অনামিকা

কিউবিকাল শব্দটার সাথে বাঙালিরা কম বেশী এখন পরিচিত। এক সময়ে অফিসের হর্তাকর্তারা ছাড়া অফিসের সবাই হল ঘরে এই দিক ওই দিক মুখ করে বসত। ইদানীং ম্যানেজমেন্ট কর্মচারীদের কিছুটা প্রাইভেসি দেয়ার চেষ্টা করছে। ডেস্কের তিন দিক দিয়ে ঘিরে দেয়া হয় হার্ড বোর্ড কিংবা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে। এতে কর্ম দক্ষতা বাড়ছে কি-না সেটা বলা মুশকিল। তবে, অফিসে যারা কাজ করে; তাদের সবারই প্রাইভেসি সম্পন্ন নির্দিষ্ট বসার জায়গায় হয়েছে। বাড়িতে যেমন ঘুমানোর জন্যে নিজস্ব বিছানা থাকে, সে রকম কাজ করার জন্যে তিন দিক দিয়ে ঘেরা টেবিল, চেয়ার, কম্পিউটার দেয়া নির্দিষ্ট জায়গা আছে। এরই বাহারি নাম কিউবিকাল।

কিউবিকালগুলো বাইরের থেকে দেখতে মোটামুটি একই রকম হয়। ভিতরটা আবার কর্মচারীরা নিজেদের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী সাজিয়ে রাখে। কারো কিউবিকালের ডেস্কে গাদা গাদা ফাইল দেখা যায়, আর কেউবা ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। তবে একটা বিষয় বেশ সাধারণ। বেশীর ভাগ কিউবিকালে বাসিন্দারা প্রিয়জনের ছবি রেখে সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। রোমান্টিকরা প্রিয়জনের সাথে নিজের কোন ছবি সুন্দর করে ফ্রেম বন্দি করে ডেস্কের উপরে রাখে, নয়তো কিউবিকালের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়।

ও আরেকটা ব্যাপার বলা হয় নি। কিউবিকালের বাইরে ছোট একটা ফ্রেমের মধ্যে কর্মচারীর নাম আর পদবি দেয়া থাকে। আরএন ফিনান্সিয়েলের অফিসের দোতলায় উত্তর দিকে কোণায় এক কিউবিকালে নেম প্লেটে লেখা আলমা আবালোস। পরের লাইনে পদবি লেখা, ডেভালোপার । ভিতরটা খুবই পরিপাটি করে সাজানো। ফাইল, ফুল, ছবি সবই আছে। দেখলেই বুঝা যায়, সাজানোর মধ্যে একটা শিল্প সম্মত ভাব। কোণায় এক তোড়া টকটকে লাল গোলাপ ফুল। ঠিক ফুল গুলোর সামনে, এক ফটো ফ্রেমে আলমার ছবি। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, একটা মানুষকে বুঝি লাল গোলাপগুলো ঘিরে রেখেছে।

ছবিতে আলমা বিয়ের সাদা গাউন পরে বসা। কানে, গলায়, হাতের আঙ্গুলে বিভিন্ন ধরণের অলংকার। বাম হাতের অনামিকায় বড় একটা হীরার আংটি। দেখলেই বুঝা যায়, অনেক দামী। এ রকম ছবিগুলোতে সাধারানত বউ চেয়ারে বসে, বর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আলমার বেলায় একটু অন্য রকম। সাজ গোজ বউদের মতই। চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসে, মুখে হাসি হাসি ভাব প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান দিয়ে কাজটা করানো হয়েছে, সেটা বুঝা যায়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আলমার হাতে চক চকে লাল রঙের ছোট একটা বাক্স। সাদা পোশাক, মানানসই সাজের পাশে লাল রঙের একটা বাক্স চোখে কেমন একটা ধাক্কা দেয়।

আলমা প্রতিদিন বিভিন্ন পোশাক, সাজে অফিসে আসলেও; বিয়ের আংটিটা বাম হাতের অনামিকায় ঠিকই থাকে।

ঢাকা শহরের কলাবাগান এলাকা। ৫৬ নম্বর সড়কের ১২৭ নম্বর বাসায় খুব ব্যস্ততা চলছে। এক সপ্তাহ আগে শুভ এসেছে এমেরিকা থেকে। চার সপ্তাহের জন্যে। ফিরে যেয়েই আরম্ভ করবে নতুন চাকরি। কাজে ঢোকার আগেই তো ছুটির এপ্লিকেশান করা যায় না। তা ছাড়া বাঙালি মানুষ এমেরিকার কোম্পানিতে কাজ করবে; ইমিগ্রেশানের আইন কানুনের বিষয়-আষয় আছে। বাড়ির সবাই ব্যাপারটা নিয়ে পুরো ওয়াকেবহাল। এই সীমিত সময়ের মধ্যে সব শেষ করে শুভকে এমেরিকায় ফেরত পাঠাতে হবে।

শুভ’র বাবা মারা গেছেন বছর দু য়েক আগে। তখন বাবাকে শেষ বারের দেখতে যাওয়া হয় নি। হাজার ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিল না। পুরোদমে ক্লাস চলছিল। সাথে খরচের একটা ব্যাপার ছিল। শুভ দূর থেকে মন খারাপ করেছে, কেঁদেছে। মায়ের পাশে যেয়ে সান্ত্বনা দেয়া হয় নি। মাও বুঝতে পেরেছিলেন সন্তানের অপারগতা। তিনি মন শক্ত করে বললেন, না বাবা তোমার এখন আসার দরকার নাই। যার যাওয়ার কথা, তিনি তো চলেই গেছেন। তোমার পড়া লেখা শেষে হলেই উনি ওই জগত থেকে খুশি হবেন।

সেই আসা এত দিন পরে হল। এর মধ্যে ছোট বোন এলিনার বিয়ে হয়েছে। ভাল লাগার মানুষ ছিল। শুভ চাচ্ছিল এলিনা প্রথমে অধ্যায়ন শেষ করুক। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিল, মাস্টার্স শেষ করার পর বিয়ে করলে শুভ'র বেশী ভাল লাগত। কিন্তু সব মিলিয়ে শুভ জোর করে নিজের মতামত জানাতে পারল না। মা বিয়ের পক্ষেই মত দিলেন, বাসায় কোন পুরুষ মানুষ নাই। পাড়ার ছেলেরা বিরক্ত করে।

যাই হোক, মায়ের শেষ বড় দায়িত্ব এখনো বাকী; একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দেয়া। প্রায় বছর খানেক ধরে তিনি মেয়ে বাছাই, পছন্দের কাজটা একনিষ্ঠভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য প্রজেক্টে নামার আগে, ছেলের অনুমতি নিয়ে নিয়েছেন। মেয়ে দেখে ভাল লাগলে, ছবি পাঠাতেন ছেলের কাছে। ছেলে সায় দিলে, তার পরে আরম্ভ হত নানা ধরণের অনুসন্ধান। একেবারে প্রাইভেট ডিটেকটিভদের মত। এ ভাবে খুঁজতে খুঁজতে, অবশেষে মা-ছেলের মনের মত এক জন মেয়ে পাওয়া গেল।

