একজন ক্ষুদে কবি ও দার্শনিক: ম্যাটি স্টেপানেক

এমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের জিমি কার্টারের মাথায় হাজার ধরণের চিন্তা। হাজারো সমস্যা নিয়ে ভাবতে হয়, কত ধরণের পরিকল্পনা পর্যবেক্ষণ করে মতামত দিতে হয়। সাথে সাথে অনেকের অনুরোধ রক্ষা করতে হয়। এ বারের অনুরোধ অবশ্য কিছুটা অন্য রকম। ১১ বছরের এক জন বালক তার সাথে কথা বলতে চেয়েছে।

এমেরিকার ৩৯ তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। এক সময়ে বাদাম চাষ করতেন। একেবারে সাধারণ মানুষের জীবন ছিল। পরে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচন করেন। শুধু নিজের দেশের মানুষের কষ্টে তিনি ব্যথিত হতেন না, তিনি সারা বিশ্বের শান্তির জন্যে এখনো নিরলস-ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০২ সালে বিশ্ব শান্তির অবদানের জন্যে তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। যাই হোক, অকারণে এক মুহূর্ত নষ্ট করার মতো সময় তার নাই। কিন্তু যারা তাকে বালকটার সাথে কথা বলতে অনুরোধ করেছে, তারা একান্ত জরুরী না হলে এমন প্রস্তাব প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দিত না।

২০০১ সালের গ্রীষ্ম কালের কথা হচ্ছে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা খবর দিলেন, মহামান্য প্রেসিডেন্ট (এমেরিকায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকেও, প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করা হয়) দশ মিনিটের মধ্যে ফোন করবেন। কিন্তু যার সাথে কথা বলবেন, তার রুমে তো ফোন নেই। ফোন লাগানোর জন্যে তাড়াহুড়ো লেগে গেল। ভাগ্যক্রমে বলতে হবে, প্রেসিডেন্টের ফোন আসার আগেই ফোনের লাইন লাগানো সম্ভব হলো।

জিমি কার্টার যার সাথে কথা বলার জন্যে ফোন করলেন, তার নাম ম্যাটি স্টেপানেক (Mattie J.T. Stepanek)। প্রেসিডেন্টের একটা ধারণা ছিল, ১১ বছরের বালক তার সাথে কি ধরণের কথা বলতে পারে। হয়ত জানতে চাইবে, প্রেসিডেন্ট হলে কেমন লাগে? কিংবা বলবে আমি কি চাইলে প্রেসিডেন্ট হতে পারবো। আসলে তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে এমন কথাগুলো ভেবে রেখেছিলেন। আগেও তিনি এ ধরণের ফোন কল করেছেন কি- না!

কিন্তু না জিমি কার্টার একেবারে ভুল প্রমাণিত হলেন। তিনি যা ভেবেছিলেন, ম্যাটি সে রকম কিছুই বলল না। বরং, কথা হলো শান্তি নিয়ে। কথা হলো সারা বিশ্বে কি করে দারিদ্র আর ক্ষুধা দূর করা যায়। আলোচনা হল, বিশ্বে কি করে টেকসই শান্তি স্থাপন করা যেতে পারে।

প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার যার পর নাই অবাক হলেন। ম্যাটিকে মুহূর্তের জন্যেও ১১ বছরের বালক বলে মনে হয় নি। বরং তার কাছে মনে হয়েছে, ওই পাশ থেকে তার মতই কোন রাষ্ট্র নায়ক, সারা পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের জন্যে উদগ্রীব। মানুষের কষ্ট, তা সে বিশ্বের যেই প্রান্তেই হউক না কেন, সেও জিমির মত সইতে পারছে না। দু জনই এই উদ্দেশ্যে যে কোন ত্যাগও করতে প্রস্তুত আছেন।

