মশকের কত্থক
সু -প্রিয় বাঙালি ভাই ও বোনেরা, আপনাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছেন যিনি মশা দেখে ভীত হন না? যারা মশাকে এতদিন এরোসল, কয়েল, মশারি দিয়ে অবজ্ঞা করেছেন, তারা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, এদের কেমন বিপুল ক্ষমতা। বিশাল সংখ্যক মানুষ এখন মশাদের ছড়িয়ে দেয়া ডেঙ্গু রোগে ভুগছেন। রোগটায় আক্রান্ত হলে একেবারে মহা-দুর্যোগ হচ্ছে। বলা হচ্ছে হাসপাতালে কোনো বেড খালি নাই। হাই লেভেলের কানেকশান কিংবা অর্থের জোর না থাকলে চূড়ান্ত ধরণের ভোগান্তি হবার নির্ঘাত সম্ভাবনা। জ্বরের সাথে একেবারে গাঁটে গাঁটে প্রচণ্ড ব্যথা। তা আবার তিন দিন কিংবা এক সপ্তাহের জন্যে না। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এই কষ্ট-বেদনা চলতে পারে লম্বা সময় ধরে। পরিপূর্ণভাবে ডেঙ্গু জীবাণুকে ধ্বংস করতে না পারলে এক এক করে শরীরের জরুরী অঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে যদি কেউ চির-বিদায় নিয়ে ফেলেন; তা হলে বলতে হবে তারা ক্ষুদ্র মশার বিধ্বংসী ক্ষমতার প্রমাণ হয়ে অমর হয়ে গেছেন। মশা সম্প্রদায়ের শক্তি সম্পর্কে যারা এখনও পরিষ্কার ধারণা রাখেন না, তাদের বলি একটু অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এদের সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হবে। সাথে সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মশক সম্প্রদায় যে কি ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে, তার একটা পরিচিতি পাওয়া যাবে।
এক সময় ধারণা করা হতো, মশা শুধু মাত্র ম্যালেরিয়া নামক বিটকেলে অসুখের জীবাণু এক মানুষ থেকে নিয়ে অন্য মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। কাজটা করে তারা না-কি এভারেস্ট জয়ের সমান মহা-আনন্দ পেতো। সেই খুশীতে সারাদিন ভো ভো করে গান গেয়ে বেড়াতো। তখনকার দিনে ম্যালেরিয়া রোগের এক মাত্র ওষুধ ছিল কুইনাইন। এই কুখ্যাত ওষুধে রোগ ভালো হলেও, শরীর হয়ে যেত একেবারে পর্যুদস্ত। তখন বিখ্যাত এক কথা ছিল, “কুইনাইনে ম্যালেরিয়া সারবে; কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?”
মেলা বছর ধরে মশা তাদের শক্তির দাপট দেখিয়ে আসছে। তারা আফ্রিকা থেকে জিকা ভাইরাস বহন করে ল্যাটিন ও মধ্য এমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। শুধু ভাইরাস ডেলিভারি দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি; আঞ্চলিক মশারা পূর্ণ উদ্যমে ক্লান্তি-হীনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ‘জিকা’ জীবাণু চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে। গর্ভবতী মহিলারা জন্ম দিয়েছিল অপরিপক্ব মস্তিষ্কের শিশু। সারা বিশ্ব একেবারে নাজুক অবস্থায় পড়েছিল। সেই সময়ে মশার কারণে ব্রাজিলের তো একেবারে করুণ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। গতবারের অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় বিদেশী খেলোয়াড়দের সেখানে খেলতে যেয়ে জিকা রোগের ভয়ে একেবারে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মূর্ছা যাবার অবস্থা হয়েছিল। আল-কাইদা, আইসিস, বোকা হারাম সন্ত্রাসীরা যেই কাজটা করতে পারে নি, মশা সেই কাজ কি সুচারুভাবে না করে দেখিয়েছে!
