করোনার উল্লাস মঞ্চ আমার পৃথিবী না

ছোবল শব্দটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। অভিধান অনুযায়ী শব্দটার অর্থ নখ বা দাঁত দিয়ে আক্রমণ। প্রতিশব্দ হিসেবে ‘দংশন’কে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কথাটার সাথেআরও কয়েকটা শব্দ নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে খেলে যায়, ‘সাপের ছোবল’, ‘কালো নাগিনীর ছোবল’। এইবার যদি জানতে চাওয়া হয় মরণ ছোবল বলতে কি বুঝায়? তা হলে মুহূর্তেই মাথার মধ্যে খেলে যাবে, নিঃশেষ হয়ে যাবার আগে অবশিষ্ট শক্তি ব্যবহার করে চূড়ান্ত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত আঘাতটাই মরণ ছোবল।

বিষধর সাপের থেকে বেশি শক্তি নিয়ে এক মহামারী আজ সারা পৃথিবীকে পর্যুদস্ত করে চলেছে। একের পর এক মানুষকে অসুস্থ করছে; অনেককে পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। প্রচুর মানুষ কর্ম হীন হয়ে পড়েছে। খাদ্য ও সরবরাহের সংকট হচ্ছে। দুটো বিশ্ব যুদ্ধের থেকেও বিশ্ব আরও বড় হুমকির সম্মুখীন। মানব সভ্যতা এই ছোবলের কতটুকু ক্ষতি সামাল দিতে পারবে? আবার কতো দিনে আগের মতো মাথা তুলে দাঁড়াবে? উত্তরটা একমাত্র ভবিষ্যতের কাছেই আছে। তবে আশার কথা বেশ কয়েকটা ভ্যাকসিনের ব্যবহার ইতিমধ্যে আরম্ভ হয়েছে। যদিও পৃথিবীর সব প্রান্তে এই ওষুধ পৌঁছতে বেশ কিছু সময় লাগবে। এর পর জানা যাবে মানব জাতির করোনা ভাইরাসকে নির্মূল করতে আর কত দিনের প্রয়োজন।

এই করোনা ভাইরাস আমাদের সবাইকে একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কারভাবেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা যতই উন্নত প্রযুক্তির অহমিকায় ভুগি না কেনো, দম্ভ নিয়ে অন্যকে পরাস্ত করার নিত্য নতুন পন্থা আবিষ্কার করি না কেনো; আমরা এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের বিপরীতে একেবারেই অসহায়! এইতো মাত্র কয়েকদিন আগেই মঙ্গল গ্রহে মানুষের কলোনি গড়ে তুলার নানা পরিকল্পনা করছিল। আর এখন কি-না নিজেকেইনিজের বসতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হচ্ছে। এই ভাইরাস কাউকেই কেয়ার করেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশের প্রেসিডেন্টকেও ছাড় দেয়নি। তবে সব মাথা এক হলে, মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। মাত্র এক বছরের মাথায় একাধিক ভ্যাক্সিন চলে এসেছে।

যারা আমার লেখা পড়েন, তারা জানতে চান ইদানীং আমার লেখা দেখা যাচ্ছে না কেন। আসলে আজকে দীর্ঘদিন হলো মনটাকে স্থির করে লেখালেখিতে বসাতে পারছি না। গত এক বছর ধরে করোনার তাণ্ডব চলছে। আমি শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়নি; কিন্তু অন্তরটা একেবারে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছে। এখন সম্ভবত এমন মানুষ পাওয়া কঠিন যার কোনো প্রিয় কিংবা পরিচিতজন এই রোগে আক্রান্ত হয়নি। এই নির্মম ভাইরাস বিশ্ব ও বাংলাদেশের কত না বরেণ্য মানুষকে ছিনিয়ে নিয়েছে, তা লিপিবদ্ধ করলে বিশাল বড় একটা তালিকা হয়তো হয়ে যাবে। এই কোভিড কিংবদন্তী বাঙালি অভিনেতা ও আবৃত্তিকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট এবং ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মুর্তজা বশীর, বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানীকে আমাদের মাঝ থেকে নিয়েছে।