সেই মেয়ের সাথেই শুভ’র বিয়ে হতে যাচ্ছে।

বাঙালিদের ভূগোলে মেলা জ্ঞান। উন্নত দেশগুলোর মানুষগুলোকে নিঃসন্দেহে তাক লাগিয়ে দিতে পারবে। কোন দেশ কোথায়, সেখানকার রাজধানী কিংবা বড় শহরের কি নাম-- বেশীর ভাগ মানুষেরই জানা। ম্যানিলা শহর কোথায় জানতে চাইলে, নিমিষে উত্তর পাওয়া যাবে, কেন ফিলিপাইনের রাজধানী হল ম্যানিলা। এর বেশী বলা অনেকের জন্যে একটু কষ্টকর হবে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, হংকং সম্পর্কে আমাদের ধারণা বেশ ভাল। নিজে না হলেও পরিচিত কেউ হয়ত ওখান থেকে ঘুরে এসেছে।

ওই দিক কার একটা বড় শহর হলেও, বাঙালিদের ম্যানিলার সাথে যোগাযোগ তেমন নাই। সেখানকার জীবন যাত্রা অজানাই বলা যায়। কিন্তু ঢাকার সাথে ম্যানিলার অনেক দিক থেকে মিল । প্রচুর মানুষের বস বাস। রাজনীতি সম্পর্কে যেমন আগ্রহ, তেমনই রাজনীতিবাজদের দুর্নীতি একেবারে পাহাড়ের সমান। অনেকের হয়ত এক সময়কার ফিলিপাইনের ফাস্ট লেডি ইমেলদার মারকোসের কথা মনে আছে। স্বামীর নামে সীমাহীন ক্ষমতার অপব্যাবহার কথা জানেন। এই মহিলার জুতার সংখ্যা এত ছিল যে, তা রাখার জন্যে পুরো এক প্রাসাদের দরকার হত। আর অন্য জিনিসপত্রের কথা না হয়, নাই বললাম। প্রশাসনের মাথায় এমন ঘাপলা থাকলে, নীচের দিকে কেমন হতে পারে; বাঙালি মাত্রই তা ভাল করে জানে।

ম্যানিলা শহরের চারিদিকটা কিন্তু ছবির মত। শত দ্বীপের দেশ ফিলিপাইন। দেশটার রাজধানী ম্যানিলা শহর এক উপসাগরের মাঝের দ্বীপ। মজার ব্যাপার হল, উপ সাগরের নামও আবার ম্যানিলা বে। আমাদের দেশের সাথে যেমন বঙ্গোপসাগরের নাম মিলে গেছে, অনেকটা সে রকম। প্রচুর গাছ পালা, ঝক ঝকে আকাশ, চারিদিকে গাঢ় নীল পানি, আর মানুষের কোলাহল যে কারোরই মন কেড়ে নেবার জন্যে যথেষ্ট। বাঙালিদের মত ফিলিপিনোরাও ভালোবাসে গল্প করতে আর আড্ডা দিতে। আর বেশী আড্ডা দিলে যা হয়, রাজনীতি নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে থাকে। ফলে এক দিকে বন্ধু যেমন বাড়ে, তার সাথে সাথে নতুন শত্রুও যোগ হয়।

দেশটার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব সখ্যতা। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জাপানের হাত থেকে দেশটাকে মার্কিন সৈন্যরাই মুক্ত করেছিল। সামরিক ঘাটিও সেই তখন থেকেই এখানে আছে। ফলে দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগ অনেক গভীর। এদের মধ্যে বিবাহ হয়েছে প্রচুর। এমেরিকানরা যেমন ফিলিপাইনে আছে, তেমনি এমেরিকায় ফিলিপিনোদের সংখ্যাও নেহায়েত কম না। চাইলে অনেক সহজেই ফিলিপিনোরা সহজেই আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে চলে আসতে পারে Land of Opportunity এমেরিকায়।

সেই দেশের একটা মিষ্টি সুন্দর মেয়ের নাম আলমা রোবোলাস।

“এই কিছু উড়ে যেতে দেখলে?"

"কই না তো।”

"পাখী কিংবা ওই জাতীয় কিছু’র ডানা ঝাঁপটে উড়ে যাবার শব্দ? ”

আলমা দুটো কম্পিউটার মনিটরের ডান দিকেরটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছিল। পাশা-পাশি বড় দুটো কম্পিউটার মনিটর। কিউবিকালের ভিতর দিকটা হচ্ছে ডান দিক। অফিসের কাজের জটিল কোন সমস্যা হয়তো মাথার মধ্যে খেলে যাচ্ছিল। কাজটা শেষ না করে অন্য কিছু নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। কাজটা একেবারে শেষের দিকে। এখন মাথাটা অন্য দিকে দিলে, পরে আবার কাজটা প্রথম থেকে আরম্ভ করতে হবে।

কিন্তু শুভ’র থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিলের ব্যাপার। কি রকম একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব। সারাক্ষণ মুখে হাসি আর ঠোটের মাথায় অদ্ভুত সব কথা; যেন একেবারে তৈরি থাকে। সেই আলমার কিউবিকালের বাইরে দাঁড়িয়ে উড়ে যাওয়া নিয়ে কি সব বলছে। আলমা ‘কই না তো’ বলে চেষ্টা করছিল, যাতে শুভ এখন অন্য দিকে চলে যায়। কাজটা শেষ করে না হয়, শুভ’র সাথে কিছু কথাবার্তা আর রসিকতা করে আসা যাবে। অবশ্য আলমা ভাল করেই জানে, শুভ নাছোড়বান্দা টাইপের মানুষ। ও যখন এসেছে, তখন তাকে পুরো মনোযোগ না দিয়ে কোন উপায় নাই। না হলে, আবার কি বলে বসে!

আলমা অনেকটা বাধ্য হয়ে মনিটর থেকে চোখ উঠিয়ে শুভ’র দিকের তাকালো, কি উড়বে আর কিসের শব্দ নিয়ে কথা বলছো? আমার এই কাজটা শেষ করে না হয়, আমি তোমার কাছে আসি। ও না। এক ঘণ্টা পরে একটা মিটিং আসে, সেটা সেরে তার পরে আসছি।

শুভ ভাল করেই বুঝলো আলমা তাকে এখন এভয়েড করতে চাচ্ছে। কিন্তু এতে খুব একটা উপকার হল না। শুভ অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে লাগল, এই যে দূর প্রাচ্যের সুন্দরী; তোমাকে অনেক অনেক অভিনন্দন। তোমার “বেটা অপারেশনের প্রজেক্ট” সিলেক্টেড হয়েছে। তোমার জন্যে নগদ দু হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার। আমি ইমেল দেখে ছুটে আসলাম; নিজের মুখে খবরটা দেবার জন্যে। উড়ার বিষয়টা হল, তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা পাখীর মত উড়ে আরও অনেক উপরে উঠে গেল। আর শব্দের ব্যাপারটা হলঃ মেয়েরা কি আর নীরবে কিছু করতে পারে। তোমার খ্যাতি যখন উপরের দিকে উড়ছিল, তখন পাখী ডানা ঝাঁপা দেবার শব্দ হওয়ার কথা না?