এইবার দেখি, বাংলাদেশে ক্ষুদে মশক সম্প্রদায় কেমন ধরণের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। কি যেন গানটা? “তবে কি আর ভাল লাগে, যদি সন্ধ্যা হলে ভো ভো করে মশা?” আসলে ভালো লাগার কি কিছু এখানে আছে? মশারা মহা আনন্দে যুগ যুগ ধরে বাঙালির রক্ত চুষছে। এখন আবার তাদের এলিট ফোর্স এডিস মশা বাহিনী দিনের বেলাতেও দারুণ সফলতার সাথে বাঙালিদের কামড়ে ডেঙ্গু রোগ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। পিপাসা লাগলেই কোকের বোতলে স্ট্র ঢোকানোর মতই বাঙালির শরীরে হুল ঢুকিয়ে দু এক পেগ রক্ত পান করে নিচ্ছে। বীর বাঙালির রক্ত মশক সম্প্রদায়ের ধমনীতেও প্রবাহিত হয়ে চলেছে। কবির রক্ত পান করে মশাদের কবি কবি ভাব তৈরি হচ্ছে, আবার ধমনীতে শিল্পীর রক্ত থাকার কারণে মুখ থেকে সুরেলা গান এমনিতেই বের হয়ে আসছে, ‘ভো ভো ভো ভো।’ আর আরেক দল মশা ভাগ্য দোষে পুষ্টিহীন বাঙালির রক্ত পান করে মহা বিরক্তি প্রকাশ করছে। সেই রক্তে না আছে কোনো টেস্ট, না আছে কোনো শক্তি। সেই বিরক্তি থেকে তৈরি হচ্ছে মশাদের প্রতিবাদ। ইচ্ছা না থাকলেও এই মশার দল হতাশার গান ধরছে। একটু কান পেতে শুনলেই এই ভো ভো’ শব্দের মধ্যে অন্য এক সুর শোনা যাবে। তাদের শাহী মেজাজটা খারাপ হলেই ভেজালে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের শরীরে বিশুদ্ধ ডেঙ্গু, চিকঙ্গুনিয়া আর ম্যালেরিয়ার জীবাণু ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মশারা বাঙাল জাতিটাকে নতুন করে আরেক হাত দেখাচ্ছে। অবশ্য মশা সম্প্রদায়কে একটা ব্যাপারে ধন্যবাদ না দিলেই না।
বাঙালি জাতিকে এখনও তারা খাস দয়ার মধ্যে রেখেছে। বাংলাদেশে অধিকাংশ মশা পুষ্টিহীন বাঙালির বিস্বাদ রক্ত পান করে এখনও চরম বিরক্ত হয় নি। বাঙালিদের শরীরে তারা ভয়ঙ্কর ‘জিকা’ ভাইরাস ঢুকিয়ে দেয় নি। যদিওবা এই বছর তারা ব্যাপকহারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে দিয়ে স্পষ্টতই তাদের অসন্তুষ্টি জানিয়ে দিচ্ছে। তবে সাবধান, এখানকার মশাদের বেশী হতাশ ও বিব্রত করা যাবে না। বলা তো যায় না, রাগ হয়ে গেলে মহা শক্তিধর মশা আবার নতুন কি-না করে বসে!
পাশের বাড়ির ছক্কু মিয়ার দশ বছরের ছেলে রুক্কু বীর দর্পে বাবা- মাকে জানালো, সে দুটো মহিলা আর তিনটা পুরুষ মশা মেরেছে। পুত্রের প্রতিভায় ছক্কু মিয়া তো একেবারে অজ্ঞান। বাবা ছেলের কাছে জানতে চাইলেন, সে কিভাবে জানলো কোনটা পুরুষ ও কোনটা মহিলা মশা। ছেলে জোর গলায় বলল, “কেন তোমার মদের বোতলের পাশে যেই মশাগুলো মারলাম সেগুলো পুরুষ। মায়ের ড্রেসিং টেবিলের আশে পাশে যেগুলো ঘুরছিল সেগুলো মহিলা।” বাস্তবে রুক্কুর মশা বিষয়ক যে জ্ঞান আছে; সেটা কিন্তু একেবারে অনন্য। বলা যায় মোটামুটি এর কাছাকাছি জ্ঞান, চরিত্র , ও বাহাদুরি নিয়ে বাঙালি বছরের পর বছর মশা নিধনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং মশা মারার কামান থেকে এক গাদা কুয়াশা (fog) বের হলেও, তাতে কিন্তু মশা আর মরছে না। পরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ওস্তাদ আমাদের জনগণের সেবকেরা বলছেে ওষুধে কাজ হচ্ছে না। আসলে সর্ব বিষয়ে কমিশন ও লাভ প্রত্যাশী বঙ্গ সন্তানেরা কতটুকু যে কারচুপি করেছে, সেটা হিসেব করে বলাটা কঠিন। তবে এতটুকু তো বলাই যায় যে কোনো ওষুধেই অতিরিক্ত পানি বেশী মেশালে কার্যকারিতা থাকে না। অন্যদিকে দেশের সুযোগসন্ধানী তারকারা ঝাড়ু দিয়ে ধুলা উড়ানোর ছবি টিভিতে দেখিয়ে ও পত্রিকায় ছাপিয়ে প্রচুর বাহবা কামিয়ে নিয়েছে। ভাগ্যিস রবী ঠাকুর বেঁচে নাই। না হলে তাকে কর্ম পটীয়সী বাঙালিদের এইসব লোক দেখানো এলাহী কর্মযজ্ঞ নিয়ে তাকে “জুতা আবিষ্কার” ধরণের আরেকটা কবিতা লিখতে হতো।
