ইসলাম ধর্মে হতাশার স্থান

ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবো, ওমুক বাড়ির মেয়ের বিয়েতে পাড়ার সবার দাওয়াত, আগামী সপ্তাহে খোকার পরীক্ষা--ধরণের কথাগুলো ইদানীং শোনা যাচ্ছে না। ভবিষ্যৎ সব সময়ে আমাদের অজানা থাকলেও, এখন ভীষণভাবে সেটা অনিশ্চিত। জীবন আবার কবে স্বাভাবিক মানে সেই আগের মতো হবে সেটা আমরা কেউ জানি না। একটু অসাবধান হলেই মৃত্যুর হাতছানি। একেবারে সারা বিশ্বে দম বন্ধ করা পরিবেশ। কেউ আর কোনো পরিকল্পনা করতে পারছে না। এখন শুধু একটাই আশা; এই পরিস্থিতির সমাপ্তি। কিন্তু এই আশা নিয়ে কতো দিন আমাদের বসবাস করতে হবে সেটাও আমাদের জানা নাই। এই দিকে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর পরে করোনা কাকে ছোবল দিবে? নিজেকে কিংবা পরিবারেরে একজন আক্রান্ত হলে কি অবস্থা দাঁড়াবে?

এ রকম কঠিন অবস্থায় প্রতিটা মানুষই প্রচণ্ড মানসিক চাপে আছেন। আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় থাকাটাও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। এক এক করে বহু মানুষের মনে হতাশা এসে ভর করছে। তবে এমন না যে হতাশা শুধু করোনারই ফসল। স্বাভাবিক সময়ে আরও হাজারো কারণে মানুষ হতাশায় ভুগে। অর্থনৈতিক, দাম্পত্য, প্রেম, চাকরি থেকে আরম্ভ করে স্বাস্থ্য জটিলতাও হতাশা তৈরি করতে পারে। ভুক্তভুগীরা নিজেকে অসহায় ভাবতে আরম্ভ করে। সবার থেকে, সব কিছু থেকে গুটিয়ে ফেলতে চায়। জীবনটাকে অসহ্য মনে হতে থাকে। বুঝে উঠতে পারেনা কেনো এতো চাপ, কেনো এতো দুঃসময়। আজকে ইনশা আল্লাহ আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো এ রকম পরিস্থিতি ও হতাশা সম্পর্কে ইসলাম ধর্ম কি বলে ।

পবিত্র কুরআন শরীফে সুরা আল বাকারায় (২:১৫৫) বলা হয়েছে, “আমি তোমাদের অবশ্যই আতংক, ক্ষুধা, সম্পদ, ও ফসল দিয়ে পরীক্ষা করবো।” এখানে আরও বলা হয়েছে, যারা ধৈর্য নিয়ে খারাপ সময় মোকাবেলা করে এবং বলে, “আমরা আল্লাহ কাছ থেকে এসেছি আর তার কাছেই আমরা ফিরে যাব ; তাদের জন্য সুখবর রয়েছে।” আবার সুরা আম মাইদায় বলা হচ্ছে (৫:৬), “আল্লাহ তোমাদের ভারাক্রান্ত করতে চান না; বরং তোমাদের বিশুদ্ধ করে, তার নেয়ামত তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ থাকো।” সুরা আল মু মিনুন এ বলা হচ্ছে, কোন আত্মাকে তার ক্ষমতায় কুলাবে না এমন পরীক্ষা দেয়া হয় না। সুরা আল হাদীদ সহ একাধিক সুরায় বলা আছে, পৃথিবীর এই ক্ষণস্থায়ী জীবন হলো একটা মরীচিকা। সাথে সাথে সুরা ইউসুফে (১২:৮৭) বলা হয়েছে, "কখনই আল্লাহ’র ক্ষমা সম্পর্কে আশা ছেড়ে দিও না।” সুরা আত তালাক-এ (৬৫:৭) বলা হচ্ছে, “শীঘ্রই কষ্টের পরে, আল্লাহ, জীবন সহজ করে দিবেন।” এবং সুরা আল আন আম (৬:৫৯)–এ আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন, তার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতা পর্যন্ত পড়ে না।