শুভ বিসনেস ইনটিলিজেন্সের ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার। আলমা আইটি’র ডেভালাপার । দু জনে এক সাথে একটা প্রজেক্টে কাজ করেছিল। অফিস লোকেশান কোন কারণে যদি ব্যাবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে, তখন কাজ সচল রাখার বিকল্প ব্যবস্থা বের করা নিয়ে প্রজেক্টটা ছিল। তারই নাম “বেটা অপারেশান প্রজেক্ট”। শুভ ছিল টিম লিড, আলমা ছাড়াও অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট থেকে ছয় জন ছিল। এই প্রজেক্টের কারণে কোম্পানির সিস্টেম ডাউন হলেও, কোম্পানির হাতে বিকল্প উপায় থাকবে। মেলা ক্ষতির থেকে রক্ষা পাবে। গত শীতে কয়েকটা শহরে প্রচণ্ড তুষার পাতের কারণে বেশ কিছু অফিস বন্ধ রাখতে হয়েছিল। কোম্পানি চাচ্ছিল, এ রকম অবস্থায় কাজ যাতে আটকে না পড়ে। টিম লিড হিসেবে শুভ হয়ত সবার আগে খবর পেয়েছে। বোর্ড অফ ডিরেক্টর নিশ্চয়ই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে। প্রায় ছয় মাস ধরে প্রচুর খাঁটা খাটুনি করেছিল তারা এই কাজে। কোন কোন দিন এক টানা আঠারো ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে।

মুহূর্তেই আলমার মন খুশীতে ভরে উঠলো। চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে, শুভ’র সাথে হাই ফাইভ করলো। শুভ বলে চলল, তোমাকে আর মিটিঙে যেতে হবে না। আমি তোমার ম্যানেজারকে বলে এসেছি, তুমি মিটিঙে থাকতে পারছো না; তুমি আমাদের সাথে এখন লাঞ্চে যাচ্ছ। বাকী টিম মেম্বারদের আমি লবিতে জড় হতে বলেছি। সেখান থেকে আমরা এক সাথে রেস্টুরেন্টে যাব।

দূর প্রাচ্যের সুন্দরী কম্পিউটার লক করে, শুভ’ র সাথে রওয়ানা দিল।

আলমা রোবোলসকে নিয়ে অফিসে কথা-বার্তা হয়। সে অফিসে আসে সবার আগেই। কাজে-কর্মে সবার থেকে বেশী সিরিয়াস। অন্যরা রসিকতা করে তাকে ডাকে 'মিস সিরিয়াস’ বলে ডাকে। সবার সাথে মুচকি করে হাসলেও, বেশীক্ষণ কারোর সাথে সে কথাবার্তা চালায় না। অবশ্য অফিসের কাজে পুরো ভিন্ন বিষয়। একে বারে সরব মানুষ। আইডিয়া, সমস্যা প্রকাশে কোন দ্বিধা নাই। সহ কর্মীরা ভেবে পায় না, একটা মানুষ এ রকম হয় কি করে? কাজ ছাড়া আর কিছু বুঝে না।

বাঙালি ছেলে শুভ আবার অন্য রকম। সারাক্ষণ হৈ চৈ। আনন্দ করতে খুব ভালোবাসে। পুরো অফিসকে মাতিয়ে রাখে। ওর মজার কথা ছাড়া মিটিং যেন নিরস মনে হয়। শুভ'র সাথে কাজ করতে সবারই মহা উৎসাহ। কিন্তু এক ডিপার্টমেন্টে তো আর সবাই কাজ করতে পারে না। তার পরেও কোন যৌথ ডিপার্টমেন্টে প্রজেক্টে শুভ থাকলে কোন কথাই নাই। আড্ডা, আনন্দের সাথে সাথে শুভ ঠিকই কাজ বের করে সবাইকে চমক লাগিয়ে দেয়। আপার ম্যানেজমেণ্টের তাই জটিল, বড়, জরুরী প্রজেক্টগুলো শুভকে দিতে বেশী আগ্রহী থাকে।

আলমা শুভ'র সাথে আগেও কাজ করেছে। অন্য কলিগদের সাথে কাজ ছাড়া অন্য কথা না বললেও, শুভ'র সাথে বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বলে। ব্যাপারটা অন্যরাও খেয়াল করেছে। কিছুটা কানাঘুষা যে চলে না, তা কিন্তু বলা যাবে না।

আলমার বাম হাতের অনামিকায় বিয়ের আংটি না থাকলে হয়ত আরও অনেক কথা হত।

তবে দু জনের এক দিক থেকে বেশ মিল আছে। এটা সেটা নিয়ে কথা বললেও, কেউ কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনো কথা বলে না। আলমার স্বামীকে কেউ দেখে নি, আর শুভ বিবাহিত না অবিবাহিত তাই কেউ জানে না। কোম্পানির অনুষ্ঠানে স্বামী-স্ত্রী আমন্ত্রণ থাকলে, দু জনেই কিন্তু একাই আসে। কেউ জানতে চাইলে, মিষ্টি হেসে অন্য দিকে কথা ঘুরিয়ে নেয়।

এমনকি শুভ কোন মেয়ের ব্যাপারে বাড়তি কোন আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানা যায় না।

শুভ'র বোন এলিনা গো ধরল, হাতে সময় কম থাকলেও বিয়ের কোন আনুষ্ঠানিকতা বাদ দেয়া যাবে না। প্রথমে এনগেজমেণ্ট মানে পান-চিনি, তার পরে মেয়ে-ছেলের হায়ে হলুদ, শেষে ঘটা করে বিয়ে; বাড়ির একমাত্র ছেলে বলে কথা। মাও আপত্তি করলেন না। বাড়িতে কত দিন আনন্দ হয় না। একটু হৈ চৈ হলে ক্ষতি কি। ওপার থেকে শুভ-এলিনা'র বাবা নিশ্চয়ই স্বস্তি পাবেন।

কন্যার নাম ঝুমু। বাড়ি সেই নারায়ণগঞ্জের চাষারা এলাকায়। ঠিক হল শুক্রবার সন্ধ্যায় ছেলে পক্ষের বারো জন যাবে মেয়ের বাড়িতে। ছেলের মা তার ভবিষ্যতের পুত্র বধূকে নিজের হাতে আংটি পরিয়ে আসবেন। পরের বুধবার গায়ে হলুদ, তবে সেটা হবে কিছুটা অন্য রকম। সময়ের স্বল্পতার জন্যে ছেলে-মেয়ের গাঁয়ে হলুদ এক সাথে হবে। অবশ্য এ রকম ইদানীং হরদম হচ্ছে। এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে বিয়ের মুল অনুষ্ঠান ঢাকার সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে। ঠিক পরের দিনই বর-বউ যাবে কক্সবাজারে তিন দিনের হানিমুনে। এলিনা একটু ঠাট্টা করে ভাইকে বলে আসলো, একেবারে কঠিন প্ল্যানিং করে দিলাম। কোন কিছু-ই বাদ দেয়া হয় নি। হানিমুন পর্যন্ত আছে জনাব।

শুভ তেড়ে আসলো বোনের দিকে, তবে রে বড় ভাইয়ের সাথে ফাইজলামো। আগে বিয়ে করেছিস বলে কি ভাবছিস, বয়স, তোর লাফ দিয়ে আমার থেকে বেশী হয়ে গেছে!

