gray vest

খোলা হাওয়ায়

নাম তার আফজাল হোসেন।

বিখ্যাত এক টিভির নায়কের সাথে নাম মিলে যাবার জন্যে মাঝে মধ্যেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কিছু মানুষে তাকে নায়ক আফজাল বলে ভুল করে; বন্ধুরা সুযোগ পেলেই খেপায়। ঝামেলাটায় একেবারে সেই স্কুল জীবন থেকে ভুগছে। সে যখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ে, আফজাল হোসেন তখন ছোট পর্দা কাঁপানো নায়ক। টিভি চ্যানেল সে সময়ে ছিলে সবেধন একখানা; বিটিভি। ‘এ সপ্তাহের নাটক’ দেখার জন্যে পুরো দেশ যেন উন্মুখ হয়ে থাকে। নাটক চলাকালীন সময়ে পথে ঘাটে মানুষজনের চলাচল পর্যন্ত কমে যেতো। বিটিভি অবশ্য সে সময়ে দারুণ সব নাটক বানাতো। বাণিজ্য না শিল্প সেখানে মুখ্য ছিল। আসাদুজ্জামান নুর, হুমায়ুন ফরিদি, সুবর্ণা মুস্তাফা, আফজাল হোসেনের মতো জাঁদরেল সব অভিনেতারা নাটকে কাজ করতেন। তবে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে যার সব চেয়ে বেশী খ্যাতি ছিল, তিনি হলেন আফজাল হোসেন। মেলা তরুণীর ক্রাশ ছিল তার উপর। আর উঠতি ছেলেদের খায়েস ছিল আফজাল হোসেন হওয়ার।

যাই হোক গল্পের আফজাল হোসেনের সাথে নাটকের আফজাল হোসেনের সাথে বয়সের বিস্তর পার্থক্য থাকলেও সে কিন্তু ধীরে ধীরে লম্বা হতে হতে নায়কের সমান লম্বা হয়ে গেল। ছোট শরীরটাও বড় হয়ে উঠলো। মানুষের ভুল করার মাত্রাও বাড়তে লাগলো। কাছের মানুষরা বুদ্ধি দেয়া আরম্ভ করলো অভিনয়ে ঢুকে পড়ার জন্যে। কেউ কেউ জুড়ে দিলো, “আফজাল হোসেন ইদানীং অভিনয় কমিয়ে দিয়েছে, তোমার জন্যে এখন সুবর্ণ সুযোগ। গেলেই একেবারে মাৎ করে ফেলবে।” কিন্তু যাকে নিয়ে এতো কথা তার অভিনয় নিয়ে কিন্তু একেবারেই আগ্রহ নাই। অন্যদিকে আফজাল হোসেন নাটকে অভিনয় কমাতে কমাতে এমন পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছল, বছর ঘুরে যায় কিন্তু তার অভিনীত নতুন কোনো নাটক একটিও টিভি চ্যানেল প্রচার করে না। আগে তাকে একমাত্র টিভি চ্যানেলে প্রায়ই দেখা যেতো , আর এখন একগাদা টিভি চ্যানেলের কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার মানে তিনি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন; অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তাতে অন্য আফজাল হোসেনের ঝামেলা বাড়তে লাগলো। মাঝে মাঝে তার মধ্যে নাটকের মানুষরা অভিনেতাকে খুঁজে পেয়ে কাজ করার অফার দেয়। কিন্তু ভুক্তভোগী আফজাল কোন ভাবেই অভিনয়ে সম্মতি দেয় নি।

আসলে সম্মতি দেয়ার সুযোগই বা কোথায়? আফজালের লক্ষ্য একেবারে ভিন্ন। অঙ্ক, বিজ্ঞান দুটোই তার প্রিয় বিষয়। বাবা, মা চাচ্ছিলেন ছেলে বাবার মতো ডাক্তার হউক। কিন্তু ছেলের ঝোঁক অন্যদিকে। সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাও আবার এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। মানে রকেট, প্লেন নিয়ে কাজ করবে। বাবা মা’কে ফিসফিস করে বলেছিলেন, “বাংলাদেশে না আছে প্লেনের ফ্যাক্টরি, না এখন থেকে চাঁদে রকেট পাঠানো হয়। ওই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে ছেলে দেশে থাকবে না।” আফজাল ঠিকই বাবা-মা’র উদ্বেগটা ধরে ফেললো। তাদের অভয় দিয়ে জানালো, বাংলাদেশে এখনো এরোনটিক্যাল পড়ানো হয় না। প্রথমে সে ঢাকায় ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। তার পরে বিদেশে যেয়ে এরোনটিক্যাল পড়ে আসবে। আর ততদিনে বাংলাদেশে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা তৈরি হয়ে যাবে। বাবা-মা এই সব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে মন খারাপ করার কিছু নাই। তাদের ছেলে তাদের কাছাকাছিই থাকবে। মাত্র কয়েক বছরের শুধু বিদেশে যেয়ে থেকে আসবে।

আফজাল বাবা মা ‘র ইচ্ছার প্রতি সহনশীল হলেও, মাঝে মাঝে এমন সব ঘটনা করতো; যা অন্যরা শুনলে আঁতকে উঠবে। গ্রামে যেয়ে একবার খালি হাতে সাপ ধরলো। তখন সে মাত্র ম্যাট্রিক দিয়েছে। মা বললেন গ্রাম থেকে ঘুরে আসতে। সেখানে মা’ র এক চাচাতো চাই আছেন। অন্য আত্মীয়রা অনেক আগেই গ্রাম ছেড়ে শহর কিংবা বিদেশে চলে গেছে। শফিক মামা মায়ের থেকে বয়সে কিছু বড়। দুই পরিবারের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক। মামা শহরে আসলেই ওদের বাসায় উঠতেন। মামা গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। রাজনীতি করেন। অর্থ সম্পদ ভালোই। তার বাসায় মা পাঠিয়ে দিলেন কিছুদিনের জন্যে গ্রাম দেখে আসতে। ঘটনার দিন সকাল বেলা বাসার পুরুষ মানুষরা সব কাজে কর্মে বের হয়ে পড়েছিল। আফজাল যেহেতু ছুটি কাটাতে গেছে এবং সুযোগ একটা পেয়েছে; সে বেশ দেরী করে ঘুম থেকে উঠতো। বাসায় থাকলে, মা শুক্রবার কি সোমবার ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে দেন। এতে কোন মাফ নাই। তার কথা ঘুম থেকে দেরী করে উঠলে বাসার লক্ষ্মী চলে যায়। আফজাল কথাটার কোন যুক্তি খুঁজে পায় নি। যাই হোক মামার বাসায় এসে বেশ বেলা করে সে উঠছে।

হঠাৎ হৈ চৈ’র শব্দে আফজালের ঘুম ভেঙ্গে গেল। বেলা তখন দশটা-সাড়ে দশটাতো হবেই। চোখ ঢলতে ঢলতে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো। উঠোনে ইয়া বড় একটা সাপ। বাড়ির অনেকেই দৌড়ে পালিয়েছে। মামী আর দু জন কাজের মহিলা যা যা করে শব্দ করছেন। ভাবটা এ রকম তাদের কথা শুনে সাপ চলে যাব। ও রকম সময়ে ঘরের থেকে আফজালকে বের হতে দেখে মামী চিৎকার করে উঠলেন, “এই দিনে এসো না। এখানে বিরাট একটা সাপ, কামড় দিবে।” এইবার আফজালও দেখতে পেলো বড় একটা গোখরো সাপ ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে। সাপটা সমূহ বিপদ আন্দাজ করে ফেলেছে। সে প্রস্তুত আত্মরক্ষায় তার মরণ কামড় বসিয়ে দিতে। আফজাল হাতের ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলে ধীরে ধীরে সাপটার দিকে এগিয়ে গেল। উপস্থিত যারা ছিল কেউ বুঝতে পারলো না ছেলেটা কি করতে যাচ্ছে। এইবার সে ভীষণ সাহসের কাজটা করলো। ডান হাত দিয়ে চট করে সাপটার মুখের ঠিক নিচে চেপে ধরলো। বাম হাত দিয়ে সাপটার অন্য অংশ হাতে তুলে নিলো। তার পরে মামীকে চিৎকার করে বলল, “মামী বড় একটা কিছু দেন। সাপটাকে ওর মধ্যে আটকে রাখবো। মামী প্রথমে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও, এক মিনিটের মধ্যে একটা বিশাল হাড়ি নিয়ে হাজির হলেন। আফজাল সাপটাকে হাড়ির মধ্যে ছুড়ে মেরে ঢাকনাটা দিয়ে দিলো। আর যারা ছিল দৌড়ে এসে হাড়ির ঢাকনার উপর ভারী পাথর রাখলো। পরে এক সাপুড়ে এসে সাপটাকে নিয়ে গেল।

চারিদিকে আফজালের সাহসিকতার খবর ছড়িয়ে পড়লো। খবর পেয়ে মামা ছুটে আসলেন। ভাগনার সাহসিকতায় মুগ্ধ হলেও, উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ বাবা, তোমার এত ভয়ঙ্কর কাজটা করা ঠিক হয় নি। যদি সাপটা কামড় বসিয়ে দিতো।” আফজাল শান্ত গলায় উত্তর দিলো, “মামা, ওই ভাবেই সাপ ধরতে হয়।” এমনভাবে বলল যেন তার সাপ ধরার উপর যেন ট্রেনিং নেয়া আছে। মামা ফোন করে মা কে জানালেন। মা ওই দিক থেকে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ফোন করলেন। ছেলে বেশ বিরক্ত হয়ে মাকে জানাল, “এতো আতঙ্কের কি আছে? আমি টিভিতে দেখেছি, তাই কাজটা করেছি। তা ছাড়া আমি জানতাম আমার কাজটা করতে কোন অসুবিধা হবে না।” মা ওই দিক থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন, এই ছেলে আর কত যে অদ্ভুত সব কাজ করবে!

এ রকম ঘটনা অনেক বলা যেতে পারে। তার মধ্যে আরেকটা বলি। সাপ মারার ঘটনার বছর দু য়েক পরের কথা। সে তখন ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায়। কয়েক বন্ধু মিলে গেল পাহাড়ি এলাকা সীতাকুণ্ডে বেড়াতে। পাহাড়ের মাথায় একটা মন্দির আছে। কথিত আছে সীতাকে রাবণ যখন হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলো, সীতা তার অলংকার শরীর থেকে খুলে ফেলতে ফেলতে যাচ্ছিলো, যাতে রাম তাকে পরে খুঁজে পায়। এখানকার পাহাড়ের চূড়ায় সীতার সে রকম ফেলা দেয়া একটা অলংকার পড়েছিল। সেই ঘটনার স্মরণে পাহাড়ের চূড়ায় একটা মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। তীর্থ যাত্রীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে বিশাল কোন হৃদয়বান পাহাড়ের গোঁড়া থেকে চুড়া পর্যন্ত পাকা সিঁড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। পাহাড়টা কত উঁচু? সেটা অবশ্য ঠিক জানা নাই। তবে কম পক্ষে বিশ তলা বিল্ডিঙের উচ্চতার তো হবেই। আফজাল ও তার বন্ধুরা সিঁড়ি বেয়ে মহা উৎসাহে উঠা আরম্ভ করলো। ওদের ধারণা ছিল ওরা একটানে চূড়ায় উঠবে। মন্দির দেখা শেষ হলে আবার হুড়াহুড়ি করে নেমে আসবে। কিন্তু যে রকম ভেবেছিল, ও রকম হলো না। সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা উঠতেই হাঁপিয়ে উঠলো।

কিংবদন্তিতে আছে রাম যখন বনবাসে ছিলেন তখন সীতার গোসল করার জন্যে এই এলাকায় একটা কুণ্ড মানে পুকুর কেটে দেয়া হয়েছিল। তার থেকেই জায়গাটার নাম হয়ে যায় সীতাকুণ্ড। তা ছাড়া পাহাড় বেয়ে বেশ কিছু মনোহারিণী ঝর্ণা থেকে পানি সারাক্ষণ ঝরেই চলেছে। উষ্ণ প্রস্রবণও আছে। সেখানকার পানি সারাক্ষণ উষ্ণই থাকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে যখন সুফি সাধকরা ধর্ম প্রচারে এসে এখানে আস্তানা গেড়েছিলেন। সে জন্যে এ অঞ্চলে বেশ কিছু সুফিদের মাজারও আছে এখানে। সে জন্যে দেখা যায় হিন্দু, মুসলমান--- দু ধর্মের মানুষদের এখানে সারা বছর ধরেই আনাগোনা। তবে যে ধর্মের মানুষই হউক না কেন, বেশীর ভাগ মানুষেরই লক্ষ্য থাকে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের চুড়ার মন্দিরটা ঘুরে আসা।

