ক্ষুদিরাম বসু 

প্রায় দুশ বছর ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ শাসন করে গেছে। শুধু শাসন বললে ভুল হবে, মূলত তারা করেছিল শোষণ। বাণিজ্যের নাম করে প্রথমে ঢুকলো, কিন্তু ছলে-বলে-কৌশলে তারা এক এক করে পুরো ভারতের শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করলো। বাংলার তাঁতি যাদের মসলিন কাপড় বানানোতে বিশ্ব জোরা খ্যতি ছিল, ব্রিটিশরা তাদের হাতের আঙ্গুল কেটে দিলো; যাতে তারা মসলিন বানাতে না পারে। কৃষকদের ধান চাষ বন্ধ করে নীল চাষে বাধ্য করলো। 

নীল তো আর পেটের ক্ষুধা মেটায় না। দেশের মানুষ অনাহারে থাকলো, বাঙালি অভুক্ত রইলো। মসলিন কাপড়ের জায়গায় স্থান করে নিলো মেশিনে বানানো কাপড়। বাংলার তাঁতিদেরও আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেল। তার পরে বাংলাকে ভেঙ্গে দু টুকরো করা হলো। ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচারে বাংলা তথা সমগ্র ভারত বর্ষের প্রতিটা মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। 

দেশের মাটিতে লাল মুখো বিদেশীদের একের পর এক যন্ত্রণার বিপক্ষে প্রতিবাদ আরম্ভ হলো। ঠিক হলো ব্রিটিশদের ভারত থেকে খেদাতে হবে। কিন্তু কাজটা এতো সহজ না। তাদের ছিল আধুনিক গোলা বারুদ আর অস্ত্র-শস্ত্র। তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা কামানের গোলা দিয়ে গুড়িয়ে দিলো। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্যে তারা প্রতিবাদকারীদের ধ্বংস করতে প্রস্তুত। সেখানে তারা কোন ছাড় দিবে না। 

বাংলার দামাল ছেলেরা অস্থির হয়ে পড়ল। এই লাল মুখো বিদেশিদের শুধু প্রতিরোধ করেই বাড়ি পাঠানো যাবে না, তাদের উপরে আঘাত হানতে হবে। কিন্তু সেটা তো আর সহজ কথা না। কঠিন আইন চালু আছে। ব্রিটিশদের বিপক্ষে কিছু করলেই, সেটা হয় দেশদ্রোহিতা। তার জন্যে ভীষণ কঠিন শাস্তি। বিদ্রোহীদের ফাঁসির মঞ্চে পাঠাতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না। দেশান্তরি করে দূরের দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া, দীর্ঘ মেয়াদি জেল, শারীরিক অত্যাচার-তো আছেই।

এত কিছুরে পরেও, ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্যে প্রথম যে বোমা ছুড়ে মারার কাজটা করেছিল, তার নাম ক্ষুদিরাম বসু। যখন সেই এই বিশাল দুঃসাহসিক ঘটনা করলো, তখন তার বয়স সবে ১৯।

ক্ষুদিরামের জন্ম ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। অল্প বয়সে মা বাবা মারা যায়। বড় বোন অপরূপা দেবীর কাছে বেড়ে উঠা। ‘ক্ষুদিরাম’ নাম হওয়া নিয়ে খুবও একটা মজার গল্প আছে। বাবা-মা’র কয়েকজন কন্যা সন্তান থাকলেও, কোন জীবিত পুত্র সন্তান ছিল না। সে সময়ে একটা সংস্কার ছিল। কয়েক জন মৃত শিশুর পরে, জীবিত পুত্রকে, মা সব লৌকিক অধিকার ছেড়ে দেয়ার ভান করতেন। তখন কেউ পুত্র সন্তানকে কড়ি অথবা খুদ দিয়ে কিনে নিত। বড় বোন অপরূপা দেবী তিন মুঠো খুদ দিয়ে ভাইকে কিনেছিলেন। তাই তার নাম হয়ে যায় ক্ষুদিরাম। 

বাবা মা মারা যাওয়ার পর ক্ষুদিরাম দূর সম্পর্কের এক দাদা ও বৌদির কাছে যেয়ে উঠলো। কিন্তু ৮ বছরের বালকের যে আদর-স্নেহ পাবার কথা, সেটা কপালে জুটলো না। মেলা কাজ করতে হতো, আর ছিল কথায় কথায় শাস্তি। সেই জন্য স্কুলের পড়া লেখায় একদম মন বসলো না। খেলাধুলা, ব্যায়াম আর ডিটেকটিভ বই ছিল ভীষণ প্রিয়। কোন এডভেঞ্চারের কাজ পেলে, সবার আগে এগিয়ে যেত ক্ষুদিরাম। 

