time lapse photography of lights

অপার্থিব

চাকলাদার সাহেব টোস্ট বিস্কুট খাচ্ছেন। তার খাওয়ার ধরণটা একেবারেই অন্যরকম

সামনে এক কাপ চা থেকে ধুঁয়া উড়ছে। তিনি সেখানে বিস্কুটটা ভিজিয়ে নিচ্ছেন না।

প্রথমে কটাস করে শব্দ হবে। তার মানে তিনি কামড় দিয়ে এক টুকরো টোস্ট বিস্কুট মুখের ভিতর দিয়েছেন। তার পরে আরম্ভ হবে চিবানো। অনেকটা ঘর বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। চারিদিকে শুধু শব্দ আর শব্দ, মড়, মড়, কট, কট। তিনি আবার তখন চোখ বন্ধ করে এই বিশেষ সময়টা উপভোগ করেন। বিস্কুটটা চাবানো শেষ হলে, চুষ করে শব্দ হয়। তখন বুঝতে হবে, মুখের বিস্কুটের টুকরো তার ইহ-জাগতিক দায়িত্ব শেষ করে, রহিম চাকলাদারের উদরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।

চাকলাদার সাহেব এর পরে ক্ষণিকের জন্যে চোখ খুলবেন। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিবেন। কাপটা পিরিচের উপর রাখা মাত্র, ডান হাতটা নিজে নিজে বিস্কুটের বাকী অংশটা নিয়ে মুখের কাছে চলে আসবে। তিনি বিস্কুটটাকে আরেকবার চোখ গোল গোল করে দেখে নিয়ে, চোখ বন্ধ করবেন। তার পরে কামড় বসাবেন।

আবার চারিদিকে চলতে থাকবে টোস্টের বিকট বাজনা। পরিষ্কার শোনা যাবে দশ হাত দূর থেকেও।

এই ভাবে জনাব রহিম চাকলাদার এক এক করে দুটো টোস্ট বিস্কুট আর সাথের এক কাপ চা শেষ করবেন। সময়টা একেবারে বাঁধা ধরা: সাড়ে দশটা থেকে দশটা পঞ্চান্ন পর্যন্ত। পরের পাঁচ মিনিটে তিনি বাথরুমে একটা সংক্ষিপ্ত সফর দিয়ে আসবেন। কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় ফাইল খুলে কাজে মন দিবেন।

সপ্তাহের পাঁচ দিক এর কোন ব্যতিক্রম নাই। যেই বিস্কুট থেকে এত শব্দ বের হয়, তা যে তিনি কোথা থেকে আনেন, তার রহস্য তিনি পর্যন্ত কারো কাছে ফাঁস করেন নি।

এক কামরার অফিস, সাথে লাগান গুদাম। ঢাকার “অতিক্রম ইন্টারন্যাশনালকোম্পানির তিনি ডিসট্রিক্ট ম্যানেজার। যদিওবা উপজেলার দায়িত্ব, তারপরেও পদবী ডিসট্রিক্ট ম্যানেজার। গত দুই বছর ধরে এই পদে আছেন। এখানে ঢাকার থেকে গুড়ো দুধের চালান আসে। এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা তার থেকে কিনে নিয়ে যায়। প্রতি তিন মাসে ঢাকা থেকে টাই পড়া লোক আসে হিসাব নিকাশ দেখে যাবার জন্যে। সেই দিন অফিসে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বিরানি আনা হয়। ঢাকার মানুষ বলে কথা, আদর আপ্যায়নের কি কোন কমতি করা যায়। ছোট শহরে গল্প চালু আছে, ঢাকার লোকদের মারাত্মক ক্ষমতা। এক কলমের খোঁচায় যে কারোর চাকরি মুহূর্তের মধ্যে খুইয়ে দিতে পারে।

রহিম চাকলাদার ছাড়াও এই অফিসে আরও দুই জন কাজ করে। অধীর বিশ্বাস ক্যাশিয়ার; টাকা পয়সা লেন দেন, হিসাব নিকাশ আর ব্যাঙ্কে আসা যাওয়া করে। তৃতীয় ব্যক্তি শুকুর আলি হল সুপারভাইজার। ট্রাক যে দিন দুধ নিয়ে আসে, সেদিন তাকে দু জন কুলি নিয়ে আসতে হয়। সাথে সাথে থেকে তাদের কাজের তদারকি করে। অন্য দিন গুলোতে গুদামের তালা খুলে কাস্টমারদের মালামাল এনে দেয়। তা ছাড়া সুযোগ পেলেই অধীর বিশ্বাসের উপরে সুপারভাইজারি ফলানোর চেষ্টাটা থাকে। বলে, কি করেন সারাদিন বসে বসে, অফিসটাও একটু গুছিয়ে রাখতে পারেন না।

