নী ভালবাসা

ছবি তোলা হচ্ছে।

বলাই বাহুল্য কিছুক্ষণের মধ্যে এর থেকে কয়েকটা ছবি ফেসবুকে চলে যাবে। এক জনের ছবি গুলোর জন্যে সেই সাত সমুদ্রের ওই পারে অপেক্ষা করার কথা। ইলেক্ট্রনিক ক্যামেরা, ফোন ক্যামেরা আর ফেসবুক; ছবি তোলা আর প্রচারের ব্যাপারটা সারা পৃথিবীতে খুবই সহজ করে দিয়েছে। এখন এর জন্যে বাড়তি খরচ আর সময় দিতে হয় না বললেই চলে।

তিন দিনের সফরে দু জোড়া দম্পতি এসেছে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে। সাথে আরেকজনের আসার কথা ছিল; টুটুলের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওর আসা হয়ে উঠে নি। সে ফোন করে বলল, “শেষ মুহূর্তে ঝামেলা হয়ে গেল রে।" তার পরেও বাকীরা সব এসেছে। বলা যায় টুটুলের পীড়াপীড়িতে আসতে বাধ্য হয়েছে । সে ফোনে অপর প্রান্ত থেকে বলে চলল, "টিকিট কাটা হয়ে গেছে, হোটেলের রুম পর্যন্ত বুক। এখন এক জনের জন্যে তো আর, বাকী চার জন প্রোগ্রাম বাতিল করতে পারে না।" টুটুল বলে চলল, "যা যা, কোন অসুবিধা নাই। তোদের ভালো কিছু সময় কাটলেই আমি খুশী। অনেক অনেক ছবি তুলবি। ফেসবুকে দিয়ে দিস। আমার দেখলে মনে হবে আমিও তোদের সাথে ছিলাম। তোরা আমার জন্যে মন খারাপ করিস না। আমি তোদের চার জনের হাসি মুখ, একসাথে একই ছবিতে দেখতে চাই। তবে শর্ত একটাই, প্রথম যেই ছবিটা পোস্ট করবি, সেখানে চার জনকে এক সাথে থাকতে হবে।" তার পরে টুটুল হাসতে হাসতে বলল, “ছবি তোলার সময় আমার জন্যেও কিন্তু একটা জায়গা রাখিস। হয়ত উড়ে এসে আমিও হাজির হতে পারি। হা হা হা......”

যে চার জন বেড়াতে এসেছে, তারা হল কাজল আর তার বউ ইলা, ইমন আর তার বউ রিনি। তারা একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ইলা, রিনি দু জন ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে আর কাজল, ইমন ছিল ভূগোল আর সমাজ বিজ্ঞানে। কিভাবে যে এদের এক জনের সাথে আরেকজনের ভাব হয়ে গেল বলা, তা এখন বলা মুশকিল। কোন রকমে ক্লাস শেষ করেই আরম্ভ হয়ে যেত ওদের দিন ব্যাপী আড্ডা, আনন্দ, এইদিক ওইদিক যাওয়া, সিনেমা দেখা আরও কত কি!

পঞ্চম যে মানুষ ওই দলে ভিড়েছিল, তার নাম টুটুল। খুব রসিয়ে কথা বলতে পারত। সে ছিল ইমনের বন্ধু। কিন্তু পড়ত ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। চার জনের হট্টগোলে সব সময় যোগদান করতে পারত না। তার ক্লাসের সংখ্যাও বেশী ছিল, সাথে সাথে পড়া লেখার মেলা চাপ। বাসাটাও ছিল বেশ দূরে, সেই এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে উত্তরায়।

টুটুল অল্প কথায় আসর মাৎ করতে ছিল মহা ওস্তাদ। তার কথায় নে হেসে কেউ থাকতে পারত না। ওর ভাণ্ডারের মজার কথার কোন ইয়ত্তা ছিল না। একদিন টুটুল হন্তদন্ত হয়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করল, "আচ্ছা বল তো জন্মদিনের আগে কি হয়?” ইলা বলল, "কি আবার হয়, মায়ের প্রসব বেদনা হয়।" কাজল আরেকটু চিন্তা করে বলল, "বাচ্চা ডেলিভারি করতে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।"

