মৃত্যু কি?
করোনা ভাইরাসে সুবাদে সারা বিশ্বে বলতে গেলে মৃত্যুর মিছিল চলছে। অনেকেরই চেনা জানা প্রিয় জন এই ভাইরাসের ছোবলে প্রাণ হারিয়েছেন। বাকীরা সংবাদ থেকে জেনে নিচ্ছেন পৃথিবীর কোন দেশে এ পর্যন্ত কি পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এই মুহূর্তে বলতে গেলে সবারই এই চিন্তা, করোনার শেষ কোথায়? কতো দিনে এই মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার ওষুধ বের হবে কিংবা কতো দিনে প্রতিষেধক বাজারে আসবে? ওষুধ আসার আগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কি দশা হবে? মৃত্যু হয়ে যাবে না-তো? মৃত্যুই যদি হয়ে যায়, তা হলে সেই সময়টা আমাদের কি পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে?
বিশ্বাসীদের কাছে জন্ম ও মৃত্যু দুটোই পরম করুণাময় নির্ধারিত। মৃত্যু আমাদের অবধারিত। তবে আমাদের কারোরই জানা নাই সেটা কখন হবে এবং এর প্রকৃত রূপটাই বা কি। মৃত্যু হওয়ার সময়টাতে কি আমরা অজানা জগতে যাত্রার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠবো, না কি অনাবিল শান্তির ভুবনে যাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হবো? মৃত্যু কি আমাদের জীবনের সমাপ্তি, না-কি শুধু আমাদের এক জগত থেকে আরেক জগতে স্থানান্তর?। আসুন ইসলাম ধর্মের আলোকে বিষয়টাকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করি, ইনশা আল্লাহ।
হাদিসে (মুসলিম শরীফ) বর্ণিত আছে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলেছেন, “পৃথিবীতে একজন আগন্তুক বা মুসাফিরের মতো জীবন যাপন করো।" মুসাফির শব্দটাকে সহজ অর্থে আমরা বলতে পারি, ভ্রমণকারী। যিনি এক জায়গা থাকে আরেক জায়গা যাচ্ছেন, তার চূড়ান্ত গন্তব্যকে লক্ষ্য করে। ইসলাম ধর্ম মোতাবেক আমরা এই পৃথিবীতে পথ চলে আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীতে এই ক্ষণিকের পথ চলার উপর নির্ভর করছে, আমাদের বাকী বিশাল পথ চলার পরিণতি।
আপনি যদি কাউকে বলেন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন সেটা আপনি জানেন না এবং কোথায় যাবেন তাও আপনার জানা নাই; তা হলে যেই লোক এই কথা শুনছেন তার অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের সামগ্রিক জীবনের সাথে এর একটা বড় ধরণের মিল পাওয়া যাবে। আমরা জন্মের আগে কোথায় ছিলাম, আর মৃত্যুর পরে কোথায় যাবো, তা আমাদের অনেকেরই অজানা। এখন আমরা একটু খুঁটিয়ে দেখি, আমাদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ আল কুরআন বিষয়টা নিয়ে কি বলছে।
কুরআন শরীফে বেশ অনেকবার মৃত্যুর ব্যাপারে বলা আছে। সুরা আল আনবিয়া (২১: ৩৫) য়, আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন বলছেন, “প্রতিটি আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে, আর আমি তোমাদের খারাপ আর ভাল দিয়ে পরীক্ষা করি। তোমরা আমার কাছে অবশ্যই ফিরে আসবে।” কোরান শরীফের এই উদ্ধৃতি থেকে মৃত্যু ছাড়া আরেকটা বিষয় চলে আসছে। আমরা আল্লাহ’র কাছ থেকে এসেছি আর আমরা তার কাছেই ফিরে যাবো।