মুরুব্বি বলতে ফজলু মামা। মায়ের বড় ভাই। ছোট বোনকে খুব স্নেহ করতেন। ভগ্নি-পতি মারা যাবার পর থেকে পরিবারটার সব কিছুতেই আছেন। সাহায্য, উপদেশ সব ব্যাপারেই শুভ'র মা জাহানারা, বড় ভাইয়ের উপর ভরসা করেন। কাছাকাছি বাসা। ষাটোর্ধ বয়স। ওকালতি করে মোটামুটি আছেন।

এনগেজমেণ্ট মানে আংটি পরানোর অনুষ্ঠানে যাবার জন্যে দুটি গাড়ির ব্যবস্থা করা হল। মামার লাল টয়োটা-করোনা কার, আর ভাড়া করা একটা মিনি বাস। মামা আর তার বোন যাবেন টয়োটাতে আর বাকীরা মিনি বাসে। আয়োজনে সবাই খুশী; মুরুব্বিরা আলাদা থাকলে মিনিবাসে ইচ্ছামত আনন্দ করতে সুবিধা হবে। গান বাজিয়ে একটু নাচানাচি আর হাসি-ঠাট্টা করতে করতে যাওয়া আর কি।

হাসা-হাসি আর এক লক্ষ কথা না হলে, না-কি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণ হয় না!

ক্যাথোলিক খৃস্ট ধর্ম অবলম্বীদের দেশ ফিলিপাইন। ধর্ম নিয়ে বেশ গোঁড়া। ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে না চললে, মানুষরা বাঁকা চোখে দেখে। বাবা বেশ খরচ পত্র করে আলমার এমেরিকা যাবার আয়োজন সম্পন্ন করলেন। তার ছোট ভাই দেশ ছেড়ে চলে গেছে, আজ প্রায় বছর পনের হল। প্রথম প্রথম বড় ভাইকে চলে আসার জন্যে পীড়াপীড়ি করতো। কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশ যেতে আলমার বাবার মন একেবারে সায় দেয় নি।

কিন্তু বললেন, আলমার জন্যে ব্যবস্থা করতে। এর এখানে ইউনিভার্সিটি গ্রাজুয়েশান হয়ে গেলে, সে যাতে আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিতে পারে। ছোট ভাই মানে আলমার চাচা সে হিসেবেই গুছিয়ে রাখলেন। এই দিকে আলমা পড়ালেখায় কৃতিত্ব দেখাতে থাকলো। যে কোন পরীক্ষায় তার স্থান সবার উপরে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তার রেসাল্ট নিয়ে রীতিমত পত্রিকায় লেখালেখি হল। পুরো দেশের মধ্যে আলমার স্থান শীর্ষে। এর আগে, পুরো দেশের মধ্যে এত ভাল রেসাল্ট কোন মেয়ে করতে পারে নি।

একেবারে ১০০% স্কলারশিপ নিয়ে আলমা ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানিলা'র আইটি প্রোগ্রামে ভর্তি হল। সেখানেও জয় জয়াকার। সুন্দরী মেয়ে, পড়ালেখায় সবার উপরে। অনেক ছেলেই মহা উৎসাহী হয়ে আলমার মন গলানোর চেষ্টা করতে লাগল। এর মধ্যে যেমন ছিল সহপাঠিরা, তেমন ছিল উপরের ক্লাসের ছেলেরা। অল্প বয়সের লেকচারেরাও এই কাজে পিছিয়ে থাকল না।

কিন্তু আলমা কারোর-ই প্রেমে আহবানে সাড়া দিবে না বলে ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু, মানুষ যা ভাবে, তা কি আর সব সময়ে হয়? আলমা এক দিন আবিষ্কার করল, তার মন, শরীরও কোন ছেলের সঙ্গ চায়। অবাক হল, মাত্র কয়েক দিন আগেই না সে ভাবত, ছেলের আবার কিসের দরকার। ভালই তো ছিল, কিছু দিন পরে এমেরিকা যাবার প্ল্যান। সেখানে যেয়ে মাস্টার্স করবে। আইটিতে মাস্টার্স থাকলে ভাল চাকরি পেতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।

প্রোগ্রামিং ক্লাসে লেকচারার মাত্র এই বছর জয়েন্ট করেছে। অন্য ফিলিপিনোদের থেকে লম্বাই বলা যায়। ব্যায়াম করা শক্ত শরীর। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে প্রচুর ভক্ত বানিয়ে ফেলেছে। ক্লাসে যখন লেকচার আরম্ভে করে, মনেই হয় না পড়াচ্ছে। বরং সবাই মন্ত্র মুগ্ধের মত মনে হয় গল্প শুনে যাচ্ছে। প্রোগ্রামিঙের মত নিরস বিষয় যে এত সুন্দর করে বুঝানো যেতে পারে, তা সবার কল্পনার বাইরে ছিল।

মেয়েদের মধ্যে এর মধ্যে অঘোষিত প্রতিযোগিতা হয়েছে, কে লেকচারার লি ওয়ানের বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে পারে। ক্লাসে এক দিন লেকচারার সাহেব জানতে চাইলো, কারোর কাছে কি একটা এক্সট্রা কলম হবে। সাথে দেখা গেল, ক্লাসের চার জন মেয়ে হাতে কলম নিয়ে তার দিকে ছুঠে এলো। প্রোগ্রামিং ক্লাসে মেয়েদের সাজ, গোঁজ, মিষ্টি হাসি দিনে দিনে বাড়তেই থাকলো। লেকচারার সাহেবের ব্যাকগ্রাইউণ্ড গবেষণা করে বের করে ফেলা হয়েছে। প্রতিটা পরীক্ষায় ফার্স্ট, মাত্র এমেরিকার এমআইটি থেকে পিএইচডি করে ফিরে এসেছে। পরিবারে এক মাত্র মা আছেন। এমেরিকায় বেশ অনেকগুলো অফার ছিল। কিন্তু মা আর দেশের মায়া তার কাছে সব চেয়ে বড়। সেই জন্যে ফিরে এসেছে।

আলমা পুরো বিষয়টা নিয়ে একেবারে মাথা ঘামাতে চায় নি। এক সাবজেক্টের এক টিচারকে নিয়ে এত বেশী কথা বলার কি থাকতে পারে? কিন্তু না বিষয়টা নিয়ে, মাথাটা এমনিতেই নিজের থেকে ঘামতে থাকলো। একটা পুরুষ মানুষ এত স্মার্ট হয় কি করে? যেমন দেখতে, তেমন কথা বার্তায়-বার্তায়। পৌরুষ যেন ছিটকে বের হচ্ছে। তার পরে আবার সব মেয়েই যেন জন্যে পাগল। কিন্তু লেলচারার সাহেব নিজেকেই নিয়ে ব্যস্ত। অন্য কারো বিশেষ করে মেয়েদের দিকে কোন আগ্রহই দেখায় না। লোকটার কি আসলে গর্ব বেশী?

কি যে হল আলমার। লি ওয়ানকে মুহূর্তের জন্যেও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলো না। ক্লাসে লি ওয়ান, বাসায় লি ওয়ান। কি সমস্যা রাতে ঘুমালেও সেই একই মানুষ। কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, রুচি হয় না। কি যে যাদু করলো লোকটা। এ রকম তো আগে হয় নি কখনো।

বেশ কয়েক দিন ভোগার পর, এক বান্ধবী সাথে শেয়ার করলো ব্যাপারটা। সে তো সাথে হৈ হৈ করে উঠলো, আরে আরে তুই তো প্রেমে পড়েছিস। কিন্তু আলমা না ঠিক করেছিল, সে প্রেমে পড়বে না।আগে নিজের ক্যারিয়ার গোছাবে।

তাও আবার এক পক্ষীয় প্রেম। তাকে এখন অন্য পক্ষকে রাজী করাতেই হবে। সেই বা কম কি-সে?

তার পরেও মনে ভয় থাকলো, লি ওয়ান যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে?

নারায়ণগঞ্জ শহর বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে এক বিশেষ স্থান নিয়ে আছে। দেশের সব চেয়ে বড় রাজনৈতিক দলটার জন্মের সুত্রাপাত সেখানে হয়েছিল বলে অনেকে দাবী করেন। এক সময়ে ব্যাবসা-বাণিজ্যে এতই উন্নত হয়েছিল, যে নারায়ণগঞ্জকে বলা হত প্রাচ্যের ডান্ডি। পাট কল, সুতা কল থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ধরণের কারখানা এখানে হয়েছিল। কাজের আশায় সারা বাংলাদেশ এমনকি ভারত বিহার সহ অন্যান্য জায়গা থেকেও মানুষ এখানে বসত গেড়েছিল।

অজানা, অচেনা লোক এক জায়গায় এসে থাকা আরম্ভ করলে অবিশ্বাসের জোয়ারটা বাড়তে থাকে দ্রুত গতিতে। নারায়ণগঞ্জের হাজার বছরের সম্প্রীতিতে চিড় ধরতে থাকল। ষাটের দশকে বিশাল লজ্জাকর হিন্দু-মুসলমানের সাম্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেল। স্বাধীনতার পর হানাহানির রূপ পাল্টাতে থাকল। সাম্প্রদায়িক সমস্যার জায়গায়, পরিবার ভিত্তিক প্রতিপত্তি বিস্তারের প্রতিযোগিতা স্থান করে নিল। প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে খুন, গুম রেওয়াজ এখান থেকেই চালু।

তালুকদার পরিবারের প্রধান চমন তালুকদার। নারায়ণগঞ্জে তার একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে উঠে পরে লেগেছে। স্থানীয় মাফিয়া, ক্যাডারদের পিছনে বড় ধরণের মাসোহারা দেয়। অবশ্য তার জন্যে বিভিন্ন খাত থেকে প্রচুর উপার্জন আসে। কিন্তু সমস্যা আরেক জায়গায়। ষাটোর্ধ সেলিম সিদ্দিকির নেতৃত্বে সাধারণ জনগণ তার কাজ-কর্ম নিয়ে সমালোচনা-নিন্দা-প্রতিবাদ করছে। কিছু কিছু জায়গায় আবার তার দলের কাজে বাধা তৈরি করেছে। মানে প্রতিরোধ পর্যন্ত করেছে।

চমন তার বাসায় পেয়ারের কাছের বান্দাদের মিটিঙে ডাকল। নারায়ণগঞ্জে এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এর সমাপ্তি এখনই টানতে হবে। ওই পক্ষ বেশী শক্তিশালী আর পাবলিক সাপোর্ট পেয়ে গেলেই বিপদ। এর মধ্যে ঢাকার কিছু পত্রিকা তার পরিবারকে নিয়ে কটাক্ষ করে খবর ছেপেছে। ঢাকার হাই কমান্ড বলেছে, যে করেই হোক ঝামেলা তুলে ফেলতে। অনেক রাত পর্যন্ত শলা-পরামর্শ চলল। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হল, সেলিম সিদ্দিকিকে তুলে ফেলা হবে।

কিন্তু কাজটা কে করবে? এখানকার জনগণ তার দলের লোকদের চিনে। ঠিক হল, বরিশালের কালা কামালকে দিয়ে কাজটা করানো হবে। খরচ কিছু বেশী হলেও, কথা বার্তা কম হবে। এর আগেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরণের কর্মকাণ্ড সে করেছে।

দেশের বড় লিডারা কালা কামালকে এক নামে জানে। বলা তা যায় না; কার কখন আবার কালা কামালকে দরকার হয়ে পড়ে!

আলমা কাজটা যত কঠিন ভেবেছিল, তার থেকে বিষয়টা অনেক সহজ হল। এক দিন সাহস করে সে লি ওয়ানের অফিস রুমে গেল। লি ওয়ান নতুন লেকচারার। অন্য আরেক জন লেকচারেরে সাথে রুমটা শেয়ার করে। ভাগ্যটা ভালই বলা যায়। লি ওয়ান তখন একাই ছিল। আলমাকে রুমে আসতে দেখে সে খুবই অবাক। আলমা যে সব পরীক্ষায় তার মতই প্রথম হয়, সেটা সে অন্য টিচারদের থেকে শুনেছে।

আলমা সাহস করে লি ওয়ানের রুমে ঢুকল ঠিকই, কিন্তু মুখ থেকে কিছুই বের হল না। একেবারে বোবা পাওয়ার অবস্থা। লি জানতে চাইল, তোমার জন্যে কি কিছু করতে পারি?

আলমা মুখে কিছু বলল না। কিন্তু তার মুখ, চোখের ভাষা লি ঠিকই বুঝলো। উত্তরে কিছু বলতে চাইল। না কি অদ্ভুত লি’র ও একই সমস্যা দেখা দিল। তারও মুখ খুললো না। কিন্তু শরীরের বাকী সব অঙ্গ নীরবে আলমার সাথে কথা বলল। এ রকম শব্দহীন কথোপকথন কতক্ষণ চলল, তা এখন বলা মুশকিল। তবে দু জনে তখনই আবিষ্কার করল, তারা মনে হয় --একে অপরের জন্যে তৈরি। এই বয়সেই মানুষ তার পূর্ণতা খুঁজে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে। কি জানি কথাটা, প্রতিটি অঙ্গ আমার কাঁদে, তোমার প্রতিটি অঙ্গের জন্যে।

দৃষ্টি বিনিময়ের সাথে সাথে মন বিনিময় হতে সময় লাগল না। আলমার খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিক হল। জীবনের মানে আরও বেশী সুন্দর মনে হতে লাগল। সময় পেলে দু জনে এক সাথে এ দিক, ও দিক ঘুরে বেড়ায়। বারে বারে একই প্রতিজ্ঞা করে, জীবনের বাকী সময়টুকু তারা কোন ভাবেই এক জন আরেক জন ছাড়া থাকবে না।

