girl in blue white and red striped long sleeve shirt

হ্যাট পরা ইংরেজ পুতুল

পুতুল নিয়ে শিশুদের খেলার ব্যাপারটা প্রায় উঠেই যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক খেলনাগুলো আসার আগে বাচ্চাদের বিশেষ করে মেয়ে বাচ্চাদের কাছে পুতুল-ই ছিল সবচেয়ে প্রিয় খেলনা। তার পরেও অল্প কিছু শিশু এখনও পুতুল নিয়ে খেলে। বিশেষত গ্রাম অঞ্চলে পুতুল বানানো চলটা রয়ে গেছে। মেলায় নানা ধরণের মেলা পুতুল উঠে। তবে শহর অঞ্চলে পুতুলের ব্যবহার নাই বললেই চলে। অভিজাত হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানে দামী পুতুল দেখা গেলেও, সেগুলো মূলত বাড়ির ডেকোরেশন পিস মানে সাজিয়ে রাখার সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শোনা যায়, এইসব হাতে বানানো পুতুল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। শিল্প পিয়াসু বিদেশীরা সেগুলো কিনছে। তবে তারাও সেই সব পুতুল দেশীয় শহরবাসীদের মতো বাচ্চাদের খেলার জন্যে না, বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যবহার করছে।

রিকি ধানমণ্ডিতে জন্ম নেয়া ও সেখানে বেড়ে পরিবারের একমাত্র সন্তান। বাবা-মা অনেকটা পাল্লা দিয়ে ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া সন্তানকে নানান ধরণের দামী দামী খেলনা কিনে দেন। কম্পিউটার, আই-প্যাড, গেম বয় থেকে আরম্ভ করে ইলেকট্রিক গাড়ি, রোবট দিয়ে ঘর ভরা। বাবা সালেকিন শেখ বিদেশী কোম্পানির বড় কর্মকর্তা। প্রায় বিদেশে যান। ফেরার সময় ছেলের জন্য একগাদা উপহার নিয়ে আসেন। এতে রিকির খেলনার স্তুপ বেড়েই চলেছে। মা রিনি নিয়মিত দেশের বড় বড় সুপার মার্কেট ঘুরে ছেলেকে খুশি করার জন্যে কিছু না কিছু কিনে আনেন। সেগুলো বাবার বিদেশ থেকে আনা খেলনার সাথে হুবহু মিলে না গেলেও, বেশ কাছাকাছি হয়ে যায়। রিকি প্রথমদিকে খেলনা নিয়ে তুমুল উৎসাহ দেখায়। প্রথম কয়েকদিন একেবারে বালিশের পাশে নিয়ে ঘুমায়। কিন্তু দু একদিন যেতে না যেতেই আগ্রহ শেষ। হয়তো এর মধ্যে নতুন কোনো খেলনা চলে এসেছে।

রিকির অল্প সময়ের মধ্যে খেলনা পরিত্যক্ত করা নিয়ে বাবা-মা’র কোনো অভিযোগ নাই। তাদের সামর্থ্য আছে বলেই রিকি কাজটা করতে পারছে। তা ছাড়া বাচ্চার রুম ভর্তি আধুনিক সব সামগ্রী না থাকলে মানুষের কাছে সম্মান-ই বা বাড়বে কি করে? কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে অন্য রকম একটা সমস্যা হচ্ছে। ক্লাস ফাইভের ছেলেটা আধুনিক সব খেলনা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বাক্স থেকে বের করে হাতে দিলে দূরে সরিয়ে রাখছে। বালিশের পাশে রাখার তো প্রশ্নই উঠে না। মা বিষয়টা দ্রুত-ই ধরে ফেললেন। জরুরী ভিত্তিতে স্বামীকে ফোন করলেন। বেশ সময় নিয়ে আলোচনা করলেন যে কি করা যায়। সিদ্ধান্ত হলো সালেকিন শেখ এবার ইটালি থেকে এমন কিছু আনবেন যা রিকি আগে কখনও দেখে নি।

বাবা একেবারে দু হাজার ডলার খরচ করে এমন খেলনা আনলেন যেটা রিকির নাই। একটা ড্রোন প্লেন আনলেন যেটা উপর থেকে ভিডিও ছবি মনিটরে পাঠাতে পারে। এই খেলনায় দু ধরণের মজা। এক, রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে ড্রোন আকাশে উড়ানো। দুই, ড্রোন থেকে পাঠানো ছবি দেখা। বাবা-মা মিলে ছেলেকে নিয়ে লং ড্রাইভ করে যমুনা নদীর ধারে নিয়ে গেলেন। ড্রোন উড়ানো হলো। উপর থেকে পাঠানো ছবি মনিটরে ভেসে উঠল। উপস্থিত সবাই আনন্দে ও উত্তেজনায় অস্থির হয়ে পড়ল। কিন্তু যার জন্যে এতো আয়োজন সে বিষয়টা নিয়ে নির্বিকার। বাবা মা নানাভাবে চেষ্টা করলেন রিকির আগ্রহ গড়ে তুলতে। ছেলের হাতে ড্রোনের রিমোট দিয়ে আকাশ থেকে পাঠানো ছবির বর্ণনা দেয়া হলো। ক্লাস ফাইভের জন্যে এটা জটিল হয়ে গেল কি-না, সেটা বাবা-মা ঠিক বুঝতে পারলেন না। দু জনে ফিসফিস করলেন, একজন সাইকিয়াটরিষ্টের সাথে কথা বলতে হবে।