মস্তিষ্ক খাটিয়ে একেক জন একেকটা উত্তর দিতে লাগল। সবার কথা শুনার পরে, অনেকটা বিচারপতিদের রায় পড়ার ভঙ্গিতে টুটুল বলতে লাগল, "কারোর উত্তর ঠিক হলো না। আসলে জন্মদিনের আগে হচ্ছে, “'শুভ', প্রথমে শুভ, তার পরে জন্মদিন। আজকে হচ্ছে জনাব টুটুলের শুভ জন্মদিন।"

হৈ হৈ করে হাসির রোল পড়ে গেল। ইমন মুখ বাঁকা করে বলল, "আগে বলবি না। একটা না হয় কেকের ব্যবস্থা করা যেতো।” ইলা একটা সোহাগী গলা করে বলল, "এই ভাবে হঠাৎ করে বললে, জন্ম দিন আর শুভ থাকে না।"

টুটুল রোমান্টিক একটা গলা করে করে ইলাকে বলল, "আগে জানলে কি বউ সেজে আসতে?”

ইলা তেড়ে আসল, তবে রে বদমায়েশ …………

বদমায়েশের সাথে ভালো লাগা, ভালোবাসা হতে বেশী সময় লাগলো না। টুটুলের পরের জন্মদিনে ইলা ঠিকই শাড়ি পরে এসেছিল। এক সাথে তারা ঘুরে ফিরে বেড়াল। অবশ্য বেশীর ভাগ সময় সাথে রিনা, ইমন, কাজল ছিল। টুটুল অনেকটা সিনেমার বিজ্ঞাপন পড়ার ঢঙে বলল, "সুধী মণ্ডলী যদি একটু সুযোগ-সুবিধা না দেয়, তবে নায়ক-নায়িকা একটু একান্তে সময় কাটাবে কি করে। তোরা আর কতক্ষণ কাবাবে হাড্ডি হয়ে থাকবি?”

কাজলের কথাটা খুব গায়ে লাগল, "কি, কি বললি? আমরা কাবাবের হাড্ডি?? কেক খাওয়ালাম, লাঞ্চ করালাম। এখন এ রকম অপমানজনক কথা। যা যা তুই এখান থেকে যা। আমরা সবাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির, আর তুই হলি বহিরাগত- বুয়েটের, দি রিয়েল গ্রেট কাবাবকে হাড্ডি। গেলি, নাকি পুলিশ ডাকবো......”

টুটুল অনেকটা ব্যঙ্গ করে করল, "তা ঠিক। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সব চেয়ে সুন্দরী যে মেয়ে সে আমার জানে মান, ডার্লিং। তোরা ভাগ। আমি এখন প্রিয়তমা ইলা মিত্রের সাথে সময় কাটাব। গত জন্মদিন ফ্লপ করার জন্যে এই বার একটা বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। একান্তে গান শুনাবো আমার প্রিয়তমাকে।"

ইমন একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়ে বলল, "তুই জীবনে কখনো বাথরুম ছাড়া কোথাও গান গেয়েছিস না-কি? যেই হেঁড়ে গলা। তোর গান শুনলে সব দৌড়ে পালিয়ে জান বাঁচাবে।"

টুটুলের উত্তরটা মনে হয় ঠোঁটের ভিতরে প্রস্তুত ছিল। কবিতা আবৃত্তি করার মত করে বলতে লাগল, "আমার প্রিয়তমার কাছে আমার প্রতিটা শব্দই সুর, প্রতিটা বাক্যই গানের কলি, আর.........।"

অন্যরা টুটুল-ইলাকে চান্স দেয়ার জন্যে কিছুক্ষণের মধ্যে সরে পড়ল। ইলা গম্ভীর হয়ে টুটুলকে বলল, "তুমি কি আমার লাস্ট নেম জান না। আমাকে সবার সামনে ইলা মিত্র ডাকলে কেন?”