দু জন অসম বয়সের মানুষের বিস্ময়কর বন্ধুত্ব তখন থেকে আরম্ভ হলো।

এমেরিকায় এক মহতী সংগঠন আছে, যার নাম মেক আ উইশ ফাউন্ডেশন (Make a Wish Foundation)। অল্প বয়সের বালক-বালিকা যাদের কোন মরণ-ব্যাধি হয়েছে, অর্থাৎ যাদের আয়ু মাত্র কিছুদিন বাকী, তাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে এই সংগঠন একনিষ্ঠ-ভাবে ভাবে কাজ করে চলেছে।

ম্যাটি অচেতন অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা নিয়ে ওয়াশিংটনের শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। বাঁচার সম্ভাবনা ছিল একেবারে ক্ষীণ। কিন্তু ডাক্তাররা ছেড়ে দেবার বান্দা না। নিজেদের প্রচেষ্টা আর আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মিষ্টি একটা বাচ্চা তাদের সবার ভালো লাগা কেড়ে নিলো।

সবার অক্লান্ত প্রচেষ্টা আর বিধাতার কৃপায় তিন মাস পরে ইনটেনসিভ কেয়ারে ম্যাটি চোখ খুললো। সবার চোখে মুখে সাফল্যের প্রশান্তি। কিন্তু কেউ উৎফুল্ল হতে পারছে না। তাদের জানা হয়ে গেছে, ম্যাটি চোখ খুললেও; সে এখনও পুরো সুস্থ হয় নি। আসলে চিকিৎসা শাস্ত্র তাকে রক্ষা করতে পারবে না। ম্যাটির হাতে বেশী দিন নাই। ছেলেটার মনোবল জোরালো করা খুব দরকার। তার মনের ভিতরের সুপ্ত কোন ইচ্ছা যদি পূরণ করা যায়, তা হলে তাকে কিছু আনন্দ দেয়া যেতে পারে। তার থেকে হয়ত মনোবল আরও কিছুটা শক্ত হবে। সেটার উপর ভর করে ম্যাটি হয়তো পৃথিবীতে আরও কয়েকটা বেশী দিন বেঁচে থাকতে পারবে।

হাসপাতাল থেকে যোগাযোগ করা হলো, মেক আ উইশ ফাউন্ডেশনের সাথে। তারা সাথে সাথেই তাদের প্রতিনিধি কথা চলতে এলো। ম্যাটির কাছে জানতে চাইলো, তার মনে কি এমন কোন বিশেষ ইচ্ছা আছে। ম্যাটি একটু মুচকি হেসে বলল, আমার অবশ্য ইচ্ছা আছে। তবে একটা না তিনটে। যদি বলো, তোমরা সে গুলো পূরণ করতে পারবে, তা হলে বলি। না হলে থাক।

মেক আ উইশ ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি ভাবলেন, ম্যাটিও হয়ত এ বয়সের অন্য বাচ্চাদের মত বলবেন, ডিসনি ল্যান্ডে বেড়াতে যাব, কিংবা প্রেসিডেন্ট অথবা কোন বিখ্যাত মানুষের সাথে মিলিত হতে চায় । তারা এ ধরণের কাজ আগেও করেছে। সে জন্যে বেশ সাহসের সাথে, তিনি উত্তর দিলেন, তুমি যা বলবে তাই হবে। আমরা আমাদের সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিয়োগ করবো, তোমার ইচ্ছা পূরণের জন্যে।

ম্যাটি ধীরে ধীরে কথা আরম্ভ করল, আমি স্পষ্ট জানি, আমার হাতে বেশী সময় নাই। তবে আমার ইচ্ছা তিনটা পূরণ হলে; আমি খুব আনন্দিত হবো।

ম্যাটি জানাল, তার প্রথম ইচ্ছার কথা। সে এমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সাথে দেখা করতে চায়। কয়েক বছর আগে, সে এই প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের উপর গবেষণা করেছিল। তার সাথে মিলিত হওয়ার কারণ হিসেবে, একেবারে বড় মানুষের মত বলল, সারা বিশ্বে, বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন। শুধু তাই না, প্রেসিডেন্ট হিসেবে, তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরেও; তৃতীয় বিশ্বে নির্বাচনে ভাঁওতা বাজি বন্ধ আর দারিদ্র দূর করার জন্যে তিনি কাজ করে চলেছেন। তিনি আমার হিরো। তার সাথে মিলিত হতে পারলে আমার জীবন সার্থক হবে।

