আমি বাংলায় গান গাই

"তুই" বাংলা ভাষার একটা অনবদ্য ও অতুলনীয় শব্দ। একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে যাকে ভালোবাসা যায়, তাকেই শুধু তুই বলে ডাকা যায়। অবশ্য কিছু মানুষ এই শব্দটাকে তুচ্ছার্থে ব্যবহার করলেও, তুই র একটা অন্য রকম বিশেষ আবেদন আছে। আপনি হলো সম্মানের, তুমি হলো সাধারণ সম্বোধনের। আর তুই হলো একান্ত ভালোবাসার। একমাত্র খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথবা খুবই প্রিয় মানুষরা এই পদবি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।

আমার যে জীবন সঙ্গিনী তার সাথে আমার পরিচয় যুগ যুগান্তরের। হৃদয়ের সবটা নিংড়ে দিয়ে একে অপরকে তুই বলতাম। কিন্তু বিয়ের পরে পরিবার থেকে আপত্তি এলো, স্বামীকে তুই বলা যাবে না। যাই হোক, তুই পরবর্তীতে তুমি হয়ে গেল। অবশ্য এর সাথে সাথে একটা বাড়তি উপহারও আসল। আমার সঙ্গিনীর থেকে নতুন একটা নাম পেলাম, "ওগো"। সম্ভবত শব্দটা হাজার বছরের বাঙালী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ফসল। বিবাহিতা বাঙালি নারীর মুখ থেকে তা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বের হয়ে আসে। অন্য ভাষাগুলোতে এর প্রতিশব্দ পাওয়া গেলেও, তুই শব্দের দোসর পাওয়াটা কঠিন।

বাংলা আর বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নাই। ভাষার নামে আর কোনো কি দেশ পৃথিবীতে আছে? হয়তো আরও দু একটা পাওয়া যাবে। কিন্তু ভাষার জন্যে কি আর কোনো জাতি রক্ত দিয়েছে? বাংলা ভাষার জন্যে শুধু বাংলাদেশের বাঙালীরাই রক্ত দেয়নি, আসামের বাঙ্গালীরাও একই কারণে প্রাণ দিয়েছে। এই ভাষায় কি আছে, যে তার অবমাননা হলে মানুষ প্রাণ দিতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না?

যেই ভাষা তার চারিদিকের সবুজ শ্যামল বনানী, নীল আকাশ আর বহমান নদীর মাঝের পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে, যেই ভাষার সাথে তার প্রতিটা মানুষের আত্মার সম্পর্ক, যেই ভাষা তাদের প্রত্যেকটা অনুভূতিকে নির্বিঘ্নে কোমল করে বের করে আনে, যেই ভাষা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর জসিমুদ্দিনের পরিচয়; সেই ভাষার মানুষদের তাদের ভাষার আর তাদের মানচিত্রের অতন্দ্র-রক্ষী হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। সেই শক্তিই তাদের বলীয়ান করেছিল জিন্নাহর মুখের উপর না বলতে, রাজপথকে বুকের তরতাজা রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে বাংলা ভাষাকে তার যোগ্য জায়গায় বসাতে। তারপরে ভাষা আর মানচিত্রের উপর যখন হায়েনার আক্রমণ এসেছে, দ্বিধাহীন বাঙালি তা রুখে দাঁড়িয়েছে। আরও বিশাল ভাবে প্রমাণ করেছে বাংলা আর তার নামের দেশেটার জন্যে তারা যে কোনো মূল্য দিতে সব সময় প্রস্তুত।

এই বাংলা ভাষায় আমার মায়ের আদর, এই বাংলা ভাষায় মাকে মাগো বলে জড়িয়ে ধরা। এই বাংলা ভাষায় আমার প্রিয়াকে তুই বলে কাছে টেনে নেয়া আর এই বাংলা ভাষাতেই আমার প্রিয়ার ওগো বলে সম্ভাষণ। এই বাংলা আমার অস্তিত্ব, আমার বেঁচে থাকার অহংকার। এই বাংলা আমার স্বপ্ন আর বাস্তবের মাধ্যম। এই বাংলা-ই আমার পরিচয়।

এতো প্রচণ্ড ভাবে ভাষা অন্য কোনো জাতির সাথে জড়িয়ে নাই। তার পরে আমাদের কাঁধে আছে, যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন দেশ আর বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি, তাদের রক্তের ঋণ। আমরা আজকে, পৃথিবীর যেখানেই যেই অবস্থানেই থাকি না কেনো, তাদের ত্যাগ ছাড়া আমরা অনেক পিছিয়ে থাকতাম।

বাংলায় কথা বলা, শুধু কথা বলা না একটা সংস্কৃতিকে ধারণ করা। যেই সংস্কৃতিতে সংকীর্ণতা নাই, আছে প্রকৃতির মত বিশালতা। আর আছে মায়ের ভালোবাসা। সমাজ আর দেশের জন্যে সৎ ভাবে জীবন যাপনের অঙ্গীকার। মাকে, প্রেয়সীকে আপন করে না নিলে নিজেকে ভালোবাসা যায় না। বাংলা ভাষা আর তার সংস্কৃতিকে থেকে বিচ্ছিন্ন হলে নিজেকে নিজের শেকড় থেকে যে ছিঁড়ে ফেলা হয়!

যারা ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষা অকারণে ব্যবহার করেন, তাদের মনে যত বড় আত্মতুষ্টি থাকুক না কেন, তারা বাস্তবে নিজেকেই হেয় করছেন। তবে একথা বলা হচ্ছে না, আমরা অন্য ভাষা শিখব না। আমরা নিশ্চিত করব, আমাদের মানুষ যাতে বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে বাংলায় কথা বলে। সময়ের সাথে আমাদের ভাষার বিবর্তন হয়েছে এবং হবে, কিন্তু আমরা আমাদের মৌলিক গুণাবলী যাতে অটুট থাকে। বাংলা ভাষায় কিছু বিদেশী শব্দের অনুপ্রবেশ তারই উদাহরণ। এখানে অকারণ বিতর্ক সৃষ্টির কোনো সুযোগ নাই।

যারা অন্য ভাষার চটকদার কিছু গান, বাজনা রপ্ত করে চটুল কাজ-কর্ম করেন, তাদের বলছি ভেবে দেখুন আরেকবার। আমাদের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করার দায়িত্ব আমার, আপনার সবার। যারা অন্য ভাষার মানুষদের জীবন সঙ্গী করেছেন, তাদেরও একই কথা বলি। আমরা যদি পরের প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়ে না যাই; তা হলে সালাম, বরকত আর ত্রিশ লক্ষ শহীদদের কাছে আমরা কি জবাব দিবো?

বছরের একটা দিন ঘটা করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, ছবি তোলা আর মাস জুড়ে বই মেলা করা কি তাদের ঋণ শোধ করার জন্য যথেষ্ট ?

রচনাকালঃ ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০১১