টুটুল মিষ্টি করে বলল, "ডার্লিং আজকের এই শুভ দিনে রাগ করো না। তোমাকে ইলা মিত্র বলে আমি এক বিখ্যাত নায়িকা বানিয়ে দিলাম। এক সময় তাকে সবাই এক নামে চিনতো।"

ইলার রাগটা আরও বেড়ে গেল। বিরক্ত হয়েই উত্তর দিলো, “আমাকে এক নামে সবার চেনার কোনো দরকার নাই। যাদের আমার চেনার কথা, শুধু তারা চিনলেই চলবে। তোমার যদি না পোষায়, তা হলে আরেক জন ইলা মিত্র খুঁজতে বের হতে পারো। আমাকে আর বিরক্ত না করলেই খুশী হব। তা ছাড়া for your kind information ইলা মিত্র কোন নায়িকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের একজন সংগঠক।"

টুটুল একটু চুপ করে থেকে বলল, "সরি ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও। একটু রসিকতা করার জন্যেই তো কথাটা বলা। এখন দেখি হিতে বিপরীত হচ্ছে। আমার জানে মান, আমাকেই ভুল বুঝছে! আসলে নারীর মন বুঝা আমার কর্ম না। কত বড় বড় কবি-সাহিত্যিক এই বিশেষ বিষয়ে একেবারে তেত্রিশের নীচে নাম্বার পেয়ে ফেল করেছে।"

ইলা বেশ জোর গলায় এইবার বলল, "আমি সব সময় সব কিছু নিয়ে রসিকতা করাটা একেবারেই পছন্দ করি না।"

তার পরের ঘটনাগুলো অনেকটা ছক বাঁধা নিয়মে চলতে লাগল। টুটুল-ইলার প্রেম বেশ জমে উঠল। ভালোবাসা, বিরহ কোনোটারই কমতি ছিল না। টুটুল স্বভাব সুলভ রসিকতায় ক্ষণিকে রেগে যাওয়া ইলাকে বেশ সহজেই মান ভাঙ্গিয়ে ফেলত।

টুটুল এক বার সময় দিয়ে, ইলার সাথে দেখা করতে আসতে পারল না। শেষ মুহূর্তে রহমান স্যার ক্লাসে একটা এসাইনমেন্ট দিয়ে বললেন, "যারা আজকেই শেষ করতে পারবে, তাদের স্পেশাল বোনাস পয়েন্ট দেয়া হবে।" টুটুল ভাবল এক ঘণ্টার মধ্যে এসাইনমেণ্ট শেষ করে ইলার কাছে গেলেই হবে। এই বোনাস পয়েন্টটা তার খুব দরকার।

কিন্তু না কাজটা শেষ করতে করতে তিন ঘণ্টা লেগে গেল। কয়েকবার অবশ্য ইলার কথা মনে পড়েছিল। কোন ভাবেই কাজটা ছেড়ে উঠা সম্ভব ছিল না। সেই সময়ে আবার মোবাইল ফোন চালু হয় নি। তিন ঘণ্টা পরে যেয়ে টুটুল আর ইলাকে পেলো না। ইমন বলল, "ভয়ঙ্কর অবস্থা। ইলা কান্নাকাটি করে বাসায় চলে গেছে। একেবারে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে গেছে, যেই ছেলে সময় দিয়ে কথা রাখতে পারে তার সাথে সে সম্পর্ক রাখবে না।

কাজলও ছিল সেখানে। সে দাঁত কেলিয়ে বলল, "ইলা বলেছে সে তোর সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখবে না। আমাদের জানিয়ে গেছে, তোর মাথার মুড়িঘণ্ট সে নিজের হাতে বানাবে। এখন তুই সাবধানে থাক। পেছন দিক থেকে আচমকা আক্রমণ আসতে পারে। যে কোন সময়ে মাথা গুড়ো হয়ে যাবে। তোর প্রেম তো গেলই; এখন নিজের মাথাটাকে কিভাবে বাঁচাবি, সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা আরম্ভ করতে পারিস।"

পরের দিন সকালেই টুটুল ইলার বাসায় হাজির। মাথার চুল একেবারে কামানো, মানে ন্যাড়া। সাথে ইয়া বড় একটা হাঁড়ি। বেল বাজাতে ইলার বাবা দরজা খুলে দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দু জনের খুব খাতির হয়ে গেল। একেবারে মনে হচ্ছিল তাদের অনেক দিনের জানা শোনা।

ইলার বাবা বললেন, "এই হাঁড়ির মধ্যে কি?” টুটুল নরম গলায় উত্তর দিলো, “চাচা ইলা গত কাল জানাল ওর মুড়িঘণ্ট খেতে খুব ইচ্ছা করছে। তাই সারা রাত ধরে বাজার করে নিজের হাতে আমি রেঁধেছি।" কথাটা শুনে ইলার বাবা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, "তুমি নিজের হাতে রেঁধেছ! বুয়েটে পড়, আবার রাঁধতেও পার। তোমার তো অনেক গুণ।”