বিভিন্ন ধরণের ও বয়সের মানুষরা তাদের সাথে সাথে উঠছিলো। সিঁড়িগুলো বেশ খাড়া হওয়ার কারণে অল্প কিছু উপরে উঠার পর পরই পর্যটকরা ক্লান্ত হওয়ার কারণে জিরিয়ে নিচ্ছিলো। এইভাবে উঠার একটাই আনন্দ; উঠতে কষ্ট হলেও নামা একেবারে সহজ হবে। মাধ্যাকর্ষণের টানে একেবারে সাই সাই করে নেমে আসবে। যাই হোক, মন্দির দেখে নামার সময়ে বিপত্তি হলো। চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা খুব দ্রুত গতিতে নামছিল। এতে পিছলে পড়ে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকে। সে জন্যে মা তাকে কোলে নিয়ে নামা আরম্ভ করলো। কিন্তু বিষয়টা সহজ হলো না। এই বয়সের বাচ্চাদের কম হলেও একটা ওজন আছে। মায়ের তার সন্তান নিয়ে নামতে নামতে একেবারে কাহিল হওয়ার অবস্থা। এক পর্যায়ে বেচারি মা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেল। আর কোলের শিশুটা হাত থেকে ছিটকে চলে গেল। ঘটনাটা এমন জায়গায় হলো যেখানে পাহাড়টা সরাসরি ঢালু হয়ে গেছে। শিশুটা গড়াতে গড়াতে নিচের দিকে চলে গেল।

শিশুটার মা ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে কি করবে সে বুঝে পেলো না। যখন বুঝলো প্রিয় সন্তান অনেক নিদে যেয়ে পড়েছে; মুখ থেকে তার বিরাট একটা আর্ত চিৎকার বের হয়ে এলো। অর্থ অনেকটা এ রকম তোমরা কেউ আমার বাচ্চাটাকে সুস্থ-সবলভাবে ফিরিয়ে এনে দাও। আফজালরা ছিল পাঁচ জনের দল। তারা সবাই ঘটনাটার একেবারে চাক্ষুষ সাক্ষী। অবশ্য ওরা ছাড়াও আরও কিছু মানুষ বিষয়টা দেখেছে। কিন্তু কী করা যেতে পারে সেটা কারোর মাথায় খেলছিল না। অজানা আশংকায় সবার মাথায় খেলে গেল। ছেলেটা বেঁচে আছে তো। যদি বেঁচে থাকে, তা হলে এখনই উদ্ধার করার দরকার। উপর থেকে ঠিক দেখাও যাচ্ছে না ছেলেটা কোথায় যেয়ে পড়লো। পাহাড়ের এই জায়গাটা এমনভাবে খাড়া হয়ে নেমে গেছে, যে কেউ নেমে যেয়ে দেখবে সেটা চিন্তা করাটাই কঠিন। একেবারে মৃত্যুকূপ বলা যেতে পারে।

মন্দিরের পাশে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসেছে। ওদের খবর দেয়া যেতে পারে। তার মানে কাউকে আবার ছুটে উপরে উঠতে হবে। সেটা করতে সময় লাগবে। তাদের খবর দিয়েই বা কি হবে? তাদের পাহাড়ে উঠা-নামার প্রশিক্ষণ থাকতে পারে। তাদের কেউ দ্রুত নেমে যেয়ে শিশুটাকে তুলে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কারোর মাথাতেই বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। কেউ বাংলাদেশের পুলিশকে পাহাড় বেয়ে উঠা নামা করতে দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না। তা ছাড়া কয়েকজন পেট মোটা পুলিশও সেখানে ছিল। তাদের প্রশিক্ষণ থাকলেও এখন তারা কাজটা করতে গেলে নিজেদের বিপদই ডেকে আনবে। মুখে আলোচনা না করলেও আইডিয়াটা সবাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। কী করা যেতে পারে? নাহ কারোর মাথার থেকেই যুতসই কিছু বের হলো না। কিন্তু হাতে সময় একেবারেই নাই। বাচ্চা ছেলেটা যদি কোন ঝোপ ঝাঁরে আটকে থাকে দ্রুতই উদ্ধার করার দরকার। না হলে আরও নিচের দিকে পড়তে থাকবে। বিপদের আশঙ্কা হু হু করে বেড়ে যাবে।

হঠাৎ দেখা গেল কেউ একজন সিঁড়ি থেকে লাফ নিয়ে পাহাড়ের বাকে যেয়ে পড়লো। তারপরে সাই সাই করে নিচের দিকে নামতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সে অন্যদের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল। অন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা। কে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এইভাবে নেমে চলেছে একটা শিশুর খোঁজে। সে ঠিকভাবে ফিরে আসতে পারবে তো? সাথে বাচ্চাটা থাকবে তো? বাচ্চাটা সুস্থ আছে তো? বন্ধুদের বুঝতে কোন সমস্যা হলো না এই কাজটা কে করছে। আফজাল ছাড়া যে এই কাজ এখানে আর কেউ করতে পারে না, সেটা তারা মুহূর্তের মধ্যেই ধরে ফেললো। এ রকম সাহসিকতার কাজ আগেও সে মেলা করেছে কী না। কিন্তু আজকেরটা খুব বেশী ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল। এ রকম খাড়া পাহাড় ধরে নামতে যেয়ে যদি পা পিছলে পড়ে, কিংবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে; তা হলে খালাম্মা মানে আফজালের মাকে তারা কি উত্তর দিবে? ওদের আসলে আফজালকে ঠেকানো উচিত ছিল কার না কার বাচ্চা, তার জন্যে নিজের জীবন দেয়া কিংবা হাত-পা ভাঙার কোন মানে হতে পারে না।

মাঝে মিনিট দশেক পার হয়ে গেল। সবাই রুদ্ধ শ্বাসে অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে আরও মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। তাদের মুখ থেকে বিভিন্ন ধরণের মন্তব্য বের হতে লাগলো। কারোর মতে মা’টা একেবারে দায়িত্ব জ্ঞানহীন। ছেলেটাকে শক্ত করে ধরবে না! কিছু মানুষ আফজালের সাহসের নিন্দা করতেও ছাড়লো না। একটা ছোট শিশু গেছে, সে জন্যে একটা যুবককেও প্রাণ দিতে হবে না-কি? অন্যরা আফজালের কাজে বাহবা দিতে দ্বিধা করলো না। এ রকম কিছু সৎ, সাহসী, পরোপকারী যুবক আছে বলেই বাংলাদেশ এখনো টিকে আছে।

প্রথমে আফজালের বন্ধু সেলিম দেখলো বন্ধুর মাথা দেখা যাচ্ছে। চিৎকার করে সে বলল, “ওই, ওই আফজালের মাথা দেখা যাচ্ছে।” সাথে সাথে সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ গেল পাহাড়টা যেখানে ঢালু হয়ে খাড়া নেমে গেছে। ওখানে ধীরে ধীরে আফজালের মাথা দৃশ্যমান হচ্ছে। বন্ধুরা কিছুটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আর যাই হোক খালাম্মার কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। কিন্তু পরের কথাটা হলো ও কি বাচ্চাটা নিয়ে ফিরছে? কায়মনোবাক্যে সবাই চাচ্ছিল ও যাতে খালি হাতে না ফিরে। শিশুটাকে যাতে জীবিত নিয়েই ফিরে। কয়েকজন উত্তেজনায় চোখ বন্ধ করে সৃষ্টি কর্তাকে ডাকা আরম্ভ করলো। বিধাতাও উপস্থিত কাউকে হতাশ করলেন না। এক হাতে বাচ্চা নিয়ে আফজালকে খুব সাবধানে উঠতে হচ্ছিল। সে জন্য সময়টা অনেক বেশী লাগছিল। দু জন দেখতে পেয়ে সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আফজাল ধীর পায়ে এসে মায়ের হাতে তার সন্তান তুলে দিয়ে বলল, “আল্লাহ’র অশেষ রহমত। বাচ্চাটা গড়াতে গড়াতে একটা ঝোপে যেয়ে আটকা পড়েছিল। আমি ওখান থেকেই তুলে নিয়ে এসেছি। আসলে খুব সাবধানে কাজটা করতে হয়েছে। একটু ওজন পড়লেই ঝোপ গলে ছেলেটা পড়ে যেতো। সে জন্য তুলে আনতে সময়টা বেশী লেগেছে।” আফজাল এমনভাবে কথা গুলো বলল যেনো সময় বেশী লাগার জন্যে খুব লজ্জিত। মা সন্তানকে কোলে নিয়ে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো।

বছরের ৩৬৫ দিন এক এক করে পার করতে দীর্ঘ সময় মনে হতে পারে; কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে এই সময়টাকে চট করেই রোমন্থন করে আসা যেতে পারে। শুধু এক বছর কেনো আরও অনেক লম্বা সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা মুহূর্তের মধ্যেই স্মরণ হয়ে যায়। আমাদের আফজাল হোসেনকে যে এক সময়ে নায়ক হওয়ার জন্য অফার পেতো সময়ের সাথে সেটা এখন অতীত হয়ে গেছে। বড় বড় বাস্তব এডভেঞ্চারের প্রাক্তন নায়ক মোটামুটি নির্ভেজাল জীবন পার করছে। ভোর বেলায় উঠে অফিসে চলে যায়। সকাল ছয়টার সময়ে আফজাল ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা। রাস্তায় ট্রাফিক খারাপ হলে ফিরতে আরও দেরী হয়। ফিরে আসার পর দুনিয়ার ক্লান্তি এসে ভর করে। কিন্তু তাতেই বা কি। ঘরে এসে রাতের খাবার রেডি করা, খাওয়া-দাওয়া, পরের দিনের কাপড়-চোপড় রেডি করে বিছানায় যেতে যেতে বেশ রাত। তার পরে সেই কাকা ডাকা সকালে উঠে আবার ছোটা। অবশ্য উইক এন্ডে কিছুটা আরাম। একটু দেরি করে উঠা, তার পরে এক গাদা কাজ। কাপড় চোপড় লন্ড্রি করা, বাজার করা ইত্যাদি ইত্যাদি। তার পরে শুধু একজনের কাজ না। আরও একজনের গৃহস্থালির সব কাজ আফজাল করে দেয়।

এই আরেকজনটা কে? বলছি। সে কিন্তু নিজের সব কাজ নিজেই করতে জানে। সে ওইভাবেই বড় হয়েছে। আফজালই মেয়েটাকে কোন কাজ করতে দেয় না। কেন দেয় না? মেয়েটাও আফজালের সাথে সেই ভোরে উঠে। তার অফিস বাসার থেকে প্রায় মেইল বিশেক। ড্রাইভ করে যেতে আধা ঘণ্টার মতো লাগে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত। তখন দু জনই ক্লান্ত। কিন্তু আফজালের ধারণা সে যেহেতু শক্ত সমর্থ পুরুষ, সে জন্যে তাকে অবশ্যই মহিলাদের থেকে বেশী কাজ করতে হবে। সেটা হউক না বাসা কিংবা বাইরের কাজ। বাইরে যেহেতু দু জনে সম পরিমাণ কাজ করছে; তাকে বাসায় কাজের দিক থেকে এগিয়ে থাকতে হবে। যা ভাবা সেই কাজ। বাড়িতে ফিরে আফজাল নতুন উৎসাহে ঝাঁপিয়ে বাড়ির কাজ গুলো সারে। তবে এক দিক দিয়ে ভালো; বাড়িতে সদস্য সংখ্যা মাত্র দুই। না হলে আফজালের কাজের পরিমাণ হয়তো আরও বেড়ে যেতো।