অফিসের তিন অধিবাসীর বসার জায়গা একই কামরায়। এক দিকে চাকলাদার সাহেবের বড় টেবিল। অন্যদিকটায় অধীর আর শুকুর আলির বসার জায়গা। অবশ্য সাড়ে দশটা থেকে এগারটা পর্যন্ত এরা দু জন অফিসের বাইরে যেয়ে সিগারেট টেনে আসে। চাকলাদার মুরুব্বী মানুষ, তার সামনে তো আর সিগারেট টানা যায় না। তা ছাড়া উনার টোস্ট বিস্কুট খাবার সময় যে বিশাল প্রলয়ঙ্করী শব্দ আরম্ভ হয়ে যায়, তা তাদের কানের জন্যে নেয়াটা কঠিন ব্যাপার। এই সময়ে কোন কাস্টমার আসলে, তাদেরও বাইরে অপেক্ষা করতে হয়।

রহিম চাকলাদারের টোস্ট বিস্কুট খাবার বিষয়টা শহরের সবাই জানে। এক কান, দু কান করে সবার কাছেই খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই উৎসাহ নিয়ে গেছে, নিজের চোখে দেখে আর কানে শুনে আসার জন্যে। কিন্তু অধীর বিশ্বাস আর শুকুর আলি তাদের কোন ভাবেই অফিসে ঢুকতে দেয় নি। বরং সিগারেট টানতে টানতে আরও বাড়িয়ে বলেছে, বিস্কুট খাবার শব্দে টেবিলের সব জিনিষপত্র নীচে পড়ে যায়। এগারটা দু মিনিটে ঢুকে, তাদের প্রথম কাজ হয় মেঝে থেকে পড়ে যাওয়া জিনিস পত্র উঠিয়ে, আবার জায়গা মত রাখা।

ছোট মফঃস্বলের মানুষরা নিজের চোখে দেখতে না পেয়ে বিষয়টার নানা ডাল পালা বিস্তার করে রঙ মিশিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এটা এখন অনেকটা কিংবদন্তিতে রুপ নিয়েছে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন বেড়াতে এলে এলাকাবাসী সগর্বে চাকলাদার সাহেবের ঘটনা বয়ান করে।

যেই রহিম চাকলাদারকে নিয়ে এত আলোচনা, তিনি কিন্তু নিজে খুব বেশী কথা বার্তা বলেন না। দু রুমের টিনের ছাদওয়ালা বাসায় একাই থাকেন। সপ্তাহে এক বার কাঁচা বাজার করেন। অফিস-বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যান না। ষাটোর্ধ চাকলাদার সাহেবকে মানুষরা আড় চোখে দেখে। অনেকের ধারণা তিনি মানুষ না, হয়তো জীন। আবার কিছু মানুষ বলে, তিনি আসলে আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করেন। জীনরা তাকে সব সময় ঘিরে রাখে। সে জন্য তিনি, অফিসের বাইরে কারোর সাথে একান্ত প্রয়োজন না হলে কথা বলেন না।

তবে, অফিসের অধীর বিশ্বাস আর শুকুর আলি ভাল করেই জানে রহিম চাকলাদারের থেকে সৎ মানুষ আর হতে পারে না। কত বারই না কত মানুষ না তাকে প্রলোভন দেখিয়েছে। এক বার তো ঢাকা থেকে আসা টাই পড়া সিনিওর অডিটর, তাকে সরাসরি বাড়তি টাকা আয়ের উপায় বাতলিয়ে দিয়ে গেল। রহিম তালুকদার পরের দিনই ফোন করলেন কোম্পানির এম ডিকে। এক ঘণ্টার মধ্যে অডিটর সাহেবকে সাধের চাকরি হারিয়ে রাস্তায় নামতে হল।