ঘটনাটা আসলে অন্য জায়গায়। মাস খানেক আগে ড্রাইভার সিদ্দিক রিকিকে গ্রামের বাড়ি থেকে একটা পুতুল এনে দিয়েছে। সিদ্দিকের স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। বাবার খবর নেওয়ার মতো সময় তাদের নাই। তার দেশের বাড়িতে তিন কামরার টিনের চালের ঘর আছে। সেখানে দূর সম্পর্কের এক খালাতো ভাই দুটো রুম নিয়ে সস্ত্রীক থাকে। তৃতীয় রুম বেশির ভাগ সময়েই তালা দেয়া থাকে। সিদ্দিক দু তিন মাস পর পর ছুটি নিয়ে কয়েক দিনের জন্যে বাড়ি থেকে ঘুরে আসে। বন্ধ রুমটাতে ছোট একটা খাট ছাড়া পুরনো সব জিনিসে ঠাসা; স্টোর রুম বললে ভুল হবে না। ওই সব জিনিসপত্র ঘাটতে যেয়ে সিদ্দিক নীল রঙের একটা পুতুল দেখলেন। সাথে সাথেই মনে পরে গেল পুতুলটার ইতিহাস। ছোট বোন সালেহার জন্মের পর সিদ্দিকের বাবার দাদী মানে বড় মা এই পুতুল দিয়েছিলেন। তার হাত ও সুঁইয়ের কাজে অনেক নাম ডাক ছিল। ধারণা করা হতো তিনি নিজেই এই পুতুল বানিয়েছিলেন। সেটা প্রচলিত কোন বর-বউয়ের ছিল না। ছিল হ্যাট পরা এক ইংরেজ বালকের।

সিদ্দিকের বাবার দাদীর বয়স ঠিক করে কেউ বলতে পারতো না। মানুষে বলাবলি করতো উনার বয়স কম করে হলেও একশত হবে। সারা জীবন অজ পাড়া গায়ে কাটালেও প্র-পৌত্রীকে এ রকম পুতুল কিভাবে বানিয়ে দিলেন কিংবা কোথায় পেলেন সেটা নিয়ে অনেকেই তাকে প্রশ্ন করতো। তিনি কাউকেই কোনো সন্তোষজনক উত্তর দেন নি। সেই আমলে গ্রামে বিদ্যুৎ তো ছিল-ই না; টেলিভিশন থাকার তো প্রশ্নই উঠে না। হয়তো তিনি ম্যাগাজিনে ওরকম কোন ছবি দেখে পুতুলটা বানিয়েছেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনাও কম। খেলনাটা হার্ড প্লাস্টিক দিয়ে বানানো। সেটা গ্রাম্য একজন মহিলার পাওয়ার কথা না। পেলেও সেটাকে কেটে পুতুলের আকার দেয়ার যন্ত্রপাতি পাওয়াটা বলতে গেলে অসম্ভব। সেই সময়ে গ্রামে বাংলা পড়তে পারে এমন মানুষ ছিল হাতে গোণা কয়েকজন। আর ইংরেজি জানার তো প্রশ্নই উঠে না। দু চার জনের অবশ্য ‘ইয়েস, নো, ভেরি, গুড’ পর্যন্ত জানতো। তাদের মনে এতো ধরণের প্রশ্ন আসে নি।

বোলিয়া গ্রামে সিদ্দিকের দাদী সখিনা বিবির বয়সের মানুষ আর কেউ ছিল না। বয়সের তুলনায় তিনি ছিলেন বেশ অন্যরকম। তার যে এতো বয়স হয়েছে সেটা তার গড়ন দেখে বুঝাটা কঠিন। তার চোখের দৃষ্টি, শ্রবণ, গায়ের শক্তি কমে আসলেও নিজের সব কাজে তিনি নিজেই করতেন। শুধু তাই না বহু বছর ধরে তিনি বলতে গেলে গ্রামের প্রধান ধাত্রী। আরও কয়েকজন মহিলা একই কাজ করলেও জটিল প্রসূতির কোনো কেস থাকলে তার ডাক পড়তোই। আবার অনেকে বাড়তি ভরসার জন্যে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ে তার উপস্থিতি চাইতো। বলা তো যায় না কখন আবার জরুরী সাহায্যের দরকার হয়ে পড়ে। অন্য ধাত্রীদের বিষয়টা একেবারে পছন্দের ছিল না। তাদের ধারণা এই বুড়ি দাদী-জান না থাকলেও তাদের আয় আরও ভালো হতো। গ্রামের সবাই তাকে দাদী-জান বলে ডাকত।

