ঐ রংধনু থেকে…… 

ঐ রংধনু থেকে কিছু কিছু রং এনে দাও… বিখ্যাত এই গানের প্রথম কলিই মনটাকে সেই দূর আকাশে সাত রঙের মাঝে নিয়ে যায়। রংগুলোকে হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করে। কিন্ত তাই কি আর সম্ভব? দূর আকাশে যাওয়া তো বড় একটা দুরুহ ব্যাপার। তার পরে রংধনুর উপস্থিতি তো হয় সামান্য কিছু সময়ের জন্যে। কিন্তু এমন একটা রংধনু যদি থাকত, যেটাকে চাইলে ছোঁয়া যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে মন ভরে তাকিয়ে থাকা যায়! হ্যা প্রিয় পাঠক বন্ধুরা সেটা সম্ভব। কিভাবে ও কোথায় সম্ভব, তা আজকে জানাব। তবে এখনই একটা কথা বলে রাখি, এই রংধনু মানুষের তৈরি কোন কারসাজি না। একেবারে বাস্তব। তবে সেখান থেকে কোন রং বের করে প্রিয়তমাকে দেওয়া হয়ত যাবে না। 

ছোট আয়তনের দেশ বাংলাদেশের মানুষ আজ সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। শোনা যায় দু কোটি বাঙালি দেশের বাইরে। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ কোটি হলে, প্রতি আট জন বঙ্গ সন্তানের এক জন দেশ মাতৃকার থেকে অনেক দূরে। সখ করে আপনজনদের ছেড়ে কেউ দেশান্তরী হয় না। কিছু উপার্জনের কিংবা উন্নত জীবনের আশায় তারা দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়। তা ছাড়া এক বিরাট অংশের জনগণ মনে হয় দেশ ছাড়ার জন্যে এক পায়ে খাঁড়া হয়ে আছে। তারা হাজার বিপদ জেনেও ডিঙিতে করে সমুদ্র পাড়ি দেয়, জাহাজ থেকে লাফ দেয়, সাঁতরে সাগর পাড়ি দেয়, কিংবা মরুভূমিতে মাইলের পর হেঁটে চলে নতুন জীবনের সন্ধানে। আবার কিছু বাঙালি দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়ায়। বিদেশ যেতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে এমন মানুষও নেহায়েত কম না।

মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের পর সব চেয়ে বেশী বাঙালি সম্ভবত আছে উত্তর এমেরিকায়। উত্তর এমেরিকা বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডাকে বুঝায়। দেশ দুটোই বাংলাদেশের তুলনায় সাইজে অতিকায়। এখানকার বড় শহরগুলোতে প্রচুর বাঙালি বসবাস করে। উত্তর এমেরিকায় সব চেয়ে বেশী বাঙালি থাকে নিউ ইয়র্কে। আর ক্যানাডায় সর্বাধিক বাঙালি আছে অন্টারিও প্রদেশের টরোণ্টো শহরে। বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে কমপক্ষে হাজার পঞ্চাশেক বাঙালি এখানে ঠায় নিয়েছে। শহরটার কয়েকটা অঞ্চল বা পাড়া মনে হয় বাঙালিতে ঠাসা। ক্রিসেন্ট টাউন, ডাল ফোরথ, বাংলা টাউন প্রভৃতি জায়গাগুলো যেন একেকটা মিনি বাংলাদেশ। পথে ঘাটে বাঙালিদের উপস্থিত একেবারে স্পষ্ট। বাঙালিদের মালিকানায় আছে প্রচুর দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য। শুধু তাই না তাদের খদ্দেররাও বেশীর ভাগ বাঙালি। এখানে কিছু রেস্টুরেন্ট, দোকানের নামের সাইন বোর্ডে বাংলা লেখা দেখা যায়। 

নিউ ইয়র্ক ও সেখানকার বাঙালিদের দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। ইচ্ছা ছিল টরোণ্টো শহরের বাঙালি ও তাদের জীবন যাত্রাকে সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করার। সুযোগটা এসে গেল। প্রিয়তমা স্ত্রীকে সেখানকার এক সংগঠন সমস্বর আমন্ত্রণ জানালো; টরোণ্টোর অনুষ্ঠানে যেয়ে কবিতা আবৃত্তি করার জন্য। এখানে উল্লেখ করে রাখি, আশির দশকে দেশে মারুনা হাসানের রাহীর কবিতা আবৃত্তির বেশ নাম ডাক ছিল। এখনও সে চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে। টরোণ্টোতে জুন (২০১৬) মাসের ৩, ৪, ৫ তারিখে বাংলা নাটক, কবিতা এবং গানের জমকালো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। 