মেয়েটার নাম শেরী স্মিথ। সিনেমার নায়িকার মতোই সুন্দরী। লম্বা, শুকনো, খাড়া নাক আর সোনালী চুল। আফজালের সাথে দেখা ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায়। আফজাল ইকোনমিক্সে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে মাস্টার্স করতে এসেছিল। যদিও এক সময়ে তার এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু সেটা পরে আর হয়ে উঠে নি। সে অর্থনীতি নিয়ে পড়ছিল। যাই হোক, এতো নামী দামী স্কুলে স্কলারশিপ পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার না। তার পরেও সেখানে সুযোগ হয়ে গেল। আফজাল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করার সময়ে মাইক্রো ইকোনমিক্স’র সামাজিক প্রভাবের একটা রিসার্চ প্রজেক্ট করেছিল। এর জন্যে ডিপার্টমেন্টে কিছুটা স্বীকৃতি মিলেছিল। আফজাল তারই একটা কপি পাঠিয়ে দিলো ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায়। নিজের উপর ধারণা ছিল কাজটা অনেক উন্নত মানের হয়েছে। যেহেতু অনেক ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষকরা ছাত্রদের দিকে তেমন একটা মনোযোগ দেন না; সেইজন্য তার কাজ ঠিকভাবে সমাদৃত হয় নি। আফজালের গবেষণা কাজ যোগ্য জায়গায় যেয়ে পৌঁছল। আফজাল মাস খানেকের মধ্যে চিঠি পেল, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া আফজালকে চায়। একবারে মাস্টার্স করে, সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে। বাংলাদেশের মাস্টার্সকে তারা সমকক্ষ ধরতো না। আফজাল আবার মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি প্রোগ্রাম আরম্ভ করলো।

দু জনের পরিচয় কিছুটা নাটকীয় বলা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ছাত্রদের অরিয়েন্টেশনের একটা অনুষ্ঠান ছিল। তখন আফজালের পড়ালেখার প্রচণ্ড চাপ। তার পরেও সে ভলান্টিয়ার করার জন্যে সাইন আপ করলো। একটু অন্য রকম সময় যাতে কাটে। সারাক্ষণ কাজ ও চাপ কতো নেয়া যেতে পারে! অবশ্য সে শুনেছিল, প্রাত্যহিক রুটিনের বাইরে এই ধরণের ভলান্টিয়ার কাজ পিএইচডি ছাত্ররা করে থাকে। কিন্তু আফজালের সেই দিকে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তার মাথার মধ্যে একই চিন্তা, কি করে ঠিক সময়ে পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে যাওয়া যায়। পিএইচডি সুপারভাইজার প্রফেসর ওয়াল্টার একদিন জানতে চাইলেন, “তুমি পড়ালেখার বাইরে আর কী কী করছো?” আফজাল জানালো সে আসলে তেমন কিছু আর করছে না। এ বার প্রফেসর ঠোটে একটা মুচকি হাসি তৈরি করে বললেন, “তা হলে নিশ্চয়ই কোথাও প্রেম করছো? সে জন্য কোন সময় পাচ্ছো না।” এই বার আফজাল লজ্জা পেলো। শিক্ষক যে ছাত্রের সাথে রসিকতা করতে পারে সেটা জানা ছিল না। সে যখন এই প্রশ্নের উত্তর না জানালো; প্রফেসর একেবারে তেড়ে মেরে উঠলেন, “সারাক্ষণ পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তুমি একেবারে পাগল হয়ে যাবে। আমি দেখতে চাই তুমি আরও কিছু কাজ করছো।” আফজাল জানে সুপারভাইজারের কথার বরখেলাপ কোন ভাবেই করা যাবে না। পিএইচডি পেতে হলে অবশ্যই টিচারের কথা মতো চলতে হবে না। এই কারণেই আফজাল অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে সাহায্য করার জন্যে নাম লেখালো।

চার ঘণ্টার কাজ। একেবারেই সহজ। নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের ক্যাম্পাসের কোথায় কি অবস্থিত মানে আবাসিক হলগুলো, লাইব্রেরী, স্টেডিয়াম, ক্লাস রুম ইত্যাদি কোনটা কোথায় সেগুলো দেখিয়ে দেয়া। কেউ ক্যাম্পাস বিষয়ক কোন প্রশ্ন করে, তার উত্তর দিয়ে দেয়া। প্রতি বিশ জন ছাত্রের একেকটা গ্রুপ করা হলো। প্রতিটা গ্রুপের দু জন করে ভলান্টিয়ার। আফজাল যেই গ্রুপের দায়িত্ব পেলো সেখানকার দ্বিতীয় ভলান্টিয়ার শেরী। ছাত্ররা জমায়েত হওয়ার আগেই দু জনে হাজির হলো। প্রথমে হাই হ্যালো বলার পর একজন আরেকজনের বৃত্তান্ত জানলো। শেরীর বিষয় বায়ো কেমিস্ট্রি। সেও পিএইডি’র জন্যে পড়া ও গবেষণায় ব্যস্ত। বেশীর ভাগ দিনই সতের-আঠারো ঘণ্টা কাজ করে চলে। আফজালের সাথে আরেকটা বিষয় দারুণ মিলে গেল। শেরীকেও তার সুপারভাইজার জোড় করে ভলান্টিয়ার হওয়ার জন্যে পাঠিয়েছে। তাকেও একই কথা বলা হয়েছে, শুধু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে উন পঞ্চাশ বায়ু মানে মাথা খারাপ হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। দু জনে এক চোট হেসে নিলো। তারা দু জন হবু পাগল এক জায়গায় হয়েছে! শিক্ষকদের নিশ্চয়ই ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ছাত্রদের জন্যে এ ধরণের নির্দেশনা দেয়া আছে।

আফজাল বিদেশে আসার পর থেকে তেমন কোন বন্ধু-বান্ধব বানায় নি। কোন মেয়ের কাছাকাছি যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। দেশে মা আফজালের জন্যে মেয়ে দেখা নিয়ে মহা ব্যস্ত। তারও একই লক্ষ্য পিএইচডি শেষ করেই ভো দৌড়। একেবারে বাংলাদেশ। সেখানে একটা চাকরী খুঁজে পাবার সাথে সাথেই মায়ের পছন্দ করা অপরূপা বঙ্গ ললনাকে বিয়ে। তারপর সুখী জীবন চলতেই থাকবে। তবে মা যে কেমন কন্যা পছন্দ করেন তা নিয়ে সামান্য সংশয় ছিল। কিন্তু পরের মুহূর্তে মনে হয়েছে, মায়ের পছন্দ সব সময়েই সেরা। তবে শেরীর একেবারে পাশে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে কেমন একটা অনুভূতি সৃষ্টি হলো। মেয়েটার থেকে একটা মায়াবী সুগন্ধ ভেসে আসছে। মেয়েটা লম্বায় আফজালের ঘাড় পর্যন্ত। মুখে হাল্কা মেকআপ, ঠোটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক। হাতের পায়ের নোক নিখুঁত করে কাটা। তবে নেল পোলিশের রঙ বেশ গাঢ়। আফজাল মুহূর্তে শেরীর মেলা কিছু পর্যবেক্ষণ করে ফেললো। মাথায় চিন্তা এলো যেই মেয়ে দিনে পনেরো থেকে আঠারো ঘণ্টা কাজ করে, সেই মেয়ে কি করে নিজেকে এতো পরিপাটি করে রাখতে পারে। হঠাৎ শেরীর হাসির শব্দে আফজালের চিন্তাইয় ছেদ পড়লো। সে হাসিটা কমিয়ে বলা করা আরম্ভ করলো, “আরে মশাই আমি জানি তুমি কি ভাবছো। আমার মতো ব্যস্ত মানুষ কেমন করে এতো ফিটফাট হয়ে আছে? আমি আগেই খবর নিয়ে জেনে রেখেছিলাম আফজাল, দ্যা রয়েল বেঙ্গল হিরো, আজকে আমার সাথে ভলান্টিয়ার করবে। সে জন্যে একটু মানজা দিলাম আর কি। হে হে।”

এবার আফজাল কেমন একটা বোকা চোখ নিয়ে তাকালো। মেয়েটা এখানে আসার আগে কে আসবে, কী কী করতে হবে জাতীয় সব খবর নিয়ে এসেছে। আর সে কি না যেমন তেমন কাপড় চোপড় পরে হাজির হয়েছে। নিজেকে শেরীর পাশে খুবই বেমানান মনে হলো। মাথায় আসলে সেও টাই-স্যুট পরে আসতে পারতো। শেরী আরেক দফা হো হো করে হেসে উঠলো, “তুমি তো আচ্ছা বোকা। একটু পর পর টেনশনে ভুগো। এস এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, তোমাকে জিন্স আর টী শার্টে কিন্তু ফাটাফাটি লাগছে। হলিউডের কোন ডিরেক্টর দেখলে নির্ঘাত অভিনয় করতে নিয়ে যাবে।” এইবার আফজাল হেসে উঠলো। বাংলাদেশের তাকে নায়ক বানানোর কত জনই না চেষ্টা করেছে। এখন এক শ্বেতাঙ্গিনি তাকে একই ধরণের কথা বলছে। আফজালের কিছুক্ষণের মধ্যে শেরীর সাথে একেবারে সহজ হয়ে গেল; আড়ষ্টতা চলে গেল। দু জনের মধ্যে প্রচুর কথা বার্তা হলো। মনেই হলো না দু জনের পরিচয় আজকে এবং একটু আগেই। বহুদিনের পরিচয় থাকার মতো করে দু জনের হাসি-ঠাট্টা, গল্প চলতে লাগলো। ভলান্টিয়ার কাজ শেষ হয়ে যাবার পরে দু জনে একটা কফি শপে যেয়ে বসলো। আরও কয়েক ঘণ্টা মানে একেবারে রাত দশটা পর্যন্ত শত বিষয় নিয়ে কথাবার্তা চললো। বিদায়-ক্ষণে আফজালকে অবাক করে দিয়ে শেরী আলতো করে আফজালকে জড়িয়ে ধরল মানে পশ্চিমা বাসায় যাকে বলে ‘হাগ’ বলে সেইটা দিলো। এই দেশে হাগ বিষয়টা তেমন কোন ব্যাপারটা না। এ দেশে হাগের দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু তার পরেও, আফজালের অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল। নরম একটা শরীরের ছোঁয়া আর মিষ্টি একটা আবেশ। একটা হিমেল বাতাস বুঝি ভরিয়ে দিলো পুরো অন্তরটা।

পরের সপ্তাহে দু জনে আবার দেখা করলো। ধীরে ধীরে সাক্ষাতের বিরতি কমতে লাগলো। তিন দিন, দু দিন থেকে একদিনে যেয়ে ঠেকলো। তার পরেও মন ভরে না। মাঝে মাঝে লাঞ্চ আর দিনের শেষেও দেখা করা আরম্ভ করলো। কয়েক ঘণ্টা পর পর ফোনে কথা বলা তো আছেই। দু পক্ষই বুঝতে পারলো অন্যজনকে ছাড়া থাকাটা থাকা অসম্ভব হয়ে উঠছে। সারাদিন কাজের ব্যস্ত থাকলেও, পরের বার দেখা হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ অপেক্ষায় অধীর হয়ে থাকতো। এইটা কি প্রেম বলে? দু বর্ণের মানুষের মধ্যে মিলন কি সম্ভব? অসম্ভব নিশ্চয়ই না। দু বর্ণের মানুষের মধ্যে বিয়ের উদাহরণ দেয়া কিন্তু একেবারেই কঠিন না। কিন্তু এখানে কথা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আসা একজন সুদর্শন যুবকের কথা, যার একমাত্র চিন্তা পড়ালেখা শেষ হওয়া মাত্রই ছুটে বাংলাদেশে মায়ের কাছে যাওয়া। মা তার জন্যে সুন্দরী বাঙালি কন্যা ঠিক করে রাখবেন। তাকেই সে বিয়ে করবে। দেখা যাক পরিকল্পনা মোতাবেক বাস্তবের কতটুকু মিল পাওয়া যায়।

সুন্দরী কিশোরীদের পেছনে উৎসাহী ছেলেদের কখনো কোন কমতি হয় না। সেটা বাংলাদেশ, এমেরিকা কিংবা পৃথিবীর যেই প্রান্তই হউক না কেন। শেরী ছোট বেলা থেকেই জানতো সে যেখানেই যাউক না কেন; কিছু চোখ তাকে অনুসরণ করে চলবে। সেই চোখগুলোর ভালো লাগায় উপচে পড়তো; আবার কিছু চোখ কাছেও আসতে চাইতো। মেয়েরা এ রকম আগ্রহ খুব উপভোগ করে। শেরীও এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। বিধাতার হয়তো এ রকম করেই নারীদের সৃষ্টিদের করেন। নারী মাত্রই যে হাজারও সৌন্দর্যের সমন্বিত প্রকাশ। অন্যদিকের পুরুষ হলো সেই সুন্দর ও সৌন্দর্যের একনিষ্ঠ পূজারী। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই। কিছু পূজারী ‘চোখ থাকিতেও অন্ধ’। তারা সত্য ও সুন্দর খুঁজে পায় না। হতভাগা তারা। পূজারীরা অর্ঘ ঢেলে দিতে চাইলেও শেরী সযত্নে সরে পড়েছে। ছেলেদের ধারণা ছিল শেরী বেশী দেমাগি। নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী ভাবে। কিছু ছেলে হতাশ হয়ে দুর্নাম ছড়াতে পর্যন্ত দ্বিধা করে নি। তারা বলে বেরিয়েছে, শেরীর ছেলেদের ব্যাপারে আগ্রহ নাই। সে অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো না।

যেই শেরীকে নিয়ে এতো কথা বার্তা, সে বেশ ছোট বেলা থেকেই তার লক্ষ্য স্থির করে রেখেছে। তাকে মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করতে হবে। মা তাকে ভালো করেই বুঝিয়েছে, পৃথিবীতে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে ওটাই প্রধান অবলম্বন। শেরীর যখন জন্ম হয়, তখন শেরীর মা এলিশার বয়স সবে ১৫। হাই স্কুলের গণ্ডি পাড়ি দিতে পারে নি। প্রেমিক ছিল একজন। একই ক্লাসে পড়তো। টিন এজারদের এক পার্টিতে ওরা তুমুল মদ পান করলো। সাথে অন্যান্য নেশাকর জিনিসগুলোও ছিল। পার্টি শেষে দু জনে একসাথে বিছানায় গেল। ফলশ্রুতিতে এলিশার পেটে সন্তান এলো। অল্প বয়সের প্রেমিক পুরুষ ও তার পরিবার চাপ দিচ্ছিল এবোরশোন করিয়ে ফেলার জন্যে। প্রথমে এলিশার পরিবার তাতে সায় দিলো। এলিশা নিজেই বাবা-মা’র সাথে, সেই বা একটা বাচ্চার দায়িত্ব নিবে কি করে? কিন্তু এলিশা বেঁকে বসলো। সে বাচ্চাটাকে রাখবে এবং প্রয়োজন হলে সে নিজে চাকরি করে আয়-রোজগার করে বাচ্চা মানুষ করবে। এলিশার বাবা-মা ইচ্ছা না থাকলেও মেয়ের দাবীতে মত দিলো।

সুস্থ সবল শিশু হলো। বাবা কাছে না আসলেও মা ও তার পরিবারের আদর যত্নে ফুটফুটে শিশুটা বেশ সুন্দর বেড়ে উঠতে লাগলো। তবে সমস্যা একটা হলো কিশোরী মা তার সন্তানের দায়িত্ব পালন থেকে সরতে লাগলো। কিছুদিনের মধ্যেই তার অন্য বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে বেরানো আরম্ভ করলো। অনেকটা মা হলে কি কি দায়িত্ব পালন করতে হয়, সে সব বুঝার আগে মা হয়ে গেলে, সন্তানের সাথে দায়িত্ব পালনে ক্লান্তি তো চলে আসতেই পারে। দায়িত্ব এসো পড়লো নানা-নানীর উপর। এই দেশে এ রকম ঘটনা ভুরি ভুরি হয়। শেরীকে তার নানা-নানীর কাছেই বড় হতে হয়েছিল। মা এলিশা কলেজে পড়ার জন্যে সেই যে বাসা থেকে বের হয়েছিল, তার পরে আর বাড়ি ফিরে নি। অবশ্য নিয়ম করে জন্মদিন ও ক্রিস্টমাসে শেরীকে কার্ড পাঠিয়ে এসেছে। এলিশা আর পড়ালেখা শেষ করতে পারি নি। আবার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। আরও দুটো বাচ্চা হয়েছিল। এলিশা আবারও ওদেরকে বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু উনারা রাজী হন নি। তার জানিয়ে দিয়েছিলেন, নতুন করে তাদের পক্ষে আর কারোর দায়িত্ব নেয়া সম্ভব না। চার সন্তানের মধ্যে এলিশা ছিল সব চেয়ে ছোট। এই কয়জনকে মানুষ করতে করতে তাদের বয়স বেড়েছে, কমে এসেছে শক্তি ও ধৈর্য। নানা-নানী দু জনই অবসরে গেছেন। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষমতাও প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছিল।

তারা শেরীকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয় নি। প্রতিটা প্রয়োজনে শেরী নানা-নানীকে পেয়েছে। সেটা হউক স্কুলের টিচারের সাথে মিটিং, অন্য শহরে ব্যান্ড প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া কিংবা অসুস্থ হলে সারা রাত জেগে থাকা। অন্যদিকে শেরীও তাদেরকে হতাশ করে নি। অল্প বয়সেই সে বুঝে নিয়েছে, তার মা কিশোরী বয়সে যে ভুলটা করেছে, সেটা সে কোনো ভাবেই একই কাজ করবে না। নানা-নানী তাকে বুঝাতে পেরেছিলেন, শেরীকে পড়ালেখা করে অনেক দূর এগুতে হবে। তাতেই তারা মেয়েকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, নাতনী সেটা পূর্ণ করে দিয়েছে বলে সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন। শেরী প্রথম থেকেই পড়ালেখায় তার মেধা প্রমাণ করেছিল। হাই স্কুলে সে হয়েছিল ভেলেডেকটারিয়েন মানে স্কুলে শীর্ষ স্থান পেয়েছিল। ইউনিভার্সিটিতে ১০০% স্কলারশিপ পেতে কোনো সমস্যাই হয় নি। তাও আবার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় মতো নামজাদা জায়গায়। সেখানে সে কৃতিত্ব দেখিয়ে চললো। ব্যাচেলর, মাস্টার্স করলো রসায়ন বিদ্যায়। পিএইচডি করার অফার পেয়ে গেল।

আফজাল হোসেন ও শেরী স্মিথ দু জনই মহা ব্যস্ত মানুষ। তার পরেও দু জনের যোগাযোগ বাড়তে লাগলো। দিনে কয়েকবার ফোনে কথা হচ্ছে, সারাদিন ধরে টেক্সট ম্যাসেজ আদান প্রদান চলছে, সন্ধ্যায় দু জনে মিলিত হচ্ছে। তার পরেও মন ভরছে না। আরও সাথে সাথে থাকতে ইচ্ছা হয়। একজনের মাঝে আরেকজন হারিয়ে না গেলে কি আর পরিপূর্ণ সুখ হয়? । প্রস্তাবটা শেরীর থেকেই আসলো। আফজালকে সে বলল, “তুমি আমার এপার্টমেন্টে এসে উঠতে পারো। তাতে একসাথে দু জন থাকতে পারবো। খরচ কমবে। অনেক ভালোবাসাও হবে।” কথাটা শোনা মাত্রই আফজালের কান একেবারে লাল হয়ে গেল। মনে হল জায়গাটা ভীষণ গরম হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো সময়ে ধুঁয়া বের হওয়া আরম্ভ হতে পারে। হাজার হলেও বাঙালি ছেলে বলে কথা। তাদের পক্ষে এ রকম কিছু চিন্তা করাটাও কঠিন। বিয়ের আগে একটা মেয়ের সাথে থাকা আরম্ভ করলে দেশের মানুষেরা সব ছিতু করবে। দেশের থেকে সে হাজার হাজার মাইল দূরে। হয়তো দেশের কেউ বিষয়টা জানতেই পারবে না। কিন্তু আফজাল ছাড়াও ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় আরও কিছু বাঙালি ছাত্র আছে। একমুখ, আরেক মুখ করতে শেষে যদি খবরটা মায়ের কাছে যেয়ে পৌঁছে যায়। তিনি কিন্তু ভীষণ দুঃখ পাবেন।

বাঙালি ছেলে আফজাল এডভেঞ্চার প্রিয় সাহসী ছেলে। কিন্তু সংস্কার ভাংলে তার প্রভাব পড়বে পরিবারের উপরে। মা-বাবাকে নিয়ে আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী গায়ের উপরে এসে যা তা বলে যাবে। বাবা মা’কে বকা-ঝকা করবেন, “আগেই বলেছিলাম ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর কোন দরকার নাই। এখন দেখো সবার মুখে চুন কালি দিচ্ছে।” মা চুপ করে সব শুনবেন, কিন্তু কোনো উত্তর দিবেন না। মুখ ভার করে না ঘুমিয়ে রাত কাটাবেন। ফোন করলে হয়তো কথাই বলবেন না। আফজালের আর বেশী চিন্তা করতে মন চাইলো না। শেরীকে জানালো তার পরিস্থিতি, “আমি মা-কে কষ্ট দিতে পারবো না। আর তোমাকে ছাড়াও থাকতে পারবো না।” শেরী আফজালের কথায় বেশ অবাকই হলো। বলে কি এই ছেলে। দু জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ একসাথে থাকবে, এখানে বাবা-মা, আত্মীয় স্বজনের কষ্ট পাওয়ার কি থাকতে পারে। তবে এতটুকু ভালো করেই বুঝলো, বিষয়টা আফজালকে মারাত্মকভাবে মানসিক পীড়া দিচ্ছে। সে তার কাছেও আসতে চায়, আবার তার বাঙালি সংস্কারের বিরুদ্ধেও যেতে পারছে না।

এইভাবে টানাপড়েন চললো বছর খানেক। দু জনই তাদের পড়ালেখা, কাজ-কর্ম চালিয়ে যেতে থাকলো। পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে ডক্টরেট করা তো আট চাট্টি খানি কথা না। তবে দু জনই ভালোলাগার আবেগকে বিন্দুমাত্র উড়িয়ে দিতে পারলো না। যোগাযোগ কিছুটা কমলেও সম্পর্ক অনেক বেশী পোক্ত হয়ে গেল। একজনের আরেকজনের, বলতে গেলে সবই জানা হয়ে গেল। দু জনই মহা খুশী এটা জেনে যে দু পক্ষ এই প্রথম প্রেম করছে। অবশ্য আফজাল প্রথম অবাক হয়েছিল শুনে যে শেরী এর আগের কোন ছেলের সাথে জড়ায় নি। শেরীর প্রশ্ন, বাংলাদেশে কি সুন্দরী মেয়েরা ছেলেদের দিকে তাকায় না। আফজালের উত্তর শুধু তাকায় না, ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। কিন্তু সে এ ব্যাপারে কখনো কারোর ডাকে সারা দেয় নি। শেরী প্রথম দিকে এই কথা শুনলে হয়তো অবিশ্বাস করতো। কিন্তু এখন সে আফজালের প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে। শেরীও খুব ভালো করেই জানে, আফজালও মনে প্রাণে তার প্রতিটা কথাকে সত্যি বলে মনে করে। পুরো মার্কিন সমাজ এক রকম, শেরী অন্য রকমভাবে নিজেকে মোহের ডাক থেকে দূরে রেখে বড় করেছে, সেটা আফজাল এখন কোন প্রশ্ন ছাড়াই সত্যি বলে মেনে নিয়েছে।

সমস্যাটার অভাবিত সমাধান শেরীই করলো। সে নিজে উদ্যোগী হয়ে আফজালের বাসায় ফোন করলো। বাবার সাথে অল্প অল্প করে কথা বার্তা আরম্ভ হলো। কিছুদিনের মধ্যেই আফজালের ছোট বোন শীলার সাথে একেবারে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। দু জনের মধ্যে দু দেশ, সংস্কৃতি ও পরিবার নিয়ে মেলা কথা বার্তা চলতে লাগলো। অবশ্য শীলা সহজেই বুঝে নিলো শেরীর তাদেরকে ফোন করার মধ্যে বিশেষ কোনো ব্যাপার আছে। ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। সে নিজেও ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এবং তার একজন ভালোবাসার মানুষ আছে কি-না। ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার জন্যে সেই শেরীর কাছে জানতে চাইলো আফজালকে তার কেমন লাগে। পশ্চিমা দেশের মেয়েদের বেশী রাখ-ডাক থাকে না। শেলীকে সব খুলে বলল। শেষে বলল, “তোমার ভাইকে বলেছি আমার সাথে উঠতে ; সেটাতে তার সমস্যা। আবার আমার সাথে দেখা না বলে খুব মন খারাপ করে থাকে। বুঝতে পারছি না ছেলেটাকে নিয়ে কি করি।“ শেলী আশ্বাস দিলো সে সাহায্য করবে।