তখন ব্রিটিশ আমল চলছে। গ্রামের একমাত্র যানবাহন হচ্ছে গরুর গাড়ি। শুধুমাত্র সচ্ছলরাই এই বাহন ভাড়া করতে পারেন। আর বাকিদের পায়ে হেঁটে এক-জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে হয়। সে জন্যে মানুষরা প্রচুর হাঁটে। সকালে আরম্ভ করে একেবারে অন্ধকার নামা না পর্যন্ত। তার পরে আবার সকালে নতুন করে পথ চলা। শোনা যায় মানুষরা ২০-২৫ মাইল পায়ে হেঁটে গঞ্জ কিংবা শহরে যেতো। ভিন গ্রামের বিয়ে হওয়া কোনো কুটুমকে দেখতে হলে সেই একই বাহন; মানে পায়ে হেঁটে যাওয়া। তবে কালে ভদ্রে এই দৃশ্যের ব্যতিক্রম চোখে পড়ত। প্রায় পাঁচ গ্রাম পরে ছিল জমিদার বাড়ি। উনার একটা চার চাকার মোটর গাড়ি ছিল। সেটা না-কি বিদেশ থেকে আমদানি করা। তিনি সেই গাড়ি চড়ে বছরে দু একবার গ্রাম পরিদর্শনে আসতেন। পুরো গ্রাম ভেঙে পড়তো তার গাড়ি দেখার জন্যে। এবড়ো থেবড়ো মেঠো রাস্তা ধরে গাড়ি চলতো। তার পিছনে একগাদা কিশোর-কিশোরী হৈ চৈ করতে করতে ছুটতে থাকত।

প্রায় একই ধরণের দৃশ্য দেখা যেতো ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যখন এলাকা পরিদর্শনে আসতেন। সেটা অবশ্য খুবই কম হতো। বলতে গেলে দু বছরে একবার। তার সফরের বেশ আগের থেকে সরকারী লোকজন গ্রামে আসা যাওয়া আরম্ভ করতো। সাথে থাকতো জমিদারের লোক। চারিদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছনতা ও জায়গা রং করার হিড়িক পড়ে যেতো। বিদেশী সাহেব বলে কথা। সাথে বড় একটা বন্দুক নিয়ে আসতেন। সাথে কয়েকজন পুলিশও থাকত। মানুষে বলাবলি করত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব খুবই রাগী মানুষ। কিছু পছন্দ না হলে ইংরেজিতে চিৎকার করে গালাগালি করেন। একবার জমিদারের নায়েবকে খুব বকা-ঝোঁকা করে গুলি করার জন্যে বন্দুক তুলেছিলেন। পরে অবশ্য কি একটা মনে করে বন্দুক নামিয়ে ফেলেন। তার গাড়িটা ছিল কিছুটা অন্যরকম। বড় চাকা থাকাতে গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলতে জমিদার সাহেবের গাড়ি মতো বেগ পেতে হতো না। কিন্তু গাড়ি বেশ ধীর গতিতে এগিয়ে চলত। শতবার নিষেধ করেও কিশোর-কিশোরীদের দলকে গাড়ির পিছনে দৌড়ানো থেকে আটকে রাখা যেতো না।

খবর এলো নতুন ম্যাজিস্ট্রেট বোলিয়া গ্রাম দেখতে আসবেন। তিনি আগের জন থেকে আরও বেশী রাগী। প্রচার পেয়ে গেল তিনি এ পর্যন্ত না-কি কয়েক জায়গায় গুলি করে মানুষ মেরেছেন। চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। জমিদার সাহেব দশ জন কর্মচারী পাঠিয়ে দিলেন। সাথে কয়েকজন স্থানীয়কে চুক্তি ভিত্তিতে কাজে নেয়া হলো। অন্যরা উৎসাহী হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে সাহায্যে এগিয়ে এলো। তারা আর যাই হোক গ্রামে খুন খারাপি চান না। নির্ধারিত দিনে নতুন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব উঁচু চাকার গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন। সবাই তো অবাক। এতো একেবারে কম বয়সের একজন। আগের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বয়স্ক, আর মাথায় ছিল ইয়া বড় টাক। আর নতুন-জন একেবারে তার বিপরীত। বয়স কম, মাথা ভর্তি সোনালি চুল। শরীর রং একেবারে টকটকে লাল। 