৪ তারিখ শনিবার সন্ধ্যায় আমরা অনুষ্ঠানস্থলে যেয়ে হাজির হলাম। তার আগের রাতে মেলা ঝক্কি সামাল দিয়ে ডালাস থেকে আমরা দুজন উড়ে এসেছি; আমাদের বর্তমান নিবাস এমেরিকার ডালাস শহর থেকে। ফ্লাইট কয়েকবার ডিলে করেছিল। প্রথমবার করলো এমেরিকান এয়ার লাইন্সের একজন ফ্লাইট ক্রু’ র অনুপস্থিতির কারণে। পরে ফ্লাইট বদলে দিল। সেই ফ্লাইট আবার করলো তিন বার ডিলে। রাত ন’ টার জায়গায় গন্তব্যে পৌঁছলাম রাত দেড়টায়। দেখলাম আমাদের দেশের বিমান কোম্পানির রোগ এদেরও কম না। আমরা আসলে বিমানকে এত বিষেদাগার না করলেও পারি! 

এয়ার পোর্টে নিতে এসেছিল প্রিয় শ্যালিকা রীতি আর তার ছোট ছেলে নামির। ওদের দেখেই মুহূর্তে হারিয়ে গেল সারাদিনের A Journey by a Plane’ র ক্লান্তি। মেলা বছর পর ওদের সাথে দেখা। শেষবার যখন দেখেছিল, তখন নামির ছিল বেশ ছোট। এততো ছোট ছিল যে, আমি আদর করে ডাকতাম “ট্যাবলেট” বলে। সেই ট্যাবলেট এখন প্রাপ্ত বয়স্ক, সাথে সাথে লম্বা ও চওড়া হয়েছে। ভাবলাম ছোট মানুষ যখন বড় হয়ে গেছে, তখন আমিও হয়ত জীবনের অনেকটুকু অতিক্রম করে ফেলেছি। হাতে তা হলে সময় কমে আসছে দ্রুত। 

ফিরে আসি টরোণ্টোর বাঙালির সেই অনুষ্ঠানে। অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। মঞ্চে নাটক হল, বৃন্দ কবিতা আবৃত্তি হল। মুহূর্তে মনটা চলে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে। দিনের পর দিন ক্লাসের পরে মহড়া দিয়ে অনুষ্ঠান দাঁড় করানো হত। এখানেও একেবারে তাই। তবে অংশগ্রহণকারীরা ক্লাস না, কাজের শেষে মহড়া করেছে। প্রত্যেককেই এখানে আয় রোজগার করতে হয়। অবাক হলাম, এদের বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি দারুণ দরদ দেখে। সেই সাত সাগর, তেরো নদীর পাড়ি দিয়ে বিদেশ বিভুয়ে এসেও বাংলা’র জন্য এদের ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমে নি। বরং বলা যায় আরও শতগুণ বেড়েছে। আহা, কি যে যাদু আছে বাংলার মাটিতে! একবার যে এই মাটির গন্ধ পেয়েছে, তার পক্ষে সেটা ভুলা হয়ত অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল যদি দেখে যেতে পারতেন, প্রবাসীদের বাংলার জন্যে এই ভীষণ টান!! তাদের গর্বের কোন ইয়ত্তা থাকত না !! 