শেলী বিষয়টা খুলে বলল বাবা-মাকে। দু জনেই সাথে সাথে বেঁকে বসলেন, ‘মেম বিয়ে করলে, লোকে কি বলবে?’ সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দু জনের অবস্থান পাল্টাতে লাগলো। শেরী মায়ের সাথে কথা বলা আরম্ভ করলো। যদিও মায়ের ইংরেজিতে কথা বলার ক্ষমতা নেহায়েতই সামান্য। তার পরেও শেরী তার ভবিষ্যৎ শাশুড়ির মন জয় করে ফেললো। মায়ের শরীরের অবস্থা এবং তার সময়মতো ওষুধ না খাওয়ার বাতিক, বাবার হাঁটুর ব্যথা, বাড়ির ছাদ থেকে পানি লিক করছে; থেকে আরম্ভ করে পরিবারের সব খবরই শেরীর জানা ছিল। ফোনে সময় নিয়ে শেরী এখন এইগুলোর কি অবস্থা এক এক করে জেনে নিতো। তার মধ্যে কিছু কিছু বাংলা শব্দ শিখে নিয়েছে। আফজাল যে বাড়ির এতো কিছু নিয়ে চিন্তা করে সেটা ভেবে তারা অনেক খুশী হলো। আফজাল দেশে থাকতে কেউ বুঝতে পারে নি তার এই সব বিষয় নিয়ে কোন চিন্তা মাথা ব্যথা আছে। বেশীর ভাগ সময়ই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ চৈ করে বেড়াতো। শেলী বাবা-মাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো, “নিশ্চয়ই শেরী ভাইয়াকে ভীষণ ভালোবাসে। না হলে কি আর তো এতো আগ্রহ নিয়ে বাড়ির সব খবর জানতে চায়।”

বাবা-মায়ের নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা চলতে লাগলো। শেলী কাছে থাকলে সেও আলোচনায় অংশ নিয়ে শেরীকে ভাইয়ের বউ হিসেবে মেনে নেয়ার প্রচুর যুক্তি যোগ করে দিতো। সে আরও যোগ করতো, এর মধ্যে পরিচিতদের মধ্যে কোন কোন বাঙালি ছেলে বিদেশি মেয়ে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। বিশেষ করে বলতো বাবার এক খালাতো চাই সামিন আঙ্কেলের কথা। উনি মেলা বছর আগে রাশিয়া গিয়েছিলেন। ওখানকার মেয়ে বিয়ে করে স্থায়ী হয়ে যান। অবশ্য বলতে গেলে প্রায় প্রতি বছরই দেশে বউ, বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে আসেন। তার মেয়ে ক্যাটিনার এখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। একেবারে রুশ অলিম্পিক দলের হয়ে সাঁতারে প্রতিযোগিতা করে। শেলীর কথা হলো, “ভাইয়া যদি বিদেশী মেয়ে পছন্দ করে তা হলে এতো আপত্তি কেনো? দু জনেই পূর্ণ-বয়স্ক, শিক্ষিত। পরিবারের কথা ভাবে বলেই বাবা মাকে জানিয়েছে। চাইলে নিজেরাই বিয়ে করে ফেলতে পারতো। ভাইয়া যেখানে সুখী হয়, সেখানেই মত দেয়া উচিত।” শেলী কথার বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি অকাট্য। অন্য ধর্মের বলে আপত্তি করলেন। সেটা ধোপে টিকলো না।

সপ্তাহ দুয়েক পর আফজাল জানালো ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী তারা বিয়ে করেছে।

এক বছর, দু বছর করতে করতে পাঁচ বছর পার হয়ে গেল। দু জনের কাজে কর্মে অনেক উন্নতি হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার মতো জায়গায় লেকের ধারে বিশাল এক অট্টালিকা কিনেছে। পুরো বাড়ি সাধ মিটিয়ে দামী ফার্নিচার, পেন্টিং দিয়ে সাজালো। বাসায় তেমন কেউ বেড়াতে না আসলেও, যারা আসতো তারা সবাই বাহবা দিয়ে যেতো। মাঝে আফজাল তার বাবা-মাকে দু বার এমেরিকা প্লেনের টিকিট দিয়ে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে বাবা কাজের থেকে রিটায়ার্ড করেছেন। তারা ছেলের বাড়ি থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন। ছেলের এতো সুন্দর জায়গায় বাড়ি-ঘর তাদের মন কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের সব চেয়ে বেশী বিমোহিত করেছিল ছেলের বউয়ের মিষ্টি মধুর ব্যবহার। সারাদিন ব্যস্ত থাকলেও, শেরী শ্বশুর-শাশুড়ির সুবিধা হতে পারে এমন সব কিছুই করতো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। একটা ইয়েলো ক্যাব ট্যাক্সি ঠিক করা ছিল, সেই তাদেরকে এই সেই দিক নিয়ে যেতো। শনিবার-রবিবার সবাই মিলে সমুদ্রের ধারে কিংবা দূরে কোথাও বেরিয়ে আসতো। তা ছাড়া পুরো সপ্তাহ ছুটি নিয়ে তাদেরকে লাস ভেগাস আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখিয়ে নিয়ে আসলো। আরেকবার নিয়ে গেল মেক্সিকো বেড়াতে। বাবা মা’র সাথে সাথে আফজাল নিজেও খুবই আনন্দিত ছিল যে শেরী তার পরিবারের সবাইকে এতো আপন করে নিয়েছে। পৃথিবীর দু বর্ণের দু জন মানুষের যে সুখী দাম্পত্য জীবন সম্ভব, তারা বুঝি তাই প্রমাণ করে দেখালো।

সারাটা দিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সন্ধ্যার পর কিছুটা অবকাশ হয় দু জনে একসাথে কিছুটা সময় একান্তে কাটানোর। যদিও সারাদিন টেক্সটে কিংবা ফোনে যোগাযোগ চলে। প্রেমের উচ্ছ্বাস কমলেও, সারাদিনের প্রতিটা ঘটনা এঁকে অন্যকে না বলে বুঝি সস্তি আসতো না। তারপরেও দিনের শেষে সব কাজের পর মুখোমুখি বসলে দু জনের মাথায় ভিন্ন একটা বিষয় খেলে যেতো। বিষয়টা অনেকটা এ রকম, দু জনে চেষ্টা করে চলেছে একটা বাচ্চা নেবার। প্রস্তাবটা প্রথম এসেছিল শেরীর কাছ থেকে। সে আর দেরী করতে চায় না। পড়ালেখা শেষ করতে করতে তাদের অন্যদের তুলনায় বেশী সময় লেগেছে। অন্যরা যেখানে আন্ডার গ্র্যাড কিংবা মাস্টার্স করে চাকরি আরম্ভ করে দেয়, সেখানে তারা পিএইডি মানে ‘ডক্টরেট’ উপাধি নিয়ে চাকরি আরম্ভ করেছে। কষ্ট করলে যেমন কেষ্ট পাওয়া যায়, তেমনি তাদের এখন স্বচ্ছল জীবন। তবে সময় তো আর বসে থাকে না। বয়স ঠিকই বেড়ে চলেছে। এখন বাচ্চা না নিলে দেরি হয়ে যাবে। মায়ের শরীর শক্ত থাকার একটা বিষয় তো থাকেই। তা ছাড়া গায়ের শক্তি থাকতে থাকতে সন্তানকে বড় করার বিষয়টা থেকেই যায়।

চেষ্টা চলতে থাকলো। সাথে সাথে কত না পরিকল্পনা। ছেলে হলে কি নাম, মেয়ে হলে কি নাম, আর তারা দেখতেই বা কেমন হবে। গায়ের রং, চেহারা বাবা না মায়ের হবে। শেরী বলল, “ দু জনের সংমিশ্রণে অদ্ভুত সুন্দর দেখতে একটা পুত্র সন্তান হবে। বাবা দেখতে যেহেতু একেবারে নায়কের মতো, তার জীন নিয়ে জন্ম নেয়া ছেলেও সে রকম নায়কের মতো হবে। ” আফজালের কথা, “ মেয়ে হবে এবং সে হবে মায়ের মতো অপ্সরী।” চেষ্টার তিন মাসের মধ্যে ফল দেখা গেল। শেরীর পিরিয়ড হলো না। বিধাতা সহজেই সদয় হলেন। প্রেগন্যান্সি কনফার্ম করার কিট কিনে নিয়ে বাসায় পরীক্ষা করলো। রেজাল্ট পজিটিভ। ওদের আর তর সইলো না। পরের দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে হাজির হলো। ডাক্তার নিশ্চিত করলেন, শেরী মা হতে চলেছে। ওদের মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। আফজাল গাড়িতে উঠেই মাকে ফোন করে খুশির খবরটা দিলো। যাই হোক, পরের দিন থেকে দু জনেই অফিস আরম্ভ করে দিলো। এখনো মেলা সময় হাতে, প্রায় দশ মাস। ওদের বুঝি আর তর সইছে না। আরও তাড়াতাড়ি যদি শিশুটা বের হয়ে আসতো। না সেটা একেবারেই অসম্ভব। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতেই হবে।

দেখতে দেখতে মাস খানেক পার হয়ে গেল। শেরীর তলপেটে খুব ব্যথা হয়। সারাদিন ধরেই কষ্টটা পায়। কিন্তু রাতে শুতে গেলে সব একেবারে অসহ্য হয়ে উঠে। আর তিন দিন পরে বৃহস্পতিবারে ডাক্তারের সাথে এপোয়নমেন্ট। তখন ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিবে, কেন এত কষ্ট হচ্ছে। এইদিকে বেচারির কাজে এতো ব্যস্ততা যাচ্ছিল যে কাজ ছেড়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা খুবই মুশকিল। সোমবার সকালে ব্যথাটা মনে হলো আরও বেড়ে গেল। বিছানা থেকেই উঠতে পারলো না। আফজাল ধরেই নিলো শেরীর এই কষ্টটা হয়তো এ রকম সময়ে মহিলাদের হয়ে থাকে। আফজাল শেরীকে বলল, “আজকে কাজে যাওয়ার দরকার নাই। আমি তোমার অফিসে ফোন করে দিচ্ছি।” শেরী কোন উত্তর দিলো না। আফজাল তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে শেরীর নাস্তা বানিয়ে বিছানায় নিয়ে আসলো।

আফজাল এসে শেরীকে কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। কি হলো মেয়েটার। তাকিয়ে দেখে শেরীর মুখ কেমন যেন নীল হয়ে গেছে। জ্ঞান হারিয়েছে বলে মনে হলো। সে আর দেরী করলো না। ৯১১ নম্বরে কল করে করলো। দশ মিনিটের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স এসে শেরীকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। আফজাল নিজেও গাড়ি ড্রাইভ করে হাসপাতালে ছুটে গেল। এর মধ্যে শেরীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে ডাক্তার ওটি থেকে বের হয়ে আফজালকে জানালেন, “শেরীর প্রেগন্যান্সি টিউবের ভিতরে না হয়ে বাইরে হয়েছিল। তাতে পুরো জায়গাটা ইনফেকটেড হয়ে ওভারি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রেগন্যান্সি নষ্ট মানে মিস ক্যারিয়েজ হয়ে গেছে।” এর পরে ডাক্তার সব চেয়ে ভয়ংকর খবরটা দিলেন, “শেরীর ওভারি রিমুভ করে ফেলা হয়েছে। সেটা না করলে শেরীকে বাঁচানো যেতো না।” ডাক্তার সাহেব আরও বুঝিয়ে চললেন, “তার মানে সে আর কখনো মা হতে পারবে না। তবে গুড নিউজ হলো তিন-চারদিনের মধ্যেই সে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠবে।”

