মাত্র মাস খানেক আগের কথা। তখনও এমেরিকার উপকুলে কুখ্যাত করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েনি। হাতে গোণা কয়েকটা শহরে সবে মাথাটা ঢুকিয়েছে। তবে এর মধ্যে সে চীন ও ইউরোপের কয়েকটা দেশকে বেশ ভালোভাবেই ধরাশায়ী করেছে। পৃথিবীর প্রতিটা সংবাদে করোনা নিয়ে ব্যাপক কভারেজ চলছিল। এ রকম একটা জটিল সময়ে আমি সিশনাল ফ্লুতে (ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ) একেবারে পর্যুদস্ত হয়েছিলাম। ভীষণ কষ্টকর শুকনো কাশি, জ্বর ও সারা গায়ে ব্যথা। পৃথিবীর যে কোনো সর্বোচ্চ কষ্টকর রোগের সাথে একে তুলনা করা যেতে পারে। করোনা ভাইরাসের সাথে এর অনেক সামঞ্জস্য। দুটোই একই পরিবারের ভাইরাস। উপসর্গগুলো প্রায় একই রকমের। দুটোই মরণ আঘাত হানতে সক্ষম। তারপরেও করোনা না হওয়াতে বেশ স্বস্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও সারাক্ষণ মাথার মধ্যে একই চিন্তা খেলছিল; করোনার কালো ছোবল আর কতো মারাত্মক হবে!
শুনেছি বড় বড় লেখকদের অসুস্থ অবস্থায় মস্তিষ্কের সৃজনশীল অংশটা অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠে। তখন সেখান থেকে লেখা-লেখির নানা খোরাক এমনিতেই গরগর করে বের হতে থাকে। প্রচণ্ড দুর্বলতা সত্ত্বেও আমি বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে যেয়ে বসলাম। ভাবলাম এই সুযোগে অখ্যাত লেখকের অনুর্বর মস্তিষ্ক থেকে উন্নত মানের কিছু যদি চলে আসে। অসুখ তো আর চিরকাল থাকবে না; কিন্তু কষ্ট করে কিছু একটা লিখে ফেলতে পারলে সেটা হয়তো দু একজন পাঠক ভবিষ্যতে পড়তে পারবে। কিন্তু কি অদ্ভুত; মাথায় নতুন কিছু খেলল না। একের পর এক ভাইরাস ও মহামারী নিয়ে হাজারো ভাবনা মাথায় আসতে লাগল। হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। এই অধম গায়ে জ্বর আর পুরো শরীরে ম্যাড়ম্যাড়ে ব্যথা নিয়ে সৃজনশীল কিছু করতে একেবারে ব্যর্থ হলো।
আজ ভাবলাম লেখাটা শেষ করি। আবার সে একই ব্যাপার। মাথাটা আবারও করোনা ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবতে পারছে না। তা হলে আর কি করা? বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত আর আতঙ্ক জাগানিয়া বিষয় ' করোনা ভাইরাস' নিয়ে কিছু কথা না হয় বলি। করোনা ভাইরাস এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটা দেশকে একেবারে স্থবির করে তুলেছে। প্লেন চলাচল মোটামুটি বন্ধু। বিলাস বহুল জাহাজে আনন্দ ভ্রমণ পুরোটাই নিষিদ্ধ। জন সমাবেশ করা নিষেধ। ব্যবসা, বাণিজ্য, উৎপাদন ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। অসুখটাতে ব্যাপক মানুষজনও মরছে। সারা বিশ্ব এই পর্যন্ত প্রায় চার লক্ষ্যের কাছাকাছি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। তার মধ্যে হাজার সতের মানুষের মৃত্যু-বরণ করেছে। কিন্তু এতো ক্ষমতাধর ও প্রচণ্ড ছোঁয়াচে হলেও করোনা ভাইরাসের মানুষ নিধনের আনুপাতিক পরিমাণ কিছুটা কম বলা যায়। একটা উদাহরণ দেই। সিশনাল ফ্রু’র কারণে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মৌসুমে ৩৬ মিলিওন মানুষ অসুস্থ হয়েছে এবং ২২,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সারা বিশ্বের ভুক্তভোগীর সংখ্যা যোগ করলে সংখ্যাগুলো আরও ভয়ঙ্কর দেখাবে। তা হলে আপাতত দৃষ্টিতে কম বিধ্বংসী হওয়ার পরও করোনা নিয়ে এতো আতঙ্ক কেনো? আমি নিশ্চিত আপনারা এর মধ্যে করোনা ভাইরাস নিয়ে মেলা ব্যাখ্যা শুনেছেন। এই ভাইরাস পশুদের মধ্যে বহুদিন ধরে থাকলেও; পশু থেকে মানুষ এবং পরে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের ইতিহাস নাই। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনও এই জীবাণুর ডিএনএ’র সাথে পরিচিত না। আবার একে প্রতিরোধ করার মতো কোনো ওষুধ এখনো বের হয় নি। আমাদের এই মুহূর্তে কারোরই জানা নেই করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯’ এর হানা আর কতদূর বিস্তৃত হবে এবং পরিসমাপ্তিই বা কোথায়।