স্থানীয় অতিথি ছাড়াও, অটোয়া, নিউ ইয়র্ক থেকে কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পী আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। এক সময় তারা দেশের আসরগুলো মাতিয়ে রাখতেন। এখন বিদেশে মাটিতে অনুষ্ঠানগুলোতে শুধু মাতাচ্ছেনই না, নতুন সাংস্কৃতিক কর্মী নির্মাণে কাজ করছেন। নতুন প্রজন্ম অভিজ্ঞদের থেকে অভিনয়, কবিতা আবৃত্তি, গান শিখছে। এক যুবা বয়সের ছেলে তবলা বাজিয়ে একেবারে বাজিমাত করে দিল। শুনলাম দক্ষিণ এশিয়ার অন্য ভাষা-ভাষীর মানুষরাও তাকে নিয়ে যায় তাদের অনুষ্ঠানে তবলা বাজানোর জন্যে। ছেলেটার বাজানো শুনে মনে হল, সে ঢাকার সেরা তবলা বাদকদের পর্যন্ত দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারবে। গর্বে বুকটা ফুলে ইয়া বড় হল। এরাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে যুগের পর যুগ বিদেশের মাটিতে টিকিয়ে রাখবে। 

যে কোন সফল অনুষ্ঠানের জন্যে শিল্পীদের উন্নত পরিবেশনার সাথে সাথে দরকার বোদ্ধা দর্শক ও তাদের অংশগ্রহণ। হল ভর্তি দর্শক মনযোগ দিয়ে একের পর এক পরিবেশনাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল। কবিতা আবৃত্তি উপস্থিত সবার মন কেড়ে নিল। আমন্ত্রিত অন্যান্য ও আমার প্রিয়তমা কবিতা আবৃত্তি করে দর্শকদের মন জয় করলো। বাংলা কবিতা আবৃত্তির সমঝদার টরোণ্টো তৈরি করছে। এ তো বাংলার জন্যে বিশাল অর্জন। সাধু টরোণ্টো, সাধু টরোণ্টোর নিবেদিতপ্রাণ সাংস্কৃতিক কর্মীবৃন্দ!! 

সুরেলা কণ্ঠিরা বেশ কিছু গান গাইলেন। গায়কী ও পরিবেশনা আবার প্রমাণ হল তাদের অনন্যতা। সাথে বাদ্যযন্ত্রীরা সমান তালে তাদের পারদর্শিতা দেখালেন। ভালো লাগার এক অপূর্ব ভুবন তৈরি হল। আনন্দে শিহরণ চলে এলো। শেষে স্থানীয় একজন বিশিষ্ট গায়ক মঞ্চে এলেন; অদ্ভুত তার গলা, অদ্ভুত তার সুর। মুহু মুহু করতালি ও গানের অনুরোধে মনেই হচ্ছিল না, আমরা দেশ থেকে এত দূরে এক অনুষ্ঠানে আছি। কি যেন কথাটা, “যেখানে বাঙালি, যেখানে বাংলা, সেখানেই বাংলাদেশ।” টরোণ্টোর অডিটরিয়ামটা যে, সেই মুহূর্তে ক্ষুদে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল, সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না।

পরের দিন রোববার। প্ল্যান আগের থেকে পাকাপাকি করা ছিল নায়েগ্রা ফলস দেখতে যাবার। কিন্তু সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি। মনটা কেমন দমে আসলো। বৃষ্টির বেগ বাড়লে নায়েগ্রা ফলস প্রাণ ভরে উপভোগ করা মুশকিল হবে। তার পরেও আমার সেখানে যাওয়া চাই। শ্যালিকা রীতির বাসা থেকে ঘণ্টা খানেকের রাস্তা। ক্যানাডার যাওয়ার আগে থেকে শিহরিত ছিলাম, প্রথম বারের মত বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক বিস্ময় নায়েগ্রা ফলস দেখব বলে। প্রিয়তমার কাছে অনেক শুনেছি সেখানকার নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের কথা। সে এর আগে একবার এই সৌন্দর্য দেখে এসেছে। তখন সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, পরের বার অবশ্যই আমাকে নিয়ে এই জায়গায় আসবে। সেই পরের বার আজকে এসেছে। বৃষ্টি হউক, ঝড় হউক আমাকে সেখানে যেতেই হবে। 