এ রকম একটা খবরের জন্যে আফজাল প্রস্তুত ছিল না। ভেবে পেলো না ডাক্তারকে এখন সে কি বলতে পারে। মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। ডাক্তার আফজালের ঘাড়ে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “Everything will be alright---সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।” আফজাল বুঝে পেলো না আর কি ঠিক হতে পারে। সে বাবা হতে পারবে না। শেরী শরীরের একটা অঙ্গ হারিয়েছে। নিজেকে ভীষণ দোষী মনে হলো। সে একটা শিশু নিতে রাজী চেয়েছিল বলেই এতো সমস্যা। অবশ্য শেরীর উৎসাহ তার থেকে আরও বেশী না। এখন আর এইসব ভেবে কি লাভ? এখন সে শেরীকে কি বলবে? একটা মেয়ে সারাটা জীবন সংগ্রাম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলো, তাকে সে কিভাবে বলবে তার একটা বড় স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে। শুধু তাই না তাদের এই স্বপ্ন আর কখনই বাস্তব হবে না।

ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন এ রকম পরিস্থিতি মহিলাদের উপর মানসিক চাপ ফেলে। বড় ধরণের ডিপ্রেশন হতে পারে। এমনকি সুইসাইডাল মানে আত্মহত্যার ঝুঁকি পর্যন্ত হতে পারে। এই জন্যে সাথে সাথে থাকতে হবে। কোনভাবেই রাগানো যাবে না। যা করতে চায় সেইটা করতে দেয়া খুব জরুরী। না হলে বড় ধরণের বিপদের সম্ভাবনা থাকে। আফজাল অফিস থেকে দু সপ্তাহের ছুটি নিলো শেরীর দেখা শোনা করার জন্যে। শেরীর শরীরের অবস্থা কিছুটা ভাল হলেই, দূরে কোথাও বেরিয়ে আসবে। ক্যানাডা যাওয়া যেতে পারে। শেরী একবার বলেছিল, ক্যানাডার নায়েগ্রা ফলস দেখতে যাবার খুব ইচ্ছা। এমেরিকার বাফেলো থেকে সে এই জলপ্রপাত দেখেছে। কিন্তু মন ভরে নি। কারণ ক্যানাডার দিক থেকে এর সৌন্দর্য অনেক বেশী। সেইবার পাসপোর্ট সাথে ছিল না বলে ক্যানাডায় যেতে পারে নি।

শরীরের দিক থেকে শেরী কিছুদিনের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেল। কাজেও ফিরে গেল। ঠিক হলো তিন মাস পরে আগামী গ্রীষ্মে দু জনে মিলে জলপ্রপাত দেখতে যাবে। অবশ্য প্রথমে শেরী যেতে চাচ্ছিল না। কিন্তু আফজাল নাছোড় বান্দার মতো লেগে থাকলো ; “না যেতে হবে।” আফজালের ধারণা দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে, শেরীর মন কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। শরীরের ও মন দুটোর উপর দিয়ে কি ধকলটাই না গেল। শেরী কাজে ফিরে গেলেও কারোর সাথেই তেমন কোনো কথা বলে না। একেবারে চুপচাপ কাজ করে চলে। আগের মতো কথা-বার্তা বলে অফিস মাতিয়ে রাখে না। দেখতে দেখতে মাস দুয়েক পার হয়ে গেল। সহকর্মীরা শেরীর মধ্যে তেমন আর পরিবর্তন দেখতে পেলো না। এর মধ্যে তার কয়েকজন সহকর্মী আফজালকে ফোন করে জানতে চেয়েছে, “শেরী কি বাসায়ও মন খারাপ করে থাকে?”

বাসায়ও যে শেরী খুব একটা অন্য রকম তাও কিন্তু না। আফজাল দশটা কথা বললে শেরী উত্তর দেয় একটা। তাও মহা বিরক্তি নিয়ে। রাতে বিছানা থেকে উঠে পাশের রুমে যেয়ে কাঁদতে থাকে। আফজাল পিছনে পিছনে যেয়ে শেরীকে আসস্ত করার চেষ্টা করে, “বাচ্চা যে হতেই হবে এমন কোনো কথা নাই। পৃথিবীতে নিঃসন্তান দম্পতি প্রচুর আছে।” এই কথা শুনে শেরী কোন উত্তর দিলো না। আফজাল আসলে ভেবে পায় না আর কি বলতে কিংবা করতে পারে। এই কথাতেও শেরী এমনভাবে তাকিয়ে থাকলো যে সেই আফজালের কথা কিছুই বুঝে নি। এমনকি আফজালের চোখের দিকেও তাকাচ্ছে না। যেই মেয়ে আফজালকে দেখলে মুখের তুবড়ি ফুটাতো, সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আফজাল শেরীকে জড়িয়ে ধরে ঠোটে একটা চুমু দিয়ে বলে, “তুমি যদি চাও আমরা ছোট একটা বাচ্চা এডাপ্ট করতে পারি। যদি বলো বাংলাদেশ থেকে না হয় বাচ্চা নিয়ে আসলাম।” শেরী বলতো, ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক, তাদের সন্তান যেন আফজালের চেহারা ও গায়ের রঙ পায়। সেইজন্যেই আফজাল বাংলাদেশ থেকে বাচ্চা আনার কথা বলল। না কোন লাভ হলো না। শেরী নির্বাক হয়েই থাকলো। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

এমেরিকায় বেড়ে উঠা শক্ত মনের একটা মেয়ে এভাবে যে বদলে যেতে পারে সেটা আফজাল ভাবতেও পারে নি। অবশ্য হাসপাতালের ডাক্তার সাবধান করেছিল, এ রকম ঘটনার পর ডিপ্রেশনের সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। মুড সুইং তো হয়ই। আসলে একজন নারীর কাছে মেনে নেয়া খুবই কঠিন, যে সে আর মা হতে পারবে না। প্রকৃতি নারীদের দায়িত্ব দিয়েছে সন্তান জন্ম দেয়ার। শত শারীরিক ভোগান্তি হলেও, সেখানেই তাদের আনন্দ, সফলতা। তবে একই ডাক্তার অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “সাধারণত কিছুদিনের মধ্যে এই মানসিক চাপ কমে আসতে থাকে। আর যদি সমস্যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে, তা হলে সাইক্রিয়াটরিষ্টের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। ইদানীং মানসিক অসুস্থতা চিকিৎসার ভালো ওষুধ বের হয়েছে।” আফজাল জানে ওই সব ওষুধ থেকে দূরে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এ সবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক। তার মধ্যে আত্মহত্যার মতো মারাত্মক ঝুঁকিও আছে। আফজালের বিশ্বাস ছিল শেরী খুব শিগ্রি বাস্তবতা মেনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।

আফজাল শনিবার সকালে যেয়ে সারা সপ্তাহের কাঁচা বাজার সেরে ফেলতো। তার পরে রান্না করে ফ্রিজে তুলে রাখতো। সে দিন ছুটির দিন বলে দেরী করেই ওরা ঘুম থেকে উঠলো। আসলে শেরী কয়েকবার রাতে উঠে বসেছিল। তার সাথে আফজাল উঠলো। পরে ভোর রাতে ঘুমালো । আফজাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা এগারোটা। শেরী তখনও ঘুমাচ্ছে। আফজাল ভাবলো, শেরী ঘুমাতে থাকুক; এর মধ্যে সে বাজারটা সেরে আসবে। যা ভাবা সেই কাজ। আফজাল নীরবে উঠে পোশাক পাল্টে ঘর থেকে বের হয়ে পড়লো। ফিরতে ফিরতে ঘণ্টা দুয়েক লেগে যাবে। মাছ কিনতে সে এক ইন্ডিয়ান গ্রোসারি দোকানে গেল। সেখান থেকে ফেরার সময় রাস্তায় জ্যামে পড়লো। রাস্তা মেরামতের কাজ চলছিল। চার লেনের রাস্তার তিন লেনই বন্ধ করে রেখেছে। ফিরতে ফিরতে পুরো ডবল সময় লেগে গেল। জ্যামে আটকে আফজালের খুব টেনশন হচ্ছিল। কয়েকবার শেরীকে ফোন করেছিল খবর নেয়ার জন্যে। কিন্তু ওইদিক থেকে শেরী ফোনটাই রিসিভ করে নি। কিন্তু ফোনের শব্দে তো শেরীর ঘুম ভেঙ্গে যাবার কথা। চিন্তায় আফজালের একেবারে অস্থির অবস্থা হয়ে গেল। কেন যে এতো দুরের মাছের বাজারে সে গিয়েছিল।

আফজাল শেরীকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো। না কোন জবাব নাই। বুকটা ধড়াস করে উঠলো। কোন বিপদ হয় নি তো? এই ঘর সেই ঘর পুরো বাড়ি খুঁজে ফেললো। নাহ কোথাও নাই। ঘর থেকে বের হয়ে যায় নি তো। সেটা অনেকটা অসম্ভব। কারণ শেরীর গাড়ি বাইরে পার্ক করা আছে। এখানে সব কিছু এত দূরে দূরে যে, গাড়ি ছাড়া কোনো উপায় নাই। আফজালের হঠাৎই মনে হলো, বাথরুম তো চেক করা হয় নি। বিছানা খালি দেখে অন্যরুম খোঁজা আরম্ভ করেছে। ছুটে গেল বেডরুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমের দিকে। যা ভেবেছিল তাই ঠিক। বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তার মানে শেরী ভিতরে। দরজায় টোকা দিয়ে ডাকা আরম্ভ করলো, “শেরী, শেরী প্লিস দরজা খোলো।” কোন জবাব না পেয়ে মনের মধ্যে ভয় এসে ভড় করলো। কোন বিপদ হয়ে যায় নি তো, “Are you okay? তুমি ঠিক আছো?” এবারও কোনো উত্তর নাই। আফজাল আর দেরী করলো না। ৯১১ নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাইলো।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্যারামেডিক্সরা এম্বুলেন্স নিয়ে চলে এলো। তার তিন মিনিট পরে আসলো ফায়ার সার্ভিস মানে দমকল বাহিনী। দরজা ভেঙ্গে শেরীকে উদ্ধার করা হলো। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল বাথটবে। সারা বাথটব রক্তে ভরা। পাশে একটা কিচেন নাইফ পড়ে আছে। ডানহাত দিয়ে শেরী বাম হাতের কব্জির থেকে অনেকটুকু জায়গা কেটেছে। সেখান থেকেই প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। এক পর্যায়ে সে দুর্বল হয়ে পড়েছে কিংবা মতের পরিবর্তন হওয়াতে কাজটা সে শেষ করতে পারে নি। টবের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। প্যারামেডিক্সরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো, “আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।” আফজালের সেই মুহূর্তে দিশেহারা অবস্থা হলেও কথাটা কানে গেল। নিজের উপর মহা বিরক্ত হলো। তার আসলে উচিৎ ছিল, আরও আগেই শেরীকে সাইক্রিয়াটরিষ্টের কাছে নিয়ে যাওয়া। সেইটা করলে এ ধরণের দুর্ঘটনা হতো না। যাই হোক অল্পের জন্যে বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছে। শেরীর জানটা তো বাঁচছে। এ যাত্রা রক্ষা পাওয়ার জন্যে উপরওয়ালাকে অজস্র ধন্যবাদ জানালো।

শেরীর হাতে বাইশটা সেলাই পড়লো। ডাক্তাররা বললেন, “অনেক কষ্টে হাত বাঁচানো গেছে। তবে কয়েকদিন পর থেকে থেরাপি আরম্ভ করতে হবে। তবে আগের তুলনায় ৭০% উপর কর্মক্ষম হবে না। থেরাপি না করলে আরও খারাপ অবস্থা হবে।” আফজাল অফিস থেকে পুরো দু মাসের ছুটি নিয়ে নিলো। এক মাস ছুটি জমানো ছিল। আরেক মাস আনপেড। শেরীকে যে কোনো মূল্যে সুস্থ দেখতে চায়। দরকার হলে চাকরি ছাড়তেও প্রস্তুত। শেরী সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মোটামুটি ভালো হয়ে উঠলো। কয়েকবার আফজালের ক্ষমা চাইলো, “আমার এ রকম কাজ করাটা একেবারেই ঠিক হয় নি। কেন যে করলাম তাও আমি জানি না। আমি খুবই লজ্জিত। ভীষণ স-রি।” আফজাল বারে বারে বলে উঠলো, “এইটা-তো আর তোমার দোষ না। তোমার মানসিক অবস্থার জন্যে এমন হয়েছে। আমারই বরং তোমার কাছাকাছি থাকা উচিৎ ছিল। আগেই সাইক্রিয়াটরিষ্টের কাছে কেন যে নিয়ে যায় নি, সে জন্যে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টুপিড বলে মনে হচ্ছে।”