তবে সিনিওর অডিটর সাহেব অধীর বিশ্বাস আর শুকুর আলির সাথে গোপনে সফল আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিল। গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলেছিল, ক্ষমতার পরিবর্তন আসন্ন। তবে একেবারে প্ল্যান মোতাবেক কাজ করে যেতে হবে। আপনাদের মাসোহারা ঠিক সময় মত পৌঁছে যাবে। অডিটর আরেকবার সাবধান করে দিয়ে বলল, খবরদার কাক-পক্ষীও ব্যাপারটা যাতে না জানে। না হলে আপনাদের মহা বিপদ নেমে আসবে।

সিনিওর অডিটরের চাকরি চলে গেলেও, অধীর বিশ্বাস আর শুকুর আলির মাসোহারা ঠিক সময় মত চলে আসত। ওরা বুঝল, দায়িত্বে অবহেলা করলে অডিটরের কথা নির্ঘাত ফলে যাবে।

কোন টোস্ট বিস্কুটে কামড় দিলে এমন শব্দ হয়, তা নিয়ে সুধী জনের বিভিন্ন মতামত আছে। অবশ্য মতামত দেবার আগে অনেকেই চেষ্টা করেছে একই কায়দায় নানা ধরণের টোস্ট বিস্কুট কামড় দিয়ে শব্দ সৃষ্টি করার। কিন্তু কোন লাভ হয় নি। এই সব আয়োজনে প্রধান বিচারক হিসেবে দাওয়াত দেয়া হত চাকলাদার সাহেবের দুই সহকর্মীকে। অনুষ্ঠান শেষে অধীর বাবু কিংবা শুকুর আলি প্রবলভাবে মাথা নাড়িয়ে বলেছে, নাহ উনার কাছাকাছিও হয় নি। এই কাজ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না।

কেও বলেছে বিস্কুটে পাথরের গুড়া মেশান থেকে, আর কেও বলেছে এই শব্দ তার দাঁতের থেকে আসে। কিন্তু কোন মতবাদই ধোপে টিকে নি। শেষে সবাই এক মত হল, বিস্কুট কিংবা দাঁত, কোনটাই না: চাকলাদার সাহেব আসলে অন্য জগতের মানুষ। তিনি যখন বিস্কুট খান, তখন অশরীরীরা এসে, ছন্দে ছন্দে এই সব ঘটনা ঘটায়।

অধীর বাবু আর শুকুর আলিকে টোপ দেয়া হল, তারা যদি মসজিদের মৌলবি সাহেবকে এই সব কাণ্ডকারখানা দেখাতে পারে, তবে তাদের জন্যে বিশেষ পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু মৌলবি সব শুনে এর মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইলেন না। কিন্তু চারিদিকে রটে গেল, তিনি পর্যন্ত ভয় পেয়েছেন। চাকলাদার সাহেবের সামনে যে জীন, ভুত নাচানাচি করে, তারা নাকি মৌলবি সাহেবকে শাসিয়ে গেছে। ওই মুখী হলে ঘাড় মটকিয়ে দেয়া হবে।

কিছু ঘটনা বেশ দ্রুত গতিতে হল।অতিক্রম ইন্টারন্যাশনালতিন মালিকের বিবাদের কারণে দু জন তাদের ভাগের অংশ বিক্রি করে চলে গেল। বেলাল সরকার একেবারে পূর্ণ মালিক হয়ে গেল। শোনা যেত, তার ব্যবসা থেকে রাজনীতি আর দেশ বিদেশ ভ্রমণের দিকেই বেশী মন। লোকে বলাবলি করতে লাগল, বেলাল সরকার নিশ্চয়ই রাজনীতির কোন চাল দিয়ে অন্য দুই পার্টনারকে বঞ্চিত করেছে।

বেলাল সরকার আগের দুই পার্টনারের প্রিয় মানুষদের সব বরখাস্ত করে দিল। আগের এমডিকে সরিয়ে নতুন এমডিকে নিয়োগ দেয়া হল। হেড অফিস থেকে নতুন সব নিয়ম কানুন আসতে লাগল। তিন দিন চেষ্টা করে রহিম চাকলাদার নতুন এমডি সাহেবের সাথে কথা বলার সুযোগ পেলেন। তিনি বলতে লাগলেন, স্যার বয়স তো অনেক হল। এই বার আমি চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে চাই।

ওই দিক থেকে নতুন এমডি সাহেব হৈ হৈ করে বলতে লাগল, আরে না না কি যে বলেন। আমাকে চিনতে পারলেন না। আমি সেই সিনিওর অডিটর, যার বিরুদ্ধে আপনি কমপ্লেন করেছিলেন, আমি কিন্তু সব ভুলে গিয়েছি। হে হে। আমি তো জানি, আপনার থেকে বিশ্বাসী মানুষ আর হয় না। আপনাকে আমাদের এখন বেশী দরকার। অনেক নতুন নতুন ব্যবসা যোগ হবে। তা ছাড়া বেলাল সাহেব একটু গুছিয়ে নিয়ে আপনাকে ভিসিট করতে যাবেন। পত্রিকায় নিশ্চয়ই দেখেছেন, তার মন্ত্রী হবার কথা বার্তা চলছে। তিনি মন্ত্রী হলে, সব ধরণের ব্যবসা আমরা একাই করব। কোন চিন্তা নাই। তখন আপনার বেতন বাড়িয়ে দেয়া হবে।

রহিম চাকলাদারকে আর কোন কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে এমডি ফোনের লাইন কেটে দিল। বেচারা , কিছুক্ষণ ফোনটা কানে ধরে নামিয়ে রাখলেন। তার পরে কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে অজানা কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করে, অনেকটা স্বগক্তি করার মত বিড় বিড় করে বললেন, আমি বাড়ি যাব

বেলাল সরকার অন্য দুই পার্টনারদের সরিয়ে দেওয়ার এক মাসের মধ্যে মন্ত্রী হয়ে গেল। বিরোধী দলের পত্রিকাগুলো নিউজ করল, পার্টি ফান্ডে বিপুল টাকা জমা দেওয়ার পরেই তাকে এই পদ দেয়া হয়েছে। তার গত পাঁচ বছরের চেষ্টা সফলতার মুখ দেখল। নিন্দুক পত্রিকাগুলো এও জানাল, বেলাল সরকার কাঁচা কাজ করে না। ব্যবসায়ী মানুষ কমপক্ষে দশ গুন মুনাফা ছাড়া কোথাও টাকা বিনিয়োগ করে না।

কোন ঘোষণা ছাড়াই এক দিন নতুন এমডি চাকলাদার সাহেবের অফিসে এসে হাজির হল। আলাদা করে মিটিং করল রহিম চাকলাদার আর তার পরে অধীর বাবু, শুকুর আলির সাথে। এমডি দু জনের হাতে দুটো খাম ধরিয়ে ফিস ফিস করে বলল, আপনাদের কাজে আমরা খুব খুশী। চাকলাদার সাহেবকে তো একেবারে বিখ্যাত করে দিয়েছেন। আপনাদের বেতন কয়েকদিনের মধ্যে বেড়ে যাবে।

খুব জরুরী বিষয়। মালিক বেলাল সরকার মন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম সফর হিসেবে, এই উপজেলাকে বেছে নিয়েছেন। পরের নির্বাচনে তার এখান থেকেই দাঁড়ানোর ইচ্ছে। সে নিজে সারা জীবন ঢাকা শহরে থাকলেও, তার বাবা এখানে পাকিস্তান আমলে সরকারী অফিসে কাজ করে গেছে।

কথা বলতে বলতেই, এমডি কোটের পকেট থেকে ছোট একটা বোতল বের করে, তার ভিতরের রঙ্গিন পানি পুরোটাই এক নিঃশ্বাসে গলায় ঢেলে দিল। একটু থেমে বলতে লাগল, একেবারে বিদেশী মাল। কাজের সময় এক বোতলেই মেলা কাজ দেয়, মাথাটা একেবারে ক্লিয়ার হয়ে যায়। চিন্তা করতে আর কথা বলতে সুবিধা হয়। এর মধ্যেই তার গলা ভারি হয়ে এসেছে, সাথে সাথে চোখ দুটো লাল টকটকে। বুঝা গেল, বিদেশী মাল খুবই কাজের। একেবারে ফাস্ট একশান, ডিরেক্ট একশানও বলা যেতে পারে।