এই বৃষ্টি, এই নাই -অবস্থার মধ্যে আমরা বের হয়ে পড়লাম। আজকে আমাদের আরেকজন সঙ্গী যোগ হয়েছেন, হাফিজ ভাই। তিনি আমার ভাইরা ভাই মানে শ্যালিকার স্বামী। বেশ সাবধানী ও হিসেবি ড্রাইভার। গবেষণা করে এর মধ্যে বের করে ফেলেছেন, আমাদের পৌছতে পৌছতে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে। তবে রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক জ্যাম হবে। তার কথা একেবারে সত্য প্রমাণিত হল। বেশ কয়েক জায়গায় রাস্তা মেরামতের জন্যে জ্যামে পড়তে হল। পথে কয়েকবার কয়েক পশলা ঝুম বৃষ্টি হল। তা সত্ত্বেও, গন্তব্যে পোঁছান মাত্রই, বিধাতার তৈরি এক অদ্ভুত বিস্ময়কর স্থানের সৌন্দর্যে প্রচণ্ড বিস্মিত হওয়া সাথে সাথেই আরম্ভ হল। 

ভূতাত্ত্বিক শাস্ত্র অনুযায়ী বেশ কিছু পর্যায় অতিক্রম করে আমাদের আজকের এই পৃথিবী। ধারণা করা হয়, প্রায় বার হাজার আগে বরফ যুগ (Ice Age) শেষ হওয়ার পরে নায়েগ্রা ফলসের সৃষ্টি হয়। নায়েগ্রা নদীর উপর বড় দুটো জলপ্রপাত আছে। নায়েগ্রা নদী এমেরিকার নিউ ইয়র্ক অঙ্গ রাজ্য ও ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। এমেরিকার জলপ্রপাতের নাম এমেরিকান ফলস ও ক্যানাডার নাম হর্স শু ফলস (Horse Shoe)। এমেরিকান ফলসের ডান দিকে তৃতীয় একটা স্বতন্ত্র জলপ্রপাত আছে, যার নাম বঁধুর নেকাব জলপ্রপাত (Bridal Veil Falls)। জলপ্রপাতের নাম এরকম বধূ বিষয়ক কেন হল, তার বর্ণনা একটু পরে দিচ্ছি। যাই হোক কাছাকাছি জায়গায় এই তিনটা জলপ্রপাত নিয়েই হল নায়েগ্রা ফলস। মজার ব্যাপার হল, কাছাকাছি হওয়ার জন্যে তিনটা জলপ্রপাতকেই স্বক সাথে দেখা যায়। 

গ্রেট লেকসের (Great Lakes) পানি জলপ্রপাত দিয়ে পড়ে নায়েগ্রা নদীতে যাচ্ছে। কি পরিমাণ পড়ছে? ঘণ্টায় ৫.৫ বিলিওন গ্যালন পানি। হর্স সু ফলস ১৭০ ফুট উঁচু আর এমেরিকান ফলস হল ১৮০ ফুট। তবে প্রস্থে ক্যানাডার হর্স শু ফলস হল ২৫০০ ফুট ও এমেরিকান ফলস তার অর্ধেকের কম ১১০০ ফুট। পর্যটকের কাছে তাই ক্যানাডার হর্স শু ফলসের আবেদন কিছুটা বেশী। বঁধুর নেকাব জলপ্রপাত উচ্চতা ও প্রস্থে অন্য দুটির থেকে কম হলেও, সে আবার নিজের মহিমায় উজ্জ্বল, যেন এক কিশোরী তরুণী বঁধুর ঝিলিক দেয়া লাজুক হাসি। 

গাড়ি পার্ক করে গুটি গুটি পায়ে গর্জনশীল নায়েগ্রা ফলসের পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম। আকাশের বৃষ্টি এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু জলপ্রপাতের পানির ছিটা বাতাসের সাথে ভেসে এসে শরীরে লাগছিল। কেমন যেন আবেশে মন, শরীরে দুটো ‘র মধ্যেই একটা প্রশান্তি কাজ করতে লাগলো। লেকের জলরাশি চক্রাকৃতি করে ঘুরে ঘুরে অতর্কিত সশব্দে নিচে পড়ছে। পড়ার সময় ভীষণ শব্দ করছে। না-কি কাঁদছে? কি যেন গানটা,“পাহাড়ের কান্নাকে সবাই ঝর্ণা বলে।” এখানে তো পাহাড় নাই। শুধু উঁচু জায়গা থেকে নেমে পড়া অথবা পড়ে যাওয়া। তা হলে কেন এত কান্না? এই বিশাল জলরাশি কি পিছনের কিছু ফেলে আসতে চাইছে না? আমরা কি ফেলে আসা দিনগুলোর জন্যে কাঁদি? আমাদের কি একবারও চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলতে ইচ্ছা করে না, আমি আমার ‘সময়’ কে ফেলে চলে যেতে চাই না! আমি যে আমার প্রিয় জনকে হারিয়ে এগিয়ে চলেছি, তাকে তো আমি হারাতে চাই নি। আমি তাকে সব সময়ে সাথে রাখতে চেয়েছিলাম। 