ওরা এ বার দেরী করলো না। সাইক্রিয়াটরিষ্টের সাথে দেখা করলো। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। শেরী মূল সমস্যা বুঝলেন। শেরীকে আলাদা রুমে নিয়ে বললেন, “ওভারি নাই তো কি হয়েছে? আর্টিফিশিয়াল ওভারি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছে। তা ছাড়া মেডিক্যাল সায়েন্স যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তুমি অন্য কারো ডিম্ব (Egg) ব্যবহার করেও বাচ্চা নিতে পারো। আশা করি, তুমি শীঘ্রই একজন মা হতে পারবে। এখন থেকেই গাইনি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখবে। তা হলে কিছুদিনের মধ্যে ভালো কিছু হতে পারে।” এ পর তিনি একটু রহস্য করে মুচকি হেসে বললেন, “তোমার হাসবেন্ডকে কিন্তু স্পার্ম (শুক্রাণু) সেভ করতে বললে ভালো হয়। জানোই তো বলা হয় ইয়ং স্পার্ম থেকে স্মার্ট সন্তান হওয়ার চান্স বেশী থাকে। ইন কেস আর্টিফিশিয়াল ওভারি ব্যবহার আরম্ভ হতে হতে কিংবা রাইট ডিম্বাণু জোগাড় করতে যদি কিছুটা সময় পার হয়ে যায়, তা হলে গুড স্পার্ম তোমাদের থাকলো। আমার তো মনে হয় তোমার হাসব্যান্ডের স্পার্ম সেভ করার এখনই রাইট টাইম। ও এখন স্মার্ট, ইয়ং, স্ট্রং।” এর পর সাইক্রিয়াটরিষ্ট আফজালকে পাশের রুমে একা নিয়ে বললেন, “এ রকম সময়ে লজিক ঠিক মতো কাজ করে না। ওকে আমি বলেছি, ও ভবিষ্যতে প্রেগন্যান্ট হতে পারবে। ও যখন মানসিকভাবে শক্ত হয়ে আসবে, তখন ওকে বলতে হবে সেটা আর সম্ভব না। তার আগে এই তথ্যটা সংশোধন করার দরকার নাই। আসলে ওর সাব কনসাস মাইন্ড কিছুতেই মানতে পারছে না যে সে আর মা হতে পারবে না।”

সাইক্রিয়াটরিষ্ট সাহেব খুব সাবধান করে দিলেন, যাতে আগামী কয়েক দিন আফজাল সব সময়ে শেরীর কাছাকাছি থাকে। পূর্ণ ভালো হতে হতে তিন মাস কিংবা ছয় মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তিনি নতুন দুটো ওষুধ প্রেসক্রিপশন করেছেন। আশা করছেন ফলাফল কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যাবে। তবে সমস্যা হলো প্রায় ১০% রুগীর সাইড এফেক্ট হয়। মুড সুইং প্রথমে বাড়তে বাড়তে ধীরে ধীরে কমে আসে। এই সময়ে আত্মহত্যার ঝুঁকি ভীষণভাবে বেড়ে যায়। শেরী যেহেতু এর মধ্যে কাজটা একবার চেষ্টা করেছে; সে জন্যে সম্ভাবনা আরও বেশী। এমনো দেখা গেছে, অল্প কিছুদিনের মধ্যে একেবারে ভালো হয়ে গেছে। রুগীরা নির্মম বাস্তবতা মেনে নেয়। তিনি বললেন, দু সপ্তাহ পর শেরীকে তার কাছে নিয়ে আসতে। তিনি কেমন অগ্রগতি হচ্ছে সেটা দেখতে চান। এবং তিনিই জানাবেন কখন শেরীকে কি জানাতে হবে। সাইক্রিয়াটরিষ্ট আফজালকে একটু গম্ভীর গলায় জানিয়ে রাখলেন যে, তিনি শেরীকে আর্টিফিশিয়াল ওভারি সম্পর্কে কিছুটা অতিরিক্ত আশার কথা বলেছেন। কারণটা তিনি চাচ্ছেন যে শেরী যাতে এখনই একেবারে আশা হারিয়ে না ফেলে। ডাক্তার সাহেব আফজালকে আরও বললেন, “শেরী হয়তো তোমাকে স্পার্ম কালেক্ট করে রাখার জন্যে বলতে পারে। তাকে এক ধরনের আস্থা দেয়ার জন্যে কাজটা করা যেতে পারে।” তিনি একটু দম নিয়ে বলে চললেন, “এর থেকে আমি আশা করছি যে শেরীর অবচেতন মন ধরে নিবে যে বাচ্চা হওয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে। তার মা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যায় নি। অবশ্য ভবিষ্যতে তোমরা চাইলে সারোগেট মাদার ( কারো গর্ভ ব্যবহার করে ) দিয়ে বাচ্চা নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে তোমার স্পার্ম ব্যবহার হবে। অন্ততপক্ষে তুমি বায়োলজিক্যাল বাবা হতে পারবে। তাতেই হয়তো ওর সান্ত্বনা হবে। যাই হোক, তোমরা সেইটা করবে কি-না, সেটা তোমাদের ব্যাপার। আমি সাইক্রিয়াটরিষ্ট না একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কথাগুলো বলছি। তবে তোমরা অবশ্যই দূরে কোথাও থেকে ভ্যাকেশন করে এসো। শেরীর জন্যে ভিন্ন কোন পরিবেশে যাওয়াটা খুবই জরুরী।”

আফজাল ঠিক নিশ্চিত ছিল না শেরী তাকে আসলেও স্পার্ম ব্যাঙ্কে যেতে বলবে কি-না। কিন্তু বলে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। শেরীই ঠিকই সেই আবদার করে বসলো, “যাও তুমি স্পার্ম ব্যাঙ্কে যেয়ে কাজটা করে আসো। বলা তো যায় না আর্টিফিশিয়াল ওভারি তৈরি হতে কতো সময় লাগে। আমি তোমার সবচেয়ে শক্তিশালী স্পার্মটাই চাই।” প্রথমে আফজাল কিছুটা গাঁই গুই করছিল। কিন্তু শেরীকে মনে কষ্ট দিতে একেবারেই ইচ্ছা করলো না। বেচারি এমনিতেই অনেক ভুগছে। তারপরেও আফজাল কিছুটা সময় নিলো সিদ্ধান্ত নিতে। তিন দিন পরে বলল, “আমি কাজটা করতে পারি দুটো শর্তে। এক তুমি কথাটা কাউকে বলতে পারবে না। দুই, তোমাকে আগামী শনিবারেই আমার সাথে ক্যানাডায় যেতে হবে, নায়েগ্রা ফলস দেখতে।” শেরী সাথে সাথেই দুই শর্তেই রাজী হয়ে গেল। আফজাল বেশ স্বস্তি পেল এই ভেবে প্রকৃতির অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যদি শেরীর ডিপ্রেশন চলে যায়। যা হয় নি সেটা মনে রেখে কষ্ট পেয়ে আর কত সময় নষ্ট করা যায়?

পরের দিন আর বলতে হলো না, আফজাল নিজেই সকালে উঠে রওয়ানা হলো দিলো স্পার্ম ব্যাঙ্কের উদ্দেশ্যে। দরজায় দাঁড়িয়ে শেরী একটা ফোঁড়ন কাটলো, “দেখো আবার ব্যাঙ্কে স্পার্ম না দিয়ে কোনো মেয়ের ভিতরে দিয়ে এসো না।” কথাটা শেষ করার আগেই শেরী মুখ টিপে টিপে হাসলো, আফজালের মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেল। অনেকদিন পর মেয়েটার চেহারা মধ্যে আগের সেই লাবণ্য খুঁজে পেলো। মিষ্টি মেয়ের এই আনন্দের জন্যে সে যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। স্পার্ম জমা রাখা সেখানে কোন ব্যাপারই না। সে গতকালই কথা-বার্তা বলে আজকের জন্যে আপয়েনমেণ্ট ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ এক প্রশ্ন মাথায় এসে ঠায় পেল। ওয়েব সাইটে স্পার্ম বের করার যে প্রক্রিয়ার কথা দেয়া আছে, সেটা ভেবে হাসি পেলো। এই বয়সে ছবি দেখে কি আর উত্তেজিত হওয়া যায়। তারপরে জোড় করে বের করা। খুবই হাসি পেলো। মানুষের মাথায় কত না অদ্ভুত বুদ্ধি। স্পার্ম যত্ন করে বের করে ফ্রিজে অনন্তকালের জন্যে সেভ করার উপায় বের করেছে। হা হা কি অদ্ভুত, সে মারা গেলেও অন্য কোন নারী সেটা ব্যবহার করে গর্ভবতী হতে পারবে; একটা শিশুর জন্ম দিতে পারবে। সেটা যদি একশত বছর পর হয়? তার স্পার্ম দিয়ে গর্ভবতী হবে তখনকার সুন্দরী কোন মেয়ে। কি যেন হিসাবটা পঞ্চাশ বছরে এক প্রজন্ম (generation), একশত বছর পর দু প্রজন্ম। তার নাতির সমকক্ষ কোন মেয়ে যদি তার স্পার্ম ব্যবহার করে। বিষয়টাতে কি লজ্জা পাওয়া উচিৎ?

নাহ কাজটা করতে ঝামেলা হলো না। অনেকদিন মিলন হয় নি। অল্প চেষ্টাতেই মেলা বীর্য বের হয়ে এলো। বাকী কাজগুলো যেভাবে বলা ছিল, ঠিক সেভাবেই করলো। স্পার্মের মালিকানা তার অনুপস্থিতিতে শেরীর নাম দিলো। হিসেব নিকেশ শেষ করে আফজাল যখন স্পার্ম ব্যাংক থেকে বের হচ্ছে, পিছন থেকে এক মহিলা কণ্ঠ তাকে ডাকলো, “মিস্টার আফজাল, মিস্টার আফজাল”। ঘুরে দেখে মাঝ বয়সী এক মহিলা তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে, “আমি এই সেন্টারের ম্যানেজার। আমার সাথে একটু আসুন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে।” আফজাল বুঝে পেলো না তার সাথে আবার কি কথা থাকতে পারে। সে তো যা যা বলা হয়েছে সবই করেছে। কিছুটা ইতস্তত করে উত্তর দিলো, “জী মানে আমি তো ফুল পেমেন্ট করে দিয়ে এসেছি। মহিলা বলল, “বিষয় সেইটা না। আপনার সাথে কনফিডেন্সিয়াল কথা আছে। আপনি আমার সাথে আমার অফিসে কাইন্ডলি আসুন।”

আফজাল ম্যানেজার মহিলার থেকে এই কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তিনি একটা শান্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে আরম্ভ করলেন, “আমার দেখে মনে হয়েছিল আপনি ভারত কিংবা পাকিস্তানের হবেন। আমাদের একজন ক্লায়েন্ট আছে, যিনি এই দু দেশের যে কোনো একটা থেকে এসেছেন। তবে তার স্বামী ওই দিককারই আরেক দেশ বাংলাদেশের। দম্পতিটা শিশু নিতে চায়। কিন্তু হাসব্যান্ডের শারীরিক কিছু সমস্যা আছে। তার স্পার্ম কাউন্ট খুবই কম। অনেক চিকিৎসা নিয়েছে কিন্তু লাভ হয় নি। কিন্তু সেটা থেকে ফারটিলাইজ হচ্ছে না। ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডোনেটেড স্পার্ম ব্যবহার করবে। আমাদের জন্যে সেটা জোগাড় করে দেয়া কোনো কঠিন ব্যাপার না। তবে মহিলার একটা শর্ত, কাজটা কঠিন করে দিয়েছে। তিনি চাচ্ছেন বাংলাদেশ অরিজিনের কারো স্পার্ম নিতে। শুধু তাই না ডোনারকে লম্বা ও স্মার্ট হতে হবে। তারা প্রয়োজনে ডোনারকে ফিফটি থাউসেন্ড ডলার দিতে প্রস্তুত আছে।” মহিলা একটু থেমে নিয়ে দম নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “ এখন বলো তোমার জন্ম কোন দেশে? আর তুমি স্পার্ম দিয়ে একটা দম্পতিকে সাহায্য করতে পারো কি-না?”