তার গাড়ির পিছনেও একদল ছেলেমেয়ে ছুটতে লাগল। তাদের মধ্যে ছিল বারো বছর বয়সের একজন কিশোরী; সখিনা। তার শরীরটা বয়সের তুলনায় বেশি পরিপূর্ণ। আগের ম্যাজিস্ট্রেট এই সব দুষ্টু ছেলে মেয়েদের দিকে ঘুরেও তাকাতেন না। কিন্তু নতুন ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টাতে প্রচুর আগ্রহ পেলেন। কিছুক্ষণ পর পর ঘুরে ঘুরে ওদের দেখে নিচ্ছিলেন। তিনি জমিদারের নায়েবকে সখিনাকে দেখিয়ে কানে কানে কিছু বললেন। ম্যাজিস্ট্রেট ও তার দল গ্রামে তাঁবু খাটাল। তিনি ও তার দল সেখানেই রাত কাটাবেন। সকাল হলে পরের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবেন। পুরো বিষয়টা ছিল গ্রামবাসীদের জন্যে বিস্ময়। তাঁবু খাটান, আগুন জ্বালান আর রান্না-বান্না দেখার জন্যে বড় সড় ভিড় হয়ে গেল। অবশ্য অন্ধকার নামার সাথে সাথে যে যার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো। কিন্তু আরেকটু অন্ধকার হওয়ার পর দেখা গেল নায়েব ও তার দু জন সহযোগী সখিনাকে টানতে টানতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের তাঁবুর সামনে নিয়ে দাঁড়াল। শব্দ শুনে ইংরেজ সাহেব তাঁবুর বাইরে এসে খপ করে সখিনার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাঁবুর ভিতরে নিয়ে গেলেন।

রিকি মা’কে জানাল তার রুমে সব খেলনা সরিয়ে ফেলতে হবে। রিনি পুত্রের এরকম কথায় যার পর নাই অবাক হলেন। তিনি জানতে চাইলেন এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার কি কারণ। রিকি বেশ গম্ভীর ভাবেই উত্তর দিলো, “আমাকে টম বলেছ আমার রুমে আর কোনো রকম খেলনা থাকতে পারবে না। সে বলেছে সেই শুধুমাত্র আমার সাথে খেলবে।” মা অবাক হয়ে এইবার জানতে চাইলেন, “টমটা আবার কে?” ছেলে আরও গম্ভীর গলায় জানাল, “ওই যে সিদ্দিক চাচু আমাকে ইংলিশ লিটল বয়ের ডল এনে দিয়েছিলেন, ওরই নাম টম।” মা এইবার হেসে বললেন, “বেশ ভালই তো ওর নাম দিয়েছ—টম। একেবারে বিদেশী নাম। ভালই তো। চেহারা অনুযায়ী ওর নাম টম, জন, হেনরি জাতীয় কোন একটা নাম বুদ্ধিমানের কাজ।" রিকি আবার মুখ খুলল, “ওই আমাকে বলেছে ওর নাম টম।”

রিনি আর কথা বাড়ালেন না। খুব-ই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। একবার মনে হলো ড্রাইভার সিদ্দিককে ডেকে খুব করে বকে দিবেন কি-না। কি হাবি জাবি পুতুল এনে দিয়েছে, যাতে তার এতটুকু ছেলের মাথা বিগড়ে গেছে। পরে মনে হলো বিষয়টা খুব ছেলে মানুষের মতো হবে। বেচারা বয়স্ক মানুষ ভালোবেসেই রিকির জন্য সুন্দর একটা পুতুল এনে দিয়েছেন। যদিও সে বলেছে যে পুতুলটার অনেক পুরনো। কিন্তু দেখলে মনে হয় মাত্র কিনে আনা হয়েছে। বেচারির মাথার মধ্যে খেলল না সে এখন কি করতে পারে। তার এতটুকু জানা আছে ছেলে ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ না করলে সে সারা রাত জেগে কাঁদবে। নিজের উপর বিরক্ত লাগতে লাগল। আসলে ছেলেকে অতিরিক্ত আদর দিয়ে দিয়ে একেবারে স্পয়লড করে ফেলা হয়েছে। পরের মুহূর্তে মনে হলো একমাত্র সন্তানকে আদর করবেন না তো কাকে আদর করবেন। এখন-ই ছেলের বাবাকে ফোন করে কথা বলতে হবে। ছেলে ভাবছে একটা পুতুল তার সাথে কথা বলছে। এ তো একেবারে মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপর লক্ষণ। লোকটা আবার পরিবারে যখন কোন ইমারজেন্সি হয়, তখনই দেখা যায় সে দেশে নাই। এইবার উনি গেছেন একেবারে ইউরোপে। ফিরতে আরও দু সপ্তাহ বাকী। 

সালেকিনকে ফোন করে পাওয়া গেল না। রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না। বিষয়টা কি হতে পারে? তার ভালো করেই জানার কথা বিশেষ দরকার না হলে বাসার থেকে ফোন যাবে না। এর মধ্যে রিনির মাথা গরম হওয়া আরম্ভ করছে। লোকটার সাথে যোগাযোগ করতেই হবে। টেক্সট লিখতে ইচ্ছা করছে না। কথা বললে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলা যায়। লিখে কি আর সব কিছু ব্যাখ্যা করা যায়? উপায় না দেখে ওয়াটস এপে লিখতে হলো পুরো বিষয়। রিনির ফোনের মধ্যে টাইপ করে লেখাটা একেবারে পছন্দের না। কিন্তু এখন আর কোনো উপায় নাই। লিখতে লিখতে ভাবতে লাগল আগামী দু ঘণ্টার মধ্যে উত্তর না পেলে যা করার দরকার তা নিজেকেই করতে হবে।