পরের মুহূর্তেই ইলা রক্ত চক্ষু করে টুটুলের সামনে এসে হাজির হলো। গলা ছোট করে জানতে চাইল, "আমার বাসায় আসতে তোমাকে কে বলল?” টুটুল পরিবেশটাকে হালকা করার জন্যে বলল, "তুমি আমার মাথার মুড়িঘণ্ট বানাতে চেয়েছ। কিন্তু নিজের মাথা তো আর ভাংতে পারলাম না। তাই মাথার সব চুল ফেলে দিয়েছি। আর নিজের হাতে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জন্যে ফ্রেস মাছের মুড়িঘণ্ট রেঁধে নিয়ে এসেছি।"

কিন্তু টুটুলের এত বড় আত্মত্যাগ আর কষ্ট ইলার মনে একটুও রেখাপাত করতে পারল না। ইলা রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, "এই হাঁড়ি নিয়ে এখান থেকে বিদায় হও। না হলে তোমার মাথায় তোমার রাঁধা মুড়িঘণ্ট ঢালব। এই সব ভাঁড়ামো আমার এক দম ভাল লাগে না। এখনই এখান থেকে বের হয়ে যাও। তোমার ওই পোড়া মুখ আমি দেখতে চাই না।"

এই ঘটনার পর দু জনের আর দেখা হয় নি। কিন্তু এক জন আরেকজনের খবর ঠিকই পেয়েছে। ইলা বড় একটা চিঠি লিখেছিল টুটুলকে, "আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমরা আসলে একজন আরেকজনের সাথে ঠিক যাই না। তুমি আমাকে বুঝতে পার না, হয়ত আমিও তোমাকে না। তুমি রসিকতা দিয়ে আমাকে জয় করে নিতে চাও। কিন্তু আমার কাঁদতে ভালো লাগে, আকাশের তারা গুনতে ভাল লাগে। তুমি এইগুলো কিছু বুঝবে না। তুমি সুখী হও, জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাও, সেটাই কায়মন বাক্যে কামনা করি। আজ থেকে আমাদের দু জনের পথ দু দিকে বেঁকে গেছে। আমাকে আর না খুঁজলেই খুশী হবো।”

ইলার ব্যবহার আর চিঠি টুটুলকে ভীষণ কষ্ট দিলো। তার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড লাগল। কাজলকে ডেকে বলল, "আমি ইলার রাগ ভাঙ্গাতে যাব না। রাগ কি শুধু ওর একারই হতে পারে? যে আমার দিকটা বুঝতে কখন চেষ্টা করে না, তার সাথে আমারও সম্পর্ক শেষ।"

এর বছর খানেকের মধ্যে টুটুল এমেরিকায় স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেল। পড়া লেখায় মেধাবী, কথা বার্তা আর রসিকতায় চৌকস টুটুল এমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে স্থান করে নিলো। এমএস, পিএইচডি করার পর খুব ভাল বেতনের চাকরি পেয়ে গেল। কয়েক দিন পর খবর এলো টুটুল এক মার্কিন সুন্দরীকে বিয়ে করে সুখের সংসার আরম্ভ করেছে।

অন্য দিককার ব্যাপার আরও চমকপ্রদ। যেই কাজলকে ডেকে টুটুল তার ইলার সাথে সম্পর্কের ইতির কথা জানিয়েছিল, সেই কাজলের মধ্যে ইলা নিজের ভালোবাসাকে নতুন করে খুঁজে পেলো। পড়া লেখা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দু জনেরই চাকরিও হয়ে গেল। এক শুভক্ষণে দু জনের বিয়ে হয়ে গেল। ইমন আর রিনির গল্প অনেকটা একই রকম। তারাও কাজল-ইলার বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই একজন আরেকজনের গলায় মালা পরাল।

তার পরে অনেকটা গড্ডালিকার মত ওদের পাঁচ জনের জীবন কাটতে লাগল। প্রায় বছর পনের পরে টুটুলই ওদের সবাইকে খুঁজে বের করল। ফেসবুক থেকে এক এক করে বাকী চার জনকে পেলো। তার পরে চলতে লাগল নিয়মিত কথা বার্তা আর হাসি ঠাট্টা। সপ্তাহে দুই একবার করে টুটুল সবার সাথে ফোনে কথা বলে নিতো।