মুহূর্তেই আফজালের বেশ অনেকগুলো ঘটনার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে এলো। এক সময়ে মানুষকে সাহায্য করার মধ্যেই ছিল মহা আনন্দ। সেই সাপ মারার ঘটনা কিংবা সীতাকুণ্ডে পাহাড়ে সেই ছোট শিশুটাকে উদ্ধার করার কথা মনে পড়ে গেল। নিজের জীবন রাজী রাখতে তার একবারও দ্বিধা হয় নি। বরং কারোর স্বস্তি ফিরিয়ে যে সন্তুষ্টি পেয়েছিল, তার পৃথিবীর অন্য কোনো কাজ থেকে কোনো ভাবেই পাওয়া সম্ভব না। বিদেশে আসার পর তেমন সুযোগও হয় নি কারোর সাহায্যে সেইভাবে এগিয়ে যাবার। সাহস দেখানোর তো প্রশ্নই উঠে না। মুহূর্তেই আফজাল রাজী হয়ে গেল, “আমি দম্পতিটাকে সাহায্য করতে রাজী। কিন্তু আমি এই কাজের জন্য একটা পয়সাও নিবে না। তবে আমার একটা শর্ত আছে। ওরা যদি আমার স্পার্ম থেকে বাচ্চা জন্ম দিতে সমর্থ হয়, তা হলে বাচ্চা যখন ১৮ বছরের কিংবা পূর্ণ বয়স্ক হবে; সে চাইলে তখনই শুধু আমার পরিচয় দেয়া যাবে। তার আগে কখনই না। যদি সে আগ্রহী হয় তা হলে আমার সাথে যোগাযোগ করো। ওরা যদি শর্ত পালন করতে প্রস্তুত থাকে, আমি স্পার্ম ডোনেট করবো।”

ঘণ্টা খানেক পরেই আফজালের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ওই দিক থেকে স্পার্ম ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মহিলা মহা উৎসাহে বলতে লাগলেন, “তোমার শর্ত ওরা মেনে নিয়েছে। এখন তোমার সুবিধা মতো এসে কাজটা করে যেতে পারো।” পরের দিন সকালে আফজাল স্পার্ম ব্যাংকে ফিরে এলো। তার হাতে সময় একেবারে কম। বিকালেই ফ্লাইট। শেরীকে নিয়ে সে ভ্যাঙ্কুভার যাচ্ছে। আগামী সাত দিন সেখানে ঘুরবে, ফিরবে, আরাম করবে। এই কয়টা দিন ওদের উপর কি ভীষণ ধকলটাই না গেল!

সকালে ঘুমটা ভাংলো একেবারে অন্যরকমভাবে। রাতে যখন হোটেলে এসে উঠেছিল, তখন শরীরে ছিল দুনিয়ার ক্লান্তি। মুখে কিছু খাবার দিয়ে বিছানায় শোয়া মাত্রই দু জনই ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেল। জানালার দু দিককার পর্দার মধ্যে কিছুটা ফাঁকা ছিল। সেখান থেকে সূর্যের আলো ভেদ করে রশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। তারই কিছুটা এসে পড়লো ওদের মুখে। প্রথমে ঘুম ভাংলো শেরীর। কানের আসলো জলপ্রপাতের পানি পড়ার বিরামহীন গর্জন। একই শব্দ রাতেও শুনেছিল। তখন হয়তো ক্লান্তিতে শব্দটাকে তেমন মায়াবী মনে হয় নি। এখন কানে শব্দ যাওয়া মাত্রই মন-শরীর দুটোই কেমন আবেশে ভরে গেল। শেরী উঠে যেয়ে পর্দা সরালো। সাথে সাথে সূর্যের সব আলো রুমের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে ডুকে সারাটা ঘর আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিলো। চোখে পড়লো বিশাল জলপ্রপাতের অবিরাম পানি পড়া। অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা অস্থির হয়ে গেল। সে আনন্দে চিৎকার করে আফজালকে ডাকলো, “উঠো, উঠো। দেখো কি চমৎকার দৃশ্য আর পাগল করা দেয়া সুরের শব্দ। নায়েগ্রা আমাকে একই সুরে ডেকেই চলেছে। আমি নায়েগ্রাকে ছুঁতে চাই। আমি এই পানির ভিতরে ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতে চাই।”

আফজাল দেরি করলো না। শেরীর পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। আসলেও বিমোহিত হওয়ার মতো দৃশ্য। সাথে জল প্রপাতের শব্দের সুর। কিন্তু আফজাল শেরীর উত্তেজনায় আরও অনেক বেশী উৎসাহিত হলো। কায়মনোবাক্যে সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করলো, তিনি যেনো শেরীকে আগের মতো সেই হাস্যোজ্জল, উচ্ছল করে দেন। ওরা রেডি হয়ে নাস্তা করে বের হয়ে পড়লো নায়েগ্রাকে ছুঁয়ে দেখতে। ছুটে ছুটে চোখ ভরে শেরী বিশাল এই জলপ্রপাত দেখতে লাগলো। তার চোখ-মুখ থেকে আনন্দ বুঝি ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছে। কে বলবে মাত্র কয়েক দিন আগে মেয়েটা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। তার কাছে জীবন একেবারে অর্থহীন মনে হয়েছিল। আফজাল ক্যামেরা দিয়ে একের পর এক ছবি তুলে চললো। আফজালের ভীষণ ভালো লাগছে। নায়েগ্রা জলপ্রপাত ও শেরীর আনন্দ -হাসি ভরা মুখ তার ভালো লাগাকে একেবারে পরিপূর্ণ করে দিলো। আরও আগে আসলে শেরীকে এতো কষ্টে ভুগতে হতো না।

পর্যটকদের জন্যে ছোট ছোট লঞ্চে করে জলপ্রপাতের পানি ঠিক যেখানে আছড়ে পড়ছে তার একেবারে খুব কাছাকাছি চলে যায়। চোখে মুখে পানির ছিটা লাগে। চূড়ান্তভাবে বিস্মিত না হয়ে উপায় নাই। এ রকম এক লঞ্চে ওরা দুজন চললো নায়েগ্রার বাকিটুকু সৌন্দর্য স্পর্শ করতে। লঞ্চে প্রচুর মানুষ ছিল। সবার পরনে ভেষ্ট , যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ পানিতে ডুবে না যায়। নায়েগ্রার পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত বেশ কিছু মানুষ মারা আছে। যাই হোক আনন্দের সময়ে এইটা নিয়ে কথা না বলাই ভালো। লঞ্চের যাত্রীরা অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল কিংবা ছবি তুলা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সব চেয়ে মজার ব্যাপার নায়েগ্রা ফলসের পানিতে সূর্যের আলো থাকলেই রংধনু দেখা যায়। ওরা পানিতে লঞ্চে উঠার আগেই সেই রংধনু দেখেছে। এখন তাদের লঞ্চ সেই জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। এই স্বর্গীয় অভিজ্ঞতার তুলনা দেয়া একেবারেই মুশকিল। দৃশ্যটাকে স্মরণীয় করতে আফজাল ছবি তুলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মানুষের জীবনে এ রকম সুযোগ খুব বেশী আসে না। তার ছবি তুলতে এমনিতেই ভালোই লাগে। এক সময়ে ছবি তুলতে কতো খরচ করতে লাগতো। ছবি তুলে নেগেটিভ ওয়াশ করে প্রিন্ট। আর এখন ইলেক্ট্রনিক ক্যামেরায় ক্লিক করা মাত্রই রেডি। দু মিনিটের মধ্যে ফেসবুকের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া যায়। আফজাল এই সব ভাবছিল আর মনের সুখে ছবি তুলে চলে ছিল।

হঠাৎ কেমন একটা আর্ত চিৎকার শুনতে পেলো। তার পরে কিছু মানুষের হৈ চৈ। আফজাল তাকিয়ে দেখে আশে পাশে শেরী নাই। সাথে সাথেই এক অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠলো। লঞ্চের আরেক প্রান্তে মানুষ জটলা হয়ে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। আফজাল সেখানে ছুটে যেয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে। একজন মহিলা পানিতে লাফ দিয়েছে। কথাটা শোনা মাত্রই আফজালও পানিতে শেরী বলে চিৎকার করে লাফ দিল।

উদ্ধার কর্মীরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে চলে এলো। একজন মহিলাকে তারা টেনে তুললো। তবে সেটা শেরী না। অন্য এক মহিলা। আফজালকে পাওয়া গেল প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে। তবে তার নিথর শরীর। একেবারে উজানে। আফজাল লাফ দেয়া মাত্রই তাকে প্রচণ্ড পানির স্রোত টেনে নিয়ে যেতে থাকে। ভেসে যাওয়ার সময় তার মাথা কোন পাথর কিংবা শক্ত কিছুর সাথে আঘাত হয়। তাতেই আফজালের মাথার একটা বড় অংশ থেঁতলে যায়। সম্ভবত সেই কারণেই আফজালের ইহ জগতের যাত্রা সেখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়।

উনিশ বছর পরের কথা। শেরী গত কয়েক বছর ধরে সেই যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি করেছিল, সেখানেই টিচার হিসেবে কাজ করেছে। আফজালের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে। একটা মানুষ তাকে ডিপ্রেশন থেকে ভালো করার জন্যে, তার জীবন রক্ষা করার জন্যে নিজের প্রাণটা দিয়ে দিলো। অনেকে পরামর্শ দিয়েছিল আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে। শেরীর আগ্রহ হয় নি। একজন মানুষ মারা যেতে পারে, কিন্তু তার ভালোবাসা কখনো শেষ হতে পারে না। সে ঠিক করে রেখেছে আফজালের ভালোবাসা নিয়ে বাকীটা জীবন কাটিয়ে দিবে। শেরী মাঝে মধ্যে ইচ্ছা হয়েছে, ব্যাঙ্ক থেকে স্পার্ম নিয়ে আফজালের মতো কাউকে পৃথিবীতে আনতে। শেরী জানতো আফজাল তাকে স্পার্মের মালিকানা দিয়ে গেছে। সে চাইলে কাজটা করতে পারে। কিন্তু তেমন আগ্রহ পায় নি। কোনো উৎসাহী মহিলার গর্ভ ভাড়া করে ও অন্য কারো নারীর ডিম্ব ব্যবহার করে আফজালের মতো কাউকে পৃথিবীতে আনা যেতে পারে। ।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া নতুন সেশন আরম্ভ হয়েছে। শেরী কেমিস্ট্রি ১ ক্লাস নিতে যেয়ে খুবই অবাক হলো। একটা চেহারা দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। ক্লাসে মাঝামাঝিতে একটা ছেলে বসে আছে, সে দেখতে সেই প্রথম দেখা আফজালের সাথে ভীষণ মিল। সেই নাক, চোখ, উচ্চতা, শরীরের গঠন। এইটা কি করে সম্ভব? একজন মানুষের সাথে আরেকজনের এতো মিল হয় কি করে? কেউ কি তা হলে আফজালের স্পার্ম ব্যবহার করেছে? শেরীর অনুমতি ছাড়া এইটা-তো স্পার্ম ব্যাঙ্ক করবে না। এখানকার আইন কানুন খুব কড়া। কাজটা করলে স্পার্ম ব্যাঙ্কের বড় শাস্তি হবে। তা হলে কি হতে পারে? কেমন করে এই ছেলে আফজালের মতো দেখতে হয়?

যেই কাজটা কড়া উচিৎ না, শেরী সেই কাজটাই করলো। ছেলেটাকে ক্লাসের পর দেখা করতে বলল। কিছু প্রাথমিক কথা বার্তার পর শেরী আফজালের ছবি দেখিয়ে বলল, “আমি খুবই অবাক হচ্ছি যে তোমার চেহারা ও আকৃতি আমার মৃত হাসবেন্ডের সাথে অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। যদি কিছু মনে না করো, আমি কি তোমার বায়োলজিক্যাল বাবার নাম জিজ্ঞাসা করতে পারি?”

ছেলেটা মিষ্টি হেসে উত্তর দিল, “জী অবশ্যই। তার নাম আফজাল হোসেন।”

 

অক্টোবর ১, ২০১৭