না সালেকিনকে কোনো ভাবেই ধরা গেল না। আগে তো কখনও এ রকম হয় নি। যেখানেই থাকুক না কেন ফোন করলে সাথে সাথে ধরেছ। অবশ্য এবার বলেছিল পোল্যান্ডের কিছু দুর্গম জায়গায় যেতে হবে, যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নাও থাকতে পারে। মনে হচ্ছে লোকটা এই মুহূর্তে সে রকম কোনো জায়গায়। রিনির মাথাটা আরও বেশী গরম হয়ে গেল। লোকটাকে যখন দরকার তখনই তাকে পাওয়াটা যায় না। ছেলেটা এমন ঝামেলা দিচ্ছে আর সেটা নিয়ে কথা বলার মতো কেউ নাই। ছেলেটাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে পুতুলটা কেড়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা দূর করা যেতে পারে। কি যেন বলে, মাইরের উপর ওষুধ নাই। কিংবা পুতুলটা ড্রাইভারের কাছে ফেরত দেওয়া যেতে পারে। কোন বুদ্ধি যুতসই মনে হলো না। এইগুলো করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিবে। আগে একবার জিদ করে পাক্কা দু দিন না খেয়ে ছিল। সুইসাইডের হুমকিও দিয়েছিল। এখনকার এইসব পুচকে বাচ্চারাও হরদম কাজটা করছে। কিছুদিন আগে রিকির ক্লাসের একটা ছেলে মায়ের সাথে ঝগড়া করে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল।

আপাতত রিকির দাবী মেনে নিতে হচ্ছে। বাসার বুয়া এরই মধ্যে সব খেলনা বের করে বাক্স বন্দি করেছে। রিনি চেষ্টা করছে যাতে ছেলে ধরতে না পারে যে তার মনে কত বড় একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। পুত্রকে কিছু বললে একেবারে বিপদ। রাতের জন্যে অনশন ঘোষণা করবে। এতটুকু ছলে এত বড় রাত না খেয়ে থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে। ক্লাসে ইদানীং চাপ বেড়েছে। বাসায় ফিরে আসার পর আবার দু জন টিউটর আসে। এতটুকু বাচ্চার উপর চাপ তো কম না। মায়ের মন আরও অস্থির হয়ে গেল। সালেকিনকে ছাড়াই দুটো সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথমটা হলো কালকেই একটা ভালো সাইক্রিয়াটরিষ্ট খুঁজে বের করে রিকিকে সেখানে নিয়ে যাবে। স্বামীর জন্যে আর সে অপেক্ষা করবে না। সাথে রিনি আরও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। আজকে রাতে দরজায় আড়ি পেতে শুনবেন পুতুলটা আসলেও রিকির সাথে কথা বলে কি-না!

আড়ি পাতার সিদ্ধান্তের নিজের মাথাটাও বুঝি বিগড়ে যাচ্ছে। না এইসব হাবিজাবি মাথার থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে টিভি দেখার দিকে মন দিলেন। না সেটাতে খুব একটা সুবিধা করা গেল না। চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে রাতের সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। এইবার ঘুমানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলেন না। অনেকটা আপনা আপনি বিছানা থেকে উঠে রিকির রুমের দরজার পাশে যেয়ে দাঁড়ালেন। কি অদ্ভুত রিকি এখনও জেগে আছে। ভিতর থেকে কারোর গলার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। হয়তো টিভি দেখছে। কিন্তু ওর রুমে কোনো টিভি নাই। তা ছাড়া সব ধরণের ইলেক্ট্রনিক খেলনা বের করে ফেলা হয়েছে। ওসব থেকেও শব্দ বের হবে না। আবার দুটো গলার আওয়াজ কানে আসছে। একটা রিকির, অন্যটা যে কার সেটা বুঝা যাচ্ছে না।

দরজার বাইরের থেকে কথা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল না। কিছুটা দ্বিধা হলেও সেটা সামলে দরজা ঠেলে ছেলের কামরায় প্রবেশ করলেন। মনে যেটা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ ছিল তাই দেখলেন। রিকি আর পুতুল কথা বলছে। রিনি ঢুকাতে ওদের কথোপকথন থেমে গেল। রিকি বিছানায় বসে ছিল আর পুতুলটা পাশের টেবিলে সোজা করে রাখা। রিকির মতো পুতুলটাও রিনির দিকে ঘুরে তাকাল। এইটা কি করে সম্ভব? পুতুলটা কি করে নিজের মাথা ঘুড়িয়ে ফেলল? তা হলে পুতুলটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রিকির কথাই ঠিক। রুমের লাইট বন্ধ থাকলেও জানালা দিয়ে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো ঢুকছিল। একবারে পরিষ্কার না হলেও, রুমের সব কিছুই আবছা দেখা যাচ্ছিল। এইবার পুতুলের দিক থেকে শব্দ আসা আরম্ভ করলো, “মিসেস রিনি আমি আসলে তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম আজকে রাতে তুমি আসবে। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ যে আমার নাম টম।”