উপরের কথাগুলোকে আমাদের জীবনের সাথে মিলিয়ে চিন্তা বিষয়টা অনেকটা এরকম দাঁড়াতে পারে: আমাদের প্রত্যেককেই ব্যক্তি কিংবা জাতি হিসেবে মহান আল্লাহ তা’লা পরীক্ষা করেন। আমরা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ি । এই বিপর্যয় পরম করুণাময় আল্লাহ'র তরফ থেকেই আসে। কারণ তার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতা পর্যন্ত পড়ে না। এই পরীক্ষার মধ্যে আমরা যখন পড়ি, আমাদেরকে ধৈর্য্য আর বিশ্বাস অবিচল রাখার জন্যে বলা হয়েছে। মহান সৃষ্টি কর্তা পরম করুণাময় আল্লাহ সুবহান আ তা আলা শীঘ্রই আমাদের এ অবস্থার অবসান করবেন। আমরা সামাল দিতে পারবো না, এমন কোন পরীক্ষায় আল্লাহ আমাদের ফেলেন না। বরং, আমরা আতঙ্কিত হয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলি। নিজেকে, অন্যদেরকে, সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করি। হতাশাগ্রস্ত হয়ে কেউ বিপথে চলে যায়, আবার কেউ বা আত্ম ধ্বংসকারী কাজ করে। এমনকি জীবন নিয়ে ক্লান্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বিবেচনা করে। জয় হয় শয়তানের কু মন্ত্রণার। আমারা আল্লাহ’র নির্দেশিত পথ থেকে দূরে সরে যাই।

যুক্তরাষ্ট্রের একটা জনবহুল শহর শিকাগো। সেখানে এক বিলবোর্ডে করোনা সংক্রমণ মোকাবেলা করতে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (দঃ)'র বাণী শোভা পাচ্ছে, “ঘন ঘন হাত ধুবে, আক্রান্ত স্থান ছেড়ে যাবে না, এবং আক্রান্ত স্থানে যাবে না।” এখনকার বিজ্ঞান মহামারী ঠেকানোর জন্যে যা বলছে; মুসলমানদের সেটা গত ১৪০০ বছর থেকে জানা। ইসলামের ইতিহাসে এ পর্যন্ত বেশ অনেকবার মহামারী ও ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। মহানবী (দঃ) স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপর খুব জোর দিয়ে গেছেন। তিনি গণ-স্বাস্থ্য ও নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ৭ম শতাব্দীতে খলিফা উমর বর্তমান সিরিয়ার এক অংশ মহামারীতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে সামরিক অভিযান না চালিয়ে ফিরে এসেছিলেন। উপরন্তু ইসলাম ধর্মে মৃত্যু কামনা করা একেবারে নিষিদ্ধ । নিয়ম মেনে ধৈর্য্য ধরে নির্ধারিত কাজ করতে থাকলে মহামারীর থেকে মুক্তি মিলবে, ইনশাল্লাহ।

ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর প্রত্যেকটা ঘটনার সমাপ্তি আছে। এখন যা বর্তমান, পরের মুহূর্তেই তা অতীত। মরুভূমিতে মরীচিকা দেখার মতো। আল্লাহ সুবহান তা আলা আমাদের পরীক্ষা করেন, যাতে তিনি তার নেয়ামত কোন কার্পণ্য ছাড়াই আমাদের দিতে পারেন। কিন্তু কিছু মানুষ বিপর্যয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে অস্থির হয়ে পড়েন। ভাবতে থাকেন, আর কতো পরীক্ষা! এর শেষ কোথায়!! এই কথার উত্তরে বলা যায়, আল্লাহ যাকে বেশী ভালোবাসেন; তাকে হয়তো পরীক্ষাও বেশী করেন। সফলভাবে পরীক্ষা দিতে পারলে, আল্লাহ তা’লা বেহেস্তের অঙ্গীকার করেই রেখেছেন।

শেষে এই কথা বলি, ইহকাল এবং পরকাল নিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ জীবন। আমরা আমাদের কিছু কাজের ফল ইহকালে না পেলেও, আল্লাহ’র রহমতে, পরকালে অবশ্যই পাবো। আল্লাহ তা আলা’কে পরম বিশ্বাসে ডাকলে, তিনি প্রত্যেককে সাড়া দেন। তবে তার “সাড়া” আমরা এখন অনেকে বুঝতে পারি না। কিন্তু আমাদের শেষ বিচারের দিন যখন এই “সাড়া” র সব চেয়ে বেশী প্রয়োজন হবে, তখন আমরা তার উপকার পাবো, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের দরজা প্রত্যেক বিশ্বাসীর জন্য সব সময় খোলা।