পিতা মাতা কে হবে আর গোত্র, বর্ণ কি কবে, তা আল্লাহ তা’ লা আমাদের জন্যে নির্ধারণ করে দেন। সুরা আল ইমরানে (৩: ৬) আছে, আল্লাহ তার ইচ্ছা মতো আমাদের আকার দিয়ে মায়ের গর্ভে স্থাপন করেন। সুরা ইয়াসিনে (৩৯: ৬৮) বলা হচ্ছে, ইসরাফিল ফেরেশতা শিঙ্গা বাজান আরম্ভ করলে, হাশরের দিন এসে উপস্থিত হবে। তখন প্রতিটা আত্মা তাদের শরীরে ফিরে আসবে। সকল মানুষ তখন পুনরুজ্জীবিত হবে। তার পরে প্রত্যেককে মহান সৃষ্টি কর্তার সামনে দাঁড়াতে হবে।
প্রত্যেককে তখন ইহ জগতে তাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কৃত কর্মের রেকর্ডের বই দেয়া হবে। সেখানে মানুষের সামান্যতম ঘটনাও লিপিবদ্ধ থাকবে। সুরা আল ইনশিকাক (৮৪: ৭--৯) অনুযায়ী, ডান হাতে যারা এই বইগুলো পাবে তারা আনন্দের আত্মহারা হয়ে উঠবে; আর যারা বাম হাতে পাবে তাদের মুখ আতঙ্কে আর ভয়ে ম্লান হয়ে উঠবে। তারা পৃথিবীতে ফিরে যেয়ে আবার নতুন করে জীবন কাটানোর জন্যে কান্নাকাটি করবে।
কুরআন শরীফে বেশ অনেক বার বলা হয়েছে, বিচার শেষে আল্লাহ তা’লা বান্দাদের বেহেশত অথবা দোজখে পাঠাবেন। যারা বেহেশতে যাবেন, তাদের জন্যে থাকবে খুবই আরামদায়ক সুখকর জীবন। আর যারা পৃথিবীতে আল্লাহ’র নির্দেশ অমান্য করেছিল, তাদেরকে যেতে হবে ভীষণ কষ্টকর দোজখে। পরম করুণাময় আল্লাহ তা আলা বলেছেন, শেষ বিচারের দিনে কারোর বিরুদ্ধে বিন্দু মাত্র অবিচার করা হবে না। মুমিন বান্দারা ভালো কাজের জন্যে পুরস্কৃত হয়ে বেহেশতে যাবেন, আর পাপীরা তাদের শাস্তি পাবে দোজখের কষ্ট-বেদনায়।
উপরের আলোচনা থেকে এটা মোটামুটি বলা যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের বৃহত্তর জীবনকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়: ১) মাতৃ গর্ভে আসার আগে মহান সৃষ্টি কর্তার আছে আমাদের অবস্থান, ২) মাতৃ গর্ভে আমাদের দশ মাসের আবাস, ৩) পৃথিবীর বুকে আমাদের জীবনযাপন, ৪) মৃত্যু ও পুনরুজ্জীবনের মধ্যকার জীবন এবং সর্ব শেষে ৫) পুনরুজ্জীবন থেকে আরম্ভ করে শেষ বিচার ও তার পরবর্তী বেহেশত অথবা দোজখের জীবন।
শেষ বিচারের পরে আমরা আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যে পোঁছাব। এর পরে সেখানে আমাদের পথ চলা বন্ধ হবে। আরম্ভ হবে অনন্ত জীবন, যার কোন শেষ থাকবে না। বর্তমানে আমাদের অবস্থান ৩ নম্বর পর্যায়ে। আমরা পৃথিবীর বুক ধরে এগিয়ে যাচ্ছি, পরবর্তী পর্যায়ের দিকে, যা হলো মৃত্যু। এটা আমরা ইতিমধ্যেই জানি, আমরা আমাদের বর্তমান কর্মকাণ্ডের উপরেই নির্ভর করছে আমাদের বৃহত্তর জীবনের পর্যায় ৪ ও ৫।
যেই ছাত্র সারা বছর নিয়মিত পড়ালেখা করেছে, তার কাছে পরীক্ষা কোনো ভয়ের ব্যাপার না। সে রকম, যাত্রা পথের পর্যায় ৪ ও ৫ ‘র জন্যে যারা প্রস্তুতি নিয়েছে, তাদের জন্যে মৃত্যু কিংবা শেষ বিচারের দিন ও তার পরবর্তী জীবন কোন আতঙ্কের কারণ হতে পারে না। বরং তা তাদের খুশী হওয়ার কারণ হতে পারে, যে তারা আল্লাহ’র সান্নিধ্য পাওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।
কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পরের জীবনই আসল ও সত্যিকার জীবন। এই পৃথিবীর জীবনকে বলা হয়েছে মরীচিকার কৃত্রিম জীবন। এই জীবন খুবই অল্প সময়ের। কিন্তু এই অল্প সময়ের মাহাত্ম্য অনেক। এই সময় সঠিক ব্যাবহার করতে পারলেই আমাদের বাকি পথ চলাটুকু নির্বিঘ্ন হতে পারে।
শেষে সুরা আল বাকারা (২: ২৮৫) থেকে দুটো লাইন উদ্ধৃত করে, আজকের আলোচনা শেষ করছি, “আমরা শুনি ও মান্য করি। আমাদের ক্ষমা করুন প্রভু। আপনার কাছেই আমাদের যাত্রার সমাপ্তি”।