দ্বিতীয় ইচ্ছা হলো, ওপরাহ ওইনফ্রে (Oprah Winfrey) টেলিভিশন অনুষ্ঠানে যেয়ে নিজের লেখা কিছু কবিতা পড়া। সেই সময়ে ওপরাহ’র টেলিভিশন টক শো, এমেরিকা ও পৃথিবীর আরও কিছু দেশে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। সেই সময়ে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন ছিল যে সমাজ সংস্কারক ওপরাহ’র কথা পছন্দ করতো না।

ম্যাটি কবিতা লিখতো। সে তার লেখা কবিতার নাম দিয়েছিল, ‘হৃদয়-গান’ (Heart-Songs)। এগুলো শুধু লেখা বললে ভুল হবে, আসলে লেখাগুলো ছিল হৃদয় নিংড়ানো অভিব্যক্তি। ম্যাটি বলে চলল, তার তৃতীয় ইচ্ছা ‘হৃদয়-গান’ নিয়ে। সে চায়, এ গুলো বই আকারে আকারে ছাপাতে।

জীবদ্দশায় ম্যাটির ইচ্ছাগুলো পূরণ হয়েছিক কিনা, সেটা আমরা একটু পরে জানবো। তার আগে না হয়, দেখে আসি ম্যাটির কি অসুস্থতা ছিল। এবং এই শিশু বয়সে তার মনে এত ভিন্ন ধরণের ইচ্ছা হওয়ার কারণই বা কি।

শব্দ, ছন্দ, ভাব, আর চিন্তাধারার প্রকাশ কবিতায় হয়। এই সব গুলোর উপর দক্ষতা থাকলেই, ভাল কবিতা লেখা সম্ভব। এক জন তিন বছরের ছেলে কবিতা লিখলে, মানুষের অবাক হওয়ার-ই কথা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ম্যাটি স্টেপানেক তিন বছর বয়সে কবিতা লেখা আরম্ভ করে। তার পরের ১১ বছর সে কয়েক হাজার কবিতা লিখেছিল। সাথে সাথে বেশ কিছু ছোট গল্পও রচনা করেছিল। এমেরিকার লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের জন্য নিজের লেখা একটা সংকলন তৈরি করে। সাহিত্যে অবদানের জন্য বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছিল। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো, ১৯৯৯ সালের মেলিন্ডা এ লরেন্স আন্তর্জাতিক গ্রন্থ পদক (Melinda A. Lawrence International Book Award)।

এই বার ম্যাটির জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে কিছু বলি। ম্যাটি তার মায়ের থেকে একটা খুব শক্ত, জটিল ও দুর্লভ অসুখ নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। অসুখটার নাম হল ডাইসাটোনোমিক মিটাকোনড্রিয়াল মায়ওপ্যাথি (dysautonomic mitochondrial myopathy)। রোগটা মাসকুলার ডিসরফির (muscular dystrophy) এক কঠিন রূপ। যাই হোক বন্ধুরা, তোমাদের এই সব কঠিন সব নাম বলে কনফিউজড করতে চাই না।

