কাঁধে নিয়ে রোদ্দুর
“কাঁধে নিয়ে রোদ্দুর” কতদূর যাওয়া যায়? উত্তরটা গানটার যে রচয়িতা তার মুখ থেকে শোনার কথা ছিল শুক্রবার মার্চের ৯ তারিখে। বেশ কিছুদিন ধরে কাজটার জন্যে প্রস্তুতি চলছিল। আশরাফ শামীমের ঢাকা থেকে স্কাইপের মাধ্যমে যোগ দেয়ার কথা ডালাস থেকে প্রচারিত “টেক্সাস টক” অনুষ্ঠানে। সে জন্যে তার লেখা কিছু অপ্রকাশিত কবিতা ও গান প্রচারের জন্যে ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু না পরিকল্পনা মাফিক কাজটা শেষ পর্যন্ত করা গেল না। না বলে- না কয়ে হাতের সব কাজ ও অঙ্গীকার বাতিল করে শামীম চলে গেল না ফেরার দেশে। আরেকবার প্রমাণ হলো, মানুষ ভাবে এক, আর বিধাতার সিদ্ধান্ত থাকে আরেক। (Man proposes, God disposes)
সেই কলেজ জীবন থেকে আশরাফ শামীমের সাথে পরিচয়। অবশ্য ঘনিষ্ঠতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে। ওই বয়সেই সে গুছিয়ে ধীরে সুস্থে যুক্তি, তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে দারুণ কথা বলতো। চমৎকার কবিতা লেখার হাত ছিল। শ্রেণী বিভক্ত সমাজের নিপীড়ন তাকে ভীষণ ব্যথিত করছিল। বিত্তবানদের শোষণ সে কোনো ভাবেই মানতে পারছিল না। সে স্বপ্ন দেখা আরম্ভ করেছিল দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের। সক্রিয় হয়ে উঠেছিল রাজনীতিতে। এর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে আমি বিদেশে পাড়ি দেই। তখন দীর্ঘ দিন শামীমের সাথে যোগাযোগ ছিল না। তবে অন্য বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ওর খোঁজ খবর পেতাম। দেশে যত বারই বেড়াতে গিয়েছি, শামীম সময় বের করে ঠিকই আমার সাথে দেখা করে যেতো।
আশরাফ শামীম নিজে গবেষণা করতো, লিখতো এবং প্রচুর বই পড়তো। তার পরেও সে ছিল আমার মতো সাধারণ ও প্রবাসী এক মানুষের লেখা-লেখির একনিষ্ঠ ভক্ত। প্রথম দিকে আমাকে তার মুগ্ধতার কথা বললে, ভাবতাম বন্ধু বলে একটু বেশীই উচ্ছ্বাস দেখায়। একবার সম্ভবত আমার সংশয় ধরতে পেরে আমার লেখা ভালো লাগার কারণ ব্যাখ্যা করে লিখলো, “যেখানে আমাদের নেশাগ্রস্ত কবিগণ গণিকালয় আর পরকীয়ায় আসক্ত না হয়ে কবিতার ভাব-ছন্দ খুঁজে পায় না, তেমনি মূর্খতার কুয়োর বসে নির্লজ্জ গদ্য লিখে খ্যাতি লাভের চেষ্টায় রত থাকে যে দেশের সাহিত্য-উৎপাদক গোষ্ঠী--- সেখানে কাজী হাসানের জীবন ঘনিষ্ঠ গল্প বা প্রবন্ধগুলি আমাদের মনোজগতকে সৎ-সাহিত্যের দীপ্তিতে প্লাবিত করে দেয়। পাঠকের সাথে কথা বলার তার আছে বিশেষ এক ভঙ্গি, যা একান্তই তার নিজস্ব। আমি এটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমি তার কাছে আরো অনেক বেশি সৃষ্টিকর্ম আশা করি যা তাকে নিশ্চিতভাবে এক বিশেষ মানবিক উচ্চতায় নিয়ে যাবে।” মনে হলো আমার বন্ধু শামীম আমার কাঁধে দায়িত্বের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিলো। বন্ধু, আমাকে উৎসাহ দেবার এই অদম্য চেষ্টার কথা ভেবে আজ তোমাকে স্যালুট দিচ্ছি। সাথে সাথে হেনরি ফোর্ডের কথাটা স্মরণ করছি, “My best friend is the one who brings out the best in me”
