“হ্যালো হাসান ভাই, আপনার সাথে কবে দেখা হচ্ছে?”
দেশে গেলে এই হতো আমার প্রথম ফোন কলের প্রথম অংশ। দীর্ঘ প্লেন যাত্রার পর এয়ারপোর্টের হাঙ্গামা শেষ করে উত্তরার বাসায় ঢুকতে ঢুকতে একেবারে ভোর রাত হয়ে যায়। তারপরে বিছানায় শুতে না শুতেই চোখ দুটো এমনিতেই লেগে আসে। সকাল হতে না হতেই ফোন বাজার শব্দে ঘুমটা ভাঙে। ওইদিকে থেকে মানুষটা প্রবল উৎসাহে কথা আরম্ভ করেন। মনে হয় এই সময়টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কুশল বিনিময়ের পরপরই তার সরাসরি প্রশ্ন, কবে আমাদের দেখা হচ্ছে।
প্রবাসে কাজ ও নানা বিষয়ে সংশ্লিষ্টতার কারণে শত ইচ্ছা থাকলেও দেশে দীর্ঘ সময় থাকার সুযোগ মেলে না। সব মিলিয়ে দিন দশেকের বেশী থাকা হয় না। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ছাড়াও দেশে বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করতে হয়। সেখান থেকে সময় বের করাটা বেশ কঠিন-ই বলা যায়। কিন্তু তাঁকে আমার সময় দিতেই হয়। তিনি আবার আরও কিছু মানুষকে আমার সাথে দেখা করার জন্যে আমন্ত্রণ করেন। এই আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা হতেন শিল্প-সাহিত্যের সাথে জড়িত আপনজনরা। সেখানে চলতো আড্ডা, খাওয়া দাওয়া এবং ছবি তোলা। আমার জন্যে এ হতো দেশে বেরাতে যাওয়ার বিশেষ প্রাপ্তি। কিন্তু এখন এর থেকে আমি নিদারুনভাবে বঞ্চিত হবো। কারণ দেশে পৌঁছানোর পর প্রথম কলটা যিনি করতেন এবং ক্ষুদে মিলন মেলার আয়োজন করতেন, তিনি আজ আর এই পৃথিবীতে নাই। পার্থিব সব মায়া ত্যাগ করে তিনি চলে গেছেন ওই পারে। আমি বলছি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনী সংস্থা নন্দিতা প্রকাশের কর্ণধার বিভি রঞ্জনের কথা। করোনা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে গত মাসের ১২ তারিখে (এপ্রিল ১২, ২০২১)।
বিভি রঞ্জন নন্দিতা প্রকাশ থেকে আমার লেখা তেরোটা বই প্রকাশ করে ছিলেন। আমাদের সম্পর্ক একজন লেখক ও প্রকাশকের সীমানা অল্প সময়ের মধ্যে অতিক্রম করে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। তার কর্মনিষ্ঠা, সততা ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমরা জানি বাংলাদেশের সাথে এমেরিকার সময়ের ব্যবধান বারো ঘণ্টা। তার মানে আমার দুপুর দুটো মানে বিভি রঞ্জনের রাত দুটো। আমি যখনই তার কাছ থেকে কিছু জানতে চেয়েছি, উত্তরটা প্রায়ই সাথে সাথেই চলে আসতো। একবার কথা প্রসঙ্গে জানিয়ে ছিলেন বই মেলার জন্যে তিনি দিনে আঠার ঘণ্টা কিংবা তার থেকে অধিক সময় কাজ করে থাকেন। প্রতিবছর বই মেলায় শ দুয়েক বই নন্দিতা প্রকাশ থেকে বের হতো। তার মধ্যে বেশ অনেক নতুন লেখক-কবি সুযোগ পেতো। তার মাধ্যমে এ পর্যন্ত বেশ কিছু প্রথিতযশা সাহিত্যিক বের হয়ে এসেছে। তিনি একবার কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, তার প্রকাশনার মূল আয় বই মেলার প্রকাশিত বই থেকে আসে না; বরং পাঠ্য পুস্তক ও অন্যান্য প্রকাশনা আসা মুনাফাটা বেশি। তা সত্বেও