আপাতত এত টুকু জেনে রাখলে চলবে, এইটা এক ধরণের জেনেটিক ডিএনএ সমস্যা। এর কারণে বাচ্চাদের শারীরিক বৃদ্ধি কম হয়, মাংসপেশি ঠিক মত কাজ করে না বরং দুর্বল হতে থাকে। তার সাথে যোগ হয় হার্ট, লিভার, কিডনি, শ্বাস সমস্যা। কোন কিছুর জানা ও শেখার বুদ্ধিবৃত্তিক কাজগুলো ব্যাহত হতে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত; এর প্রতিকার বের করতে পারে নি। রোগাক্রান্তদের আয়ু সর্বাধিক ১৩-১৪ বছর। সব চেয়ে বেশী কষ্টের কারণ হলো, এই ছোট জীবনের একটা বড় সময় এই রোগে আক্রান্তদের হাসপাতালে কাটাতে হয়। হাসপাতালে বাইরে থাকলেও, উইল চেয়ার, অক্সিজেন সিলিন্ডার আর নানা ধরণের যন্ত্রপাতি সাথে রাখতে হয়। বুঝতেই পারছো, রোগটা ভীষণ কষ্ট দেয়।

ম্যাটির অন্য তিন ভাই বোন এই রোগেই মারা গিয়েছিল। ম্যাটি নিজেও জানতো তাকে অল্প কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিটা মিনিট যুদ্ধ করতে হতো।; অন্তহীন কষ্ট যেনো চলতেই থাকতো। তার পরেও শরীরের কষ্ট তাকে তার লক্ষ থেকে বিন্দু মাত্র বিচ্যুত করতে পারে নি।

এখন আসো, তোমাদেরকে ম্যাটির লেখা-লেখির সাথে কিছুটা পরিচয় করিয়ে দেই। আমরা অনেকেই, অলসতা করে কাজ ভবিষ্যতের জন্যে ফেলে রাখি। ভাবি, এখন তো মাত্র বর্তমান চলছে, ভবিষ্যৎ আসতে দেরী আছে। কাজটা পরে করলেই হবে। কিন্তু ম্যাটি বলে গেছে, “ভবিষ্যৎ অনেক দূরের মনে হলেও, সেটার কিন্তু আসলে আরম্ভ এখন-ই”।

চোখের সামনে ভাই বোনদের মৃত্যু ছোট ম্যাটির মনকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। ভাই জেমির যখন মারা যায়, তখন ম্যাটির বয়স ৪। মায়ের কষ্ট আর নিজের কষ্টকে হালকা করার জন্যে সে লিখেছিল,

আমি মাকে দিয়েছি I give my mommy

কবরের গুপ্ত ধন’ Buried treasure’

একেবারে পিটার প্যানের ছেলেটার মত Just like the little boy in Peter Pan.

কিন্তু মাকে আমি দিতে পারব না But I can’t give my mommy

কবরের জেমি’ Buried Jamie’.

সে এখন স্বর্গে He is in the Heaven

সেটা হলো এই মাটির গর্ত That is the hole in the ground,

গুপ্তধনের মতো Like a treasure

ম্যাটির চিন্তা, ভাবনা ও দর্শন সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। তার পরিবার ও তার নিজের অতুলনীয় দুঃখ আর কষ্ট ছিল ঠিকই। কিন্তু ম্যাটি এ জন্যে পিছিয়ে পরার মানুষ ছিল না। তার ভাষায়, “বেদনার বিষয় হয়; এবং হবে। কিন্তু সে জন্যে সব সময়ে দুঃখ নিয়ে থাকার দরকার নাই”।

অনেকে আছেন, কষ্টে থাকলে সৃষ্টি কর্তাকে কিংবা নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন। তবে আমাদের এই ক্ষুদে কবি ও দার্শনিক লিখে গেছে, “আমি কখনো ঈশ্বরকে প্রশ্ন করি না। অবশ্য কিছু সময়ে বলি, কেন আমি? কেন আমার এতো কষ্টকর জীবন? কেন আমার এই অসুখ? কেন আমার ভাই বোনেরা মারা গেল? কিন্তু পরে আমি ভাবি আর বলি, আমি না কেন? (why not me?)”।

খারাপ সময় সম্পর্কে ম্যাচটির একটা উদ্ধৃতি, তার লড়াকু, শক্তিশালী মন সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা দেয়। ম্যাটির কথায়, “আমাদের সবার জীবনে ঝড় আসে। এক সময়ে আমরা কঠিন সময় থেকে বের হয়ে আসি। আমাদের তখন উদযাপন (celebrate) করা উচিত। সমস্যা যত-ই কঠিন হউক না কেন, তার থেকে অবশ্যই সুন্দর কিছু আমারা খুঁজে পেতে পারি।”