প্রথমে ইলা টুটুলের ফোন আসলে অন্য দিকের সরে পড়ত। একবার কাজল কিছুটা জোর করেই ইলার হাতে টুটুলের ফোন ধরিয়ে দিলো। আবার আরম্ভ দু জনের এ কথা, সে কথা, নানা কথা। টুটুল দেখা গেল এতগুলো বছরে একদম বদলায় নি। হৈ হৈ করে সব রসিকতা করতে থাকে।

একবার ইলা জানতে চাইল, "তোমার বিদেশী ললনা বউয়ের কথা যে বল না, কি বিষয়?” টুটুল ওই দিক থেকে হাসতে হাসতে বলল, "আমি তো বিয়েই করিনি, বউ আসবে কোথা থেকে? তুমি যাতে কাজলকে বিয়ে কর, সেই জন্যে আমি বিয়ে খবরটা রটিয়ে দিয়েছিলাম।" এর পরে টুটুল আবার রসিকতা আরম্ভ করল, "তোমার জন্যে আমি আজও মজনু হয়ে আছি। হৃদয়টা পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। ওখানে আর কেও বসত বাঁধতে পারবে না। তার পরেই টুটুল ইলাকে অবাক করে দিয়ে গান ধরল:

পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,

যম যাতনা সকল যেতো দূরে

সে আর লালন একখানে রয়

লক্ষ যোজন ফাঁক রে

মাঝে লক্ষ যোজন ফাঁক রে ।

আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।

গান শেষ করে টুটুল বেশ গম্ভীর গলায় বলল, "জানো আমি এখন লালনের গান গাইতে পারি। প্রায়ই তার গান গাই। আর যখন গাই চোখ দুটো থেকে শুধু পানি পড়তেই থেকে, পড়তেই থাকে। জান এই পৃথিবীতে শুধু মায়া আর মায়া, শুধু মরীচিকা আর মরীচিকা। কোন কিছুই ধরা যায় না; শুধু ছোঁয়া যায়।"

ইলা পরিষ্কার বুঝল টুটুল যা বলছে তার সবটুকুই অন্তর থেকে বলছে। এখানে সদা হাস্যময়ী টুটুল কোন রসিকতা করার চেষ্টা করছে না। ফোনটা রেখে ইলা অনেকক্ষণ কাঁদল। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি আসতে লাগল। বুকের কোথায় যেন সূক্ষ্ম এক কষ্টের কাঁটা এসে বিঁধল। ইলা বুঝল না, এমন কেন হচ্ছে! "এইটা কি ভালোবাসা? ভালোবাসা মানে কি কষ্ট? কষ্টের রং কি নীল। তা হলে ভালোবাসা রঙও নিশ্চয়ই নীল?”

ইলা বিড় বিড় করতে লাগল, "কষ্টের ভালোবাসা, নীল ভালোবাসা। নী ল ভালোবাসা। নী ভালোবাসা। নী ভলোবাসা।”

কি অদ্ভুত ইলার ভিতর থেকেও সুর বের হয়ে আসল। আসলে লালনের গানতো তো আর শুধু গলা থেকে আসে না। সেটা আসে একেবারে ভিতর থেকে। বুকের ঠিক মধ্য খান থেকে। হৃদয়, মন, আর সুর একাকার হয়ে যায়:

বাড়ির কাছে আরশিনগর সেথা এক পড়শি বসত করে।

আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।।

কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে, কাজল ইলা, ইমন-রিনি হাসি হাসি মুখ করে বেশ কিছু ছবি তুলল। ইমন বলল, "হোটেলে যেয়ে আমার প্রথম কাজই হবে ফেসবুকে ছবিগুলো আপলোড করা। ওইদিকে হয়তো ছবিগুলো দেখার জন্যে টুটুল অস্থির হয়ে পড়েছে। অন্যরা সায় দিলো কথায়, তাই সই।

হোটেলে ফিরে ইমন ছবিগুলো দেখে নিচ্ছিল কোন ছবিটা আগে দেয়া যায়। একটা ছবি দেখে সে একেবারে অবাক। তাদের চার জনের সাথে আরেক জন দেখা যাচ্ছে। ইলার পেছনে, ঝাপসা; কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। একেবারে মনে হচ্ছে টুটুল। ইমন চিৎকার দিয়ে অন্যদের ডাকল। সবাই একমত হল, পঞ্চম মানুষটা হুবহু টুটুলের আকৃতির। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? সে ত এমেরিকা থেকে আসতে পারে নি। সে এই ছবির মধ্যে কোন ভাবেই আসতে পারে না।