পুতুলটা দেখতে ছোট বাচ্চার মতো হলেও গলার আওয়াজটা বয়স্ক মানুষের মতো শোনা গেল। তবে কথা বলছে চোষ ইংরেজিতে। কানের মধ্যে বেশ খট খট করে লাগল। ব্রিটিশ কাউন্সিলে কুইন ভিক্টোরিয়া সময়কার ঘটনার উপর একটা নাটক দেখেছিল, অনেকটা সেই রকম মনে হলো। রিনির অল্প সময়ে বিস্তর পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা আছে। সেই ছোট বেলা তার এই গুণ। না হলে মুহূর্তেই এত কিছু বিশ্লেষণ সবাই করতে পারে না। কিন্তু এইটা কি করে সম্ভব? একটা পুতুল তার সাথে কথা বলার জন্যে অপেক্ষা করছে।

বিধাতার অদ্ভুত রসিকতা মানুষের পক্ষে বুঝাটা কঠিন। দুর্ঘটনায় পরা মানুষগুলো আবার নতুন করে ঝামেলায় পড়ে। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট পরের দিন সকালে তার তাঁবু গুটিয়ে সেপাই সান্ত্রী নিয়ে চলে গেলেন। তার সখিনার প্রয়োজন শেষ হলেও মেয়েটার ভোগান্তির চলতে থাকল। ম্যাজিস্ট্রেট সখিনার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। গরিব সখিনার বাবা এত টাকা একসাথে ইহকালে দেখেনি। টাকা গুনেই নানা রকমের পরিকল্পনা মাথায় খেলতে থাকল। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্য যাওয়ার আগে একটা ভালো কাজ করলেন। গ্রামের সবার জানা হয়ে গিয়েছিল যে সখিনার সাথে কি ঘটেছে। চলে যাওয়ার আগে ইংরেজ সাহেব গ্রামের মাতব্বরকে ডেকে কড়া গলায় বললেন, “খবরদার এ নিয়ে গ্রামে যাতে কোনো আলোচনা না হয়। আমার লোক গ্রামেই আছে। অন্যথায় হলে আমি ঠিকই খবর পেয়ে যাব। যারা আমার কথা অমান্য করবে তাদের সবাইকে আমি নিজের হাতে এক এক করে গুলি করে মারব।” 

ম্যাজিস্ট্রেটের হুমকি কাজে দিল। গ্রামের কেউ বিষয়টা নিয়ে কোনো উচ্চ বাচ্য করলো না। বলা তো যায় না কে না কে আবার ম্যাজিস্ট্রেটের লোক। মুখরোচক কথা বলে কেউ বেঘোরে প্রাণটা দিতে আগ্রহী না। কয়েকদিনের মধ্যেই বিষয়টা ভুলা আরম্ভ হলো। সখিনার পরিবারও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলো যে এটা একটা নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু না। সখিনার বাবা-মা নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করলেন। মেয়েকে দুরের কোনো গ্রামে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। সেখানকার কারোরই ম্যাজিস্ট্রেটের কুকর্মের কথা জানা জানবে না। এই দিকে সাহেবের দেয়া টাকা দিয়ে এক চিলতে জমি কেনা হলো। বাকী টাকা দিয়ে দুটো দুধেল গাভী হয়ে যাবার কথা।

কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই একটা সমস্যা দেখা গেল। কিশোরী সখিনার পেটে ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তান এলো। পরিবারটা অস্থির হয়ে উঠলো এখন কি করা যায়। অবিবাহিত মেয়ের বাচ্চা হলে গ্রামের সবাই তাদের এক ঘরে করে দিবে। বাচ্চা নষ্ট করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কারণ ব্যাপারটা ধরতে ধরতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। কয়েকজন অভিজ্ঞ মহিলা দেখে একই মত দিলেন। এখন করার কিছু নাই। চেষ্টা করতে গেলে সখিনার জীবনের ঝুঁকি হবে একেবারে শতভাগ। বাব-মা’র মাথায় একেবারে আকাশ ভেঙে পড়াল। কথাটা গোপন রাখা গেল না। এক কান দু কান করে ম্যাজিস্ট্রেটের কানে যেয়ে খবরটা পৌঁছল।

ইংরেজ সাহেব তড়িৎ ব্যবস্থা নিলেন। তিন দিনের মাথায় তার অফিসের চাপরাশি রতন মিয়া যেয়ে সখিনাকে বিয়ে করে শহরে নিয়ে এলো। এর জন্যে তার বেতন বেড়ে দ্বিগুণ হলো। সাথে এক কাড়ি নগদ টাকাও পেলো। সাহেব বাচ্চা হওয়া সময় খোঁজ খবর রাখলেন। বাচ্চা হওয়ার পর গোপনে সখিনার সাথে দেখা করে বললেন, “ছেলের নাম স্যাম রেখো। ওর দায়িত্ব আমার। ও বড় হলে আমি বিদেশ নিয়ে যাব।” ছেলেকে উপহার দিলেন ইংল্যান্ড থেকে আনা একটা পুতুল। দেখতে ঠিক বিদেশী বালকের মতো। মাথায় আবার হ্যাট। ইংরেজ সাহেব রতন মিয়াকে ডেকে ভালো করে বুঝিয়ে বললেন, “এই পুতুলের নাম টম। এ যেন সব সময়ে স্যামের সাথে থাকে। না হলে কিন্তু বিপদ হবে। ছোট শিশুটা খুন হয়ে যাবে।”