বেচারা বেশিদিন দাদা-বউদির সাথে টিকতে পারলো না। মেদিনীপুরে বোন অপরূপা দেবীর কাছে ফিরে এলো। প্রথমে তাকে ভর্তি করা হলো, মেদিনীপুর হ্যামিলটন স্কুলে। তার পরে তাকে দেয়া হল সেখানকার কলেজিয়েট স্কুলে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় ক্ষুদিরাম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, পড়ালেখা তার কর্ম না। এর থেকে অনেক বড় কাজ তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

ক্লাসে অমনোযোগী আর ফাঁকি দেয়ার জন্যে ক্ষুদিরামকে শিক্ষকদের কাছে শাস্তি পেতে হতো। সম বয়স্ক বাউণ্ডুলে ও বখাটে ছেলেদের জড় করে তাদের নেতা হয়ে গেল; নাম দিল “ভূত ধরা ও তাড়ানোর দল” সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করার জন্যে তার এই প্রচেষ্টা। দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড তার প্রিয় হয়ে উঠলো। দেশ থেকে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ঝাটিয়ে দূর করার পরিকল্পনা মাথার মধ্যে খেলতে থাকলো। 

সে সময়ে পরিচয় হয় সত্যেন বসু নামে এক বিপ্লবীর সাথে। তার একটা সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন ছিল; নাম ‘যুগান্তর’। এদের আদর্শে, ক্ষুদিরাম খুব সহজেই অনুপ্রাণিত হলো ও সক্রিয় সদস্য হয়ে পড়লো। অন্যান্য বিপ্লবীদের স্নেহ-আদর, তাকে আরও বেশী উৎসাহিত করলো। এদের সংস্পর্শে এসে রাজনৈতিক জ্ঞান বাড়তে থাকলো। সে পণ করে ফেললো, যে কোন মূল্যে দখলদার ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বদেশকে উদ্ধার করতে হবে। 

এই সংগঠনে ব্রিটিশদের সাথে লড়ার জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। সেখানে লাঠিখেলা, তলোয়ার চালানো, বোমা ফাটানো, পিস্তল, বন্দুকের ব্যবহার ইত্যাদি শেখানো হত। যেহেতু ক্ষুদিরামের আগ্রহ বেশী ছিল, সে জন্যে অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেল।

১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। মেদিনীপুরের মারাঠা কেল্লায় এক শিল্প প্রদর্শনী হচ্ছিল। বিষয়বস্তু ছিল ব্রিটিশদের অধীনে ভারতের উন্নতি ও পরিবর্তন তুলে ধরা। সেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছিল। সেখানে ক্ষুদিরাম “সোনার বাংলা” নামে এক বিপ্লবী পত্রিকা বিলি আরম্ভ করে। ব্রিটিশদের অনুগত মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এক ব্রিটিশ পুলিশ এসে ক্ষুদিরাম থেকে পত্রিকাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে, তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলো। 

ক্ষুদিরাম পুলিশকে চিৎকার করে বলেছিল, খবরদার আমার হাত ধরবে না। কথা শেষ করেই, নিজেকে ঝটকা দিয়ে পুলিশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়েই, পুলিশের নাকে সজোরে একটা ঘুসি মেরে পালিয়ে গেল। এ জন্যে অবশ্য মামলা হয়। বিচারপতি ক্ষুদিরামের বয়স কম হওয়ার জন্যে ক্ষমা করে দেন। 

পরের বছর ক্ষুদিরাম ডাক হরকরার মেল ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। সেখান থেকে বেশ অর্থ প্রাপ্তি হয়। সেগুলো সে সংগঠনের কাজের জন্যে খরচের জন্যে দিয়ে দেয়।

সেই সময়ে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের নাম ছিল কিংসফোর্ড। বিপ্লবীদের রাষ্ট্রদোহী আখ্যা দিয়ে কঠিন সব শাস্তি দিতো। তার মনে ভারতীয়দের জন্যে সামান্যতম মায়া-দয়া পর্যন্ত ছিল না। একের পর এক বিপ্লবীদের ফাঁসি আর সুদীর্ঘ দিনের জেল দেয়ার জন্যে কুখ্যাতি ছিল। বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিল কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে হবে। 

দায়িত্ব পেল ক্ষুদিরাম ও রংপুরের ছেলে প্রফুল্ল চাকী। ব্রিটিশরা এর মধ্যে আঁচ করে ফেললো, কিংসফোর্ডের উপর আক্রমণ হতে পারে। তাকে পাঠিয়ে দেয়া হল মোজাফরপুরে । দুই ক্ষুদে বিপ্লবী সেখানে গেল। সারাদিন ধরে গতিবিধি লক্ষ করলো। কিংসফোর্ডের বাসার পাশেই ইয়োরোপিয়ান ক্লাব। বাসা, অফিস, ক্লাব--এই তিন জায়গা ছাড়া সে আর কোথাও যায় না।