ঘণ্টা খানেক পর কাজলের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। টুটুলের বোন নীরা ফোন করেছে। সেও এমেরিকায় থাকে। আসলে টুটুলের দেশে আপন আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। নীরা বলতে লাগল, "কাজল ভাই, ভাইয়া কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে।" কাজল নীরাকে ভাল করেই চিনত আর সে যে টুটুলকে, ভাইয়া বলে তাও জানত। কাজল চিৎকার করে বলল, "কি কি বললে? এইটা কি করে সম্ভব? কখন, কিভাবে??” নীরা ওই দিকে বলতে লাগল, "এইতো কয়েক ঘণ্টা আগে। সময় ছিল এখানকার সকাল পাঁচটা দশ।" কাজল হত-বম্ভ হয়ে বলল, "কি কি বললে?” ওই দিক থেকে নীরা শান্ত গলায় বলতে লাগল, "ভাইয়ার তো গত দু বছর ধরে লিউকোমোনিয়ায় ভুগছিল। কথাটা সে আপনাদের কাছে গোপন রেখেছিল। খুব ইচ্ছা ছিল আপনাদের, বিশেষ করে ইলা আপুর সাথে শেষ বারের মত দেখা করে আসার। দেশের যাবার জন্য টিকিটও করেছিল। কিন্তু বেচারা এয়ারপোর্টে যেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাকে আপনার ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছিল, বলেছিল ওর জীবন যদি তার আগেই শেষ হয়ে যায়, তা হলে আপনাকে যাতে জানাই।"

১০

ইমন ছবিটার দিকে আবার নজর দিলো। সময় বিকাল চারটা পনের। বাংলাদেশ আর এমেরিকার সময়ের ব্যবধান এগার ঘণ্টা। তার মানে মৃত্যুর পাঁচ মিনিট পরে টুটুল ওদের কাছে এসেছিল। আর কেউ তাকে দেখতে পারল না। কিন্তু আসবেই বা কি করে? এইটা কি করে সম্ভব?? ইলা, রিনি কাঁদতে আরম্ভ করল। কাজল গম্ভীর হয়ে গালে হাত দিয়ে টুটুলের কথা ভাবতে লাগল।

ইমন বিষয়টা বুঝার জন্যে কম্পিউটার অন করল। আসলে ল্যাপটপটা আনা হয়েছিল ফেসবুকে ছবি আপলোড করার জন্যে। সব ছবিই টুটুলের পাঠান ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা। সেখান থেকে সরাসরি আপলোড করা যায় না। ছবিগুলোকে প্রথমে কম্পিউটারে নিতে হয়। তারপরে ফেসবুকে পোস্ট করতে হয়। সে গুগলে যেয়ে সার্চ করা আরম্ভ করল যে এই ধরণের কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি-না। কিছুক্ষণের মধ্যে জানতে পারল কিছু মানুষ মারা যাবার পরেও প্রিয় জনের কাছে এসেছে---এমন ঘটনা আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে বলে উল্লেখ আছে। এ রকম চলে যাওয়া মানুষ আর কারোর চোখে না পড়লেও ক্যামেরার লেন্সে তা ঠিকই ধরা পড়ে। ইমন অন্যদেরও ঘটনাটা জানাল।

রিনি কাঁদতে কাঁদতে বলল, "টুটুল তা হলে আমাদের কাছে এসেছিল? ইস বেচারা!!”

ইলা জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে রাতের সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে স্রোতের অবিরাম শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে সমুদ্রও চিৎকার করে কোন এক দুঃখে অবিরাম কেঁদে চলেছে।

যে মেয়েকে আগে কেউ কখনও গান গেতে শুনে নি, সে গান ধরল। একেবারে নিখুঁত সুরে লালনের সুরে। ইলার গানের সুরের কান্নার সাথে সমুদ্রের কান্না মিলে যেন একাকার হয়ে গেল:

পারে লয়ে যাও আমায়।

আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়।।

আমি একা রইলাম ঘাটে

ভানু সে বসিলো পাটে

তোমা বিনে ঘোর সংকটে

না দেখি উপায়।।

(রচনাকালঃ ২০১৪)