মৃত্যু, বিশ্বাস ও করোনা কাল

ভয়ঙ্কর এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। চারিদিকে আতঙ্ক। অনেকের আবার এতো সাবধানতার পরেও আক্রান্ত হচ্ছেন। দুর্ভোগের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। আমাদের স্বজনদের বৃত্তের পরিধিতে বলতে গেলে কেউ না কেউ আক্রান্ত হয়েছেন, আবার কেউবা মারাও গেছেন। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে মহান সৃষ্টিকর্তা কি তার বান্দাদের উপর রুষ্ট? তার অনুমতি ছাড়া যদি কোনো পাতাও না পড়ে, তা হলে তাঁর জ্ঞাতসারে কেনো করোনা নামের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস পুরো মানব সভ্যতাকে হাঁটুতে বসিয়ে ছেড়েছে। তিনি কেনো এ রকম ভয়ঙ্কর জীবাণুকে মানুষের এতো বড় ক্ষতি করতে দিলেন। তাঁর প্রিয় বান্দাদের এতো কষ্টের পরও কেনো রহমত আসছে না। ইনশা আল্লাহ বিষয়টা নিয়ে আমরা কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। কিন্তু বিষয়টাতে যাওয়ার আগে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিৎ আল্লাহ রাবুল আল আমিন তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবকে কিপরিমাণ অনুগ্রহ করে থাকেন।

“যদি পৃথিবীর সব গাছ কলম হতো, এবং সব গুলো মহাসাগর কালি হতো; আরও সাতটা মহা সাগর যদি বাড়তি কালি হতো, তার পরেও আল্লাহ’র মাহাত্ম বর্ণনা করে শেষ করা যেতো না। আল্লাহ সর্ব শক্তিমান, সর্ব জ্ঞানী।” (সুরা লুকমান ৩১-২৭) । হাদিসে আছে, এক বার প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ(দঃ) কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আল্লাহ’র কোন অনুগ্রহ (favor) আমাদের জন্যে ন্যূনতম? জবাবে মহানবী বলেছিলেন, আমরা যে শ্বাস প্রশ্বাস নেই, সেটাই আমদের জন্যে আল্লাহ’র কাছ থেকে ন্যূনতম অনুগ্রহ। বন্ধুরা বুঝতেই পারছেন, আমরা যে শ্বাস প্রশ্বাস ছাড়া বেঁচে থাকতে পর্যন্ত পারব না, সেটাই হলো আমাদের জন্যে আল্লাহ’র ন্যূনতম অনুগ্রহ। তা হলে, মাথার উপরে ছাদ, ক্ষুধা নিবারণের জন্যে খাদ্য, কিংবা মায়ের দোয়া, সন্তানের ভালোবাসা—এই গুলো কি? এ গুলো সব আমাদের জন্যে আল্লাহ’র বাড়তি অনুগ্রহ।

আপনাকে যদি বলা হয়, আমাদের জন্যে আল্লাহ’র অনুগ্রহের সংখ্যা কয়টি? আপনি হিসেব করা আরম্ভ করলে দেখবেন শেষ করা যাচ্ছে না। কোরাআন শরিফে এর উত্তর আমরা পাই, কেও যদি আল্লাহ’র অনুগ্রহ গুনতে চায়, তার শেষ সে কখনো পাবে না। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টি, সূর্যের আলো আর তাপ, মাঠের শস্য, গবাদি পশু, রাতের নিদ্রা-বিশ্রাম থেকে আরম্ভ করে রোগ মুক্তি, কোনটি আল্লাহ’র অনুগ্রহ না? কোরআন শরিফে আরও আছে, এই পৃথিবীতে এমন কোন চলমান জীব নাই, যার খাদ্য আল্লাহ জোগান দেন না।(সুরা হুদ ১১-১৬)

আমাদের জন্যে আল্লাহ’র অপরিসীম অনুগ্রহের সাথে সাথে যে প্রশ্নটা চলে আসে, তা হল, আমরা এই অনুগ্রহ, নেয়ামত কি বুঝতে পারি? তার জন্যে কি আমরা কৃতজ্ঞ? কোরআন শরিফে বলা হচ্ছে, আল্লাহ মানব জাতির জন্যে দয়ায় পরিপূর্ণ, কিন্তু তারা, বেশীর ভাগই কৃতজ্ঞ না(সুরা ইউনুস ১০: ৬০) ।