এমডি সাহেব এক গাল হেসে, চোখ টিপে বলল, উনি ছিলেন পিওন। এখন তার ছেলে মন্ত্রী। আরেকবার হো হো করে হেসে, কাশতে কাশতে বললেন, আমিও ভাবছি স্যারের সাথে রাজনীতি করা আরম্ভ করব। চাকরি করে আর কত টাকা আয় হয়। জীবনে কিছু টাকা পয়সা রোজগার করতে না পারলে, বেঁচে থাকার আনন্দটাই মাটি। আপনারাও এক কাজ করেন, লোকাল রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। কমপক্ষে চেয়ারম্যান, ফেয়ারম্যান হয়ে আরাম করে জীবনটা কাঁটিয়ে দিতে পারবেন। হো হো।

হাসি থামিয়ে, দম নিয়ে এমডি বলতে লাগল, এখন হল লং টার্ম প্ল্যানিঙ্গের দিন। বেলাল সরকার মালিক হওয়া, মন্ত্রী হওয়ার কাজ কর্ম আরম্ভ হয়েছে সেই কবে! গুটি চালাচালি করছেন কি আর আজকে থেকে? বছরের পর বছর পার হয়ে গেছে। এখন কত খেলা বাকী আছে। এক এক করে কত কিছু যে দেখবেন। সবই সময়ের ব্যাপার। হে হে।

একটু পরেই উপজেলার চেয়ারম্যান এসে হাজির। তার সাথে এমডি সাহেব নিভৃতে মিটিং করলেন। সেই সময়ে অন্যদের বাইরে চা খেতে পাঠিয়ে দেয়া হল। অনেক কিছু নিয়ে কথা বার্তা হল। মন্ত্রীর সফর যাতে সফল হয়, সাথে সাথে সবাই যাতে উপকৃত হয়। এমডি চেয়ারম্যানকে এক বান্ডিল টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল, এইটা হল আপনার এডভান্স। মন্ত্রী সাহেব কাওকে অখুশি রেখে কাজ করেন না। তার পরে একটা চাবি ধড়িয়ে দিয়ে বলল, কেও যেন ঘুণাক্ষরেও সব জানতে পারবে না। এর জন্যে আমরা আজ তিন বছর ধরে প্ল্যান করে আসছি। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ঢাকা থেকে আপনার উপজেলার গুদামে গম চলে আসবে। তার পরে তো জানেনই......... এখন শুধু মন্ত্রীর সফর যাতে সফল হয়, সেটা নিয়ে কাজ করে যান। হাতে মাত্র দশ দিন সময়।

এমডি , যাবার সময় গুদামের তালা বদলে দিয়ে জানাল, ঢাকা থেকে অনেক দাম দিয়ে এই চাইনিজ তালা এনেছি। এই হল চাবি। অনেক শক্ত-পোক্ত তালা। আসল চাবি ছাড়া কেও এটা খুলতে পারে না। আর খবরদার এই তালা যাতে কেও চাবি ছাড়া না ছোঁয়। একটা আঁচর পর্যন্ত না পড়ে। সবাইকে সাবধান করে দিলাম, খবরদার !

পরের দিক রহিম চাকলাদার চাবি দিয়ে আর তালা খুলতে পারলেন না। প্রায় ঘণ্টা খানেক চেষ্টা করে, শেষে এমডি সাহেবকে ফোন করলেন। কিন্তু না কোন ভাবেই, তাকে ধরা গেল না। কাস্টমাররা খালি হাতে বিড় বিড় করতে ফিরে যেতে হল। অধীর বিশ্বাস আর শুকুর আলিও মন খারাপ করে বসে থাকল। সবাই ভুলে গেল, রহিম তালুকদার আজকে তার টোস্ট বিস্কুট খান নি।

পুরো দিন পার হয়ে গেল, এমডি সাহেবের কোন হদিস পাওয়া গেল না। ঢাকা অফিসের কেও কিছু বলতে পারল না। এই দিকে এমডি সাহেব কঠোরভাবে বলেছেন, এই তালায় যাতে আঁচর পর্যন্ত যাতে না পড়ে। তালা ভাঙ্গার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হল। এক দিন এক দিন করে, দু দিন পার হয়ে গেল। এমডিকে যখন চাকলাদার সাহেব ফোনে পেলেন, এমডি খুব ব্যস্ততার সুরে বলল, চিন্তার কিছু নাই। আসলে আমারই ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে ভুল চাবি দিয়ে এসেছি। আমি চাবি পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। কয়েকদিনের মধ্যে পেয়ে যাবেন।

চাকলাদার সাহেব জানতে চাইলেন, জী তা হলে ব্যবসার কি হবে? এমডি উত্তরে বলল, আপনাকে ওই সব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি দেখব। আর কোন কথার জন্যে অপেক্ষা না করে এমডি লাইন কেটে দিল।

উপজেলা গুদামে যে দিন গম আসল, সে দিন রাতেই গুদামের দরজা ভেঙ্গে ডাকাতি হল। দরজা ভাঙ্গা, গুদাম একেবারেই ফাঁকা। এক বস্তা গমও কোথাও নাই। শূন্য, পুরোটাই খালি, একেবারে গড়ের মাঠ। পুলিশ দারোগা আসল, ছবি তোলা হল। অনেককে প্রশ্ন করা হল। এক কোণায় দেখা গেল, চেয়ারম্যান মাথা চাপড়িয়ে বলছে, একি হল; আমাদের এই উপজেলায় এ রকম জঘন্য ঘটনা আগে কখন ঘটে নি। আমি এখন পার্টির নেতাদের কাছে মুখ দেখাব কি করে। জনগণকে কি বা উত্তর দিব। বেচারা এত হাউমাউ করছে, কিন্তু চোখের মণি চারিদিকে ঘুরছে। বারে বারে দেখে নিচ্ছে কে কে আসছে, কে কি করছে।

গম কোথায় গেল তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। তবে মৌলবি সাহেব জানালেন, তিনি যখন ভোর রাতে চাকলাদার সাহেবের গুদামের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সেখানে তিনি দুটো ট্রাক থেকে মালামাল নামাতে দেখেছেন। কিন্তু উপজেলার সবার এর মধ্যে জানা হয়ে গিয়েছিল, গুদামের চাবি উলট পালট হয়ে গেছে। গত কয়েক দিন ধরে গুদামের দরজা খোলা যাচ্ছে না। এমনকি কোম্পানির গুড়ো দুধ বিক্রিও বন্ধ আছে।

পুলিশ এসেও পরীক্ষা করে দেখল। না তালা কিংবা দরজা ভাঙ্গার কোন চিহ্নই পাওয়া গেল না। সবাই এক মত হল মৌলবি সাহেব ভুল ভুল দেখেছেন। কি দেখতে, কি দেখেছেন আর কি বলছেন, তার মধ্যে পুরোটাই গোলমাল। আসলে বয়সের সাথে সাথে হয়ত মাথাটাও কিছুটা আওলা হয়ে পড়েছে।

সারা উপজেলায় মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সাজ সাজ রব চলতে লাগল। দেয়াল পরিষ্কার করে রঙ দেয়া হল। কিছুদূর পর পর তোরণ বানান হল। ব্যানারে ব্যানারে মনে হতে লাগল বড় কোন উৎসব হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় লেখা, “মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন; শুভেচ্ছা, স্বাগতম সাথে ছবি, বেলাল সরকার হাত নাড়াচ্ছেন। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হল, ঢাকার থেকে টিভি ক্যামেরা আসবে মন্ত্রীর সাথে। সবাই যাতে ভাল কাপড় পড়ে আসতে ভুল না করে। বলা তো যায় না, কাকে টিভিতে দেখিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে উপজেলার সম্মানের একটা ব্যাপার আছে না! আবার শোনা যাচ্ছে, এই সব টিভি আবার দেশের বাইরে থেকেও দেখা যায়।

এমডি সাহেব মন্ত্রীর আগমনের আগের দিন সকালে চাবি নিয়ে হাজির হল। একই সময়ে চেয়ারম্যান, পুলিশের দারোগা আর কিছু স্থানীয় সরকারী কর্মচারী চলে আসল। রহিম চাকলাদার বুঝতে পারলেন না, এত মানুষ এখানে আসার কি কারণ। মনে হচ্ছে এদের সব খবর দিয়ে আনা হয়েছে।

চাবি দিয়ে দরজা খোলার পরে দেখা গেল, গুদামে গুড়ো দুধ সব উধাও। থাকে থাকে সব গমের বস্তা। পুলিশ আর দেরী করল না। রহিম তালুকদার, অধীর বিশ্বাস, শুকুর আলিকে বেঁধে নিয়ে গেল।