টেমস নদীর তীরে ছোট গুছানো গাছগাছালিতে ভরা নগরটার নাম বার্কসশায়ার। যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ পূর্ব দিকে এর অবস্থান। বিখ্যাত উইন্ডসর ক্যাসেল এইখানেই নির্মাণ হয়েছিল। ধারণা করা হয় ইউরোপের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে এইটাও একটা। সেখানে প্রায় দুই শত বছর আগে একটা ঘটনা হয়েছিল। জন সাইমন নামের এক ব্যক্তির চুল কাটানোর সেলুন ছিল। তার সংসারে সচ্ছলতা থাকলেও মনে সুখ ছিল না। পর পর চারটে বাচ্চা হয়ে জন্মের এক বছরের মধ্যে মারা গিয়েছিল।

ডাক্তাররা জনের স্ত্রীর কোনো সমস্যা খুঁজে পান নি। শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে তার নিজেরও কোনো অভিযোগ ছিল না। শিশুগুলো সুস্থ সবলই হচ্ছিল। কিন্তু কয়েকমাস পরই তারা খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিচ্ছিল। অনেক চেষ্টা ও জোর করেও তেমন লাভ হচ্ছিল না। সেই আমলে স্যালাইন দিয়ে শরীরে পুষ্টি ঢুকিয়ে দিবে দেবার ব্যবস্থা ছিল না। বেচারা জন মেলা জায়গা গেল, অনেকের পরামর্শ নিলো কিন্তু কোনো ফলাফল পেলো না। কেউ বলল অভিশাপ লেগেছে, আবার কারোর মত ডেভিলের (শয়তানের) অশুভ দৃষ্টি পড়েছে।

একবার জনের দোকান বন্ধ করতে করতে বেশ দেরি হয়ে গেল। সারাটা দিন ব্যস্ত ছিল। তার পর একজন কর্মচারী না আসাতে কাজের চাপটাও বেশি হয়ে গিয়েছিল। হিসাব-নিকাস করে পরিষ্কার করতে করতে আরও সময় লেগে গেল। যেই মুহূর্তে বাতি নিভাতে যাচ্ছে, তখনই একজন বেশ বয়স্ক লোক ধীরে ধীরে দোকানে ঢুকল। লোকটার গাল ভরা সাদা দাড়ি আর ঘাড় সমান লম্বা চুল। পেশায় যে নাপিত সে এক দৃষ্টিতে বুঝে ফেলল এই লোকের কাজ করতে গেলে মেলা সময় লাগবে। তারপরেও একজন বয়স্ক লোককে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছা করলো না।

জনকে দিনের শেষ কাস্টমারের পিছনে আরও কিছুটা সময় দিতে হলো। লোকটা বয়স্ক হলেও এক এক করে মেলা কথা জানতে চাইলো। সে এই লোককে আগে দেখে নি। জন সবিনয়ে জানতে চাইলো, “মুরুব্বি আপনি কি এই এলাকায় নতুন কিংবা বেড়াতে এসেছেন?” উত্তরে সে জানাল, “আমি তো পাশের গলিতেই থাকি। তোমাকে প্রায়-ই দেখি।” জন এইবার লজ্জা পেয়ে গেল। একজন বয়স্ক মানুষ তাকে দেখে মনে রেখেছে। আর সে কি-না সেটা খেয়ালই করে নি।

কথায় কথায় জন তার সমস্যার কথা জানিয়ে বলল এই জন্যে তার স্ত্রী ও নিজে ভীষণ মনকষ্টে দিন পার করছে। যে যা বলেছে তারা তাই করেছে, কিন্তু তার পরেও বাচ্চা হয়ে মারা যাচ্ছে। বাচ্চা না হলে একটা কষ্ট ছিল। কিন্তু হওয়ার পরে এতটুকু বাচ্চাদের চলে যাওয়ার যন্ত্রণা তারা সহ্য করতে পারছে না। জনের কথা শুনে মুরুব্বির খুব মায়া হলো। এক মুহূর্ত চিন্তা করে তিনি বললেন, “ আমি জানি ঝামেলাটা কোথায়। আমি তোমাদেরকে এর থেকে উদ্ধার করবো।”

জন ভাবল ডাক্তার, পুরোহিত যেখানে কোনো সাহায্য করতে পারলো না; সেখানে এই মুরুব্বি-ই বা কি করতে পারবে। সে শুকনো হাসি মুখে এনে বলল, “আপনি যদি কিছু করতে পারেন তা হলে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকব।” লোকটা দাম মিটিয়ে চলে গেল। কিন্তু তার কথার রেশটা জনের মধ্যে থেকে গেল। বাড়ি যেয়ে স্ত্রীকে জানাল যে একজন রহস্যময়ী বয়স্ক মানুষ বলেছেন যে তিনি আমাদেরকে এই সমস্যা উদ্ধার করবেন। স্ত্রী এ রকম আশ্বাসের কথা আগেও অনেকবার শুনেছে, তাই সে এ ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না।