সাহিত্যের প্রতি এই অগাধ অনুরাগ, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বাংলা ও বাঙালিকে ভালোবেসে দূর প্রবাসে শত প্রতিকূলতার মাঝেও যারা সাহিত্য চর্চা করেন, তাদের কারো কারো সৃষ্টি উচ্চ মান সম্পন্ন হলেও তা মূলধারায় যেয়ে আর পৌঁছায় না। কেনো সেটা হয় না; সেই আলোচনা হয়তো অন্য কোথাও হতে পারে। তবে সংক্ষেপে বললে, আর দশটা ক্ষেত্রের মতো এখানেও প্রবাসীদের মূলধারায় প্রবেশে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা আছে। বিভি রঞ্জন বিষয়টা বুঝতেন। তিনি তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে ছিলেন আমার সৃষ্টি সবার সামনে তুলে ধরতে। প্রতিবারই তিনি স্ব-উদ্যোগী হয়ে আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠান করতেন। দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা সেখানে অতিথি হতেন। কেউ স্টল থেকে বই কিনে লেখকের অটোগ্রাফ চাইলে তিনি-ই আমার পক্ষ থেকে কাজটা করতেন। বেশ কয়েকবার আমার লেখা বই বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগার সংগ্রহ করার জন্যে নির্বাচিত করেছিল। তিনি প্রতিবারই খবরটা আমাকে মহা উৎসাহে পৌঁছে দিতেন।
আমার এক বন্ধু আশরাফ শামীম ক্যান্সারে ভুগছিল। সে আমার লেখা পড়তে ভালোবাসত। অসুস্থতার জন্যে সেবার সে মেলায় যেয়ে বই সংগ্রহ করতে পারছিল না। আমি বিভি রঞ্জনকে কথাটা জানানো মাত্রই তিনি বন্ধুটাকে বই কুরিয়ার করে পাঠিয়েছিলেন। আমার বাবাও আমার বই সংগ্রহ করেন, পড়েন ও পরিচিত-জনদের মাঝে বিতরণ করেন। তাকেও তিনি বই প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই পাঠিয়ে দিতেন। কলকাতার গৌতম শাহা আমার লেখা পছন্দ করেন। আমার বই তিনি তার কাছেও পাঠিয়ে ছিলেন। ফেসবুকে কারোর আগ্রহ তার দৃষ্টিতে আসলেই তিনি তার কাছে বই পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। আমি জানি ঠিক একই রকমভাবে বিভি রঞ্জনের কাছে আসা প্রতিটা ব্যক্তি তারা বিশাল হৃদয়ের ছোঁয়ায় মুগ্ধ হয়েছেন।
একবারেই অপ্রত্যাশিতভাবেই খবরটা এলো বিভি রঞ্জন আর নেই। দেশে গেলে তার থেকে আর ফোন কলটা আর পাবো না। তার কণ্ঠ থেকে শুনবো না, ‘হ্যালো হাসান ভাই, আপনার সাথে কবে দেখা হচ্ছে?’। পাণ্ডুলিপি কিংবা প্রচ্ছদ নিয়ে আলোচনা আর হবে না। আমরা কেউ না চাইলেও তাঁকে বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছি। তবে সান্তনার কথা হলো এই বিদায়টাই তো আর শেষ কথা না। একে বলা যেতে পারে সমাপ্তির সূত্রপাত। এক এক করে আমরা সবাই সেই যাত্রায় শরিক হবো। তার পরে অনন্তকালের পথ চলা! হয়তো সেখানে বিভি রঞ্জনের সাথে আমরাও আবার সহযাত্রী হবার সুযোগ পাবো !!
তার সাথে আনন্দের স্মৃতিগুলো কি বেদনাদায়কই না হয়ে উঠেছে! শুধু এতটুকুই সান্ত্বনা স্মৃতিগুলো আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক হয়ে থাকবে। স্মৃতিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, বিভি রঞ্জনকে তিনি যেনো শান্তিতে রাখেন।