আনন্দ ও বিষাদের এই বিচিত্র স্বাদে মনটা ভরে থাকলো। কিছুটা সময় নীরবে জলপ্রপাতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সৃষ্টিকর্তা তার অনন্য শিল্প কর্মের প্রমাণ কত ভাবেই না দিয়ে রেখেছেন। সে সময়ে চোখ পড়লো পানির দিকে কিছু রঙের ঝলকানিতে। ভাল করে চেয়ে দেখি, আরে এতো রংধুন! কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? সেটা তো আকাশে থাকার কথা। বুঝলাম আমি ঠিকই দেখছি। জীবনে প্রথম আকাশে না পানির উপরে রংধনু দেখলাম। ছোট চোখ দুটো মনে হয় সার্থক হল। আহা কি দেখছি। সৃষ্টিকর্তার নান্দনিক জ্ঞান যে সর্বশ্রেষ্ঠ, তা আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম। 

মনে হল ছোট বেলার সেই ছড়ার কথা। আকাশে রংধনু দেখলে বলে উঠতাম, “রোড হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে; খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে।” এখানে আকাশে সূর্যের আলো থাকলে পানির উপরে রংধনু তৈরি হয়। তবে এখানে রংধনুর সাথে খেঁকশিয়ালের বিয়ের সম্পর্ক থাকলে মেলা সমস্যা হয়ে যেত। কোথায় যে এত শিয়াল পাওয়া যেত। স্মৃতিগুলোকে ফ্রেম বন্দীর কাজ কিন্তু অনবরত চলছিল। নামির ক্লান্তিহিনভাবে ছবি তুলেই চলেছিল। আমার আই ফোনেও বিভিন্ন আঙ্গিকে ছবি নিলাম। সেলফি ষ্টিক ব্যবহার করে আমাদের পুরো দলটার ছবি নেয়া হল বেশ কয়েকবার। 

মেরিলিন মনরো নাম শুনে নি, এমন মানুষ কিন্তু পাওয়া মুস্কিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের তিনি হলিউডের খুবই বিখ্যাত একজন নায়িকা ছিলেন। চেহারা, চুল, শরীর --সব কিছুই ছিল তার যাদুকরী। শুধু সে সময়কার কেন, বছরের পর বছর পুরুষদের স্বপ্নের নায়িকা হয়ে আছেন। ১৯৫৩ সালে মেরিলিন মনরো অভিনীত ছায়াছবি “নায়েগ্রা” একেবারে সবাইকে মাত করে দিয়েছিল। তার পর নায়েগ্রা ফলস হয়ে উঠেছিল হানিমুন বা মধুচন্দ্রিমাকারিদের তীর্থ স্থানে। কারণ সিনেমাতে মেরিলিন নায়েগ্রাতে হানিমুন করতে এসেছিলেন। এই সুবর্ণ সুযোগ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো হাত ছাড়া করে নি। শেরাটন, হলি ডে ইন সহ আরও অনেক কোম্পানি নায়েগ্রা ফলসের সাথে মিলিয়ে ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। চাইলে এবং বাড়তি কিছু খরচ করার সামর্থ থাকলে, হোটেলের বিছানায় শুয়ে নায়েগ্রা ফলসের পানি পড়া দেখা ও শোনা যায়। 