জন পুরো বিষয়টা মাথার থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলো না। পাশের গলিতে যেয়ে বেশ কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করল, কয়েকজনের কাছে লোকটার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইলো; কিন্তু কেউ হদিস দিতে পারল না। এর মধ্যে দেখতে দেখতে এক মাস দু মাস করে তিন মাস পার হয়ে গেল। মিথ্যা আশ্বাস ভেবে মাথার থেকে বিষয়টা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। প্রায় ছয় মাসের মাথায় লোকটার দেখা মিলল। তবে এইবার তিনি দিনের শেষে না; সেলুনের প্রথম কাস্টমার হলেন। জন উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এলো। কিন্তু মনে হলো লোকটা যে কোনো কথা দিয়ে গেছে সেটা সে বেমালুম ভুলে গেছে।

চুল, দাড়ি কামানোর পর তিনি তার দাম মিটালেন। তারপরে সাথের ব্যাগ থেকে ছোট একটা প্যাকেট বের করে জনকে দিয়ে বললেন, “তোমার পরিবারের উপর ডেভিলের (শয়তানের) কু-দৃষ্টি আছে। সেই তোমার বাচ্চা মেরে ফেলে। এই প্যাকেটে এক পুতুল আছে। আমি নিজের হাতে সেটা বানিয়েছি। এইটা তোমার পরবর্তী শিশুর সব সময়ে সাথে সাথে রাখবে। ডেভিল কাছা কাছি এলেই এই পুতুল জীবন্ত হয়ে ওকে রক্ষা করবে। তবে সেটা শুধু তোমার প্রথম ছেলের জন্যে কাজ করবে। পুত্রের বয়স দশ হওয়া পর্যন্ত যাতে এর ব্যতিক্রম না হয়। এই পুতুল কাছে না থাকলে যেনো তোমার সন্তানের নির্ঘাত মৃত্যু হবে। এই পুতুল যাতে তোমার বংশ পরম্পরায় মানে প্রন্মের পর প্রজন্ম পুত্র সন্তানদের ধশ বছর বয়স পর্যন্ত একে বারে পাশে পাশে রাখা হয়। এইভাবে যেন চলতে থাকে। আবার বলি পুতুলটা সাথে না থাকলে ডেভিল তোমার বংশের ছেলে শিশুদের মেরে ফেলবে।”

জন এই কথাগুলোর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানতে চাইলো, “আপনার সাথে আবার কবে দেখা হবে? আর আপনার পরিচয়টাই বা কি?” ভদ্রলোক কেমন একটা হাসি দিয়ে বললেন, “আমি ওই পারের।” জন ঠিক বুঝল না এইটা আবার কি ধরণের উত্তর। তবে এতটুকু স্পষ্ট বুঝল মুরুব্বি কোনো রসিকতা করছেন না। ৬

পুতুল টম কথা বলে চলেছে এবং রিকি ও তার মা রিনি মন দিয়ে কথা শুনে চলেছে।

টম আবার মুখ খুলল, “এর পরে অবশ্য গল্পের বেশি বাকি নাই। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটই ছিলেন সেলুনের মালিক জনের জীবিত পুত্র সন্তান। তিনি যখন আবিষ্কার করলেন, তার সখিনার থেকে তার একজন পুত্র সন্তান হয়েছে; তখনই তার নিজের বাবার সাবধান বাণীর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলে গিয়েছিলেন ছেলে হলে দশ বছর বয়স পর্যন্ত টম মানে আমাকে পুত্র সন্তানের সাথে রাখতে হবে। তিনি আমাকে স্যামের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু রতন মিয়া বিষয়টার গুরুত্ব ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি। ডেভিল সুযোগ-মত পেয়ে স্যামকে কুয়ার মধ্যে ফেলে দেয়।

এইবার রিনি মুখ খুললেন, “এই পুরনো কাহিনী আমাদের বলে তোমার কি লাভ? তা ছাড়া এই ঘটনা তুমি এত দিনেও অন্যদের বল নি কেনো?” টম উত্তর দেয়া আরম্ভ করলো, “ যারা ওইপার থেকে আসে তারা এই পৃথিবীর সবার সাথে কথা বলতে পারে না। শুধুমাত্র নির্ধারিত সামান্য সংখ্যক মানুষদের সাথেই সেটা করতে পারে। তাদের আমরা বলি মিডিয়া। প্রায় একশত বছর অপেক্ষা করার পর আমি একসাথে দু জন মিডিয়া পেলাম। এরা হলো তোমরা দু জন।” 

টম এবার একটু থেমে নিয়ে আবার বলতে লাগল, “এইবার বলি তোমাদের বিষয়টা বলার কারণ। স্যামের শরীর কুয়ার মধ্যে আটকে আছে। ওর আত্মা শরীরকে ছেড়ে যেতে পারছে না। তাকে বের করে তোমরা কবর দিও। সাথে আমাকেও মাটি চাপা দিবে। না হলে আমরা ওই পাড়ে যেতো পারব না।”

(রচনাকালঃ ২০১৯)