অপেক্ষায় আছি...
বাস স্ট্যান্ড, গাইনি ওয়ার্ডের ওয়েটিং রুম, চাকরির ইন্টার্ভিউয়ের পর ক্যান্ডিডেটের মানসিক অবস্থা।
একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতির তিন ধরণের পরিবেশ। আচ্ছা বলুন-তো, এই তিন পরিবেশের মধ্যে কি কোনো মিল আছে? প্রশ্নটা শুনে অবাক হবেন হয়তো। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, একটা মিল কিন্তু তিন ক্ষেত্রেই আছে। বাস স্ট্যান্ডে যাত্রীরা তীর্থের কাকের মত বসে আছে, কখন বাস আসবে কিংবা ছাড়বে। গাইনি ওয়ার্ডের ওয়েটিং রুমে হবু বাবা, আত্মীয়স্বজন উদগ্রীব হয়ে থাকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুসংবাদের আশায়। ইন্টার্ভিউয়ের পর ক্যান্ডিডেটের মনে প্রাণে কামনা চাকরির অফারটা যেন আসে।
এই তিন ক্ষেত্রেই অপেক্ষা করার বিষয়টা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে ফেলেছেন। বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা, গাইনি ওয়ার্ডের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা, চাকরির ইন্টার্ভিউয়ের পরে অপেক্ষা। এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় না। টিকেট কেনার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা, সন্তান বড় হওয়ার জন্যে অপেক্ষা, একটা ভাল সংবাদের জন্যে অপেক্ষা। আমাদের জীবনের সাথে ওষ্ঠে-পৃষ্ঠে মিশে আছে অপেক্ষা। আমরা চাই বা না চাই, অপেক্ষা আমাদের করতে-ই হয়।
গুরুজনদের থেকে আমরা সবাই শুনেছি, সবুরে মেওয়া ফলে। কথাটার ভাব সম্প্রসারণ করলে, বিষয়টা এমন দাঁড়ায় আমরা যাতে অপেক্ষার খেলায় রণভঙ্গ না দেই। বাংলা ভাষায় ‘সবুর’ শব্দটার একটা সুন্দর প্রতিশব্দ আছে: ধৈর্য। সবুর বা ধৈর্যের উপকারিতা বিষয়ক উদাহরণের কিন্তু কোন অভাব নাই।
স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস বারে বারে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে যুদ্ধে হারছিলেন। একবার তিনি ভীষণ মন খারাপ করে এক গুহায় আশ্রয় নিলেন। মনে হচ্ছিল তার ভাগ্যে জয় নাই। তিনি ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলেন, এক মাকড়শা জাল বুনছে। মাকড়শা পর পর ৬ বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। কিন্তু সপ্তম বারে ঠিকই সে সফল হল। রবার্ট ব্রুস নতুন করে অনুপ্রাণিত হলেন। তিনি আরও কয়েকবার চেষ্টা করার পর বিজয়ী হলেন। অবশেষে তিনি ইংল্যান্ডের রাজাকে পরাজিত করতে সমর্থ হলেন। রবার্ট ব্রুসের বিজয়ের পেছনে অধ্যবসায় এবং চেষ্টার সাথে যোগ হয়েছিল অপেক্ষা। তিনি ঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন বলেই, শেষ পর্যন্ত সফলতার মধুর স্বাদ পেয়েছিলেন। অপেক্ষা না করলে তাকে ইতিহাসের আস্থা কুঁড়ে হারিয়ে যেতে হতো।
এক কথা থেকে তো আরেক কথা চলেই আসে। কাজ আরম্ভ করার সঠিক সময় বুঝতে পারেন না বলে, কিছু মানুষ কাজ থেকেই দূরে থাকেন। সেটাকে আমরা অলস মানুষের অপেক্ষা বলতে পারি। এই ধরণের অপেক্ষার আরম্ভ থাকলেও শেষ নাই। রুশ দেশের বিখ্যাত লেখক লিও তলস্তয়, ‘থ্রি কোশ্চেন’ গল্পে দেখিয়েছেন, কোন কিছু আরম্ভ করার শ্রেষ্ঠ সময় হলো এখন মানে এই মুহূর্ত। তার জন্যে অপেক্ষা করার কোনই দরকার নাই।
যাই হোক ফিরে আসি, যে কথা দিয়ে লেখা আরম্ভ করেছিল। এক অপেক্ষা থেকে আরেক অপেক্ষা তৈরি হয়, তার পরে আবার আরেকটা। এইভাবে চলতে থাকে অপেক্ষা পর অপেক্ষা, আরও অপেক্ষা। ওই যে বলছিলাম গাইনি ওয়ার্ডের ওয়েটিং রুমের কথা। প্রথমে বাবার অপেক্ষা ছিল কখন বাচ্চা হবে, তারপরে কখন স্কুলে যাবে, চাকরি করবে, বিয়ে করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিষয়টা অনেকটা আমরা যেন অন্তহীন অপেক্ষার বৃত্তে সারাটা জীবন ঘুরতেই থাকি !