যাই হোক আবার ফিরে আসি, মশা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়। মশারা তাদের দায়িত্ব পালনের জন্যে হাজার হাজার বছর ধরে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তা মানুষরা মাত্র কিছু দিন ধরতে পেরেছে। ব্যাপারটা না হয় একটু ভারী কথা বার্তা দিয়ে বলি। মশা সম্প্রদায় তাদের কাজ সুচারুভাবে করার জন্যে কয়েক ধরণের সেন্সর ব্যবহার করে থাকে। তার একটা দিয়ে ১০০ ফুট দূর থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড, ল্যাকটিক এসিড ও ঘামের গন্ধ ঠিকই ঠাহর করে ফেলে। জানেনই তো কার শরীর থেকে বেশী ঘামের গন্ধ বের হতে পারে। এয়ারকন্ডিশন রুমে বসে থাকলে কি খুব বেশী ঘাম হওয়া সম্ভব? বেচারা রিকশাওয়ালাদের সারাদিন ঘাম ঝড়িয়ে সন্ধ্যায় বাসায় এসেও রক্ষা নাই। তবে এডিস মশার দৃষ্টি শুধুমাত্র নিম্নবিত্তদের দিকে সীমাবদ্ধ নাই। সম্ভবত তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। শিকার পেলে ধনী-গরিব নিয়ে কোনো ভেদাভেদ করে না। শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু ক্ষমতাধর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে পরাস্থ হয়েছেন।
মশাদের আরও কিছু সেন্সরী ক্ষমতা আছে। সেন্সর দিয়ে মশা রঙ ও মানুষ অনায়াসে চিনে ফেলে। পরের যে সেন্সর আছে, সেটা দিয়ে মশা খবর পেয়ে যায়, চলমান বস্তুটার তাপমাত্রা আছে কি-না। এই সব সেন্সরের কারণে মশা তার শিকার চিনতে খুব বেশী ভুল করে না। আপনি কখনই দেখবেন না, মশা কোনো জড় পদার্থ যেমন টেবিল, চেয়ার, কিংবা দেয়ালে হুল ঢোকানোর চেষ্টা করছে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন লোক দেখানো কামান দাগিয়ে কেনো উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী মশা সম্প্রদায়ের ক্ষতি করা সম্ভব না। তারা তাদের নানা ধরণের সেন্সর ব্যবহার করে নিজেদেরকে বাঁচানোর উপায় বের করে নিচ্ছে। বরং তারা বাঙালিদের দারুণভাবেই ঘোল খাইয়ে চলেছে। এখন হয়তো কথায় বড় সুবিধাবাদী বাঙ্গালীদের সাইজে ক্ষুদ্র মশা সম্প্রদায়ের ছোট ছোট পা ধরে মাফ চাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, “হে সম্মানিত মশক জাতি, আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমাদের মশারির ভিতরে যেয়ে লুকাতে দিন। আমরা আপনাদের শাস্তি থকে মুক্তি চাই। চোখ বন্ধ করে শান্তিতে ঘুমাতে চাই। আপনাদের সত্যি সত্যি বলছি আমরা আর দুর্নীতি করবো না, কোনো কিছুতেই ভেজাল দিবো না। আপনারা দয়া করে আমাদের শরীরে ডেঙ্গু, চিকগুনিয়া কিংবা ম্যালেরিয়া রোগ ঢুকিয়ে দিবেন না। আমরা সুস্থ থাকতে চাই। আমরা বাঁচতে চাই। আমরা আর আপনাদের কত্থক নৃত্য দেখতে চাই না।”
আগস্ট ১০, ২০১৯
কাজী হাসান
লেখক: quazih@yahoo.com