ক্লাসে লি ওয়ান একাই কথা বলতো, আর সবাই শুনতো। কিন্তু সে যখন আলমার সাথে কথা একেবারে না বললেই চলে। চোখ দুটো গোল করে কেমন একটা দৃষ্টি দিয়ে মনে হয় এক মনে আলমার কথা শুনতে হয়। আর আলমাকে এক নাগাড়ে কথা বলে চলে। এ নিয়ে আলমা প্রথম দিকে অনেক অভিযোগ ছিল। কিন্তু লি ওয়ানের এক কথা, তোমার সব কথার সাথেই আমি এক মত। সে জন্যে উত্তর দেয়ার কোন দরকার নাই। তা ছাড়া চরম আনন্দ কিংবা দুঃখে, হয় মানুষ পাথর হয়ে পড়ে নয়ত অনেক চঞ্চল, সরব হয়ে পড়ে। এই যে তুমি এতো কথা বলছো, কিংবা আমি তোমার কথা শুনে, তোমাকে ভীষণভাবে অনুভব করছি; সবই এই চরম সুখের প্রকাশ।

তার পরে লি ওয়ান একটু রসিকতা করে বললো, তোমার চরম সুখ চলে গেলেও, তুমিও কিন্তু আমার মত স্রোতার দলে নাম লিখাতে পারো।

উত্তরে আলমা লি ওয়ানকে পিঠে একটা কিল দিয়ে বলেছে, কখনই না। আমি চির কালই চরম সুখে থাকতে চাই।

দেখতে দেখতে দু বছর ঘুরে গেল। এর মধ্যে আলমা তার বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে, আপাতত সে এমেরিকা যাবে না। সে লি ওয়ানকে বিয়ে করবে। ম্যানিলা শহরেই থাকবে। বাবা অবশ্য প্রথমে প্রতিবাদ করেছিলেন, এ রকম সুযোগ হাত ছাড়া করাটা ঠিক হবে না।

কিন্তু বাবার মন কখনই মেয়েকে কষ্ট দিতে চায় না। মেয়ের খুশীই, তার খুশী। তা ছাড়া এক দিক দিয়ে ভালই হল। মেয়ে কাছাকাছি থাকবে। চাইলেই দু চোখ ভরে দেখে আসা যাবে। বিদেশে গেলে তো আর সেটা সম্ভব হত না।

আলমা-লি বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকল। অল্প অল্প করে বিয়ের কেনা কাটি চলতে লাগলো। কিছু অলংকার কিনলো লি-দেখতে এত স্মার্ট হলেও, আলমার মতে, সে বড় ধরণের বোকার মত একটা কাজ করল। বেচারার জমানো সব টাকা খরচ করে খুব দামী একটা বিয়ের গাউন আর ডায়মন্ডের একটা আংটি কিনল। আলমা হৈ হৈ করে উঠলো, এত খরচ করার কোন দরকার নাই। লি ধীরে ধীরে বলল, যদি পারতাম তোমার জন্যে আমি পৃথিবীর সব অর্থ খরচ করে ফেলতে পারতাম। আমার ভালোবাসার জন্যে আমি সব কিছু করতে প্রস্তুত। প্রয়োজন তোমার খুশীর জন্যে পুড়ে ছাই পর্যন্ত হয়ে যেতে পারব।

২৫ শে ডিসেম্বর ক্রিস্টমাসের দিনে তাদের বিয়ে হবে। চার্চে বিয়ে বিকালে; সন্ধ্যায় কিছু আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবদের এক সাথে ডিনার করার আমন্ত্রণ জানানো হল। অবশ্য এ ছাড়া আরেকটা প্ল্যান হল। আইডিয়া অবশ্য আলমা। বিয়ের আগের দিন মানে চব্বিশ তারিখে দু জনে বিয়ের সাজ পরে সমুদ্রের ধারে যাবে এক ফটোগ্রাফারকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে অনেক অনেক ছবি তুলবে; স্মৃতিগুলো ছবি বন্দি হয়ে থাকবে। খারাপ দিনে স্মৃতির পাতাগুলো উল্টাতে সুবিধা হবে।

সব চেয়ে বড় কথা, আলমা হয়তো সমুদ্র উপকূল ভর্তি মানুষকে, আকাশকে, পানিকে, চাঁদ, সূর্য, তারাকে --সবাইকে তার ভালোবাসার কথা জানাতে চায়।

প্ল্যান অনুযায়ী আলমা বিয়ের গাউন, আংটি আর লি টাকসিডো (কালো স্যুট আর বো টাই) পরে সমুদ্রের ধারে যেয়ে ছবি সেশন আরম্ভ করল। ব্যাকগ্রাউন্ডে সমুদ্র, বিশাল আকাশ, আর ডুবন্ত সূর্য। আলমা-লি, দু জনের পা পানিতে সামান্য ডুবে আছে। সমুদ্র হয়ত পা ছুঁয়ে, ওদের ভালোবাসার স্বীকৃতি দিচ্ছে।

এর থেকে বড় রোমান্টিক দৃশ্য কি ভাবা যায়?

শুভ, আলমা আর তাদের দল লাঞ্চে যেয়ে খুবই আনন্দ করলো। দামী রেস্টুরেন্টে খাওয়া আর যারা এলকোহল পান করে, তাদের জন্যে পছন্দ মত তাও এলো। সাধারানত অফিসের ফাঁকে লাঞ্চে কেউ এলকোহল পান করে না। কিন্তু রেস্টুরেন্টে ঢুকে শুভ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট শুধু তাদের লাঞ্চের পয়সাই দিচ্ছেন না; লাঞ্চের পরে কাউকে আর অফিসে ফিরতে হবে না। এখন যত পারো খাও, পান করে আর হৈ চৈ করো।

শুভ ঘোষণা করলো, অফিসের কোন আলাপ করা যাবে ন। হয় হাসির কোন জোকস বলতে হবে, নয়ত নিজের জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত কোন কথা বলতে হবে। এর থেকে কোন মাফ নাই। সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। কোন ব্যতিক্রমের এপ্লিকেশেন না-মঞ্জুর হবে। সবাই নড়ে চড়ে বসল। হয়ত ভেবে নিল কি বলা যায়।

প্রথমেই শুভ’র পালা। এমনিতেই সারাক্ষণ হৈ চৈ করছে। কিন্তু নিজের বানানো নিয়মে কি বলবে, সেটা বের করতে, মনে হল কয়েকবার ঢোক গিললো। তার পরে সেই হাসি খুশী ভঙ্গিতে আরম্ভ করল, সেই ক্লাস ফাইভে থাকতে এক মহিলা টিচারকে ভীষণ ভাল লাগত। তাকে এক দিন সাহস করে যেয়ে তাকে বললাম, টিচার আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই। কথাটা শুনামাত্র তার ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে গেল। সাথে সাথে টিচার ছুটে গেল প্রিন্সিপালের অফিসে। সেখান থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হল, তার পরে চলল উত্তম মধ্যম। এখানে বলে রাখি সেই সময়ে বাংলাদেশে ছাত্র পেটানো জায়েজ ছিল। শাস্তি শুধু মারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। আমার বাসায় চিঠি দেয়া হল, তোমাদের ছেলে, টিচারকে বিয়ে করতে চেয়েছে। মা চিঠি পেয়ে, আরেক দফা মার পিট করলেন। তিনি দাঁত কিট মিট করতে বললেন, কি রূপবান বাদশা হওয়ার খুব শখ হয়?