সুমনা নামের মেয়েটা ভীষণ সুন্দর মনের অধিকারী ছিল। সব সময়ে হাসিমুখে সবাইকে আপ্যায়ন করার মধ্যেই ছিল তার সন্তুষ্টি। আমার শ্যালিকা রচনার সাথে ভারতেশ্বরী হোমসে পড়ত। সে নিজেকেও আমার ছোট বোন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আরও হাজারও গুণের মধ্যে তার একটা বিশাল উদারতা আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। আমার লেখার ছিল সে একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। একবার সে আমাকে বলেছিল, মন খারাপ থাকলে সে আমার লেখা পড়ে। একজন লেখক হিসেবে সেটা ছিল আমার জন্যে এক দারুণ পাওয়া। মেয়েটা কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি হলো, তখন মেলা দেরী হয়ে গেছে। ফুসফুস ১০০% ভাগই তখন নষ্ট। বেশ কিছু দিন লাইফ সাপোর্টে ছিল। আশা করছিলাম অলৌকিক কিছু যদি ঘটে! না তেমন কিছু হয়নি। ‘সুমনা নামের মেয়েটা’ অকালেই চলে গেল। ওর স্বামী হীরু ভাইও একই কারণে লাইফ সাপোর্টে ছিল। আরও ২২ দিন পর সেও সুমনাকে অনুসরণ করল। তাদের দু সন্তানকে কি বলে সান্ত্বনা দেয়া যায়, সেটা আমার মাথায় কোনোভাবেই আসছে না!

আমি জানি করোনা ভাইরাসের বদৌলতে সবারই এ ধরণের কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। যারা কোরোনাকে পরাস্থ করতে পেরেছে, তাদের জন্যও সমবেদনা জানাতেই হয়। কলি ক্যানাডা থাকে। সে অসুস্থ, কিন্তু একেবারে দমে যায়নি। তার অভিজ্ঞতা কি সুন্দর করে না লিপিবদ্ধ করেছে; ফেসবুকে নিয়মিত ছাপাচ্ছে। ঢাকায় থাকে নাসরীন। সে একজন সাংবাদিক ও সাহিত্যানুরাগী। পরিচয় অল্পদিনের হলেও তার বিশাল হৃদয়ের পরিচয় ইতিমধ্যে পেয়েছি। বেচারিকে ভাইরাসটা খুব কষ্ট দিয়েছে। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ছিল। তবে এখন ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। বড় ভাই-ভাবী বনানীতে থাকে। গত একমাস ধরে ভুগছে। ছোট বেলার বন্ধু আব্দুল্লাহ কবির লিটন। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থেকে এখন বাসায় ফিরে এসেছে। এদের জন্য যে কি পরিমাণ উদ্বিগ্ন থাকতে হয়েছে, সেটা বুঝিয়ে বলাটা কঠিন। ভাইরাসে সরাসরি আক্রান্ত না হয়েও এটা সহ্য করাটা ভীষণ কষ্টের।

লেখাটা আরম্ভ করেছিলাম ‘মরণ ছোবল’ কথাটা উল্লেখ করে। করোনা ভাইরাস ভালো করেই বুঝতে পেরেছে, এখন তার অন্তিম সময়। সে মরণ ছোবল হানছে। হাসপাতালে রুগী নেয়ার আর জায়গা নাই। নিয়ম-নীতি ও স্বাস্থ্য বিধিতে যা বলা হয়েছে সেখান থেকে এখনই সরে আসাটা একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ না। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে আমার আর কাউকে হারাতে চাই না। শেষে একটা কথা সবিনয়ে বলতে চাই। করোনা ভাইরাসের পর পৃথিবীতে আবারও অন্য কোনো পরাক্রমশালী ভাইরাস যে আসবে না; সেই কথা কেউ কিন্তু কখনই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। এইবারের শিক্ষা আশা করি মানব জাতি ভবিষ্যতে কাজে লাগাবে।

আমাদের জীবদ্দশায় এতো অল্প সময়ের এতো মৃত্যুর খবর আগে কখনও আসেনি। মৃত্যুর মিছিল চলছে তো চলছেই। কিন্তু আমরা ভাইরাসের কাছে পরাস্থ হয়েছে এমন মৃত্যুর সংবাদ আর চাই না। চেনা পৃথিবীটা একেবারে অচেনা হয়ে গেছে। আমরা আমাদের চেনা দেশটাকে, চেনা পৃথিবীটাকে ফিরে পেতে চাই। কবিতার মূল বিষয়বস্তু একেবারে এক না হলেও, কবি নবারুন ভট্টাচার্য থেকে কয়েকটা লাইন ধার করে বলতে চাইঃ

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না

এই জল্লাদের (ভাইরাসের) উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না

এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না