প্রেম যারা করে, তারা হাড়ে হাড়ে জানে অপেক্ষা করার অম্ল স্বাদ কেমন! কখন প্রেমিকার সাথে দেখা হবে, কখন মান ভাঙবে, কখন মিলন হবে। সব কিছুর জন্যে মনে হয় শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কোনো এক কবি একবার ক্ষোভ করে বলেছিলেন, অপেক্ষা করতে করতে গাছ হয়ে যাব। আক্ষেপের বিষয় হল গাছ হওয়ার সৌভাগ্য অনেকেরই হয় না। অপেক্ষা করতে করতে পথ যায় বেঁকে, ভালোবাসা যায় হারিয়ে!
এক ব্যক্তি ওজন কমানোর জন্য বহুদিন অপেক্ষা করলেন। কিন্তু কোন পরিবর্তন না দেখে, ডাক্তারের কাছে যেয়ে জানতে চাইলেন, ওজন কমানোর জন্যে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে। ডাক্তার সাহেব জানতে চাইলেন, তিনি স্বাস্থ্যকর খাওয়া দাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করছেন কি-না। ভদ্রলোক জানালেন, এই দুটো জিনিষ বাদ দিয়ে তিনি বাকী সব কিছুই করছেন। উত্তর শুনে ডাক্তার সাহেব তো একেবারে থ। বেচারা স্থুলকার ভদ্রলোক বুঝলেন না, একনিষ্ঠ চেষ্টা না থাকলে, কিছু ত্যাগ স্বীকার না করলে সারা জীবন অপেক্ষা করলেও লক্ষ্যে পৌঁছান যায় না।
বিখ্যাত ফরাসি লেখক ভলটেয়ার লিখেছিলেন, “আমরা কখনো বাস করি না, আমরা সারাক্ষণ বসবাসের আশায় থাকি” ( We never live; we are always in the expectation of living---Voltaire)। তার মতে, আমরা সারাটা জীবন অপেক্ষার মধ্যেই থেকে যাই। মার্কিন উপন্যাসিক ড্যানিয়েল হ্যান্ডলার Daniel Handler, তার The Ersatz Elevato লেখায় Violet নামের এক চরিত্র অন্যদের বলেছিল, “আমিও প্রস্তুত না, তবে আরও অপেক্ষা করলে আমাদের বাকী জীবন অপেক্ষা করতে হবে।” বুঝতেই পারছেন বন্ধুরা অবহেলা, অলসতা করে অপেক্ষায় থাকলে হবে না। অপেক্ষায় পূর্ণ একাগ্রতা না থাকলে চলবে না। কোন কিছুর আরম্ভ করার জন্যে পূর্ণ প্রস্তুত আমরা কখনই হতে পারবো না।
অপেক্ষা শুধু আমাদের নিজেকে নিয়েই সীমাবদ্ধ না। সমাজ, দেশ, বিশ্বকে নিয়ে আমাদের অপেক্ষা আর কত না আশা। একদিন দুর্নীতি-হীন ও যৌক্তিক বাঙালি সমাজ হবে, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হবে, বিশ্ব থেকে সব ধরণের হানাহানি উঠে যাবে, ভীষণ সুন্দর একটা দিন আসবে, করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন আসবে! প্রশ্ন হলো এই জন্যে আমরা কি কিছু করছি? না-কি স্থূলকায় সেই মানুষটার মত হাত পা গুটিয়ে বসে বসে আছি। অপেক্ষায় আছি, সব কিছু এমনিতেই হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা তো স্পষ্ট জানি, চেষ্টা ছাড়া অপেক্ষা; অপেক্ষা হয়েই থাকবে। তা হলে আমরা বিখ্যাত সেই ইংরেজি কথাটা “what are you waiting for? কিসের জন্যে অপেক্ষা করছো?” কিভাবে ভুলে থাকছি?? কাজে কেন ঝাঁপিয়ে পড়ছি না ???
অপেক্ষা করতে করতেই একদিন আমরা অপেক্ষা বিহীন জগতে যেয়ে পৌঁছে যাব। এখন নাম না জানা এক কবির কবিতার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে না হয় বিষয়টা তুলে ধরি। তিনি লিখেছিলেন:
“Waiting for a phone call, একটা ফোন কলের জন্যে অপেক্ষা,
Waiting for a text message, একটা টেক্সট ম্যাসেজের জন্যে অপেক্ষা,
Waiting for a visit, একটা ভ্রমণের জন্যে অপেক্ষা
Waiting for a time, এমন একটা সময়ের জন্যে অপেক্ষা,
When I no longer have to wait. যখন আমাকে আর অপেক্ষা করতে হবে না”।