়ার মূল অস্ত্র মানুষের নিজের কাছেই আছে। সময়ে সব চাপ-ই লঘু হয়ে যায়। সাথে সাথে প্রয়োজন ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস ও চেষ্টা।
সর্বশেষে নিউটনের তত্ত্বটা মনে করিয়ে দেই, প্রতিটা ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। সে জন্যে দুঃখ, কষ্ট, বেদনার মত চাপের উত্তর কোনভাবেই হতাশ হয়ে নিজের ধ্বংস ডেকে আনা হতে পারে না। বরং হতে পারে, এই সব চাপের দাঁত ভাঙ্গা জবাব হতে পারে প্রাণ খোলা হাসা ও চাপকে ঠিক তার সমান ও বিপরীত জোরে মোকাবেলা করা। মেঘের পেছনেই সূর্য লুকানো আছে। একটু কষ্ট করে কালো মেঘটাকেই সরাতে পারলেই দেখা মিলবে সুন্দর সোনালী ঝকঝকে দিন।
মে ১৬, ২০১৭
কাজী হাসান
লেখক: quazih@yahoo.com