বিশ্ব জুড়ে মানুষের দুর্দশা ছোট কবিকে খুব ভাবিয়ে তুলতো। মানুষের একতা ও বিশ্ব শান্তি তার একান্ত কাম্য ছিল। ম্যাটি লিখে গেছে, “একতা হল শক্তি... যখন দল আর সহযোগিতা তৈরি হয়, চমৎকার জিনিসগুলো তখন পাওয়া যায়।” যুদ্ধ তার একেবারে ঘৃণার বিষয় ছিল। তার মতে, “যুদ্ধ হওয়া উচিত মানুষের কথায়; বোমা কিংবা অস্ত্র দিয়ে না।” আমরা সবাই জানি, মানুষ অযৌক্তিকভাবে এবং মাথা যথেষ্ট না খাঁটিয়েই যুদ্ধ আরম্ভ করে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে বুদ্ধিমান করে তৈরি করেছেন; তারা কি-না যুদ্ধ করে নিজেদের ধ্বংস করছে; বিষয়টা কিন্তু একেবারে মিলে না।

ম্যাটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছে, “আমরা বর্তমানে বাস করলে, আমাদের অবশ্যই প্রাত্যহিক জীবনকে উদযাপন করতে হবে। আজকের প্রতিটা কাজ ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে”।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর-পরই ওপরাহ উইনফ্রে, বিশেষ এম্বুলেন্স প্লেন পাঠিয়ে ম্যাটিকে শিকাগোতে নিয়ে আসলেন। তার টিভি প্রোগ্রাম শিকাগো থেকে করা হতো। সারা বিশ্ব জানলো, ম্যাটি স্টেপানেকের কথা। জানলো তার এবং তার পরিবারের জটিল অসুখের কথা। পরিচিত হলো ম্যাটির অসাধারণ সব গুণাবলির সাথে। অনুষ্ঠানটা প্রচার হওয়ার মাত্র কিছু দিন আগে, সন্ত্রাসীরা নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে আক্রমণ করে হাজার তিনেক মানুষ হত্যা করেছিল। সবাই ম্যাটির সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে বলল, আমরা শান্তি চাই। আমারা যুদ্ধ চাই না। আমারা মানুষ হত্যা চাই না। সেই কঠিন দিনগুলোতে মানুষ একটা আশার আলো দেখতে চেয়েছিল, এবং ছোট ম্যাটি সেই কাজটাই সুচারুভাবে করেছিল।

ওপরাহ ম্যাটির জন্যে বিশেষ একটা বাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে তার প্রতিদিনের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করা হলো। ম্যাটি আর তার মা সেই বাসে করে এমেরিকার বিভিন্ন শহরে যেয়ে, শান্তির পক্ষে বক্তব্য দিয়ে বেড়াল। মাসকুলার ডিসরোপি নিয়ে মানুষের সচেতনতা স্মৃতি করে গবেষণার জন্যে তহবিল সংগ্রহ করল। মানুষকে আশার কথা শোনাল। জীবনকে সুন্দর করার জন্যে উৎসাহ দিলো।

এই দিকে পৃথিবীর অনেক নামি দামী মানুষ ম্যাটির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেল। জিমি কার্টারের কথা আগেই বলেছি। তিনি ম্যাটির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আরম্ভ করলেন। নিজে এসে স্ব- শরীরে ম্যাটির সাথে দেখা করা আরম্ভ করলেন। তা ছাড়া ফোনে ও ইমেলে পৃথিবীর কঠিন সব সমস্যা আর তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করলেন। ওপরাহ ম্যাটির খোঁজ-খবর সব সময়ে নিতেন। আরেক প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ম্যাটির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন। সেই সময়কার বড় বড় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা তার সাথে দেখা করার জন্যে ছুটে আসলেন। হ্যারি পটার খ্যাত ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফ লন্ডন থেকে ম্যাটির সাথে দেখা করতে চলে এলেন।

