ছোট্ট মাহিবার গল্প
এইবার বাংলাদেশ সফরে বয়সে ছোট কিন্তু ভালোবাসায় বিশাল এমন একজনের সংস্পর্শে এসেছিলাম। ক্লাস সিক্সের মেয়েটার নাম মাহিবা। আমার শ্যালক কনকের ছোট মেয়ে। সে যতক্ষণ পেরেছে আমার সাথে সাথে থেকেছে; ঘুম চোখে রাত জেগে আড্ডা দিয়েছে. আর আমার প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। আমিও চেষ্টা করেছি তার কথা শুনতে, তার প্রশ্নের উত্তর দিতে। মনে হয়েছিল, ছোট হলেও সে বড়দের কাছ থেকে এটেনশান আর ‘সময়’ চায়। আমি সেই চেষ্টা করেছি বলেই হয়তো আমার পাশে থাকতে সে উদগ্রীব থাকতো। শুধু তাই না আমার সুবিধা-অসুবিধা, প্রয়োজনের দিকে ছিল তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কত বার এসে জেনে যেতো আমার কিছু লাগবে কি-না। এর মধ্যে সে ঘোষণা করলো আমি ঠিক তার বন্ধুর মতো। কেউ বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে সেটা তো আর প্রত্যাখান কড়া যায় না। অসম বয়সের দুজন আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।
মাহিবা প্রচুর উৎসাহ নিয়ে আমার সাথে কয়েকটা জায়গায় বেরাতে গিয়েছিল। মাহিবা ও তার বাবা-মা’কে সঙ্গে নিয়ে এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় প্রিয় বান্ধবী রুচির বাসায় হাজির হলাম। ইচ্ছা হলো বাংলাদেশের বৃষ্টির ছোঁয়া পেতে, বৃষ্টিতে ভিজতে, বৃষ্টিকে অনুভব করতে। যা ভাবা সেই কাজ. রুচির বাসার ছাদে গেলাম। ততক্ষণে মুষলধারের বৃষ্টি কমে টিপি টিপি করে পড়ছে। আমরা খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালাম। ওর আনন্দ দেখে আমার ভালো লাগা হাজারগুণ বেড়ে গেল। এই মেয়ে কি দারুণ ভাবেই না ভালোবাসার অদ্ভুত সুন্দর ভুবন তৈরি করতে এবং ছড়িয়ে দিতে পারে!
দশ দিনের সফরে খুবই অল্প সময় মাহিবার সাথে কাটাতে পেরেছিলাম। হাতে নিয়ে গিয়েছিলাম মেলা কাজ এবং দেখা করতে হয়েছিল বেশ কিছু প্রিয় মুখের সাথে। যেদিন আমার এমেরিকার ফিরতি ফ্লাইট, সেদিন সকালে মাহিবা ওর বাবা-মা’র নিয়ে আমার সাথে বিদায়ের দেখা করতে এলো। তখন আমার প্রচণ্ড ব্যস্ততা। শেষ মুহূর্তে গোছানো, এটা-সেটা কেনা-কাটা, এবং অন্য সবার থেকে বিদায় নেবার পর্ব চলছিল। হাজার ইচ্ছা থাকলেও আমার ছোট মা মণিটাকে একেবারেই সময় দিতে পারলাম না। আমার এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠার ঠিক আগের মুহূর্তে ছোট্ট পরীটা কান্না ভেজা চোখে বলল, "ফুফা পরের বার দেশে আসলে সাথে কিন্তু কোন কাজ এনো না।”
ছোট মেয়েটা যদি জানতো এক গাদা কাজ নিয়েই যে আমাকে দেশে আসতে হয়। যদি বেঁচে থাকি এবং কর্ম থেকে অবসরে যাওয়ার সুযোগ হয়; তখন হয়তো হাতে অখণ্ড সময় থাকবে। কিন্তু তখন ছোট পরীটার কাছে কি আমার জন্যে এখনকার মতো সময় থাকবে? সে বড় হচ্ছে, কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হচ্ছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার আগ্রহ ও ভালোলাগা বদলাবে। আমার বর্তমান জগতের মতো তার ভবিষ্যৎ জীবনও ভরে উঠবে শত ধরণের ব্যস্ততায়। তখন আমাকে আলাদা করে সময় দেয়াটা ওর জন্য কঠিন হবে। কিংবা এখানকার আমার জন্যে যে অনুভূতি আছে সেটা হয়তো অন্য ধারায় চলে যাবে।
আসলে ‘সময়’ জিনিসটা হলো ভীষণ নির্মম। প্রকৃতির নিয়মে সে বয়েই চলে। অবিরাম বদলে দিচ্ছে সব-কিছু। কি জানি কথাটা, “সময় আমাকে দিলো নাকো সময়”; হয়তো তাই। যখন যতটুকু ও যেভাবে আমাদের সময়ের প্রয়োজন, মনে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেভাবে সময় ধরা দেয় না।
আমার জানা নাই ‘সময়’ ‘র এই অনন্ত বদলে দেয়া থেকে আমরা কতটুকু সু-বিচার পাই!
মে ২, ২০১৮
কাজী হাসান
প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com