পুরো দলের মধ্যে হাসির রোল পড়লো। এক জন জানতে চাইল, রূপবান বাদশা কে ছিল? শুভ সেই গল্পও বলল। শেষে যোগ করল, পরের দিন টিচারকে যেয়ে বললাম, আমি আপনাকে ডিভোর্স করে দিব। বিয়ে করতে যেয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। আর যাই কোথায়? আগের ঘটনাগুলো আবার পুনরাবৃত্তি হল। এর পর থেকে বুঝতে পারলাম, বিয়ে করলে মার খেতে হয়, ডিভোর্স করলে সেও একই অবস্থা। তাই আর কি। এ সব বিষয় থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।

এক এক করে জন, মেরি, সামান্থা, ঘোষ, টম তাদের বিভিন্ন গল্প বলল। গল্পগুলো বেশীর ভাগই আদি রসাত্মক। পেটে মদ পড়লে, বেশীর ভাগ মানুষ-ই অনেক কথা বলে। সত্যি কথাগুলো বের হয়ে আসে। যাই হোক সেই সব গল্পে, এই বার আমরা না হয় না -ই বা গেলাম। তবে শেষে অপেক্ষা করছিল, একেবারে নাটকীয় ব্যাপার। কেউ যার জন্যে প্রস্তুত ছিল না।

আলমা বসেছিল, টেবিলের শেষ মাথায়। স্বভাব সুলভ চুপচাপ বসে মার্গরিটা পান করেছিল। খৃস্ট ধর্ম অবলম্বীদের এই এক মজা। কোন অপরাধের কষ্ট ছাড়াই যত ইচ্ছা তত মদ পান করতে পারে। যাই হোক, সবার শেষে এবার আলমার পালা। কারোরই যেন অপেক্ষার বাঁধ মানছিল না। কারণ সেই একমাত্র মানুষ, যে নিজের কথা কখনো বলে নি। সবারই উত্তেজনা দেখা গেল, আলমা আজকে কি বলে।

অবশেষে আলমা আরম্ভ করল, আমার এক বন্ধু ছিল, মানে এখনো আছে নাম লি। লি ওয়ান। সে একবার বলেছিল, ভীষণ দুঃখ পেলে মানুষ হয় একেবারে নীরব ধরণের হয়ে যায় কিংবা সব সময়ে হৈ চৈ আর কথা বলতে থাকে। আমি মনে হয় প্রথম ধরণের আর আমাদের দলে আরেক জন আছে সে হল দ্বিতীয় ধরণের।

কারোরই বুঝতে অসুবিধা হল না, দ্বিতীয় ধরণের মানুষটা কে হতে পারে। কয়েক জন আবার আড় চোখে শুভকে দেখে নিল।

এক বার আমি আর লি ওয়ান ম্যানিলা বে’ র উপকুলে গেছি, ছবি তুলতে। তখন ঠিক সন্ধ্যা হয়, হয়। পিছনে আকাশ, ডুবন্ত সূর্য।

আলমার গলা ইতিমধ্যে ভারী হয়ে এসেছে। একটু থেমে নিয়ে আবার আরম্ভ করল, সমুদ্রের ধারে প্রচণ্ড বাতাসে আমার চুল এলো মেলো হয়ে যাচ্ছিল। সাথে বাতাসের শব্দ, মানুষের কোলাহল। আমি চুল ঠিক করতে করতে দৃষ্টি আরেক দিকে দিলাম। অবশ্য ক্যামেরা ম্যান সে রকমই বলেছিল। পাশে তাকিয়ে দেখি...

কিন্তু আলমা আর কথা শেষ করতে পারল না। ছোট একটা বাচ্চা মেয়ের মত শব্দ করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলো। শুভ নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে আলমাকে একটা ছোট হাগ দিয়ে বলল, তোমাকে আর বলতে হবে না। আমরা বুঝতে পারছি তোমার বুকের কোণায় লুকানো আছে জমাট কোন কষ্ট।

১০

শুভ বাসায় ফিরে কাপড় বদলিয়ে সরাসরি বিছানায় চলে গেল। আলমার কান্নাকাটি করায় তার আর খেতে ইচ্ছা হয় নি। মনে হল, মেয়েটার কষ্টকে যদি হাল্কা করে দেয়া যেত। এত মিষ্টি একটা মেয়ে, তার তো এখন ফুলের মতই সুবাস ছড়ানোর কথা। সে কিনা কেমন সারাক্ষণ চুপসিয়ে থাকে। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ দুটো লেগে এলো, সেটা সে বুঝতেই পারে নি।

সেল ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। তাকিয়ে দেখে আলমা ফোন করছে। শুভ বেশ অবাক হল। আলমা প্রজেক্ট চলাকালীন সময়ে কয়েক বার ফোন করেছে, অফিসের কোন প্রশ্ন নিয়ে। মুহূর্তেই লাঞ্চের ঘটনা মনে এলো। শুভ ফোনটা ধরলো।

ওই দিক থেকে আলমা শুভকে কোন সুযোগ না দিয়ে বলা আরম্ভ করল, আমি তোমার জন্যে ডিনার বানাচ্ছি; চলে আসো। তোমার দুপুরের খাবারটা নষ্ট করলাম। তার মাশুল দিব। তা ছাড়া তোমার সাথে আমার কিছু কথাও আছে। আমার ঠিকানা তোমাকে টেক্সট করে দিচ্ছি। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে চলে এসো।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে, আলমা বলল, এখন তা হলে রাখি। শুভ কোন সুযোগই পেল না; হ্যা না কিছু বলার।

কাটায় কাটায় ঠিক সাতটার সময়ে গুভ আলমার এপার্টমেন্টে যেয়ে হাজির হল। আলমাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে না, কয়েক ঘণ্টা আগে সে বাচ্চার মেয়ের মত কেঁদেছিল। দেখে কেমন মায়াবী লাগছে। গলার আওয়াজও কেমন অন্য রকম বলে মনে হল। অফিসের মত গম্ভীর হয়ে কথা বলছে না; কেমন যেন একটা সোহাগিনী স্বরে কথা বলছে। শুভ’র আলমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে মন চাইল।

আলমা শুভ’কে লিভিং রুমে নিয়ে বসাল। সেখানে বড় একটা সোফা সেট। ম্যাচিং পর্দা। দেয়ার ভর্তি পেন্টিং। কি সুন্দর ছিমছাম পরিপাটি করে সাজানো। শুভ’র নিজের এপার্টমেন্টের কথা মনে হল। সব কিছু স্থুপ করা, অগোছলো। গুছিয়ে থাকতে হয়ত মেয়েলি ছোঁয়ার দরকার হয়। শুভ’র গোপনেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে এলো।