প্রাকৃতিক বিস্ময়ের রাণী নায়েগ্রা ফলসকে নিয়ে মানুষের মাতামাতির শেষ নাই। ১৯০১ সালের ২৪ শে অক্টোবর ৬৩ বছরের এক স্কুল শিক্ষিকা এনি এডসন টেয়লারস একটা ব্যারেলের ভিতরে ঢুকে নায়েগ্রা ফলসের উপর থেকে লাফ দিয়েছিলেন। তিনি ভাগ্যক্রমে প্রাণ হারান নি। এর পরে বেশ কিছু মানুষ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হর্স শু ফলসের উপর থেকে লাফ দিয়েছে। বেশীর ভাগই যারা লাফ দিয়েছিল, তারা হয় গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন কিংবা তাদের সলিল সমাধি ঘটেছে। বেশ কিছু সট্যাণ্ট ম্যান দড়ি উপর দিয়ে পায়ে হেটে নায়েগ্রার এমেরিকার দিক থেকে ক্যানাডার দিক পর্যন্ত এসেছেন। তবে সাধারণ পর্যটকদের জন্য এখন অনেক নিরাপদ অভিযানের ব্যবস্থা আছে। ঠিক যেখানে পানি পড়ছে, তার প্রায় কাছাকাছি বিশেষ ফেরিতে করে যাওয়া যায়। হেলিকপ্টারে করে আরও কাছে চলে যাওয়া সম্ভব। ক্যাবল রেলে করে নায়েগ্রার উপর দিয়ে ঘুরে আসার ব্যবস্থাও আছে। 

সময় কেমন করে যেন বয়ে গেল। নায়েগ্রাকে বিদায় দিয়ে ফিরতি পথের দিকের এগিয়ে চললাম। ভাবছিলাম পানির সাথে একাত্ম হওয়ার অন্যরকম আনন্দ অনুভূতির কথা। এইজন্য হয়ত পরম করুণামায় আল্লাহ তা আলা বলেছেন, প্রতিশ্রুত বেহেশতের নিচে নদী বয়ে যাবে। হাফিজ ভাই এবার, মানুষের তৈরি সুন্দর একটা সৃষ্টি দেখালেন। ফলস সংলগ্ন নায়েগ্রা পার্কে বিশাল এক ঘড়ি আছে। ১৬, ০০০ ফুলের গাছকে চক্রাকৃতিকরে সাজিয়ে ফুল বাগান বানানো হয়েছে। তার উপরে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। বছরে দু বার ফুলের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়। বসন্তকালে নানা রঙের ভায়োলা ও অন্যান্য রঙ্গিন ফুল দিয়ে সাজানো হয়। গ্রীষ্মে আবার আরেক রূপ। স্যাণ্টোলিনা প্রজাতির নানা ফুল তখন পর্যটকদের মন জয় করে। চোখ ও মন দুটো জুড়িয়ে গেল। আহা কি সুন্দর রঙের সমাহার! 

ফেরার পথে আরেকটা অবাক করা জিনিষ দেখলাম। টরোণ্টোর লাগোয়া একটা শহর হল মিসিসাগা। ওখানকার ডাউন টাউনে মেরিলিন মনরোর দৈহিক অবয়বকে অনুকরণ করে মেরিলিন মনরো টাওয়ার্স নামের অত্যাধুনিক দুটো টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এই টুইন টাওয়ারের নকশার জন্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন দেশ থেকে বিখ্যাত সব স্থপতিরা অংশগ্রহণ করে ছিলেন। চীনের ইয়ানসাং ম্যানের ডিজাইন বিচারকরা লুফে নিয়েছিলেন। এমনিতেই ক্যানাডীয়দের মেরিলিন মনরোর জন্যে সীমাহীন ভালোবাসা। নারীর শরীরের মত বক্রাকৃতির টাওয়ার দুটো বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থাপত্য হিসেবে ধরা হয়। সেখানে উঠতে পারলে ভাল লাগতো। না সেইটা এবার হল না। তার পরেও, ক্যানাডীয়দের অভিনব সব কাজের জন্যে বড় ধরণের একটা স্যালুট দিলাম।

সোমবার দিন ভোরে আবার ডালাসের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। দু দিনে স্মৃতির ঝোলায় অবিস্মরণীয় অনেক স্মৃতি স্থান করে নিল। আবার প্রমাণ পেলাম, বৈচিত্র ও সৌন্দর্য আছে বলেই, পৃথিবীটা এত সুন্দর। বাঙালিদের তাদের নিজেদের সংস্কৃতির জন্য প্রচণ্ড টান প্রত্যক্ষ করলাম। নয়ন জুড়ে প্রাকৃতিক বিস্ময় দেখলাম। দুটোর যৌথ ফলশ্রুতিতে নিশ্চয়ই মনের বিশালতা আরও বিস্তৃত হল।

 

জুন ২৭, ২০১৬ 

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com

www.lekhalekhi.net