স্থানীয় এক প্রকাশক ম্যাটির লেখা দেখে আগ্রহী হয়ে তার প্রথম বইটা ছাপায়। পরে অন্য প্রকাশকেরাও উৎসাহী হয়ে এগিয়ে আসে। ম্যাটির সব মিলিয়ে সাতটা বই প্রকাশিত হয়েছিল। ছয়টা ছিল তার লেখা ‘হৃদয়-গান’ কবিতার বই। আর একটা গদ্য বই; যার নাম ছিল, ‘শুধু শান্তি’ (Just Peace)। গদ্য বইটাতে ম্যাটি ও প্রেসিডেন্ট কার্টার শান্তি বিষয়ক যে সব ইমেল আদান-প্রদান করেছিল, সে গুলো স্থান পেয়েছিল। প্রত্যেকটা বই নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার হয়েছিল। আর ছুঁয়ে দিয়েছিল লক্ষ্য কোটি হৃদয়।

শেষে ম্যাটির আরেকটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি, “ডাক্তাররা বলেছিল, ও এক সপ্তাহ টিকবে না। কিন্তু আমি টিকেছি। তার পরে ডাক্তাররা বলেছিল, কোন অবস্থাতে এই ছেলে এক মাস বাঁচবে না। আমি তাও বেঁচেছি। এইভাবে ২, ৫ বছরের কথাও বলেছিল। কিন্তু তাদের সব কথা ভুল প্রমাণ করে, আজ আমি টিন এজার হয়েছি”।

২০০৪ সালের ২২ শে জুন ম্যাটির মৃত্যু হয়। প্রেসিডেন্ট কার্টার শেষ কৃত্য অনুষ্ঠানে, মৃত দেহের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমি ও আমার স্ত্রী; জীবনে বহু প্রেসিডেন্ট, প্রধান মন্ত্রী, রাজা, রাণীর সাথে মিশেছি, কিন্তু ম্যাটির থেকে অনন্য সাধারণ মানুষ আমারা পাই নি। ওপরাহ’র বললেন, ম্যাটি আমাদের সময়কার নবী (prophet)। শোকগ্রস্ত সবাই স্বীকার করলেন; এক শিশু-কিশোর কবি, বিশ্ব প্রেমিক, দার্শনিকের মৃত্যু হলেও, সে রেখে গেল, অসামান্য এক কর্ম জীবন, যা যুগ যুগ ধরে বিশ্ববাসীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে।

ম্যারিল্যাণ্ডের রকভিল শহরে ম্যাটির স্মরণে শান্তির বাগান (Peace Garden) নামে এক পার্ক বানানো হয়েছে। পৃথিবীর ২০ টা দেশ পার্ক তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। সেখানে ম্যাটি আর তার শেষ সময়কার সাহায্যকারী বন্ধু মিকাহ (বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর)’র মূর্তি আছে। সেখানকার দেয়ালে লেখা আছে ম্যাটির রচনা থেকে নেয়া সব উদ্ধৃতি। ম্যাটির গলার আওয়াজ শোনার ব্যবস্থাও আছে।

বন্ধুরা সুযোগ পেলে, তোমরা কিন্তু সেখানে যেও একবার।

শেষে না হয়, ম্যাটি স্টেপানেকের আরেকটা শান্তির বাণী শুনি:

Peace grows when we are no longer afraid,

আমরা আতঙ্কিত না থাকলে শান্তি ছড়ায়

nor angry, nor hating, nor the cause of any suffering.

ক্রোধ না, ঘৃণা না, দুর্ভোগের কোন কারণ না।

Peace grows when we are united in hope”.

আমরা একতাবদ্ধ হলেই শান্তি ছড়ায় ।

অক্টোবর ৭, ২০১৫

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক