ক্যামনে হইলো?
শহরে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ হয়তো ডাব গাছ নাও দেখে থাকতে পারে। কিন্তু ডাব দেখতে কেমন সেটা তাদের সবারই জানা। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে হকারদের ডাব বিক্রি করতে দেখা যায়। বিক্রেতারা উপরের দিকটা সমান করে কিছুটা করে কেটে স্ট্র লাগিয়ে দেয়। পিপাসু ক্রেতারা সেখান থেকে চু চু করে টেনে ডাবের পানি পান করে তৃষ্ণা মেটায়। তবে কিছু তরুণ আছে যাদের অতো বেশী ধৈর্য নাই, তারা ডাব কিছুটা হেলিয়ে সরাসরি সেখান থেকেই সুস্বাদু ডাবের সুধা গলায় ঢেলে দেয়। এই কচি সবুজ ডাবের স্থায়িত্ব গাছে কিন্তু খুব বেশী দীর্ঘ হয় না। কিছু দিন অপেক্ষা করলেই সবুজ ডাব পেকে নারিকেল হয়ে যায়। তখন সেই সুন্দর সতেজ সবুজ ডাব কেমন শুকিয়ে চুপসে যায়। ভিতরে শক্ত একটা আবরণ তৈরি হয়। পানির স্বাদটাও আগের মতো সুস্বাদু থেকে না। তখন নারিকেল ভেঙে দ্বি-খণ্ডিত করে ভিতরটা কুড়ে কুড়ে নারিকেলের সাদা অংশটা বের করে আনতে হয়। অবশ্য সেটা দিয়ে তৈরি নানা ধরনের উপাদেয় খাবার আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে।
প্রিয় পাঠক, আমি জানি এই মুহূর্তে আপনার মস্তিষ্কে নারিকেল বিষয়ক যতো তথ্য আছে, সেগুলো এক এক করে বের হয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। না সেই কাজটা আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। কারণ এখনই লেখাটা মোড় নিবে। মানে প্রসঙ্গটা পাল্টে যাবে। পুরোটা নারিকেলের সাথে মিলে না গেলেও, পুরুষ মানুষের শরীরের সবচেয়ে উপরের যে অঙ্গ সেটা নিয়ে কিছু কথা বার্তা বলব। বুঝে ফেলেছেন নিশ্চয়ই কিসের কথা বলছি। আমি বলছি পুরুষ মানুষের চান্দির কথা। যৌবনে ভাটা পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের থাকে মাথা ভর্তি কেশ। দেখতে একেবারে সজীব, প্রাণবন্ত। বাহিরটা যেমন আকর্ষণীয়, ভিতরটাও সেরকম পোক্ত। মস্তিষ্কের উপরটা ঘন চুলে আচ্ছাদিত আর ভিতরটা নতুন কিছু করার বুদ্ধি ও সাহসে ঠাসা। কিন্তু সময়ের সাথে দুটোই কি রকম পাল্টে যেতে থাকে। ডাব হয়ে যায় নারিকেল। আর পুরুষ মানুষের মাথা? ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা খালি হতে থাকে। কারোরটা আবার হয়ে যায় একেবারে এয়ার পোর্টের রানওয়ে। সেই চকচকে মাথায় ভুল করে প্লেন নামার সম্ভাবনা থাকে। আরেকটু ভাগ্যবান যারা তাদের অবশ্য সামনের দিকে কিছু চুল অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু পিছন দিকে তৈরি হয় বড় একটা মসৃণ ময়দান। এক দল সৌন্দর্য সচেতন সুপুরুষ থকেন যারা হাল ছাড়ার বান্দা না। তারা বুদ্ধি করে সামনের দিকের অবশিষ্ট চুলগুলো লম্বা করে ছড়িয়ে দেন। ভাবটা এমন অন্যদের কাছে যেনো মনে হয় সারা মাথা চুলে ঢাকা। কি যেন কথাটা, শাক দিয়ে মাছ ডাকা না-কি কাকের গায়ে ময়ূরের পেখম দিয়ে ময়ূর বানানোর চেষ্টা!