ঘণ্টা তিনেক পরে শোনা গেল, থানা থেকে পালিয়ে যাবার সময় অধীর বিশ্বাস আর শুকুর আলি পাবলিকের হাতে ধরা পড়ে। তার পরে গম আর গুড়ো দুধ চুরির অপরাধে কতিপয় জনগণ তাদের শাসন করে অল্প কিছু মার ধর করে। পরে তারা গণপিটুনিতে মারা যায়।

পুলিশ থেকে বলা হয়, আমরা গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, রহিম চাকলাদার এক দল পুলিশকে নিয়ে গুড়ো দুধের সন্ধান দিতে নিয়ে যায়। কিন্তু কিছু পাবলিক তাকে জীনের বাদশা ভেবে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে। তখন কয়েক রাউণ্ড গোলাগুলি হয়। সে সময় রহিম চাকলাদার পালানোর চেষ্টা করেন।তখন দু পক্ষের মধ্যে গুলি বিনময় হয়। কিন্তু একটা গুলি এসে তার গায়ে লাগে। বেচারা ক্রস ফায়ারে মারা যান। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্নালিলাহে রাজেউন.........

অধীর বিশ্বাস আর শুকুর আলির স্ত্রীরা যখন এক জায়গায় হল, তখন তারা দুয়ে দুয়ে চারের হিসেব বের করল। বেলাল সরকার প্ল্যান প্রোগ্রাম অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিল। তার বুদ্ধিতেই রহিম তালুকদারের টোস্ট বিস্কুটের উপাখ্যান তাদের স্বামীরা ছড়িয়ে দিয়েছিল। সরকার বলে তো কথা, তাকে আগের থেকেই সব ভেবে রাখতে হয়েছিল তার পরিস্কার জানা ছিল, এক দিন এই লোকগুলোর মুখ বন্ধ করার দরকার হয়ে পড়বে।

পুলিশের দারোগার পুরো নাটকটা বুঝতে বেশী সময় লাগে নি। মন্ত্রী, এমডি, চেয়ারম্যান এক সাথে যোগসাজশ করে গম চুরি করেছে। এমডি চেয়ারম্যানকে গুদামের চাবি আগেই দিয়ে রেখেছিল। গম উপজেলার গুদাম থেকে মন্ত্রীর গুদামে গেছে। উপজেলা গুদামের দরজা জনগণকে ভাওতা দেয়ার জন্যে ভাঙ্গা হয়েছিল। কিন্তু তার মুখ খোলার কোন সুযোগ নাই। তাকে এর পর থেকে প্ল্যানের একটা চরিত্র হয়ে পুলিশের কাজগুলো করতে হল।

পরে মন্ত্রী সবাইকে দেখাল, চুরির অপরাধে নিজের কর্মচারীদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। নিজের লোককে পর্যন্ত প্রশ্রয় দেয় নি, ক্ষমা করার তো প্রশ্নই উঠে না।। তার থেকে বড় মানুষরূপী ফেরেশতা আর কে হতে পারে!

কিন্তু মন্ত্রীর গুদাম থেকে গম ফেরত দেয়া হয়েছে কি-না, সেটা নিয়ে কেও প্রশ্ন তুলল না।

বেচারা রহিম চাকলাদার, অধীর বিশ্বাস আর শুকুর আলি বেশী কিছু জানল না, কিছু বুঝল না। তাদেরকে রাজনীতির অজানা কোন কারণে, বলির পাঠা হতে হল। তা ছাড়া কে না জানে গণপিটুনি কোন বিচার হয় না। আর ক্রস ফায়ারে সাজান গল্প ভাওতা ছাড়া আদ কি।। এই সব বিষয়ে কোন প্রশ্ন তুললেই বিপদ...ক্রস ফায়ারে পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা।

পরের নির্বাচনে চোরম্যানরা সবাই জিতল।

আচ্ছা প্রিয় পাঠকরা বলুন-তো, এই গল্পে চোরম্যানদের সংখ্যা কয় জন?

আর মন্ত্রীর গুদামের গুড়ো দুধই বা কে নিল? 

মে , ২০১৪

www.lekhalekhi.net