বছর দেড়েক আগে যখন দেশে গেলাম, শামীম তখন অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে। ওকে দেখতে গিয়ে কেবিনে পেলাম না। কেবিন নম্বর আবারও চেক করে দেখলাম। একজন নার্সকে জিজ্ঞাসা করলাম। উনিও কিছু বলতে পারলেন না। ভাবছিলাম কি করা যায়। এর মধ্যে দেখি আমাদের কবি মহোদয় ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে আসছেন। হাতে একটা ব্যাগ। ছুটে গেলাম ওর কাছে। ধরে নিয়ে এসে বিছানায় বসালাম। কিছুক্ষণ পরে আবিষ্কার করলাম তার উধাও হবার কারণ, “শাহবাগের মোড়ে ভালো শরমা বানায়। নিজে যেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়ে আনলাম।” অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। অসুস্থ যে মানুষের বিছানায় থাকার কথা সে কি-না গেছে বন্ধুর আপ্যায়নের জন্যে সুস্বাদু কিছু খাবার আনতে। এইবার আমাকে আশ্বস্ত করে বললো, “সব পরিষ্কার ও ভেজালহীন। নির্ভয়ে খেতে পারো। তোমার মার্কিন উদরে কোনো সমস্যা হবে না।” ঘটনাটা আজ মনে করতেই মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলির একটা কথা মাথায় চলে এলো, “Friendship is the hardest thing in the world to explain. It’s not something you learn in school. But if you haven’t learned the meaning of friendship, you really haven’t learned anything”
কয়েক দিন পর দেশে যাবো। এবার শামীম দেখা করতে আসবে না, কিংবা আমি চাইলেও তার সাথে কিছু আড্ডা দিয়ে আসতে পারবো না। এই বারের একুশে বই মেলায় আমার দুটো বই বের হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগেই বলছিল, শরীরটা দুর্বল না হলে সে নিজে যেয়ে বই দুটো যোগাড় করে নিয়ে আসতো। ইচ্ছা ছিল নিজের হাতে তাকে বইগুলো উপহার দেবার। না সেটা আর সম্ভব না। আমার ভিতরটা একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আমি জানি তার কাছের যারা, সবারই আমার মতই অবস্থা। আমি জানি তার প্রতিটা আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত-জনের ভিতরটা আশরাফ শামীমের জন্যে ছট ফট করছে। মানুষকে সহজে আপন করে নেবার দুর্লভ গুণটা তার ছিল। কি মনোযোগ দিয়েই না সে অন্যের কথা শুনতো! কি আগ্রহ নিয়েই না প্রত্যেকের সাথে কথা বলতো।
এক জন মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আশরাফ শামীম বিশাল বড় একটা স্বপ্ন দেখেছিল দেশে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার। না সেটা বাস্তবায়ন এখনো অনেক দূর। কিন্তু সে তার সাধ্য মতো কাজ করে গেছে। কবিতা ও সাহিত্যে প্রচণ্ড প্রতিভা থাকলেও সময় ও সুযোগ তার পক্ষে কাজ করে নি। অকালেই বেচারা বিদায় নিলো এই পঙ্কিল পৃথিবী থেকে। বন্ধু আমার জীবনের শেষ কয়েকটা বছর রোগে-কষ্টে ভুগে খুব কষ্ট পেয়ে গেছে। ক্যানসার হয়েছিল। লিভার কাজ করছিল না। অপরিসীম মনের জোর ছিল বলেই এতদিন সে মারাত্মক রোগগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেতে পেরেছিল। এখন তার রোদ্দুর কাঁধে নিয়ে চলা শেষ হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তার ভোগান্তির ইতি টেনেছেন। আমিন।
কাজী হাসান
মার্চ ৩, ২০১৮
(আশরাফ শামীমের লেখা “কাঁধে নিয়ে রোদ্দুর” গানটা এখানে সংযুক্ত করে দিলাম--লেখাটা ওর দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে রিপোস্ট )