তারিখ সেদিন ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল। এডভোকেট কেনেডি নামে এক ইংরেজের স্ত্রী ও কন্যা কিংসফোর্ডের গাড়ির মত আরেকটা গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিল। ক্ষুদিরাম ভুল গাড়িতে বোমা ছুড়ে মারলো। প্রবল শব্দে যেন পুরো শহর কেঁপে উঠলো। গাড়ির দু জন আরোহী ঘটনাস্থলেই মারা গেল। কিন্তু যাকে মারার জন্যে এত আয়োজন, সেই কিংসফোর্ড মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়েছিল। 

পরিকল্পনা অনুযায়ী, বোমা ছুড়েই দু বিপ্লবী, দু দিকে পালালো। কিন্তু রক্ষা হল না। প্রফুল্ল চাকী পুলিশের হাতে ধরা পড়া মাত্রই, নিজের পিস্তল দিয়ে নিজেকে গুলি করলো; তাতেই তার মৃত্যু হলো। অন্যদিকে ক্ষুদিরামকেও পুলিশে ধরে ফেললো ওয়াইসি রেলস্টেশনে। এর মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, এই দুঃসাহসিক বাঙালির কর্মকাণ্ডের কথা। ক্ষুদিরামকে দেখতে হাজার হাজার মানুষ জড় হলো রেলস্টেশনে। সে পুলিশের হাতে বন্দী। তাতে কি যায় আসে? জনগণের উদ্দেশ্য সে চিৎকার করে বলে, বন্দে মাতরম। 

সমগ্র ভারত ছড়িয়ে পড়লো বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর কথা। দেশে বিদেশে এই ঝুঁকিপূর্ণ তরুণ কিশোরকে নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ , উন্মাদনা তৈরি হলো। খুব দ্রুততার সাথে ব্রিটিশ রাজ বিচার কাজ শেষ করলো। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা মোতাবেক ক্ষুদিরামকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। 

১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট কোলকাতা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে লক্ষ্য মানুষের ভিড়। তারা গলার সব শক্তি এক জায়গায় করে শ্লোগান দিলো, বন্দে মাতরম, বন্দে মাতরম। সকাল ৬ টার সময় ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর করা হলো। জেলার জানতে চাইলেন, তার শেষ কোন কথা আছে কি-না? উত্তরে ক্ষুদিরাম বসু জানালো, আমি খুব ভালো বোমা বানাতে পারি। সেটা আমি ভারত বর্ষের সবাইকে শিখিয়ে যেতে চাই।

পরের দিন ১২ আগস্ট অমৃতা বাজার পত্রিকায় শিরোনাম হল, “ক্ষুদিরামে ফাঁসি: প্রফুল্ল চিত্তে ও হাসি মুখে মৃত্যু।” তার সাথে লেখা , ক্ষুদিরামের ফাঁসি সকাল ৬ টায় কার্যকর করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে সে খুব শান্ত-সৌম্য ভাবে হেটে যায়। এমনকি মাথায় টুপি পরিয়ে দেয়ার সময়ে, তার মুখে মুচকি হাসি ছিল।” ব্রিটিশ পত্রিকা এম্পায়ার (Empire) লিখেছিল, ক্ষুদিরাম বসু হাসি মুখে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিল। 

দু মুঠো খুদ দিয়ে কেনা ১৯ বছরের টগবগে তরুণ ক্ষুদিরাম বসু হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছিল, দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্যে। তার ইচ্ছা ছিল, বোমা বানানোর কৌশল স্বাধীনতা পিয়াসু মানুষদের শিখিয়ে যাওয়ার। ক্ষুদিরাম মারা গেছে আজ এক শত বছরের বেশী হয়েছে। দু মুঠো খুদ দিয়ে কেনা বাঙালি ছেলে ক্ষুদিরাম, পুরো ভারত বর্ষের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯৭১ সালে ত্রিশ লক্ষ্য প্রাণ যে ঝড়ে পড়েছিল, তারা প্রত্যেকেই ছিল একই চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ একেকটা বোমা, একেকটা ক্ষুদিরাম। 

ক্ষুদিরামের প্রিয় পত্রিকা নাম ছিল “সোনার বাংলা”, আজ সেটা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের জ্বলন্ত দুটো শব্দ।

তাকে নিয়ে লেখা একটা বিখ্যাত গান, যা যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আসছে, সেটা তোমাদের জন্যে উদ্ধৃত করছি: 

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।

হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।

কলের বোমা তৈরি করে

দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,

বড়লাটকে মারতে গিয়ে

মারলাম আরেক ইংলন্ডবাসী।

হাতে যদি থাকতো ছোরা

তোর ক্ষুদি কি পড়তো ধরা মাগো

রক্ত-মাংসে এক করিতাম

দেখতো জগতবাসী।

শনিবার বেলা দশটার পরে

জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো

হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি।

বারো লক্ষ তেত্রিশ কোটি

রইলো মা তোর বেটা বেটি মাগো,

তাদের নিয়ে ঘর করিস মা

ওদের করিস দাসী।

দশ মাস দশদিন পরে

জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো

তখন যদি না চিনতে পারিস

দেখবি গলায় ফাঁসি।

 

নভেম্বর ১১, ২০১৫