আলমা বলল, সে ভিতর থেকে একটা কাজ করে এখনই আসবে। একা হয়ে, শুভ লিভিং রুমের চারিদিকে আবার চোখ বুলাতে লাগলো। বাম দিকের কোণায় একটা টেবিলের উপর আলমার কিউবিকালে ফ্রেমে বাঁধানো সেই ছবির একটা বড় সংস্করণ। ছবিটার পাশে একটা লাল রঙের ছোট বাক্স। আলমা নিশ্চয়ই , এই বাক্সটা হাতে নিয়ে ছবি তুলেছিল।

আলমার পায়ের শব্দ শুনে, শুভ ছবির থেকে চোখ সরালো। এর মধ্যে আলমা শুভ’র পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেন্টার টেবিলের উপর কিছু এপেটাইজার আর ডায়েট কোকের ক্যান। অফিসের সবাই জানে শুভ কি ড্রিঙ্ক’স খায়। তার মানে শুভ ছবিটা নিয়ে এত বেশী মগ্ন ছিল যে, আলমা এগুলো কখন এনেছে সেটা বুঝতেই পারে নি।

আলমা মিষ্টি হেসে বলল, আসো এপেটাইজার খেতে খেতে আমারা কথা বলি। শুভ কোন উত্তর না দিয়ে আলমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আলমা শুভ’র হাতে একটা প্লেট তুলে দিল। শুভ তাতে কয়েক টুকরো ফিস ফ্রায়েস নিয়ে একটু একটু করে খাওয়া আরম্ভ করলো।

আলমা নিজেও ডায়েট কোক গ্লাসে ডেলে এক চুমুক দিল, আমি খুব সরি আজকের দুপুরের ঘটনার জন্যে। আসলো কেন যে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললাম! মনে হচ্ছে আমাকে এলকোহল হয়তো কিছুটা ধরেছিল। কিন্তু সামান্য ড্রিঙ্কসে এ রকম হওয়ার কথা না।

শুভ আলমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আলমা সেই সোহাগিনী স্বরে আবার বলতে থাকল, তার ফিলিপাইনের জীবনের কথা, ভালোবাসার কথা --লি ওয়ানের কথা। শেষে বলল আজকে দুপুরে যেখানে শেষ করেছি, সেখান থেকে আরম্ভ করি। সমুদ্রের বাতাসের শব্দ, মানুষের কোলাহলের মধ্যে বুঝতে পারি না, লি আমার পায়ে কাছে পানিতে পড়ে আছে। তাকিয়ে দেখি কপাল থেকে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে। হাসপাতালের নেয়ার আগেই মারা গেল। গুলিটা কপালের ঠিক মাঝ খানে লেগেছিল।

শুভ উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইল, কে গুলি করল লি কে? তাও আবার এত মানুষের মাঝে?

আলমা নিচু স্বরে বলতে লাগলো, ম্যানিলায় পয়সা দিলে এমন কোন কাজ নাই, যেটা করানো সম্ভব না। সামনে নির্বাচন ছিল। এক দলের নেতা ঠিক করলো, অন্য দলের নেতার মন অন্য দিকে সরাতে হবে। কিন্তু তাকে সরাসরি কিছু করা সম্ভব না। সে সব সময়ে বডি গার্ড নিয়ে ঘুরে। ঠিক হল, হিট ম্যান দিয়ে নেতার ছেলেকে খুন করানো হবে। উদ্দেশ্য একটাই; ভয় পেয়ে নেতা যদি নির্বাচন থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। মজার ব্যাপার কি জানো, সেই নেতার ছেলে আর তার গার্ল ফ্রেন্ড আমাদের পাশেই দাঁড়ানো ছিল, তারাও আমাদের মত ছবি তুলছিল। পরের দিন ওদেরও বিয়ে হওয়ার কথা। হিট ম্যানের কাছে যে বর্ণনা ছিল, তার সাথে লি ওয়ানের অনেক মিল ছিল। সে নেতার ছেলের জায়গায় লিকে প্রকাশ্যে গুলি করে। পরে অবশ্য হিট ম্যান পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিল। আমি এই সব পুলিশের কাছ থেকেই শুনেছি।

কথা বলতে বলতে আলমার দু চোখ পানিতে ভরে উঠলো। লাল বাক্সটা হাতে নিয়ে ঢাকনা খুললো। দেখ দেখ আমার লি এখানে আছে।

শুভ বিষয়টা ধরতে পারলো না। আলমা ব্যাখ্যা করল, লি ওয়ান মারা যাবার সাত দিন পরে তাকে ইলেকট্রিক ওভেনে পোড়ানো হয়। এই হল তার ছাই। আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। আমরা সারা জীবন এক সাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ও ওর কথা রেখেছে; আমিও আমার কথা রেখে চলেছি। সে আমার সাথেই থাকে সারাক্ষণ। ফ্রেমের ছবিটা তার দেয়া বিয়ের গাউন, আংটি পরে তাকে এই ছোট বাক্সে নিয়ে তোলা।

আলমার কথা কথা শুনতে শুভ’র ও চোখ পানিতে ভরে গেল, কি অদ্ভুত আমার জীবনেও এ রকম এক ঘটনা আছে। শুভ আলমার মতই আরম্ভ করল, তার ফেলা আসা দিনগুলোর কাহিনী। শেষে শক্ত হয়ে বলল, কালা কামালকে বলা ছিল লাল টয়োটার মধ্যে সাদা পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোককে গুলি করতে হবে। সে তাই করেছিল, আমার বড় মামাকে আমার মায়ের সামনে নারায়ণগঞ্জে চাষারা রাস্তার মোড়ে গাড়ি থামিয়ে ঠিক কপালে গুলি করেছিল। তারা দু জন আমার ভবিষ্যৎ বধূকে আংটি পরাতে যাচ্ছিলেন। বাঙালি হিট ম্যান কালা কামালের ধারণা ছিল সে সেলিম সিদ্দিকিকে গুলি করেছে। মা এই দুঃখের ধকল নিতে পারেন নি। তিনি সাত দিনের মাথায় মারা যান। আমি ঝুমুকে বাই বলে চলে এসেছি, আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব না।

আলমা এর মধ্যে কেঁদেই চলেছে। কান্না ভেজা গলায় বলল, হিট ম্যানরা যদি জানত, ওরা শুধু এক জন করে মানুষকেই গুলি করে না। সাথে সাথে অনেক জীবিত মানুষকে নিশ্চল করে দেয়। অনেকগুলো স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়। আর যারা হিট ম্যানদের ব্যাবহার করে, তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। তারা মানুষ নামের কলঙ্ক, পশুর থেকে নিকৃষ্ট।

দু দেশ থেকে আসা দু জন আদম সন্তান কেঁদেই চলেছে। তাদের কষ্ট আর দুঃখের মধ্যে এত মিল হল কি করে? না থাক, এই সব নিয়ে এখন কোন কথা না বলি। চুপ চুপ; একেবারে চুপ। ওদের এখন কান্নার ভীষণ দরকার। বুকের ভিতরের শক্ত কষ্টের শিলা কান্নার জলে যদি একটু নরম হয়!

না হলে মানুষ কি বাঁচতে পারে?

জুলাই ৩, ২০১৫

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক --quazih@yahoo.com