কুখ্যাত করোনার শক্তিকে কুর্নিশ করার জন্য আজকে আমি লিখছি না। পুরো মানব সভ্যতা এর বিস্তার ঠেকানো ও পরাজিত করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মানুষেরা আগের সব মহামারীকে পরাজিত করেছে, এবারও অবশ্যই তা হবে। এই নিদারুণ সময়কালে সাধারণ মানুষেরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে প্রচণ্ড মানসিক চাপে ভুগছে। এদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্যে একের পর এক রসিকতা ও রঙ্গ-ব্যঙ্গ বের হয়ে চলেছে। সেখান থেকে না হয় কয়েকটা বলি। জানেত তো আমার যুদ্ধ ক্ষেত্রেও বাঁশি বাজাতে জানি, “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য”। আমার এক বন্ধু আমাকে জানাল সে ইউ টিউবে বদনার ব্যবহারের উপর একটা ভিডিও বানিয়ে আপলোড করবে। আমি জানতে চাইলাম এতো কিছু থাকতে এই বিষয়টা নিয়েই বা কেনো। সে বিজ্ঞের মতো বলল, “দেখছ না, পশ্চিমা বিশ্বে বাথরুম টিসু নিয়ে কেমন তুলকালাম কাণ্ড চলছে। ব্যাটারা বদনার ব্যবহার জানলে এই সমস্যা হতো না।” আমি মহা উৎসাহে জানালাম, “আইডিয়াটা দারুণ। ভিডিওটা হয়ে গেলে আমাকে লিঙ্ক পাঠিও।” এইবার সে আমাকে হতাশ করে বলল, “এই মহৎ কাজটার জন্য যে কোনো অভিনেতা পাচ্ছি না।” আমি তাকে সমাধান বাতলে দিলাম, “ একটা স্ট্যান্ডের ক্যামেরা বসিয়ে তুমি না হয় ভিডিও’র পুরো কাজটা একটাই সেরে ফেলো।”
আমার এক ভাগ্নি জানাল বাঙালিরা করোনার সাথে বহু আগের থেকেই পরিচিত। কারণ তারা সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছে, এটা করোনা, ওটা করোনা, বিরক্ত করোনা, শব্দ করোনা, ঝগড়া করোনা, বেয়াদবি করোনা, বেশী নাচানাচি করোনা। আরেকটা গল্প বেশ চালু হয়েছে। করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে এসে দেখল এয়ারপোর্টে আয়া শ্রেণীর কয়েকজন হাতে থার্মোমিটার নিয়ে ঝিমচ্ছে। করোনা বাধাহীনভাবে ঢাকা শহরে ঢুকে পড়ল। করোনা আগেই শুনেছে, বাঙালিরা তাদের বড় ভাই চিকনগুনিয়া, এইচআইভি সহ অন্যদেরকেও কোনো পাত্তাই দেয় নি। এখনকার মানুষেরা ফুর্তিবাজ। অন্যদের ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এদের নাই। করোনা ভাইরাস ঠেকাতে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে বলে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ সমুদ্র সৈকতে প্রমোদ করতে গিয়েছিল। আসলে যতক্ষণ নিজের বেল মাথায় নারিকেল না পড়েছে, ততক্ষণ তারা “ডোন্ট কেয়ার।” এইবার এমেরিকার একটা গল্প বলি। প্রযুক্তির বদৌলতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বামী-স্ত্রী একই ছাদের নেচে পাশাপাশি বসে কাজ করছে। একসাথে মাত্রাতিরিক্ত সময় কাঁটানোতে প্রায়ই কুরুক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই তারা একজন আরেকজন পরপারে পাঠিয়ে দিতে পারেন।
এইবার আপনাদের দুই বন্ধুর কথোপকথন শুনাই:
বন্ধু ১ঃ তুই নাকি জাহাজে চাকরি নিয়েছিস? শুনলাম তোর বাবার জাহাজে মৃত্যু হয়েছিল।
বন্ধু ২ঃ ঠিকই শুনেছিস। শুধু বাবা না, আমার দাদা এবং তার বাবাও জাহাজে কর্মরত অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন।
বন্ধু ১ঃ এত কিছুর পরেও তুই জাহাজে চাকরি করবি। তোর ভয় লাগে না?
বন্ধু ২ঃ তোর প্রশ্নের উত্তরটা পরে দিচ্ছি। এখন বল, তোর বাবা, দাদা ও তার বাবার মৃত্যু কোথায় হয়েছিল?
বন্ধু ১ঃ বাসায়।
বন্ধু ২ঃ তা হলে তোর বাসায় থাকতে ভয় করে না? তোর পূর্ব-পুরুষদের সবার তো দেখি একই জায়গাতেই মৃত্যু হয়েছিল!!
আমরা সবাই জানি মৃত্যু উপরওয়ালার নির্ধারিত স্থান ও সময়েই হবে। সেটা নিরাপদ কিংবা বিপদজনক পরিস্থিতির যে কোনোটাই হতে পারে। ইংরেজ নাট্যকার সেক্সপিয়ার থেকে ধার নিয়ে বলি, “Cowards die many times before their deaths; The valiant never taste of death but once” আমার ঠিক জানা নাই নিজেকে কেউ ভীতু ভাবতে রাজী আছেন কি-না। আতঙ্কিত হলে কিন্তু নিজেকে ভীতু বানিয়ে ফেলা হয়। তবে অবশ্যই খুবই গুরুত্বের সাথে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজটা করাটাই আসল সাহসের পরিচয়। সাধারণ মানুষের ঘরে থেকে সামাজিক দূরত্ব (Social Distancing) বজায় রেখে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার নিয়ম কানুন মানার কোনো বিকল্প নাই। সারা বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা দিন-রাত কাজ করে চলেছেন একটা প্রতিকার করার জন্য। তাদেরকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে মহতী কাজটা শেষ করার সুযোগটা দিতে হবে। শেষে কথাটা আবার বলি, আতঙ্কিত হয়ে আসল মৃত্যুর আগে মারা যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আর যদি বিপদ এসেই যায়, তবে লড়ার শক্তিটা যাতে আমাদের থাকে। সেটা একমাত্র মনের দৃঢ়তা থাকলেই সম্ভব।
মার্চ ২৩, ২০২০