বলুন তো দেখি, পুরুষদের এই চুল পড়ে যাওয়ার বিষয়টাকে কি বলে? কে যেনো পাশের থেকে ফিসফিস করে বলল, “কি আবার, টাক!” প্রথমে অল্প কিছু চুল ঝরা আরম্ভ করে। শেষে নায়ক বাহাদুর মানতে বাধ্য হন তিনি প্রকৃতির কাছে পরাস্ত হয়েছেন। মাথাটা ধীরে ধীরে গড়ের মাঠ মানে টাক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়ে যায়। বেশির ভাগ সুপুরুষদেরই পক্ষে টাকের অস্তিত্ব মেনে নেয়াটা খুবই কঠিন। কেউ কেউ পরচুলা মাথায় দিয়ে এই সমস্যা জনগণের থেকে লুকানোর চেষ্টা করেন। যাদের সাধ ও সাধ্য আছে তারা মরিয়া হয়ে উঠেন। মেলা টাকা ব্যয় করতে থাকেন হারানো সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্যে।
চুল ফিরে পাওয়ার আশায় শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই ২০১৮ সালে ৮৪৫২ মিলিওন ডলার খরচ হয়েছিল। বাকি দেশগুলোর খরচ যোগ করতে হলে বিখ্যাত কোনো একাউন্টটের দরকার হতে পারে। এই বিশাল চাহিদাকে পুঁজি করে প্রচুর ব্যবসায়ী নিজেদের মুনাফা বাড়িয়েই চলেছেন। নানান ধরণের তেল, শ্যাম্পু, কেমিকেল ও ওষুধ বিক্রি করছেন। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও শল্যবিদরাও পিছিয়ে থাকতে রাজী নন। তারা মস্তিষ্কের অবশিষ্ট চুল থেকে কয়েকটা উঠিয়ে বিরান ভূমিতে কৃষকদের মতো কৃত্রিমভাবে রোপণ করে আগের রূপ ফিরাতে পারেন বলে প্রচার করে থাকেন। এমেরিকার ৪৫ তম এবং কয়েক মাস আগে সিংহাসনচ্যুত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেব তার কেশ নিয়ে খুবই সচেতন। তিনি ক্যামেরার সামনে আসার আগে চুল ঠিক করে সেট করে নেন। বাতাসে চুলের উপরে যাতে বাড়তি চাপ না পড়ে, সে জন্য খোলা জায়গা আসার আগে তিনি টুপি পরে নেন। তিনি তার স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্যে আর কোনো ওষুধ সেবন করেন কি-না তা জানা না গেলেও, তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ হেরোল্ড বার্নস্টাইন জানিয়েছিলেন, ফিনেসট্রাইড (finasteride) নামের একটা ওষুধ প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রতিদিন খান। বলা হয়ে থাকে এই ওষুধ নাকি অবশিষ্ট কেশের স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত করে!
প্রকৃতির সম্পদের কোনো কমতি নাই। গাছ, পালা থেকে আরম্ভ করে বিশাল আকাশ, অপার সমুদ্র সবই তার মালিকানায়। তার পরেও তার পুরুষ মানুষের কেশের দিকে কেনো দৃষ্টি পড়ে সেটার সঠিক ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। তবে বিজ্ঞান টাকের প্রতিকার বের করতে না পারলেও বিষয়টার কিছু কারণ বের করতে পেরেছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডিহাইড্রোটেসটোরেন ( dihydrotestosterone) নামের পুরুষ হরমোন কমে যায়। ফলে পড়ে যাওয়া চুল প্রতিস্থাপনের কার্যক্রম দুর্বল হতে থাকে। কেনো এ রকম হয়। উত্তরটা বেশ জটিল। বংশানুক্রমিক জেনেটিকের স্পষ্ট প্রভাব আছে। তবে মায়ের পরিবারের দিক থেকে এটা চলে আসে বলে বিশ্বাস প্রচলিত থাকলেও সেটাকে বিজ্ঞান সমর্থন করে না। অনুসন্ধিৎসুরা ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করলেই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের আদ্যোপান্ত জেনে নিতে পারবেন। বেশ কিছু বছর আগের একটা ঘটনা বলি। বিয়ের পর স্ত্রী আবিষ্কার করলেন স্বামীর চুল দ্রুত হারে কমে চলেছে। বেচারি আতঙ্কিত হয়ে মাকে জানাল, তার পক্ষে টেকো জামাই মেনে নেওয়া অসম্ভব। ঘটনাক্রমে মা তখন চীনে ছিলেন। তিনি খোঁজ খবর নিয়ে নাম ডাকওয়ালা এক টাক বিশেষজ্ঞের কাছে হাজির হলেন। লোকজনে জানিয়েছিল, এই ডাক্তার না-কি অনেক টেকো মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে মাথায় চুল ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। স্নেহময়ী মা চিকিৎসক মহোদয়কে দেখে প্রচণ্ড হতাশ হলেন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সাহেবের মাথা ভর্তি ইয়া বড় টাক!
বলা হয়ে থাকে মাথায় টাক পড়া অর্থ, সম্পদ আর টাকা হওয়ার লক্ষণ। তবে অর্থ কি পরিমাণ বাড়ে সেটা কোথাও উল্লেখ নাই। বড় লোক, গরিব লোক, মেঝো লোক, সব ধরণের বিত্তের মানুষের মধ্যেই চকচকে মস্তিষ্ক দেখা যায়। নিঃসন্দেহে বিষয়টা বেশ গণতান্ত্রিক; যে কোনো পুরুষ মহোদয়-ই এই সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা রাখেন। তবে এতটুকু বলা হয়তো নিরাপদ, টাক যেহেতু পরিণত যৌবন কালের পরবর্তী সময়ে বেশিভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে; সেই হিসেবে টাক অর্জনকারীদের সম্পদ কিছুটা হলেও বাড়ার কথা। কিন্তু যাদের ধনদৌলতের ক্ষমতা তেমন একটা বাড়ে না, তাদেরকে কিছু সান্ত্বনার কথা শুনাই। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে চকচকে মাথার পুরুষরা বিপরীত লিঙ্গের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। কারণ হিসেবে জানা যায়, “টেকো মাথারা বিশ্বাসী হয়। তাদের লুকিয়ে রাখার কিছু নাই”। সে জন্যে পরিণত যুবকদের টাক নিয়ে হীনমন্যতা ভুগার কিছু নাই। সারা বিশ্বে প্রচুর বিখ্যাত সিনেমার নায়ক আছেন যাদের মাথার একটা বড় অংশ চকচকে পরিষ্কার। শুধু কি তাই? কেশ সংকটে আছেন কিন্তু প্রচণ্ড দাপটে দেশ শাসন করে যাচ্ছেন এমন উদাহরণও ভূরি ভূরি আছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের চুলের কি দশা সেটা আমাদের সবার-ই জানা! আবার পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ও এমাজনের মালিক জেফ বেজোসের মাথাও তো একেবারেই গড়ের মাঠ!!
বিজ্ঞাপনে বলা হয়ে থাকে 'চুল ফ্যাশনের মূল'। সেই চুলকে ঠিক করে সেট করার জন্যে যুবকেরা কতই না সময় কাটায়! নাপিতের কাছ থেকে সুন্দর করে চুল কাটিয়ে ফ্যাশন সম্মত ভাবে বিন্যাস করে নেয়। ভাবটা সারা বিশ্ব বুঝি অবাক বিস্ময়ে তাদের মস্তিষ্কের আচ্ছাদনের দিকে তাকিয়ে আছে। সময়ের বিবর্তনে সেই একই জায়গায় কেশ ঘাটতি হলে, হতাশা আসাটা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক না। কিন্তু বিজ্ঞ জনরা বলেন যা সম্বল আছে তা নিয়ে দাপটে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। শেষে এই প্রসঙ্গে আরও একটা গল্প বলি। নরসুন্দর দেখল তার খদ্দেরের মাথায় হাতে গোণা মাত্র কয়েকটা চুল অবশিষ্ট। সে কিছুটা রসিকতা করার জন্যে বলল, “আপনার কয়টা চুল আছে সেটা কি গুণে দিবো, না-কি পুরো মাথাটা ন্যাড়া করে দিবে।” রাশ ভারী ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, “চুলগুলো একটু ছোট করে কেটে কলপ দিয়ে দাও।”
উৎসর্গঃ যে সব বন্ধু চুল শুন্যতার সমস্যায় ভুগছেন, তাদের সবাইকে।