মুসলমানদের বিশ্বাসের একটা বড় অঙ্গ আল্লার প্রতি কৃতজ্ঞতা বা শুকর। এই শুকর থাকা আমাদের জন্যে এক বিশাল আশীর্বাদ। আমাদের যা আছে কিংবা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলা হয়েছে। এই সন্তুষ্ট থাকাটা, আমাদেরকে হতাশা, দ্বেষ, হিংসা ও প্রতিহিংসা পরায়ণ হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। উপরন্তু বৈষয়িক চাপ, দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি; আমাদের মন আনন্দ ও শান্তিতে থাকতে পারে। আমরা কৃতজ্ঞ থাকলে, আল্লাহ আমাদের উপরে তার অনুগ্রহের পরিমাণও বাড়িয়ে দেন। আমরা কৃতজ্ঞ না থাকলে, বা শুকর না করলো, আমাদের জন্য কঠিন সাবধান বাণী দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “এবং (মনে রেখ) তোমার মালিক যখন ঘোষণা করছেনঃ ‘তুমি যদি কৃতজ্ঞ থাকো(বিশ্বাস গ্রহণ করে ও আল্লাহকে ইবাদত করে), আমি তোমাকে আরও দিবো (আমার আশীর্বাদ), কিন্তু তুমি যদি অকৃতজ্ঞ হও, জেনে রাখো, আমার কঠিন শাস্তি তোমাকে দেয়া হবে”’ (সুরা ইব্রাহিম ১৪: ৭)।

কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব আমরা, নবী করিম(দঃ) থেকে বিভিন্ন ভাবে পাই। তিনি তার অন্যতম প্রিয় সাহাবী মুয়াদ ইবন জাবালকে বলেছিলেন, প্রতি বার নামাজ পড়ে তিনি যেন বলতে না ভুলেন, “ও আল্লাহ আমাকে মনে রাখতে সাহায্য করুন, যাতে আপনাকে আমি সঠিক ভাবে ধন্যবাদ(কৃতজ্ঞতা) জানাই এবং ইবাদত করি।” সুরা আর রাহমানের একটা প্রসঙ্গ এবারে উল্লেখ করতে চাই, ইনশা আল্লাহ। ৭৮ আয়াতের এই সুরায় আল্লাহ ৩১ বার মানব ও জীন কুলকে প্রশ্ন করেছেন, “তোমরা তোমাদের মালিকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করতে পারো?” প্রকৃতপক্ষে আমরা তাঁর একটা অনুগ্রহও অস্বীকার করতে পারি না। ওই যে আলোচনার প্রথমদিকে বলেছিলাম, আল্লাহ’র অনুগ্রহ হিসেব করে শেষ করা, একেবারেই অসম্ভব। আল্লাহ’র অগণিত অনুগ্রহের জন্যে আমরা সব সময়ে যেন কৃতজ্ঞ থাকতে পারি। শুকর আলহামদুল্লাহ।

এইবার ফিরে আসি আল্লাহ সুবহান আ তা আলার এতো অনুগ্রহ থাকার পরেও আমরা কেনো করোনা ১৯ র মতো কঠিন ছোঁয়াচে ভাইরাসে ছোবলে বিধ্বস্ত হয়ে চলেছি। পরম করুণাময়য় কখনো অঙ্গীকার করেন নি যে পৃথিবীতে আমাদের জীবন ঘাত-প্রতিঘাত বিহীন হবে। আমরা আমাদের জ্ঞান থেকে জানি যে প্রতিটা ক্রিয়ার সমান ও বিপরিত প্রতিক্রিয়া হয়। আমরা মানব জাতি পৃথিবীর বুকে প্রকৃতির বিপক্ষে যেয়ে কতো কিছুই না করছি। জন্তু জানোয়ার মেরে শেষ করছি, গাছ পালা কেটে শেষ করছি, ওজনের পরিমাণ বাড়িয়ে বাতাস বিষাক্ত করার পথে এগুচ্ছি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন করছি। পরম করুণাময়য় নির্দেশিত নৈতিকতা, মূল্যবোধের পরোয়া করে, এমন মানুষের সংখ্যা কমেই চলেছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অপরাধ বাড়ছে পৌনঃপুনিক গতিতে। পরম করুণাময় কোরআন শরীফে বেশ অনেক বার বলেছেন, মানুষের অবাধ্যতা রোধ করতে ব্যবস্থা তিনি পৃথিবীর বুকেই নিয়েছেন। হয়তো তাঁর নির্দেশিত পথ থেকে সরে আসার কারণে হুশিয়ারী বার্তা দিতে করোনা ভাইরাস এসেছে। এখন আমাদের খুব বেশি করে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো ক্ষমা চেয়ে তাঁর নির্দেশিত পথে ফিরে আসা। তা হলো পরম করুণাময়য় রাব্বুল আল আমিনের অনুগ্রহে আমরা এই মহা-বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারি। সুরা ইউসুফে (১২:৮৭) বলা হয়েছে, "কখনই আল্লাহ’র ক্ষমা সম্পর্কে আশা ছেড়ে দিও না।” আবার সুরা আত তালাক-এ (৬৫:৭) বলা হচ্ছে, “শীঘ্রই কষ্টের পরে, আল্লাহ, জীবন সহজ করে দিবেন।” ইনশা আল্লাহ আমরা নিজেদের শুধরে নিবো এবং রাব্বুল আল আমিন আমাদেরকে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ দান করে এই মহা দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবেন।